দুই বিখ্যাত বাঙালি—পিতাপুত্রের রসায়ন

অ+ অ-

 

প্রথমা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক মুর্তজা বশীরের ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: বাবার কাছে ফেরা’। বইটি মূলত পিতাকে লেখা পুত্রের, আর পুত্রকে লেখা পিতার চিঠি আর পিতাকে নিয়ে লেখার সংকলন। দুজন বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী ও লেখক—পিতা-পুত্রের চিঠির রসায়নে দুই প্রজন্মের সময়, চিন্তার দ্বৈরথ, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড চিত্র ধরে আছে। অনেকেই হয়তো জানেন—শিল্পী মুর্তজা বশীরের পিতা বিখ্যাত ভাষাবিদ, পণ্ডিত ও লেখক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। পত্রাবলীতে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, জ্ঞান চর্চা ও পিতা-পুত্রের বিপরীতমুখি স্বভাবের কথা আছে। আবার পিতাকে নিয়ে লেখা নিবন্ধে আছে পুত্রের মূল্যায়ন।      

বিখ্যাত পিতার পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে চাননি পুত্র বশীর। তিনি চেয়েছিলেন বাবার প্রভাবের গণ্ডির বাইরে নিজের পরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে। সন্তান হিসেবে মোটেই সহজ ছিলেন না তিনি। তরুণ বয়স থেকেই তার আত্মাভিমান ছিল প্রখর। বিশাল বটগাছের ছায়াতলে বামন বৃক্ষ হয়ে তিনি থাকতে চাননি। মাথার উপর থেকে পিতার ছায়া প্রবল ঝটকায় সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ‘মরণশীল মানুষ কি করে অবিনশ্বর হতে পারে?’ আর সেই অবিনশ্বরতার খোঁজে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী তবে অবাধ্য নয় মোটেই। কারণ তিনি অতি বিখ্যাত বাবার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার সন্তান মুর্তজা বশীর।

গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে বৃহত্তর বাংলায় বাঙালি মুসলমানের কোনঠাসা পরিসরেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেকটা লড়াই করেই ভাষাতত্ত্বে নিজের আসন পোক্ত করে নিতে পেরেছিলেন। রিক্ত বাঙালি মুসলমান সমাজে তিনি ছিলেন মুষ্টিমেয় খ্যাতিমানদের একজন। এই সমাজের প্রথম পিএইচডি গবেষক। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন পারিবারিক মানুষ, প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা। অথচ স্বনামে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নিজের নামেরও সংস্কার করেন পুত্র মুর্তজা বশীর। নামের পেছন থেকে সরিয়ে দেন উল্লাহ শব্দটি। তবে তার পেছনে অহংকার নয়, ছিল আত্মবিশ্বাস।

দুজনের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য একেবারেই বিপরীতমুখী। পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমনীয়, পণ্ডিত ও ধার্মিক। ছেলে বিদ্রোহী, শিল্পী ও কমিউনিস্ট। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে বেড়ে উঠুক পরিশীলিত সামাজিক হয়ে। ছেলে চাইলেন বাবার প্রভাবের গণ্ডির বাইরে নিজের পরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আধুনিক চিত্রের মতোই আমার ছেলে দুর্বোধ্য।’ দুর্বিনীত এই সন্তান মুর্তজা বশীর শেষ বয়সে ফিরেও এলেন বাবা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে প্রবলভাবে। পুত্রের কাছে পিতার এবং পিতার কাছে পুত্রের লেখা চিঠিপত্র ও আঁকা ছবিতে ভরা এ বই পিতা-পুত্রের সম্পর্কের এক সজীব রসায়ন। গুরুত্বপূর্ণ বইটি দুই প্রজন্মের চিন্তার নৈকট্য ও দূরত্ব বুঝতে সহায়ক হবে পাঠকের জন্য। বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা।