কালো মানিকেরা কী গান গায়?
প্যারিসের গার-দে-লিস্ট স্টেশনের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এক তরুণ কালো বেণি করা চুল মুখের সামনে এলিয়ে দিয়ে ডিজাম্বে বাজাচ্ছে আপন খেয়ালে। আমি লুভর মিউজিয়ামে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছি। পাশেই হোটেল ব্রিস্টলে, এর ছয়তলায় একটি কামরায় আছি। ছয়দিনের প্যারিস ভ্রমণে এসে কিছুটা ক্লান্তও হয়ে পড়েছি। কারণ সদ্যবিদায়ী ২০২২ সালের ২১-২৭ জুলাই পর্তুগালের লিসবনে ছয়দিন থেকে কনফারেন্সের শেষ দিনে মাদ্রিদে এসেছিলাম। সেখানে তিন দিন ঘুরাঘুরি করলাম। তারপর প্রায় উনিশ ঘণ্টা ফ্লিক্স বাসে চড়ে এখানে এসেছি। এই স্টেশনটি বাঙালি পাড়া হিসেবে পরিচিত। তবে আমি যে হোটেলে উঠেছি সেখানে আফ্রিকানদের বিচরণ বেশি, পাশে আরো বেশ কয়েকটি আফ্রিকান রেস্টুরেন্ট আছে। ব্রিস্টলের রিসিপশনিস্ট থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই নিগ্রো। বন্ধুরা আগে থেকেই সাবধান করে রেখেছিল যে প্যারিস খুব একটা নিরাপদ নয়। চুরি-ছিনতাই হয়। সেই চিন্তা করে আমি আইফেল টাওয়ারের আশপাশের বুকিং করা হোটেল বাতিল করে দিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। তবে এই গরমের মৌসুমে হোটেল ভাড়া বেশ চড়া। অবশেষে খুঁজে পেলাম সর্বনিম্ন ৫০ ইউরোর এই সিঙ্গেল রুমটি। গরমের কারণে রাতেও জানালা খুলে ঘুমুতে হয়। স্ট্রিটে কতিপয় আড্ডাবাজ তরুণ-যুবক রাত দুটো-তিনটে অবধি চিৎকার-চেচামেচিতে উত্তপ্ত করে রাখে। ছয়তলা থেকেও তা বিকট শোনায়। মাদ্রিদ থেকে শখ করে একটা ড্রাগবার নামে ৬০০ চুমুকের একটি ইলেকট্রিক সিগারেট কিনেছিলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এই কাচের টিউবটাকে একাকীত্বের সঙ্গী করে নেই। মাঝে মাঝে বুঝতে চেষ্টা করি এই কালো বাউণ্ডুলে যুবকেরা ঝগড়া-মারামারিতে লিপ্ত হয়েছে কি না। নিচে তাকিয়ে দেখি, না, আসলে তারা আড্ডা দিচ্ছে। সামান্য আলোর নীচে তাদের উত্তুঙ্গ সংলাপ বিবাদের মতো শোনায়। আশে পাশে বেশকিছু বিয়ারের ক্যান-কাচের শিশি পড়ে আছে। ধোঁয়া উড়ছে ঠোঁটে। অবিরত।
ওঁদের পাশ দিয়ে যেতে কিছুটা ভয় লাগে। এরকম তাগড়া ডার্ক-চকলেট রঙের শরীর, তার সাথে কারো কারো মাতলামি দেখে মনে হয় কখন তারা আমাকে পেয়ে বসে। এই সুবিশাল প্যারিসের আভিজাত্যের সাথে এদের এই আচরণইবা কতটুকু মানায়? এই ধরনের প্রশ্ন আমাকে ভাবায়। কয়েকজন বাঙালির সাথে এখানে পরিচয় হয়েছে। তাদের সাথে এই বিষয়ে কথা উঠালে তারাও সায় দিয়ে বলে, এদের এরকম আচরণের জন্য বৈদেশি হিসেবে তাদেরকেও নাকি ছোট হতে হয়। কিন্তু হাশেম সাহেবের বক্তব্য ছিল ভিন্ন, সে বললো, এই যে প্যারিস, এত বিষ্ময়কর, অভিজাত স্থাপত্য দেখলেন, এগুলো কাদের রক্তে-ঘামে গড়া, তার ইতিহাস কি জানেন? সেই শ্রমিকের প্রতি এই সাদা মানুষেরা কতটুকু মূল্য দিতে পেরেছে? প্রকৃতপক্ষে ওরাই তো এসবের উত্তরাধিকার। আদিত্য শাহীনের কাছ থেকে হাশেম সাহেবের নাম্বার পেয়েছিলাম। যার নির্দেশনায় আমি মাদ্রিদ থেকে এখানে এসেছি। বিকেলে গার-ডু-নর্ড স্টেশনের পাশে গিটার হাতে গাইছিল এক কালো যুবক, বব মার্লির সেই গান—
Old pirates, yes, they rob I
Sold I to the merchant ships
Minutes after they took I
From the bottomless pit
But my hand was made strong
By the hand of the Almighty
We forward in this generation triumphantly.
অর্থাৎ ‘পুরোনো জলদস্যুরা আসে, হ্যাঁ তারা আমাকে ডাকাতি করে নিয়ে যায়, আমি জাহাজের বণিকের কাছে বিক্রি হয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি অতল গর্তে ঢুকে যাই, কিন্তু আমার হাত খুব শক্ত।’
শত শত বছর ধরে তাদের জীবন যে দাসত্বের শিকলে আটকানো ছিলো বা এখনো রয়েছে, সেই গভীর আর্তনাদে ঘেরা এই গান, আবার তার ভেতর দিয়ে উপচে ওঠা সুঠাম সাহসের সুর-তালই হলো কালোমানিকের গান।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখে কনসার্টে গান গাইছেন বব মার্লে। ছবি © উইলি ফ্রে
এই কথার ভিতর যে গভীর যাতনার ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা বড় অমানবিক, আবার যে দৃঢ়তাও রয়েছে—তা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বদলের প্রত্যয়। সেই ইতিহাস আমরা খুঁজে পাই এই ‘রিডাম্পসন সং’ বা মুক্তির গানে। এই গান আগেও শুনেছি, কিন্তু তার মর্ম বুঝিনি। শত শত বছর ধরে তাদের জীবন যে দাসত্বের শিকলে আটকানো ছিলো বা এখনো রয়েছে, সেই গভীর আর্তনাদে ঘেরা এই গান, আবার তার ভেতর দিয়ে উপচে ওঠা সুঠাম সাহসের সুর-তালই হলো কালোমানিকের গান। পৃথিবীর সভ্যতা যারা নির্মাণ করেন, সেই সভ্যতার ভারে চাপা পড়ে যাওয়াটাই যেন কালো মানুষের নিয়তি। তাই তারা মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েও গাইতে পারে—
Won't you help to sing
These songs of freedom?
Cause all I ever have
Redemption songs
অন্তত গান গাইবার জন্য যে স্বাধীনতাটুকু প্রয়োজন, তা-ই বা ক’জন পায়? ভিক্টর জারা কিংবা পল রোবসন এমনকি মাইকেল জ্যাকসন? পর্তুগালের লিসবনে যে নাবিক জীবনের রূপ পরিগ্রহ করে এলাম, এরপর স্পেনে মাদ্রিদের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাক্ষাৎ মিললো এক রাজনৈতিক দলের। তারা স্পিকারে বাজাচ্ছিল ফরাসি বিপ্লবের কালে রচিত ইউজিন পোতিয়েরের ‘লা ইন্টারন্যাশনালে’। হ্যাঁ ফরাসি বিপ্লব তো এদেশেই হয়েছিল, যেখান থেকে দাসশ্রেণির ক্ষমতা আরোহনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল।
Arise, wretched of the earth
Arise, convicts of hunger
Reason thunders in its volcano
This is the eruption of the end
Of the past let us wipe the slate clean
Masses, slaves, arise, arise
The world is about to change its foundation
We are nothing, let us be everything.
এই গানটিই মোহিত বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন, ‘জাগো জাগো জাগো সর্বহারা, অনশন বন্দি-কৃতদাস/ শ্রমিক দিয়াছে আজ সাড়া, উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস।’ কালো মানুষেরা দাস থেকে শ্রমিক হলো, শ্রমিক হিসেবে নাগরিকের অধিকার পেল। তাদের জন্য শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত হলো, অসুস্থ-কর্মহীন মানুষের জন্য বেকার ভাতা নির্ধারিত হলো। এই স্বাধীনতার উপর্যুপরি আনন্দের রেশই হয়তো হোটেল ব্রিষ্টলের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উপরতলার মানুষের এখনো যে বিত্তবৈভব ও আয়েশের স্তর নির্মাণ করে রেখেছে, তা কি কখনো স্পর্শ করা সম্ভব। হয়তো নয়। তাই তারা হাসে আর গান গায়। গায়ের রঙ কিংবা গন্ধ যে এখনো অচ্ছুত করে রাখে, সেই অবস্থান থেকে দেখলে সিভিলাইজড মানুষের এত এত মানবতার কথাগুলো হেয়ালি মনে হয়।
১৯৮৬ সালের ‘নাথিং টু মাই নেম’ গানটির কথা তিয়ানানমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের কাছে কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। ১৯৯৩ সালে হংকং রক ব্যান্ড বিয়ন্ডের ‘বাউন্ডলেস ওসেনস ভ্যাস্ট স্কাইস’ সামাজিক আন্দোলনে প্রতিবাদী সংগীত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের বরুণ গ্রোভার, পূজন সাহিল, মাদারার মত শিল্পীরা প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছে। ‘দলিত অধিকার আন্দোলন’ বিশেষ করে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য রয়েছে অসংখ্য সংগীতের ব্যবহার।
আমার এখনো মনে হয় ভেরিবাদক লুইস আর্মস্ট্রঙের গাওয়া সেই গানের কথাগুলো পৃথিবীর মানুষের জন্য এখনো পর্যন্ত অনন্য সুন্দর গান। কী সরল কাব্যভঙ্গি, কী সাধারণ দৃশ্যের বর্ণনা, কিন্তু গাইতে গিয়ে লুইসের যে অভিব্যক্তি, তা বর্ণনাতীত। বব থিয়েলে ও জর্জ ডগলাসের লেখা সেই গানটি হলো—
I see trees of green
Red roses too
I see them bloom
For me and you
And I think to myself
What a wonderful world!
I see skies of blue
And clouds of white
The bright blessed day
The dark sacred night
And I think to myself
What a wonderful world.
অর্থাৎ ‘আমি সবুজ গাছ দেখি, লাল গোলাপ দেখি/ আমি ফুল ফুটতে দেখি তোমার আমার জন্য/ আর নিজে নিজেই ভাবি, এই পৃথিবী কী সুন্দর। আমি নীলাকাশ দেখি, সাদা মেঘ দেখি, উজ্জ্বল দিন দেখি, গাঢ় ভয়ার্ত রাত দেখি। আর নিজে নিজেই ভাবি, এই পৃথিবী কী সুন্দর!’ অনন্য-সুন্দর গানটিও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায় যে এই সুন্দর পৃথিবী সকলের জন্য সমান? তা হয়নি বলেই তো জেমস ব্রাউন চিৎকার করে গেয়েছেন—‘Say it loud, I'm black and I'm proud’। এই গানের মধ্যে বলা হয়েছে—
Now we demand a chance to do things for ourselves
We're tired of beating our heads against the wall
And working for someone else, huh
You know, we are people, too
We like the birds and the bees
But we'd rather die on our feet
Than keep living on our knees
এদের গানগুলো এমন কেন? এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা সবখানেইতো উপনিবেশিক আগ্রাসন হয়েছে, কিন্তু প্রহসন ও নির্যাতনের চরিত্র অঞ্চলবিশেষে আলাদা। ভারতের শত শত জাহাজ সম্পদ লুট হলেও এদেশের মানুষকে দাস হতে হয়নি। কিন্তু এই কালোদের গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানানোর ইতিহাসওতো আমাদের জানা। তার মানে কে অমানবিক আর কাকে অমানব বলা হয়ে চলেছে, সেই অধিকারের প্রশ্নে জবাব শুধুই নিরব উপলব্ধির বিষয়। কারণ প্রতিবাদ করা কখনোই দাসদের জন্য বৈধ ছিল না। ১৯৬০ সালে চিলির গায়ক ভিক্টর জারা গেয়েছিলেন ‘নুয়েভা ক্যানসিওন চিলেনা’, এই গানের জন্য তাকে নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছিলো। তারপরেও প্রতিবাদ কখনো থেমে থাকেনি। সেই প্রত্যয় থেকে কিউবান প্রতিবাদী সঙ্গীত শুরু হয়েছিল ‘নুয়েভা ট্রোভা’ নামে, যা কিউবান বিপ্লবকে উন্নীত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে পুয়ের্তো রিকোতে প্রতিবাদী গান শোনা যেত রয় ব্রাউন, আন্দ্রেস জিমেনেজ, আন্তোনিও ক্যাবান ভ্যালেদের কণ্ঠে। ১৯৮৬ সালের ‘নাথিং টু মাই নেম’ গানটির কথা তিয়ানানমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের কাছে কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। ১৯৯৩ সালে হংকং রক ব্যান্ড বিয়ন্ডের ‘বাউন্ডলেস ওসেনস ভ্যাস্ট স্কাইস’ সামাজিক আন্দোলনে প্রতিবাদী সংগীত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের বরুণ গ্রোভার, পূজন সাহিল, মাদারার মত শিল্পীরা প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছে। ‘দলিত অধিকার আন্দোলন’ বিশেষ করে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য রয়েছে অসংখ্য সংগীতের ব্যবহার।
ষাটের দশকে ‘অ্যাং লিনিয়াং মাসা’ বার্টোল্ট ব্রেখট প্রভাবিত ‘পাপুরি সা পাগ্লারাল’ গানটি প্রতিবাদ এবং প্রচারণার সংগ্রামে জনপ্রিয় হয়েছিল। ইউরোপের বেলারুশিয়ান প্রতিবাদী গান ‘অ্যাডভিইকু মাই স্পালি’ বা ‘আমরা যথেষ্ট ঘুমিয়েছি’। ব্রিটেনে ১৭ শতকের গৃহ ও ধর্মীয় যুদ্ধের যুগে ‘ডিগারস গান’ ‘কিন্তু ভদ্রলোককে নামতে হবে, এবং গরীবরা মুকুট পরবে’, ‘এখন দাঁড়াও, খননকারীরা সবাই!’—এরকম অজস্র সংগীতে মুখর হয়েছে বিশ্ব। পৃথিবীতে কালো মানুষদেরকে পিটিয়ে খেদিয়ে দেয়া হয়েছে বলেই তারা আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সাদাদের সভ্য বদান্যতার গলিতে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তারা শুরু একটু বেঁচে থাকার জন্য নৈরাজ্য করে। যা আমার আপনার মতো দু-একজনকে বিব্রত করতে পারে। কিন্তু উপরতলার মানুষকে মোটেও স্পর্শ করতে পারে না। তবে তাদের গানকে কেউ আটকাতে পারেনি। তাদের গান এখন সমগ্র পৃথিবীর গান। জ্যাজ-ব্লুইজ, হিপহপ, রেগে কোনটি নয়?
► প্রচ্ছদে সংগীত শিল্পী পল রবসন। অংকন: রাজীব দত্ত
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন