কবির আত্মা সব সময় অপরাজিত: আল মাহমুদ

অ+ অ-

 

আল মাহমুদ

কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি তুলনারহিত কৃতিত্বের সঙ্গে লিখে চলেছেন। মৌলিক কাব্যভাষার সহযোগে আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে বাংলার ঐতিহ্য প্রোথিত করেছেন। শব্দের সন্ধানে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন লোক থেকে লোকান্তরে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম সোনালী কাবিন, কালের কলস, লোক লোকান্তর, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে। গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধবণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস উপমহাদেশকাবিলের বোন। লেখালেখির স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরষ্কার। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি [১৯৬৮] এবং একুশে পদক [১৯৮৭] বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও নির্মাতা শ্যামল নাথ

শ্যামল নাথ: একজন আল মাহমুদ, যাকে কেউই চিনতো না। যিনি একটি খালি ব্রিফকেস নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে খুব দুঃসাহসে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছিলেন। আগের সেই আল মাহমুদ আর এখনকার আল মাহমুদের সাথে নিজেকে মেলালে এখন কেমন লাগে?

আল মাহমুদ: আমার তেমন কিছু মনে হয় না। গরিব পরিবারে জন্মেছি আমি। নিজের শ্রমে নিজে নিজে উঠে এসেছি। পরিচিত হয়েছি। লেখাই আমাকে পরিচিত করেছে সারাদেশে।

শ্যামল: আপনার কবিতাখ্যাতি শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরেও ছড়িয়ে গিয়েছে। এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন এবং এই সময়ে এসে কি ভাবছেন?

আল মাহমুদ: আমার অনেক শ্রম আছে। লেখা তৈরি করতে হয়। লেখার জন্য প্রচুর পড়তে হয়। সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। ধীরে ধীরে লেখার খ্যাতি থেকে প্রতিপত্তি আমার সহায় হয়। এই আর কি! তারপর আস্তে আস্তে আমার লেখা বাংলাদেশেরে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। আমার শ্রম আছে, পরিভ্রমণ আছে। সারা পৃথিবী আমি ঘুরেছি। সমস্ত বড় শহরইংল্যান্ড, প্যারিস, নিউইর্য়ক। পৃথিবীর বড় বড় শহরের ফুটপাত ধরে আমি হেঁটেছি। এর পিছনে আমার জানার আগ্রহ ছিল। দেখার আগ্রহ ছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল পরিশ্রম।

শ্যামল: আল মাহমুদের নাম উচ্চারণের পাশাপাশি অনুচ্চারিত হয়েছে। সমালোচকরা বলেন যে কবি আল মাহমুদ তাঁর আগের চিন্তা-চেতনা থেকে অনেকটা সরে এসেছেন?

আল মাহমুদ: এটা সত্য না। আমার চিন্তা চেতনার পরিবর্তন এসেছে পড়তে পড়তে। খ্যাতি, প্রতিপত্তি তো আর এমনি এমনি হয়নি। কষ্ট করতে হয়। আল্লাহ খ্যাতি, প্রতিপত্তি মানুষকে দেন। আমাকেও দিয়েছেন।

শ্যামল: যখন বাড়ি থেকে চলে এলেন ঢাকায় তখন আপনি কি ধরে নিয়েছিলেন কবিতা লেখাই আপনার কাজ বা কবিতাই আপনার সব?

আল মাহমুদ: আমি তো কবি হতেই চেয়েছিলাম। মানুষ তো এখন আমাকে কবি বলেই ডাকে। এটা আমার ভালই লাগে। এর চেয়ে আর বড় প্রাপ্তি কি হতে পারে আমার জীবনে। আমি যা হতে চেয়েছিলাম আমি তাই হয়েছি। কবিতাই তো আমার সব হয়ে গেল।

শ্যামল: কিভাবে আপনার ভিতর এই আত্মবিশ্বাস জন্মালো যে আপনি কবি হতে পারবেন?

আল মাহমুদ: আমি দেখেছি। শিখেছি। প্রচুর পড়েছি। যারা বড় বড় কবি আছে তাদের সাথে মেশার চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেল।

শ্যামল: এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুকবিতা পত্রিকায় আপনার কবিতা ছাপানোর কথা কি বলবেন? এরপর তো আপনাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাই নয় কি?

আল মাহমুদ: শ্যামল. ঠিক বলেছো। বুদ্ধদেব বসু তো আমাদের সময়কালের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। যখন তাঁর কাছ থেকে চিঠি পেলাম, তোমার একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে মনে হচ্ছে’—কবিতা ভবন। বাস্ আমার তো আনন্দে পাগল হয়ে যাবার অবস্থা। পরের সংখ্যায় আমার তিনটি কবিতাই ছাপা হয়েছিল।

শ্যামল: আপনার লেখা কি কোথাও থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়নি?

আল মাহমুদ: না। আমি যেখানেই কবিতা পাঠিয়েছে কোথাও থেকে প্রত্যাখাত হইনি। আমি প্রচুর লিখেছি। আমার প্রকাশনা ভাগ্য ভাল।

শ্যামল: আপনি বাংলা কবিতায় তো এক ভিন্ন ধরনের কাব্যভাষা সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি গদ্য ভাষায়ও আপনার অবদান কম নয়। একসাথে কাব্যে ও গদ্যে ঋদ্ধ হওয়া তো সহজ কাজ নয়। কিভাবে এটা সম্ভব হলো?

আল মাহমুদ: আমার সাধনা ছিল তো। চর্চা ছিল তো। আমি সবসময় ভাবতাম আমার কোমরে দুটি তরবারি। একটি কবিতা, আরেকটি গদ্য। কোথাও থেকে প্রত্যাখ্যাত হইনি।

শ্যামল: মাহমুদ ভাই, কবিতায় কিংবা লেখালেখিতে তো আপনি প্রত্যাখ্যাত হননি। কিন্তু প্রেমে কি কখনো প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন?

আল মাহমুদ: আমি যাকে ভালোবাসতাম, তাঁকে কমিউনিকেট করা মাত্র খুব রিয়েক্ট করেছেন। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আর কি। আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম প্রেমে। একে তো গরিব ঘরের সন্তান, অন্যদিকে দেখতে তো আর আমি রাজপুত্র নই। কবিতা লিখে কিছু হয়েছে আর কি জীবনে!

শ্যামল: আপনার সময়ের সমাজ আপনাকে কিভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল?

আল মাহমুদ: প্রথম তো ঢাকায় আসলাম। আমাকে আমার পরিচিত লোকজন আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম।

শ্যামল: এখন পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ সোনালী কাবিন। এটি স্নাতক পর্যায়েও পঠিত হচ্ছে। আপনি পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তা হলো লিরিকধর্মিতা। যা আপনার কবিতাকে বিশেষ বিশিষ্টতা দান করেছে।

আল মাহমুদ: আমি মনে করি, মানুষের জীবন তো লিরিকাল। মানে গীতিময়তায় আচ্ছাদিত। সেখানে গীতিময়তার যে অভ্যাস বাংলা কবিতার ভিতরে রয়েছে, সেটা অব্যাহত থাকবে। কবিতার মধ্যে গীত প্রবণতা, মিল, অন্তমিল এবং অনুপ্রাস এগুলো মানুষ পছন্দ করে। এটা হল বাংলা কবিতার আধুনিক অবস্থান। এটাকে আরো পরিশ্রুত করে বইতে দেওয়া উচিত। আমি মনে করি, এতে বাংলা কবিতার উন্নতি হবে।

শ্যামল: আপনি কবিতায় সব সময় ছন্দ, পয়ার ও গীতিময়তা নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। বর্তমানে অনেকেই গদ্য কবিতা লিখছেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কবিতার ক্ষেত্রে কতটা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আল মাহমুদ: আমি গদ্য কবিতায় বিশ্বাস করি না। কবিতা তো কবিতা, সেটা আবার গদ্য কি? যদি গদ্যই কবিতা হতো, তবে সমর সেন...! আমি তাঁর কবিতা পছন্দ করি, কিন্তু সমর সেন কি সত্যি আমাদের মধ্যে আলোচিত। তিনি আলোচনায় আসছেন না। কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসাবে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়।

শ্যামল: আপনি একবার বলেছিলেন, কবিরা তো প্রকৃতপক্ষে কখনও হার মানে না। যতদিন সে বেঁচে থাকে, ততদিন সে লিখতে চায়। আপনি সারাজীবন কবিতা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। যদিও আপনার কবিতার হাতেখড়ি হয়েছিল ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা আপনি কিভাবে পেলেন?

আল মাহমুদ: আমি তো সব সময়ই বলিকবি হলো বিজয়ী মানুষ, তারা তো হার মানে না কখনো বা তারা তো পরাজিত সৈনিক না। কবির আত্মা সব সময় অপরাজিত। এর জ্বলন্ত উদাহরণ কাজী নজরুল ইসলাম। আর আমি তো তখন ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। ওখানে লালমোহন স্মৃতি পাঠাগার ছিল। এটা পরিচালনা করতো কমিউনিস্ট পার্টি। এটা আমরা তখন জানতাম না। কিন্তু অনেক মূল্যবান বই ওখানে পেয়েছি এবং পড়েছি। কলকাতায় কোনো বই প্রকাশ হলে সেটা একদিন পরই ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ওই পাঠাগারে পাওয়া যেত। এটা একটা বিরাট ব্যাপার ছিল আমাদের কাছে। আমরা লেখক ছিলাম, কবি ছিলাম। এর জন্য আমরা সারাদিন ওই পাঠাগারে যেতাম।

শ্যামল: লিরিকধর্মিতাই গানের প্রবণতা। তাহলে আপনি কেন গান লিখলেন না?

আল মাহমুদ: আমার কখনোই ইচ্ছে হয়নি গান লেখার। সবই তো শিখতো হয়। ছন্দ শিখবার জন্য আমি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর কাছে আমি ঋণী। তাঁর কাছে আমি ছন্দ শিখেছিলাম।

শ্যামল: সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও দিতে পারি কাবিন বিহীন হাত দুটি,/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি/ আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রকুটি;... সোনালি কাবিনের কথা বলছি। আপনি তখন চট্টগ্রামে ছিলেন। এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বাসায় থাকতেন। আপনার কি অনুভব হয়েছিলো, সোনালি কাবিনে লিখে ফেলার পর?

আল মাহমুদ: আমি তখন চট্টগ্রামে ছিলাম গোরখা ডাক্তার লেনে ছিলাম। অসাধারণ স্বপ্নময় জীবন কাটিয়েছি। তখন এ্যাংলা ইন্ডিয়ানদের বাসায় থাকতাম। কবি বলে ওরা আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। সাধারণত তারা কাউকে দাওয়াত দেন না। কিন্তু তাদের বাসায় আমাকে দাওয়াত দিতেন। আমি প্রথমে একটানে সাতটি সনেট লিখে ফেলি। এরপর বাকি সাতটি। আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমার প্রতিভা সম্পর্কে আমার স্বচ্ছ ধারণা ছিল। 

শ্যামল: আপনার সময়কালের সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য কবি কাকে মনে করেন এপার-ওপার বাংলা মিলিয়ে। কাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?

আল মাহমুদ: শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তারা আমার বন্ধু ছিল। আমাদের এখানে শামসুর রাহমানকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। শামসুর রাহমানের কবিতায় রিপিটেশন আছে।

শ্যামল: আপনার অনুজ কবি রফিক আজাদ মারা গিয়েছেন। তার কবিতা সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ কি?

আল মাহমুদ: তার কবিতায় একটা চমকে দেবার ব্যাপার ছিল। এর ফলে সে অনেক খ্যাতিও লাভ করেছে। কিন্তু কবিতার উচ্ছ্বলতা সহজলভ্য জিনিস নয়।

শ্যামল: মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনাদের লেখালেখির কী অবস্থা ছিল?

আল মাহমুদ: মুক্তিযুদ্ধ এক বিস্ময়কর ঘটনা। আমরা দুঃখ আর লাঞ্ছনা অতিক্রম করেছি। সেই সময়ে আমরা লেখাটা বন্ধ করিনি। আমরা কখনো লেখা বন্ধ করিনি। আমরা বন্ধ্যা ছিলাম না।

শ্যামল: ১৯৭৫ সালে আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত কথা সাহিত্যক আবু রুশদ মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতুল্য অন্য কোনো কবির হাত থেকে এত কয়টা ভাল গল্প বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা তার সাহিত্যকে গুরুত্বে ঈর্ষণীয় এক মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস। এটা আপনার জন্য একটা বড় প্রাপ্তি। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি যে, পানকোড়ির রক্ত’—গল্পে আপনি লিখেছেন, নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে আমি সেখানে এক পেশাদার শিকারির মত হাঁটু গেড়ে বাগিয়ে বসলাম।... একটি শ্যামবর্ণ নারীর শরীর নদীর নীলিমায় আপন রক্তের মধ্যে তোলপাড় করছে। আপনি কি সত্যি কখনোও শিকার করেছেন এবং আবু রুশদের মন্তব্য সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে কি?

আল মাহমুদ: আমি বন্দুক নিয়ে সে সময় শিকার করতাম। আমার বন্দুকের লাইসেন্স ছিল। আমি বন্দুক চালাতে জানতাম। তবে বেশিদিন নয়, অল্প কয়দিন আমি শিকার করেছিলাম। পরে এই পাখি মারা আমার ভিতর এক ধরনের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করলো। আমি সেটা আর করলাম না। আমি বন্দুকটা ত্যাগ করলাম। আবু রুশদের এই কথার বিচার তো তোমরা করবে। আমি আর কি করবো!

শ্যামল: প্রত্যেক মানুষের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার বা আকাঙ্ক্ষা থাকে। আপনার জীবনে কি কোন অতৃপ্তি রয়েছে?

আল মাহমুদ: অতৃপ্তি তো আছে। না পাওয়ার বঞ্চনা আছে। আমার আবার খ্যাতিও হয়েছে আবার অ-খ্যাতিও হয়েছে। আমি তো আর সব মানুষকে খুশি রাখতে পারিনি। তাই না? আবার সমালোচনাও হয়েছে। তবে সব ছাপিয়ে উঠেছে আমার কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি।

শ্যামল: কলকাতায় আপনার জলবেশ্যা গল্প থেকে সিনেমা হয়েছে। এবং অনেকগুলো গল্প থেকে নাটকও নির্মিত হয়েছে। এই বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি?

আল মাহমুদ: জানি আমি। কলকাতায় যারা আমার জলবেশ্যা গল্প নিয়ে সিনেমা করেছে তারা আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। এবং তারা আমার অনুমতি নেওয়ার জন্য আমার কাছে এসেছিল। তারা কিছু টাকাও আমাকে দিয়েছিল। প্রথম দফায় বিশ হাজার টাকা দেয়। পরবর্তী সময়ে আরোও বিশ হাজার টাকা দেয়। তারা তো আমার সাথে ভালো ব্যবহার-ই করেছে। এবং আমি শুনলাম যে, কলকাতা মানে পুরো পশ্চিমবঙ্গে আমি পাঠ্য বিষয়।

শ্যামল: আপনার লেখা উপন্যাস উপমহাদেশ কিংবা কাবিলের বোনকে আপনি সার্থক লেখা বলে মনে করেন?

আল মাহমুদ: আমি তো মনে করি। আমি মনে করি, কাবিলের বোনের মত লেখা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির পরে আমার এই বইটা। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। খুবই উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এর আঙ্গিক, গঠন রীতি এবং ভাষা। এখানে আমাদের মুসলমানদের উত্তরাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এরকম একটি বই তো আমি আর দেখতে পাই না।

শ্যামল: আপনি একবার বলেছিলেন—‘কবি হতে গেলে সারা জীবন উৎসর্গ করতে হয়। কেন?

আল মাহমুদ: হ্যাঁ, একটা জীবন দিতে হয়। এটা কোন পার্টটাইম জব নয়। একটা পুরো জীবন দিয়ে দিতে হয়। কবিতা থেকে ফিরতে পারে না সে।

শ্যামল: আপনি তো এখন ডিকটেশন দিয়ে লেখেন। এতে কোন অতৃপ্তি রয়েছে কি? বা আপনার মনে হয় না যে, যদি আমি নিজ হাত দিয়ে লিখতে পারতাম।

আল মাহমুদ: আমার খুব মনে হয়। আমি যদি ভাল চোখে দেখতে পেতাম! যদি নিজ হাতে লিখতে পারতাম! সেটা তো এখন সম্ভব নয়। মানুষের ইন্দ্রিয় স্বল্পকালীন। কিছুদিন কাজ করে এরপর আর করে না। আমি সারা পৃথিবী ঘুরেছি আমার চোখ দুটো বাঁচাবার জন্য। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমি সেটা পারিনি। তবে আমাকে বলা হয়েছে আপনি পুরো অন্ধ হয়ে যাবেন না। তবে দেখতে পাবেন। এই যে, তোমাকে আমি ঝাপসা মতন দেখছি আর কি।

শ্যামল: আপনি নতুন এক কাব্য চেতনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে, নিজস্ব ধারা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলা কবিতায় আপনি এক অগ্রপথিক। আপনার বিবেচনায় কবিতা আসলে কি?

আল মাহমুদ: আমার ধারণা হল, কবিতা মানুষের এক ধরনের দীর্ঘশ্বাসের মত। এটাই তো আমার মনে হয় কবিতা।

শ্যামল: আপনি একবার বলেছিলেন যে, আপনার লেখা অদূর ভবিষ্যতেও পঠিত হবে। আপনি কিভাবে এই আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন বা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করেছেন?

আল মাহমুদ: আত্মবিশ্বাস তো তৈরি হয়েছিল দেখা ও লেখার মাধ্যমে। এবং ভ্রমণের মাধ্যমে। আমি তো সারা দুনিয়া ভ্রমণ করেছি। ফুটপাত ধরে কত হেঁটেছি। কখনও রোদ কখনও বৃষ্টি; আমি তো দাঁড়াইনি। আমি যা দেখেছি তাই লিখেছি।