স্মারক দুর্ঘটনা: দৃশ্যশিল্পের নিবিড় পাঠ

অ+ অ-

 

এটা একটা ঘটনা, ঠিক ভাস্কর্য না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে এ শিল্প স্থাপন আদতে জনসমাজের কাছে আমাদের একটি প্রস্তাব, যা তাদেরকে এই সৃষ্টির অভিজ্ঞতা নিতে আমন্ত্রণ জানায়, অবশ্যই আমরা কলোনাইজড। ইন আওয়ার মাইন্ড। আমাদের যে কলোনিয়াল অসুখটা আছে..., ওই যে দুটো সিট রাখা হয়েছে, কফিনের মতো..., রবীন্দ্রনাথকে এক পশ্চিমা পণ্ডিত বলেছিলেন তোমাদের মধ্যে কাল চেতনা নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সত্যি তাই। আমরা কাল নিয়ে ভাবি না, চিরকাল নিয়ে ভাবি।

এসব খণ্ডালাপ। একটি শিল্পকর্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে, শামসুন্নাহার হলের পাশে সড়কদ্বীপে তার অবস্থান। তার সাথে জড়িয়ে দেশের গুণী কিছু মানুষ তাঁদের সহকর্মীদের বিয়োগব্যাথা। সড়কের পাশেই দুমড়েমুচড়ে যাওয়া একটা গাড়ি, তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কলকবজা, তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা নিঃসাড় হাত, তাকে ঘিরে রাখা কফিনের মতো আসন, কিংবা তারই দুমড়ে যাওয়া সিটের ওপর উড়তে ভোলা এক পাখিএই সবই অজস্র প্রশ্নের উৎসমুখ হতে পারলেও শেষতক তা ঠিকঠাক পারছে কী? শিল্পকর্মটির বর্গই বা কী হবে? ভাস্কর্যই তো? জনশিল্প নিয়ে জন কী ভাবছে, আদৌ ভাবে কি? নাকি এ অন্য সব পরিসরের মতোই একটি পরিসর হয়ে ওঠে শুধু? জনশিল্প জনের ওপর কী প্রভাব ফেলে? মানুষ শিল্পকে আসলে কতটা কাছ থেকে দেখে বা দেখতে চায়? এই যে একটি শিল্পকর্মকে স্থান দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জায়গার জনপরিসরে বদল আনা হলো, শিল্পের প্রয়োজনে রূপান্তর এলো, আবার এ শিল্পের প্রভাবে আচরণগত বদলের সম্ভাবনা তৈরি হলো, পরিবেশ বা প্রকৃতি শাসনের নানা নিয়ামক নিয়ে নাড়াচাড়া হলো এমন এক শহরে, যেখানে সবুজ এক সযত্ন সঞ্চয়ের বস্তু হয়ে উঠেছে অনেক আগেই, সেখানে এই স্থাপনা আসলে কোন মরমে টান দেয়; শুধুই কি মৃত গুণীর স্মৃতি, নাকি আরও কিছু। এই এত এত আয়োজন আসলে ভাস্কর্য ধারণা, প্রচল বেদিনির্ভরতা বা লার্জার দ্যান লাইফ ধারণাকে আসলে ঝাঁকুনি দিতে পারল কিনা?

একটি শিল্পকর্ম নিয়ে এভাবে সাধারণ থেকে সংশ্লিষ্ট, শিল্পী থেকে স্থপতি এতজনের সাথে কথা বলে, নিজস্ব অনুসন্ধান চালিয়ে বিস্তৃত পরিসরে কাজ বাংলাদেশে সম্ভবত হয়নি। বীক্ষণ কাঁচের নিচে কী আসেনি? শিল্পী ঢালী আল মামুনের শিল্পভাবনা এবং সেখানে পশ্চিমা প্রভাব, শিল্পের নানা দর্শনের গলি-ঘুপচি ও সেখানে বিরাজিত হঠাৎ আলোর ছটা, স্থপতি সালাহউদ্দিনের পরিসর, জনপরিসর চিন্তার কাঠামো, আমাদের নাগরিক হয়ে ওঠা না ওঠা, ক্যাথরিন মাসুদের শিল্প নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি এবং যৌথ শিল্প সম্পর্কিত আলাপ, আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাস্কর্য বাছবিচার। এই প্রতিটি প্রসঙ্গই হাজির হয়েছে দীপ্তি দত্তের তীক্ষ্ণ ও তীব্র অতসী কাচের তলায়। একটি শিল্পকর্ম নিয়ে এমন বিশ্লেষণধর্মী ও এতটা পরিশ্রমসাধ্য কাজ বাংলাদেশে বিরল বলা যায়। কয়েক বছর ধরে একনাগাড় পর্যবেক্ষণ করে এই দেখার সূত্রটি রচনা করেছেন তিনি। শিল্প সংশ্লিষ্টজন, সাধারণ শিক্ষার্থী ও লেখকের নিজের বিশ্লেষণ এক মলাটে ঠাঁই পেয়েছে—‘মুক্তবাতায়ন স্মরণিকা জাদুঘর: স্মারক দুর্ঘটনা বইটিতে, যাকে লেখক নিজেই আখ্যা দিচ্ছেনদৃশ্যশিল্পের একটি প্রস্তাবনা বলে। বাংলাদেশের তো বটেই বাংলায় শিল্পকর্মের নিবিড় পাঠ বিবেচনায় এ বই নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। বইটির প্রচ্ছদ ও প্রকাশনা, দুটিই করেছে বুবুক। মূল্য রাখা হয়েছে ৫৬৫ টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৮৫ টাকা।