মার্কিন বুদ্ধিজীবী, লেখক ও দার্শনিক নোম চমস্কির সাক্ষাৎকার

অ+ অ-

 

|| নোম চমস্কি ||

নামজাদা মার্কিন লেখক, ভাষাবিদ ও দার্শনিক। তাকে আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনক বলা হয়। জন্ম ১৯২৮ সালে, আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ায়। তিনি ১৯৫৫ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পিএইডি সম্পন্ন করেন। আলোচিত বহু গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। তার বিখ্যাতগ্রন্থসিনথেটিক স্ট্রাকচার (১৯৫৭), ল্যাংগুয়েজ এন্ড মাইন্ড (১৯৬৮), আসপ্যাক্ট অব দ্য থিওরি অব সিনটেক্স (১৯৬৫), দ্য মিনিমালিস্ট প্রোগ্রাম (১৯৯৫), ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট (১৯৮৮), ডেটারিং ডেমোক্রেসি (১৯৯১), আন্ডারস্ট্যান্ডিং পাওয়ার (২০০২) এবং গাজা ইন ক্রাইসিস (২০১০)। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে তার অবদান অসীম। আধুনিক চিন্তার ইতিহাসে অনন্য চমস্কি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় অভিষিক্ত হয়েছেন। মৌলিক বিজ্ঞানে অবদানের জন্য কিয়োটো পুরস্কার, কম্পিউটার ও কগনেটিভ সাইন্সে বিশেষ অবদানের জন্য হামবোল্ড মেডেল ও বেন ফ্রাঙ্কলিন মেডেলে ভূষিত হন। চমস্কি কনসেপ্ট অব ইউনির্ভাসাল গ্রামার’-এর প্রবর্তন করেন, যা সকল মানবভাষাকে একই কাঠামোতে নিয়ে আসে। যা মানুষের মন/মস্তিকের সহজাত কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুধুমাত্র ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রকে পরিবর্তন করেননি তিনি, তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন কগনেটিভ সাইন্স, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, কমপিউটার বিজ্ঞান, গণিত, শিশুশিক্ষা ও নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। চমস্কি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। কখনো নৈরাজ্যবাদী, আবার কখনো উদার-সমাজতন্ত্রী ভাবধারায় ব্যাখ্যা করেছেন। মূলস্রোতের করপোরেট গণমাধ্যমের আদর্শগত ভূমিকার একজন ধারালো সমালোচক চমস্কি। পুঁজিবাদ বজায় রাখায় নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত সম্মতি কিভাবে কাজ করে তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন তিনি।

 

|| সম্পাদকীয় নোট ||

কিংবদন্তি মার্কিন বুদ্ধিজীবী, ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোম চমস্কির পডকাস্টটি রেকর্ড করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে। এটি সঞ্চালনা করেন আরেক মার্কিন অর্থনীতিবিদ, লেখক ও অধ্যাপক টেইলর কোয়েন। পডকাস্টটির লিখিত রূপ ১৪ জুন ২০২৩ সালে প্রকাশ করা হয় নোম চমস্কির ওয়েবসাইটে (chomsky.info)। সম্প্রতি নোম চমস্কির পডকাস্টটির বাংলা অনুবাদের কপিরাইট পায় প্রতিধ্বনি। কপিরাইটের ডিউরেশন ৩ বছর। প্রকাশের সদয় অনুমতি দানের জন্য প্রতিধ্বনি নোম চমস্কি ও টেইলর কোয়েনের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। চমস্কির এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ।   

 

|| ভাষা, রাজনীতি, বাম-উদারতাবাদ ও প্রগতি প্রসঙ্গে ||

 

টেইলর কোয়েন: টেইলরের সঙ্গে কথোপকথনে সবাইকে স্বাগতম। আজকে আমি নোম চমস্কির সঙ্গে কথা বলবো। আর নোম সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে মনে করি না। নোম আপনাকে স্বাগতম।

নোম চমস্কি: আপনার সঙ্গে কথা বলে আমারও ভালো লাগবে আশা করি।

কোয়েন: আমি যদি আপনার চিন্তার সঙ্গে উইলহেম ফন হামবোল্ডের চিন্তার তুলনা করি, তাহলে দুজনের চিন্তার মধ্যে একটা সত্তাবিষয়ক সাধারণ উপাদান খুঁজে পাই। এই মিলের কারণেই আপনি ভাষার সঙ্গে স্বাধীনতার অকাট্য সম্পর্ক বিদ্যমান স্বীকার করে নিবেন, নিশ্চয়ই।

চমস্কি: ফন হামবোল্ড নিঃসন্দেহে একজন খ‍্যাতিমান ও প্রতিভাবান ভাষাতাত্ত্বিক ছিলেন, যিনি ভাষার কিছু মৌলিক নীতিমালা আবিষ্কার করেছিলেন। নীতিমালাগুলো সেই সময় সম্পূর্ণ নতুন ছিল আর এই সময়ে এসে আমরা কেবলমাত্র তা বুঝতে শুরু করেছি। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি শুধু আধুনিক গবেষণা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনকই ছিলেন না বরং ধ্রুপদি উদারনীতিবাদের জনকও ছিলেন।

তিনি যেমনটা বলেছেনস্বাধীনতা সম্পর্কে তার মৌলিক ভাবনা মূলত জন স্টুয়ার্ট মিলের অন লির্বাটি গ্রন্থের জন‍্য একটি অ্যাপিগ্রাম মাত্র। অর্থাৎ একজন ব‍্যক্তির মৌলিক অধিকার হলোপ্রথমত সকল বাহ‍্যিক অন‍্যায় চাপ বা বাধা থেকে মুক্তি। অন‍্যায় জিজ্ঞাসাবাদ থেকে মুক্তি। সব রকম স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসন বা বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত থেকে স্বীয় স্বার্থ ও মঙ্গলের জন‍্য কাজ করতে পারার অধিকার ও স্বাধীনতা।

কোয়েন: আপনি একবার দাবি করেছিলেন, হামবোল্ড এক মূলত প্লেটোবাদী ছিলেন। তিনি শিক্ষণের স্মৃতিমূলক ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। আপনিও কি ঠিক একইভাবে প্লেটোর ভাবধারার অনুসারী?

চমস্কি: লাইবনিৎসও একবার স্বীকার করেছিলেন, জ্ঞান সম্পর্কে প্লেটোর স্মৃতিবিষয়ক মতবাদ মূলত সঠিক। শুধু স্মৃতিতে ঘটে যাওয়া ভুলের অংশটুকু শুদ্ধ করে নিতে জানতে হবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়এই ভুল অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া কোন কিছু নয়। বরং আমাদের মানব প্রকৃতিতে সহজাত প্রক্রিয়ায় যে ভুল থেকে যায়।

এই বিষয়ে আমরা যেভাবে পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হতে পারি, লাইবনিৎস হয়তো তেমনটা পারেননি। আমরা এখন এমন বিষয়ে কথা বলবো যা লাইবনিৎসের সময় থেকে আরো বিবর্বিত হয়েছে এবং মানব প্রকৃতির সহজাত প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে গেছে। হামবোল্ডের মতো প্রজ্ঞাবান ব‍্যক্তির কাছে মানব প্রকৃতির সবচেয়ে মূল‍্যবান সহজাত প্রবৃত্তি হলো ‘মানব স্বাধীনতা’। মানুষের মৌলিক সত্তার মূল‍্য তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন‍্যায়ের ভিত্তিমূলে গ্রোথিত। এই ন‍্যায়ের ধারণা মানুষের ভাষা ও চিন্তার বিকাশের জন‍্যও সমান মূল‍্যবান। শুধু প্রাক-বৈজ্ঞানিক যুগের গ‍্যালিলিও বা লাইবনিৎস নয় রোমান্টিক যুগের হামবোল্ডও ন‍্যায় বিচারের সঙ্গে ভাষা ও চিন্তার এমন সম্পর্ক দেখতে পেয়েছিলেন। মানুষের ভাষার একটা মৌলিক গুণ আছে। মানুষের ভাষার ক্ষমতা মানুষকে তার মনের ভেতর সীমাহীন চিন্তা করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। শুধু নিজের ভাবনাকে অন‍্যের কাছে প্রকাশ নয় বরং অন‍্যর মনের ভাবনাকেও সুগঠিতভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। মানুষের স্বাধীন ভাষার সাহায্য এমন আরো অসংখ্য অনুপম কাজ করে দেখাতে পারে। গ‍্যালিলিও নিজেও মনে করতেন বর্ণমালা হলো মানুষের আবিস্কারগুলোর মধ‍্যে সবচেয়ে চমৎকার আবিষ্কার। কারণ এই বর্ণমালা দিয়েই আমরা এই আশ্চর্যজনক কাজগুলো করে থাকি।

হামবোল্ডের সূত্র মতে, ভাষাই আমাদের নতুন ভাষা ও নতুন চিন্তাকে তৈরি করে। এটা একরকম সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃত। ভাষা আমাদের সসীম বস্তুকে অসীমভাবে ব‍্যবহার করতে সক্ষম করে তোলে। আমরা এক সীমাবদ্ধ ব‍্যবস্থায় বসবাস করি। ভাষা একে সীমাহীন উপায়ে ব‍্যবহার করতে পারে। আর এই জটিল ও অপার সম্ভাবনার ধারণা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় মানে ১৯৩০ ও ১৯৪০ দশকে কুর্ট গডেল, অ‍্যালান টুরিং ও অন‍্যান‍্য গণিতবিদ কম্পিউটিং তত্ত্বকে উন্নত করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা বুঝতেই পারিনি। কিন্তু এখন সসীম কিভাবে অসীমভাবে কাজ করে তা আমরা ভালোই বুঝি। অসীমতাকে আমরা এখন এক ক্ষুদ্র লেপটপের মধ্যে হাতে মুঠোতে নিয়ে ঘুরি।

কোয়েন: এটা কি প্রাকৃতিক ভাষা ও কৃত্রিম ভাষার মধ‍্যে ভিন্নতা যা রুশোর রাজনৈতিক ভাবনাকে ভিন্নপথে নিয়ে গেছে?

চমস্কি: কোনদিকে নিয়েছে...?

কোয়েন: রুশো। আপনি একজন বাম উদারনীতিবাদী। সেই তুলনায় রুশো অনেকটা কর্তৃত্ববাদী। ঠিক কি না?

চমস্কি: রুশো একজন মিশ্র চরিত্রের লোক ছিলেন। তিনি পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করতেন না। আপনি রুশোর মধ‍্যে সবরকম চিন্তার প্রকাশ ও প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। আপনি যদি রুশোর সেকেন্ড ডিসর্কোস অন ইনেক্যুয়ালিটি পড়েন, তাহলে দেখবেন এটা অনেকটা উদারতাবাদীর পক্ষে। অনেকটা কার্তেসিয়ান নীতি থেকে উৎসারিত। সামাজিক সংগঠনের উদারতার ধারণার উপর কিভাবে মানুষের চিন্তা ও ভাষার মৌলিকাতা এবং সৃষ্টিশীলতার নীতি কাজ করে তাই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটা একরকম রুশো। আপনি আরো ভিন্নরকম রুশো পাবেন।

 

চিন্তা মূলত ভাষার মাধ‍্যমে গঠিত হয় মানে ভাষা চিন্তার জন্মদাতা। চিন্তা ও ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আলাদা করা সম্ভব না। ভাষাকে অনেক সময় শ্রুতিময় চিন্তা বলা হতো। এখন আমরা জানি চিন্তাকে শ্রুতিশীল না হলেও হয়। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই পরিবর্তনটা হয়েছে। আচরণবাদীদের প্রভাবে আমরা ভাবতে শুরু করেছি যে ভাষা হলো যোগাযোগের একটা যন্ত্র মাত্র। যা আবার প্রাণীবাদ অনুযায়ী বিবর্তিত হয়েছে। ব‍্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে সকল প্রাণীরই নিজস্ব প্রক্রিয়ার যোগাযোগ ব‍্যবস্থা রয়েছে। এমনকি সকল বৃক্ষ পর্যন্ত যোগাযোগ করে। তবে ধারণা করা হয় একমাত্র মানুষই সর্বোচ্চ পর্যায় ও প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করতে সক্ষম।

 

|| ভাষার বিবর্তনবাদী ধারা প্রসঙ্গে ||

কোয়েন: আপনি ভাষার বির্বতনবাদী পন্থার ব‍্যাপারে এতটা সংশয়ী কেন?

চমস্কি: না, আমি সংশয়ী নই। বরং বিবর্তনবাদ নিয়ে ভুলভাবে যে ভুল বোঝাবুঝি আছে তার ব‍্যাপারে আমি সংশয়ী। কেননা এই ভুল আমাদের ভাষার বিবর্তন সম্পর্কে অনেক ভুলভাবে চিন্তা করতে বাধ‍্য করে। আধুনিক যুগে মানে বিংশ শতাব্দীতে আচরণবাদের প্রভাবে কিংবা ডারউইনবাদের ভুল ব‍্যাখ‍্যাকারীদের কারণে একটা বিশ্বাস প্রচলিত হয়েছিল। কোথাও কোথাও এখনো বিশ্বাস করা হয় যে, মানবভাষা বিশেষ করে সকল ভাষা প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে সৃষ্ট হয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শেষ হয়েছে। এই ধ্রুপদি গ্রিক ভাষাই মূলত আমাদের চিন্তার বাহন। চিন্তা মূলত ভাষার মাধ‍্যমে গঠিত হয় মানে ভাষা চিন্তার জন্মদাতা। চিন্তা ও ভাষা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আলাদা করা সম্ভব না। ভাষাকে অনেক সময় শ্রুতিময় চিন্তা বলা হতো। এখন আমরা জানি চিন্তাকে শ্রুতিশীল না হলেও হয়। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই পরিবর্তনটা হয়েছে। আচরণবাদীদের প্রভাবে আমরা ভাবতে শুরু করেছি যে ভাষা হলো যোগাযোগের একটা যন্ত্র মাত্র। যা আবার প্রাণীবাদ অনুযায়ী বিবর্তিত হয়েছে। ব‍্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে সকল প্রাণীরই নিজস্ব প্রক্রিয়ার যোগাযোগ ব‍্যবস্থা রয়েছে। এমনকি সকল বৃক্ষ পর্যন্ত যোগাযোগ করে। তবে ধারণা করা হয় একমাত্র মানুষই সর্বোচ্চ পর্যায় ও প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করতে সক্ষম।

তবে এটা একটা বির্তকিত বিষয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত যে পূর্বতন মতবাদের ধারা বহুলাংশে সঠিক। কিন্তু আমার মতে এই প্রক্রিয়ায় মানুষের ভাষা ও চিন্তা বিবর্তিত হয়নি। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়ার বির্বতন লাভ করেছে। যেটা প্রকৃত বিবর্তনবাদের সঙ্গে যৌক্তিকভাবে সম্পৃক্ত। এমনভাবে বিবর্তিত হয় নাই যেমনটা অনেকে সহজভাবে বিশ্বাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভাষা ও চিন্তার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন ধারণাটি সামান‍্য তো দূরের কথা একেবারেই কোন অবদান রাখেনি। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রাণীর বিবর্তনবাদের সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়া বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আরো অনেক কিছু ঘটে। এই বিষয়ে অনেক শক্ত প্রমাণও আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আমাদের আংশিক কিছু প্রমাণ যদিও আছে কিন্তু এটা খুব পরিস্কার যে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি। আধুনিক মানুষ এসেছে এই দুই লক্ষ থেকে তিন লক্ষ বছর আগে। এটা বিবর্তন শুরু হওয়ার অনেক পরের যুগ।

আর এখন আমাদের হাতে মানুষের জেনোমিক বিশ্লেষণও আছে। অকাট্য প্রমাণ নিয়ে বলা যায় আধুনিক হোমোসেপিয়েন্সের খুদে দল যেমন দ্রুত একত্রে আর্বিভূত হয়েছে তেমনি বিবর্তন যুগে এসে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত ৫০,০০০ বছর আমরা সবাই জানি তাদেরও চিন্তা ও ভাষা ব‍্যবহার করার ক্ষমতা ছিল। এই বৃত্তিতে জীবন্ত মানুষের মাঝে তেমন কোন আলাদা পার্থক্য ছিলো না। এমনি ১,৫০,০০০ বছর আগে যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাদের উত্তরসূরীদের মাঝেও কোন ব‍্যবধান ছিল না। এর মানে এই যে বিচ্ছিন্নতার পূর্বেই চিন্তা ও ভাষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিতে ছিল।

আপনি যদি আধুনিক মানুষের আর্বিভাবের পূর্বের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখবেন হাড়, পাথর বা এমন কিছুতে উচ্চমানের কোন প্রতীকী বা সৃজনশীল কোন নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষের আগমনের অনেক পরে আপনি খুব উন্নত ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য নিদর্শন পাবেন, যেমগুহাচিত্রযা খুবই চমকপ্রদ।

আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে লাস্কো গুহা বন্ধ হওয়ার আগেই এর চিত্রকর্ম দেখতে পেয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতাটা ছিল অপূর্ব। আপনি আরো সহজে বুঝবেন যদি এই সম্পর্কে পিকাসোর অভিমত পড়েন। পিকাসো লাস্কোচিত্র দেখে বলেছিলেন, আমরা গত দশ হাজার বছরে আসলে শিল্পের কিছুই শিখিনি। যদিও লাস্কো প্রায় ৩০,০০০ বছরের পুরানো। না আরো পিছিয়ে যাই। সম্ভবত ৮০,০০০ বছর পূর্বে! এটা অনেক বড় সংখ‍্যা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বিবর্তনের সময়কালের হিসাব অনুযায়ী এটা এক চোখের পলকের মতো সময়।

আচ্ছা, এই সবকিছু কিসের ইঙ্গিত দেয়? এটাই বোঝায় না কি যে মানুষের আর্বিভাবের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে বিশেষ কিছু ঘটে গেছে। বিশেষ এই মৌলিক কিছু গুণ যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। যা নিয়ে গ‍্যালিলিও, হামবোল্ড ও অন‍্যেরা মুগ্ধতায় ছিলেন। তারপর থেকে পৃথিবী উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন হয়নি। মানুষের এই বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার বলয়ে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রায়োগিকভাবে এটা মানব প্রজাতির সবার মধ্যে সমানভাবে বিদ‍্যমান (তবে প্রচণ্ড বিকারগ্রস্ত হলে ভিন্ন কথা)। এমন অনন‍্য ক্ষমতা প্রাণী জগতের অন‍্য কোথাও দেখা যায়নি।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ সম্পর্কে আপনার ভ্রান্ত ধারণা কি এই ভাষার বিবর্তনবাদকে একটা অসাঞ্জস‍্যপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়? এটা বরং বিবর্তন তত্ত্বের সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ডারউইনের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, সকল বিবর্তনে পরিবর্তন খুবই ক্ষুদ্র থাকে। এমনকি তিনি এটাও বলেছেন, যদি এটা সত‍্য না হয় তাহলে আমার সম্পূর্ণ তত্ত্বটিই ভেঙ্গে পড়বে।

 

একদিকে টেকনোক্রেটিক ও নীতি-ভিত্তিক বুদ্ধিজীবীর দল যাদের সজ্জন কর্মীবাহিনী হিসাবে মানা হতো। অন‍্যদিকে মূল‍্যবিচার-ভিত্তিক বুদ্ধিজীবী যাদের দুষ্টের দল বলে মনে করা হতো। ম‍্যাকগ্রেগর বান্ডি যাদের বলেছেন সভ‍্যসভার বন‍্যপাল, যারা ন‍্যায়, স্বাধীনতা ও অধিকারের মতো আবোলতাবোল বিষয়ে কথা বলেন।

 

|| ভাষার বৃহৎ নকশা প্রসঙ্গে ||

কোয়েন: আপনি ভাষার বৃহৎ মডেল প্রসঙ্গে খুবই সমালোচনা প্রবণ আছেন। সম্প্রতি স্টিফেন উলফ্র্যাম তার একটা প্রবন্ধে যুক্তি দেখান যে সেই সব ভাষার মডেলগুলো সঠিক। মূলত আপনার ভাষাতত্ত্বের মতকেই সমর্থন করে বলে যে এই মডেলগুলো ভাষার অর্ন্তনিহিত কাঠামোকে সনাক্ত করে। না হলে তাদের কার্যকারিতা খুব সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?

চমস্কি: উলফ্র্যাম একজন চমৎকার ভাষাতাত্ত্বিক। আমি তার সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছিলাম। আমার মনে হয়, ওনার তত্ত্ব কিছুটা সত‍্য আবার কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ভাষার বৃহৎ মডেলগুলোর কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। এরা এটাই নির্দেশ করে যে মডেলগুলো আদতে আপনাকে ভাষা ও চিন্তা বিষয়ে তেমন কিছুই বলে না। খুবই সরল বৈশিষ্ট্য। মডেলগুলোর অন্তর্নিহিত নীতি কখনো পরিমার্জন বা পরিবর্তিত করা যায় না। তারা যেমন করে সম্ভাব‍্য ভাষার জন্য কার্যকর তেমনি অসম্ভাব‍্য ভাষার জন‍্যও কার্যকর। এটা এমন মনে হয়, যেন কেউ রসায়নের মতোই ভাষার সকল উপাদানের একটি নতুন পর্যায়-সারণি তৈরি করে সকল অস্তিত্বশীল ও অনস্তিত্বশীল ভাষার উপাদানকে অর্ন্তভুক্ত করে রেখেছে যাদের মধ‍্যে কোন পার্থক্য করা যায় না।

এটাই হচ্ছে ভাষার বৃহৎ মডেলগুলোর কারিশমা। ভাষার সকল নীতিমালাকে লঙ্ঘন করে এমন কোন তথ‍্য-উপাত্ত যুক্ত করে দেন। তারপরও দেখবেন এরা ঠিকঠাক কাজ করছে। কোন রকম বিপত্তি বা বিভাজন করবে না। এই নকশা একটা কাঠামোগত পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রথমে সকল এক মহাকাশ পরিমাণ তথ‍্য স্ক‍্যান করে। পরিসংখ্যানিক প্রণালি ও ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কিনা খুঁজে বের করে। তারপর সবকিছুকে এক জায়গায় জড়ো করে। এই প্রণালিতে তারা খুব দক্ষতার সঙ্গে যে কোন শব্দ সম্পর্কে সুন্দর ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে যে ঠিক কোন শব্দের পর কোন শব্দ আসবে।

যেমনটা আমি বলেছিলাম, অনেক চতুর প্রোগ্রামিংয়ের খেলা, ব‍্যাপক পরিমাণের কম্পিউটারের ক্ষমতা এবং অবশ্যই অবিশ্বাস্য রকম তথ‍্যের সমাহার একটা অকল্পনীয় ব‍্যবস্থা সম্পর্কে যা করে, মডেলগুলোও ভাষা নিয়ে তাই করে। যার ফলে নীতিগতভাবেই এরা ভাষা সম্পর্কে নতুন কিছুই জানায় না।

অন‍্য সব জৈব সংগঠনের মতোই মানুষেরও কিছু সহজাত ক্ষমতা আছে। আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যটাই এমন যে মানব ভ্রূণ পাখার বদলে হাত তৈরি করে। আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই একটা নবজাত শিশু তার চারপাশের শব্দকে নিজের মাঝে আত্মস্থ করে এবং পরে হুবহু তার অনুকরণ করতে পারে। এই অংশগুলোই ভাষা। আমি বলতে চাচ্ছি যে’—খুব সচেতন ভাবে নয়, বরং পুরোটাই স্বপ্রবৃত্তভাবে হয়—‘বুঝলেন এই অংশগুলোই ভাষা। আমি মানুষের পরিপক্কতার ধারাক্রম নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি। মানুষের পরিপক্কতার খুব নির্দিষ্ট একটা ধারাক্রম নিয়ে। অর্থাৎ প্রায় দুই বা তিন বছরে মধ্যে আমি ভাষার সকল মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিজের মধ‍্যে আত্মস্থ করে নিতে পারি।’

এখন আপনি আমার টেবিলের নিচে জগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জি বা কুকুর রেখে দেন। ঠিক একই শব্দ তারা হাজার বছর ধরে শুনবে। তারা কিন্তু একে নিছক শব্দ হিসাবে গ্রহণ করবে। অর্থ বাহক কোন ভাষা হিসাবে নয়। হ‍্যাঁ এটাই মানুষের মধ‍্যে নিহিত মৌলিক একটা গুণ। এই কারণেই আজ আমি আর আপনি আমাদের ভাবনাগুলো ভাষার সাহায্যে প্রকশ করছি কিন্তু একদল শিম্পাঞ্জি মিলে তা কখনোই পারবে না।

কোয়েন: আপনি কি মনে করেন মিডিয়া সম্পর্কে আপনার নিরীক্ষা বা বিচার-বিশ্লেষণ এবং নির্মিত সম্মতির ধারণা আপনার ভাষাবিষয়ক মতামত থেকে সৃষ্ট বা প্রভাবিত?

চমস্কি: ভাষা নয়। আমার সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে মতামত থেকে সৃষ্ট। আসলে “নির্মিত সম্মতি’ শব্দবন্ধটা আমার নিজের বানানো না। আমি এই ধারণাটা ওয়াল্টার লিপম‍্যানের কাছে থেকে ধার করেছি। উনাকে তো চেনেন? বিংশ শতাব্দীর বিখ‍্যাত বুদ্ধিজীবী ছিলেন। তিনি একইসঙ্গে উইড্র উইলসনের প্রোপাগাণ্ডা সভার সদ‍স‍্য ছিলেন।

আমি এটা এখানে বলতে চাই না। যদিও আপনিও আমার মতোই সত্যটা জানেন যে ১৯১৬ সালে উইলসন প‍্যাসিফিস্ট প্রোগ্রামের জোরেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। যেহেতু আমেরিকার জনগণ চাচ্ছিল না ইউরোপিয়ানদের যুদ্ধে জড়াতে। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলন, আমি যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখবো। কিন্তু অল্প কয়েকদিন পরই আমেরিকা মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে জড়ালো। ফলে তিনি এক মহাজটিল সমস্যায় পড়ে গেলেন। কিভাবে আপনি এক শান্তিপ্রিয় জনগণকে জার্মান-বিরোধী উন্মাদনায় লেলিয়ে দিতে পারেন, পারেন কি?

উইলসন খুব চমৎকারভাবেই এতে সফল হলেন। এর নীলনকশা হিসাবে উইলসন একটা কমিশন গঠন করলেন। পাবলিক ইনফরমেশ নামে একটা কমিটি বানালেন। যা আদতে ভুল তথ‍্যের সমাহার। এটাকে ক্রিল কমিশন বলা হয়। ওয়াল্টার লিপম‍্যান এই কমিটিরই সদস‍্য ছিলেন। এডওয়ার্ড বার্নেস নামে আরেকজন এই কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি গণসংযোগ ইন্ডাস্ট্রির অন‍্যতম প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন।

উইলসন ও বার্নেস দুজনেই লিপম‍্যানের নির্মিত সম্মতি ধারণা দিয়ে খুব মুগ্ধ ছিলেন। বার্নেস পরবর্তীকালে এই ধারণাকে সম্মতির প্রকৌশল নাম দেন। এই প্রক্রিয়াজাত সম্মতি জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখতো। জনমত গঠন করতে পারতো। শান্তিপ্রিয় জনগণকে জার্মান-বিরোধী উন্মাদে পরিণত করতে পারতো। যারা চোখের সামনে জার্মানজাত যে কোন কিছুকে হত‍্যা করতে চাইতো। 

নির্মিত সম্মতির কারণে শ্রমিকদের উপরও প্রচণ্ডভাবে আঘাত এসেছিল। এই বিষয়টা কর্পোরেট সেক্টরে আরো বেশি প্রভাব ফেলেছিল। তারা দেশপ্রেম-বিরোধী অভিযোগ এনে সব শ্রমিক সংঘকে ভেঙে গুড়ো করে দিয়েছিল।

যাই হোক, বার্নেসের মতো লিপম‍্যানও এই ধারণা দিয়ে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি একে গণতান্ত্রিক চর্চার একটা শিল্প হিসাবে অভিহিত করেন। তবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে বার্নেস ও লিপ্পম‍্যান দুজনেই যর্থাথ উদারনীতির অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তারা মনে করতেন, জনগণ মূলত নির্বোধ ও অজ্ঞ। তাদের কিসে ভালো তা তারা জানে না। আমরাই ভালো বুঝি। তাই তাদের হয়ে আমরাই জনকল‍্যাণের পরিকল্পনা করবো। আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় জনগণের আক্রোশ ও পদদলন থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখার জন‍্য প্রতিরক্ষা ব‍্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

এটা অনেকটা লেনিনের মতবাদের মতোই শোনাচ্ছে। সে একই রকম আড়ম্বরপূর্ণ ভাষা। তাই না? এই বিভাজনটা কেনেডির শাসন আমলের জন‍্যও সমানভাবে প্রযোজ‍্য। একদিকে টেকনোক্রেটিক ও নীতি-ভিত্তিক বুদ্ধিজীবীর দল যাদের সজ্জন কর্মীবাহিনী হিসাবে মানা হতো। অন‍্যদিকে মূল‍্যবিচার-ভিত্তিক বুদ্ধিজীবী যাদের দুষ্টের দল বলে মনে করা হতো। ম‍্যাকগ্রেগর বান্ডি যাদের বলেছেন সভ‍্যসভার বন‍্যপাল, যারা ন‍্যায়, স্বাধীনতা ও অধিকারের মতো আবোলতাবোল বিষয়ে কথা বলেন।

আগে থেকেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মাঝে এই মনোভাবটা সমানভাবে বিরাজমান, কোন রকম রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়াই বিদ‍্যমান। যেমনলিপম‍্যান বলেছেন, জনগণ শুধুমাত্র দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারবে। সরাসরি কোন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। পাবলিক অ‍্যাফেয়ার্সের কোন কিছুতেই জনগণের সরাসরি কোন সম্পৃক্ততা সম্ভব নয়। এই দায়িত্ব আমাদের মতো বুদ্ধিজীবীদের। যেমনটা রেইহোল্ড নেইবোর বলেছেন, একদিকে আমরা জনসাধারণের জন‍্য কল‍্যানকর কাজ করবো অন‍্যদিকে তাদরকে একটা ভ্রমের মধ‍্যে রাখবো আর সবকিছুকে অতি সরলীকরণের মাধ্যমে তাদের আবেগকে ছেঁকে রাখে।

এই কাজে সফল হতে হলে পাবলিক অ‍্যাফেয়ার্স থেকে অর্থনীতিকে সবসময় বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। উদার অর্থনীতিবিদসহ সকল অর্থনীতিবিদই এই বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মূলত উদার অর্থনীতিবিদরাই অর্থনীতিকে আলাদা করে রাখে। যদিও তা শুধুই একটি শুদ্ধ বিজ্ঞান মাত্র। আমরা বিজ্ঞানের খেয়াল রাখবো তাই জনগণের এই বিষয়ে নাক গলানো উচিৎ না।

উপরের সবকিছুই আধুনিক চিন্তার এক একটি প্রধান ধারা। কিন্তু তাদের উৎস অনেক প্রাচীন। নির্মিত সম্মতি বিষয়ে আমি ও অ্যাডওয়ার্ড হারম‍্যান যে বইটি লিখেছি তাতে আমরা এই প্রত‍্যয়গুলো নির্বাচন করেছি। মিডিয়ায় কাঠামো নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখাতে চেয়েছি যে, প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া কাঠামো, বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রত‍্যয়গুলো কিভাবে কার্যকরী ভাবে পক্ষপাদদুষ্ট প্রচারণার কাছে অবনত হয়।

 

ভাগ‍্য ভালো যে পৃথিবীতে এমন কিছু ব‍্যক্তি আছেন যারা এমনটা ভাবেন, যেমনপ্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব উইলিয়াম পেরি। তিনি তার সারাটা জীবন রাষ্ট্র ব‍্যবস্থায় নিউক্লিয়ার এস্টাবলিশম‍্যান্টের পিছনে ব‍্যয় করেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন যে তিনি এই বিষয়ে খুবই ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকেন। সন্ত্রস্ত এই কারণে যে আমরা দিনে দিনে এক মহাদুর্যোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দ্বিগুণ সন্ত্রস্ত কারণ এটাকে থামাতে কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সবাই নীরবতা পালন করছে।

 

|| প্রগতির সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ||

কোয়েন: আপনি ভবিষ্যৎ বিষয়ে খুব আশাবাদী। মানুষ যদি স্বভাবতই প্রোপাগাণ্ডা প্রবণ হয়। তাহলে এতোটা আশাবাদী কিভাবে থাকেন?  আমরা কি বিরামহীন ভাবে একটা ভ্রমাবস্থার মধ‍্যে আটকে নেই? যেখানে যতসব আজগুবি তথ‍্য প্রচার করা হয় আর আমরা সেগুলো বিশ্বাস করতে থাকি।

চমস্কি: প্রথমত, আমি খুশি হতাম যদি আমি আশাবাদী হতে পারতাম। পৃথিবী যেভাবে চলছে তা নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন ব‍্যাপার। আমরা দুটি জটিল সংকটের মুখোমুখি আছি। একটা হচ্ছে নিউক্লিয়ার যুদ্ধের আশংকা যেটা পৃথিবীর শেষ যুদ্ধ হবে। অন‍্যটি হলো পরিবেশ ধ্বংস করে মানবপ্রজাতির অস্তিত্ব সংকটের উওরণে প্রয়োজনীয় ও প্রায়গিক কোন পদক্ষেপ গ্রহণে ব‍্যর্থ হওয়া।

আমরা দুটি সংকট মোকাবেলায় বিপরীত দিকে হাঁটছি। কিন্তু আমাদের হাতে সময়ও কম। বিশ্ব নেতৃবৃন্দও আমাদের আশাহত করে এই বিপরীত পথে দ্রুত হাঁটছে। এই অবস্থায় আশাবাদী কিভাবে থাকি।

তবে আশার কিরণ কিছুটা আছে। আপনি যদি ইতিহাস দেখেন। তাহলে দেখবেন মানুষ সংগঠিত হয়, প্রতিরোধ করে, ঘুরে দাঁড়ায়। পীড়নমূলক স্বৈরাচারী শাসন কাঠামোকে ভাঙতে চায়। ন‍্যায় ও স্বাধীনতা বেষ্টিত একটা সীমানা তৈরি করে। অনেক কিছু করার আছে। আপনি যদি পিছন ফিরে দেখেন তাহলে লক্ষ্য করবেন আমার কতো কিছুকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছি। আবার এটাও দেখবেন গত দু’দশকের মধ‍্যে আমরা কতোটা অগ্রগতি করেছি।

১৯৬০ দশকের আমেরিকার দিকে ফিরে দেখেন। ওই সময় ব‍্যাপক ভাবে মিশ্র-জাত বিরোধীদের জন‍্য কঠিন আইন তৈরি করা হয় যা নাৎসিরা গ্রহণ করতে অপারগতা জানায়। পৃথক আবাসন ব‍্যবস্থা জারি রাখার জন‍্য ফেডারেল কর্তৃক আদেশ জারি ছিল। তার মানে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর বছরগুলোতে আফ্রো-আমেরিকান ও কৃষ্ণ-আমেরিকানরা হয়তো কারখানায় একটা ভালো চাকরি পাওয়ার অধিকার ও সুযোগ ছিল, কিন্তু লেভিটাউনে নিজের আলাদা বাড়ি কেনার সুযোগে ছিল না।

অবশ্যই, আমেরিকার বেশিরভাগ লোক সম্পদ বলতে বাড়ি গাড়ির সম্পত্তিকে বোঝায়। কিন্তু কালো আমেরিকান নাগরিকরা ৫০ ও ৬০ দশকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। আমেরিকান সমাজের মূল স্রোতে বাস করেও ফেডারেল আইনের পৃথকীকরণ আদেশ মেনে চলতে বাধ‍্য হতো।

যদি নারী অধিকারের কথা বলি। সেই ৬০ দশকেও নারীরা ফেডারেল আইনের চোখে পূর্ণ মানুষ নয় বরং সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হতো। এটা ১৯৭৫ সালের কথা যখন নারী মানুষ ও নাগরিক হিসাবে পূর্ণ অধিকার পায়। ফেডারেল বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়ার অধিকার পায়।

সব পরিবর্তন হয়েছে। ৫০-৬০ বছর আগের তুলনায় দেশ আরো সভ‍্য হয়েছে। কিন্তু এটা জাদুর মতো মুহূর্তে হয়ে যায়নি। জনমানুষের অনেক সংগ্রামের ফল এই পরিবর্তন। ইতিহাস খুড়ে দেখলে এমন অগণিত সংগ্রামের উদাহরণ পাবেন। আপনি এখানকার সময়কেই দেখুন না। আমি আগেও বলেছি নেতা-শ্রেণিরা এক মহাদুর্যোগের দিকে দৌড়াচ্ছে। জনগণের মাঝেই অনেক সমাজ সংস্কার কর্মী কাজ করে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বলছে, আমরা নিরাপদ ভবিষ্যৎ চাই। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের দিকে তাকালে আপনি এটাই দেখতে পাবেন।

এখন বলা যায়, দুটো মিটিং হচ্ছে। একটা গ্লাসগোতে। যেটা গতবার শারম এল শেখে হয়েছিল, ওই জায়গাটা এতো দূরে যে বেশি মানুষ একত্রিত হতে পারেনি। কিন্তু গ্লাসগোর মিটিংটা একটা হলের ভেতর হচ্ছিল। অনেক অভিজাত ও ভদ্র নারী ও পুরুষরা জমায়েত হয়েছে কিন্তু এই বিষয়ে কেউ কিছু বলছিল না। কিন্তু বাইরে হাজার হাজার তরুণ মিছিল করছিল আর চিৎকার করে বলছিল, জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে, তা থামাতে এখনই আমাদের জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা আমাদের এক দফা এক দাবী। জানেন কি? একটা মিটিং আশাবাদের কারণে হচ্ছে, আরেকটা হতাশাবাদের জন‍্য।

কোয়েন: নিউক্লিয়ার যুদ্ধ প্রসঙ্গে থমাস শেলিংয়ের মতবাদ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

চমস্কি: এটা ঠিক আছে। বির্মূত স্তর থেকে চিন্তা করলে আপনি বিষয়টিকে এভাবেই বলতে পারেন। আসল কথা হলো, নিউক্লিয়ার যুদ্ধের সম্ভাবনাকে চিন্তা করলেও, এটা এক পাগলাটে চিন্তা। দুটি পরাশক্তির মধ‍্যে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ হতেই পারে না। কেননা যে প্রথমে নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিক্ষেপ করবে সে অপর দেশকে নিমেষেই ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। অন‍্য দেশ আক্রমণ করার সময়ই পাবে না। এটা হবে একপাক্ষিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কার্যকারণ নিয়ে অনেক রকম কথা হতে পারে এবং শেলিংয়ের গেইম থিওরি অনেকভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। কিন্তু মূল কথা হলোএই রকম যুদ্ধ যেন না হয় তার সবরকম পদক্ষেপ নিবে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

ভাগ‍্য ভালো যে পৃথিবীতে এমন কিছু ব‍্যক্তি আছেন যারা এমনটা ভাবেন, যেমনপ্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব উইলিয়াম পেরি। তিনি তার সারাটা জীবন রাষ্ট্র ব‍্যবস্থায় নিউক্লিয়ার এস্টাবলিশম‍্যান্টের পিছনে ব‍্যয় করেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন যে তিনি এই বিষয়ে খুবই ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকেন। সন্ত্রস্ত এই কারণে যে আমরা দিনে দিনে এক মহাদুর্যোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দ্বিগুণ সন্ত্রস্ত কারণ এটাকে থামাতে কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সবাই নীরবতা পালন করছে।

মাঝে মাঝে কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। কয়েক সপ্তাহ আগে দ‍্য পিউ পোলিং এজেন্সি রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে জনগণের মনোভাব কি তার একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এগুলো খুবই মূল‍্যবান। সাম্প্রতিককালে তারা কিছু লোককে কিছু বিষয়ের উপর কয়েক জোড়া অপশন দিয়েছে। জরুরি প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো ক্রমান্বয়ে সাজাতে বলেছে। অবাক বিষয় নিউক্লিয়ার এই তালিকাটাই ছিল না। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন ছিল। তাও আবার তালিকার নিচের দিকে ২১ নম্বরে ছিল। নির্মিত সম্মতির এমন নির্লজ্জ প্রয়োগ ও বহিঃপ্রকাশই একদিন আমাদের ধ্বংসের কারণ হবে।

 

আপনি যদি আমেরিকার সবচেয়ে উৎসুক মাওবাদীর খোঁজ করেন তাহলে হেনরি কিসিঞ্জারের নাম প্রথমে আসবে। তিনি মাও অনুরাগী ছিলেন। মাওকে পূজা করতেন। আপনি যদি এমন একটা ছবি দেখতে চান তাহলে আমি বলবো নিক্সন-কিসিঞ্জারের উপর কারোলিন আইসেনবার্গের বিস্তৃত গবেষণাগুলো পড়ে দেখুন। আর্কাইভাল তথ‍্যের ভিত্তিতে সেগুলো লেখা হয়েছে। সবচেয়ে যেটা বেশি লক্ষণীয় তা হলো মাওয়ের প্রতি ভক্তিতে কিসিঞ্জারের চোখের তারা জ্বলজ্বল করে। তিনিই নিজেই মাওয়ের একজন অন্ধ চাটুকার ছিলেন।

 

|| বাম উদারনৈতিকতার ধারা প্রসঙ্গে ||

কোয়েন: আজকের দিনে সমগ্র বাম উদারনৈতিকতার ঐতিহ্যকে এত দুর্বল মনে হয় কেন, অন্তত আমার কাছে? আমি যদি রুডলফ রকারের নাম কারো কাছে বলি তাহলে খুব অল্প লোকই আছেন যারা তাকে চিনেন বা তার নাম শুনেছেন। আমি নিশ্চিত আপনারও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। হয়তো কেউ কেউ চিনবেন। তবে তারা আপনার লেখায় তার নাম পড়েছেন বলে চিনবেন। কিন্তু নিজ তাগিদে তাকে কেউ জানে কিনা আমি নিশ্চিত নই। ১৯৬০ দশকের নব‍্য বামপন্থিরা প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। কেন এবং কিভাবে এটি ঘটেছে বলে মনে করেন?

চমস্কি: আমি মনে করি না, এটা সত‍্য। ১৯৬০ দশক মানে দশ বছর। নব‍্য বামপন্থিদের জন‍্য সময়কাল হিসাবে খুব অল্প। তারা হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ছড়িয়ে গেছে কিন্তু ওই সময়ে একটা ভালো পরিবর্তনের ছাপ ও প্রভাব রেখে গেছে। এটা সমাজকে অনেকাংশে অনেক দিকে সভ‍্য করেছে। ৬০ দশকে মানুষ কোন কিছুকে বিনা বিচারে মেনে নিত না। আপনি হয়তো সহজে সরাসরি না বলতে পারবেন না। যুব সমাজের সক্রিয়বাদী কর্মকাণ্ডের প্রভাবটা এমনই। তাই এটাকে নব‍্য বাম বলা হতো।

এটা কোন আন্দোলন নয়। কিন্তু এটা সবজায়গায় বিস্তৃত। এটা আমাদের দেখার ও চিন্তা করার দৃষ্টি বদলে দিয়েছে। এটা একই সঙ্গে উদারতাবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ ও নৈরাজ্যবাদ। এবং অবশ্যই এরা কখনোই জনপ্রিয় হবে না। আমরা একটা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বাস করি। কট্টরভাবে শ্রেণিবিভাজিত সমাজ। ব‍্যবসায়ী শ্রেণি ও উচ্চধনশালী শ্রেণি সবসময়ই একটা শ্রেণিযুদ্ধ অবস্থা বজায় রাখতে চায়। তারা মূলত স্থূল মার্কসিস্ট, অবিরাম কঠিন শ্রেণি যুদ্ধে লিপ্ত। তারা সকল প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে। সব প্রতিষ্ঠানকে হাতের মুঠোয় বন্দি রাখে। অর্থনীতিকে নিজ বলয়ে অবরোধ করে রাখে। তাই তাদের স্বার্থ বিরোধী সব আইডিয়া পছন্দ করে না। সেসব আইডিয়ার কথা আপনারা শুনতেও পাবেন না। এটা সবসময় চলে আসছে। নতুন কিছু নয়।

জর্জ অরওয়েলের কাছে ফিরে যাই। তার একটা প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন ইংল‍্যান্ড কিভাবে মুক্ত হয়েছিল। যে কোন অখ‍্যাত আইডিয়া কোন রকম শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই দমিয়ে রাখা যায় শুধুমাত্র শ্রেণি বিভাজিত সমাজের বৈশিষ্ট্যর কারণে। শুধুমাত্র ক্ষমতার কাছে বুদ্ধিজীবীদের বশ‍্যতা ও আনুগত্যের কারণে। ঘটনাক্রমে তার প্রবন্ধটিকেও আড়ালে রাখা হয়েছিল আরো একটু নাটকীয়তা সৃষ্টি করার জন‍্য। পরবর্তীকালে তার অপ্রকাশিত প্রবন্ধের সঙ্গে এটিকে পাওয়া গিয়েছিল।

কোয়েন: কিছু নব‍্য বাম ক্রিটিকস বলেনআপনাদের আছে স্নায়ুযুদ্ধের কিছু সংশোধনবাদী যেমনসেইমুর মেলম‍্যান, পেন্টাগন পুজিঁবাদী যেমনসিডনি লেন্স, ডি.এফ. ফ্লেমিং। আমি নিশ্চিত আপনি সবাইকে জানেন। তাদের সবাইকে আমার কাছে ট্রামপিয়ান বলে মনে হয়। এখানে কিছু অস্বাভাবিক পরিস্থিতি আছে যেখানে বৈদেশিক নীতির ধারণা বিপরীতমুখী থাকে। সবসময় একটা ছায়া সরকারের নিপীড়নের ভয় কাজ করে। ট্রামপিস্টরা এটাকে একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। এই বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন আর কি অনুভব করেন?

চমস্কি: সংশোধনবাদীরা ছায়া-সরকার নিয়ে তেমন কিছু বলে না। তারা কথা বলে বিদ‍্যমান সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে, কর্পোরেট সেক্টর নিয়ে, যারা রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে অভাবনীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে, যারা সামরিক ও শিল্প ব‍্যবস্থাসহ অর্থনীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আপনি ওই সময়ের প্রধান লেখকদের পড়তে পারেন, যেমনগাব্রিয়েল কলকো ও অন‍্যান‍্য। তারা পলিসির প্রকৃতি কিভাবে নির্ধারিত হয় তাই নিয়ে বলেছেন।

নব‍্য বামদের লেখায় ওইরকম কিছু আড়ম্বরপূর্ণ শব্দ আছে বৈকি। কিন্তু বেশিরভাগই কৌতুকার্থে বলা। রিপাবলিক দলের ডানপন্থিরা মূলত ধনী করপোরেট সেক্টরের ক্রীতদাস ও পূজারী। শুধুমাত্র তাদের আইনবিভাগের প্রোগ্রামগুলো একটু দেখেন। ট্রাম্প যুগে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কোন আইন প্রণয়ন হয়নি। ২০১৭ সালে জোসেফ স্টিগলিজ যাকে ডোনার রিলিফ এ‍্যাক্ট বলেছেন। এই অ্যাক্টটা জনগণের অর্থের বিনিময়ে করপোরেট সেক্টরের উচ্চ ধনীক শ্রেণির কর মওকুফ করার একটা উপহার ছিল মাত্র।

এখনকার কর্মসূচিগুলো লক্ষ‍্য করে দেখেন। প্রধান কর্মসূচি নিজেই একটা লাল সতর্ক সংকেত হিসাবে হাজির। আপনি কখনোই ট্রাম্পের বিশাল কর কর্তনে হাত দিতে পারবেন না। এখন তাহলে আপনাকে কি করতে হবে? আপনি বরং আভ‍্যন্তরীণ রাজস্ব সেবাকে প্রত‍্যাহার করে নিতে পারেন। কেন? কারণ তারা কর কারচুপিতে সদা ব‍্যস্ত থাকে। কারা? ওইতো সবচেয়ে ধনী ও সুবিধাভোগী শ্রেণি। কিন্তু আমরা প্রত‍্যাহার করবো না। কেননা ওই বিশেষ শ্রেণিকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

ট্রাম্প খুব দক্ষতার সঙ্গে এই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। যেমনতিনি ছিলেন কূটবক্তৃতায় দক্ষ। তিনি কর্মজীবীদের সামনে এক হাতে আমি তোমাদের ভালোবাসি লেখা ব‍্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। অন‍্য হাতে তাদেরই পিঠের পিছে ছুরি বসিয়েছেন। এটাই আসল ট্রাম্প নীতি। আপনি যখন বৈদেশিক নীতির দিকে তাকান। শুনতে পাবেন টাকার কার্লসন ও অন‍্যেরা বলছেন, আমরা ইউরোপে আমাদের অর্থের অপচয় করতে চাই না। কিন্তু এখানেও একটা বটম লাইনও আছে। তারা এও বলেন, তার চেয়ে বরং চায়নার সঙ্গে যুদ্ধের জন‍্য আমরা আমাদের সম্পদ ও শক্তি সংরক্ষণ করতে চাই। একেই বলে উন্মাদনা।

আপনি ডেমোক্র্যাটদের ব‍্যাপারে অনেকটাই সঠিক। তাদের বৈদেশিক নীতিবিদের দল অনেকটাই পুরাতন নব‍্য রক্ষণশীলদের দ্বারা পরিচালিত হয়। বাইডেনের আশেপাশেও এই দলের লোকে ভরা। কিন্তু রিপাবলিকানরা তাদের চেয়েও বেশি বিদজ্জনক।

কোয়েন: আমি যদি সুসান সন্টাগের মতো কারো দিকে ফিরে তাকাই। তাহলে দেখি আপাতদৃষ্টিতে সন্টাগ একসময় মাওবাদীতে রূপান্তরিত হন। বাম উদারতাবাদীরা তার কাছে বারবার ফিরে যান কেন? কিন্তু অন্যেরা তেমন গুরুত্ব দেন না কেন? মাওবাদীর প্রধান আকর্ষণটা কি? এটা কি বাম উদারতাবাদের বিপরীত কিছু? আপনি কাদের পক্ষ নিবেন?

চমস্কি: ৬০ ও ৭০ দশকে বাম উদারতাবাদী বুদ্ধিজীবীদের মধ‍্যে একটা ফ‍্যাশন খুব প্রচলিত ছিল। তা হলো মাওবাদের সঙ্গে প্রণয়ভাব করা। মাওবাদ যে কি তাদের তেমন ধারণাও ছিল না। এটা একটা জটপাকানো গল্পের মতো। খুবই নিষ্ঠুর ও কর্কশ উপাদান মেশানো ছিল। ধ্বংসাত্মকও বলা যায়। মাওবাদের আরো কিছু বিষয় আছে যা এখানে তেমন আলোচিত হয় না।

মাওবাদী নীতির একটা তাৎপর্য হলো এটি একশ মিলিয়ন মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে একই বছরগুলোতে চায়নায় একশ মিলিয়ন মানুষ অনাহার ও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। আপনি ১৯৪৯ সালের স্বাধীনতার সময় থেকে ধরে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দুটি দেশের জনমিতির তুলনা করে দেখেন। শুধুমাত্র গ্রামীণ উন্নয়ন ও উপযুক্ত স্বাস্থ‍্যসেবার অভাবে একশ মিলিয়ন ভারতীয় মৃত্যু বরণ করেছে।

এই বিষয়ে একটা বড় সিক্রেট আছে। এই বিষয়ে নোবেল জয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত‍্য সেন একটা চমৎকার আলোচনা করেছেন। তিনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যদি বিষয়টা অতটা দুষ্পাঠ‍্য নয়। তবুও আপনারা হয়তো শোনেননি। আবার সেই নির্মিত সম্মতি। তাই বলে এই কারণে লোকেরা মাওবাদের সঙ্গে প্রণয়ভাব করে না। বরং মাওবাদ সম্পর্কে তাদের প্রচুর বিভ্রান্তিকর ধারণা রয়েছে।

আপনি যদি আমেরিকার সবচেয়ে উৎসুক মাওবাদীর খোঁজ করেন তাহলে হেনরি কিসিঞ্জারের নাম প্রথমে আসবে। তিনি মাও অনুরাগী ছিলেন। মাওকে পূজা করতেন। আপনি যদি এমন একটা ছবি দেখতে চান তাহলে আমি বলবো নিক্সন-কিসিঞ্জারের উপর কারোলিন আইসেনবার্গের বিস্তৃত গবেষণাগুলো পড়ে দেখুন। আর্কাইভাল তথ‍্যের ভিত্তিতে সেগুলো লেখা হয়েছে। সবচেয়ে যেটা বেশি লক্ষণীয় তা হলো মাওয়ের প্রতি ভক্তিতে কিসিঞ্জারের চোখের তারা জ্বলজ্বল করে। তিনিই নিজেই মাওয়ের একজন অন্ধ চাটুকার ছিলেন।

 

আমাদের এখনি ঠিক করতে হবে যে আগামী কয়েক দশকের ভেতর মানুষ কি সত‍্যিই পৃথিবীতে টিকে থাকতে চায়? না, একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চায়? আমরা উত্তরগুলো জানি, অন্ততপক্ষে যে সংকট ও সহিংসতার অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার সমাধানের সম্ভাব‍্য উত্তরগুলো জানি। কিন্তু এই ব‍্যাপারে কোন উদ্যোগ নিচ্ছি না। নেতৃত্বও আগের মতোই বিপরীতমুখী। এই রকম অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কার মাঝে কেউ কিভাবে নিশ্চিন্ত ও নির্ভার থাকতে পারে।

 

|| নিকারাগুয়া ও কিউবার উন্নয়নের গতিপথ প্রসঙ্গে ||

কোয়েন: নিকারাগুয়া ও পানামার মধ‍্যে কোন দেশ অধিক উন্নয়নের সহজ পথ পেয়েছে? নিকারাগুয়া সমাজতন্ত্র নিয়ে অল্প বিস্তর পরীক্ষণের সুযোগ নিয়েছে। পানামা অনেকাংশে পুঁজিবাদের পথ অবলম্বন করেছে। পানামা কি একদিকে নিকারাগুয়া থেকে বেশি উন্নয়ন করেনি? আমি গত ১০ বছর ধরে দুই দেশেই থাকার সুযোগ পেয়েছি। আমার কাছে এই দুদেশের অগ্রগতি কাছাকাছি বলে মনে হয় না। আমি মনে হয় কোন একটা জায়গা ঠিক ধরতে পারিনি?

চমস্কি: সত‍্যিকারে যেটা ঘটেছে আপনি সেটাই ধরতে পারেননি। ১৯৮০ দশকে হাইতির পর নিকারাগুয়া ছিল লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরিদ্র দেশ। ১৯৮০ দশকের শুরুর দিকে স‍ান্দিনিস্তা বিপ্লব পুরো চিত্র বদলে দিল। এটা বিভিন্ন কর্মসূচিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে লাগলো যা বিশ্ব ব‍্যাংক, আন্তর্জাতিক আর্থিক সংগঠন বা অক্সফামের মতো সংগঠনের প্রশংসা কুড়াতে লাগল। নিকারাগুয়া ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল। এটা একটা বিপর্যয়ই ছিল। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের শাসনে সকল রাষ্ট্রই থাকে। কিন্তু নিকারাগুয়া ৮০ দশকের প্রথমার্ধ থেকে তার দারিদ্রতা থেকে সফলতা সঙ্গে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

যখন রোনাল্ড রিগ‍্যান নিকারাগুয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল, যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে বিশ্ব আদালতের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। বিশেষ করে নিকারাগুয়া যুদ্ধে বেআইনিভাবে শক্তি প্রয়োগের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। উল্লেখযোগ্য ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশও দিয়েছিল। রিগ‍্যান প্রশাসন ও কংগ্রেস যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।

যাই হোক, যুদ্ধের একটা শক্ত প্রভাব পড়েছিল। এটা উন্নয়নের কর্মসূচিকে অকেজো করে দেয়। আশাবাদকে ভেঙ্গে দেয়। পুনরায় নিকারাগুয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসে। কিন্তু নিকারাগুয়া পুরোপুরি বশ‍্যতা স্বীকার করেনি। এটা এখন স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটি এখনো কিছু সামাজিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু  ৮০ দশকে যে কর্মসূচিগুলো হাতে নিয়েছিল তাকে আর ধরে রাখতে পারেনি।

পানামা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প। এই দেশ এখন আমেরিকান বিনিয়োগের উর্বরভূমি। বিশেষ করে পুঁজি বিনিয়োগের। পানামা খাল তাদের আয়ের এক বিশাল উৎস। পানামার সঙ্গে নিকারাগুয়ার কোনো তুলনাই চলে না।

কোয়েন: কিউবা যদি ডোমিনিকান রিপাবলিকের পথ অনুসরণ করত, কিউবা কি আজকে অধিক অগ্রগতি করতে পারত না? অসংখ্য বহুজাতিক করপোরেশনকে ব‍্যবসায়ের আমন্ত্রণ জানাত। মুক্ত বাণিজ‍্য অঞ্চল তৈরি করত। ব‍্যবসায়ের বিশেষ প্রচেষ্টা চালাত। আজকে ডোমিনিকান রিপাবলিক লাতিন আমেরিকার অন‍্যতম সম্পদশালী দেশ।

চমস্কি: ঠিক আছে। তাহলে চলুন কিউবা দিয়েই শুরু করি। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে কিউবা সবচেয়ে পুরাতন ইস‍্যু। ১৮২০ সালের দিকে ফিরে যাই। তখন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে স্পেনের শাসন থেকে নিজের আওতায় এনে একটি দাস রাষ্ট্র বানিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সচিব জন কুয়েন্সি মনে করেছিলেন এমনটা আর সম্ভব নয়। কেননা বৃটিশরা মহাপরাক্রমশালী। তারা আমাদের এটা করতে দিবে না। আমাদের ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণে কিউবা নিজে রাজনৈতিক স্বার্থ ও ঝোঁকে আমাদের বলয়ে না আসে। আমরা আরো শক্তিশালী হবো। বৃটেন আরো নাজুক হবে। ঠিক তখনই কেবল আমরা কিউবা দখল করব।

১৮৯৮ সালে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। কিউবা স্প‍েন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আরম্ভ করছিল। যুক্তরাষ্ট্রও কিউবাকে স্বাধীনতার পথে সাহায্যের জন‍্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আদতে তারা কিউবা যাতে স্পেন থেকে মুক্ত না হতে পারে তারই আয়োজন করছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে এক প্রকারে তার ভার্চুয়াল উপনিবেশ বানিয়েছিল। সেভাবেই চলছিল। ধীরে ধীরে কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির মহামাফিয়া হয়ে উঠেছিল। বেশিরভাগ জনগণের জন‍্য এটি এক ভয়ংকর পরিস্থিতি হয়ে উঠেছিল।

১৯৫৯ সালে কিউবা নিজেকে স্বাধীন করেছিল। কয়েক মাসের মধ‍্যে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ ফ্লোরিডা থেকে কিউবাতে বোমা নিক্ষেপ শুরু করেছিল। পরের বছর মার্চে আইসেনহাওয়ার প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে কিউবা সরকার পতনের সিধান্ত নেয়। কেনেডি এসে পুনরায় আবার আগ্রাসন চালায় এবং ব‍্যর্থ হয়। তারপর তো কিউবার উপর সন্ত্রাসী আক্রমণও শুরু করে।

কোয়েন: সেটা তো অনেক কাল আগের কথা, তাই না? তারপর কিউবার হাতে যথেষ্ট সময় ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর আর উন্নতি করার।

চমস্কি: কিউবা প্রায় ৬০ বছরের মতো একটা পাশবিক আক্রমণের ভিতর ছিল। এটা খুব আশ্চর্যজনক যে দেশটা শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে। কিউবার স্বাস্থ্য সেবার পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ থাকার পরও কিউবা জৈবপ্রযুক্তি ভিত্তিক চিকিৎসা সেবা গড়ে তুলেছে, যা সারা বিশ্বের জন‍্য এক আশ্চর্য ঘটনা। তারা এমন অবরোধে মধ‍্যে আছে যা শুনলে অবাক হতে হয়, যেমনকিউবা হয়তো ভ‍্যাকসিনের জন‍্য কোন কাঁচামাল সুইডেন থেকে আমদানি করতে হবে কিন্তু তারা সেটা করতে পারবে না।

যুক্তরাষ্ট্র খুবই সহিংস ও বর্বর দেশ। যখন যুক্তরাষ্ট্র কোন রকম অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। চুক্তিভিত্তিতে এটা একটা তৃতীয়-পাক্ষিক নিষেধাজ্ঞা। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে বাধ‍্য থাকে। যদিও নৈতিকভাবে অনেকে বিরোধিতা করে কিন্তু মেনে নেয়। জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে দেখেন। ভোটের অনুপাত ১৮৪/২, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল এর পক্ষে। অন‍্য সবাই এর বিপক্ষে। সবচেয়ে নিষ্ঠুর রাষ্ট্রের ভয়ে অন‍্যসব রাষ্ট্র আমেরিকার অবরোধ সিদ্ধান্ত মানতে বাধ‍্য হয়।

এসব কিছুর ভিতরে কিউবা যে এখনো টিকে আছে তা খুবই আশ্চর্যজনক। আপনি যদি এর স্বাস্থ্যসেবা মানের পরিসংখ্যান বিচার করেন, জীবনযাত্রার মান বিচার করেন তাহলে বলব এটা এই গোলার্ধে সবচেয়ে উন্নত। এমনকি আমেরিকা থেকেও অধিক ভালো।

কোয়েন: কিউবা তো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব‍্যবসায় বাণিজ্য করতে পারে, তাই না?

চমস্কি: না, তারা পারে না।

কোয়েন: স্বাস্থ‍্যবিষয়ক অনেক পরিসংখ্যান আছে যা বোনোয়াট ও মিথ‍্যা বলে সামনে এসেছে। লাতিন আমেরিকা অন্য রাষ্ট্রগুলো তো কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারে। আপনি তো মেক্সিকো থেকে কিউবায় যেতে পারেন।

চমস্কি: যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার আগ্রহ দেখায় তাহলে আমেরিকা তাকে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব‍্যবস্থা থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিবে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটু মেনে চলে।

কোয়েন: বিগত বিশ বছরে এমন কোন বাম চিন্তাবিদ কি আছে যার চিন্তা আপনাকে মুগ্ধ করেছে?

চমস্কি: আমি ওইসব তরুন-তরুণীর প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করি যারা পৃথিবীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পথে পথে প্রতিবাদ করছে। অনেক বাম চিন্তাবিদই আছেন কিন্তু কাউকেই আলাদা করে উল্লেখ করার মতো নেই।

কোয়েন: কিন্তু একজন লেখক হিসাবে কাদের লেখায় আপনি অনুপ্রাণিত হন? কাদের পরবর্তী গ্রন্থের জন‍্য আপনি অপেক্ষা করেন? কাদের সঙ্গে আপনি দেখা করার, কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করবেন?

চমস্কি: আজকের দিনে এই যুগে, কিছু লিখে পাঠকের কাছে পৌছানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইন্টারনেট। কেননা অনেক লোক এখন আর বই পড়ে না। আমি নিয়মিতভাবে আমার বইয়ের সাক্ষাৎকার ও আলোচনা করি। গত কয়েক বছরে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। আগামীতে আরো আসবে।

কোয়েন: বিগত বিশ বছরে এমন কোন ডান চিন্তাবিদ কি আছেন যার চিন্তা আপনাকে মুগ্ধ করেছে?

চমস্কি: এটা সেই একই প্রশ্ন হলো। আমি বামপন্থি ও ডানপন্থি চিন্তাবিদদের অসংখ্য বই পড়ি। আমার কাছে লেখার মানটাই মূখ‍্য, লেখক নয়। তাই কোন রকম র‍্যাঙ্কিং করি না।

কোয়েন: নোয়াম চমস্কির সৃজনশীল কার্যকারিতা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন। আপনার এই অশীতিপর জীবনে এসেও আপনি এতটা প্রাণবন্ত আছেন কিভাবে?

চমস্কি: এত এত তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করার উপরি পাওনা এটা। আমরা সে সব বিষয়ে কথা বলে আসছি তাকে শেষ করার কোনো কারণই দেখছি না। আমি বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ উদ্দীপনা নিয়ে চালিয়ে যাওয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ। অনেক বিষয়ে কাজ করা যায়। কিন্তু মানুষের কল‍্যাণে কাজ করা এককথায় অনবদ‍্য। আমদের স্বীকার করতে হবে আমরা মানব ইতিহাসে সবচেয়ে অনুপম সময় পার করছি। এমন সব ঘটনার পটপরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি যা মানব সভ‍্যতা গত কয়েক হাজার বছরেও দেখেনি।

আমাদের এখনি ঠিক করতে হবে যে আগামী কয়েক দশকের ভেতর মানুষ কি সত‍্যিই পৃথিবীতে টিকে থাকতে চায়? না, একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে চায়? আমরা উত্তরগুলো জানি, অন্ততপক্ষে যে সংকট ও সহিংসতার অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার সমাধানের সম্ভাব‍্য উত্তরগুলো জানি। কিন্তু এই ব‍্যাপারে কোন উদ্যোগ নিচ্ছি না। নেতৃত্বও আগের মতোই বিপরীতমুখী। এই রকম অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কার মাঝে কেউ কিভাবে নিশ্চিন্ত ও নির্ভার থাকতে পারে।

কোয়েন: আপনি কি বংশগতভাবেই এতটা প্রাণবন্ত নাকি অপরিহার্যভাবে স্বতঃস্ফূর্ত?

চমস্কি: এই ব‍্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারে না।

কোয়েন: এটা আপনি ও হেনরি কিসিঞ্জারের, তাই না? কেউ কি কখনো আপনাদের দুজনকে একসঙ্গে ভাবতে পেরেছিল?

চমস্কি: এটা একটা রহস‍্য, জনাব। একটা রহস‍্য।

কোয়েন: আপনি নাকি প্রত‍্যেকটা ইমেইলের উত্তর দেন, কেন?

চমস্কি: কারণ আমি মানুষকে সিরিয়াসলি নেই। আমি মনে করি প্রত‍্যেকটা মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিৎ।

কোয়েন: দুটা শেষ প্রশ্ন। প্রথম হলোআপনার সম্পর্কে মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা কি?

চমস্কি: মানুষ কি পড়ছে এটা তার উপর নির্ভর করে। যারা নিউজ উইক পড়ছে তারা হয়তো ধরে নিবে আমরা ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করার পক্ষে। আদর্শবাদী পত্রিকাগুলোতে নির্মিত সম্মতি এমনভাবেই কাজ করে। কিন্তু তারা যদি আমার লেখা পড়ে তাহলে একই বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পাবে।

কোয়েন: শেষ প্রশ্ন। আসন্ন দিনে আপনি নতুন কি করবেন?

চমস্কি: হুম। আগামী ১০ মিনিটের মধ‍্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে টেক্সাসে অনুষ্ঠিত একটা কনফারেন্সে আমি লম্বা একটা আলোচনায় বসবো। এটা একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান। তারপর আবার আমি আমার মস্তিষ্কের দুপাশে দুটি বিষয়ে কাজে নেমে যাবো। এক পাশে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস‍্যু আর অন‍্যপাশে বুদ্ধিবৃত্তিক কড়চা।

কোয়েন: আপনার সমগ্র ক‍্যারিয়ারে কখনো কি মনে হয়েছে যে আপনি এই বিষয়ে ভুল ছিলেন?

চমস্কি: এমন অনেক বিষয় আছে যাতে আমি ভুল ছিলাম। ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথাই যদি বলি আমি এটাকে নিয়ে খুব ব‍্যস্ত ছিলাম। ওই বছর দুয়েক সময় আমার সারাজীবনের সমান মনে হয়েছিল। কিন্তু আমি এর সঙ্গে অনেক দেরিতে জড়িত হয়েছিলাম। ৬০ দশকের প্রথমার্থে যখন কেনেডি যুদ্ধটাকে বাড়িয়ে দিল তখন আমি সিরিয়াস হয়েছিলাম। যেখানে ১০ বছর আগেই এই বিষয়ে সজাগ হওয়া উচিৎ ছিলো। আমি সঠিক সময়টা ধরতে পারিনি। আমি ভুল ছিলাম।

এখন আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৫০ দশকের প্রথমেই এই বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধের মুক্তমঞ্চ তারা তখনই তৈরি করে রেখেছিল। সেই সময় আওয়াজ তোলার উপযুক্ত সময় ছিল। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। এমন অনেক বিষয়ে আমি সঠিক সময়ে এগিয়ে আসিনি। এমনকি আজকে এমন কিছুতে এগিয়ে আসা উচিৎ কিন্তু আসছি না।

কোয়েন: হলোকাষ্ট কি তাহলে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ নয়?

চমস্কি: বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের বলতে পারেন।

কোয়েন: ওহ, বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ। নোয়াম চমস্কি। আপনাকে ধন্যবাদ।

চমস্কি: আপনাকেও ধন‍্যবাদ।

 

টেইলর কোয়েন

মার্কিন লেখক, বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপক।  ১৯৮৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন তিনি। সহকর্মী অ্যালেক্স ট্যাবারকের সাথে কোয়েন যুগ্মভাবে অর্থনীতি বিষয়ক ব্লগ মার্জিনাল রেভোল্যুশন এবং শিক্ষবিষয়ক অনলাইন প্ল্যাটর্ফম মার্জিনাল রেভোল্যুশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য গ্রেট স্ট্যাগনেশন: হাউ আমেরিকা এইট দ্য লো-হ্যাঙ্গিং ফ্রুট অব মডার্ন হিস্ট্রি, গট সিক এন্ড উইল (ইভেনচ্যুয়ালি) ফিল বেটার (২০১১)। সর্বশেষ গ্রন্থ গোট: হু ইজ দ্য গ্রেটেস্ট ইকোনমিস্ট অব অল টাইম এন্ড ওয়াই ডাজ ইট ম্যাটার? (২০২৩)। কোয়েন ইমারজ্যান্ট ভেনচার্সের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কনভারসেশন উইথ টেইলর নামক জনপ্রিয় পডকাস্ট সিরিজের উপস্থাপক ও আলোচক। তার গবেষণা আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউ, দ্য জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি, এথিক্স, ফিলোসফি এন্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে কোয়েন জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং মারক্যাটাস সেন্টারের পরিচালক।

 

পডকাস্টটি শুনতে ক্লিক করুন  নোম চমস্কি সঙ্গে টেইলর কোয়েন

Copyright © Tylor Cowen  ||  বাংলা কপিরাইট © প্রতিধ্বনি