আপনি আচরি সদাচার [২য় পর্ব]
পড়ুন ► আপনি আচরি সদাচার [১ম পর্ব]
৫ || সংস্কৃতি ও রাজনীতি
বিংশ শতকের মার্কসবাদী হাঙ্গেরিয়ান দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ গেয়র্গে লুকাচ [György Lukács] ১৯১৯ সালে হাঙ্গেরির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক ডেপুটি কমিশনার থাকার সময় তৎকালীন হাঙ্গেরিয়ান পত্রিকা রেড নিউজ-এ লিখেছিলেন, ‘Culture is the end, politics is the means।’ রাজনৈতিক কার্যক্রমের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য সংস্কৃতি বিনির্মাণ। রাজনৈতিক উপায়ে পূরণ হয় সাংস্কৃতিক লক্ষ্য। সংস্কৃতি ফল, রাজনীতি উপায়। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, বিকশিত হয়, বিস্তার লাভ করে, প্রতিষ্ঠিত হয়, স্ফূর্তি পায়, চর্চিত হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে, রাজনৈতিক সহায়তায় মানুষের নিত্য চর্যায়। নানাভাবে ব্যাহত, প্রতিরুদ্ধ, ত্রস্ত, এমনকি নিষিদ্ধও হতে পারে। রাজনৈতিক অসহযোগিতার কারণে সংস্কৃতির চলমানতা, সংস্কার, সমৃদ্ধি, নবায়ন, পুনর্জাগরণ, সৃষ্টি ও প্রাগ্রসরের স্বতঃস্ফূর্ততা রাজনৈতিক অসহযোগিতার ফলে। সংস্কৃতি যে নিত্য হতে পারে না, সদাপরিবর্তন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়, তার পেছনে থাকে নানাবিধ পুশ ও পুল ফ্যাক্টর। অর্থাৎ, কিছু ফ্যাক্টর সংস্কৃতির উপর চেপে বসে, সংস্কৃতিকে ঠেলা মারে, ধাক্কা দিয়ে সরায়, সংস্কৃতির দিক ও মুখ বদলে দেয়। কিছু ফ্যাক্টর সংস্কৃতিকে টানতে থাকে নতুন রূপ ধারণ করে নতুন যাত্রাপথ অভিমুখে, পাতিত করে, আবার পতিতও করে, বিকৃত করে ফেলে। রাজনীতি সংস্কৃতিকে টেনে নতুন পথে নেয় যেমন, তেমনি পথচ্যুতও করার ক্ষমতা ধারণ করে। প্রাকৃতিক পরিবর্তন, বিপর্যয়, দুর্যোগ, মহামারী, দারিদ্র্য, বিত্ত-বৈভব, পুঁজি, নবচিন্তা, দর্শন ও ধর্মের আবির্ভাব, শিক্ষা, শিক্ষাহীনতা, অপশিক্ষা, নয়া নয়া বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তির উদ্ভাবন, প্রয়োগ ও বিস্তার, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব, মানচিত্রের পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ, বিরোধ ও নতুন মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা, জীবনের প্রয়োজন ও জীবনযাপন বিযুক্তি ইত্যাদি কতকিছুই না সংস্কৃতিকে টেনে ধরে অথবা ধাক্কা দিতে থাকে অব্যাহতভাবে! তার মধ্যে সংস্কৃতি চলমান থাকে আপন গতিতে। সংস্কৃতিহীন মানুষ অস্তিত্বহীনই বটে। মানুষ থাকলে সংস্কৃতি থাকে অবিচ্ছেদ্যভাবে। কিংবা মানুষ থাকলেই সংস্কৃতি থাকে। কিন্তু আধুনিকালে ফ্যাক্টর হিসেবে রাজনীতি অতি মহাশক্তিধর হয়ে উঠেছে। রাজনীতি শুভশক্তির চর্চা যেমন করে, তেমনি অশুভশক্তি হয়ে উঠতে কসুর করে না। অথচ, রাজনীতি এমন এক ব্যবস্থা যা মানুষের সংস্কৃতি থেকেই উদ্ভূত, মানুষের কল্যাণার্থে। রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়া। যারা রাজনীতিক, তাদের কেবলই জনসাধরণের পরিচালক হবার কথা। কিন্তু পরিচালক হবার বদলে ক্ষমতার মালিক হয়ে উঠতে চেয়ে রাজনীতিকগণ সকল মানুষের মধ্যে হয়ে উঠতে চায় ‘অধিক’ মানুষ। শ্রেষ্ঠ। ক্ষমতাশালী। প্রভু। ফলে, মানুষের সুরক্ষা কবচ না হয়ে রাজনীতি হয়ে ওঠে শাসকের নাগরিক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। তখন রাজনীতি প্রথমেই চাপ সৃষ্টি করে সংস্কৃতির উপর। ভাষার উপর। মানুষের বৈচিত্র্যময় অভিব্যক্তির উপর। পোশাকের উপর। নারী-পুরুষের সম্পর্কের উপর। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ভেঙে দিয়ে প্রয়োগ করতে চায় ডিভাইড এন্ড রুল পদ্ধতি। যে রাজনীতি সংস্কৃতির লক্ষ্য পূরণের উপায়, সেই রাজনীতিই আবার সংস্কৃতি বিধ্বংসী দানবের ভূমিকায় নামে। অতএব, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-মধুর, আপেক্ষিক এবং রাজনীতিকের ইচ্ছের ক্রীড়া। রাজনীতি সংস্কৃতির সাহস এবং ভয়, একইসঙ্গে।
মানুষের আচার-আচরণ, ব্যবহার ও কার্যক্রমই সংস্কৃতি। সংস্কৃতিসহই মানুষ, মানুষের মানবিক পরিচয়, যা তাকে অপরাপর প্রাণীকুল থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করে। অন্যদিকে, রাজনীতি মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যেতে পারে, যায়, মানুষের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থের কলকাঠি হতে গিয়ে। তখন মানুষের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, পানীয়, সংগীত, সম্পর্ক, অভিব্যক্তি, শিল্প, ব্যবহার্য দ্রব্য, বাক্য, বাকভঙ্গি নির্দিষ্ট করে দিতে থাকে। সংস্কৃতির চেয়ে ব্যবসা, বিত্ত, প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব রাজনীতি জনগণকে গেলায়। যেমন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে অনেক দেশেই নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ হয়, ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে হয়, পোশাক বদলে ফেলতে হয়, জনসাধারণের মুখে রাজনীতি-বান্ধব ভাষা ও ভাষার শব্দাবলী এবং পরিভাষা আরোপ করা হয়। ফলে, সংস্কৃতি স্বতঃস্ফূর্ততার পাটাতন হারিয়ে প্রথমে সংকোচিত, তারপর বিলুপ্ত হয়। মধ্যযুগে আরবি হরফে বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে, ভাবা যায়! নিকট অতীতে চেষ্টা হয়েছে উর্দু হরফে বাংলা লেখার। রাজনৈতিক কারণেই, বাঙালির রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া নিষিদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা-পূর্ব সাম্প্রদায়িক পাক সরকার। বাংলা ভাষায় বহিরাগতদের মুখ থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বানিজ্যিক রাজনীতির কারণেই ক্রমে ঢুকেছে পর্তুগীজ, বর্মিজ, ফার্সি, আরবি, ইংরেজি, তার্কিশ কত কি! হাজার বছর প্রাচীন চর্যাপদের সাহিত্যভাষা থেকে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যভাষা কতই না আলাদা। মৌখিক ও পরিবেশনামূলক সাহিত্যের ভাষায় পরম্পরাগতভাবে লক্ষণীয় স্থানীয় দেশি শব্দের বৈচিত্রময় প্রয়োগ। ভাষাকে সাহিত্য উপযুক্ত করার নামে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বৈপ্লবিক শৈল্পিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সাহিত্যসাধকগণ তা নেননি, নিতে পারেননি সম্ভবত। বঙ্কিমের ভাষা সুপ্রিম হয়েও বাংলা সাহিত্য পরম্পরার উত্তরাধিকার হতে পারেনি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভাষা ক্রমে নিকটবর্তী হয়েছে মুখের ভাষার। তাতেও রকমফের কম দেখা যায় না। কেউ কেউ ইংরেজির মিশ্রণকে, তৎসম বুলির প্রায়োগকে স্বাভাবিক করে তুলতে চেয়েছেন, কেউ কেউ আরবি-ফার্সির প্রতি ঝুঁকেছেন বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র বাংলা ভাষা বিকাশের প্রয়াসে। কি ভালো আর কি মন্দ তা নিয়ে তর্ক সংস্কৃতি প্রবাহপথের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নাই অবশ্য। সংস্কৃতির পরিবর্তন ঠেকানো যায় কমই। সংস্কৃতির প্রধান বাহন হিসেবে ভাষা, সুতরাং এগিয়েছে বহুমাত্রিক রূপ-রূপান্তরের ভেতর দিয়ে। আসলে এসব ঘটে রাজনীতির সঙ্গে অরাজনৈতিক অথচ আগ্রাসী মতাদর্শের দাপটে। রাজনীতি যখন অধীন হয় পুঁজির, ধর্মের, ধনিকের, বণিকের, তখন তার নিজস্ব উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়ে সে ছোটে কেবলই ক্ষমতার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে। রাজনীতিতে তখন কেবল গণ্য হয় রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক পক্ষগণের স্বার্থ। মানুষ, মানুষের সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে, পড়েও। তখন, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি দৃশ্যমান হয় কেবল। বলা যায় ব্যক্তির স্ফূরণ ঘটে, সমাজ ভেঙে পড়তে থাকে। সমাজ ও সংস্কৃতিহীন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। সংস্কৃতি বলতে তখন যা বোঝায়, তা অপসংস্কৃতি। আত্মপরিচয় ফলে অচিহ্নিত হয়ে ওঠে। তবে, রাজনীতি বলতে রাষ্ট্র-অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থামাত্র আর নয়। অপরাপর রাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পৃক্ততাও সক্রিয়ভাবে ক্রীড়া করে, সংস্কৃতি রূপান্তরের ক্ষেত্রে। তদুপরি যোগাযোগ, বৈশ্বিক বানিজ্য ও তথ্য-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি রাজনৈতিক শক্তিতে নতুন নতুন মাত্রা দান করে। বিশ্বময় প্রবাহিত সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যে বিশ্ববিন্যাসের ঐক্য তৈরি হয়, হয়েছে, হবেও। রাজনীতির কেন্দ্রস্থল থেকে মানুষকে খেদিয়ে ক্ষমতার অভ্যুত্থান ঘটার কারণে সংস্কৃতি ক্রমে অনুষ্ঠান ও সংরক্ষণাগারের শ্বাসরুদ্ধকর চেম্বারে আটকা পড়ে, পড়ছে, নিষিদ্ধ হচ্ছে, ক্ষমতা দ্বারা নির্দেশিত হচ্ছে। সংস্কৃতিকে জোর করে বাঁধার চেষ্টা কম নেই। নদীর প্রবাহ যেমন বল করে আটকানো হয় বাঁধ দিয়ে, নদীকে শাসন করা হয় যেমন সেতু বানানোর প্রয়োজনে এবং এভাবে অবশেষে নদী হয়ে ওঠে চর সর্বস্ব, মৃত; তেমনি নিষেধের ত্রাসে, ক্ষমতার তোষণে সংস্কৃতি ভরে ওঠে বিচিত্র চাপানো ‘অপ’ দ্বারা। তৈরি হয় সংস্কৃতির সংকট।
সংস্কৃতির সংকট তো আসলে মানুষেরই সংকট। সংকট উত্তরণের সকল ক্ষমতা রাজনীতির হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে এমন ভাবনা আত্মবিনাশী হলেও, আজকের সমাজে এটাই বাস্তবতা। কেননা, রাজনীতি উঠেছে পেশাদার গোষ্ঠীর হাতে। পেশাদার রাজনীতিকদের বোঝানো মুশকিল যে, রাজনীতিতে প্রত্যেক মানুষের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই সংস্কৃতির মুক্তি ঘটবে। সংস্কৃতি আসলে সার্বিক মানব ও মানবতার মুক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। সংস্কৃতিই প্রাণ। প্রাণের অধিকার মানুষ শেষ পর্যন্ত ছাড়বে না, ছাড়তে পারবে না, আত্ম-অস্তিত্বের স্বার্থেই। যখন মূল হারিয়ে প্রাণে টান পড়বে, মানুষ ঠিক জাগবে। সংস্কৃতির নবজোয়ার রচিত হবে। মানুষ রাজনৈতিকভাবেই ব্যক্তিক, সামাজিক, সামষ্টিক, জাতিগত আত্মমুক্তি, অর্থাৎ, সংস্কৃতির মুক্তি রচনা করবে। রাজনীতিকেই সংস্কৃত হতেই হবে। সংস্কৃতি অতি ব্যাপক সুবিস্তৃত ছাতা। তারই ছায়ায় রাজনীতি পথ পেতে পারে। সংস্কৃতি থেকে চ্যুত হলে রাজনীতিরই বিপদ। যেমন বিপদগ্রস্ত সংস্কৃতি-বিচ্যুত ব্যক্তি, সংস্কৃতি-ত্যাগী সমাজ ও ব্যক্তি। সংস্কৃতি ও রাজনীতির পরস্পারিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির ইতহিাসের এক বিশিষ্ট বাস্তবতা হিসেবে দেখা গিয়েছিল। বিশ্বে এমন উদাহরণ বিস্তর। ফরাসি বিপ্লব, অক্টোবর বিপ্লব—সবখানেই সংস্কৃতির প্রভাব, মানবিক অনুভূতির সঙ্গে রাজনীতির ঐক্যের ইতিহাস। রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তনের হাত ধরে সংস্কৃতিতে যে অবনমন আজকে দৃশ্যমান, তা অবশ্যই বদলাবে। সংস্কৃতি পূর্ণ শক্তিতে আত্মপরিচয়ের বাহনরূপে পুনরাবির্ভুত হবে। সংস্কৃতি-রাজনীতির পারস্পারিকতার পুনরুজ্জীবন ঘটবেই।
৬ || রাজনীতি ও প্রশাসনে সদাচার
বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করেছে। সদাচার অর্থেই পরিভাষাগতভাবে ‘শুদ্ধাচার’ প্রয়োগ করা হয়েছে। শুদ্ধাচারকে চরিত্রনিষ্ঠা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সুশৃঙ্খল, শন্তিপূর্ণ, সমসন্তুষ্টির, সৌহার্দ্যের, সম্প্রীতির ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, বানিজ্যিক, পেশাদারী, শৈল্পিক, পরিশীলিত, উন্নত জীবন-যাপন সমুন্নত রাখার স্বার্থে গ্রহণযোগ্য সর্বজনীন আচরণ, কর্তব্যনিষ্ঠা, রীতিনীতি, অভ্যাস ও দায়িত্বশীলতা অর্জনের চর্চাকেই শুদ্ধাচার বলতে হবে। তার মানে সংস্কৃতি শুদ্ধাচারের চর্চার ভেতর দিয়েই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শুদ্ধাচার কৌশলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শুদ্ধাচার চর্চা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করে রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রতি অর্থ বছরের জন্য শুদ্ধাচার কৌশল কর্ম-পরিকল্পনা প্রস্তুত করে এবং বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। পদক্ষেপ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ‘মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত কর্মচারীদের পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্যে’ নীতিমালাও প্রণিত হয়েছে। নীতিমালায় নির্দিষ্ট গ্রেডভূক্ত পুরস্কারপ্রাপ্য যাগ্য কর্মচারী নির্বাচন করার দশটি করে মূল্যায়ন সূচকও নির্ধারিত হয়েছে। যেমন, গ্রেড ২-৯ ভূক্ত কর্মচারীদের শুদ্ধাচার পুরস্কার মূল্যায়ন সূচক: ১. সততা ও নৈতিকতা; ২. সেবাগ্রহীতাদের সেবা প্রদান; ৩. পেশাগত দক্ষতা ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার (ই-নথি, ই-সার্ভিস ইত্যাদি); ৪. অধস্তন কর্মচারীদের তত্ত্বাবধান ও পরীবিক্ষণ; ৫. দলগত কাজের সমন্বয়; ৬. সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ; ৭. বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি এবং শুদ্ধাচার কৌশল কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপরতা; ৮. কর্তব্যনিষ্ঠা ও স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ; ৯. উদ্ভাবন ও সংস্কার কার্যক্রমে আগ্রহ; ১০. ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন। ১০ থেকে ১৬ এবং ১৭ থেকে ২০ গ্রেডভূক্ত কর্মচারীদের জন্যও রয়েছে অনুরূপ মূল্যায়ন সূচক।
প্রশাসনিক পর্যায়ে এমতো পদক্ষেপের পরও দুর্নীতিজনিত লজ্জা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। আইন, নীতি ও কৌশলগত শক্ত অবস্থান সত্ত্বেও মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ঘুষ লেনদেন, অর্থ পাচার, ঋণ কেলেঙ্কারি, জুয়া, জনগণের প্রশাসনিক সেবা-বঞ্চনা, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, বায়াসনেস থেকে মুক্ত না হবার কারণ হিসেবে চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতিগত বিপর্যয়কে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, সুশাসন সম্পর্কে ধারণা ও অনুশীলনগত ঘাটতি রাষ্ট্রীয় কর্মচারী এবং সর্বসাধারণের মধ্যে দৃশ্যমানভাবে প্রকট। সুশাসন এমন এক আদর্শিক প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা যা রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গসমূহ এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিসরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি ঘটায়। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জাবাবদিহিতা, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা, আইনের শাসন, কর্তব্য প্রতিপালন, মানবাধিকারের চর্চা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন ও অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমেই কেবল সুশাসন নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। রাজনীতি বিজ্ঞান সুশাসনের কতক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছে। বৈশ্বিক অঙ্গনে এবং যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রে তা মান্য। রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতি, আইন, পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও সংশ্লিষ্ট কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করতে হয় অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা, জাবাদিহিতা, ঐক্যমত, সংবেদনশীলতা, আইনানুগতা, সমতা ও অন্তর্ভূক্তি এবং দক্ষতা ও কার্যকারিতা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী, পুরুষ, ধনী, গরিব, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তরুণ-তরুণী সকলের অংশগ্রহণ সুশাসনের একটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের দৃশ্যমান প্রতিফলন প্রশাসনিক পর্যায়ে দেখতে চাইলে শিক্ষা পদ্ধতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগের যথাযোগ্য মাধ্যমে রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিমনস্ক জনসাধারণকে অংশগ্রহণের যোগ্য করে তুলতে হয়। অংশগ্রহণের যোগ্যতা কেবল কর্মদক্ষতা নির্ভর হতে পারে না, চিন্তার সম্পষ্টতা ও মানবিক, সামাজিক, দেশজ ও বৈশ্বিক সংবেদনশীলতার প্রয়োজন হয়। সে প্রয়োজনীয়তা পূরণের দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচারের সংস্কৃতি উপদেশ ও উৎসাহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। সুশাসনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা। এর মানে কার্য বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সেবা সম্পর্কিত কোনো তথ্যই সেবা পাবার অধিকারী এবং অপরাপর যেকোনো পক্ষের কাছে গোপন থাকবে না। কাজ বা সেবার খাতওয়ারি বাজেট, সংশ্লিষ্ট নীতিমালা, সিদ্ধান্ত, কার্যফল ইত্যাদি সকল প্রকার তথ্য উন্মুক্ত থাকবে অথবা আগ্রহী যেকোনো নাগরিক জানতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোথাও কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার ব্যাখ্যা তুলে ধরবেন, কারণ দর্শাবেন, অর্থাৎ জবাবদিহি করবেন। জবাবদিহিতা না থাকার অর্থ হলো সুশাসন না থাকা। সুশাসনে ভিন্নমত ও বিভিন্ন মতাদর্শের প্রতি পারস্পারিক সহিষ্ণুতা ও মনেযোগ থাকে। তবে বৃহত্তর, সামাজিক, সামষ্টিক, রাষ্ট্রীয়, আইনী, নৈতিক, সর্বজনীন কল্যাণ স্বার্থে ঐত্যমত প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ঐক্যমত প্রত্যেক পক্ষের সহমত নাও হতে পারে, তবে সর্বোচ্চ ঝুঁকি মোকাবেলার মাধ্যমে সবচেয়ে দুর্বলের সমস্যা সমাধানের স্বার্থে গৃহীত মতামত। ঐক্যমতই সিদ্ধান্ত। তবে সিদ্ধান্ত একবার গৃহীত হলে তা পালনীয় সর্বস্তরে। এক্ষেত্রেও ঘাটটি দূর করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যুক্তিসঙ্গত সময়সীমার মধ্যে ন্যায্য পদ্ধতিতে স্বচ্ছভাবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার সংবেদনশীলতা সেবা প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং সেবা গ্রহীতা এবং নাগরিক সমাজের থাকলে তবেই সুশাসন কার্যকর হবার রাস্তা পায়। সংবেদনশীলতার প্রথম গুণ হলো সেবাপ্রার্থীর বা সেবা প্রাপকের চাহিদা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, অভ্যাস, সংস্কৃতি, আবেগ ও অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। সেবাদাতা হবার শ্রেষ্ঠত্ববোধ পরিত্যাগ করে সেবাগ্রহীতার সন্তুষ্টিবোধের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আইন এই জন্যই তৈরি হয়, যাতে ক্ষমতাবান আধিপত্যবাদী না হয় ক্ষমতাহীনের উপর। আইনের চোখে সবাই সমান। প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং রাষ্ট্রীয় সেবা কার্যক্রমে তাই আইনের শাসন আবশ্যক। কেবল আইন থাকলেই সুশাসন রয়েছে বলা যায় না। আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগই আসল কথা। সংবিধান, নীতিমালা, আইন, বিধি, প্রবিধি, পরিপত্র সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই। সুযোগ, অধিকার পাবার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি কর্তব্য পালনে সকলে সমান। সকলের মধ্যে প্রত্যেকে অন্তর্ভূক্ত। ধর্ম, গোত্র, অর্থনৈতিক অবস্থা, লৈঙ্গিক পরিচয়, জাতিগত ভিন্নতা, পরিধেয়ের পার্থক্য, প্রতিবন্ধিতা, রাজনৈতিক পরিচয়, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ব্যক্তিগত বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সকলেরই সুযোগ ও অধিকার সমান। সমান কথাটিও ততখানি সরল নয়। পিপাসার্তের জন্য পানি এবং বস্ত্রহীনের জন্য বস্ত্র আর অপুষ্টির শিকারের জন্য পুষ্টিকর খাবার—এর নামই সমতা। পিপাসার্ত, বস্ত্রহীন, অপুষ্টির শিকার সবাইকে পানি প্রদান করলে সমতা বিধান হয় না, বরং তাতে বস্ত্রহীন ও অপুষ্টির শিকার ব্যক্তি বা শিশু বঞ্চিত হয়, বৈষম্যের শিকার হয়। বেশি ধনীদের অর্থ ও সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে অতি দরিদ্রদের জীবন-যাপনের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারলেই সমতার নীতি সুরক্ষিত হয়েছে বলা যাবে। সুশাসন অধিক অতিরিক্ত ভোগ ঠেকায় এবং বঞ্চনার নিরসন করে। পেছনের সারির মানুষকে টেনে সামনে নিয়ে এসে সকলকে এক কাতারে মোলাকাত করানোর জন্য প্রশাসনে ও প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন হয় আইন, নীতি, সিদ্ধান্ত, বরাদ্দ ঐক্যমতের ভিত্তিতে স্বচ্ছভাবে, জবাবদিহির মাসসিকতা নিয়ে বাস্তবায়নের যথাযথ দক্ষতা—তাহলেই প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা প্রমাণ হয়, সুশাসনের অস্তিত্ব স্পষ্ট অনুভব করা সম্ভব হয়। ব্যক্তিগত সদাচার ও প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার প্রতিপালন নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য, তবে তা বিচ্ছিন্নভাবে কার্যকর করে তোলা অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হয়, বিশেষ করে আইনী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায়। রাষ্ট্রে শুদ্ধাচারের চর্চা হতে হবে সমন্বিতভাবে। শিক্ষায়, পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতিতে, প্রচার মাধ্যমে, আজকের প্রযুক্তি নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বোত্রই শুদ্ধাচারী সংস্কৃতি সৃষ্টি, বিকাশ, প্রতিপালন, উদ্যাপনের মাধ্যমেই আসবে প্রত্যাশিত দুর্নীতিশূন্য সুশাসনের দিন। একরাতের দৈবচক্রে এমন স্বপ্নের বাস্তবায়ন অলীক প্রত্যাশা হবে। দূরদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত, যোগাযোগ সম্পর্কিত, স্থানীয়, বৈশ্বিক পরিবর্তন, ঝুঁকি, সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেই দীর্ঘমেয়াদী বাস্তব সম্মত সকলের কল্যাণের পরিকল্পনা আমাদের প্রস্তুত করতে হবে এবং তা কার্যকর করার কঠোর সংগ্রাম সততার সঙ্গে করতে হবে প্রজন্মকে প্রস্তুত করে নিয়ে। শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই।
আরও বলতে হয় যে, শুদ্ধাচারের নীতি মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্টভাবে প্রযোজ্য করার মতো বিচ্ছন্ন পদক্ষেপ সদাচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না। বান্তবে রাজনীতিই প্রশাসনিক সংস্কৃতির প্রধান প্রভাবক। রাজনীতির প্রতিনিধিগণের নীতি-নৈতিকতার প্রতিফলন প্রশাসনিক আচরণে ঘটে। প্রশাসনিক আচার-আচরণে রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা-সিদ্ধান্তের প্রভাব তৈরি হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে রয়েছে। কাঠামোগত চেইন অফ কমাণ্ড তার মধ্যে একটিঅ যদিও, রাজনীতি বিজ্ঞানীগণ রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্পর্ককে জটিলভাবে বর্ণনা করে থাকেন। একদল মনে করেন, রাজনীতি ও প্রশাসন স্বতন্ত্র। আরেক দল রাজনীতি ও প্রশাসনের পারস্পারিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাদের দুইকে অবিচ্ছেদ্য এবং একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠরূপে দেখেন। কেউ বলেন, ‘Politics—administration dichotomy refers to the view that public administration should be premised on a science of management and kept separate from traditional partisan politics and general policy making’। আরও বলা হয়, ‘Politics is the proper activity of administration legislative bodies and other policy-making groups. The administration is the proper activity of administrators, who carry out the policies stated in the laws of the jurisdiction or political unit’। অন্য দলের মতামত হলো, ‘Government is a continuous process. It is true that the process contains phases. Legislation is one phase, administration another. But these are merged together and at certain points become indistinguishable’। তাদের কথা হলো, ‘The exercise of discretionary power, the making of value choices, is a characteristic and increasing function of administration and bureaucrats; they are thus importantly engaged in politics’। এর আলোকে, রাষ্ট্র কাঠামোর, অর্থাৎ, সংবিধান, রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গসমূহের ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা, স্বাতন্ত্র্য, সক্ষমতা, স্বায়ত্বশাসনের স্বরূপ, নীতিমালা, আইন, বিধি, প্রবিধি এবং রাজনীতি ও প্রশাসন উভয়ের প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ তথা সদাচার চর্চার উপরেই নির্ভর করে রাজনীতি ও প্রশাসনের সম্পর্ক ও সার্বিক প্রশাসনিক সংস্কৃতি। রাজনীতি, বিশেষ করে সরকার এবং জনমতের ভিত্তিতে সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দল প্রশাসনের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠলে যেমন বিপদ, তেমনি প্রশাসন স্বপ্রণোদিতভাবে সম্পূর্ণ রাজনীতিগ্রস্ত হলেও সংকট প্রকট হয়। রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন প্রশাসনের পক্ষে স্বেচ্ছাচারি হওয়া সম্ভব। এইসব দিক বিবেচনায়, শুদ্ধাচারের নীতি সকল পর্যায়েই পযোজ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা, প্রশাসনিক কর্মচারীদের পরিচালনার নীতিবিধি প্রণয়ন ও প্রয়োগের অধিকারী রাজনীতির প্রতিনিধির শুদ্ধাচার বা সদাচারের চর্চা অনুসারেই প্রশাসনিক শুদ্ধাচার বা সদাচারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, চর্চিত হয়, বিস্তৃত হয়, টেকসই হয়। সরকারের সদাচারের লক্ষ্য কোনোমতেই দলীয় স্বার্থ নয়, বরং রাষ্ট্র ও জনসাধারণের সমতাভিত্তিক, সাম্য ও ন্যায্যতা ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নের স্বার্থ; অন্যদিকে প্রশাসনের লক্ষ্য সরকারের দল নিরপেক্ষ পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় নীতিবিধি, আইন ও উদ্যোগের স্বচ্ছ, দায়বদ্ধতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক বাস্তবায়ন। রাষ্ট্র বিদ্যমান হবার পর থেকে রাষ্ট্র শক্তিই যে সমাজ পরিচালনার দায় গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং, সমাজের তথা সমাজ অধীনস্ত ব্যক্তিবর্গের সদাচার অর্থে সংস্কৃতির দায় চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রের তথা রাজনীতির এবং মূলত সরকারের কাঁধেই বর্তায়। ফলে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার এবং সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দল ও সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল—তা বিরাধী ও সমর্থক যে দলই হোক না কেন—নাগরিক সমাজের সর্বজনীন অভিপ্সার সম্মিলনে সংস্কৃতি বান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার সাথে বাস্তবায়নের সম্মিলিত প্রয়াস পরিচালনার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৭ || ব্যক্তি ও সমাজের মাধ্যমে সংস্কৃতির রূপান্তর ও বিকাশ
মানুষ একদিকে সংস্কৃতির উৎস, আরেকদিকে সংস্কৃতির লক্ষ্য। মানুষ বলতে ব্যক্তি যেমন বোঝায়, তেমনি বোঝায় সমষ্টি, সমাজ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, গোত্র, জাতি। বাঙালি কবির বড়ু চণ্ডীদাস মনে রাখতে হয় এক্ষেত্রে: সবার উপরে মানুষ সত্য। তবে বৃহৎ বাংলার মানুষের ভাষায় ‘সংস্কৃতি’ পরিভাষা হিসেবে নতুনই বলা যায়। বলা যায় ঔপনিবেশিককালে এর আবির্ভাব, কালচার শব্দের বাংলা পরিভাষা হিসেবে। ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তার প্রাণময়, গতিময় বিকাশ-অভিপ্সা বোঝাতে কালচার বা সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ আরম্ভ হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘কৃষ্টি’কেই কালচারের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন প্রথমত। কালক্রমে সংস্কৃতিই বহুল ব্যবহৃত। তবে সংস্কৃতি দ্বারা সভ্যতাও বোঝানো হয় কিছু ক্ষেত্রে। বিজ্ঞজনেরা যদিও মানুষের সংস্কৃতির চেয়ে সভ্যতাকে আলাদা করেন। সভ্যতাকে সহজে বোঝানো হয় ‘সংগঠিত, পল্লবিত সমাজের সুস্থির, স্থানুত্ব-কামিতা’ হিসেবে। সভ্যতা ধ্বংসের পরও সংস্কৃতি প্রবাহমানতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম পরম্পরায়। মানুষের প্রাণধারণ ও জীবনযাত্রা সহজ করতেই সংস্কৃতির যাবতীয় প্রয়াস। স্থান বিশেষের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ুগত পরিস্থিতি এবং খাদ্য ও ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদির উৎপাদন পদ্ধতি ও বণ্টন ব্যবস্থার সাপেক্ষে সংস্কৃতি বিকশিত হয়। তাহলে সংস্কৃতি স্থানভেদে ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। অনেকে মনে করেন, ধর্মের একক সংস্কৃতি বিশ্বের সকল স্থানের নির্দিষ্ট ধর্মানুসারীদের সংস্কৃতিগত ঐক্য দান করতে পারে। আদতে তা বাস্তবে ঘটতে দেখা যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, আরবী মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমান অথবা ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানের সংস্কৃতি এক নয়। এমনকি ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রেও স্থানভেদে ভিন্নতা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়, যেমন সম্ভব হয় খ্রিস্টান ধর্মানুসারী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানে বসবাসরত মানুষদের পোশাকের ভিন্নতা চিহ্নিত করা, খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা চিহ্নিত করা। তাই সংস্কৃতি নির্দিষ্ট স্থানের, নির্দিষ্ট ভাষাভাষী জনগণের, নির্দিষ্ট সমাজের এবং সমাজ-অধীন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাঠ করতে হয়।
কিন্তু মানুষের জীবনধারা ও চিন্তার পরিবর্তন-প্রবণতা সম্পর্কে সমাজতাত্ত্বিক, নৃবিজ্ঞানী, ধর্ম বিশেষজ্ঞ, মানববিদ্যাবিদ সকলেই নিঃসন্দেহ। তবে তা জৈবিক সহসাই নয়, বরং নানাবিধ পুশ ও পুল ফ্যাক্টর প্রভাবিত সাংস্কৃতিক পরিবর্তনই প্রধানত ঘটে। মানুষের দুটো হাত, দুটো কান, দুটো চোখ, একটা মুখের পরিবর্তন—দৈহিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন কোটি বছরের ব্যবধানে নিশ্চয় ঘটে, তবে তা এতটাই অদৃশ্যমান যে সহসা চোখে পড়ে না। মানুষের গাত্রবর্ণ, শারীরিক উচ্চতা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন-গাঠনে দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে ভিন্নতা অবশ্য দৃশ্যমান। সংস্কৃতি এসব ফারাকের উপরেও নয়, বিকশিত হয় জীবনযাপনের চাহিদা ও পরিপ্রেক্ষিত সাপেক্ষে। ভিন্নতাকে নির্দিষ্ট স্থানের জাতি, গোষ্ঠী, ভাষাভাষী, ব্যক্তি কি চোখে দেখে, তার দ্বারা সংস্কৃতি চিহ্নিত হয়। তাহলে কিসের পরিবর্তন চলমান থাকে মানুষ ও মানুষের সমাজে? পরিবর্তন হয় আকাঙ্ক্ষায়, অভিব্যক্তিতে, শক্তিমত্তায়, প্রবৃত্তিতে, খাদ্যাভ্যাসে, পোশাকে, অর্থনৈতিকতায়, পারস্পারিক সম্পর্কে, ভাষায়। সংস্কৃতিও সেই সাথে সদাই পরিবর্তন লাভ করে। সংস্কৃতি জগতে চলতে থাকে ভাঙাগড়ার অশেষ খেলা, কালে কালে, সময়ের সাথে সাথে জীবনযাত্রায় নব নব অনুসঙ্গের সংযুক্তি ও অকার্যকর অনুসঙ্গের বিযুক্তির মধ্য দিয়ে। প্রস্তর যুগের মানুষ আর আজকের মানুষ যেমন এক মানুষ নয়, তেমনি মধ্যযুগের বাঙালি আর উপনিবেশোত্তর স্বার্বভৌম বাংলাদেশের বাঙালি এক নয়, সংস্কৃতিগতভাবে। মানুষের রুচি, প্রত্যাশা, জীবন-ধারণ পদ্ধতি প্রতি মুহূর্তের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় ক্রমে রূপান্তরিত হতে থাকে। সংস্কৃতির অনেক উপদান যেমন বিলয়প্রাপ্ত হয়, আবার সংস্কৃতিতে আসে নতুন নতুন উপাদান, সৃষ্টি হয় নতুন সংস্কৃতি, এবং পুরোনো, সুপ্ত সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নবপ্রাণ পায়। যেমন, পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের সংস্কৃতি বাংলাদেশে নতুনই। আবার চর্যাপদের চর্চা প্রাচীন, যার পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। তাই সংস্কৃতির পরিবর্তন মানে এক সংস্কৃতির স্থানে আরেক সংস্কৃতির স্থান দখল করার ঘটনামাত্র নয়। ভূমি, স্থান দখল তো হয়ই, মানুষকেও বলপূর্বক আটকে ফেলা যায় নিশ্চয় আধিপত্যবাদী ক্ষমতার শেকল দিয়ে, কিন্তু সংস্কৃতি কেবল বস্তু যেহেতেু নয়, ভাব, চিন্তা ও অভ্যাসও বটে, তাই মানুষের সংস্কৃতি মানুষ—ব্যক্তি ও সমাজ—তার আপন চাহিদার ভিত্তিতেই বদলে নেয় ঐতিহ্য ও পরম্পরার সঙ্গে সম্বন্ধ রেখে, শেকলে বাঁধা থাকে না। সম্বন্ধই (পরম্পরা) সংস্কৃতির অনন্যতা। সম্বন্ধহীনরূপে আসমান থেকে আচমকা জাতির, সম্প্রদায়ের, সমাজের, ব্যক্তির উপর সংস্কৃতি নাজেল হতে পারে না। বাইরের শক্তি, প্রকৃতির পরিবর্তন, যুদ্ধ ও দুর্যোগ, রাজনৈতিক অভিঘাত ইত্যাদি সে পরিবর্তনের প্রভাবক নিশ্চয়। তাই বলে আমূল পরিবর্তন সংস্কৃতির ধর্ম নয়। সংস্কৃতি কালে কালে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, প্রাকৃতিক ও মনুষ্য-সৃষ্ট পরিস্থিতিপূর্ণ পটভূমির উপযুক্ত হয়ে ওঠার লক্ষ্যে রূপান্তরিত হয়।
সংস্কৃতি রূপান্তরের সূচনা হতে পারে একক ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতার বলে। আবার সমষ্টিও হতে পারে রূপান্তরের সূত্রধর, সময়ের প্রয়োজনে। একক বিজ্ঞানীর অভাবনীয় আবিষ্কার ব্যক্তির মাধ্যমে ব্যবহারিক সাফল্যলাভ করলে, আবিষ্কৃত বস্তু বা প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে; সমাজে, সমষ্টিতে, রাষ্ট্রে, বিশ্ব পরিসরে। যেমন, টেলিভিশন এলো। মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখতে শুরু করলো। প্রতিবেশি ও বন্ধুদের এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে চোখ সরে আসতে থাকলো চৌকা বাক্সের পর্দায়। তাতে মানুষে মানুষে মিথস্ক্রিয়া তো কমে গেল দৃশ্যমানভাইে। সংস্কৃতিও বদলালো। দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেল টেলিভিশন। মোবাইল ফোন এবং উচ্চ প্রযুক্তির যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যদির আভির্ভাব ব্যক্তি এবং সমাজের ভূমিকায় ঘটিয়ে ফেললো যুগান্তকারী পরিবর্তন। তারপরও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রকাশক বৈচিত্র্যময় মানব আচরণ ও অভিপ্সায় ঐতিহ্যগত উপাদান লোপ পেল না। তবে নিশ্চয় রূপান্তরিত হলো। ভাটিয়ালির স্বাদ নিতে নদীর বদলে এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলেই চলছে। নদীজীবনের বিবর্তনে ভাটিয়ালির ঐতিহ্য জীবন্ত রূপ থেকে প্রাপ্ত হলো আনুষ্ঠানিকতার রূপে। উত্তর বাংলার সিদল [বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি শুটকি, কচুরলতি, ঝাল ইত্যদি দ্বারা প্রস্তুত উত্তরাঞ্চলীয়—বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রংপুর, ভারতের কোচবিহার, গোয়ালপাড়া অঞ্চলের খাবার] তৈরির রেসিপি সম্পর্কে সহজেই নগরীয় রসিক জানতে সক্ষম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সিঁদল থাকছে, তার পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। সিঁদলের স্থানীকতা, ব্যাপ্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে রন্ধন পদ্ধতি নবায়িত হচ্ছে। একে হরিয়ে যাওয়া বলে না। বিলুপ্তিও নয়। বলে, রূপান্তর। নতুন ধরনের ব্যক্তি সৃষ্টি হচ্ছে, নতুন প্রকার সমাজের আবির্ভাব ঘটছে। দেখা দিয়েছে এবং দিচ্ছে নতুন নতুন সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টি হয়েছে ভার্চুয়াল সমাজ। ভার্চুয়াল সংস্কৃতি। যেখানে কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না, দেখতে পারে পরস্পরের প্রতিকৃতি মাত্র। সেভাবেই পূর্বেও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ধরতে পারে বিচিত্র মনোভাব। হতে পারে অচেনা মানুষের সহমর্মী কিংবা শত্রু, চোখে চোখ না রেখেই। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘মানুষ তার মেধা ও কর্মদক্ষতার বলে, শরীরের প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উৎপাদন উপকরণের সঙ্গে খাপ খেয়ে বেঁচে থাকে এবং অগ্রসর হয়। এইভাবে চতুর্পার্শ্বস্থ বাহ্যিক পরিবেশের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষ পরিবর্তন সাধন করে জগতের এবং একইসঙ্গে বদলে ফেলে নিজেরও স্বভাব [সংস্কৃতি]।’ অর্থাৎ, নিজস্ব সংস্কৃতি জীবন ও জগতের প্রয়োজনে, নতুন সময়ের চাহিদা পূরণের নিমিত্তে রূপান্তরিত হয়। ব্যক্তি পরিবর্তিত হয়, সমাজ পরিবর্তিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তর লাভ করে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি। তারপর বিকশিত হয়। সঞ্চারিত হয়। উদ্যাপিত হয়। চর্চিত হয় প্রজন্মান্তরে। পরম্পরাগতভাবে। সংস্কৃতির রূপান্তর প্রক্রিয়া নতুন সময়ের নব ভাবনায় উদ্দীপিত ব্যক্তি ও সমাজের চর্যায় অব্যাহত থাকে।
রূপান্তর অশেষ চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কৃতি রূপান্তরের ধারাই আসলে মানুষের ইতিহাসেরই ধারা। বাঙালির বর্ণবাদী হিন্দুত্ব, বাংলায় ইসলামের আগমন, প্রাচীন কসমোপলিটান বিক্রমপুর-সুবর্ণগ্রামের আধিপত্যের অবসান, ব্রাহ্ম সমাজের প্রচেষ্টা, মুঘোল শাসন, আইন-ই-আকবরি উদ্যোগ, ইংরেজ ঔপনিবেশিকতা, ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বারা বাংলায় ঘটিত রেনেসাঁ, বাউল সংস্কৃতির রূপান্তর, বাংলা ভাগের পর বাঙালি সংস্কৃতির নব রূপায়ন, পাকিস্তানের সৃষ্টি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড, প্রলম্বিত স্বৈরশাসন, ইসলাম পন্থার প্রভাব, প্রবৃদ্ধিকামী বৈষম্যমূলক অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা, ধনী ও গরিবের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, নদ-নদীকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন, নদীভাঙন, চর জাগা… সবকিছুই এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে—ব্যক্তি ও সমাজকে—ব্যক্তির বিশ্বাস ও সম্প্রদায়কে—ব্যক্তিক ও সামষ্টিক এবং রাজনৈতিক ও আদর্শিক চিন্তা ও প্রবণতাগতভাবে নতুন নতুনভাবে প্রভাবিত করে চলেছে কালের যাত্রায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জীবন-যাপনে প্রযুক্তির প্রবেশ ও বিস্তার, যুক্ত হয়েছে বড় বড় প্রাকৃতিক ঘটনা ও মহামারীর প্রেক্ষাপট। যার ফলশ্রুতিতে, ব্যক্তি এবং সমাজের কার্যকলাপ স্বাভাবিকভাবেই একই রুচিতে, আকাঙ্ক্ষায়, প্রবৃত্তি ও প্রবণতায় আটকে নেই। পরিবর্তন লাভ করেছে বহুমুখি। সংস্কৃতির রূপান্তর, সুতরাং, এই সময়ে এসে বিদ্যায়তনিক, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সংস্কৃতি যেহেতু জীবনাচার, জীবনের সহজতা, স্বচ্ছন্দ, সমাজের শান্তি ও সম্প্রীতি, এবং রাষ্ট্রের সমতাভিত্তিক শান্তিই যেহেতু সংস্কৃতির লক্ষ্য, তাই সংস্কৃতির প্রত্যাশিত বিকাশের স্বার্থে তার রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক, সামজিক, ব্যক্তিক ভূমিকা আছে—সজ্ঞান ভূমিকা যেমন আছে, স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দেশ্যহীন ভূমিকাও আছে তেমনি। এই বোধ দ্বারাই নির্ধারণ করতে হবে ব্যক্তি হিসেবে, সমাজ হিসেবে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা, কার্যকলাপ, সদাচার বা শুদ্ধাচার। তবেই সংস্কৃতি আত্মপরিচয়ের গৌরব হয়ে উঠতে পারবে, আমার সভ্যতার, আমাদের সভ্যতার নির্ণায়ক স্পষ্ট হবে, আধিপত্যবাদী বৈশ্বিকতা, নয়া উদারবাদ এবং মুক্ত বাজারের এই যুগে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটমান ও আসন্ন বিপদের কালপর্বে। তার জন্য ব্যক্তির সঠিক বিকাশ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সামাজিকতা, সামাজীকিকরণ, যৌথতা, সংগঠন—বাস্তব এবং ভার্চুয়াল, উভয় জগতে। এই সংবদ্ধতা সৃষ্টি ও বজায় রাখার দায়িত্ব বহনের উপযুক্ত আর বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি নিঃসন্দেহে নয়। এ দায়িত্ব সমষ্টির। প্রতিষ্ঠানের। সমাজের। রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের। বিশেষ করে, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা বিষয়ক প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের। সরকার ও প্রশাসনের। আইন ও বিচার বিভাগেরও।
সংস্কৃতির বাহক, পালক, সঞ্চারক হিসেবে যোগ্য ব্যক্তি সৃষ্টি করা আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধানতম কাজ। অস্বীকার করা যাবে না যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের চর্চা সংস্কৃতিতে আজও অস্তিত্বশীল—আশরাফ-আতরাফ ভেদ, ধনি-গরিব বৈষম্য, শাসক ও শাসিতের দ্বন্দ্বজিউয়ে রেখে চলা সমাজে ও রাষ্ট্রে ব্যক্তির সুষম বিকাশের জো নেই। বৈষম্যের পটভূমিতে দাঁড়াতে ব্যক্তির কষ্ট হয়, ব্যক্তির মন বেঁকেচুরে যায়, সমাজে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। তাতে সংস্কৃতি বিকৃতি লাভ করে। বিকৃতিও এক প্রকার রূপান্তর বটে, তবে অপ্রত্যাশিত। সংস্কারপ্রবণ মন বিকৃতিকে সমর্থন করে না, কিন্তু বিকৃতির ফল ভোগ করে। সর্বময় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রই পারে ব্যক্তির সংস্কার করতে, সমাজকে পরিশ্রুত, শুদ্ধ, সদাচারী করতে, প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে। প্রতিষ্ঠানসমূহকে সমন্বিতভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে সদাচারী সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানোর ভার এখন সত্যিকারেই জনগণ কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঁধে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংস্কৃতি বিনির্মাণে জনগণকে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্দীপিত করবে।
► আসছে তৃতীয় পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন