পুরস্কারের খারাপ প্রভাব লেখকের মধ্যে পড়ে: উমর

অ+ অ-

 

ভূমিকা

বদরুদ্দীন উমর রাজনীতিবিদ, লেখক-গবেষক, ইতিহাসবিদ ও মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক। ক্ষমতার কাছে মাথা নত করেননি আজ পর্যন্ত। তিনি ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর জন্মের ৯১ বছর পেরিয়ে ৯২ বছরে পা দিয়েছেন। এখনো তিনি সম্মানজনক ও দীর্ঘ সফল জীবনযাপন করে প্রাণবন্ত ও কর্মক্ষম। তাঁকে অনেকে শুধু ভাষা আন্দোলনের গবেষক হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু এর বাইরেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

পাকিস্তান জামানায় অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক, সাহিত্যিকরা যখন দেশের যুগান্তকারী আন্দোলনগুলোকে এক পার্শ্বিকভাবে দেখা, অনেকটা লুকিয়ে রাখার মত নিরব ছিলেন, তখন তিনি সেসবকে উন্মোচন করেছেন। এভাবে তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের বিদ্রোহ; জনগণের কোন অংশ তাতে শক্তি জোগাল; দুর্বলতাটা কোথায় ছিল বলে আজও মুক্তি আসেনি তা আমাদের সামনে তুলে আনলেন। তাঁকে আজ পর্যন্ত লাভের আশায় ক্ষমতা ও খ্যাতির কাছে নুইয়ে পড়তে দেখা যায়নি। বার্ধক্য অনেকের শরীর ও মনের শিরদাঁড়া বাঁকা করে দেয়, অথচ এই ৯২ বয়সেও তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রর সামনে সততা ও মনীষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সময়ের কাছে একজন রাজনীতিবিদের কাজ শুধু বিজয়ের জয়গান গাওয়া নয়, পরাজয় ও এর কারণটা কোথায় লুকিয়ে আছে, তা অনুসন্ধান এবং পথ বাতলিয়ে দেওয়াটাও অন্যতম কাজ। তিনি এই জরুরি কাজেরই অন্যতম সাধক বলা যায়।

পাকিস্তান আমলে তাঁর সংস্কৃতি চিন্তার ট্রিলজি সেই সময়ের অনেক গোপন ঘটনার গোমর ফাঁস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সংস্কৃতির সংঘাত যে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে পারে, তা প্রথম তিনিই দেখান। বাঙালিত্বের সঙ্গে মুসলমানিত্বের বিরোধ যে কৃত্রিম ব্যাপার, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বলে যাকে চিহ্নিত করা হয় তা যে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, জাতীয়তাবাদ কীভাবে জাতিকেই গ্রাস করে, জনবিচ্ছিন্ন প্রগতিশীলতা যে আসলে শ্রেণিগত পিছুটানেরই রকমফের; এসব তিনিই প্রথম দেখান।

আর উনিশ শতকের পশ্চিম বাংলার তথাকথিত বঙ্গীয় রেনেসাঁস নিয়ে সেই সময়ের বিদ্বানদের নিয়ে আমাদের মোহ ভাঙ্গানোর জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার কৃষকঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ বই দুটি এখনো মাইলফলক বলতে হবে। এ সবের বাইরে বঙ্গভঙ্গ ও ভারতভাগের দায় যে কংগ্রেস নেতাদের সেটা প্রমাণ করেন তিনি বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিভারতীয় জাতীয় আন্দোলন গ্রন্থে। তখন পর্যন্ত জয়া চ্যাটার্জির ভারত ভাগ এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা বিভাজনের রাজনীতি-অর্থনীতি প্রকাশিত হয়নি। 

তাঁর লেখক-গবেষক সত্তার পাশাপাশি তিনি শুধু অক্সফোর্ড ফেরত বিদ্বানের গরিমাই ছাড়েননি, আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে বিপ্লবী রাজনীতিতে নেমে পড়েছিলেন। একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে পিকিংপন্থি ধারার কমরেড আব্দুল হক ও তোয়াহার সঙ্গে বিরোধ ঘটে এবং তিনি বাংলাদেশপন্থি ধারার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আমার কাছে মনে হয়, তাঁর মতো জেদি, সৎ ও সাহসি মানুষের রাজনৈতিক নেতা হওয়ার কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? তিনি তো একাই একটি প্রতিষ্ঠান। সে কারণেই আদমজী, ফিলিপস, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক প্রত্যাখ্যান করতে তাঁর এতটুকু দ্বিধা হয়নি। এ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন

“…ষাটের দশকে মাত্র একটি-দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে এমন অনেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যত দিন জীবিত ছিলেন, ষাটের দশকের সব পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ইসলাম, মুসলমান, পাকিস্তান, কায়েদে আজম প্রভৃতি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো, তবে সাধারণ বিষয়ের মানসম্মত বইয়ের লেখকরাও পুরস্কার পেয়েছেন। একটি উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী লিখেই আবু ইসহাক পুরস্কার পান [১৯৬৩]। আনিসুজ্জামানের দুটি গবেষণামূলক বই বেরিয়েছিল স্বাধীনতার আগে, দুটিই মুসলমানদের নিয়ে, তা হলো মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য [১৯৬৪] এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র [১৯৬৯]। শওকত আলী ও হাসান আজিজুল হকও একটি-দুটি বই প্রকাশ করেই পুরস্কার পান। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও আধুনিকদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার পেছনে যে সরকারি নীতির প্রভাব ছিল, তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারটি বই প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসনামলের সাম্প্রদায়িক পরিবেশে তাঁর বইগুলোর ভূমিকা ছিল অসামান্য। বইগুলো হলো সাম্প্রদায়িকতা [১৯৬৬], সংস্কৃতির সংকট [১৯৬৭], সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা [১৯৬৮] এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি [১৯৭০]। ষাটের দশকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য উত্তাল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে বদরুদ্দীন উমরের এই গ্রন্থগুলো ছিল অসামান্য প্রেরণা। আজ বাংলাদেশে ভাষাসৈনিকে ভরে গেছে, একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি রোমান্থনে ক্লান্তি নেই একদল ভাষা আন্দোলন ব্যবসায়ীর এবং তাঁদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অথচ বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন, তার কোন রেকর্ড নেই। বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার দিগন্ত উন্মুক্ত হয়। তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার পথিকৃৎ। চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশের পরও বাংলা একাডেমি অথবা অন্য কোন পুরস্কার কমিটির দৃষ্টি এড়িয়ে যান তিনি। এখন সাম্প্রদায়িক শব্দটি উচ্চারণ না করে যাঁরা দিন শুরু করেন না, একাত্তরের আগে তাঁরা ওই শব্দ এড়িয়ে যেতেন। 

বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন পণ্ডিত যদি ইসলাম ও মুসলমান বা পাকিস্তান জাতীয়তাবাদ নিয়ে একখানা বই লিখতেন, ষাটের দশকে তিনিও একাধিক পুরস্কার পেতেন। ১৯৭২ সালে তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়; কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। উপযুক্ত কাজটিই তিনি করেছিলেন। তিনি অবিচল প্রতিষ্ঠান বিরোধী। [বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা: সৈয়দ আবুল মকসুদ, ২০১৯, ডেইলি স্টার বুকস, ঢাকা।]

বদরুদ্দীন উমরের আত্মজীবনী আমার জীবন থেকে জানা যায় তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও সক্রিয়তার কথা; যার শুরু ১৯৬৪ সালে। সে বছর ভিয়েতনামে মার্কিন বিমানবাহিনীর টংকিং উপসাগরে হামলার ঘটনায় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ জনের বেশি শিক্ষককে সমবেত করেন বিবৃতি প্রদান করে সাম্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদ করেন। তিনি বিবৃতি সংগঠিত করেই নিষ্ক্রিয় থাকেননি; ভিয়েতনামে হামলার প্রতিবাদে তিনি মার্কিন কনস্যুলেটে চিঠি দিয়ে তিন মাসের জন্য আমেরিকায় লিডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে যাওয়ার আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করেন। একইভাবে পাকিস্তানের মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার কারণে সরকারের সঙ্গে তাঁর বৈরিতা প্রবল হতে থাকায় তিনি পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ব্রিটেনের সোয়াসয়ে পিএইচডি করতে যাওয়ার বিষয়টি আর গ্রহণ করেননি।

সাপ্তাহিক ভিত্তিতে লেখা তাঁর সেসব লেখা যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ থেকে যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ-এ ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ও মূল্যবান ধারাবাহিক বিবরণ হিসেবে রয়ে গেছে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি; এখানকার শাসকশ্রেণি ও তাঁদের পরিচালিত শাসনব্যবস্থার বয়ান হিসেবে।

তিনি স্বীকার করেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, তবে একইসঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলতে চান পুঁজিবাদও পেছনে হটছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘সমাজতন্ত্রের আদৌ কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না, এ প্রশ্ন যদি কেউ তোলে, তাহলে এর বিপরীতে প্রশ্ন করতে হবে পুঁজিবাদেরও কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি না।২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর মিরপুরের রূপনগরের বাসায় বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেনসাংবাদিক মাসুদ রানা

১৯৬৩ সালে সাম্প্রদায়িকতা বইটি লিখেছিলাম, তারপর এখন পর্যন্ত যত লেখালেখি করেছি, সেই লেখালেখির তাগিদ কিন্তু আমার মূলত রাজনৈতিক চিন্তা থেকে, আমার একটা আদর্শগত চিন্তা থেকে। কাজেই রাজনীতি এবং লেখালেখি দুটোই একেবারে অবিচ্ছিন্ন। একটা থেকে অন্যটাকে আলাদা করে দেখা যাবে না। আমি অনেক সময় যেটা বলেছি, আমি কোন সাহিত্যিক নই, আমি একজন রাজনীতিবিদ। যা আমি লিখিইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি সব কিছুই হচ্ছে রাজনীতির প্রয়োজনে। সব কিছুই আমার রাজনীতি ও আদর্শের প্রয়োজনে।

মাসুদ রানা: দীর্ঘ একটা জীবন কাটাচ্ছেন। এই জীবনের সার্থকতা কী বলে আপনি মনে করেন?

বদরুদ্দীন উমর: জীবনের সার্থকতা বলতে কী বোঝায় তা আমি জানি না। তবে জীবনে যেটা দেখেছি তার মধ্যে হয়ত বা সার্থকতা থাকতে পারে। আমি তো একটা দীর্ঘ পাঁচ খণ্ডে আত্মজীবনী লেখেছি। যেটাতে ১৯৪০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমার জীবনের অনেক কথা লেখা আছে। জীবনে বহু বিষয় দেখেছি। ব্রিটিশ আমলের জীবন, ৪০-এর দশকের জীবন, রাজনীতি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা দেখেছি এবং তখনকার সমাজ যে রকম ছিল, সেই সমাজে বসবাস করেছি। যে সমাজ এখনকার থেকে অনেক উন্নত ছিল। মানুষ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো ছিলএসব দেখেছি। পরে ঢাকা ও অর্ক্সফোর্ড, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছি এবং সেখানকার জীবনকে দেখেছি। তারপর রাজনীতি করতে এসে অনেক কিছু দেখেছি। মানুষের অনেক রকম অবস্থা দেখেছি। আন্দোলন দেখেছি। এসব দেখা কি সার্থকতা বলা যায় না।

মাসুদ রানা: এ জীবন নিয়ে কোনো খেদ কি আছে?

বদরুদ্দীন উমর: খেদ তো নেই। এখন পর্যন্ত ভালোই কেটেছে।

মাসুদ রানা: আপনার প্রধানত দুটি পরিচয়একটি হলো রাজনীতিবিদ এবং দ্বিতীয়টি লেখক ও গবেষক। কোন পরিচয়টাকে বড় করে দেখতে ভালো লাগে এবং কেন?

বদরুদ্দীন উমর: আসলে একটার সঙ্গে আরেকটাকে আলাদা করে দেখা যায় না। দুটোর সঙ্গে দুটোই জড়িত। প্রথম হচ্ছে, আমি হঠাৎ করে কোনো কিছু করিনি। আমি যে লেখালেখির কাজ শুরু করেছি অনেক আগে। তবে যেসব লেখা আমি স্বীকার করি, সেসব লেখা শুরু করেছি ১৯৬৩ সাল থেকে। অনেক দেরিতে লেখা শুরু করি, তখন আমার ৩২ বছর বয়স। কিন্তু হঠাৎ করে আমি লেখা-লেখি আরম্ভ করেনি। অনেক লেখালেখি করে পরে একটা জায়গায় এসেছি।

চিন্তা-ভাবনার দিক থেকেও আমি আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়েছি। একটা সময় পর আমি রাজনীতিতে এসেছি। যদিও আমার পরিবারে তিন-চার পুরুষ আগ থেকে রাজনীতির চর্চা ছিল। সেটা ছিল উনিশ শতকের সময় থেকে। কিন্তু আমি নিজে কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না ছাত্র জীবন থেকে। আমি কোন ছাত্র সংগঠনের সদস্য থাকিনি কোন সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও কোন ছাত্র রাজনীতি আমি করিনি, কোন দল বা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু রাজনীতি সচেতন বরাবরই ছিলাম সেই ছোটবেলা থেকেই।

পরবর্তী সমস্ত পর্যায়ে এবং শেষ পর্যন্ত রাজশাহীতে থাকতেই এবং তার আগেই আমি ঠিক করেছিলাম আমি রাজনীতি করব। দেশের যে অবস্থা, সমাজের যে অবস্থা তাতে মনে করেছি এটা পরিবর্তন করা দরকার, এ জন্য রাজনীতি করা দরকার। রাজনীতি করতে এসেছি অন্য কোন কারণে নয় সমাজ, দেশ ও মানুষের অবস্থার যেন পরিবর্তন করা যায়, সেই চেষ্টা করার জন্য রাজনীতি করতে এসেছিলাম।

আমি লেখালেখি করছি এখন পর্যন্ত। আর ১৯৬৩ সালে সাম্প্রদায়িকতা বইটি লিখেছিলাম, তারপর এখন পর্যন্ত যত লেখালেখি করেছি, সেই লেখালেখির তাগিদ কিন্তু আমার মূলত রাজনৈতিক চিন্তা থেকে, আমার একটা আদর্শগত চিন্তা থেকে। কাজেই রাজনীতি এবং লেখালেখি দুটোই একেবারে অবিচ্ছিন্ন। একটা থেকে অন্যটাকে আলাদা করে দেখা যাবে না। আমি অনেক সময় যেটা বলেছি, আমি কোন সাহিত্যিক নই, আমি একজন রাজনীতিবিদ। যা আমি লিখিইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি সব কিছুই হচ্ছে রাজনীতির প্রয়োজনে। সব কিছুই আমার রাজনীতি ও আদর্শের প্রয়োজনে।

মাসুদ রানা: আপনি বাংলা একাডেমি ও ইতিহাস গবেষণা পরিষদ পুরস্কার ত্যাগ করেছিলেন এবং একুশে পদকও আপনাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু নেননি। পুরস্কার কেন নিলেন না?   

বদরুদ্দীন উমর: আমি পুরস্কার নেই না এ কারণে যে, প্রথমত, আমি যে লেখালেখি করিএটা আমি নিজের আন্তরিক তাগিদ থেকে করি, নিজের প্রয়োজন থেকে করি। এর জন্য আমাকে কেউ পুরস্কার দেবে, এটা আমার অসুবিধা লাগে। আমার ভালো লাগে না। আমি যে আন্তরিকভাবে কাজটা করছি, তার জন্য কেউ আমাকে পুরস্কার দেবে কেন? আর এই পুরস্কার বলতে আমি যেটা মনে করি, আসলে একজন লেখকের লেখা মানুষ যদি পড়ে, লেখা নিয়ে আলোচনা করে এবং মানুষ যদি তার দ্বারা উপকৃত হয়তাহলে এটাই হলো একজন লেখকের আসল পুরস্কার।

দ্বিতীয়ত হলো, পুরস্কার জিনিসটা এমনিতেই ভালো না। কারণ সাধারণত দেখা যায়, পুরস্কার যারা দেন তারা নিজেদের স্বার্থে যারা লেখে তাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। কারণ নোবেল প্রাইজ থেকে আরম্ভ করে আদমজী, দাউদ, আনন্দবাজার পত্রিকার পুরস্কারএ সব পুরস্কার তারা কেন দেয়? এরা কী দেয় এ জন্য যে, উন্নত আদর্শ, প্রগতিশীলতা, লেখার উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য একজন লেখককে পুরস্কার দেয়? তারা দেয় এ জন্য যে, এ সব লেখক পুরস্কার পেয়ে একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকে। কারণ যারা পুরস্কার দেয়, যাদের কথা বললাম, তারা প্রধানত দেশের ধনিকশ্রেণির লোক। এই ধনিকশ্রেণির লোকেরা অনেক সময় অনেক লুটপাট করে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করেন। এই ধরনের লোকেরা কিংবা কোন সরকার পুরস্কার দেয় এ জন্য যে, যাতে এ সব লেখক একটা গণ্ডির বাইরে না যেতে পারেন। যাতে লেখকরা একটা সীমানার মধ্যে থাকেন। একটা পুরস্কার দিলে মানুষের যেটা আসলে হয়, একবার পুরস্কার পেলে পরে আবার অন্য পুরস্কার পাওয়ার ঝোক তৈরি হয়।

উদাহরণস্বরূপ আমি বলতে পারি, পশ্চিমবাংলার লেখক মহাশ্বেতা দেবী যেমন ছিলেন। আমার সঙ্গে এক সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি যে সব বিষয়ে লিখতেন বা কথাবার্তা বলতেন, তাতে আমার মনে হতো তিনি বুঝি পুরস্কার পছন্দ করেন না। তবে তিনি একবার একটা সরকারি পুরস্কার পেলেন। আমি তখন তাঁকে বললাম, আপনি কেন এ পুরস্কার নিলেন? তিনি তখন বললেন, এ পুরস্কার নেওয়া আমার ঠিক হয়নি। তারপর দেখলাম, তিনি এরপরে আরও পুরস্কার নিলেন এবং সব থেকে খারাপ ছিল, ম্যাগ সাই সাইয়ের মতো সাম্রাজ্যবাদী পুরস্কার নিলেন। যে পুরস্কার নগদ মূল্য ছিল প্রায় তিরিশ-চল্লিশ লাখ টাকা। তারপর দেখা গেল, তিনি যে এই সব পুরস্কার নিলেন এরপর তাঁর লেখালেখির মান নষ্ট হয়ে গেল। একই সঙ্গে তাঁর যে চরিত্রের ঋজুতা ছিল, মেরুদণ্ড যে খাড়া ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি মমতা ব্যানার্জীর একজন সাগরেদ হয়ে মারা গেলেন। কাজেই পুরস্কারের একটা খারাপ প্রভাব লেখকের মধ্যে পড়ে, সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

আমি যে লেখালেখি করিএটা আমি নিজের আন্তরিক তাগিদ থেকে করি, নিজের প্রয়োজন থেকে করি। এর জন্য আমাকে কেউ পুরস্কার দেবে, এটা আমার অসুবিধা লাগে। আমার ভালো লাগে না। আমি যে আন্তরিকভাবে কাজটা করছি, তার জন্য কেউ আমাকে পুরস্কার দেবে কেন? আর এই পুরস্কার বলতে আমি যেটা মনে করি, আসলে একজন লেখকের লেখা মানুষ যদি পড়ে, লেখা নিয়ে আলোচনা করে এবং মানুষ যদি তার দ্বারা উপকৃত হয়তাহলে এটাই হলো একজন লেখকের আসল পুরস্কার।   

মাসুদ রানা: আপনি কোন ছাত্ররাজনীতি করেননি। বিদেশে গিয়ে মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন? মার্ক্সীয় রাজনীতির প্রতি এই পরিবর্তনটা কীভাবে হলো?

বদরুদ্দীন উমর: এর জবাবটা খুব সোজা। আমি মার্ক্সীয় রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হলাম আন্তরিকভাবে পরিবর্তন চেয়েছিলাম বলে। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, লেখাপড়া করেছি। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা যাচাই করার একটা ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার জোরে আমার মনে হয়েছে যে, মার্ক্সসবাদের চেয়ে উন্নততর কোন চিন্তা নেই, কোন রাজনীতি নেই। এ কারণে আমি মার্ক্সসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি, এ আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আকৃষ্ট হয়ে আমি কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছি। এর অন্য কোনো জবাব নেই।  

আর আমি তো বিদেশে মার্ক্সসিস্ট হওয়ার জন্য যাইনি। অক্সফোর্ডে গিয়ে আমি অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশেছি। অক্সফোর্ড এমন একটা জায়গা সেখানে সারা দুনিয়া থেকে লোক যায়। সেখানে যত ইউরোপীয়, এশিয়া, আফ্রিকার জাতির মানুষ আছে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি। সেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। সেখানে এ সবের সুযোগ অনেক বেশি। ওইখানে গিয়ে হঠাৎ করে যে আমি মার্ক্সসিস্ট হলাম, ব্যাপারটা সে রকম না। কারণ আমার চিন্তার মধ্যে ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন হচ্ছিল। সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা হিসেবেই আমি অর্ক্সফোর্টে যাঁদের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে আলাপের মধ্য দিয়ে গেছি। এভাবে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। বলা যেতে পারে যে, রাজনৈতিক চিন্তা করতে গিয়ে আমি মার্ক্সীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।

মাসুদ রানা: বাংলাদেশে ক্রমশ মানুষের মনে ধর্মীয় চিন্তার বিস্তার ঘটছে। কেন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো বলে মনে করেন?

বদরুদ্দীন উমর: আমি মনে করি যে এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এটা আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের একটা প্রচারণা যে, এখানে ধর্মের প্রচারণা বেশ বেড়ে যাচ্ছে, এখানে সাম্প্রদায়িকতা আছে ইত্যাদি। এসব আসলে ভুয়া কথা। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এটার কোন পরিবর্তন নেই। ধর্মীয় চিন্তা এখানকার চেয়ে ভারতে একশ গুণ বেশি আছে। মানুষ সাধারণভাবে নামাজ, রোজা ও বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে। তার মানে এটা নয় যে তারা ধর্মীয় চিন্তার দ্বারা জীবন-যাপন করছেন। ধর্মীয় চিন্তার দ্বারা সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ রকম কোনো ব্যাপারেই নেই। কিছু ধর্মীয় রাজনীতির দল আছে বটে, তারা কোন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে না। তারা লোকদেরকে ধর্মীয় চিন্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধও করে না।

আজকাল একটা জিনিস দেখা যাবে, আগে যত ওয়াজ-মাহফিল হতো, আগে যত ধর্মীয় এ সব প্রচার হতো যেমনআমাদের এই মহল্লায় আগে ওয়াজ-মাহফিলের জন্য টেকাই মুসকিল হতো, মাইক দিয়ে এমন অত্যাচার করা হত, কিন্তু এখন দীর্ঘদিন ধরে এ সবের কিছুই হচ্ছে না। তার মানে এখান থেকে ধর্মীয় চিন্তা উঠে গেছে, তা নয়। কিন্তু যেটা বলা হয়, এখানে ধর্মীয় চিন্তার খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এখানে ধর্মীয় চিন্তার বিস্তার ঘটছেএ সব কথা ঠিক না। 

মাসুদ রানা: ষাটের দশকে আপনার রচিত সাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক সংকট, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা লিখে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। যার ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন। এতো বছর পরেও কী মনে করেন সাংস্কৃতিক সংকট রয়ে গেছে? 

বদরুদ্দীন উমর: সাংস্কৃতিক সংকট তো আছে। তখনকার সাংস্কৃতিক সংকটের বড় দিক ছিল সংস্কৃতি অনেকখানি ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ধর্মের চিন্তা দ্বারা, ধর্মীয় রাষ্ট্রের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ধীরে ধীরে সে প্রভাব অনেকখানি কেটে গেছে। সেই প্রভাব যাতে কাটে, এ কারণে আমি সেই সময় লেখালেখি করেছিলাম। সরাসরি রাজনীতিতে না থাকা সত্ত্বেও লেখার মাধ্যমে আমি চেষ্টা করেছিলাম সেই সংকটের উপর আলোচনা করতে। সেই সংকট কীভাবে কাটবে, সে বিষয়েও কিছু লেখালেখি করেছিলাম।

কিন্তু সংকট তো পরিবর্তন হয়নি। একটা সমাজ থেকে সংকট সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন হতেই পারে না। প্রত্যেক দেশে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকট রয়েছে। যত উচ্চ সভ্যতাই হোক না কেন যেমনইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, রাশিয়া, চীন সব জায়গাতেই একেক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকট আছে। এখানেও সাংস্কৃতিক সংকট আছে। এখানকার সাংস্কৃতিক সংকটের মূল রূপ হচ্ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদ দ্বারা সংস্কৃতি প্রভাবিত। বিশেষত, বাংলাদেশে মধ্যশ্রেণি যে সংস্কৃতি চর্চা করেন তা আওয়ামী লীগের উগ্র জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত। এ কারণে তারা সমস্ত সংস্কৃতিকে এমন কি ভারতের যে বিভিন্ন সংস্কৃতি আছে তাদের থেকেও নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। যেমন বলা যায়, তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের তারা উর্দু ভাষার বিরোধী। উর্দু সিনেমা দেখে, উর্দু গান শোনে, কিন্তু কেউ উর্দুতে কথা বললে তার দিকে বাকা চোখে তাঁকায়। এই যে একটা উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা, সেই চিন্তা তো খুবই প্রতিক্রিয়াশীল। এ কারণে তারা বাংলাসহ সব ভাষা থেকে উর্দুকে বিচ্ছিন্ন করেছে, এটা একটা সংকট। তার কারণ ভারতীয় যত ভাষা আছে  উর্দু ও হিন্দি হচ্ছে বাংলার সবচেয়ে নিকটবর্তী।

সেই ভাষা থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে বাংলা ভাষা ভারতীয় সব ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা দ্বীপের মতো হয়ে আছে। ফলে বিভিন্ন ভাষার মধ্যে একটা মিশ্রণ, সংস্কৃতির যে আদান-প্রদানের চর্চা, সেটা তো বাংলাদেশে হচ্ছে না। যেটা ইউরোপে দেখা যায়, ফরাসি, জার্মানি, ইতালি, ইংরেজিসব ভাষার লোকেরা পরস্পরের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। সেখান থেকে তারা লেনদেন করে। বাংলাদেশে সেরকম নেই। এটার কারণ হচ্ছে এই দেশে মেরুদণ্ডহীন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আছে। তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নিজেদেরকে বাঙালি, বাঙালি বলে প্রচার করে এ দেশের সর্বনাশ করছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি। এখনও এখানকার এই অবস্থা। এরা স্বাধীনতার পরে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি হয়েছে, কিন্তু মানুষ হয়নি।

মাসুদ রানা: বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট যে আন্দোলন করছে, তার ভবিষ্যৎ কী বলে আপনি মনে করেন?

বদরুদ্দীন উমর: এখানে সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে তার কারণ আছে। এই সরকারের মতো একটা ফ্যাসিস্ট সরকার দুনিয়াতে খুব কমই আছে এবং বাংলাদেশে এর সঙ্গে তুলনীয় হচ্ছে যে, শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসন। এই শাসনে মানুষ জর্জরিত, শোষিত ও অত্যাচারিত হয়েছিল। কয়েক হাজার লোক মেরে ফেলেছিল। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিল। সেখানে মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। ব্যাপকভাবে লোকজনকে গ্রেফতার ও খুন করা হয়েছিল। সেই সময় হাজার হাজার জাসদের কর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স, জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

এখন শেখ মুজিবের কন্যা ২০০৮ সাল থেকে যে শাসন করছেন, এটা তো একটা মহাদুর্বৃত্ত শাসন, ফ্যাসিস্ট শাসন। এই শাসনের বিরুদ্ধে এখন জোর আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলন এখন দানা বেধেছে। এই দানা বাধার কারণ হচ্ছে, জনগণ অসহ্য অবস্থার মধ্যে পড়েছে। তারা এখন আর এই শাসন সহ্য করতে পারছেন না। এই শাসনের পরিবর্তন করতে তারা বদ্ধ পরিকর। কাজেই এই আন্দোলন এখন চারিদিকে হচ্ছে।

সম্প্রতি এক দৈনিক পত্রিকা খবরে দেখলাম, শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার একটা পরিকল্পনা করেছেন। আমার নিজের ধারণা, এরপর আর তাঁর থাকার সম্ভাবনা নেই। তাঁকে যেতেই হবে। তাঁকে ছাড়তেই হবে। কারণ জনগণ তাঁর এত বিরুদ্ধে গিয়েছে যে, তাঁর পক্ষে আর থাকা সম্ভব না। তাছাড়া পশ্চিমা যে দেশগুলো আছে, যারা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক তারা একে একে হাসিনার শাসনের পরিবর্তন চাইছে। তিনি যাই মনে করুন, যতই ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করুন, দেশের যে অবস্থা এখন দেখা দিয়েছে, দেশের লোকের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে যে বিরোধিতা বাড়ছে, তাতে তাঁর টিকে থাকা সম্ভব না।

এই দেশের যে ঐতিহ্য, সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁকে যেতে হবে। এখন তিনি কীভাবে যাবেনভোটের মাধ্যমে যাবেন, না এরশাদ যেভাবে গিয়েছিলেন বা অন্য কোনোভাবে যাবেন, সেসব আলাদা কথা। কিন্তু তিনি যে যাবেন, এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর পক্ষে আর ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।

যদিও সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা জনগণের শাসন কায়েম হবেএ রকম আশার করারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু এ শাসন পরিবর্তন খুব দরকার। এই শাসন পরিবর্তন করা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা আর করার উপায় নেই।

মাসুদ রানা: বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় কী এবং কারা?

বদরুদ্দীন উমর: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে, বর্তমান শাসকশ্রেণি, যে শ্রেণি দুর্বৃত্ত, ব্যবসায়ি, চোরাকারবারি। ১৯৭২ সাল থেকে এরা ক্ষমতায় এসেছে শেখ মুজিবের পৃষ্ঠপোষকতায়। আর শেখ মুজিবের করারও কিছু ছিল না। কারণ তাঁর দল আওয়ামী লীগের কোনো সুগঠিত, মেরুদণ্ডওয়ালা চরিত্র ছিল না। তারা ছিল দুর্বল, মধ্যশ্রেণির একটা দল। শেখ মুজিবের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের ফলে তিনি অল্প দিনের মধ্যে মানে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশের যে অবস্থা করেছিলেন, তাতে তাঁর পক্ষেও আর ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কতিপয় সামরিক বাহিনির লোক তাঁকে হত্যা করেছিল এটা ঠিক, কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের ক্ষমতা তাদের হতো না, যদি শেখ মুজিব জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যেতেন। তিনি যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তার বড় প্রমাণ হলো তাঁকে হত্যার করার পর তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেননি। আওয়ামী লীগের লোকেরাও কোন প্রতিবাদ করেননিযেটা হাসিনা বলে থাকেন। এটা থেকে বোঝা যায়, তিনি কতটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের লোকদের এটা ব্যাখ্যা করতে হবে, শুধু গাল দিলে হবে না যে, তারা কেন আসেননি, কেন প্রতিবাদ করেননি। যে জনগণ ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবকে বিশাল অভ্যর্থনা ও সমর্থন দিয়েছিলেন তারা কেন সমর্থন প্রত্যাহার করলএর ব্যাখ্যা তো আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে একই শ্রেণির নানা দল ক্ষমতায় ছিল। শেখ মুজিব সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থেকে চলে গেলেও তিনি ছিলেন এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই রাষ্ট্রটা হলো মধ্যশ্রেণির রাষ্ট্র। শেখ মুজিবের নির্যাতন, দমন-পীড়নের ফলে আওয়ামী লীগের পতনের পর কিছুদিন ক্ষমতায় ছিল না। তারপর আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলো। কিন্তু মধ্যবর্তী যে শাসন ছিল, সেগুলো তো মধ্যশ্রেণিরেই শাসন ছিল। কারণ এ সময়টাতে আওয়ামী লীগ ছিল না বলে এমন কোন দল ছিল না, যারা ক্ষমতায় যেতে পারত। সে জন্য সামরিক বাহিনির লোকজন ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এরপর আওয়ামী লীগ আবার ফিরে এলো। আবার ফিরে এসে তারা চরিত্র দমন-পীড়ন চালিয়ে বাংলাদেশকে একটা অসম্ভব বিপদগ্রস্ত অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে। এই রাষ্ট্রে মানুষ যে ভাবে আশা করেছিল, যেখানে রাজনৈতিক মুক্তি হবে, মানুষের জীবনের পরিবর্তন হবে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হবেআসলে এ সবের কিছুই হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যদি রাজনীতি অন্যভাবে মোড় নেয়, এখানকার মানুষের মধ্যে যদি গণতান্ত্রিক চিন্তা বিকাশ লাভ করে, তাহলে অবশ্যই এই পরিস্থিতির পরিবর্তিত হবে।

মাসুদ রানা: বাংলাদেশে ক্রমশ বামপন্থি শক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে, এর কারণ আপনি কী মনে করেন? এ থেকে উত্তরণে কী করণীয় আছে বলে মনে করেন?

বদরুদ্দীন উমর: বাংলাদেশে বামপন্থি শক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে মানে সেটা তো ৭২ সাল থেকে হয়েছে প্রথমত। ১৯৭১ সালে বামপন্থিবিশেষত কমিউনিস্টদের একটা বিপর্যয় হয়েছিল, কারণ তাঁদের নীতি সে সময় দেউলিয়া ছিল। মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির কেউ-ই সঠিকভাবে তাদের লাইন নির্ধারণ করতে পারেনি। মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি তো আওয়ামী লীগের লেজুড়ে পরিণত হয়েছিল কলকাতায় এবং পরবর্তী সময়েও। আর পিকিংপন্থি যে দলগুলো ছিল, এগুলো সম্পূর্ণ দেউলিয়া রাজনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

একাত্তর সালে যুদ্ধের সময়, এই কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপর শেখ মুজিব যে দমননীতি চালালেন, সেই দমননীতির ফলে এখানে সেই দলগুলো আর সংগঠিত হওয়ার অবস্থায় ছিল না।

তারপরে আর একটা বড় ঘটনা হচ্ছে, বাংলাদেশ হওয়ার পরে এ দেশের মধ্যশ্রেণির চরিত্রের মধ্যে একটা পরিবর্তন হলো। বাংলাদেশ হওয়ার পরে এই মধ্য শ্রেণি যে সুযোগ-সুবিধা পেল, এটা তো তারা চিন্তা করতে পারত না। তাদের কল্পনাতেও ছিল না। হঠাৎ নয় মাসের মধ্যে তাদের এ পরিবর্তন হলো। এই বাংলাদেশে যেখানে পাকিস্তান আমলে মাত্র চারশত কোটিপতি ছিল, দেখা গেল১৯৭২ সালের মধ্যে কয়েক শত কোটিপতি দাঁড়িয়ে গেল। এখন তো বাংলাদেশে হাজার হাজার, লাখ লাখ কোটিপতি। এখন এই যে পরিবর্তন মধ্যশ্রেণির মধ্যে এলো, এ কারণে এ শ্রেণির চরিত্র নষ্ট হলো। তারা আগে যেভাবে রাজনৈতিক চিন্তা করত তাদের একটা অংশ, তারা সেই চিন্তা না করে নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা মানে নিজেদের টাকা-পয়সা, সুখ-শান্তি, বাড়ি-ঘর কীভাবে হবেএই চিন্তার মধ্যে পড়ল। দেখা যাবে, যে ছাত্র সমাজ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে অনেক গৌরবজনক আন্দোলন করেছে, তারা ভাষা আন্দোলন করেছে। এ আন্দোলনের চেয়েও একটা মস্ত বড় আন্দোলন করেছে আইয়ুব খানের আমলে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন তারা ব্যাপকভাবে করেছিল। সেই ছাত্র সমাজ ১৯৭২ সাল থেকে পুরো অন্ধকারের মধ্যে ছিল। পুরো সত্তরের দশকেও অন্ধকার ছিল ছাত্র সমাজের জন্য। তারা এই সময়টাতে বিশেষ কিছু করেনি।

দেখা গেল, আশির দশকে সামান্য কিছু আন্দোলন করেছিল ছাত্র সমাজ এরশাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার বিশেষ করে প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি কোন চরিত্র ছিল না, যেটা আগের সব ছাত্র আন্দোলনে ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো আওয়াজ তুলেছিল, এক দফা এক দাবী এরশাদ তুই কবে যাবি সেই রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই তারা আন্দোলন করেছিল।

তারপর দেখা যাবে, নব্বই সালের পর এই ছাত্র সমাজ প্রথমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই দুইয়ের দ্বারাই একটা গুণ্ডাবাহিনি হিসেবে সংগঠিত হলো। এখন ছাত্র বলতে গুণ্ডাবাহিনি ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। পরিস্কারভাবে এখন আওয়ামী লীগ এই গুণ্ডাবাহিনিকে রাস্তায় নামাচ্ছে। পুলিশের ছত্রছায়ায় তারা গুণ্ডাবাহিনি হিসেবে লোকজনের উপর আক্রমণ করছে। মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করলে তাদের মোবাইল এ গুণ্ডাবাহিনি চেক করছে।

এ যে অবস্থাএটা তো চরম অবনতি একটা জাতি, সমাজ ও দেশের পক্ষে। এখানে যে এই অবস্থা সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পক্ষে ব্যাপক আন্দোলন হবে, ছাত্ররা, যুবকরা এগিয়ে আসবে সে অবস্থা নেই। যদিও আওয়ামী লীগের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে লোকজন এখন একটা প্রতিরোধের মধ্যে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে কোনো পরিবর্তন হবে না। এই যে একটা আন্দোলন ও সংগ্রাম হচ্ছে, তাতে রাজনীতির একটা মোড় পরিবর্তন হতে পারে এবং তখন ছাত্ররা চিন্তা করতে থাকবে, তারা যদি গুণ্ডামি পরিত্যাগ করে ঠিক মতো চিন্তা-ভাবনা করে, দেশের প্রতি তারা দৃষ্টি দেয়, [এতদিন তো দেশের প্রতি তাদের দৃষ্টি ছিল না] তখন তারা সুস্থভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারবে। এটা হলে দেশে বামপান্থি শক্তি আবার নতুনভাবে সংগঠিত হবে।

এটা তো নিশ্চিয় বলা যায় না, এ দেশে বামপন্থি শক্তি চিরকালের জন্য শেষ হয়ে গেছে। বিশেষ কতগুলো নির্দিষ্ট কারণে এর মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং অবস্থার অবনতি হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। মানুষের লড়াই থাকবে, ভবিষ্যতে এই লড়াই করবে এবং লড়াইয়ের সময় যাতে বামপন্থিদের একটা শক্তি হয়, তারাই একটা নেতৃত্বের নির্ধারক ভূমিকায় থাকবে। এতে সন্দেহের কোন কারণ নেই।   

মাসুদ রানা: বাংলাদেশের ৫১ বছর বয়স হলোএ নিয়ে আপনার কাছ থেকে সামগ্রিক মূল্যায়ন শুনতে চাচ্ছি।     

বদরুদ্দীন উমর: সামগ্রিক মূল্যায়ন এত কম সময়ে করা সম্ভব না। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে। এই রাষ্ট্রে মানুষ যে ভাবে আশা করেছিল, যেখানে রাজনৈতিক মুক্তি হবে, মানুষের জীবনের পরিবর্তন হবে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হবেআসলে এ সবের কিছুই হয়নি। তবে ভবিষ্যতে যদি রাজনীতি অন্যভাবে মোড় নেয়, এখানকার মানুষের মধ্যে যদি গণতান্ত্রিক চিন্তা বিকাশ লাভ করে, তাহলে অবশ্যই এই পরিস্থিতির পরিবর্তিত হবে। এবং এটা যে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।