বাংলা বইয়ের দুঃখ || শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, অবিভক্ত ভারতের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তিনি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮৭ সালে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ সালে মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের ডিহিরির চাকরি চলে গেলে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৮৯২ সালে স্কুলের ফি দিতে না-পারার কারণে তাকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। সে সময় তিনি ‘কাশীনাথ’ ও ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দুটি গল্প লেখেন। ১৮৯৪ সালে এন্ট্রাস পরীক্ষা পাশ করে কলেজে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে এফএ পরীক্ষা দিতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার জন্য তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। তাঁর অনেক উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শরৎচন্দ্র রচিত বিখ্যাত উপন্যাস—বড়দিদি [১৯১৩], পরিণীতা [১৯১৪], পল্লীসমাজ [১৯১৬], দেবদাস [১৯১৭], চরিত্রহীন [১৯১৭], শ্রীকান্ত [চারখণ্ডে ১৯১৭-১৯৩৩], দত্তা [১৯১৮], গৃহদাহ [১৯২০], পথের দাবী [১৯২৬] ও শেষ প্রশ্ন [১৯৩১]। ১৯২৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেয়। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি পান। ১৯৩৮ সালে ১৬ জানুয়ারি তিনি কর্কট রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। প্রতিধ্বনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়ের অমূল্য প্রবন্ধ ‘বাংলা বইয়ের দুঃখ’ পুনর্মুদ্রণ করেছে। কারণ বর্তমান বাস্তবতায় তাঁর এই প্রবন্ধের আবেদন এখনো ফুরায়নি। শরৎচন্দ্রের লেখায় বাঙালির পাঠাভ্যাস আর বই বিমুখতার কারণ কিছুটা হলেও আঁচ করা যাবে।
প্রবন্ধ || বাংলা বইয়ের দুঃখ || শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কুমার মুনীন্দ্রদেব রায় মহাশয়ের বক্তৃতা শুনে আর কিছু না হোক অন্ততঃ একটি উপকার আমরা পেয়েছি। ইউরোপের নানা গ্রন্থাগার সম্বন্ধে তিনি যা বললেন হয়ত তার অনেক কথাই আমাদের মনে থাকবে না। কিন্তু আজ তাঁর বক্তৃতা শুনে আমাদের মনে জেগেছে একটা আকুলতা। ইউরোপের গ্রন্থাগারের অবস্থা যে-রকম উন্নত, সে-রকম অবস্থা যে আমাদের দেশে কবে হবে—তা কল্পনাও করা যায় না। তবে যেটুকু হওয়া সম্ভব, তার জন্যে আমাদের চেষ্টা করা উচিত। চারিদিক থেকে অভিযোগ ওঠে, আমাদের গ্রন্থাগারে ভাল বই নেই,—আছে কেবল বাজে নভেল। আমাদের লেখকেরা জ্ঞানগর্ভ বই লেখেন না। তাঁরা কেবল গল্প লেখেন। কিন্তু তাঁরা লিখবেন কোথা থেকে? এই অতিনিন্দিত গল্প লেখকদের দৈন্যের সীমা নেই। অনেকেরই উপন্যাসের হয়ত দ্বিতীয় সংস্করণ হয় না। যা বা লাভ হয় সে যে কার গর্ভে গিয়ে ঢোকে তা না বলাই ভাল। অনেকের হয়ত ধারণাই নেই যে, এই-সব লেখক-সম্প্রদায় কত নিঃস্ব, কত নিঃসহায়।
বিলাতে কিন্তু গল্পলেখকদের অবস্থা অন্যরকম। তারা ধনী। তাদের এক-একজনের আয় আমরা কল্পনা করতেও পারিনে। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের পুস্তকের সংস্করণের পর সংস্করণ হয়। কারণ ও-দেশে অন্ততঃ সামাজিকতার দিক থেকেও লোক বই কেনে। কিন্তু আমাদের দেশে সে বালাই নেই। ও-দেশে বাড়িতে গ্রন্থাগার রাখা একটা আভিজাত্যের পরিচয়। শিক্ষিত সকলেরই বই কেনার অভ্যাস আছে। না কিনলে নিন্দে হয়,—হয়ত বা কর্তব্যেরও ত্রুটি ঘটে। আর অবস্থাপন্ন লোকদের তো কথাই নেই। তাঁদের প্রত্যেকেরই বাড়িতে এক-একটা বড় গ্রন্থাগার আছে। পড়ার লোক থাকুক বা না-থাকুক—গ্রন্থাগার রাখাই যেন একটা সামাজিক কর্তব্য। কিন্তু দুর্ভাগা জাত আমরা। আমাদের শিক্ষিতদের মধ্যেও পুস্তকের প্রচলন নেই।
অনেকে হয়ত মাসিক পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে সমালোচনার ছলে শুধু গালিগালাজের উপকরণ সংগ্রহ করে নেন। যদি খোঁজ নেন তো দেখতে পাবেন, তাঁদের অনেকেই মূল বইখানা পর্যন্ত পড়েননি। আমি নিজেও একজন সাহিত্য-ব্যবসায়ী। নানা জায়গা থেকে আমার ডাক আসে। অনেক বড়লোকের বাড়িতে আমি গেছি। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাঁদের আছে সবই—নেই কেবল গ্রন্থাগার। বই কেনা তাঁদের অনেকের কাছেই অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। যাঁদের বা একান্তই আছে, তাঁরা কয়েকখানা চকচকে বই বাইরের ঘরে সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু বাংলা বই মোটেই কেনেন না।
তাই বাংলায়—যাকে আপনারা জ্ঞানগর্ভ বই বলছেন—সে হয় না, কারণ বিক্রি নেই। বিক্রি হয় না বলেই প্রকাশকেরা ছাপাতে চান না। তাঁরা বলেন, ও-সবের কোন চাহিদা নেই—নিয়ে এসো গল্প। লোকে ভাবে, গল্পলেখাটা বড়ই সোজা। শুভানুধ্যায়ী পাড়ার লোকে যেমন অক্ষম আত্মীয়কে পরামর্শ দেয়—তোকে দিয়ে আর কিছু হবে না, যা তুই হোমিওপ্যাথি কর্গে যা। অথচ হোমিওপ্যাথির মত শক্ত কাজ খুব কমই আছে। এর কারণ হচ্ছে, যে জিনিসটা সকলের চেয়ে শক্ত, তাকেই অনেকে সবচেয়ে সহজ ধরে নেয়। ভগবান সম্বন্ধে কথা বলা যেমন দেখি, তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা করতে কারও কখনো বিদ্যেবুদ্ধির অভাব ঘটে না।
কত বড় বড় কবি উৎসাহের অভাবে নাম করতে পারেননি। পরলোকগত সত্যেন দত্তর শোক-বাসরে গিয়ে দেখেছিলুম, অনেকে সত্যিই কাঁদছেন। তখন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলুম—কড়া কথা বলা আমার অভ্যাস আছে, এ-রকম ক্ষেত্রে কড়া কথা মাঝে মাঝে বলেও থাকি—সেদিন বলেছিলুম, এখন আপনারা কেঁদে ভাসাচ্ছেন। কিন্তু জানেন কি যে, বারো বছরে তাঁর পাঁচ-শ-খানা বই বিক্রি হয়নি? অনেকে বোধকরি তাঁর সব পুস্তকের নাম পর্যন্ত জানেন না। অথচ, আজ এসেছেন অশ্রুপাত করতে।
গল্প লেখকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে কি হবে? টাকার অভাবে কত ভাল ভাল কল্পনা—কত বড় বড় প্রতিভা যে নষ্ট হয়ে যায়, তার খবর কে রাখে? যৌবনে আমার একটা কল্পনা ছিল,—একটা উচ্চাশা ছিল যে,—দ্বাদশ মূল্য—নাম দিয়ে আমি একটা volume তৈরি করব। যেমন সত্যের মূল্য, মিথ্যার মূল্য, মৃত্যুর মূল্য, দুঃখের মূল্য, নরের মূল্য, নারীর মূল্য—এই রকম মূল্য-বিচার। তারই ভূমিকা হিসাবে তখনকার কালে—নারীর মূল্য—লিখি। সেটা বহুদিন অপ্রকাশিত পড়ে থাকে।
পরে—যমুনা—পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বটে, কিন্তু সেই—দ্বাদশ মূল্য—আর শেষ করতে পারিনি, তার কারণ—অভাব। আমার জমিদারি নেই, টাকা নেই, তখন এমন কি দু-বেলা ভাত জোটাবার পয়সা পর্যন্ত ছিল না; প্রকাশকেরা উপদেশ দিলেন, ও-সব চলবে না। তুমি যা তা করে তার চেয়ে দুটো গল্প লিখে দাও,—তবু হাজারখানেক কাটবে। আমাদের জাতির বৈশিষ্ট্যই বলুন, কিংবা দুর্ভাগ্যই বলুন, বই কিনে আমরা লেখকদের সাহায্য করি না। এমন কি যাঁদের সঙ্গতি আছে—তাঁরাও করেন না। বরং অভিযোগ করেন, গল্প লিখে হবে কি? অথচ আজ অন্তঃপুরে যেটুকু স্ত্রীশিক্ষার প্রচার হয়েচে, তা এই গল্পের ভেতর দিয়েই।
কত বড় বড় কবি উৎসাহের অভাবে নাম করতে পারেননি। পরলোকগত সত্যেন দত্তর শোক-বাসরে গিয়ে দেখেছিলুম, অনেকে সত্যিই কাঁদছেন। তখন অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলুম—কড়া কথা বলা আমার অভ্যাস আছে, এ-রকম ক্ষেত্রে কড়া কথা মাঝে মাঝে বলেও থাকি—সেদিন বলেছিলুম, এখন আপনারা কেঁদে ভাসাচ্ছেন। কিন্তু জানেন কি যে, বারো বছরে তাঁর পাঁচ-শ-খানা বই বিক্রি হয়নি? অনেকে বোধকরি তাঁর সব পুস্তকের নাম পর্যন্ত জানেন না। অথচ, আজ এসেছেন অশ্রুপাত করতে।
আমাদের বড়লোকেরা যদি অন্ততঃ সামাজিক কর্তব্য হিসাবেও বই কেনেন, অর্থাৎ যাতে দেশের লেখকদের সাহায্য হয়—এমন চেষ্টা করেন, তাতে সাহিত্যের উন্নতিই হবে। লেখকেরা উৎসাহ পাবেন, পেটে খেতে পাবেন, নিজেরা নানা বই পড়বার অবসর পাবেন। এর ফলে তাঁদের জ্ঞানবৃদ্ধি হবে, তবে ত তাঁরা—জ্ঞানগর্ভ—বই লিখতে পারবেন।
রায় মহাশয়ের বক্তৃতা শুনে আর একটা কথা বেশী করে আমাদের নজরে পড়ে যে, ও-দেশের যা কিছু হয়েছে, তা করেছে ও-দেশের জনসাধারণ।
তারা মস্ত লোক। তাদেরই মোটা মোটা দানে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমরা প্রায়ই সরকারকে গালাগালি দিই। কিন্তু এই আমাদের দেশবন্ধুর স্মৃতিভাণ্ডার ভরল কতটুকু! তিনি দেশের জন্যে কত করেছেন। তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্যে কত আবেদনই না বেরুল। কিন্তু সে ভিক্ষাপাত্র আজও আশানুরূপ পূর্ণ হল না; অথচ ইংলণ্ডে ‘ওয়েস্টমিনস্টার এবি’র এক কোণে যখন ফাটল ধরে, সেখানকার ডীন কুড়ি লক্ষ পাউন্ডের জন্যে এক আবেদন করেন। কয়েক মাসের মধ্যে এত টাকা এল যে, শেষে তিনি সেই ফন্ড বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ দাতারা নাম বাজাবার জন্যে যে দান করেননি তা স্পষ্ট বোঝা যায়, কারণ কাগজে কারোরই নাম বেরোয়নি। এতটা সম্ভব হয় তখনই যখন লোকের মধ্যে স্বদেশ সম্বন্ধে একটা প্রবুদ্ধ মন গড়ে ওঠে।
আমার প্রার্থনা, কুমার মুনীন্দ্রদেব রায় মহাশয় দীর্ঘজীবী হোন। তাঁর এই প্রারব্ধ কাজে উত্তরোত্তর সাফল্যলাভ করুন। ওঁর কথা শুনে আমাদের মনে জাগে আকুলতা। যাঁর যে পরিমাণ শক্তি লাইব্রেরি আন্দোলনের জন্যে তাই দেন ত দেশের কাজ অনেক এগিয়ে যাবে। আমাদের নিজেদের দেখার হয়ত অবসর ঘটবে না। কিন্তু আশা হয়, আজকের দিনে যাঁরা তরুণ,—যাঁরা বয়সে ছোট, তাঁরা নিশ্চয়ই এ কাজের কিছু ফল দেখতে পাবেন।
‘কোন্নগর পাঠচক্র’র চেষ্টায় এই যে সব মূল্যবান কথা শুনা গেল, তার জন্যে বক্তা এবং সভ্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিই। আজ বড় আনন্দ পেলাম,—শিক্ষা পেলাম, মনের মধ্যে ব্যথাও পেলাম। কোথায় ইউরোপ আর কোথায় আমাদের দুর্ভাগা দেশ! যুগযুগান্তের পাপ সঞ্চিত হয়ে আছে। একমাত্র ভগবানের বিশেষ করুণা ছাড়া পরিত্রাণের আর তো কোন আশা দেখি না।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন