নানা স্বাধীনতার সবই একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত: অমর্ত্য সেন

অ+ অ-

 

অমর্ত্য সেন

জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে। বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম রাখেন অমর্ত্য সেন। শিক্ষাজীবন শুরু ঢাকার সেইন্ট গ্রেগরী স্কুলে। দেশভাগের সময় সপরিবার চলে যান ভারতে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক এবং কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে স্নাতক সম্মান ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা করেছেন দিল্লি ইউনিভার্সিটি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৯ সালে পান ভারতরত্ন খেতাব। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কালেকটিভ চয়েস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার, অন ইকোনমিক ইনেকোয়ালিটি, পভার্টি অ্যান্ড ফ্যামিনিস: অ্যান এসে অন এনটাইটেলমেন্টস অ্যান্ড ডিপ্রাইভেশন, র‌্যাশনালিটি অ্যান্ড ফ্রিডম, দ্য আগু‌র্মেনটেটিভ ইন্ডিয়ান, ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম, ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা (যৌথ) প্রভৃতি।

 

তখন আমার বয়স ১১ বছর। সেই শ্রমিকটির অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে তাঁর বেঁচে থাকার পরাধীনতা তৈরি হলো। তারপর তো তাঁকে আমার বাবা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে ওই শ্রমিক মারাও গেলেন। এটা থেকে আমার যেটা মনে হয়েছিল, আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকনানা স্বাধীনতার সবই একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। সে জন্য সামগ্রিকভাবে সব দিকের স্বাধীনতা দেখে উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। এটাই আমার বইয়ের প্রধান বক্তব্য।

 

মতিউর রহমান:  আপনার ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম বইয়ের মূল কথা স্বাধীনতা অর্থাৎ জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে জনগণকে ক্ষমতা দিতে হবে, স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের ইচ্ছেগুলো পূরণের সুযোগ দিতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।

অমর্ত্য সেন:  আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার প্রধান বক্তব্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে স্বাধীনতার দিক দিয়ে দেখতে হবে এবং স্বাধীনতার চেয়ে বড় অর্থবহ মনে করতে হবে। এটা এই না যে, শুধু কিছু রাজনৈতিক অধিকার রইল কি না। তবে সেটা তার মধ্যে একটা নগণ্য বিষয়ও নয় আবার সেটাই একমাত্র বিষয়ও নয়। সে জন্য লোকের খাওয়া-পরা জুটল কি না, তার খাওয়া-পরা না জুটলে যে পরাধীনতা দেখা দেয়, সেটাও তো বড় একটা জিনিস। যেমন আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই নিজের আলোচনায় একবার লিখেছিলাম, যখন প্রথম দাঙ্গায় একজন লোককে মরতে দেখলাম; তিনি ছিলেন একজন মুসলিম শ্রমিক। তিনি ওয়ারী হিন্দু অঞ্চলে এসেছিলেন দাঙ্গার সময়, তাঁর বাড়িতে কোনো খাবার ছিল না। তিনি জানতেন যে একটা ঝুঁকি নিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও তিনি এসেছিলেন এ জন্য যে, তাঁর স্বাধীনতা ছিল না বাড়িতে বসে থাকার। কেননা বাড়িতে কোনো খাবার নেই। সে জন্য তাঁকে যখন একজন কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি তখন ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছিলেন। ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে ১৪ লারমিনি স্ট্রিটে, তাঁকে ছুরি মারল কিছু হিন্দু গুন্ডা। তিনি আমাদের বাড়ির ভেতরে ছুটে এলেন এবং আমি চিৎকার করে আমার বাবাকে ডাকার চেষ্টা করলাম ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শ্রমিকটি যখন আমাদের সামনে পানি খাচ্ছিলেন, সেই সময় তিনি আমাদের বলছিলেন, আমি জানি এ মুহূর্তে এ অঞ্চলে আসাটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমার স্ত্রীও এ কথা বলেছিলেন। তা সত্ত্বেও আমি এসেছি যে আমার একটা কাজ এবং একটা মজুরির সম্ভাবনা তৈরি হলো। সেটা না নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, স্বাধীনতাও আমার নেই। কেননা, বাড়িতে বাচ্চারা কিছু খেতে পাচ্ছে না। কোনো খাবার নেই। অতএব আমাকে আসতেই হলো।

তখন আমার বয়স ১১ বছর। সেই শ্রমিকটির অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে তাঁর বেঁচে থাকার পরাধীনতা তৈরি হলো। তারপর তো তাঁকে আমার বাবা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে ওই শ্রমিক মারাও গেলেন। এটা থেকে আমার যেটা মনে হয়েছিল, আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকনানা স্বাধীনতার সবই একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। সে জন্য সামগ্রিকভাবে সব দিকের স্বাধীনতা দেখে উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। এটাই আমার বইয়ের প্রধান বক্তব্য।

মতিউর রহমান:  পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাধীনতাকেও আপনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, যেটাকে আপনি সোশ্যাল কমিটমেন্ট হিসেবে দেখেন...।

অমর্ত্য সেন:  আমার মনে হয় যে আমাদের যে মানবিক অধিকার, তার মধ্যে যেমন খাওয়া-পরা, অসুখ হলে চিকিৎসা পাওয়ার দাবি যেমন আছে; তেমনি আমাদের মন খুলে কথা বলতে পারা, যা বলতে চাই তা প্রকাশ করতে পারা, অন্যদের সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে পারাএই স্বাধীনতাটাও আমাদের মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমার ধারণা, পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত সভ্যতাতেই মানবিক এসব অধিকারের কথা নানা সময়ে লোকে বলেছেন। এটা শুধু একটা পশ্চিমা ধারণা বললে অত্যন্ত ভুল করা হবে।

ভারতবর্ষে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীনেও হয়েছে। জাপানেও হয়েছে। পশ্চিম এশিয়াতে, আরব সভ্যতাতেও এ নিয়ে আলোচনা আছে অনেক। এ জন্য এই মূল্যবোধটা আমার ধারণা, একটা মানবিক মূল্যবোধ। অতএব মানবিক অধিকারই আমাদের সামগ্রিক মানবিক মূল্যবোধ, এটাও আমার একটা বক্তব্য।

মতিউর রহমান:  আপনি তো এসবের পাশাপাশি জনকল্যাণের জন্য মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেদিক থেকে আমাদের এ অঞ্চলে অগ্রগতিও আছে, সমস্যাও আছে। বাংলাদেশ বলেন, ভারত বলেন, রাষ্ট্রকে এই দায়িত্বগুলো পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের একটা দায়বদ্ধতাও আছে। আবার দেখা যায় যে আমাদের রাজনীতিবিদ বা সরকার, তাঁরা যে কথাগুলো বলেন, সেগুলো রক্ষা করেন না। এই যে জনকল্যাণমুখী একটা রাষ্ট্রের ভাবনা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা জানতে চাইছি।

অমর্ত্য সেন:  আমার মনে হয়, বিভিন্ন স্বাধীনতার যে অঙ্গাঙ্গি যোগ, সেই দিক থেকে সমস্যাটার বিচার করতে হবে। যদি সরকারের কাছে দাবি করা হয় যে কিছু করা হোকতা ভারতে হোক, পাকিস্তানে হোক বা বাংলাদেশে হোক। তারা সে দাবি শুনে যদি বলে, আরও কিছু করব এবং তার পরে তারা যদি না করে, তাহলে এটা নিয়ে আলোচনা করা যে তারা বলেছিল, করবে। কিন্তু তারা করল না। তাতে যে গাফিলতির একটা প্রমাণ পাওয়া গেল, সেটা নিয়েও তো সামাজিক আলোচনা চলতে পারে। সে জন্য সমালোচনা করার স্বাধীনতা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত। খেতে না পেলে খাবার দেওয়া হবে, চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করা হবে। তারা বলল কিন্তু করল না। সেই স্বাধীনতাটাকে রূপ দিতে হলে আমাদের কথা বলা, প্রতিবাদ করা, আলোচনা করা, সংবাদ প্রকাশ করার স্বাধীনতাটা খুবই দরকার।

প্রথম কথা হচ্ছে, উন্নয়নের একটা অংশ হচ্ছে গণতন্ত্র। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাদের অন্যান্য যে স্বাধীনতাঅর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, সেগুলো গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিয়ে আরও জোর গলায় চাইতে থাকব এবং এ ক্ষেত্রে মৌনতা বোধ হয় অবিচারের প্রধান সহায়ক। মৌনতা দিয়ে মানবিক অধিকার পাওয়া যায় না।

মতিউর রহমান:  আপনি বলেছেন, গণতন্ত্র সরাসরি উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত।

অমর্ত্য সেন:  আমি তা-ই মনে করি। আমার বইয়ে খানিকটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় লোকে প্রশ্ন করেন, গণতন্ত্রের ফলে উন্নয়ন হবে কি হবে না। প্রথমেই মানতে হবে, গণতন্ত্র উন্নয়নের একটা অংশ। যেমন ডিম সেদ্ধ করতে হলে জল ফোটানো দরকার। এই না যে ফোটানো জলটা আমরা খাব। বরং তা দিয়ে ডিমটা সেদ্ধ হবে। কিন্তু গণতন্ত্র জিনিসটা তো ঠিক গরম জলের ব্যাপার না। গণতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের একটা অংশ। আপনি খুব ধনী হলেন কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা পেলেন না। এমনকি সেই সব দেশে সাধারণ মানুষ তাদের মতামত প্রকাশ করলে তাদের জেলে দেওয়া হয়, সেই সব দেশ উন্নত দেশএ রকম কথা বলতে পারা যায় না।

প্রথম কথা হচ্ছে, উন্নয়নের একটা অংশ হচ্ছে গণতন্ত্র। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাদের অন্যান্য যে স্বাধীনতাঅর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, সেগুলো গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিয়ে আরও জোর গলায় চাইতে থাকব এবং এ ক্ষেত্রে মৌনতা বোধ হয় অবিচারের প্রধান সহায়ক। মৌনতা দিয়ে মানবিক অধিকার পাওয়া যায় না।

মানবিক অধিকার পেতে হলে আমাদের জোর গলায় বলতে হবে, দাবি করতে হবে। সে জন্য গণতন্ত্রের ভূমিকা শুধু নিজের মূল্যের জন্য নয়। নিজের মূল্য তো আছেই। তার ওপরে যে স্বাধীনতার মূল্য আরও দিইসামাজিক, অর্থনৈতিক, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে, সেগুলোকেও সাহাঘ্য করবে। এদের সঙ্গে যোগাযোগগুলো ইতিবাচক, নেতিবাচক নয় বলে আমার ধারণা।

মতিউর রহমান:  আবার তো গণতন্ত্রে সংকটও সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বলেন, ভারতে বলেন, গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের ত্রুটিমুক্ত একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

অমর্ত্য সেন:  এটা ঠিকই। অনেক সময় লোকে গণতন্ত্রের ভুলটা চট করে চোখে দেখেন। কিন্তু তাঁরা যদি সময় নিয়ে দেখেন বা আমাদের গণতন্ত্রের ব্যবহারের যে সুযোগ, সেটা আরও নিতে উদ্গ্রীব থাকেন, তার ফলে যে সামাজিক উন্নতি হতে পারে, সেটা অনেক সময় তাঁরা দেখেন না।

আমি দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। ভারতের সঙ্গে যদি চীনের তুলনা করেন, চীনে গণতন্ত্র নেই, ভারতের আছে। অথচ দেখা যায় চীন অনেক বেশি উন্নতি করেছে। এটা একদিকে ঠিক। গোড়ার দিকে যখন চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছিল, তখন মাও সে-তুংয়ের নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে যেভাবে তারা এগিয়ে ছিল, পরে সে তুলনায় কিছু হয়নি। ১৯৭৯ সালে দেং জিয়াও পিং যে সংস্কারটা করলেন, সেটা হলো চীনের জীবনপ্রত্যাশা বা গড় আয়ুর বিষয়েতখন গড় আয়ু ভারতের চেয়ে ১৪ বছর বেশি। অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে চীনের অর্থনৈতিক প্রগতি অনেক বেশি দ্রুত হয়েছে। ভারতেও মোটামুটি দ্রুত। তবে চীন এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ যদি দেখেন চীনের সঙ্গে ভারতের গড় আয়ু ১৪ বছরের জায়গায় কমে হয়েছে ৭ বছর এবং ভারতের কিছু কিছু অংশ আছে, যেমন কেরালা, যেখানে গড় আয়ু চীনের থেকে চার-পাঁচ বছর বেশি। চীনে যেখানে ৭১, সেখানে কেরালায় ৭৫ বা ৭৬ এবং আমার ধারণা, কেরালার দিকে যদি দেখেন, কেরালার গুণটা হচ্ছে বহুদলীয় ব্যবস্থা, বিভিন্ন পার্টি দিয়ে তৈরি গণতন্ত্র আছে। এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টিকে কংগ্রেস সমালোচনা করে। কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট পার্টি সমালোচনা করে। অন্যদিকে চীনের যে ধরনের রাজনৈতিক ভিশন বা দৃষ্টিভঙ্গি, তা থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে জোর দেওয়া হয়েছিল। কেরালায় সেটা গোড়া থেকেই ছিল। তার ফলে কেরালা চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার-পূর্ববর্তী সময়ের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, তার সঙ্গে গণতন্ত্রকে মেলাতে পেরেছে। এটা একটা উদাহরণ।

আরেকটা উদাহরণ আপনাকে দিচ্ছি। গুজরাটে যখন দাঙ্গা হলো, দুই হাজার মুসলমান মারা গেল। এটা আমাদের হিসাব। যদিও গুজরাটের রাজ্য সরকার তা মানে না। সেই দাঙ্গার মধ্যে যখন ওরা আবার নির্বাচন করল, তখন সেই বিজেপিই জিতল এবং সরকার গঠন করল। তাতে অনেকেই বললেন, গণতন্ত্র করে এটা বাঁচানো গেল না। তবে তা তো প্রমাণিত হলো ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে জাতীয় নির্বাচনে। গুজরাটে যে হিংসাত্মক কাজ হয়েছে এবং খুনোখুনি যেগুলো হয়েছে, তার ফলে বিজেপির মার খাওয়ার খুব একটা যোগ আছে। আর সে কারণেই বাজপেয়ি হেরে যাওয়ার পর নিজেই বললেন, গুজরাটের রক্তবন্যার ফলে আবারও নির্বাচনে হেরে গেলাম।

এই কথা বলার পর তাঁর সহকর্মীরা সবাই সমালোচনা করলেন এবং তিনিও তাঁর কথাটা প্রত্যাহার করলেন। কিন্তু কথাটা ফেরত নিয়ে নিলেও ব্যাপারটা তো সত্যি। সেই জন্য গণতন্ত্রে পরাজয়টা, সেটা নির্ভর করে খানিকটা সময়ের ওপর। আর দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে আরও কী করেছি। কংগ্রেস ও বামপন্থি জোটগুলো যে রাজনৈতিক প্রচার করল, তার মধ্যে বলা হলো এ রকম কেন ন্যায়ের অভাব হবে, যাতে করে এত লোক মারা যেতে পারেগুজরাটে যখন অর্থনৈতিক প্রগতি হচ্ছে ইত্যাদি। তার ফলে আমার ধারণা, গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে যে মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে, সেটা অসত্য নয়।

বাংলাদেশ তো আমার নিজের দেশ। আমার পরিবার এখান থেকে গেছে। আমি ছেলেবেলায় এখানে ছিলাম। কিছুদিন এখানে পড়াশোনা করেছি। তারপর যাই শান্তিনিকেতনে। তাই বাংলাদেশে এলে আমার আত্মিক সম্পর্কটা সঙ্গে সঙ্গে ফুটে বের হয়। সেটা বাংলাদেশে না এলে আসে নাএ রকম তো নয়। নানা সময়েই আমার মনে হয় ঢাকার কথা। মানিকগঞ্জে বাড়ি ছিল, মামাবাড়ি বিক্রমপুরে অথবা বেড়াতে গেছি চট্টগ্রামে ইত্যাদি। এগুলো খুব মনে পড়ে। এই যে মানসিক একটা যোগাযোগ, সেটা তো খুব বড় একটা যোগাযোগ।

মতিউর রহমান:  আপনি তো সংস্কারের কথাও বলেন, তবে নৈতিকতাবিহীন সংস্কার নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সংস্কারের বাইরে কেউ থাকতে পারছে না। কিন্তু আপনি সংস্কারকে নিয়ে আসছেন, পাশাপাশি মানুষকে বাদ দিয়ে সংস্কার নয়, এ কথাও বলছেন।

অমর্ত্য সেন:  সংস্কার শব্দটি আমার খুব পছন্দসই শব্দ নয়। সংস্কৃতি, সভ্যতা, সংস্কারটা অনেক সময় মনে হয় যেটা, চিন্তা না করেই আমরা মানতে পারি। একটা কথা তো আছেই, আমাদের সবারই কিছু বিশ্বাস থাকবে। এ বিষয়ে সুন্দর কথা বলেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। তিনি বলতেন, রহি আকল (The port of reason)। আরও বলতেন, আমার যে বিশ্বাস নেই তা নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাসগুলো আমার চিন্তা ও যুক্তির আগে নয়। যুক্তির পরে আমি ঠিক করব, আমি কী বিশ্বাস করব।

এখন সংস্কারটা, আমার ধারণা অনেক সময় ব্যবহার করা হয় যে চিন্তার আগেই যে বিশ্বাসগুলো আসে, সংস্কৃতি কিন্তু ঠিক তা না। সংস্কৃতি হচ্ছে একটা সভ্যতা। তার মধ্যে চিন্তাও যেমন সভ্যতার অঙ্গ, তেমনি যুক্তিও সভ্যতার একটা অঙ্গ। তা থেকে যদি বিশ্বাস আসে এবং সে বিশ্বাসের ভিত্তি কোথায়? তার মধ্যে চিন্তা ও আলোচনা, যুক্তি ও বিচার এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভূমিকা কী, এটা আমাদের ভাবা উচিত বলে মনে করি।

নীতিবোধের কথা যেটা বলছেন, নীতিবোধটাও আমার ধারণা, যুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। আমরা সমাজে বাস করি। প্রশ্ন উঠতে পারে যে কেন আরও কিছু করতে চাই অথবা আর কিছুই করতে চাই না। তাতেও একটা প্রশ্ন উঠবেইযুক্তিটা কী? কী কারণে আরও কাজ করতে চাই? আমি মনে করি না, যুক্তিহীন বিশ্বাসের কোনো রকম ভিত্তি আছে। আমার যে নতুন বই বের হচ্ছে, দ্য আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়া পেঙ্গুইন থেকে, তার মধ্যে বড় একটা চরিত্র হচ্ছে সম্রাট আকবর। তিনি তো ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু তাঁর ধর্মবিশ্বাসটাকে তিনি যুক্তি দিয়ে সমর্থন করেছেন। যুক্তি ছাড়া সমর্থন করছেন, এ রকম দৃষ্টান্ত নেই।

মতিউর রহমান:  বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু কথা বলবেন? কী রকম দেখেন এ দেশের সম্ভাবনা?

অমর্ত্য সেন:  বাংলাদেশ তো আমার নিজের দেশ। আমার পরিবার এখান থেকে গেছে। আমি ছেলেবেলায় এখানে ছিলাম। কিছুদিন এখানে পড়াশোনা করেছি। তারপর যাই শান্তিনিকেতনে। তাই বাংলাদেশে এলে আমার আত্মিক সম্পর্কটা সঙ্গে সঙ্গে ফুটে বের হয়। সেটা বাংলাদেশে না এলে আসে নাএ রকম তো নয়। নানা সময়েই আমার মনে হয় ঢাকার কথা। মানিকগঞ্জে বাড়ি ছিল, মামাবাড়ি বিক্রমপুরে অথবা বেড়াতে গেছি চট্টগ্রামে ইত্যাদি। এগুলো খুব মনে পড়ে। এই যে মানসিক একটা যোগাযোগ, সেটা তো খুব বড় একটা যোগাযোগ।

মতিউর রহমান:  বাংলাদেশের সম্ভাবনা কী রকম দেখেন?

অমর্ত্য সেন: আমার তো মনে হয় ভবিষ্যৎ খুব ভালো। যদি সামাজিক মাপকাঠিতে দেখেনসামাজিক চিন্তার কথা, যা এখন বলা হয়, তাতে তো বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে গেছে। শিক্ষার কোনো কোনো সূচকে এগিয়ে গেছে। আয়ুতে এখনো এগোয়নি। তা ছাড়া এই যে এনজিও, বলা যেতে পারে বেসরকারি কাজের যে গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশে হয়েছেব্র্যাক বা গ্রামীণ ব্যাংকএগুলো পৃথিবীর কাছে অনেক বড় জিনিস। আমার নিজের ধারণা, এটা শুধু দেখানোর জিনিস না, এতে করে সামাজিক একটা উন্নতি হচ্ছে এবং উন্নতির আরও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সেগুলোকে কীভাবে আরও পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

মতিউর রহমান:  সামনে সার্ক সম্মেলন, আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে কোনো কিছুর সম্ভাবনা কি আপনি দেখেন?

অমর্ত্য সেন:  আমার তো রিজিওনাল কো-অপারেশন নিয়ে একটা বক্তব্য আছে। আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানেরও যে একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে বিচার, বুদ্ধি, তর্কেরএটাকে আমি ইতিবাচক বিষয় বলে মনে করি। খুনোখুনি তো তর্কের বিকল্প নয়। সে জন্য তর্কটা আমাদের করা দরকার। মতবিরোধ তো হবেই। মতবিরোধ হলে আলোচনা করা দরকার। আমার ধারণা, তর্ক করার সংস্কৃতি বাড়ানো দরকার। আমাদের যদি প্রধান একটা সমালোচনা থাকে বিজেপির হিন্দুত্ব সম্পর্কে যে, তারা আলোচনা-যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে বিশ্বাস, সংস্কার এবং কিছু লোকের প্রতি আত্মীয়তাবোধ এবং অন্য লোকের প্রতি অনীহাএই দিকে জোর দিচ্ছে। সেটা নিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে বসে আমরা আলোচনা করতে পারি, তর্ক করতে পারি। আমার ধারণা, ভারতের ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করছে। তার সঙ্গে আমি যোগ করব, দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎও নির্ভর করছেনিজেদের মধ্যে আরও তর্ক করতে পারব কি না, এর ওপর।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের জল নিয়ে মতপার্থক্য হতে পারে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে তো নানা বিষয়ে ঝগড়া চলছেই ভারতের। কিন্তু সব বিষয়ে আলোচনা করে কীভাবে এগুলোর সমাধান করা যেতে পারে, সেদিকে অগ্রসর হওয়া দরকার সবার।

মতিউর রহমান:  আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

অমর্ত্য সেন:  ধন্যবাদ আপনাকেও।

 

সম্পাদকীয় নোট

২০০৪ সালে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ২০০৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন প্রথম আলোর সম্পাদক ও লেখক মতিউর রহমান। এটি প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয় ৩১ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে। সাক্ষাৎকারটি সংকলিত হয় ইতিহাসের সত্য সন্ধানে: বিশিষ্টজনদের মুখোমুখি গ্রন্থে। গুরুত্বপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটি প্রতিধ্বনির পাঠকদের কথা বিবেচনা করে পুনর্মুদ্রণ করা হলো।