দার এস সালামের দিবারাত্রি

অ+ অ-

 

তড়িঘড়ি করে আমি যানযিবার থেকে জাহাজে উঠলাম। জাহাজ প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিল। ইতিমধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে। আমি আমার সিটে গিয়ে দেখি পাশে মাসাইগোষ্ঠীর একজন বসে আছে। এখানে মাসাই দূরের কেউ নয়, কাছের জন বলা চলে। পথেঘাটে সব জায়গায় লাল, কমলা বা ম্যাজেন্টা রঙের এক খণ্ড কাপড় চাদর আর আরেক খণ্ড লুঙ্গির মতো পোশাক পরে এরা ঘোরাফেরা করে। ছেলেমেয়ে সবার পোশাক একই এবং সবাই সারা গায়ে চওড়া গয়না পরে। গয়নাগুলো রঙিন পুতি দিয়ে হাতে তৈরি। কারোটা খুব চওড়া, কারোটা মাঝারি আকারের।

আমি কেন্দুয়া বীচ থেকে যানযিবার শহরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে এসেছি। জাহাজের কোণায় কোণায় কি আছে আমি জানি। যাবার সময় দেখেছি। স্থানীয় আর বিদেশি ট্যুরিস্টে ভরা জাহাজ। নিজের সিটে বসে শরীর এলিয়ে দিলাম। এদিকে যাত্রার পুরোটা সময় মহামান্য মাসাই সানগ্লাস চোখে দিয়ে ঘুমিয়েই কাটাল। বার কয়েক তার মাথা আমার কাঁধে এসে ঠেকছিল। ছেলেটার বয়স ২২/২৩ হবে। ইচ্ছে করে তো আর হেলে পড়ছে না তাই কিছু বলা ঠিক হবে না।

জেটিতে নেমে উবারের খোঁজে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু উবারের দেখা নেই। কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে আমি হাঁটা দিলাম। ভাবছি জেটির কাছের সেই রেস্তোরাঁয় যাব নাকি যেখানে কয়েকদিন আগে খেতে গিয়েছিলাম। এসব ভাবতে ভাবতে একটি আধুনিক গীর্জার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার উবার ডাকার চেষ্টা করলাম। গীর্জার ভেতর থেকে ম্যানেজমেন্টের কেউ এসে জিজ্ঞেস করল আমার কোনো সহায়তার প্রয়োজন কিনা। আমি বললাম, উবার ডাকছি, আসছে না। তারা আমাকে বসতে দিল আর নিজেরাই চেষ্টা করতে লাগল উবার ডাকার। কিছুক্ষণ পর গীর্জার পেছনের গেইটে উবার এসে থামল। উবার চালক একজন নারী, নাম জুডিথ। আমি এত আনন্দিত হলাম জুডিথকে দেখে যে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। পুরো পথই আলাপ চলল। জুডিথ একজন স্বাবলম্বী নারী। পাঁচ বছর ধরে ট্যাক্সি চালাচ্ছে। জুডিথের ব্যক্তিগত জীবন আর দশটা তানজানিয়ান নারীর মতোই। জুডিথ ভালোবেসে বিয়ে করেছিল একটি পুরুষকে। সন্তান হবার পর পুরুষটি বদলে গেল, ভরনপোষণ দিতে চাইতো না। অগত্যা ঘরে ছোট বাচ্চা রেখে জুডিথ কাজে নামে। পড়াশোনা করেছে মেরিন সাইন্সে কিন্তু কাজ মেলেনি। অগত্যা ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। বড় মেয়েটির বয়স সাত বছর আর ছোটটির আট মাস। বড়টিকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়েছে। ছোটটিকে ন্যানির কাছে রেখে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চার বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ দাবী কর না কেন? সে বলল, প্রথমত সে ভরণপোষণ দেবে না, দ্বিতীয়ত ভরণপোষণ দিলে আমাকে তার কথামতো চলতে হবে। তাই আমি কোনো দাবীদাওয়া রাখিনি। প্রাক্তনের কথা মান্য করার মানেই হয় না। আমি যোগ করলাম, সে তোমার কথা মানলে তুমিও মানতে। দায়িত্বহীনের মতো ছেড়ে চলে যাবার পর তাকে মানতে হবে কেন?

ট্যাক্সি চালক জুডিথ  

আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম, এই যে তুমি অনেক রাত অবধি ট্যাক্সি চালাও, তোমার কোনো অসুবিধে হয় না? জুডিথ বলল, আমার কখনোই কোনো অসুবিধে হয়নি। এমনও হয়েছে অনেক রাতে গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছে তবে সাথে সাথেই অন্যান্য গাড়ির চালক এসে সহায়তা করেছে।

আমি তানজানিয়ার সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে খানিকটা শুনেছি। বেশিরভাগ মেয়েই অল্প বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করে বা না করে সন্তান নেয়। বিয়ে করার চেয়ে সন্তান নেয়া খুব জরুরি মনে করে এরা। সন্তান নেয়ার পর বেশিরভাগ পুরুষই মেয়েটিকে ছেড়ে চলে যায় এবং এরপর আর খোঁজখবর রাখে না, দায়বদ্ধতাও থাকে না এদের। ব্রোকেন ফ্যামিলির টিনএজ মায়ের মেয়েও অনাদর অবহেলায় বড় হয়ে স্বপ্ন দেখে একটি পরিপূর্ণ পরিবারের। ভবিষ্যতে জীবনে সঙ্গী, সন্তান সে পায় কিন্তু সে সঙ্গীটি বেশিদিন স্থায়ী হয় না। মেয়েটির হৃদয় বারবার ভাঙে। আর এভাবেই চলতে থাকে এ রীতি। হৃদয় ভাঙ্গার জন্যই কি নারীজন্ম তবে!

আমার এক ভারতীয় বন্ধু তানজানিয়ায় বেশ কয়েক বছর কাজ করে গিয়েছে। সে বলেছিল, আমার ফ্যাক্টরিতে বেশিরভাগ কর্মী হল নারী। এরা সব সিঙ্গেল মাদার। যাদের স্বামী আছে, তারা বউয়ের পয়সায় বসে বসে খায়। আমি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এখানে আসার পর মনে হল ঘটনা সত্য। তবে সব পুরুষ এরকম নয়। সেটা সম্ভবও নয়। নারী ছেড়ে চলে গেলে কাজ করেই খেতে হয় এদের।

তবে এদেশের মেয়েদের আরেকটা দিক আমার ভালো লেগেছেপুরুষটি ছেড়ে চলে যাবার পর সে আর পুরুষটির পেছনে সময় নষ্ট করে না। সে একা চলতে শিখে যায় এবং মনে করে পুরুষটি তার জীবনে উল্লেখযোগ্য কেউ নয়। পুরুষটির সাথে আবার মিলে যাওয়ার জন্য পেছনে পেছনে ঘোরে না। একারণেই তানজানিয়ার প্রায় সব নারী কর্মজীবি। যানযিবারেও বোরখা, হিজাব পরা নারীদের কাজ করতে দেখেছি। দোকানের কাজ, অফিসে, বাড়িতে কাজ, ব্যবসা ইত্যাদি যে কোন কাজেই নারীদের চমকপ্রদ উপস্থিতি। পথেঘাটে চলাচলে নারীরা নিরাপদ। নারীরা ভাঙতে ভাঙতে শিখে নিয়েছে পরনির্ভরশীল না থেকে কিভাবে নিজেকে গড়ে নেয়া যায়।

জুডিথ আমাকে সেই অ্যাপার্টমেন্টে নামিয়ে দিল যেখানে কিছুদিন আগে এসে থেকেছিলাম।

আরুশা থেকে সেদিন দার এস সালাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ন'টা বেজে গিয়েছিল। নতুন শহর কিছুই চিনি না। আমি সাধারণত রাতে চলাচল করি না, কোন শহরেই না। বাসের সহযাত্রী ডমিনিক আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিল, আমি তোমাকে ট্যাক্সি ঠিক করে দিচ্ছি।

ডমিনিক টেনে হিঁচড়ে আমার সব জিনিসপত্র বাস থেকে বের করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য উবার ডেকে দিল। উবার যতক্ষণ না আসে সেও দাঁড়িয়ে রইল আমার সাথে।

উবার চালক ছেলেটির বয়স কম। ভালোই ইংরেজি বলে। নাম এডওয়ার্ড কিন্তু বোনের নাম ফাতিমা। ওদের পরিবার মুসলিম আর খ্রিস্টান মিক্সড, তাই নামে এমন ভিন্নতা। বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি তানজানিয়ায় এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বিয়ের পর যে যার ধর্ম পালন করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। কেউ কেউ আবার ধর্ম নামের সাথে জুড়ে দিয়েই দায়িত্ব পালন করে। সত্যি সত্যিই পালন করার ধার দিয়ে যায় না। ১৮ বছর বয়স অবধি ছেলেমেয়েদের ধর্ম পালন নিয়ে কোন চাপ দেয়া বা জ্ঞান দেয়া হয় না। ১৮ বছর হয়ে গেলে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন ধর্ম পালন করবে বা সেক্যুলার থাকবে বা ধর্ম শুধু নামের সাথেই ব্যবহার করবে। একারণেই এডওয়ার্ড-এর বোন ফাতিমা হতেই পারে। সাধারণত এ দেশে মুসলমানদের সংখ্যালঘু বলা হয়ে থাকে তবে কোথাও কোথাও খ্রিস্টান মুসলমান সমান সংখ্যায় বসবাস করে। ডেমোগ্রাফি অনুযায়ী এদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৩৭ ভাগ  মুসলমান।

আমি দার এস সালামে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। সমুদ্রের কিনারে দেখেই এমন ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু পৌঁছানোর অনেকক্ষণ পর অ্যাপার্টমেন্টের কেউ আমাকে চাবি বুঝিয়ে দিতে এলো না। এডওয়ার্ডও চলে যায়নি। বলল, তুমি তোমার অ্যাপার্টমেন্টে না যাওয়া অবধি আমি নড়ছি না। তুমি আমাদের অতিথি, তোমার একটা ব্যবস্থা করে তবেই আমি যাব। ছেলেটির কথায় আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। অবশ্য আফ্রিকায় এমন আতিথেয়তা নতুন কিছু নয়। আমার আগেও ভালো ভালো অভিজ্ঞতায় ঝোলা ভরে আছে।

দার এস সালামের জেটি 

কিছুক্ষণ পর চাবি নিয়ে একজন এল। আমি এডওয়ার্ডকে বিদায় জানিয়ে চারতলায় আমার জন্য বরাদ্দ করা অ্যাপার্টমেন্টে গেলাম। অ্যাপার্টমেন্টের মালিকই আমায় চাবি দিয়ে খুলে সব বুঝিয়ে দিল। আগামী কয়েকদিন আমি আপাতত সাগরের হাওয়া থেকে বঞ্চিত হবো না। বেডরুম, লিভিংরুম সবই সাগরের দিকে মুখ করা। বিশাল বারান্দায় সাগরের ঢেউয়ের সাথে নোনা বাতাস আছড়ে পড়ছে। অ্যাপার্টমেন্ট মালিকের নাম জিম। আদতে ব্যাংকার কিন্তু গেস্ট হাউসের ব্যবসা তাকে বাড়তি আয়ে সহায়তা করে। জিম চলে যেতেই প্রথমে যেটা বুঝলাম সেটা হল দার এস সালামের গরম আমাকে হাঁসফাঁসে ফেলে দিয়েছে। নভেম্বর মাসে ব্যাঙ্গালোরের আবহাওয়া অতি উত্তম ছিল। তারপর ভ্রমণ করলাম পূর্ব আফ্রিকার তিনখানা দেশ, এমনকি তানজানিয়ার বাকি অঞ্চল ভীষণ আরামদায়ক ছিল। আজ বহু মাস বাদে গরম ও হিউমিডিটির দেখা পেলাম। কিছুক্ষণ বারান্দায় গরম আর জলীয়বাষ্প উপভোগ করে বেডরুমে গিয়ে এয়ারকন্ডিশন ছেড়ে বসলাম। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ডিনার করার জন্য বাইরে যাবার প্রশ্নই আসে না। আর আশেপাশে নাকি রেস্তোরাঁও নেই। বিশাল আধুনিক কিচেনে কোথায় কি আছে খুঁজে রান্না করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই এখন। আর সাধে আমার বাক্সপেটরা বিশালাকার হয়নি। এর অর্ধেক ভরে আছে নানা ধরনের স্ন্যাকসে। আমি মাফিন খেয়ে ঘুমাতে গেলাম।

সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি রান্নাঘরে ইতিমধ্যেই একজন স্টাফ এসে আমার জন্য নাশতা তৈরির কাজে লেগে গিয়েছে। মেয়েটির নাম আকিনা। জিজ্ঞেস করল ডিম কিভাবে খেতে চাই। আজ আমার সানি সাইড আপ খেতে ইচ্ছে করছে, তাই করে দিতে বললাম।

আমি কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলাম। সামনে সাগর আর বাইরে ঘনঘোর। বৃষ্টি পরছে বলে গরম লাগছে না। এরকম আবহাওয়া থাকলে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে। তবে আরুশায় যে সমস্যায় পরিনি সেটা মনে হল এখন পরব। আমার কাছে এদেশের সিম কার্ড নেই। সিম কার্ড ছাড়া উবার ডাকব কিভাবে বা ম্যাপের সাহায্যে ঘুরে বেড়াবোই বা কিভাবে। জিমকে ফোন করে জেনে নিলাম কোথায় সিম কার্ড কিনতে পাওয়া যাবে। নাশতা করে উবার ডেকে চলে গেলাম সিম কার্ড কিনতে। ততক্ষণে ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। দুই হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। সিম কার্ড কম্পানির অফিসে গিয়ে আমি উবার চালককে ছাড়িনি। অপেক্ষা করতে বলেছি। কে জানে এই ঘনঘটায় যদি আর বাহন না পাই। সিম কার্ড কিনে সেই উবার নিয়ে চললাম যানযিবার যাবার জন্য জাহাজের টিকেট কিনতে জাহাজ ঘাটে। পথে কিছুই দেখতে পেলাম না অঝোর ধারায় বৃষ্টির জন্য। মনে হল বেশ বড় শহর। কিছু আধুনিক দালান-কোঠাও আছে।

টিকেট কাউন্টারে নানা দেশের লোকের ভীড়। স্থানীয় লোকজন তো আছেই। স্থানীয়দের জন্য টিকেটের আলাদা দাম, বিদেশিদের জন্য আলাদা। বিদেশীদের টিকেটের দাম স্থানীয়দের চেয়ে প্রায় তিন গুন। আমি সাধারণ ক্লাসের টিকেট কাটলাম।

বাইরের ঘনঘটা থামার নাম নেই। ম্যাপে দেখাচ্ছে আমি দার এস সালামের যে সব জায়গায় বেড়াতে চাই আশেপাশেই তার কয়েকটা আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সাগরের তীর ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে। সামনেই বিশাল জলরাশি। জেটি পার হলে কংক্রিটে তৈরি তীরে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া অবাধ্য জল। ছাতা মাথায় কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম তীর ধরে কিন্তু বৃষ্টি এত জোরে পরছিল যে পুরোই ভিজে গিয়েছি। আশ্রয়ের প্রয়োজন এখন। পাশেই একটি গীর্জা, নাম আযানিয়া চার্চ। আমি ডানে-বামে না তাকিয়ে ঢুকলাম গীর্জায়।

আযানিয়া চার্চ নির্মিত হয়েছিল ১৮৯৮ সালে। সাগরমুখী গীর্জাটি বেভারিয়ান আদলে নির্মাণ করেছিল জার্মান মিশনারি। সাধারণ ট্যালির ছাদ আর একপাশে ঘন্টাঘরের মতো উঁচু চূড়া নিয়ে বহিরাঙ্গের সাধারণ প্রকাশ। ভেতরটাও খুবই সাদামাটা।

আযানিয়া গীর্জা

গীর্জার ভেতরে এখন সোয়াহিলি ভাষায় প্রার্থনা চলছে। দু'পাশের লম্বা লম্বা বেঞ্চে অল্প কয়েকজন বসে পাদ্রীর বক্তৃতা শুনছে, বেশিরভাগই নারী। এই গীর্জাটি মূলত প্রোটেস্টেন্ট গীর্জা। মূল বেদীতে নেই কোন ধরনের জমকালো নকশা। শুধু গীর্জা ঘরের দুপাশের দেয়ালে কয়েকটা জানালা ও এর উপরে স্টেইন্ড গ্লাস বা রঙিন কাচের উপর যিশু ও তার অনুসারীদের কিছু ছবি আঁকা।

গীর্জা দেখে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি থামার নাম নেই। এক জায়গায় আটকে থাকলে কিছুই দেখতে পারবো না। আর ম্যাপ দেখে মনে হচ্ছে এ পাড়ায় দেখার মতো অনেক কিছু আছে। অনেক পুরনো ভবন নতুনের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। জেটির দিকে আবার ঘুরে গেলাম একটা পুরনো ভবন একা দাঁড়িয়ে আছে দেখে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে খুব আভিজাত্যপূর্ণ বিশাল এক বাড়ি। সাদা দোতলা বাড়ির মজবুত কাঠের দরজায় কারুকাজ করা। বাড়িটাকে হেরিটেজ ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৮৬৬ সালে নির্মিত বাড়ির নাম আটিম্যান হাউস। ভেতরে যাবার উপায় নেই তাই সদর দরজার সামনে ঘুরঘুর করতে থাকলাম। সদর দরজার এক কোনায় একটা ছোট বোর্ড চোখে পড়ল, লেখামিশনারিস অফ আফ্রিকা (হোয়াইট ফাদারস)। এই বাড়িটি আফ্রিকায় আসা শ্বেতাঙ্গ ধর্মযাজকদের আবাসস্থল ছিল। সেটাও আবার ফলাও করে প্রচার করেছে। সে সময়ে কোনো শেতাঙ্গই কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে সেভাবে মিশতো না। তাই বলে এভাবে লিখে আলাদা করে থাকতে হবে! অবশ্য ওদের আর দোষ দেই কেন, আমাদের ভারত উপমহাদেশেই কত শত বৈষম্য ছিল বা এখনো আছে। আমরা সেসব দেখে বা সয়ে বড় হই বলে পার্থক্য করতে পারি না।

সাদা ফাদারদের সাদা বাড়ি পার হলে যে পথটা পড়ে তার দুপাশে বৃক্ষের অভাব নেই। বরষায় ভিজে আরও নবীন হয়ে উঠেছে। সামনে কয়েকটা অফিস ভবন আর রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁ দেখে একবার ভাবলাম ঢুকি। ভাবতে ভাবতে একজন ওয়েটার এসে আমার সাথে আলাপ জুড়ে দিল। এরা আলাপি সে তো জানিই, কিন্তু অন্য ব্যাপার হল আমি মুসুঙ্গু বা এদের ভাষায় হোয়াইট। কেন যে এরা এখনো মুসুঙ্গুদের এত তোয়াজ করে, মনিব মানে বুঝি না। বোধহয় শত শত বছরের অভ্যেস এখনো বদলায়নি। অথবা তারা গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। ছেলেটা আমাকে রেস্তোরাঁয় বসতে বলল। আমি ফেরার পথে ঘুরে যাব বলে বেরোলাম সামনের ভবনটি দেখতে। ভবনের গায়ে লেখাফ্রিমেসনস হল।

ফ্রিমেসন শব্দটি আগে শুনিনি। ইংরেজ আমলের কোন আলাদা দল বা সেরকম কিছু হবে। ইন্টারনেট বলল, একসময় একটি দল ছিল যারা বিভিন্নভাবে মানবতার কথা বলত বা সেবা দিত, ইন্টেলেকচুয়াল, স্পিরিচুয়াল শিক্ষা দিত তবে কোন বিশেষ ধর্মের সাথে না জুড়ে। এরা ছিল সেক্যুলার। বিশ শতকে এদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। অবশ্য এই দলের লোকজনকে গীর্জা বা দক্ষিণপন্থীগোষ্ঠী বিশেষ সুনজরে দেখতো না। এদের বিলুপ্ত হতে তাই বেশি সময় লাগেনি।

ফ্রিমেসনস হলের ভেতরে ঢোকার পথ বন্ধ, বাইরে বিশাল এক তালা ঝুলছে। তালায় হাত দিতেই গেইটম্যান রে রে করে দৌড়ে এল। যেন ফ্রিমেসনস হলের ভেতরে রত্নভান্ডার আছে আর আমি এসেছিই সেসব ছিনিয়ে নিতে। সে আমায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কি পারমিশন আছে? আমি বললাম, কিসের পারমিশন, কার পারমিশন? যাযাবরের কি পারমিশন লাগে নাকি?

সে বুঝল আমার মাথা খারাপ। আমিও বুঝলাম এর ভেতরে ঢোকার অনুমতি ২/১ জন ছাড়া অন্য কারো নেই। আমি বেরিয়ে খানিক হেঁটে চলে আসলাম তানজানিয়া ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। আসার পথে ঝেঁপে আসা বৃষ্টির সাথে ঝেঁপে আসছিল প্রাচীন বৃক্ষের সবুজ ডালপালা। অথচ আমরা সেই সুদূর ভারত উপমহাদেশ থেকে ভাবি যে আফ্রিকা মানেই হল রুক্ষ শুস্ক মরু প্রান্তর অথবা ভয়ংকর জঙ্গল। সাহারা মরুভূমি অবশ্য আফ্রিকার সামান্য একটা অংশ জুড়ে আর জঙ্গল বলতে যা বোঝায় তা আছে, কঙ্গোতে আর রোয়ান্ডার একাংশে। পূর্ব আফ্রিকার বাকি অংশে দেখলাম হয় পাহাড় নয় সমতলভূমি। এখন বর্ষাকাল তাই চারিদিক সবুজ তবে শুকনো মৌসুমেও এ শহরের গাছগুলো ঠিক ছায়া দেয়।

ফ্রিমেনস হল

ন্যাশনাল মিউজিয়ামটি আকারে ছোট। প্রথমে ঢুকতেই বিভিন্ন সময়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ি রাখা আছে। আরেক পাশে ইসলামিক আর্ট অনুসরণ করে প্রবেশদ্বার। দরজাটি অশ্বক্ষুরাকৃতি এবং দেয়ালে নানা রঙের টাইলস ছোট ছোট করে কেটে বসিয়ে নকশা করা হয়েছে।

জার্মানরা তানজানিয়া শাসন করে কিছুকাল, এরপর সামান্য সময়ের জন্য ইংরেজ। পূর্ব আফ্রিকায় বৃটিশদের মূল ঘাঁটি ছিল কেনিয়া আর উগান্ডা। তাই এই দেশগুলোতে এরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে অনেকখানি। জার্মানরা তানজানিয়ার উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেয়নি তাই আফ্রিকার অন্যান্য কলোনির মতো তানজানিয়ার উন্নয়নে বাধা পড়েছে। ১৯৬৩ সালে তানজানিয়ার মূল ভূখণ্ড বা ট্যাঙ্গানিকা পুরোপুরি স্বাধীন হয়। এর এক বছর পর ওমানি শাসকরা যানযিবার ছেড়ে দেয় মূল তানজানিয়ার হাতে।

মিউজিয়ামে এখন কেউ নেই। বাইরে ঘনঘোর অন্ধকার, বৃষ্টির ধারায় মন চাচ্ছে পুরনো বাড়ির খরখরি দেয়া খোলা জানালায় বড় বড় গাছের পাতায় চুইয়ে পড়া জলের উচ্ছ্বাসে এক মগ কফি নিয়ে বসি। এমন মধুর দিনে কে ইতিহাসের শুকনো খটখটে বিষয় দেখে সময় নষ্ট করতে চায়! আমার ইচ্ছে না করলেও আজকেই ঘুরে সব দেখে শেষ করতে হবে।

এই মিউজিয়ামে বিভিন্ন সময়ের মাটির তৈজসপত্র রাখা। কিছু কিছু পাঁচ/ছয় শ বছরের পুরনো। আদিকাল হতে কলোনিয়াল সময় অবধি হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবি, বিভিন্ন সময়ের অস্ত্র, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত লোহার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি রাখা আছে। এ জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সংগ্রহ হল পারানথ্রোপাস বোইসি আমলের মানুষের হাড়। যে আমলকে পারানথ্রোপাস বোইসি বলা হয় তার অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছর পূর্বে, মানে পঁচিশ লক্ষ বছর আগের মানুষের হাড়, মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল এ দেশের মাটিতে। এমন মহামূল্যবান সংগ্রহ দেখার পর জাদুঘরের অন্যান্য সংগ্রহকে খুবই মামুলি বলে মনে হল। বাকি যা দেখার ছিল তা তাড়াতাড়ি দেখে আমি চলে গেলাম সেই রেস্তোরাঁয় যেখানে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে কিছুক্ষণ বাদে আবার আসব।

রেস্তোরাঁটি একতলা ও দোতলা জুড়ে। আমি দোতলায় চলে গেলাম। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল রেস্তোরাঁয় খেতে আসা সব বয়সী মানুষ আমাকে সম্ভাষণ করছে হাসি মুখে। এক মাসের উপরে আফ্রিকা ভ্রমণ করছি। তাই তাদের এই সম্ভাষণ আমার অপরিচিত নয়। আমি মুসুঙ্গু, এরা মনে করে এদের চেয়ে আমি উঁচু জাতের। কী আশ্চর্য মানুষের সাইকোলজি। সেই কবে শ্বেতাঙ্গদের কড়াল থাবা থেকে মুক্ত হয়েছে আফ্রিকার দাসপ্রথা তবুও এদের অবচেতন মনে এখনো সেই ভাবমূর্তি রয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে আমার বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, কেন তোমরা আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারোনা? কেন আমাকে উঁচু শ্রেণীর ভাবতে হবে? আই হেইট রেসিজম। আর মূল মুসুঙ্গুদের কাছে আমি কালো মানুষ। ওদের কাছে নিজেরা মানে ইউরোপীয়, আমেরিকান আর অস্ট্রেলিয়ান ছাড়া সবাই কালো। সে ইরানি হোক বা জাপানি হোক।

দোতলার কোন টেবিল খালি ছিলোনা বলে একজন স্থানীয় ভদ্রলোক বিনয়ের সাথে আমার টেবিলে বসার অনুমতি চাইলেন। আমার খাবার ততক্ষণে এসে গিয়েছে। প্ল্যাটারে তখন শাক ভাজি, বাঁধাকপি ভাজি, আলু দিয়ে মাংসের তরকারির সাথে ভাত শোভা পাচ্ছে। আমার টেবিলে বসা ভদ্রলোকের নাম ডেভিড। ডেভিড যে কম্পানিতে কাজ করে তার মালিক ভারতীয়। অনেক ভারতীয় কয়েক জেনারেশন আগে কেনিয়া রেলওয়ে শুরু করার সময় স্কিলড লেবার হিসেবে চলে এসেছে। পরে সুবিধামতো নিজেদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এসেছে এবং আশেপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এরাই সমস্ত আফ্রিকা জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে এতই সফল ও একচেটিয়া যে আজ অবধি কোনো স্থানীয় এদের ডিঙ্গাতে পারেনি। এরা মূলত ধনীকশ্রেণী ও নিজেদের মধ্যেই মেলামেশা করে। কালো আফ্রিকান সে যতই ভালো বা শিক্ষা-দীক্ষা, কাজে, মেধায়  উপযুক্ত হোক না কেন, তাদেরকে এই ভারতীয়রা অধস্তন হিসেবেই মূল্যায়ন করে। সবার জন্ম এদেশে কিন্তু এদের বেশিরভাগ কখনোই ভারতে যায়নি। হিন্দী/ গুজরাতি এদের মাতৃভাষা।

দাসপ্রথা আজ কোথাও নেই। যারা কালোদের দাস করে রাখত সেই ইউরোপীয় বা আমেরিকানদের মাঝেই এখন কোন ভেদাভেদ নেই আর ভারতীয়দের এমন আচরণ আমি খুবই আশ্চর্য হলাম। অবশ্য ভারত উপমহাদেশের মতো এত ভয়াবহ রেসিজম বা বর্ণবাদী মানুষও আমি পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। ফর্সা, কালো; ধনী, গরিবে ভয়াবহ ভেদাভেদ এখনও অবস্থান করছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়।

ডেভিড প্রায়ই অফিসের কাজে ভারতে যায়। আমাকে জিজ্ঞেস করল, সাধারণত ট্যুরিস্টরা এ ধরনের রেস্তোরাঁয় খেতে আসে না। তুমি কি মনে করে আসলে?

আমি বললাম, আমাকে ডাকলেই যে আমি চলে আসি তাই। অবশ্য সেরকম ডাকার মতো ডাকতে হয়।