বুকারজয়ী ঔপন্যাসিক পল লিঞ্চের সাক্ষাৎকার

অ+ অ-

 

পল লিঞ্চ প্রসঙ্গে

প্রফেট সং, বিয়ন্ড দি সী, গ্রেইস, দি ব্ল্যাক স্নো এবং রেড স্কাই ইন দি মর্নিংয়ের মতো অনবদ‍্য পাঁচটি উপন‍্যাসের স্রষ্টা আইরিশ শিল্প-সমালোচক ও কথাসাহিত্যিক পল লিঞ্চের সাথে কথা বলেছে দি ওয়াইজ আউল। তিনি ২০১৮ সালের ক‍্যারি গ্রুপ প্রদত্ত বর্ষসেরা আইরিশ উপন‍্যাস বিজয়ী। সম্প্রতি তিনি প্রফেট সং উপন‍্যাসের জন‍্য ২০২৩ সালের বুকার পুরস্কারে ভূষিত হন। তার প্রথম উপন‍্যাস রেড স্কাই ইন দি মর্নিং ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। যা পশ্চিমা দুনিয়ায় ব‍্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এটি ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক গ্রন্থ পুরস্কার চূড়ান্ত তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয় এবং শ্রেষ্ঠ প্রথম উপন‍্যাস পুরস্কারের জন‍্য মনোনীত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আমাজনে এটি মাসের সেরা বই ছিল। দি ব্ল‍্যাক স্নো [২০১৪] উপন‍্যাস ফ্রান্সের ফেমিনা পুরস্কার ও এনঅ‍্যাক উপন‍্যাস পুরস্কারে মনোনীত হয়। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দি ওয়াইজ আউল ম্যাগাজিনের সম্পাদক রচনা সিংহ। সাক্ষাৎকারটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন পল লিঞ্চ বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন। আমরা আনন্দিত, প্রতিধ্বনির পক্ষে যোগাযোগ করা হলে দি ওয়াইজ আউল [The Wise Owl] ম্যাগাজিনের সম্পাদক রচনা সিংহ সানন্দে সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশের অনুমতি দেন। আমরা বুকারজয়ী ঔপন্যাসিক পল লিঞ্চ ও সাক্ষাৎকারগ্রহীতা লেখক-সম্পাদক রচনা সিংহের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ

    

পল লিঞ্চ © ছবি: স্কাই নিউজের সৌজন্যে

 

‘আমার লেখা প্রত্যেকটা উপন্যাস নোঙরবিহীন জাহাজের মতো’

 

আমি মূলত কাহিনির মূল বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে লেখা শুরু করি। এরা উপন্যাসের কোন ধারায় অন্তর্ভূক্ত হবে তা নিয়ে অতো গভীর থেকে ভাবি না। কিন্তু আপনি আমার উপন্যাসের বিস্তৃতক্ষেত্র নিয়ে যা বলেছেন তা অনেকখানি সত্য। যে গল্পটা আমাকে দিয়ে আমার ভেতরের সত্তা লিখিয়ে নেয় তা কখনোই আমার সচেতন ভাবনা থেকে আসে না।

 

রচনা সিংহ: উপন্যাস আপনাকে ঠিক কেন আকর্ষণ করে? এমন কোন চিরায়ত কিংবা সমকালীন ঔপন্যাসিক কি আছেন যাদের লেখা আপনাকে উপন্যাস লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছে অথবা অন্য কোন শিল্পের প্রভাব যা আপনাকে কলম ধরতে প্রেরণা দিয়েছে নাকি এটা একটা সাধারণ ঘটনা? যেমন আয়ারল্যান্ড হচ্ছে অকথিত গল্পে পূর্ণ, যা পাঠককে বলা উচিৎ বলে মনে করেন?

পল লিঞ্চ: ঔপন্যাসিক হওয়ার আগে আমি প্রায় দশ বছর ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি যাতে কোনভাবেই ঔপন্যাসিক না হতে হয়। আমি তো গান লিখতাম, একটি গানের ব্যান্ডে যুক্ত ছিলাম, কিছুদিন সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেছি। কিন্তু আমার মনের গভীর থেকে, আমার সত্তার ভেতর থেকে আমি সবসময় সাহিত্য সৃষ্টির ডাক শুনতে পেতাম। সারাটা জীবন আমি অনেক দরদ ও সাধনা নিয়ে সাহিত্য পাঠ করেছি। অনেকদিন ধরেই ঔপন্যাসিক হবার একটা তীব্র তাড়না অনুভব করতাম। কিন্তু ঔপন্যাসিক হবার জন্য যা যা করার দরকার তার কিছুই করিনি। আমি ঔপন্যাসিক না হবার জন্য খুব করে চেষ্টা করেছি। কারণ আমি আমার প্রিয় লেখকদের সৃষ্টির মহত্ত্ব ও বিশালতা দিয়ে সবসময় ভীত ছিলাম [জয়েস, ফকনার, ম্যাককার্থি, সারামাগো এবং অনেকে]। আমি ঔপন্যাসিক না হবার জন্য খুব করে চেষ্টা  করেছি। কারণ আমার মধ্যে ভয় ছিল, আমি হয়তো অতোটা ভালো ঔপন্যাসিক হতে পারবো না। আপনি আসলে যা সেই সত্যটা যখন আপনি অস্বীকার করেন, যখন আপনি আপনার ভেতরের কণ্ঠ শুনতে চান না, তখন কিন্তু আপনি ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি কিংবা একটা শূন্যতা অনুভব করবেন। তখন আমার বয়স মাত্র ত্রিশ এবং আমি কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমি সিসিলি দ্বীপের লিপারিতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানে আমি একরকম আত্মজাগরণ অনুভব করেছিলাম। মনে হচ্ছিলো, আমি যেন আমাকে নতুন করে জানতে পারলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি কতটা অসুখি ছিলাম। আমি যে জীবন যাপন করছিলাম তা কতটা মিথ্যা ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমি আসলে ভেতরে ভেতরে একজন ঔপন্যাসিক। জীবনে প্রথমবারের মতো যেন একটা সত্য উন্মোচন হলোসৃষ্টিশীলতার সমুদ্রে ব্যর্থ হবার ভয় আসলে লেখক জীবনের একটা মৌলিক অংশ। এই ভয় বাদ দিয়ে কেউ লেখক হয়ে উঠতে পারে না। স্যামুয়েল ব্যাকেট যেমন লিখেছেন, যতবার চেষ্টা করেছো, ততবারই ব্যর্থ হয়েছো? কোন ব্যাপার না। আবার চেষ্টা করো, আবার ব্যর্থ হও, আরো ভালো করে ব্যর্থ হও। আমি তখন থেকেই জানতাম, যদি একটা ভালো উপন্যাস লেখার জন্য আমাকে আগামী ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে আজই হোক তার প্রথম পদক্ষেপ।

রচনা সিংহ: আপনি এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি উপন্যাস লিখেছেন। সবই প্রায় সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে সমাদৃত হয়েছে এবং সাহিত্য জগতের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। আমরা সব উপন্যাসকে বিভিন্ন উপধারায় আলাদা করতে পারি। রেড স্কাই ইন মর্নিং-কে যেমন আমরা পশ্চিম-আমেরিকান হিসাবে পাঠ করতে পারি। দি ব্ল্যাক স্নো-কে তেমন গ্রামীন জীবনের আখ্যান বলা যায়। গ্রেইস উপন্যাস হলো বিল্ডিংস্রোম্যান ও পিকোরাস্কের এক উৎকৃষ্ট উদাহারণ। আমি ঠিক জানতে চাই উপন্যাসের এমন সব রীতি কি আপনার সচেতন মনের নির্বাচন নাকি উপন্যাসের কাহিনি সূত্র ও কাহিনির বিন্যাস ঠিক করে কোন ধারায় উপন্যাস লিখবেন?

পল লিঞ্চ: আমি মূলত কাহিনির মূল বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে লেখা শুরু করি। এরা উপন্যাসের কোন ধারায় অন্তর্ভূক্ত হবে তা নিয়ে অতো গভীর থেকে ভাবি না। কিন্তু আপনি আমার উপন্যাসের বিস্তৃতক্ষেত্র নিয়ে যা বলেছেন তা অনেকখানি সত্য। যে গল্পটা আমাকে দিয়ে আমার ভেতরের সত্তা লিখিয়ে নেয় তা কখনোই আমার সচেতন ভাবনা থেকে আসে না। কিন্তু আমি অনেক বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করেছি। প্রত্যেকটা উপন্যাস সহজাতভাবে কোন না কোন বিষয়বস্তুকে খুঁজে নেয় [অথবা আপনি আরো বিশেষভাবে উপন্যাস লেখার নানা ধারার কথা বলতে পারেন], নতুন কোন শৈলী আবিষ্কার করে কিংবা এমন কিছু যা আমার কাছে নতুন মনে হয়। ফিলিপ রথ একবার নরথ্রপ ফ্রায়ের কথায় সুর মিলিয়ে বলেছিলেনপ্রত্যেক প্রকৃত লেখকের তাদের নিজেদের মিথলজি থাকতে হবে। প্রত্যেক উপন্যাসই আমাকে নতুন কিছুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। আবার সব উপন্যাসই একান্তভাবে আমার লেখার সৃজনশীল জগতে বাস করে। আমার লেখার নিজস্ব মিথলজি থেকে উৎসারিত।

রচনা সিংহ: আমার যতদূর মনে পড়ে, কোথায় যেন পড়েছিলাম যে আপনি ইতিহাস নির্ভর উপন‍্যাস লেখায় তেমন আগ্রহ বোধ করেন না। তবুও আপনার লেখা দুটি উপন‍্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও মধ‍্য ভাগের সময়কাল জুড়ে বিস্তৃত। এই বিষয়টি কী একটু বিশদভাবে বলবেন?

পল লিঞ্চ: মহৎ কথাসাহিত‍্য পরিমণ্ডলে উপন‍্যাস হলো শুধুই উপন‍্যাস। উপন‍্যাসকে ধারা ও উপধারায় বিভক্ত করা একটি দুরূহ কাজ। তারপরও উপন‍্যাসকে ভিন্ন ভিন্ন লেবেলে পৃথকীকরণ থেকে মুক্ত রাখা এক প্রকার অসম্ভব কাজ। আপনি যদি গভীর সাহিত‍্যগুণ সম্পন্ন ও অতীতাশ্রয়ী কোন উপন‍্যাস লিখেন, তাহলে প্রকাশক ও পাঠক সমানভাবে আপনাকে ইতিহাসের ছাঁচে ফেলে দেবে। আর উপন‍্যাসটিও ঐতিহাসিক উপন‍্যাস হিসাবেই প্রকাশিত ও প্রচারিত হবে। যখনি আপনি কোন উপন্যাসকে কোন বিশেষ জনরা বলে পরিচয় করিয়ে দেবেন, তখনই তা বিশেষ কোন পাঠকশ্রেণীর জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এতে উপন্যাস তার সার্বজনীনতা হারিয়ে ফেলে। এই পুরো বিষয়টা আমার কাছে একটা নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হয়। সাহিত্য সমঝদারদের মধ্যে একটা দল আছে যারা গোপনে বিশ্বাস করেন যে ঐতিহাসিক উপন‍্যাস কখনোই আমরা যে সময়ে বাস করি তাকে ঠিকঠাকভাবে প্রতিফলিত করতে পারে না। তারা মনে করেন, ঐতিহাসিক উপন‍্যাস মূলত অতীতবিষয়ক টীকাটিপ্পনী। কিন্তু একজন ঔপন্যাসিক অতীত যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবে তার লেখায় তুলে আনতে পারেনএই ভাবনাটাই একটা বিভ্রম বলে মনে হয়। উপন্যাস সবসময় একটা স্বপ্নের মতো, ঠিক এই মুহূর্তে দেখা স্বপ্নের মতো। কারণ একজন ঔপন্যাসিক যে সময়ে বাস করেন সে সময়কে এড়িয়ে তার কল্পনাশক্তি, তার চেতনা, তার ভাষার গতি এবং তার দেখা জগত আর জীবনকে সঠিক ও নিপুণ স্বরে বলে ফেলা অত সহজ নয়।  শুরু থেকে আজ অব্দি যত উপন্যাস লেখা হয়েছে তার সম্মিলিত ইতিহাসের রূপ হলো আজকের উপন্যাস। সে কারণে উপন্যাস কিছু অলিখিত নিয়ম দিয়ে পরিবেষ্টিত, সমকালীন পাঠক তার স্পন্দন ঠিকই বুঝতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনএকজন ঔপন্যাসিক অতীতকে অবিকল ফুটিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু নিজের সময়ের বাইরে গিয়ে অতীতকে অবিকল ফুটিয়ে তোলা এক অসম্ভব প্রয়াস। ঐতিহাসিক উপন‍্যাস এক প্রকারে সমকালীন উপন্যাস, অন্য কিছু হতেই পারে না।

 

আমার লেখা প্রত্যেকটা উপন্যাস নোঙরবিহীন জাহাজের মতো, যা আমার অচেতন মন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে আসে। গল্পগুলো আমার লেখকীয় আবেশের পাত্রের মতো। কখনো তা অতীতে ঘুরতে যায় কখনো তা বর্তমানে চলাচল করে। আমি কখনোই কোন লেখা সচেতন মন থেকে লিখি না। যদিও আমার এক উপন্যাস থেকে অন্য উপন্যাসের প্রতি সামান্য বেশি অনুরাগ আছে এবং অচেতন মন থেকেই আমি তা মেনে নেই।

 

রচনা সিংহ: বিয়ন্ড দি সী ছাড়া আপনার লেখা সব উপন্যাসই আয়ারল্যান্ডের পটভূমিতে রচিত। আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলিকে উপজীব্য করে লেখা। উপন্যাসগুলো যেন আইরিশদের জবানবন্দি। গ্রেইস উপন্যাস যেমন মহাদুর্ভিক্ষের পটচিত্র, রেড স্কাই ইন মর্নিং তেমন দেশান্তরি জীবনের আখ্যান। আপনার উপন্যাসের মূখ্য চরিত্রদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বসিয়ে আইরিশদের অতীত খুঁড়ে আনার পেছনের ভাবনা বা গল্পটা কি বলবেন?

পল লিঞ্চ: আমার লেখা প্রত্যেকটা উপন্যাস নোঙরবিহীন জাহাজের মতো, যা আমার অচেতন মন থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে আসে। গল্পগুলো আমার লেখকীয় আবেশের পাত্রের মতো। কখনো তা অতীতে ঘুরতে যায় কখনো তা বর্তমানে চলাচল করে। আমি কখনোই কোন লেখা সচেতন মন থেকে লিখি না। যদিও আমার এক উপন্যাস থেকে অন্য উপন্যাসের প্রতি সামান্য বেশি অনুরাগ আছে এবং অচেতন মন থেকেই আমি তা মেনে নেই। আমার প্রথম তিনটি উপন্যাসে আমি পুরাতন কাহিনিতে নতুন মিথলজি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। প্রাণহীন আখ্যানগুলোকে আমার প্রজন্মের জন্য পুনর্জন্ম দিয়েছি। রেড স্কাই ইন মর্নিং উপন্যাসকে আপনি অতীতের আইরিশ অভিবাসন সংকটের সাথে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর আমার প্রজন্মর যন্ত্রণার আখ্যান হিসাবেও পড়তে পারেন। দি ব্ল্যাক স্নো আইরিশ অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি দুর্বৃত্তদের প্রতি আইরিশ জাতির মনের বাসনার রূপক হিসাবেও পড়া যায়। গ্রেইসে আমি আইরিশ মহাদুর্ভিক্ষের আখ্যানকে পুনরায় লেখার চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও সমস্যাজনক সত্যের বাইরে গিয়ে অতীতের অবস্থান পুনরায় নির্ধারণ করার চর্চা করেছি। অতীতকে বর্তমানের মতো প্রাণময় করতে চেয়েছি। এই উপন্যাসে আমি শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছিমহাদুর্ভিক্ষের সময়ে আইরিশ জনগণ যে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছে সেই বিষয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এক নিরেট নীরবতায় ডুবে আছে। আমি শুধু এই গাঢ় নীরবতার সংস্কৃতির মূল কারণ খুঁজে পেতে চেয়েছি। আমাদের জাতীয় ক্ষতটাকে বুঝতে চেয়েছি। আমি এই ক্ষতের হাড়ে-মজ্জায় প্রবেশ করেতে চেয়েছি।

রচনা সিংহ: আপনার লেখা বিয়ন্ড দি সী আমাকে হেমিংওয়ের দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী ও ইয়ান মার্টেলের লাইফ অফ পাই উপন্যাস দুটির কথা মনে করিয়ে দেয়। এটাই প্রথম উপন্যাস যেখানে আপনি আয়ারল্যান্ডের সীমানার বাইরে এসে এক সূক্ষ্মতম জীবনের আখ্যান এঁকেছেন। এখানেও মাত্র দুটি চরিত্র আছে। উভয়ই মূল চরিত্র। প্রেক্ষাপটও মহাসমুদ্রের ভাসমান নৌকায়। পাঠকও সার্বজনীন ট্র্যাজিডির সকল বৈশিষ্ট্যর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। যেখানে একজন মানুষ তার অতীতের ভুলের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত। বর্তমানের শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং দুরাবস্থার সাথে সংগ্রামে লিপ্ত। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার সাথে সংগ্রামে লিপ্ত। এই দিকগুলোই কী এই উপন্যাসের অনুপ্রেরণা?

পল লিঞ্চ: ২০১৩ সালে দুজন জেলে মেক্সিকো উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে ভ্রমণে যায়। সেখানে তারা এক ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়েন। তাদের নৌকা উত্তাল সমুদ্রে দুলতে থাকে। সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ স্রোতে দিকবিহীন ভাসতে থাকেন। তারা তীর থেকে আরো দূরে যেতে থাকেন। এতটা দূরে যে তাদের উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। লোক দুটি এই সমুদ্রের বিশাল শূন্যতায় নিজেদেরকে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তাদের মধ্যে একজন জেলে হোসে সালভাদর আলভারেঙ্গা দীর্ঘ ১৪ মাস পর মার্শালদ্বীপে একা ভেসে আসেন। এই ঘটনাটা আমার কল্পনাকে প্রায় স্তব্ধ করে রেখেছিল। দরজায় অপ্রত্যাশিত কড়ার শব্দ আমাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

আমরা আসলে কিভাবে আমাদের জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিকে সংজ্ঞায়িত করি। ঔপন্যাসিক হিসাবে এই বিষয় আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে। দস্তয়ভস্কি যে প্রশ্নটা করেছেন: মানুষ আসলে কতটুকু মানুষ? আমি নিজেকে উপন্যাসের দুই জেলে বলিভার ও হেক্টরের জীবনে নিজেকে বসিয়ে দুই বছর ভেবেছি। কল্পনায় শূন্য সমুদ্রে নিজেকে একা ভাসিয়ে দেখেছি কেমন লাগে? তাদের নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি। তাদের মনের ভেতরটা দেখতে ছেয়েছি। মানুষ আসলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় বসবাসের জন্য সৃষ্ট। কিন্তু যখন আমরা বিচ্ছিন্নতার আবহে বন্দী থাকি তখন আমাদের মন ও অনুভবে কী ঘটে তাই জানতে চেয়েছি। জীবনকে এভাবে ছেঁকে ছেঁকে শুদ্ধ রূপে দেখার এক দার্শনিক উপন্যাস হলো বিয়ন্ড দি সী

 

সাহিত্য সকল সৃষ্টিশীলতার এমন একটা জায়গায় অবস্থান করে যা জীবনকে একই সাথে সুন্দর ও বেদনাদায়ক করে তুলতে পারে। তাই সাহিত‍্য সবসময় আমার কাছে প্রথম অগ্রাধিকার পায়। আর চলচ্চিত্রের অবস্থান ঠিক তার পরেই। আমার কল্পনা শক্তি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আমি যখন লিখি, মনে হয় প্রত‍্যেকটা ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটছে।

 

রচনা সিংহ: সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার উপন‍্যাস প্রফেট সং ২০২৩ সালের বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছে। এটিও আয়ারল‍্যান্ডের পটভূমিতে রচিত। আইলিশ নামের একজন নারীর গল্প বলেছেন। আয়ারল্যান্ডের বিক্ষুব্ধ ও দুঃসময়ের কথা বলেছেন। সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদ, বাস্তুচ্যুতি ও দুর্লভ‍্যকে পাওয়ার অদম্য সংগ্রামের মতো বিষয়বস্তু উঠে এসেছে উপন‍্যাসের পাতায় পাতায়। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলবেন কী এমন একটি চমৎকার ও দুঃসাহসিক উপন‍্যাস লেখার প্রেরণা কোথায় পেলেন? 

পল লিঞ্চ: ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যখন আমি প্রফেট সং লিখতে বসেছিলাম তখন আমি আমার মনের কাছে স্বচ্ছ ছিলাম যে আমরা পশ্চিম ইউরোপের মানুষেরা এক ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এক ভয়ংকর সময়ে আমাদের বসবাস। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থায় এক টেকটোনিক শিফট হচ্ছে। আমি এমন এক উপন‍্যাস লিখতে চেয়েছি, যা আধুনিককালের সংঘাতকে ঠিকঠাক ধরতে পারবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্প্রতিক সিরিয়া যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি রিফিউজি সংকটের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে কিছু সংখ্যক ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকার আর সদিচ্ছার অবয়বে নাটকীয় মোড় দেখতে পাই। ইউরোপের দ্বিমুখি আচরণ প্রকাশ হয়ে যাওয়া একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। উদার গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল হুমকির মুখে। আমি এমন একটা গল্প খুঁজছিলাম যা আমার সকল উদ্বেগ ও আশঙ্কাকে ধারণ করতে পারবে। আমি ভেবে অবাক হচ্ছিলামপপুলিস্ট সরকার নিয়ন্ত্রিত আয়ারল্যান্ড আসলে দেখতে কেমন হবে, যখন আয়ারল্যান্ডের গণতন্ত্র স্বৈরশাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি এটাও ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে এমন জনপীড়নমূলক রাষ্ট্রব‍্যবস্থায় একজন ব‍্যক্তি মানুষ ঠিক কতটা স্বাধীন ইচ্ছা ভোগ করতে পারেন। এই ভাবনার প্রবাহ আমাকে ক্রমে অবসাদের ফাঁদে ফেলে দিচ্ছিল। অন‍্যভাবে যদি বলি তবে বলবো প্রফেট সং অধিবিদ‍্যক প্রশ্নের আকর যদিও, তবে গভীরভাবে একটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বলা আখ‍্যান।

রচনা সিংহ: আপনার প্রত‍্যেকটি উপন‍্যাসের কাহিনি কাঠামো খুবই মনোমুগ্ধকর। কিন্তু যে দিকটা আপনার বলা গল্পের পাঠকে করে তোলে আনন্দদায়ক, তা হলো এর সিনেমাটিক ভাষা শৈলী। দি ব্ল‍্যাক স্নোর আলোকচ্ছটার দৃশ‍্য, গ্রেইস উপন‍্যাসের চুলকাটার পর্ব আমার মনের মধ্যে আটকে ছিল বহুদিন, শুধুমাত্র এর চিত্ররূপময়তার কারণে। আমি ভাবছিলাম, আপনি কি সচেতনভাবেই আপনার ভাষাকে এমন চিত্ররূপময় করে তোলেন নাকি একজন ঔপন্যাসিক হবার পূর্বে আপনি একজন চলচ্চিত্র সমালোচক ছিলেন বলে এই ব‍্যাপারটা আপনার মধ‍্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে?

পল লিঞ্চ: সাহিত্য সকল সৃষ্টিশীলতার এমন একটা জায়গায় অবস্থান করে যা জীবনকে একই সাথে সুন্দর ও বেদনাদায়ক করে তুলতে পারে। তাই সাহিত‍্য সবসময় আমার কাছে প্রথম অগ্রাধিকার পায়। আর চলচ্চিত্রের অবস্থান ঠিক তার পরেই। আমার কল্পনা শক্তি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আমি যখন লিখি, মনে হয় প্রত‍্যেকটা ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটছে। যেন আমি একটা চলচ্চিত্র দেখছি, আমি যখন পত্রিকার জন‍্য চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতাম। আমি প্রায় ১০০০ টার বেশি ফিল্ম রিভিয়ু লিখেছিফলে আমাকে অসংখ্য রকমের কাহিনি, আখ‍্যান ও গল্প নিজের মধ‍্যে ধারণ করতে হয়েছে। এমন কি সবচেয়ে হেঁয়ালিপূর্ণ ও অস্পষ্ট সিনেমাতেও একটা গল্প বলার তাড়না আছে। আমি ঠিক এই নিয়মকেই আমার কথাসাহিত্যে প্রয়োগ করে থাকি। সাহিত‍্যের মহাবিশ্বে কিছু লেখক আছে যারা মনে করে যে আপনি যদি সিরিয়াস ঔপন্যাসিক হতে চান আর আপনার বিচ্ছিন্নতাবোধকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে চান তাহলে গল্প বলার যেকোন রীতি বর্জন করে নতুন রীতি অবলম্বন করতে পারেন। যদিও এইরকম ধারণা একটু অদ্ভূত। একজন সত‍্যিকারের ঔপন্যাসিকএকজন পরিপূর্ণ ঔপন্যাসিকযে গল্প এখনো বলা হয়নি তার সরলতার মধ‍্যে সমগ্র মহাবিশ্বের ভারকে তার লেখায় বহন করতে পারে। একটা গল্পকে যথার্থভাবে বলতে, এর সত‍্যকে সম্পূর্ণরূপে তুলে আনতে একজন লেখকের প্রচুর শ্রম ও দক্ষতা বিনিয়োগ করতে হয়। আমার মধ‍্যে একটা সংশয় সবসময় কাজ করে, যে লেখক কোন গল্প লেখার সময় যত বেশি সর্তক থাকে সে লেখক গল্পটা তত কম ঠিকঠাকভাবে লিখতে পারে।

রচনা সিংহ: আপনাকে এই প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের একজন বলে মনে করা হয়। এই ব‍্যাপারে আপনার অভিমত কী? এটা আপনাকে আনন্দ দেয় নাকি আরো ভালো উপন‍্যাস লেখার জন‍্য একটা চাপ অনুভব করেন?

পল লিঞ্চ: লেখালেখি যেহেতু একটি একক ব‍্যক্তির নিঃসঙ্গ পেশা সেহেতু বড় কোন স্বীকৃতি অবশ‍্যই উৎসাহ দেয়। যখন অন‍্য লেখকদের কাছে আপনি আপনার লেখার প্রশংসা পাবেন তখন অবশ‍্যই তা আপনাকে পরিতৃপ্তি দেবে। স্বীকৃতি এমন এক শক্তি যা আপনাকে সৃজনশীল পথে আরো উদ্যম নিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায‍্য করে। সত‍্যি বলতে এই ব‍্যাপার নিয়ে আমি অতটা ভাবি না। শুধুমাত্র  আমাদের পরের প্রজন্মই বলতে পারবে আমাদের প্রজন্মের মহৎ লেখক কারা ছিলেন। সেই কারণে আমি শুধু আমার লেখার প্রতি যত্নশীল হতে পারি। আমি শুধু চেয়ারে বসে থাকতে পারি। আমি শুধু লেখার কাজটাই করতে পারি।

 

দি ওয়াইজ আউলের সম্পাদকীয় নোট

উপন্যাস সৃষ্টি ও লেখক হিসাবে আপনার সৃজনশীল সফরের এমন মননশীল আলোচনার জন‍্য অসংখ্য ধন‍্যবাদ পল। আপনার সৃজনশীল প্রচেষ্টা সত‍্যিই অনবদ‍্য। এ বছর বুকার পুরস্কার জয়ের পথে দি ওয়াইজ আউলের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ শুভকামনা।

কপিরাইট @ The Wise Owl : Intervew Link