কবি ফররুখ আহমদের একমাত্র সাক্ষাৎকার

অ+ অ-

 

 

সাক্ষাৎকার সম্পর্কে প্রসঙ্গ কথা

অস্ট্রিক আর্যু 

লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে কবি ফররুখ আহমদের জবাব ছিল এমন—‘লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না-করলে এ যুগে লেখকের এবং লেখার অস্তিত্ব রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব বলেই আমি লেখাকে স্বাধীন সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী।’ কথাটি কবি বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। এটি ছিল কবি ফররুখ আহমদের একমাত্র মুদ্রিত সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ১৯৬৮ সালে। সাক্ষাৎকারটি নতুন করে সংযোজন হচ্ছে ঐতিহ্য প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিতব্য ফররুখ-রচনাবলিতে।

কবি ফররুখ আহমদের পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ, জন্ম ১০ জুন ১৯১৮ সালে; তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমায়। মৃত্যু ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে, ঢাকায়। লেখালেখির শুরু ছোটবেলা থেকেই। প্রথম জীবনে এফ. আহমদ নামে লিখতেন পরে ফররুখ আহমদ নামটাই স্থির করেন। পৈতৃক নামের পূর্বে ব্যবহৃত সৈয়দ শব্দটি তিনি কখনও ব্যবহার করেননি।

ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবেই অধিক পরিচিত। তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা। কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপক ইসলামি চিন্তাবিদ মওলানা আবদুল খালেক ছিলেন ফররুখ আহমদের আধ্যাত্মিক গুরু; আর মহাকবি ইকবাল ছিলেন ফররুখ আহমদের প্রধান প্রেরণা। ফররুখের প্রথম কবিতাগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ তামুদ্দিক রূপকার, দার্শনিক মহাকবি, আল্লামা ইকবালের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত। ফররুখের মৃত্যুর পরে ইকবালের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০) নামে তাঁর কৃত ইকবালের অনূদিত কবিতা একত্রে গ্রন্থিত হয়।

ব্যক্তিগত নৈতিকতার প্রশ্নে পুলিশের চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন। কয়েকটি চাকরি বদলিয়ে থিতু হন রেডিওতে। আমৃত্যু রেডিওতেই ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের জন্য প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এর ফলে তিনিসহ পনেরো জন রেডিওর চাকরি থেকে ছাঁটাই হন। পরে অবশ্য রেডিওর ‍শিল্পীদের টানা সতের দিনের ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে ছাঁটাইকৃত কুশলীবরা চাকরিতে পুনর্বহাল হন।স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে চাকরি ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার বিপর্র‌যয়ের সম্মুখীন হন। কবির পক্ষে লেখক আহমদ ছফা এর প্রতিবাদ জানালেনফররুখ আহমদের কি অপরাধ?শিরোনামের এক লেখায়। লেখাটা ছাপা হয় গণকণ্ঠ পত্রিকায় ১৩৮০ সালের ১ আষাঢ় সংখ্যায়। এবারও চাকরিতে পুনর্বহাল হন তিনি।

কবি ফররুখ আহমদ প্রচলিত অর্থে পত্রিকায় যে ধরনের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, তার বিষয়ে বিরূপ ছিলেন। ফলে, বিপুল খ্যাতি সত্ত্বেও তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিতই হয়নি বলতে গেলে। আমাদের জানা মতে, কবির এই একটিমাত্র মুদ্রিত সাক্ষাৎকারই পাওয়া যায়। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল বই পত্রিকার জুন ১৯৬৮ সংখ্যায়। বই পত্রিকার সে সময়কার প্রতিনিধি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি গৃহীত হয় ঢাকাস্থ কবির তৎকালীন ইস্কাটন গার্ডেনের সরকারি বাসভবনে। কবি সেসময় রেডিওতে চাকরি করতেন।

সাক্ষাৎকারের সম্পূর্ণ অংশ নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো।

* * * 

 

 

আমাদের দেশের অনেকের ধারণা এই যে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না, কাজেই লেখকেরও অভাব হবে না কোনো দিন। কিন্তু কথাটি ঠিক নয়। তৈরি কাক অনেক পাওয়া যায়। বিশেষ করে শহরে অনেক কাক মজুদ থাকে। কিন্তু তৈরি লেখক অতটা সহজে পাওয়া যায় না, শহরেও খুব বেশি লেখক মজুদ থাকে না। কাজেই মৌলিক রচনার কথা বাদ দিলেও তরজমা করার মতো যোগ্য লোকেরও তখন অভাব হবে। আর যে সমস্ত বই লেখা বা তরজমা করা হবে, তারও প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 

সাক্ষাৎকার || ফররুখ আহমদ

বই পত্রিকা: দীর্ঘকাল যাবৎ আপনি কবিতায় নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন। আপনার সদ্য পুরস্কার পাওয়া ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যও এইরকম পরীক্ষার ফল বলে সুধী মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনি নিশ্চয় খুব পড়াশোনা করেন। তাই না?
ফররুখ: আমি যদি বলি যে, পড়াশোনা চিন্তা-ভাবনার পাঠ এখান থেকে প্রায় উঠেই গেছে, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বিস্মিত হবেন।

বই পত্রিকা: তা হব বৈকি!
ফররুখ: কথাটা বিস্ময়কর হলেও মর্মান্তিকভাবে সত্য।

বই পত্রিকা: আপনি বড় অদ্ভুত কথা বলছেন দেখি।
ফররুখ: অদ্ভুত কথা নয়। কাজের পরিচয় ফল দেখেই পাওয়া যায়।

বই পত্রিকা: কী রকম?
ফররুখ: দুনিয়ার আরো দশটা উন্নত দেশের চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক অথবা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক আর শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট অবদানের তুলনা করে দেখুন, খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, আমাদের পড়াশোনার বহর আর বিদ্যার দৌড় কতটুকু। আমাদের চিন্তা-ভাবনার পরিধি কতটুকু সে কথা বুঝতেও দেরি হবে না।

বই পত্রিকা: পড়াশোনার সঙ্গে আপনি কেন বারবার চিন্তা-ভাবনার কথা বলছেন।
ফররুখ: আমি স্বাধীন চিন্তার কথা বলছি।

বই পত্রিকা: কেন?
ফররুখ: স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে গ্রহণ-বর্জন, হজম-বদহজমের যোগ আছে বলেই।

বই পত্রিকা: বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি আমাদের পড়াশোনা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তাতে সায় দিতে পারছি না।
ফররুখ: কেন?

বই পত্রিকা: অনেকেই আমাকে একথা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, না পড়লে তাঁদের ঘুম হয় না। একথা কি মিথ্যে?
ফররুখ: ডাহা ভাঁওতাবাজি। ঘুমানোর জন্য কেউ পড়াশোনা করে না। সত্যিকারের জ্ঞানান্বেষী পাঠক তো নয়-ই।

বই পত্রিকা: তবে কি মানুষ না ঘুমানোর জন্য পড়াশোনা করে?
ফররুখ: যে মানুষ পড়াশোনা করে সে শুধু নিজেই জেগে থাকে না, অন্যকেও জাগায়, তাতে জাতি জাগ্রত হয়ে ওঠে। যারা ঘুমানোর জন্য পড়াশোনা করে তারা পাঠকই নয়।

বই পত্রিকা: তাহলে আপনি আমাদের পাঠক সম্প্রদায়কে সত্যিকারের পড়ুয়া মনে করেন না?
ফররুখ: যারা ঘুমানোর জন্য পড়ে তাদেরকে আমি পাঠক মনে করি না।

বই পত্রিকা: আর লেখক সম্প্রদায়কে?
ফররুখ: যেসব লেখকের স্বকীয়তা আছে, যাঁদের চিন্তা-ভাবনায়, প্রকাশ ভঙ্গিতে মৌলিকতা আছে, তাঁদেরকে আমি সত্যিকারের লেখক বলে মনে করি।

বই পত্রিকা: আমাদের দেশে কি এরকম লেখকের সংখ্যা বেশি?
ফররুখ: কোনো দেশেই লেখকের সংখ্যা বেশি নয়।

বই পত্রিকা: তাহলে আপনি আমাদের দেশের সাধারণ লেখক অথবা পাঠক সম্প্রদায়কে বাজে বলে মনে করেন?
ফররুখ: কোনো মানুষকেই আমি বাজে বলে মনে করি না, শুধু হামবড়া দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষকেই আমি বাজে মনে করি।

বই পত্রিকা: আপনি আমাদের লেখক ও পাঠকদের সম্পর্কে চিন্তা করেন কি?
ফররুখ: নগণ্য হলেও নিজে যখন এক-আধটু লেখার চেষ্টা করি তখন ও বিষয়েও কিছু চিন্তা করি বৈকি।

বই পত্রিকা: আপনি যেভাবে চিন্তা করেন, জানাবেন কি?
ফররুখ: উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এইসব সাধারণ পাঠকই হয়ে উঠবে অসাধারণ পাঠক, নকলনবিশ হবে সত্যিকারের ভালো লেখক।

বই পত্রিকা: এটা কি আপনার কাব্যিক উচ্ছ্বাস?
ফররুখ: না। প্রাঞ্জল বাক্যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি।

বই পত্রিকা: সর্বসাধারণের পড়াশোনার জন্য আপনি কী রকম পরিবেশ চান?
ফররুখ: সাধারণ পাঠাগার।

বই পত্রিকা: পাঠাগার কি আমাদের নাই?
ফররুখ: আছে, কিন্তু সংখ্যায় খুব কম। এত কম যে বলতেও লজ্জাবোধ হয়।

বই পত্রিকা: আপনার কথা মেনে নিলাম। মনে করুন কোনো অলৌকিক উপায়ে রাতারাতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাগার স্থাপিত হলো, কিন্তু তাতেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
ফররুখ: না। নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে।

বই পত্রিকা: কীসের সমস্যা?
ফররুখ: বইয়ের। লেখকের। প্রকাশকের।

বই পত্রিকা: সেটা কী রকম?
ফররুখ: দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের পাঠক সম্প্রদায়কে পরিচিত করতে হলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই সে চেষ্টা করতে হবে, এক্ষেত্রে বইয়ের অভাব কেন হবে তা আপনাকে খুলে বলতে হবে না।

বই পত্রিকা: কিন্তু লেখকের অভাব হবে কেন?
ফররুখ: আমাদের দেশের অনেকের ধারণা এই যে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না, কাজেই লেখকেরও অভাব হবে না কোনো দিন। কিন্তু কথাটি ঠিক নয়। তৈরি কাক অনেক পাওয়া যায়। বিশেষ করে শহরে অনেক কাক মজুদ থাকে। কিন্তু তৈরি লেখক অতটা সহজে পাওয়া যায় না, শহরেও খুব বেশি লেখক মজুদ থাকে না। কাজেই মৌলিক রচনার কথা বাদ দিলেও তরজমা করার মতো যোগ্য লোকেরও তখন অভাব হবে। আর যে সমস্ত বই লেখা বা তরজমা করা হবে, তারও প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বই পত্রিকা: আপনার শেষের কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এখনো কি আমাদের সমাজে প্রকাশনা একটা বড় সমস্যা?
ফররুখ: বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজের এটা চিরন্তন সমস্যা। এই সমস্যার জন্যই ছোট একখানা বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে বিশ্বকোষ জাতীয় বিরাট গ্রন্থের ব্যাপারে আমাদের পরমুখাপেক্ষী থাকতে হয়েছে। 

বই পত্রিকা: আগেও কি এই সমস্যা ছিল?
ফররুখ: আগেও ছিল। আপনারা বোধহয় জানেন
যে নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমরা এত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি সেই নজরুল ইসলামের প্রায় সব বই-ই প্রকাশ করেছিলেন অমুসলিম প্রকাশক। মাত্র দু’চারখানা বই প্রকাশ করেছিলেন কোনো কোনো মুসলিম প্রকাশক; তাও শেষ অবস্থায়।

বই পত্রিকা: নজরুল ইসলাম কি তাদের কাছে থেকে উপযুক্ত মূল্য পেয়েছিলেন?
ফররুখ: তা আমি জানি না।

বই পত্রিকা: এটা তো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেকার ঘটনা।
ফররুখ: হ্যাঁ।

বই পত্রিকা: তখন হয়তো মুসলিম প্রকাশকদের অবস্থা খারাপ ছিল।
ফররুখ: ধরে নিলাম আপনার কথাই ঠিক। এখন আর সে অবস্থা নাই। অনেক প্রকাশকই এখন বিত্তের অধিকারী। ধনদৌলতের মালিক। অনেক বাড়ি, গাড়ি, মোটা ব্যাংক ব্যালান্স এখন তাদের সৌভাগ্যের খবর দিচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগা লেখকদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। লেখকদের অর্থনৈতিক সমস্যার মতো সৎ গ্রন্থ প্রকাশের সমস্যাও প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।

বই পত্রিকা: আপনি কি শুধু লেখকদের দিকটিই তুলে ধরেছেন না? আমার তো বিশ্বাস যে প্রকাশকেরাই এখন লেখকদের সবচাইতে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
ফররুখ: লেখকের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন না নিজেরা পরিপুষ্ট হচ্ছেন?

 বই পত্রিকা: লেখক সম্প্রদায় কি একেবারেই বঞ্চিত হচ্ছেন? 
ফররুখ: পুরোপুরি বঞ্চিত বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে কিন্তু অধিকাংশ লেখকই যে তাঁদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না এ কথা ঠিক। তার প্রমাণ
বই-এর ব্যবসা করে প্রকাশক বড় হলে তার সঙ্গে লেখকেরও তো হওয়া উচিত, কিন্তু কোনো লেখকই তেমন হননি আজ পর্যন্ত।

বই পত্রিকা: প্রকাশনা একটা নতুন শিল্প হিসেবে এদেশে গড়ে উঠেছে, দেনা-পাওনার ব্যাপারে প্রকাশকের ত্রুটিবিচ্যুতি কিছুটা থাকতে পারে, কিন্তু লেখক-প্রকাশক সম্পর্কোন্নয়নের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করি।
ফররুখ: দেখুন এই প্রসঙ্গে ছেলেবেলায় পড়া একটা ফারসি গল্প হঠাৎ মনে পড়ে গেল। মুখতাসার গল্পটা বলব?

বই পত্রিকা: বলুন।
ফররুখ: ইরানে এক দরবেশ ছিলেন। তিনি সন্ধ্যার সময় আধমণ রুটি খেয়ে সারারাত এবাদত বন্দেগি করতেন।

বই পত্রিকা: আধমণ?
ফররুখ: হ্যাঁ আধমণ! গল্প লেখক এই আধমণ রুটি খাওয়ার উল্লেখ করে বলছেন যে, আধমণ রুটি খেয়ে সারারাত এবাদত বন্দেগিতে না কাটিয়ে দরবেশ যদি আধখানা রুটি খেয়ে সারারাত ঘুমিয়ে কাটাতেন তাহলে কী চমৎকার ব্যাপারই না হতো! অর্থাৎ বিশ-তিরিশ জন লোক খেয়ে বাঁচত।

বই পত্রিকা: আধমণি দরবেশের যে কাহিনি আপনি শোনালেন সে কথা আমাদের সকল প্রকাশকের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। প্রকাশকেরা শুধু নিজেদের উদরপূর্তিই করেন না। পৃষ্ঠপোষকতা ও সৎ কাজও করে থাকেন।
ফররুখ: তা হয়তো করে থাকেন। কিন্তু লেখকের ন্যায্য পাওনা গণ্ডা ঠিক সময়ে মিটিয়ে দিলেই লেখক সম্প্রদায়ের সঙ্গে গোটা সমাজেরও উপকার করা হতো। লেখকরাও নিশ্চিত মনে লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন।

বই পত্রিকা: লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে আপনি এত আগ্রহশীল কেন?
ফররুখ: পেশা হিসেবে গ্রহণ না করলে এ যুগে লেখকের এবং লেখার অস্তিত্ব রক্ষা প্রায় অসম্ভব বলেই আমি লেখাকে স্বাধীন সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী।

বই পত্রিকা: দুনিয়ার সব দেশেই কি লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন?
ফররুখ: দুনিয়ার সব দেশের খবর আমি বলতে পারি না, তবে অধিকাংশ উন্নত দেশের লেখকেরাই লেখাকে স্বাধীন, সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

বই পত্রিকা: এর তো খারাপ দিকও আছে?
ফররুখ: আছে! লেখক যদি নিজের বিবেক বিক্রি করে অর্থপিশাচের ভ‚মিকায় নেমে লিখতে বসেন তাহলে সেটা ব্যক্তির জন্যই নয়, সমাজের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। কিন্তু খারাপ দিকটার কথাই আপনি আগে ভাবছেন কেন?

বই পত্রিকা: না, ও কথা আমি ভাবিনি। আমি এমন কয়েকজন লেখককে দেখছি যারা বিত্তশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
ফররুখ: আমাদের দেশে লিখে বিত্তশালী হয়েছেন?

বই পত্রিকা: না, লিখে নয়। নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে।
ফররুখ: তাই বলুন। তা উত্তর তো আপনি নিজেই দিলেন।

বই পত্রিকা: একজন বয়স্ক পত্রিকা সম্পাদকও কিছুকাল আগে আমাকে বলেছেন যে, যতদিন লেখক দরিদ্র থাকেন ততদিন নাকি তিনি ভালো লিখতে পারেন। কথাটা কি সত্য?
ফররুখ: কথাটার উত্তর সরাসরি নিজে না দিয়ে আমি আপনাকে আবার অনুরোধ করব দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাতে। সচ্ছল অবস্থার দরুন সেসব দেশের লেখকেরা ভালো লিখতে পারছেন, বেশি লিখাতে পারছেন- না আমরা পারছি।

বই পত্রিকা: পত্রিকা সম্পাদকের কথার ওপর আমি কোনো গুরুত্ব দিইনি।
ফররুখ: না দিয়ে ভালোই করেছেন। কারণ অভুক্ত অবস্থায় থাকলে পত্রিকা সম্পাদকের যে ঐ দারিদ্র্যবিলাস থাকত না সে আমি নিঃসন্দেহ।

বই পত্রিকা: লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে এটি তাহলে আপনার বড় যুক্তি?
ফররুখ: লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সবচাইতে বড় লাভ এই যে, লেখক লেখাপড়ায় সবসময় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। রুজি-রোজগারের ধান্দায় লেখককে যদি অকারণে ঘুরতে না হয় তাহলে সত্যিকারের প্রতিভাবান লেখক অনেক বেশি কাজ করতে পারেন বা পারবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। উন্নতমানের লেখার জন্য এই পরিবেশ বিশেষভাবে প্রয়োজন।

বই পত্রিকা: যতদিন এই পরিবেশ সৃষ্টি না হচ্ছে ততদিন কি লেখক সম্প্রদায় লেখাপড়া বাদ দিয়ে বসে থাকবেন?
ফররুখ: তা যে থাকবেন না তা আপনি নিজেও জানেন। কিন্তু বিনা চাষের ফসল যে কী হয় তার নমুনা তো আপনারা আমাদের লেখা থেকেই পাচ্ছেন।

বই পত্রিকা: আচ্ছা, একটা কথা আবার আপনাকে জিগ্যেস করব, যদি কিছু মনে না করেন।
ফররুখ: অত সংকোচবোধ করছেন কেন, সরাসরি বলে ফেলুন।

বই পত্রিকা: আলোচনার শুরুতে আপনি ও কথাটা বললেন কেন, লেখাপড়া চিন্তা-ভাবনার পাঠ এখান থেকে প্রায় উঠেই গেছে। কথাটা আমার কাছে যেন কেমন বোধ হচ্ছে।
ফররুখ: অর্থাৎ অপ্রিয় সত্যকে মেনে নিতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্যকে না মেনে উপায় কী বলুন। একটা স্বাধীন, গতিশীল জাতির লেখক হিসেবে যেভাবে পড়াশোনা করা দরকার সেভাবে যে আমরা পড়াশোনা করি না, করছি না অথবা করতে পারছি না সেটা তো আমাদের কাজের নমুনা দেখলেই বোঝা যায়। নিজেদের ব্যর্থতার কথা আর কীভাবে বলব?

বই পত্রিকা: আমরা যারা লেখাপড়াকে দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করছি তাঁরা যদি না পড়ি তাহলে এদেশে সাধারণ পাঠক জন্মাবেই না। অতএব সেদিকে চেয়ে দেশের ও বিষয়টা একবার চিন্তা করুন।
ফররুখ: একথা বলতে গিয়ে আপনি অত মনমরা হয়ে গেলেন কেন? আমি বরং আমাদের দেশের একশ্রেণির পাঠকের খবর দিতে পারি, যারা বয়সে প্রাচীন আর উচ্চশিক্ষিত, তারা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সারাজীবন পড়ছেন, এমনকি ডিটেকটিভ নভেল কি ঐ ধরনের অন্যান্য বই পড়ে কাটাচ্ছেন।

বই পত্রিকা: এসব পাঠক সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
ফররুখ: গদ্যে আর কী উত্তর দেই, এর উত্তর দিতে হয় পদ্যে।

বই পত্রিকা: তাই দিন।
ফররুখ:

অবাক হলাম দাদুর হাতে
দেখে চুষি কাটি
ঘোরেন তিনি মারবেল আর
নিয়ে দুধের বাটি।
কেমন, হলো তো? এই যে চির-নাবালক দাদুর পড়াশোনা দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

বই পত্রিকা: নাবালক কেন, সেয়ানও হতে পারেন।
ফররুখ: তা পারেন, তবে এ বিষয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

বই পত্রিকা: কিন্তু একথাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সৎ পাঠকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
ফররুখ: আপনার কথা সত্য হোক এটাই দোয়া করি। তবে একথাটাও আমাদের জানা আছে যে, আজাদি পাওয়ার পর আমরা এমন এক উৎকট ভব্যতার শিকারে পরিণত হয়েছি; যেখানে কার্পেট বিছানো ড্রয়িং রুমের একপাশে দামি শেলফে রেক্সিনে বাঁধানো অনেক অনেক বই সাজানো থাকে। কোনোদিন সেসব বইয়ের পাতা খোলা হয় না। সেখানে শুধু আলোচনা হয় হাল ফ্যাশনের বাড়ি, গাড়ি আর শাড়ি সম্পর্কে।

বই পত্রিকা: কিন্তু ঐ শ্রেণির মানুষের সঙ্গে লেখকদের কী সম্পর্ক?
ফররুখ: লেখকদের উপরেও এখন ঐ তথাকথিত অভিজাত সম্প্রদায় প্রভাব বিস্তার করছেন, যার ফলে কঠিন শ্রম সাধনার পথ ছেড়ে অনেক লেখক বাড়ি গাড়ির স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছেন। 

বই পত্রিকা: আপনার বুঝি এখানও বাড়ি গাড়ি কিছুই হয়নি।
ফররুখ: আমার নয়, আমাদের কথা বলছিলাম।

বই পত্রিকা: আশা করি এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো কথা হবে। 
ফররুখ: তবে সেটা যেন সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান না হয়। 

বই পত্রিকা: কেন?
ফররুখ: সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আমার পেশা নয়।

* * *