ধ্রুপদি গল্প || ইঁদুর || সোমেন চন্দ
|| প্রাসঙ্গিক কথা ||
সোমেন চন্দ [২৪ মে ১৯২০—৮ মার্চ ১৯৪২] একজন মার্কসবাদী সাহিত্যিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ছিলেন। জন্ম অবিভক্ত ভারতের পুরাতন নারায়ণগঞ্জে, বর্তমান নরসিংদীর জেলার বালিয়া গ্রামে। ১৯৩৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তীর্ণ হন তিনি। ভর্তি হন ঢাকা মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে পড়ালেখা এগোয়নি বেশি। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম গণসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। ১৯৪১ সালে সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রচণ্ড মেধাবী সোমেন চন্দের লেখা প্রগতি লেখক সংঘের সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক সভায় পাঠ করা হতো। মাত্র ১৭ বছর বয়েসে লিখেছেন উপন্যাস ‘বন্যা’। ১৯৪০ সালে তার ‘বনস্পতি’ গল্পটি ‘ক্রান্তি’ পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৭৩ সালে বামপন্থি লেখক ও সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত তার গল্পের একটি সংকলন সম্পাদনা করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ তিনি ঢাকায় আততায়ীর হামলায় নিহত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র বাইশ বছর। সোমেন চন্দের মৃত্যু সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজীবী, লেখক প্রভৃতি শহরে এক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন আহবান করেন। …সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আততায়ীর হাতে নিহত হন। তিনিই বাংলার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পরও যথারীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।’ [কিছু স্মৃতি কিছু কথা: পৃ-৯৩]। ‘ইঁদুর’ গল্পটি সোমেন চন্দকে কিংবদন্তি করে তোলে। প্রকাশের পর গল্পটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। বাংলা গল্পে সোমেন চন্দের প্রভাব অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদও ‘ইঁদুর’ গল্পের প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। প্রতিধ্বনি তার ‘ইঁদুর’ গল্পটি ধ্রুপদি বিভাগে উপস্থাপন করছে। কারণ বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় গল্পটি আবেদন ফুরায়নি। বরং নানা প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বটে।
ধ্রুপদি গল্প || ইঁদুর || সোমেন চন্দ
আমাদের বাসায় ইঁদুর এত বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। তাদের সাহস দেখে অবাক হতে হয়। চোখের সামনেই, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলের সুচতুর পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়ার মতো ওরা ঘুরে বেড়ায়, দেয়াল আর মেঝের কোণ বেয়ে-বেয়ে তরতর করে ছুটোছুটি করে। যখন সেই নির্দিষ্ট পথে আকস্মিক কোনো বিপদ এসে হাজির হয়, অর্থাৎ কোনো বাক্স বা কোনো ভারী জিনিসপত্র সেখানে পথ আগলে বসে, তখন সেটা অনায়াসে টুক করে বেয়ে তারা চলে যায়। কিন্তু রাত্রে আরও ভয়ংকর। এই বিশেষ সময়টাতে তাদের কার্যকলাপ আমাদের চোখের সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শুরু হয়ে যায়। ঘরের যে কয়েকখানা ভাঙা কেরোসিন কাঠের বাক্স কেরোসিনের অনেক পুরোনো টিন, কয়েকটা ভাঙা সিঁড়ি আর কিছু মাটির জিনিসপত্র আছে, সেখান থেকে অনবরতই খুটখুট টুং টাং ইত্যাদি নানা রকমের শব্দ কানে আসতে থাকে। তখন এটা অনুমান করে নিতে আর বাকি থাকে না যে, এক ঝাঁক নজদেহ অপদার্থ জীব ওই কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপর এখন রাতের আসর খুলে বসেছে।
যাই হোক, ওদের তাড়নায় আমি উত্যক্ত হয়েছি, আমার চোখ কপালে উঠেছে। ভাবছি ওদের আক্রমণ করবার এমন কিছু অস্ত্র থাকলেও সেটা এখনও কেন যথাস্থানে প্রয়োগ করা হচ্ছে না? একটা ইঁদুর মারা কলও কেনার পয়সা নেই। আমি আশ্চর্য হব না, নাও থাকতে পারে। আমার মা কিন্তু ইঁদুরকে বড়ো ভয় করেন। দেখেছি একটা ইঁদুরের বাচ্চাও তাঁর কাছে একটা ভালুকের সমান। পায়ের কাছ দিয়ে গেলে তিনি চার হাত দূর দিয়ে সরে যান। ইঁদুরের গন্ধ পেলে তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন, ওদের যেমনি ভয় করেন, তেমনি ঘৃণাও করেন। এমন অনেকের থাকে। আমি এমন একজনকে জানি যাঁর একটা মাকড়সা দেখলেই ভয়ের আর অন্ত থাকে না। আমি নিজেও জোঁক দেখলে দারুণ ভয় পাই। ছোটোবেলায় আমি যখন গোরুর মতো শান্ত এবং অবুঝ ছিলাম, তখন প্রায়ই মামা বাড়ি যেতুম বিশেষত গভীর বর্ষার দিকটায়। তখন সমুদ্রের মতো বিস্তৃত বিলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে বর্ষার জলের গন্ধে আমার বুক ভরে এসেছে, ছই-এর বাইরে এসে জলের সীমাহীন বিস্তার দেখে আমি অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছি, শাপলা ফুল হাতের কাছে পেলে নির্মমভাবে টেনে তুলেছি, কখনো উপুড় হয়ে হাত ডুবিয়ে দিয়েছি জলে, কিন্তু তখনি আবার কেবলি মনে হয়েছে, এই বুঝি কামড়ে দিল!—আর ভয়ে-ভয়ে অমনি হাত তুলে নিয়েছি। সেখানে গিয়ে যাদের সঙ্গে আমি মিশেছি, তারা আমার স্বশ্রেণির নয় বলে আপত্তি করবার কোনো কারণ ছিল না, অন্তত সেরকম আপত্তি, আশঙ্কা বা প্রশ্ন আমার মনে কখনো জাগেনি।
সেই ছেলেবেলার বন্ধুরা মাঠে গোরু চরাত। তাদের মাথার চুলগুলি জলজ ঘাসের মতো দীর্ঘ এবং লালচে, গায়ের রং বাদামি, চোখের রংও তাই, পাগুলি অস্বাভাবিক সরু-সরু, মাঝখান দিয়ে ধনুকের মতো বাঁকা, পরনে একখানা গামছা, হাতে একটা বাঁশের লাঠি, আঙুলগুলি লাঠির ঘর্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। তাদের মুখ এমন খারাপ, আর ব্যবহার এমন অশ্লীল ছিল যে আমার ভিতর যে সুপ্ত যৌনবোধ ছিল, তা অনেক সময় উত্তেজিত হয়ে উঠত, অথচ আমি আমার স্বশ্রেণির সংস্কারে তা মুখে প্রকাশ করতে পারতাম না। তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। আমার মুখ লাল হয়ে যেত। তাদের মধ্যে একজন ছিল যার নাম ভীম। সে একদিন খোলা মাঠের নতুন জল থেকে একটি প্রকান্ড জোঁক তুলে সেটা হাতে করে আমার দিকে চেয়ে হাসতে-হাসতে বললে, সুকু, তোমার গায়ে ছুঁড়ে মারব?
আমি ওর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম, ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল, আস্তে আস্তে বুদ্ধিমানের মতো দূরে সরে গিয়ে বললাম, দ্যাখ ভীম, ভালো হবে বলছি, ভালো হবে না। ইয়ার্কি, না?
ভীম হি-হি করে বোকার মতো হাসতে হাসতে বললে, এই দিলাম দিলাম—
সেদিনের কথা আজো মনে পড়ে, ভীমের সাহসের কথা ভাবতে আজও অবাক লাগে। অনেকের এমন স্বভাব তাকে—যেমন অনেকে কেঁচো দেখলেও ভয় পায়। আমি কেঁচো দেখলে ভয় পাইনে বটে, কিন্তু জোঁক দেখলে ভয়ে শিউরে উঠি। এসব ছোটোখাটো ভয়ের মূলে বুর্জোয়া রীতিনীতির কোনো প্রভাব আছে কি না বলতে পারিনে।
একথা আগেই বলেছি যে আমার মা-ও ইঁদুর দেখলে দারুণ ভীত হয়ে পড়েন, তখন তাঁকে সামলানো দায় হয়ে ওঠে। ইঁদুর যে কাপড় কাটবে সেদিকে নজর না দিয়ে তখন তাঁর দিকেই নজর দিতে হয় বেশি। একবার তাঁর একটা কাপড়ের নীচে কেমন করে জানিনে একটা ইঁদুর আটকে গিয়েছিল। সে থেকে থেকে কেবল পালাবার চেষ্টা করছিল, ছড়ানো কাপড়ের ওপর দিয়ে সেই প্রয়াস স্পষ্ট চোখে পড়ে। মা পাঁচ হাত দূরে সরে গিয়ে ভাঙা গলায় চীৎকার করে বললেন,
—সুকু, সুকু।
প্রথম ডাকে উত্তর না দেওয়া আমার একটা অভ্যাস। তাই উত্তর দিয়েছি এই ভেবে চুপ করে রইলাম।
—সুকু? সুকু?
এবার উত্তর দিলাম, কেন?
মা তাঁর হলুদ-বাটায় রঙিন শীর্ণ হাতখানা ছড়ানো কাপড়ের দিকে ধরে চোখ বড়ো করে বললেন,
—ওই দ্যাখ!
আমি বিরক্ত হলাম। ইঁদুরের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে আর কী! এত ইঁদুর কেন? পরম শত্ৰু কী কেবল আমরাই। আমি কাপড়টা সরাতে অমনি মা চেঁচিয়ে উঠলেন, আহা, ধরিসনে, ওটা ধরিসনে।
—খেয়ে ফেলবে না তো!
—আহা,বাহাদুরি দেখানো চাই-ই।
—মা, তুমি যা ভীতু।–ইঁদুরটা অনবরত পালাবার চেষ্টা করছিল, বললাম, আচ্ছা মা, বাবাকে একটা কল আনতে বলতে পারো না? কোনোদিন দেখবে আমাদের পর্যন্ত কাটতে শুরু করে দিয়েছে।
—আহা, মেরে কী হবে? অবোধ প্রাণী কথা বলতে পারে না তো। আর কল আনতে পয়সাই বা পাবেন কোথায়? মা-র গলার স্বর এমনি অকাতর থাকে এবং অত্যন্ত সংক্ষেপে শেষ হয়ে যায়। শেষ হওয়ার পর আর এক মিনিটও তিনি সেখানে থাকেন না। তিনি অমনি চলে গেলেন।
একটা ইঁদুর মারা কল কিনতে পয়সা লাগবে, এটা আমার আগে মনে ছিল না। তাহলে আমি বলতাম না। কারণ এই ধরনের কথায় এমন একটা বিশেষ অবস্থার ছবি মনে জাগে যা কেবল একটা সীমাহীন মরুভূমির মতো। মরুভূমিতেও অনেক সময় জল মেলে, কিন্তু এ-মরুভূমিতে জল মিলবে, এমন আশাও করিনে। এই মরুভূমির ইতিহাস আমার অজানা নয়। আমার পায়ের নীচে যে বালি চাপা পড়েছে, যে বালুকণা আশে পাশে ছড়িয়ে আছে, তার ফিসফিস করে সেই ইতিহাস বলে। আমি মন দিয়ে শুনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আঠারো বছর বয়েস অবধি এগিয়ে আবোল-তাবোল অনেক ভেবেছি, কিন্তু আবোল-তাবোল ভাবনা মস্তিষ্কের হাটে কখনো বিক্রি হয় না। ঈশ্বরের প্রতি সন্দেহ এবং বিশ্বাস দুই-ই প্রচুর ছিল, তাই ঈশ্বরকে কৃষ্ণ বলে নামকরণ করে ডেকেছি, হে কৃষ্ণ, এ পৃথিবীর সবাইকে যাতে একেবারে বড়ো—লোক করে দিতে পারি তেমন বর আমাকে দাও। রবীন্দ্রনাথের পরশমণি কবিতা পড়ে ভেবেছি, ইস, একটা পরশমণি যদি পেতাম। সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোককে সত্যই জিজ্ঞেস করে বসেছি, আচ্ছা, পরশমণি পাথর আজকালও লোকে পায়? কোথায় পাওয়া যায় বলবে?
আমি যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের বৃহৎ পরিবারের লোকগুলির নির্মল দেহে তখনও অর্থহীনতার ছায়াটুকু পড়েনি। বুর্জোয়ারাজের ভাঙনের দিন তখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যায়নি। শুরু না হওয়ার আমি এই মানে করেছি যে, তখনও অনেক জনকের প্রসারিত মনের আকাশে তার ছেলের ভবিষ্যৎ স্মরণ করে গভীর সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। আমাকে আশ্রয় করেই কম আশা জন্ম নিয়েছিল। অথচ সে সব আশার শাখা-প্রশাখা এখন কোথায়। আমি বলতে দ্বিধা করব না, সে সব শাখা-প্রশাখা তো ছড়ায়ইনি, বরং মাটির গর্ভে স্থান নিয়েছে। একটা সুবিধা হয়েছে এই যে, পারিবারিক স্বেচ্ছাচারিতার অক্টোপাস থেকে রেহাই পাওয়া গেছে, আমি একটু নিরিবিলি থাকতে পেরেছি।
কিন্তু নিরিবিলি থাকতে চাইলেই কী আর থাকা যায়। ইঁদুররা আমায় পাগল করে তুলবে না। আমি রোজ দেখতে পাই একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স বা ভাঙা টিনের ভিতর ঢুকে ওরা অনবরত টুং টাং শব্দ করতে থাকে, ক্ষীণ হলেও অবিরত এমন আওয়াজ করতে থাকে যে অনতিকাল পরেই সেটা একটা বিশ্রী সঙ্গীতের আকার ধারণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে শুধু আমার কেন অনেকেরই বিষম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটা কুকুর যখন কঁকিয়ে কঁকিয়ে আস্তে আস্তে কাঁদতে থাকে, তখন সেটা কেউ সহ্য করতে পারে? আমি অন্তত করিনে। অমন হয়। যখন একটা বিশ্রী শব্দ ধীরে ধীরে একটা বিশ্রী সঙ্গীতের আকার ধারণ করে তখন সেটা অসহ্য না হয়ে যায় না। ইঁদুরগুলির কার্যকলাপও আমার কাছে সেরকম একটা বিরক্তিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আর একদিন মা চীৎকার করে ডেকে উঠলেন, —সুকু! সুকু!
বলেছি তো প্রথম ডাকেই উত্তর দেওয়ার মতো কঠিন তৎপরতা আমার নেই।
মা আবার আর্তস্বরে ডাকলেন, সুকু?
আর তৃতীয় ডাকের অপেক্ষা না করে নিজেকে মার কাছে যথারীতি স্থাপন করে তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে যা দেখলুম তাতে যদিও চিন্তিত হবার কারণ থাকে তবু চিন্তিত হলাম না। দেখলাম, আমাদের কচিৎ আনা দুধের ভাঁড়টি একপাশে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে আছে আর তারই পাশ দিয়ে একটি সাদাপথ তৈরি করে এক প্রকাণ্ড ইঁদুর দ্রুত চলে গেল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, কোনো বিশেষ খবর শুনে কোনো উত্তেজনা ভাবান্তর প্রকাশ করা আমার স্বভাবে নেই বলেই বার বার প্রমাণিত হয়ে গেছে। কাজেই এখানেও তার অন্যথা হবে না, একথা বলা বাহুল্য। দেখতে পেলাম, আমার মা-র পাতলা কোমল মুখখানি কেমন এক গভীর শোকে পার হয়ে গেছে, চোখ দুটি গোরুর চোখের মতো করুণ, আর যেন পদ্মপত্রে কয়েক ফোঁটা জল টল টল করছে, এখুনি কেঁদে ফেলবেন।
দুধ যদি বিশেষ একটা খাদ্য হয়ে থাকে এবং তা যদি নিজেদের আর্থিক কারণে কখনো দুর্লভ হয়ে দাঁড়ায় এবং সেটা যদি অকস্মাৎ কোনো কারণে পাকস্থলীতে প্রেরণ করার অযোগ্য হয়, তবে অকস্মাৎ কেঁদে ফেলা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মা অমনি কেঁদে ফেললেন, আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম. এমন একটা অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই। যার ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর বিনিয়ে বিনিয়ে কথা আমার চোখের দৃষ্টিপথকে অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিল, আরও গভীর করে দিল, আরও গভীর করে তুলল। আমি দেখতে পেলাম আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য প্রচুর অগ্নিবর্ষণ করছে, নীচে পৃথিবীর ধূলিকণা আরও বেশি অগ্নিবর্ষী। আর হৃদয়ের খেতও পুড়ে পুড়ে থাক খাক হয়ে গেল। একটি নীল উপত্যকাও দেখা যায় না, দূরে জলের চিহ্ন মাত্র নেই, মরীচিকাও দিয়েছে ফাঁকি। ভাবলাম স্বামী বিবেকানন্দের অমূল্য গ্রন্থরাজি কোথায় পাওয়া যায়? শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলি অমূল্য। সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণব্রতী শ্ৰীঅরবিন্দ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ (তখনও ভাবতাম না দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কখন শুরু হবে)! আমার মুখভঙ্গি চিন্তাকুল হয়ে এল, হাঁটু দুটি পেটের কাছ এনে কুকুরের মতো শুয়ে আমি ভাবতে লাগলাম—ঘরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে নিয়েছি ভালো করে ভাবার জন্যে—ভাবতে লাগলাম, এমন কোনো উপায় নেই যাতে এই বিকৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
সন্ধ্যার পর বাবা এলেন, খবরটা শুনে এমন ভাব দেখালেন না যাতে মনে হয় তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন অথবা কিছুমাত্র দুঃখিত হয়েছেন, বরং তাড়াতাড়ি বলতে আরম্ভ করলেন—যদিও তাড়াতাড়ি কথা বলাটা তাঁর অভ্যাস নয়, বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে। আমি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম এমন একটা কিছু হবে। আরে মানুষের জান নিয়েই টানাটানি দুধ খেয়ে আর কী হবে বলো!
দেখতে পেলাম বাবার মুখটি যদিও শুকনো তবু প্রচুর ঘামে তৈলাক্ত দেখাচ্ছে, গায়ের ভারী জামাটিও ঘামে ভিজে ঘরের ভিতর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। এমন একটা বিপর্যয়ের পরেও তাঁর এই অবিকৃত ভাব দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। এই ভেবে যে, ক্ষতি যা হয়েছে, হয়েছেই তার আলোচনায় এমন একটা অবস্থা যার কোনো পরিবর্তন নেই বরং একটা মস্ত গোলযোগের সূত্রপাত হবে, তা থেকে রেহাই পাওয়া গেল, খুব শীগগির আর আমার মানসিক অবনতি ঘটবে না।
কিন্তু বাবা কিছুক্ষণ পরেই সুর বদলালেন: তোমরা পেলে কী? কেবল ফুর্তি আর ফুর্তি! দয়া করে আমার দিকে একুট চাও। আমার শরীরটা কী আমি পাথর দিয়ে তৈরি করেছি। আমি কী মানুষ নই? আমি এত খেটে মরি আর তোমরা ওদিকে ফুর্তিতে মেতে আছ। সংসারের দিকে একবার চোখ খুলে চাও? নইলে টিকে থাকাই দায় হবে!
আমার কাছে বাবার এই ধরনের কথা মারাত্মক মনে হয়। তাঁর এই ধরনের কথার পেছনে অনেক রাগ ও অসহিষ্ণুতা সঞ্চিত হয়ে আছে বলে আমি মনে করি।
সময়ের পদক্ষেপের সঙ্গে স্বরের উত্তাপও বেড়ে যেতে লাগল। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই কঠিন উত্তপ্ত আবহাওয়ায় যে অদ্ভূত নগ্নতা প্রকাশ পাবে, তাতে আমার লজ্জার আর সীমা-পরিসীমা থাকবে না। এমন অবস্থার সঙ্গে আমার একাধিকার পরিচয় হলেও আমার গায়ের চামড়া তাতে পুরু হয়ে যায়নি, বরং আশঙ্কার কারণ আরও যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। যে পৃথিবীর সঙ্গে আমার পরিচয় তার ব্যর্থতার মাঝখানে এই নগ্নতার দৃশ্য আরও একটি বেদনার কারণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বাবা বললেন, আর তর্ক কোরোনা বলছি। এখান থেকে যাও, আমার সুমুখ থেকে যাও, দূর হয়ে যাও বলছি।
মা বললেন, অত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। চেঁচামিচি করে পৃথিবী সুষ্ঠু লোককে নিজের গুণপনার কথা জানানো হচ্ছে, খুব সুখ্যাতি হবে।
শুনতে পেলাম, এরপরে বাবার গলার স্বর রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে বোমার মতো ফেটে পড়ল!
—তুমি যাবে? এখান থেকে যাবে কি না বল? গেলি তুই আমার চোখের সামনে থেকে? শয়তান মাগী.বাবা বিড়বিড় করে আরও কত কী বললেন, আমি কানে আঙুল দিলাম, বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম একটি অসাড় মৃতদেহ হয়ে, আমার চোখ ফেটে জল বেরোলো বিপর্যয়ের পথে বর্ধিত হলেও আমার মনের শিশুটি আজন্ম যে শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছে তাতে এমন কোনো কথা লেখা ছিল না। মনে হল যেন আজ এই প্রথম বিপর্যয়ের মুহূর্তগুলি চরম প্রহরী সেজে আমার দোর গোড়ায় কড়া নাড়ছে। আগে এমন দেখিনি বা শুনিনি তবু আমার এই অনুভূতির শিক্ষা কোথেকে এল? বলতে পারি আমার এই শিক্ষা অতি চুপি চুপি জন্মলাভ করেছে, মাটির পৃথিবী থেকে সে এমন ভাবে শ্বাস ও রস গ্রহণ করেছে যাতে টুঁ শব্দ হয়নি। ফুলের সুবাস যেমন নিঃশব্দে পাখা ছড়িয়ে থাকে তেমনি ওর চোখের পাখা দুটিও নিঃশব্দে এই অদ্ভুত খেলার আয়োজন করতে ছাড়েনি। আরও বলতে পারি আমার মনের শিশুর বাঁচবার বা বড়ো হবার ইতিহাস যদি জানতে হয় তবে ফুলের তুলনা করা চলে। কিন্তু সেই শিক্ষা আজ কাজ দিল কই? বরং আরও কর্মহীনতার নামান্তর হল, আমার কাঁচা শরীরের হাত দুটি কেটে ভাসিয়ে দিল জলে, দুই চোখকে বাষ্পকুল করে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ করে দিল। আমি কী করব? আমার কিছু করবার আছে কী?
—শয়তান মাগি, বেরিয়ে যা!
আবার ভেসে এল অদ্ভুত কথাগুলি। এসব আমি শুনতে চাইনে তবু শুনতে হয়। বাতাসের সঙ্গে খাতির করে তা ভেসে আসবে, জোর করে কানের ভিতর ঢুকবে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার মনের মাটিতে সজোরে লাথি মারবে।
—যা বলছি!
গোলমাল আরও খানিকটা বেড়ে গেল।
কিছুপরে মা বাষ্পচ্ছন্ন স্বরে ডাকলেন, সুকু! সুকু!
ঠিক তখুনি উত্তর দিতে লজ্জা হল, ভয় করল, তবু আস্তে বললাম, বলো।
মা বললেন, দরজা খোল।
ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিলাম, ভয় হল এই ভেবে যে, এবার অনেক বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, যা শুনতেও ভয় পাই ঠিক তারই সামনে এক বিচারপতি হয়ে সমস্ত উত্তেজনাকে শূন্যে বিসর্জন দিয়ে রায় দিতে হবে।
কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা আর হল না। মা ঘরের ভিতর ঢুকেই ঠান্ডা মেঝের ওপর আঁচলখানা পেতে শুয়ে পড়লেন। পাতলা পরিচ্ছন্ন শরীরখানি বেঁকে একখানা কাস্তের আকার ধারণ করল। কেমন অসহায় দেখাল ওঁকে, ছোটো বেলায় যাঁকে পৃথিবীর মতো বিশাল ভেবেছি, তাঁকে এমনভাবে দেখে এখন কত ক্ষীণজীবী ও অসহায় মনে হচ্ছে। যাকে বৃহত্তম ভেবেছি, সে এখন কত ক্ষুদ্র, সে এখনও শৈশব অতিক্রম করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে। আর আমি কতো বৃহৎ, রক্তের চঞ্চলতায়, মাংসপেশির দৃঢ়তায়, বিশ্বস্ত পদক্ষেপ কত উজ্জ্বল ও মহৎ, ওই হরিণের মতো ভীরু ছোটো দেহের রক্তপান করে একদিন জীবন গ্রহণ করলেও আজ আমি কতো শক্তিমান! আমাকে কেউ জানে? এমনও তো হতে পারত, আজ লন্ডনের কোনো ইতিহাস বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির করিডোরের বুকে বিশ বছরের যুবক সুকুমার গভীর চিন্তায় পায়চারি করছে, অথবা খেলার মাঠে প্রচুর নাম করে সকল সহপাঠিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, অথবা ত্রিশ বছরের নীলনয়না কোনো খাঁটি ইংরেজ মহিলার ধীর গভীর পদক্ষেপে ভীরুর মতো অনুসরণ করে একদিন তাঁর দেহের ছায়ায় বসে প্রেম যাঞ্চা করছে। এমন তো হতে পারত, তার সোনালি চুল, দীর্ঘ পক্ষ্মাবৃত চোখ দেহের সৌরভ—আহা, কে সেই ইংরেজ মহিলা? সে এখন কই… আর সেই স্বর্ণাভ রাজকুমার সুকুমারের মা ওই ঠান্ডা মেঝের ওপর কাপড় বিছিয়ে শুয়ে? এখান থেকে কতো ছোটো আর কতো অসহায় মনে হয়! এক অর্থহীন গর্বে বুকটা প্রশস্ততর করে আমি একবার মার দিকে তাকালাম।
ডাকলাম, মা? ও মা?
কোনো উত্তর নেই। গভীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কোনো ভগ্ন নারীকণ্ঠ আমার কানের দরজায় এসে আঘাত করল না। ঘুমিয়ে পড়েননি তো?
পরদিনও আবহাওয়ার গভীরতা কিছুমাত্র দূর হল না। মা-র এমন অস্বাভাবিক নীরবতা দেখে আমার ছোটো ভাই বোনেরা প্রচুর আস্কারা পেয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি। তারা নগ্ন গাত্র হয়ে যথেচ্ছ বিচরণ করতে লাগল। স্কুলহীন ছোটো বোনটি তার নিত্যকার অভ্যাসমত প্রেমকুসুমাস্তীর্ণ এক প্রকাণ্ড উপন্যাস নিয়ে বসেছে, অন্যদিকে চাইবারও সময় নেই।
সেদিন অনেক রাতে সারা বাড়ি গভীর ধোঁয়ায় ভেসে গেল, সকলের নাক-মুখ দিয়ে জল বেরুতে লাগলো, দম বন্ধ হয়ে এল। ছোটো ভাই বোনেদের খালি মাটিতে পড়ে ঘুমুতে দেখে রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখনও রান্না হয়নি, মা?
চোখের জলে ভিজে উনানের ভিতর প্রাণপণে ফু দিতে দিতে মা বললেন, না। এখন চড়াচ্ছি।
—এত দেরি হল কেন?
মা চুপ করে রইলেন।
বুঝতে পারলাম সেই পুরোনো কাসুন্দি। বুঝতে পারলাম এ জিনিস সহজে এড়াতে চাইলেও সহজে এড়াবার নয়, ঘুরে ফিরে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় পাশ কাটাতে চাইলে হাত চেপে ধরে, কোনো রকমে এড়িয়ে গেলেও হাত তুলে ডাকতে থাকে। এই ডাকাডাকির ইতিহাসকে যদি আগাগোড়া লিপিবদ্ধ করি তবে সারাজীবন লিখেও শেষ করতে পারব না, তাতে কতগুলি একই রকমের চিত্র গলাগলি করে পাশাপাশি এসে দাঁড়াবে, আর সৌখিন পাঠকের বিরক্তিভাজন হবে। আমি তো জানি পাঠকশ্রেণিকে? তাঁদের মনোরঞ্জন করতে হলে কান্নাকাটির ন্যাকামি চলবে না, কিংবা কিছু লিখলেও টাকার হিসাবটাকে সযত্নে এড়িয়ে দিতে হবে বা হাসিমুখে বরণ করতে হবে। যেমন আমার বাবা অনেক সময় করেন প্রচুর অভাবের চিত্রকেও এক দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে পরম আনন্দে ঘাড় বেঁকিয়ে হাসতে থাকেন। কিংবা যেমন আমাদের পাড়ার প্রকাণ্ড গোঁফওয়ালা রক্ষিত মশায় করেন—ঘরে অতি শুকনো স্ত্রী আর একপাল ছেলেমেয়েদের অভুক্ত রেখেও পথে ঘাটে রাজা-উজির মেরে আসেন। বা যেমন আমাদের প্রেস কর্মচারী মদন, শূন্যতার দিনটাকে উপবাসের তিথি বলে গণ্য করে, কখনো পদ্মাসন করে বসে নির্মীলিত চোখে দুই শক্ত দীর্ঘ বাহু দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ঈশ্বরকে সশরীরে ডেকে আনে। এমন নয়। এ ছাড়া আর উপায় কী? স্বর্গের পথ রুদ্ধ হলে মধ্যপথে এসে দাঁড়াই, জীবন আমাদের কুক্ষিগত করলেও জীবনকে প্রচুর অবহেলা করি, প্রকৃতির করাঘাতে ডাক্তারের বদনাম পাই, অথবা উধ্ববাহু সন্ন্যাসী হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করি। এসব দেখে আমি একদিন সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে, দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তের নাম করতে গিয়ে যাদের জিহ্বায় জল আসে সেদিন আমি তাদেরই একজন হয়েছিলাম। বন্ধুকে এক ধোঁয়াটে রহস্যময় ভাষায় চিঠি লিখলাম। এরা কে জানো? এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু না খেয়ে মরে। যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে, এরা তাই। এরা তৈরি করছে বাগান, অথচ ফুলের শোভা দেখেনি! পেটের ভিতর উঁচ বিধছে প্রচুর, কিন্তু ভিক্ষা পাত্রও নয়। পরিহাস! পরিহাস!
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার অজ্ঞতায় নিজের মনে যে কল্পনায় সৌধ গড়ে তুললাম তাতে নিজের মনে মনে প্রচুর পরিতৃপ্ত হলাম। যে উপবাসকৃশ বিধবারা তাদের সক্ষম মেয়েদের দৈহিক প্রতিষ্ঠায় সংসার যাত্রার পথ বেয়ে বেয়ে কোনোরকমে কালাতিপাত করছেন, তাদের জন্য করুণা যেমন হল, মনে মনে পুজো করতে লাগলাম আরও বেশি। কিন্তু সেসব ক্ষণিকের ব্যাপার! শরতের মেঘের মতো যেমনি এসেছিল তেমনি মিশে গেল। মগজের মধ্যে জায়গা যদিও একটু পেয়েছিল, বেশি দিন থাকবার ঠাঁই হল না। আজ ভাবছি আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। নইলে এক অসম্পূর্ণ সংকীর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় হয়ে থাকত, সে ভাবনা নিয়ে মনে মনে পরিতৃপ্ত থাকতাম বটে, কিন্তু গতির বিরুদ্ধে চলতাম। এক ভীষণ প্রতিক্রিয়ার বিষে জর্জরিত হতাম।
এমন দিনে এক অলস মধ্যাহ্নের সঙ্গে আমি সাংঘাতিক প্রেমে পড়েছিলাম। সেই দুপুরটিকে যা ভালো লেগেছিল কেবল মুখে বললে তা যথেষ্ট বলা হবে না। সেদিন যতটুকু আকাশকে দেখতে পেলাম তার নীলকে এত গভীর মনে হল যে চোখের ওপর কে যেন কিছু শীতল জলের প্রলেপ দিয়ে দিল। ভাবনার রাজ্যে পায়চারি করে আমি আমার মীমাংসার সীমান্তে এসে পৌঁছোলাম সেই মধ্যাহ্নে, সেখানে রাখলাম দৃঢ় প্রত্যয়। আকাশের নীলিমায় দুই চোখকে সিক্ত করে আমি দেখতে পেলাম চওড়া রাস্তার পাশে সারি-সারি প্রকাণ্ড দালান, তার প্রতিকক্ষে সুস্থ সবল মানুষের পদক্ষেপ। সিঁড়িতে নানারকম জুতোর আওয়াজ, মেয়ে পুরুষের মিলিত চীৎকার ধ্বনি পৃথিবীর পথে পথে বলিষ্ঠ দুয়ারে হানা দেয়, বলিষ্ঠ মানুষ প্রসব করে আমি দেখতে পেলাম ইলেকট্রিক আর টেলিগ্রাফ তারের অরণ্য, ট্রাকটর চলেছে মাঠের পর মাঠ পার হয়ে—অবাধ্য জমিকে ভেঙে চুরে দলে মুচড়ে, সোনার ফসল আনন্দের গান গায়, আর যন্ত্রের ঘর্ষণে ও মানুষের হর্ষধ্বনিতে এক অপূর্ব সংগীতের সৃষ্ট হল। একদা যে বাতাস মাটির মানুষের প্রতি উপহাস করে বিপুল অট্টহাসি হেসেছে, সেই বাতাসের হাত আজ করতালি দেয় গাছের পাতায় পাতায়। কেউ শুনতে পায়?
যারা শোনে তাদের নমস্কার। তাই অলস মধ্যাহ্নকে মধুরতর মনে হল। দেখলাম এক নগ্নদেহ বালক রাস্তার মাঝখানে বসে একটা ইটের টুকরো নিয়ে গভীর মনোযোগে আঁক কষছে। কোন বাড়ি থেকে পচা মাছের রান্নার গন্ধ বেরিয়ছে বেশ, সঙ্গীত—পিপাসুর বেসুরো গলায় গান শোনা যাচ্ছে হারমোনিয়াম সহযোগে এই অসময়ে, রৌদ্র প্রচণ্ড হলেও হাওয়া দিচ্ছে প্রচুর, ও বাড়ির এক বন্ধু রাস্তার কলে এইমাত্র স্নান করে নিজ বুকের তীক্ষ্ণতাকে প্রদর্শনের প্রচুর অবকাশ দিয়ে সংকুচিত দেহে বাড়ির ভিতর ঢুকল, দুটি মজুর কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া সেরে কয়লামলিন বেশে আবার দৌড় দিচ্ছে। এ দৃশ্য বড়ো মধুর লেগেছে অবশ্য কোনো বুর্জোয়া চিত্রকল্পের চিরন্তনী চিত্র বলে নয়। এ চিত্র যেমন আরাম দেয়, তেমনি পীড়াও দেয়। আমার ভালো লেগেছে এই স্মরণীয় দিনটিতে এক বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির রাজত্বে খানিকটা পায়চারি করতে পেরেছি বলে। চমৎকার। চমৎকার! চমৎকার!
অনেক রাত্রে ইঁদুরের উৎপাত আবার শুরু হল। ওরা টিন আর কাঠের বাক্সে দাপাদাপি শুরু করে দিল, বীরদর্পে চোখের সামনে দিয়ে ঘরের মেঝে অতিক্রম করে দারুণ উপহাস করতে লাগল।
রান্না শেষ করে এসে মা সকলকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, ওরে মন্টু ওরে ছবি, ওরে নারু, ওঠ বাবা ওঠ!
মন্টু উঠেই প্রাণপণে চীৎকার আরম্ভ করে দিল। ছবি যদিও এতক্ষণ তার উপন্যাসের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল, এখন বই টই ফেলে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল।—ওরে ছবি, খেতে আয়, খাবি আয়!
বার বার ডাকেও ছবি টুঁ শব্দটি করে না।
মা ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, আমার কী দোষ হল? আমার ওপর রাগ করিস কেন? গরিব হয়ে জন্মালে…
মার চোখ ছল ছল করে উঠল, গলা কেঁপে গেল, আমি রাগ করে বললাম, আহা, ও না খেলে না খাবে, তুমি ওদের দাও না?
মধ্যরাত্রির ইতিহাস আরও বিস্ময়কর।
এক অনুচ্চ কণ্ঠের শব্দে হঠাৎ জেগে উঠলাম। শুনতে পেলাম বাবা অতি নিম্নস্বরে ডাকছেন, কনক, ও কনক, ঘুমুচ্ছো?
বাবা মাকে ডাকছেন নাম ধরে। ভারী চমৎকার মনে হল। মনে মনে বাবাকে আমার বয়েস ফিরিয়ে দিলাম; আর আমার প্রতি ভালোবাসা কামনা করতে লাগলাম তাঁর কাছ থেকে। যুবক সুকুমার একদিন তার বউকেও এমনি নাম ধরে ডাকবে, চীৎকার করে ডেকে প্রত্যেকটি ঘর এমনি সঙ্গীতে প্রতিধ্বনিত করে তুলবে।
—কনক? ও কনক?
প্রৌঢ়া কনকলতা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনো উত্তর দিলেন না, কঁকিয়ে উঠলেন, কোনবার উঃ আঃ করলেন। আমি এদিকে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে নিম্নগামী হলাম। বালিশের ভিতর মুখ গুঁজে হারিয়ে যাবার কামনা করতে লাগলাম। লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠলাম। শরীর দিয়ে ঘামের বন্যা ছুটল।
ওদিকে মধ্যরাত্রির চাঁদ উঠেছে আকাশে, পৃথিবীর গায়ে কে এক সাদা মসলিনের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, সঙ্গে এনেছে জলের স্রোতের মতো বাতাস, আমার ঘরের সামনে ভিখিরি কুকুরদের সাময়িক নিদ্ৰাময়তায় এক শীতল নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ও বাড়ির ছাদে নিদ্রাহীন বানরদের অস্পষ্ট গোঙানি শোনা যায়। মধ্যরাত্রের প্রহরী আমায় ঘুম পাড়িয়ে দেবে কখন?
অবশেষে প্রৌঢ়া কনকলতার নীরবতা, ভাঙল, তিনি আবার আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন, অল্প একটু ঘোমটা টেনে কাপড়ের প্রচুর দৈর্ঘ্য দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করলেন। তারপর এক অশিক্ষিতা নববধুর মতো ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হতে লাগলেন। অঙ্গ-ভঙ্গির সঞ্চালনে যে সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়, সেই সঙ্গীতের আয়নায় আমার কাছে সমস্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি লক্ষ করলাম দুই জোড়া পায়ের ভীরু অথচ স্পষ্ট আওয়াজ আস্তে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
অনেক রাত্রে বাবা গুনগুন স্বরে গান গাইতে লাগলেন। চমৎকার মিষ্টি গলা বেহালার মতো শোনা যাচ্ছে। সেই গানের খেলায় আলোর কণাগুলি আরও সাদা হয়ে গেছে, মনে হয় এক বিশাল অট্টালিকার সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সেই গানের রেখা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেষ রাত্রির বাতাস অপূর্ব স্নেহে মন্থর হয়ে এসেছে। একটা কাক রোজকার মতো ডেকে উঠেছে। বাবাকে গান গাইতে আরও শুনেছি বটে, কিন্তু আজকের মতো এমন মধুর ও গভীর আর কখনো শুনিনি। তাঁর মৃদু গানে আজ রাত্রির পৃথিবী যেন আমার কাছে নত হয়ে গেল। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন কার প্রাণ খোলা হাসিতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলাম। হাসির ঐশ্বর্যে বাড়ির ইটগুলি কাঁপছে।
বাবা বললেন, পণ্ডিত মশাই, ও পণ্ডিত মশাই, উঠুন? আর কত ঘুমুবেন সকালে না উঠলে বড়লোক হওয়া যায় কী? উঠুন?
আমি অনেক কষ্টে চোখমেলে চেয়ে দেখলাম কখন ভোর হয়ে গেছে! বাবার স্নেহময় কথায় আমি কখনো হাসিনে, কেমন, বাধে, যথেষ্ট বয়েস কি না, এককুড়ি বছর তো পেরিয়ে চললাম।
মশারির দড়ি খুলতে খুলতে বাবা বললেন, পৃথিবীতে যত গ্রেট মেন দেখতে পাচ্ছো, সকলের ভোরে ওঠবার অভ্যেস ছিল। আমার বাবা মানে তোমার ঠাকুরদারও এমনি অভ্যেস ছিল। আমরা যতো ভোরেই উঠি না কেন, উঠেই শুনতে পেতাম বাইরের ঘরে তামাক খাওয়ার শব্দ হচ্ছে। অমন অধ্যবসায়ী না হলে আর একটা জীবনে অত জমি-জমা অত টাকা পয়সা করে যেতে পারেন! তিনি তো সবই রেখে গিয়েছিলেন, আমরা কিছুই রাখতে পারলাম না। কিন্তু উঠুন পন্ডিত মশাই, যারা ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে জীবনে তারা কখনো উন্নতি করতে পারে না।
অতটা মাতব্বরী সহ্য হয় না, জীবনে একদিন মাত্র সকালে উঠেই বাড়ি সুদ্ধ লোক মাথায় তুলছেন।
সমস্ত বাড়িটা খুসির বাজনায় মুখরিত হয়ে উঠল।
ওদিকে মন্টু সেলুনে চুল ছাঁটাবার জন্য পয়সা চাইতে শুরু করেছে, ঘণ্টাখানেক পরেও পয়সা না পেলে মেঝেতে আছাড় খেয়ে তারস্বরে কাঁদবে। নারু পৰু-পক্ক বাক্য বর্ষণ করে সকলের মনোরঞ্জন করবার চেষ্টায় আছে। ছবি এই মাত্র তার উপন্যাসের পৃষ্ঠায় নায়িকার শয়নঘরে নায়কের অভিযান দেখে মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠেছে।
বাবা দারুণ কর্মব্যস্ত হয়ে উঠলেন, এঘর ওঘর পায়চারি করতে লাগলেন।
একসময় আমার কাছে এসে বললেন, তোমরা থিয়োরিটা বার করেছ ভালোই, কিন্তু কার্যকরী হবে না, আজকাল ওসব ভালোমানুষি আর চলবে না। এখন কাজ হল লাঠির। হিটলারের লাঠি, বুঝলে পণ্ডিত মশাই?
আমি মনে মনে হাসলাম। বাবা যা বলেন তা এমনভাবে বলেন যে মন মনে বেশ আমোদ অনুভব করা যায়। তাঁর কী জানি কেন ধারণা হয়েছে, আমরা সব ভালোমানুষের দল। নিজের খেয়ে চিন্তা করি, শুষ্কমুখ হয়ে শীতল জল বিতরণ করতে চাই, নিজেরা স্বর্গচ্যুত, অথচ পরের স্বর্গলাভের পথ আবিষ্কারে মত্ত।
আবার বলেন: তোমাদের রাশিয়া কেবল সাধুরই জন্ম দিয়েছে, অসাধু দেয়নি! কেবল মার খেয়ে মরছে। লেনিন তো মস্ত বড়ো সাধু ছিলেন, যেমনি টলস্টয় ছিলেন। কিন্তু ওঁরা লাঠির সঙ্গে পারবেন কী? কখনো নয়।
বলতে ইচ্ছে হয় চমৎকার! এমন স্বকীয়তা, এমন নূতনত্ব আর কোথাও চোখে পড়েছে! এমন করে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না, এটা জোর করে বলতে পারি। তিনি একবার যা বললেন তা ভুল হলেও তা থেকে একচুল কেউ তাঁকে সরাবে, এমন বঙ্গ সন্তান ভূভারতে দেখিনে। এক হিটলারি দম্ভে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিন্তু একমাত্র আশার কথা এই যে, এসব ব্যাপারে তিনি মোটেই সিরিয়াস নন, একবার যা বলেন দ্বিতীয়বার তা বলতে অনেক দেরি করেন। নইলে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। পৈত্রিক অধিকারে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তার অপব্যবহার করতেন সন্দেহ নেই।
ওদিকে কর্মব্যস্ত মাকে দেখতে পাচ্ছি। গভীর মনোযোগে তিনি তাঁর কাজ করে যাচ্ছেন, কোথাও এতটুকু দৃষ্টিপাত করবার সময় নেই যেন। কাঁধের ওপর দুই গাছি খড়ের মতো চুল এলিয়ে পড়েছে, তার ওপর দিয়েই ঘন ঘন ঘোমটা টেনে দিচ্ছেন, পরনে একখানা জীর্ণ মলিন কাপড়, ফর্সা পা-দুটি জলের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত বিশীর্ণ হয়ে এসেছে। পেছনে পেছনে নারু ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছেড়ে বাবা এবার ঘরোয়া বৈঠকে যোগ দিলেন। নারুকে ডেকে বললেন, নারু, বাবা তোমার কী চাই বল?
নারু তার ছোটো ছোটো ভাঙা দাঁতগুলি বের করে অনায়াসে বলে ফেলল, একটা মোটরবাইক। সার্জেন্টরা কেমন সুন্দর ভট ভট করে ঘুরে বেড়ায়, না বাবা?
কিন্তু মন্টুর বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছ। সে হঠাৎ পিছন ফিরে মুখটা নীচের দিকে নিয়ে কামানের মতো হয়ে বললে, বাবা, এই দ্যাখো?
দেখতে পাওয়া গেল, তার পেছনটা ছিড়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, বাঃ বেশ তো হয়েছে, মন্টুবাবুর যা গরম, এবার থেকে দুটি জানালা হয়ে গেল বেশ তো হল। এবার থেকে হু হু করে বাতাস আসবে আর যাবে, চমৎকার, না।
মন্টু সকল ত্রুটিবিচ্যুতি ভুলে বুদ্ধিমানের মতো হেসে উঠল; নারু তার ভাঙা দাঁত বের করে আরও বেশি করে হাসতে লাগল, বাবাও সে হাসিতে যোগ দিলেন। আমাদের সামান্য বাসা এক অসামান্য হাসিতে নেচে উঠলে, গুম গুম করতে লাগল।
হাসলাম না কেবল আমি। শুধু মনে মনে উপভোগ করলাম। ভাবলাম আনন্দের এই নির্মল মুহূর্তগুলি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে খুশির আর অন্ত থাকে না। মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে।
বাবার পরবর্তী অভিযান হল রানাঘরে। একখানা সিঁড়ি পেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হাসিমুখে বাবা বললেন,—আজ কী রাঁধবে গো?
মুখ ফিরিয়ে অজস্র হেসে মা বললেন, তুমি যা বলবে? বাবাকে এবার ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসল—আমি যা বলব, ঠিক তো? বলি, রাঁধবে মাংস, পোলাও, দই সন্দেশ? রাঁধবে চাটনি, চচ্চড়ি, রুই মাছের মুড়ো? রাঁধবে? রাঁধবে আরও আমি যা বলব?
—ওমা গো, থাক থাক, আর বলতে হবে না। মা দুই হাত তুলে মাথা নাড়তে লাগলেন, খিলখিল করে হেসে উঠলেন। ব্যাপার দেখে নারু দৌড়ে গেল, দুজনের দিকে দুইবার চেয়ে তারপর মাকে মুচকে হাসতে দেখে বললে, মাগো কী হয়েছে? অমন করে হাসছো কেন? বাবা তোমায় কাতুকুতু দিয়েছে?
—আরে, নারে না, অত পাকামি করতে হবে না। খেলগে যা—
বাঁ হাত তুলে মা বাইরের দিকে দেখিয়ে দিলেন।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বাবা আবার বললেন, আচ্ছা তোমাকে যেদিন প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনের কথা মনে পড়ে?
একটু চিন্তা না করে মা বললেন, আমার ওসব মনে-টনে নেই?
—আহা, বিলের ধারে মাঠে সেই যে গোরু চরাচ্ছিলে?
মার চোখ বড়ো হয়ে গেল—ওমা, আমি কী ভদ্দরলোক নই গো যে মেয়েলোক হয়েও মাঠে-মাঠে গোরু চরাব?
—গোরু চরানোটা কী অপরাধ? দরকার হলে এখানে সেখানে একটু নেড়েচেড়ে দিলে দোষ হয়? আসল কথা তোমার সবই মনে আছে, ইচ্ছা করেই কেবল যা-তা বলছ?
-হ্যাঁ গো হ্যাঁ, সব মনে আছে, সব মনে আছে।
মৃদু মৃদু হেসে বাবা বললেন, নৌকা থেকেই দেখতে পেলাম বিলের ধারে কে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার রাত্রে একটি মাত্র দীপশিখার মতো; নৌকো থেকে নেমেও দেখলাম, সেই মেয়ে তার জায়গা থেকে এতটুকুও সরে দাড়াচ্ছে না বা পাখির মতো বাড়ির দিকে উড়ে চলে যাচ্ছে না, বরং আমাদের দিকে সোজাসুজি চেয়ে আছে, অপরিচতি বলে এতটুকু লজ্জা সেই, কাছে গিয়ে দেখলাম ঠিক যেন দেবী প্রতিমা, খোলা মাঠে জলের ধারে মানিয়েছে বেশ। গভীর বর্ষায় আরও মানাবে। তারপর এক ভাঙা চেয়ারে বসে ভাঙা পাখার বাতাস খেয়ে যাকে দেখলাম সে-ও সেই একই মেয়ে। কিন্তু এবার বোবা, লজ্জাবতী লতার মতো লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
বাবা হা-হা করে প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন। কততক্ষণ পরে বললেন, তোমার কী চাই—বললে না?
আমার জন্য একখানা রান্নার কাপড় এনো।
—লাল রঙের?
—হ্যাঁ।
তারপর কার জন্যে কী এনেছিলেন খবর রাখিনি, কিন্তু নিজের জন্যে ছ-আনা দামের এক জোড়া চটি এনেছিলেন দেখেছি। মাত্র ছ-আনা দাম। বাবা এ নিয়ে অনেক গর্ব করেছেন, কিন্তু একেবারে কাঁচা চামড়া বলে কুকুরের আশঙ্কাও করছেন।
কুকুরের কথা জানিনে, তবে কয়েকদিন পরেই জুতো জোড়ার এক পাটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল কেউ বলতে পারে না। আশ্চর্য!
পরদিন দুপুরবেলা রেলওয়ে ইয়ার্ডের ওপর দিয়ে যেতে যেতে কার ডাকে মুখ। ফিরে তাকালাম। দেখি। শশধর ড্রাইভার, হাত তুলে আমার ডাকছে। এখানে ইউনিয়ন করতে এসে আমার একেবারে প্রথম আলাপ হয়েছিল এই শশধর ড্রাইভারের সঙ্গে। সেদিন সঙ্গে কমরেড বিশ্বনাথ ছিল। তখন গভীরভাবে শশধর বলেছিল, দেখুন বিশ্ববাবু, সায়েব সেদিন আমায় ডেকেছিল।
—কেন?
—শালা বলে কি না, ড্রাইভার, ইউনিয়ন ছেড়ে দাও। নইলে মুস্কিল হবে। বলছি। শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মুখের ওপর বলে এলাম, সায়েব আমার ইচ্ছে আমি ইউনিয়ন করব। তুমি যা করতে পারো করো। এই বলে তখুনি ঠিক এইভাবে চলে এলাম। আসবার ভঙ্গিটা দেখবার জন্যে শশধর হেঁটে অনেকদূর পর্যন্ত গেল। তারপর আবার যথাস্থানে ফিরে এল।
আমার প্রথম অভিজ্ঞতায় সেদিনের দৃশ্যটি আমার চমৎকার লেগেছিল। আমার এই মধ্যাহ্নের ট্রাকটর-স্বপ্নের ভিত পাকা করতে আরম্ভ করলাম সেদিন থেকে। একদা বলাই বাহুল্য যে ইতিহাস যেমন আমাদের দিক নেয়, আমিও ইতিহাসের দিক নিলাম। আমি হাত প্রসারিত করে দিলাম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিনন্দনে আমি ধন্য হলাম। তাদেরও ধন্যবাদ, যারা আমাকে আমার এই অসহায়তার বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। সেবাব্রত নয়, মানবতা নয়, স্বার্থপরতা অথচ শ্রেষ্ঠ উদারতা নিয়ে এক ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক অনুশীলন।
বিকেলের দিকে আমি শশধরের কাছে গেলাম। শশধর বললে, উঠুন।
সে আমাকে তার ইঞ্জিনে উঠিয়ে নিলে। তারপর একটা বিড়ি হাতে দিয়ে বললে, খান, সুকুমারবাবু।
বিকেলের দিকে একটা গ্যাঙের দিকে দেখা করতে গেলাম। একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করবার ছিল। ওরা আমার দিকে কেউ তাকাল কেউ তাকাল না। অদূরে ইঞ্জিনের ঝাঁ ঝাঁ সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে। পয়েন্টসম্যান—গানারদের চিৎকার আর হুইসিল শোনা যাচ্ছে।
ইয়াসিন এতদিন পরে ছুটি থেকে ফিরেছে দেখলাম। আমাকে দেখে কাজিয়া থামিয়ে বললে, ওরা কী বলছিল জানেন?
হেসে বললাম, কী?
—বলছিল আপনি একটা ব্যারিস্টার হলেন না কেন?
সকলে হো হো করে হেসে উঠল, আমিও হাসতে লাগলাম। মেট সুরেন্দ্র গম্ভীরভাবে বললে, তোমার কাছে আমাদের আর একটা নিবেদন আছে, ইয়াসিন মিঞা! আমরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে তোমায় ইস্কুলে পড়াতে চাই!
এবারে হাসির পালা আরও জোরে। কাজ ফেলে সবাই বসে পড়ল।
ইয়াসিন রেগে গেল, বললে, বাঃ, বাঃ বাঃ খালি ঠাট্টা আর ঠাট্টা, না? চারটে পয়সা দিয়েই খালাস না? চারটে পয়সা দিলেই বিপ্লব হবে, না? বিপ্লব আকাশ থেকে পড়বে না?
—একটু শান্ত হয়ে ইয়াসিন শেষে একটা গল্প বলল।
গল্পটি হচ্ছে এই: সে এবার বাড়ি গিয়ে তার গাঁয়ের চাষিদের একটা বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। সেই বৈঠকে যে লোকটা বক্তৃতা করছিল সে হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বললে, ভাই ইয়াসিন, তোমাদের ওখানে ইউনিয়ন নেই? ইয়াসিন বুক ঠুকে বললে, আলবৎ আছে! এবং সঙ্গে সঙ্গে বুক পকেট থেকে একখানা রসিদ বের করে দিল লোকটি তখন ভয়ানক খুশি হয়ে বলেছিল, তুমি যে আমাদের কমরেড, ভাই ইয়াসিন! তুমি যে আমাদেরই, ইয়াসিন তখন বিচক্ষণের মতো হেসেছিল।—দুনিয়ার সবাই এরকম জোট হচ্ছে, আর আমরাই কেবল চুপ করে বসে থাকব না? চারটে পয়সা দিলেই খালাস, না? বলতে বলতে ইয়াসিনের ঘর্মাক্ত মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে কাজে লেগে গেল গম্ভীর মনোযোগের সঙ্গে ঠকঠক শব্দ করে তার কাজ করতে লাগল।
আমি ফিরে এলাম। সাম্যবাদের গর্ব, তার ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে করে ফিরে এলাম। এখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ঝির ঝিরে বাতাসের সঙ্গে শেডঘর থেকে তেল আর কাঁচা কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ আসছে বেশ। আমি বাঁ-দিকে শেড-ঘর রেখে পথ অতিক্রম করতে লাগলাম। একটু এগিয়ে দেখি লাইনের ওপর অনেকগুলি ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় গভীর ধ্যানে বসেছে যেন। আমার কাছে ওদের মানুষের মতো প্রাণময় মনে হল, এখন বিশ্রাম করতে বসেছে। ওদের গায়ের মধ্যে কত রকমের হাড়, কতো কলকবজা, মাথার ওপর ওই একটিমাত্র চোখ, কিন্তু কতো উজ্জ্বল। মানুষ ওদের সৃষ্টিকর্তা। হাসি নেই, কান্না নেই, কেবল কর্মীর মতো রাগ। এমন বিরাট কর্মী পুরুষ আর আছে। সত্য কথা বলতে কী, এত কলকবজার মাঝে, এতগুলি ইঞ্জিনের ভিতর দিয়ে পথ চলতে চলতে আমার শরীরে কেমন একটা রোমাঞ্চ হল। আমি হতভম্ব হয়ে তাদের মাংসহীন শরীরের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।
তারপর সন্ধ্যার অনুকূলে বাসায় ফিরলাম। কয়েকদিন পরে কোনো গভীর প্রত্যুষে একটি ইঁদুর মারা কল হাতে করে আমার বাবা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসতে লাগলেন। দারুণ খুশিতে নারু আর মন্টুও দুই আঙুল ধরে বানরের মতো লাফাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পরেই আরও অনেক ছেলেপেলে এসে জুটল।
একটা কুকুর দাঁড়াল এসে পাশে। উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে যারা সাহসী তারা কেউ লাঠি, কেউ বড়ো-বড়ো ইট নিয়ে বসল রাস্তার ধারে।
ব্যাপার কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন