বাংলার উপকথা ‘নিখুঁৎ মানুষ’
রেভারেণ্ড লালবিহারি দে ‘ফোক টেলস অব বেঙ্গল’ নামে ইংরেজিতে একটি বই লিখেছিলেন। কথাসাহিত্যিক লীলা মজুমদার ‘বাংলার উপকথা’ নামের সংকলন থেকে বেশকিছু গল্প অনুবাদ করেন। সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল ‘উপকথা’ ও ‘রূপকথা’ কি এক? অনুবাদক ভূমিকায় লিখছেন, ‘…রূপকথা হল অন্যদের গল্প আর উপকথা আমাদের নিজেদের। আমাদের দেশের মাটি-জল-হাওয়া দিয়ে গড়া, আমাদের দুঃখ-বেদনায় বিধুর, আমাদের সুখে-আহ্লাদে ভরপুর।’ লেখক লালবিহারি দে রচিত ‘বাংলার কৃষি জীবন’ নামে বইটি সাড়া ফেলেছিল। ভারতীয় শাসক স্যার রিচার্ড টেম্পলের ছেলে, বেঙ্গল স্টাফ কোরের ক্যাপ্টেন আর সি টেম্পল বইটি পড়ে লেখককে লিখেছিলেন, ‘…এ দেশের বুড়িরা সন্ধ্যেবেলায় ছোট ছেলে-মেয়েদের যে-সব অলিখিত গল্প বলেন, তার একটি সংগ্রহ পেলে বেশ হয়।’ তারপর লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঐ রকম সংকলন করা যায় কি না। প্রস্তাবটা লেখকের মনে লেগে যায়, আর সেইমত তিনি উপকরণ সংগ্রহ করতে লেগে গেলেন। এভাবেই ১৯ শতকের শেষের দিকে অধ্যাপক লালবিহারি দে গল্পগুলোকে লিপিবদ্ধ করে বাংলা সাহিত্যকে চিরকালের মত ঋণী করেছেন। গল্পগুলো অবিকল অনুবাদ নয়, তবে গল্পের রূপ বদলানো হয়নি। গল্পগুলোর বাঙালিত্ব কোথাও ঘোচেনি। বাঙালির কৃষি জীবন লেখকের অনুশীলনের বিষয়বস্তু ছিল। তাই নিয়ে তিনি সার্থক এই বই রচনা করেছেন।
লীলা মজুমদারের অনুবাদকৃত ‘বাংলার উপকথা’ সংকলনের ‘নিখুঁৎ মানুষ’ গল্পটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো। আশাকরি, প্রতিধ্বনির পাঠকরা গল্পটি থেকে নৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বাংলার মানুষের রূপ কল্পনার সাহিত্যিক আনন্দ আস্বাদন করবেন। ‘নিখুঁৎ মানুষ’ উপকথাটি নেওয়া হয়েছে অন্নপূর্ণা সংস্করণ থেকে। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
—সম্পাদকীয় নোট
অনেক অনেক দিন আগে এক রাজা ছিলেন, তাঁর ছেলেপিলে ছিল না। একদিন একজন সাধু সে রাজাকে বললেন, ‘আপনার যখন এতই ছেলের শখ, তখন আপনাকে একটা ওষুধ দেব, সেটি রাণীমা যদি খান, তাঁর যমজ ছেলে হবে। তবে ওষুধটা শুধু এই শর্তে দেব যে একটি ছেলে রেখে, অন্যটি আপনি আমাকে দেবেন।’
যদিও রাজার মনে হল শর্তটি বড়ই কঠিন, তবুও একটিও ছেলে না থাকলে কে তাঁর এই বিশাল রাজ্য, এত ধনসম্পদ ভোগ করবে। এই ভেবে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজী হলেন।
রাণীমা সাধুর ওষুধ খেলেন। কয়েক মাস পরে তাঁর অবিকল একরকম দেখতে দুটি ছেলে হল। যমজ ছেলেদের ক্রমে এক বছর, দু বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর বয়স হল, তবু সাধু একজনকে নিতে এলেন না। রাজা-রাণী ভাবলেন সাধুর বয়স হয়েছিল, নিশ্চয়ই তিনি স্বর্গে গেছেন। এই মনে করে তাঁরা নিশ্চিন্তে ছিলেন।
সাধু কিন্তু মারা যাননি। দিব্যি জ্বলজ্যান্ত অবস্থায় সযত্নে বছর গুণ ছিলেন। ছেলে দুটির শিক্ষার জন্য পণ্ডিত রাখা হল। দেখতে দেখতে তারা বেশ জ্ঞানী হয়ে উঠল। তা ছাড়া গুরুর কাছে অস্ত্র বিদ্যা, ঘোড়ায় চড়া, তীর-ধনুক ছোড়াও শিখল। দুজনই দেখতে বেশ সুন্দর ছিল, সকলেই তাদের যেমন বেশ ভালবাসত, তেমনি শ্রদ্ধাও করত।
রাজপুত্রদের যখন ষোল বছর বয়স হল, সাধু হঠাৎ রাজবাড়ির সিংহ-দরজায় দেখা দিয়ে, পুরনো শর্ত মত তাঁর অধিকার চাইলেন। তাই শুনে রাজা-রাণীর বুক ভেঙে গেল। তাঁদের ধারণা হয়েছিল সাধু ইহজগতে নেই। এখন তাঁকে সশরীরে সিং-দরজায় দাঁড়িয়ে রাজপুত্রদের একজনকে দাবী করতে শুনে তাঁদের মুখ শুকিয়ে গেল।
শোক সাগরে মগ্ন হলেন তাঁরা। কিন্তু কোন উপায় ছিল না, একটি ছেলেকে দিয়ে দিতেই হবে। সাধু যদি রেগে যান, তাহলে শাপ দিয়ে তিনি দুই রাজপুত্রকে, রাজা-রাণীকে, রাজবাড়ি, এমনকি গোটা রাজ্যের সবাইকে ভস্ম করে দিতে পারেন।
***
কিন্তু কোন রাজপুত্রকে দেবেন? দুজনই যে সমান আদরের। রাজা-রাণীর মনের মধ্যে সে কী নিদারুণ দ্বন্দ্ব।
এদিকে সব কথা শুনে দুই রাজপুত্রই বলতে লাগল, ‘আমি যাব।’ ‘আমি যাব।’
ছোটজন বড়কে বলল, ‘কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও, তুমিই বড়। তুমি বাবার চোখের মণি। তুমি বাড়িতে থাক, আমি সাধুর সঙ্গে যাই।’
অনেক হাঁ-না, কান্নাকাটির পর, চোখের জ্বলে বুক ভাসিয়ে রাজা-রাণী বড় ছেলেকে সাধুর সঙ্গে যেতে দিলেন।
বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার আগে, অন্দরমহলের উঠোনে বড় রাজপুত্র একটি গাছ পুঁতে মা-বাবাকে আর ভাইকে বলল, ‘এই গাছটি আমার প্রাণ। যতক্ষণ একে সবুজ সতেজ দেখবে, বুঝবে আমি ভাল আছি। যদি কখনো দেখ গাছের খানিকটা জায়গা শুকিয়ে যাচ্ছে, বুঝবে আমার অবস্থা ভাল নয়। গাছটার আগাগোড়া শুকোলে বুঝবে আমি আর নেই।’
এই বলে মা-বাবার পায়ের ধুলো নিয়ে, ভাইকে আদর করে, বড় রাজপুত্র সাধুর সঙ্গে চলে গেল।
সাধুর সঙ্গে রাজপুত্র একটা প্রকাণ্ড বনের কাছে এসে দেখল, একটা কুকুর দুটি বাচ্চা নিয়ে বনের ধাঁরে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা বাচ্চা তার মাকে বলল, ‘মা, আমি ঐ সুন্দর মানুষটির সঙ্গে যেতে চাই। মনে হয় উনি রাজপুত্র।’
কুকুর-মা বলল, ‘যাও, বাছা।’
রাজপুত্রও খুশি হয়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল।
আরও কিছু দূর গিয়ে রাজপুত্র দেখল গাছের ডালে একটা বাজপাখি দুটি ছানা নিয়ে বসে আছে।
একটা ছানা বলল, ‘মা, আমি ঐ সুন্দর মানুষটির সঙ্গে যেতে চাই। দেখে মনে হয় উনি রাজপুত্র।’
মা-পাখি বলল, ‘যাও, বাছা।’
বাজপাখির ছানা উড়ে এসে রাজপুত্রের হাতের কব্জিতে বসল। রাজপুত্র খুশি হয়ে তাকে সঙ্গে নিল। এই ভাবে সাধুর সঙ্গে রাজপুত্র তার কুকুর-বাচ্চা আর বাজপাখির ছানা নিয়ে বনের মধ্যে দিয়ে চলল।
হাঁটতে হাঁটতে তারা গভীর বনের ভেতরে, মানুষের বাস থেকে বহু দূরে, একটা পাতার কুটিরের সামনে পৌঁছল। ঐ কুটিরে সাধু থাকতেন।
তিনি রাজপুত্রকে বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে এই কুটিরে থাকবে। তোমার প্রধান কাজ হবে আমার পূজোর ফুল তুনে আনা। বনের সব জায়গায় তুমি ঘুরে বেড়াতে পারবে, কিন্তু কখনো উত্তর দিকে যেও না। সেখানে গেলেই তোমার বিষম বিপদ হবে। বনে অনেক ফল-মূল আছে, ইচ্ছেমত খেও। ছোট ঝরনা আছে, তার জল পান কর।’
ঐ জায়গা আর নিজের কাজকর্ম, রাজপুত্রের মন্দ লাগত না। রোজ ভোরে উঠে বনের ফুল তুলে সে সাধুকে দিয়ে আসত। তারপর সাধু কোথায় যেন চলে যেতেন, সূর্য ডোবার আগে ফিরতেন না। সারা দিনটা রাজপুত্র ইচ্ছেমত কাটাতে পারত। পোষা কুকুর ছানা আর বাজপাখির বাচ্চা নিয়ে সে সমস্ত বনময় ঘুরত। বনে অনেক হরিণ ছিল, তীর-ধনুক নিয়ে তাদের পিছন দৌঁড়াত। বেশ মনের আনন্দেই সময় কাটত।
একদিন রাজপুত্রের তীর একটা হরিণের গায়ে লাগল। আহত হরিণটা উত্তর দিকে ছুটল। সাধুর বারণ ভুলে গিয়ে, রাজপুত্রও তার পিছন পিছন ছুটল। বনের মধ্যে একটা চমৎকার বাড়ি। হরিণটা দৌড়ে সেই বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। ভিতরে গিয়ে কিন্তু হরিণটাকে আর দেখতে পেল না। তার বদলে দেখল পরমাসুন্দরী মেয়ে পাশার ছকের সামনে বসে আছে।
রাজপুত্রকে দেখে মেয়ে বলল, ‘এসো অচেনা পথিক। দৈবাৎ এসে পড়েছো বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে এক দান পাশা না খেলে চলে যেও না।’
রাজপুত্র রাজি হল।
বাজির খেলা। স্থির হল রাজপুত্র হারলে সুন্দরীকে তার বাজপাখিটি দিয়ে দেবে, সুন্দরী হারলে সে রাজপুত্রকে ঠিক ঐ রকম আরেকটা বাজপাখি দেবে। সুন্দরী জিতল। কাজেই সে বাজপাখিটাকে নিয়ে একটা গর্তে রেখে তক্তা দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিল।
রাজপুত্র বলল, ‘এসো আরেক দান খেলি, এবার আমার কুকুরছানা বাজি রইল। তুমি হারলে ঐ রকম আরেকটা কুকুরছানা দেবে।’ সুন্দরী আবার জিতল। আবার সে কুকুরছানাটাকে গর্তে ভরে তক্তা চাপা দিল।
রাজপুত্র নিজেকে বাজি রেখে তৃতীয়বার খেলতে গেল। বলল, যদি জেতে ওর মত আরেকজন রাজপুত্র এনে দিতে হবে। এবারও সুন্দরী জিতল। জিতেই রাজপুত্রকে ধরে গর্তে ভরে, তক্তা চাপা দিল।
ঐ সুন্দরী মেয়ে আসলে মানুষ ছিল না। সে একটা রাক্ষসী, মানুষের মাংস খেত। রাজপুত্রের কচি শরীর দেখে তার জিভে জল এসেছিল। কিন্তু সেদিন তার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছিল বলে, পরের দিনের জন্য গর্তে ভরে রেখেছিল।
এদিকে রাজপুত্রের বাবার প্রাসাদে কান্নাকাটি পড়ে গেছিল। ছোট ভাই রোজ একবার গিয়ে দাদার হাতে লাগানো গাছটিকে দেখে আসত। এতদিন পর্যন্ত রোজই দেখেছিল তাজা সুন্দর সবুজ পাতা, তারপর হঠাৎ সেদিন দেখল গাছের পাতা শুকোচ্ছে। অমনি ছুটে গিয়ে মা-বাবাকে সে খবর দিল। তাঁরা এই মনে করলেন যে বড় রাজপুত্রের কোন বিষম বিপদ হয়েছে।
ছোট রাজপুত্র স্থির করল, সে যাবে দাদাকে উদ্ধার করতে। যাবার আগে সে-ও ঐ রকম একটি গাছ পুঁতে, মা-বাবাকে বলে গেল, ‘গাছে যতদিন সবুজ পাতা আছে, আমিও নিরাপদে আছি, পাতা ঝরলে মার বিপদ, গাছ মরলে আমার মৃত্যু।’
এই বলে রাজার ঘোড়াশাল থেকে সবচাইতে তেজী ঘোড়া নিয়ে সে বনের দিকে ছুটল।
পথে দেখল একটা বাচ্চা নিয়ে সেই মা কুকুরটি দাঁড়িয়ে আছে। দুই রাজপুত্র অবিকল একরকম দেখতে, কুকুররা ভাবল এই বুঝি সে-ই। বাচ্চা কুকুর বলল, ‘ভাইকে নিয়েছ, আমাকেও নাও।’
রাজপুত্র বুঝল দাদাই তবে কুকুরছানা নিয়েছে, সেও অন্যটিকে তুলে নিল।
বনের মধ্যে কিছুদূর যেতেই রাজপুত্র দেখল একটি বাজপাখির ছানা গাছের ডালে বসে আছে। ওকে দেখে পাখিটি বলল, ‘ভাইকে নিয়েছ, দয়া করে আমাকেও নাও।’ রাজপুত্র বুঝল দাদাই পাখি নিয়েছে, তাহলে সে এই পথেই গেছে। খুশি হয়ে সে বাজপখিকে সঙ্গে নিল।
কুকুর আর বাজপাখি নিয়ে সে গভীর বনের মধ্যে গিয়ে একটি কুটির দেখে বুঝল এই তবে সাধুর কুটির। ঘরে কেউ ছিল না। না দাদা, না সাধু। কি করবে ভেবে না পেয়ে, ঘড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে নিজে গিয়ে কুটিরে বসে রইল। ঘোড়া ঘাস খেতে লাগল।
সূর্য ডুবলে সাধু ফিরে এসে বললেন, ‘তুমি এসেছো বলে খুশিই হয়েছি। তোমার দাদাকে এত করে বারণ করলাম, উত্তর দিকে যেও না। তা সে আমার কথা শুনল না, সেই উত্তরদিকেই গেল। সেখানে এক রাক্ষসী থাকে। তোমার দাদা নিশ্চয়ই তার খপ্পড়ে পড়েছে। কে জানে এতক্ষণে হয়ত সে তাকে খেয়ে ফেলে থাকতে পারে।’
সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্রও উত্তরদিকে রওনা দিল। হঠাৎ দেখল সামনে এক বড় হরিণ। তার গায়ে তীর মারতেই, সে ছুট দিল। সেই হরিণের পিছনে গিয়ে রাজপুত্র দেখল সেটা একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকল। সেই বাড়িতে ঢুকে রাজপুত্র আশ্চর্য হয়ে দেখল হরিণ-টরিণের চিহ্ন নেই, শুধু একজন সুন্দরী মেয়ে পাশা খেলার ছকের সামনে বসে আছে।
রাজপুত্রের বুঝতে বাকি রইল না, এই সেই দুষ্টু রাক্ষসী। দাদা এরই হাতে পড়েছে।
সুন্দরী বলল, ‘এসেছই যখন, আমার সঙ্গে একদান পাশা খেল।’
ছোট রাজপুত্র অমনি রাজি হয়ে গেল। আগের বারের মতই বাজি ধরা হল। খেলাও হল এবং রাজপুত্র জিতল। জিতে বলল, ‘তাহলে দাও ঠিক আমার বাজপাখির মত আরেকটা বাজপাখি।’
কি আর করে সুন্দরী, বড় রাজপুত্রের পাখিটা বের করে দিল। পরস্পরকে পেয়ে দুই পাখির আনন্দ দেখে কে! তারপর আরেক দান খেলা হল। আবার রাজপুত্র জিতল। এবার সুন্দরি রাজপুত্রের কুকুরছানা এনে দিল। সে দুটো তো নেচে-কুঁদে একাকার।
তারপর তৃতীয়বার খেলা হল। বলা বাহুল্য রাজপুত্র আবার জিতল। এবার সুন্দরী নানারকম ওজর দেখাতে লাগল। ‘তোমার মত রাজপুত্র এই বনের মধ্যে আমি কোথায় পাব বল দিকিনি?’
***
রাজপুত্র ছাড়বার পাত্র নয়। শেষটা বাধ্য হয়ে সুন্দরী বড় রাজপুত্রকে এনে দিল। এতদিন পরে পরস্পরকে দেখে দুই ভাই আহ্লাদে ভরপুর।
তখন রাক্ষসী রাজপুত্রদের বলল, ‘আমাকে যদি না মার, তাহলে এমন একটা গোপন কথা বলব যার ফলে বড় রাজপুত্রের প্রাণ বাঁচবে।’
ওরা বলল, ‘বল কি সে গোপন কথা?’
সুন্দরী বলল, ‘ঐ সাধু হলেন মা কালীর উপাসক। তাঁর মন্দির খুব কাছেই। উনি নিখুঁত মানুষ হবার সাধনা করছেন। তার জন্য সদ্য মরা মানুষের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। এর মধ্যে উনি ছয়টা মানুষের বলি দিয়েছেন। তাদের মুণ্ডুগুলো মন্দিরের কুলুঙ্গিতে সাজানো আছে। সাতটা মানুষ বলি দিলেই ওঁর সাধনার সিদ্ধি লাভ হবে, উনি নিখুঁত হবেন। বড় রাজপুত্র হবেন সেই সপ্তম বলি। যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়, তাহলে ঐ কালী মন্দিরে গিয়ে দেখে আসতে পার।’
রাক্ষসীর কথা শুনে রাজপুত্ররা মন্দিরে গেল। বড় রাজপুত্র মন্দিরে ঢুকবামাত্র কুলুঙ্গির মুণ্ডুগুলো বিকটভাবে হাসতে লাগল। ঐ রকম দেখে শুনে রাজপুত্রদের গায়ের রক্ত হিম! বড় রাজপুত্র বলল, ‘আমাকে দেখে তোমরা হাসছ কেন?’
মুণ্ডুগুলো বল, ‘হাসছি কারণ দুদিন বাদেই তুমি আমাদের দলে যোগ দেবে। আমরা দলে ভারি হব।’
বর রাজপুত্র বলল, ‘তার মানে কি?’
একটা কাটা মুণ্ডু সকলের হয়ে বলল, ‘রাজপুত্র। কয়েকদিনের মধ্যেই সাধুর সাধনার সিদ্ধি হবে। সেই সময় তোমাকে মন্দিরে এনে বলি দেওয়া হবে। তবে তোমার রক্ষা পাবার একটা উপায় আছে। সেটা হলে আমরাও উদ্ধার পাব।’
রাজপুত্র বলল, ‘বল সে কি উপায়। আমি কথা দিচ্ছি তোমাদের জন্য যতটা পারি করব।’
কাটা মুণ্ডু বলল, “তোমাকে বলি দেবার জন্য মন্দিরে এনেছি। সাধু বলবেন, ‘মা কালীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর।’ যেই তুমি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবে, সাধু এক কোপে তোমার মাথা কেটে ফেলবেন। আমাদের পরামর্শ শোন। তুমি সাধুর কথা শুনেই বলবে, আমি রাজপুত্র হয়ে জন্মেছি, জীবনে কখনো কারো সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিনি। কেমন করে করতে হয়, তাই জানি না। আপনি আমাকে একবার দেখিয়ে দিলে, তবে পারব।’
তারপর যেই না সাধু তমাকে দেখাবার জন্য মা-কালির সামনে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বেন, তুমি তখনি তোমার তলোয়ারের এক কোপে তাঁর মুণ্ডুটা কেটে ফেলো। যেই তাঁর মাথা কাটবে, অমরা সকলেও বেঁচে উঠব, কারণ সাধুর ক্রিয়া শেষ হবে না।’
বড় রাজপুত্র কাটা মুণ্ডুগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ছোট ভাইকে সঙ্গে করে সাধুর কুটিরে গেল।
কয়েকদিন দুজনে ফুল তুলে, বনে বেড়িয়ে কাটাল। তারপর সাধুর সাধনা শেষ হল। তার পরদিন তিনি বর রাজপুত্রকে বললেন, ‘তুমি একবার আমার সঙ্গে মা-কালীর মন্দিরে চল। কিছু দরকার আছে।’
কি দরকার সে-কথা সাধু বললেন না। কিন্তু রাজপুত্র বুঝেই নিল এবার তাকে বলি দেবার সময় হয়েছে, ছোট রাজপুত্রও দাদার সঙ্গে গেল। কিন্তু সাধু বললেন, ‘তুমি ভেতরে প্রবেশ করবে না। বাইরে অপেক্ষা কর।’
মন্দিরের দরজা ভেজিয়ে সাধু বড় রাজপুত্রকে বললেন, ‘দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর।’
রাজপুত্র বলল, ‘আমি রাজার ছেলে। আমি তো কখনো কাউকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিনি। কেমন করে করতে হয়, তাও জানি না। আপনি আমাকে দেখিয়ে দিলে, আমি খুশি হয়ে করব।’
সাধু তখন দেবীর পায়ের কাছে মাথা রেখে, উপুড় হয়ে লম্বা শুয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে বড় রাজপুত্র তার তলোয়ার তুলে এক কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলল।
অমনি কুলুঙ্গির সব কাটা মুণ্ডুগুলো জোরে জোরে হেসে উঠল। দেবী নিজে সজাগ হয়ে রাজপুত্রকে বর দিলেন, ‘ঐ সাধু নিখুঁৎ হবার আশায় এতগুলো নিষ্ঠুর হত্যা করেছে, তবু নিখুঁত হতে পারেনি। আমি বর দিলাম তার বদলে তুমি নিখুঁৎ হবে। আর এই নির্দোষ মানুষগুলো আবার বেঁচে উঠবে।’
তারপর কাটা মুণ্ডুগুলোকে তাদের ধড়ের সঙ্গে জুড়ে দেবামাত্র তারা সব বেঁচে উঠে, যে যার বাড়ি গেল। দুই রাজপুত্রও তাদের দুই কুকুরছানা আর বাজপাখি নিয়ে রাজবাড়িতে ফিরে গেল। সেখানে গাছ দুটি সতেজ সবুজ হয়ে রোদে ঝিকমিক করছিল। তখন চারিদিকে কি আনন্দ, কি আহ্লাদ।
‘আমার কথাটি ফুরোল
নটেগাছটি মুড়োল।’
***
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন