পু

অ+ অ-

 

পিপু

আমার নাম পিপু। মা আদর করে ডাকে পু। পু মানে ভালোবাসা। ডুমুরগাছের পাশে বড় ঘাসের ফাঁকে যাচ্ছিল আমাদের একটি দল। সেখানে মজার একটি পোকার সন্ধান পাওয়া গেছে। মা-বাবা যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে নিল।

বিকেলের আলো পিঠের উপর সোনালি চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আমরা দ্রুত হাঁটছিলাম। মাঝামাঝি গেছি। পথ আগলে দাঁড়াল কয়েকজন মানুষ। একজনের হাতে অস্ত্র। তারা একটা মানুষকে ঘিরে ধরেছে। ওর মুখটা ভয়ার্ত।

থেমে যাব কিনা ভাবছিলাম। দলনেতা বললেন, পাশ কাটিয়ে চলো। তারপর কী হয়েছে বলতে পারব না। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম হয়ত। কখন জ্ঞান ফিরেছে জানি না। দেখলাম এক ফোঁটা রক্ত; কিছুটা জমাট হয়ে এখন থকথকে কাদার মতো। রক্তের ভেতর পড়ে আছে মা-বাবা। আমার পা-ও রক্তে ডুবে আছে। নাড়াতে পারছি না। কী করে পারব? গায়ের উপর বিশাল এক মানুষ। নড়াচড়া নেই। মানুষটা কি মরে গেছে?

কত কত শব্দের গুনগুনানি! আমি শব্দের ঘ্রাণ পাচ্ছি। ঘ্রাণ থেকে বুঝতে পারছি সব কথা। কিন্তু ওইসব কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে মা-বাবাকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে।

 

পিপু জানে, একটু আগে সিলভার কালার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিল হায়দার। বেরুনোর সময় বউকে চুমুও খেয়েছিল। বউ সবে নামাজ পড়ে উঠেছে। কাপড় বদলায়নি। প্রশংসার চোখে তাকিয়ে বলেছিল, সাদা শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

মাঝখানে মাত্র দশ মিনিট সময়। এখন কি মৃত্যু হায়দারকে চুমু খেয়ে দুটি ডানায় হাওয়া লাগিয়ে কোথাও উড়ে গেছে! তাকে চিত করলে দেখা যেত, বুকের বাঁ পাশে একটা ছিদ্র। রক্ত জমাট বেঁধে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। যেন অনেক দিন কৌটায় পড়ে থাকা খয়েরি টিপ।

রাস্তার উল্টো দিকে মোটরসাইকেলের গ্যারেজ। গ্রিলের ফাঁকে চোখ রেখে এক মিস্ত্রি বলল, একটা গুলির শব্দ শুনেছি।

গ্যারেজের মালিক বলল, আসল জায়গায় লেগেছে। এক গুলিতেই শেষ মনে হয়।

আধ কিলোমিটার দূরে হায়দারের বাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে খবর পৌঁছে যায়। সবাই হতবাক। আর্তনাদে, হাহাকারে কেঁপে ওঠে পাড়া।

পাড়ার অনেকে গুলির শব্দটা শুনেছিল। স্কুলের মাঠে আড্ডা দেওয়া ছেলেরা দৌড় দেয়। শুক্কুর কামলাদের নিয়ে ধানক্ষেতে কাজ করছিল। সেও দৌড়ে রাস্তায় ওঠে। বউ-ঝিরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। চাপা আতংক নিয়ে সবাই বড় রাস্তার খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। হোসনে আরার বুক খালি হয়েছে কিনা তা নিয়ে কেউ কেউ আশঙ্কা করে। ওরা বলে, ফটিকছড়িতে তো সন্ত্রাসী বাহিনীর শেষ নেই। দিন-রাত ঠুসঠাস শোনা যায়।

শুক্কুর বলল, হায় আল্লাহ! হায়দার মারা গেছে!

শুক্কুরের কামলা বলল, গুলি করার পরপর দিদাররা পালিয়ে গিয়েছিল। ওরা নাকি মারতে চায়নি; ভয় দেখাতে চেয়েছিল।

হায়দার কাতার থেকে এসেছে দুই মাস আগে। আসার পর থেকেই সন্ত্রাসীরা চাঁদা চাচ্ছে। চাঁদা না দিলে খবর আছে বলে হুমকিও দিয়েছে। কিন্তু চাঁদা না দিতে ওর মা বারবার নিষেধ করেছিলেন। মায়ের কথায় সে গোঁ ধরে বসেছিল। একটু আগে যখন রাস্তার মাথায় উঠল, ওরা তাকে আটকায়। বলে, চাঁদা না দিলে যেতে পারবে না। ভয় পেয়ে সে পালাতে চেয়েছিল। ধস্তাধস্তির মধ্যেই কি গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল?

বড় রাস্তা থেকে আসা শুক্কুরের ছোট ভাই ওসমান বলল, ওরা তাকে ওদের আস্তানায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। টাকা পেলে ছেড়ে দিত।

ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। তাই ওসমানের কথা কতটুকু সত্য কেউ বলতে পারছে না। লোকজন গোপন লেনদেন, বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ, প্রেমিকের সঙ্গে ঝগড়া করে সুন্দরী ভাগ্নির ইউরিয়া সার খাওয়া নিয়ে কথা বলে।

হায়দার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সন্ত্রাসীরা চলে যায়। এরপর লোকজন জড়ো হয়। কিছুক্ষণ পর পাশ দিয়ে যাওয়া সাদা মাইক্রোবাসটা থামাল তারা। হায়দারকে ধরাধরি করে তোলা হলো। নাজিরহাট বাজারের পাশে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেল। হাসপাতালে তখন আলো কমেছে এসেছে। বড় বড় গগন শিরীষগাছগুলোর আগা থেকে শেষ বিকেলের আলো মুছে গেছে। হাসপাতালজুড়ে সন্ধ্যার বিষণ্নতা।

জরুরি বিভাগে ঢোকানো হলো। ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। তারপর হয়ত বাইরে এক পলক চোখ গেল। তিনি কি আকাশ ঢেকে দাঁড়ানো গগন শিরীষের উপর দিয়ে মৃত্যুকে উড়ে যেতে দেখলেন? একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। আহা! ২৭-২৮ বছরের যুবক, কী সুন্দর গায়ের রং! দেখতে একেবারে আনারের মতো।

 

খবর শোনার পরপরই মূর্ছা গেল হায়দারের বউ।

হোসনে আরা মনে করেছিলেন ডাকাত পড়েছে। ডাকাতরা বাড়ির দিকে আসছে। কেননা কিছুদিন আগে ডাকাতদল চিঠি দিয়েছিল। কষ্টকর অতীতের কথা মনে পড়ে। বুকে কাঁপুনি। ছেলে মরুভূমির দেশে অনেক কষ্ট করে টাকা রোজগার করেছে। তাঁর আশঙ্কা, সুখ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

হঠাৎ বুদ্ধি আসে। তিনি দ্রুত আলমারিটা খোলেন। খাঁকি থলেয় স্বর্ণ ও টাকার বান্ডিল। থলেটা শাড়ির আড়ালে বুকে চেপে পুকুরের পশ্চিম পাড় পেরিয়ে দক্ষিণ পাড়ের ঘরে ঢোকেন। করিম চাচা খাটে বসে আছেন। খাটের পায়া উই খাওয়া। বৃদ্ধের নাকের কাছে কালো ফ্রেমের চশমা ঝুলছে। জানালা দিয়ে অশ^ত্থগাছের ফাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। হোসনে আরার আগমন টের পান না।

চাচার মুখে সরলতার রেখাগুলো তীক্ষ্ণ চোখে দেখেন। সেখানে কপটতা নেই।

হোসনে আরার বুক ওঠানামা করছে। বলেন, ও চাচা, থলেটা রাখেন।

থলেয় কী?

সোনা আর টাকা।

অ্যা! বৃদ্ধ স্তব্ধ। ছেলে মারা গেছে কিংবা জবাই করা কবুতরের বাচ্চার মতো ছটফট করছে আর মহিলা টাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে! টাকা বেশি না ছেলে বেশি?

হোসনে আরা গিঁট খুলে চাচাকে দেখান। থলেয় সোনার বার ও পাঁচশ টাকার কচকচে নোট। দ্রুত বন্ধ করে বালিশের নিচের দিকে ওয়াড়ের ভেতর ঢুকিয়ে চেপেচুপে দেন। একবার চাচার দিকে, আরেকবার বালিশের দিকে তাকান। চাচার হাত ধরে কাতর ভঙ্গিতে বলেন, সাবধানে রাইখ্যুন। [সাবধানে রাখবেন]

বুড়ো দেখেন, হায়দারের মায়ের চোখ দুটি ভেজা। কপালের মাঝখানে কাজলের খাড়া রেখাটা লেপটে গেছে।

চাচা জানালার পাল্লায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন। একটুও নড়েননি। রাস্তায় লোকজন শোরগোল করছে। হোসনে আরা ও হায়দারের কথা ভেবে তাঁর চোখে পানি আসে।

ওদিকে নিজেদের ঘরে ঢুকেই হোসনে আরা চিৎকার করে কেঁদে উঠেন। আহাজারি করেন, অ ফুত, আঁই যাই বুক ফাতি ন দিলাম খা? [ও ছেলে, আমি গিয়ে বুক পেতে দিলাম না কেন?]

তাঁর কান্নায় জামান শাহ বাড়ি কেঁপে ওঠে। ডান হাতে বুকে কিল মারেন। আশেপাশের মা-বোনদের বুকেও লাগে সেই আঘাত। প্রতিবেশীরা অ বব্বু [বড় বোন], অ চাচি বলে জড়িয়ে ধরে সান্ত¦না দিতে চেষ্টা করে। তিনি তখন নতুন করে আহাজারি করেন, অ ফুত, আঁর ফুত খডে? আঁর সোনার চাঁদরে খনে লই গেয়ি তোরা আঁরে খ। [ও ছেলে, আমার ছেলে কোথায়? আমার সোনার চাঁদকে কে নিয়ে গেছে তোরা আমাকে বল।]

পুব পাড়ার হাশেম হাসপাতাল থেকে এসে নিশ্চিত করল, হায়দার মারা গেছে।

হোসনে আরার বুক ফাটানো কান্না আবার শুরু হয়। কয়েকজনে মিলেও তাঁকে সামলাতে পারছে না। মেজ ছেলের জন্য দুঃখ ঝরে পড়ছে। আহ! আরেকটু আগে যদি জানতেন, টাকার থলে নিয়ে শয়তানদের মুখে ছুড়ে মারতেন।

মহিলাদের চোখে অশ্রু। সেই অশ্রুতে শীতের নদীর স্রোত।

উঠানে দাঁড়ানো প্রতিবেশীরা সন্ত্রাসীদের গালি দেয়। বলে, জালিমের বংশগুলো নির্বংশ হয় না কেন?

উঠানের ডান পাশে লম্বা দেয়াল। হায়দার বিদেশ থেকে এসে দেয়ালটা দিয়েছে। আগে এখানে লম্বা গড় ছিল। মানে জলাশয়। গড় ভরাট করে দেয়াল তৈরির সময় ইউসুফ ও রফিকদের সঙ্গে অনেক হাঙ্গামা হয়েছে। ওই সময় সন্ত্রাসী বাহিনীকে সে বিষয়টা জানিয়েছিল। কিছু টাকাও দিয়েছিল। কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী দেয়নি। পাকা ঘর তৈরির সময় চাঁদা চেয়েছিল। তা-ও দেয়নি।

হায়দারের চাচাত ভাই বাবলু কামরাঙা গাছে হেলান দিয়ে বলল, ঘরের কথা পরকে জানানোর কী দরকার ছিল? এক জায়গায় থাকলে কত কিছু হয়। তাদের টাকা দিলে না, তুমিও মরলে। কী লাভ হলো?

হায়দার বিয়ে করেছিল মাসখানেক আগে হাটহাজারীর মিরেরহাট এলাকা থেকে। মায়ের বিলাপ থেকে কিছু কথা বের হয়। মহিলাদের মাধ্যমে তা উঠানে আসে। জোহরের নামাজ পড়ার সময় হায়দার খুনসুটি করে বউকে বলেছিল, সাদা শাড়িতে তোমাকে দারুণ লাগছে।

লোকেরা এখন এ ঘটনাকে মৃত্যুর সংকেত বলে ধরে নেয়। বউয়ের সাদা শাড়িকে মনে করে বিধবার চিহ্ন।

ম্যা ম্যা শব্দ শুনে লোকজন দেখে গোলাঘরের পাশে আর্তনাদ করতে করতে ছাগলটা জিবে কামড় দিয়েছে। দড়িতে ফাঁসি খেয়েছে নাকি রোগ-টোগ, কেউ ধরতে পারল না। কয়েকজন দৌড়ে গেল। গোলাঘরের নিচে ইঁদুরের গর্তে সাপ-টাপ আছে কিনা তা-ও বলতে পারল না। হায়দারের মৃত্যুর সাথে এর যোগ আছে কিনা তারা তা আবিষ্কারের চেষ্টা করে।

মেঝ হায়দার ও ছোট ভাই হিম্মতের বিয়ে একসাথে হয়েছিল। বিয়ের আগে সংসারের এক দরজা ভেঙে দুই দরজা হয়। এক ভাগে বড় ভাই, আরেক ভাগে ওরা দুই ভাই ও মা-বাবা। এখন পাড়ায় কথা ডানা মেলে, ভাঙনের সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক আছে। কেউ কেউ বলে, ভাইকে মারার জন্য বড় ভাই আজগর সন্ত্রাসী ভাড়া করেছে।

হাশেম পুকুরঘাটে বসেছিল। সে শুক্কুরকে বাচ্চুর কথা জানায়। বাচ্চু হায়দারের চাচাত ভাই। হাসপাতালে হায়দারের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়েছিল। লাশের বুকে বসা মাছিটা উড়ে এসে বসেছিল তার মুখে। সে বিরক্ত হয়ে হাশেমকে বলেছিল, থানা-পুলিশ, লাশকাটা ঘরে কাটাকুটি; সব মিলে গেঞ্জামের রাত যাবে।

শুক্কুর জিজ্ঞেস করে, হায়দারের মোটরসাইকেলটা কোথায়?

হাশেম বলে, সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে মনে হয়। সে ভাবে, পোস্টমর্টেমের জন্য হায়দারকে নেওয়া হবে শহরে। কাল সকালের আগে কবর দেওয়া যাবে না। মৃত্যুতে ভারী এই রাত এরা কীভাবে কাটাবে?

রাত একটু বেড়েছে। নতুন করে হোসনে আরার কান্নায় আকাশ-বাতাস উলট-পালট হয়ে যায়। তিনি মেঝেতে বসেছিলেন। আলুথালু শাড়ি ধুলায় লুটাচ্ছে। তাঁর হাত ধরে আলমারিতে হেলান দিয়ে বসে আছে হিম্মতের কিশোরী বউ। চোখ দুটি টলটল করছে। নড়াচড়া নেই, যেন একটি পুতুল।

মেজ জা বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। একটু আগে মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। বাবলুর মা তার নাকে লেবু কচলে দেন। সে চোখ মেলে। চোখের দৃষ্টি শূন্য। সেই দৃষ্টি দেখে মহিলাদের বুক ফেটে যায়। তারা আহা আহা করে।

 

পু

মানুষটার দেহ সরছে না। কোনোমতেই উঠতে পারছি না। তীব্র রাগে তার বুকে কামড়ে দিই। তবুও ওর নড়াচড়া নেই।

হঠাৎ কেঁপে উঠল আমার শরীর। হ্যাঁ, আমি তার স্মৃতির নাগাল পেয়েছি। অনুভব করতে পারছি তার মনের কথা। লোকটা হয়ত মারা যাচ্ছে। মারা যাওয়ার আগে মানুষ কী করে? কী কথা ভাবে? হায়দার কি তার বাবার কথা ভাবছে?

হায়দার ভাবছে, আগে দরিদ্র ছিলাম। ওটাই হয়ত ভালো ছিল। কাতারে গিয়ে এত কষ্ট করে টাকা কামালাম। কী লাভ হলো?

আমি তাকে বলি, মরে যেও না। স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করো।

আমার কথা সে শুনতে পেয়েছে কিনা জানি না।

 

হায়দার হয়ত জেনে গেছে সে আর কয়েক মুহূর্ত বাঁচবে। ভাবছিল, মৃত্যুর সময় বাবার বিশ্রী অবস্থা হয়েছিল। সে তখন বিদেশে ছিল। বাবা মারা যাওয়ার কয়েক দিন পর দেশে এসেছে।

মৃত্যুর শেষ মুহূর্তকে বলে ছকরাত। যখন ছকরাত চলছে তখন জাফর পায়খানা করে দিয়েছেন। সেদিনের কথা অনেকের মনে আছে, কিন্তু এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। কারণ কার কেমন মৃত্যু হবে কেউ জানে না।

মৃত্যুর আগে ৬৫ বছরের জীবন কাটিয়েছেন জাফর। সেই জীবনে কত বাঁক, কত কষ্ট, তা অনেকেই জানে না।

রেঙ্গুন থেকে এসেছেন তাঁর চাচা। সঙ্গে বার্মাইয়া বউ আর মেয়ে। মেয়েটা দুধের মতো সাদা। এ রকম ফরসা তরুণী জীবনে দেখেননি। সুন্দরী চাচাত বোনের প্রেমে পড়ে যান তিনি। পরে মনে হয়েছে তিনি আসলে একটা ফাঁদে পড়ে গেছেন।

তারপর তিনিও বার্মা গিয়েছিলেন। বার্মা থেকে যে বছর বউকে নিয়ে দেশে এসেছিলেন তার সঙ্গে ছিল জানু, শানু, আজগর ও হায়দার। হিম্মতের জন্ম আরো পরে। দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে।

দেশে এসে কী করবেন ভেবে পান না। অভাবের সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলেন। বার্মা থেকে শিখে আসা দুটি সাপ মার্কা মহৌষধের কথা মনে পড়ল। তাকে উদ্ধার করল দুটি সাপ মার্কা ঔষধ।

বার্মা থেকে এসে উপরে টিন দিয়ে বেড়ার ঘর বেঁধেছেন। বেড়া আলকাতরা মাখানো। ঘর থেকে আসে ওষুধের গন্ধ। একটা কক্ষে সবসময় কাজ চলছে। কয়েকজন বসে প্রচারপত্রের জোড়া সাপ ভাঁজ করছে, লালচে ওষুধ ও অ্যাসিড ঢেলে মিকচার বানাচ্ছে। শিশুরা প্যাকেটে বোতল ও প্রচারপত্র ভরছে।

কোন বাজারে কোন দিন হাটবার তার মুখস্থ। কালা মুন্সির হাট, মাদাম বিবিরহাট, শিলকড়ি বাজার, তেঁতুলিয়াহাট, মিরেরহাট, বটতল, লালিয়ারহাট, চরপাখি বাজারদেশের কোনো বাজারে বসতে বাকি রাখেননি। উত্তর থেকে পুবে, পুব থেকে দক্ষিণে, যেখানে বাজারের খবর পেয়েছেন, মানুষজনের একত্র হওয়ার সম্ভাবনা আঁচ করেছেন, চাদর বিছিয়ে ওষুধ সাজিয়ে বসে পড়েছেন।

বসতে বসতে চাদর ক্ষয়ে গেছে। বিক্রি করেছেন কিংবা করতে পারেননি; খেয়েছেন কিংবা খাননি। কত মেলা, কত আসর, কত পীরের ওরশে গেছেন। সংসারের সুখের স্বপ্নে বিভোর থেকেছেন। মানি অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছেন বাড়িতে। মাসে, দুই মাসে বাড়ি গেছেন। ক্ষুধার্ত উদরে ক্লান্তির বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরে এক-দুই রাত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন।

এদিকে হোসনে আরা ক্রোধের আগুন জ্বালাচ্ছেন। হাঁড়িতে যদি ঠিকমতো ভাত ফুটত, ধোঁয়া ওঠা ভাত ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারতেন; ওষুধ বানাতে লেগে যেতেন। খালি পেটে কাজ করা যায়? তবু হাঁটু গেড়ে বসতে হয়। প্রায় সময় কাঁচামাল কেনার পয়সা থাকে না। ভাত জুটে না। তখন মেজাজ ধনুকের মতো হয়। কথা কমে যায়। তাদের উঠানে পা রাখা মানুষের সংখ্যাও কমতে থাকে।

উঠানের সামনে গোলাপ ফুলের গাছ আছে বেশ কয়েকটা। স্বামীর কথা ভেবে মন গোলাপের গন্ধে ভরাতে চান। চার মাস ধরে ওর খবর নেই। বড় করে নিশ্বাস নেন। নিশ্বাসে গোলাপের বদলে ওষুধের গন্ধ ঢুকে যায়।

হায়দার কাঁদে। কান্না তাঁকে আথালি পাথালি করে। কিন্তু চোখের জল ফেলবেন, সেই মহিলা তিনি নন। ক্ষুধার ভেতর আরো একা হন। বিকেলে সন্তানের কান্নার পাশে নির্বিকারে চুল আঁচড়ান, বাঁধেন।

জোড়া সাপের একটাও যদি আঁকাবাঁকা হেঁটে এসে টাকা দিয়ে যেত, তাহলে কিছু চাল-ডাল এনে ক্ষিধে কমানোর চেষ্টা করতেন। ঘরের পাশে কয়েকটা কচুগাছ ছিল। এখন পাতা বা গাছ কিছুই নেই। আড়াই দিন ধরে পানি ছাড়া আর কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। কারো কাছে যাননি, কাউকে জানতে দেননি। সন্তানদের হুমকি দিয়েছেন, চিৎকার করলে গলা টিপে ধরবেন।

আতংকে বারবার চমকে ওঠার রাত। হোসনে আরার মন আজ বড় চঞ্চল। চার বছরের হায়দারের অবস্থা মৃত্যুর আগের হেঁচকি ওঠার মতো। খালি গা; পরনে চেইন ছেঁড়া রং জ্বলা প্যান্ট। পায়ের পাতায় ধুলোবালি। চোখ উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। পেট পিঠে ঠেকেছে। তিনি পেটে হাত ঘষেন। ক্ষুধা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় স্নেহকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চাচ্ছেন।

হোসনে আরা জানুকে ডাকেন। ওর বোতাম ছেঁড়া ফ্রক গড়াচ্ছিল। আরেকটু হলে কিশোরী বুক দেখা যেত। সে উঠে অ্যালুমিনিয়ামের তোড়াওয়ালা গ্লাসে করে মাটির কলসি থেকে পানি ঢালে। পানি গড়ানোর শব্দটা আশার মতো। রাত কত কে জানে। বাইরে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক। চেরাগের আলো নিভে যায়। মা অন্ধকারে চামচে করে পানি খাওয়ান। সামান্য ঢোকে, কিছু গড়িয়ে পড়ে।

হায়দারের চোখ বন্ধ। মনে হয় চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। জানু বিছানায় মাথা রেখে কাত। হোসনে আরা ছেলের পাশে গড়িয়ে পড়েন। চেরাগ তো নিভে গেছে। আলাদিন তার চেরাগ নিয়ে সুদূর আরব থেকে মায়ের স্বপ্নের মধ্যে উড়ে আসে। চেরাগের দৈত্য কোনো শব্দ করে না। চুলায় চাল দেয়। ভাত রাঁধে, মাছ রাঁধে। নেচে নেচে রান্না করে। তারপর সবাইকে জাগায়। সামনে গরম গরম মাছ-ভাতের প্লেট। ধোঁয়া ওঠা পাইজাম চালের ভাত আর রুই মাছের সুগন্ধে হোসনে আরা অবাক হন। দৈত্য আঙুল ঠোঁটের কাছে নিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।

এ সময় লাফিয়ে উঠেন হোসনে আরা। পেটের ভেতর কেমন কচলায়। ছেলের বুকে কান পাতেন। হ্যাঁ, বেঁচে আছে।

হায়দারের মনে হলো, বহুদূর থেকে অচেনা ঘুম এসে চোখে ঢুকে গেছে। মুছে দিয়েছে বিবর্ণ ছোটবেলা। সে চোখ মেলতে কিংবা ভাবতে পারছে না। রাতের পাখির মতো কেউ ডাকছে, কু কু। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে! মা ঘুমের সাথে মিশে যাচ্ছে!

 

পু

অতীতের একটা কথাও ভুলেনি হায়দার। তাই তো দুনিয়া একদিকে কাত হয়ে গেলেও মায়ের কথা অমান্য করেনি। তাঁর কথা মেনে আজ এ দশা! আর ভাবতে পারছে না। চোখে কেউ আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। কমে এসেছে আলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। ছয়টি পায়ের মধ্যে মনে হয় চার-পাঁচটি পা ভেঙে গেছে। ভাঙা পাগুলো রক্তে ডোবানো। এক পা একটু একটু নাড়াতে পারছি, কিন্তু বের করতে পারছি না। রক্ত সরিয়ে মা-বাবাকে যে তুলে আনব সেই শক্তিও নেই। এখন আমি কী করব? এলোমেলো মনে স্মৃতি হাতড়াচ্ছি আর হায়দারের স্মৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ছি।

 

মৃত্যুর আগে হায়দারের মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা যেন ইতিহাস বইয়ের ক্ষয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা। সেখানে সে একটা সুখী সংসারের কাহিনি পড়ার চেষ্টা করে।

বাবা এক সকালে আলসে মানুষের মতো হেঁটে হালদা নদীর চরে যান। নদীর পাড়ে বসে ইসহাকের হালের বলদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, মসজিদের পুকুরপাড়ের পেছনে দুই গণ্ডা জমিতে ফসল হয় না। পাঁচ গণ্ডা জমি এখনো বন্ধক পড়ে আছে। কৃষক হওয়ার, ফসল ফলানোর স্বপ্নটা পূরণ হয়নি।

হয়ত বাবা মারা যাননি। ওষুধের থলে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। বড় রাস্তায় এখন যেখানে শুয়ে সে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, সেখানে মাদুর পেতে বসেছেন। মাথার উপর সরকারি মেহগনিগাছ। বলছেন, দুটি সাপ মার্কা মহৌষধ। খস, খাজুলি, রক্তদোষ, একজিমা, কানের ঘা, হাতের নখ, পায়ের নখের ঘাÑসব ভালো হয়ে যাবে। ছোট ফাইল আট টাকা, বড় ফাইল পনের টাকা। একবার লাগান, সঙ্গে সঙ্গে কাজ।

বাবার মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মুখ-হাত নড়ে, রাস্তায় ধুলো ওড়ে। আজ গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারীর ওরশ। টাক ডুম টাক ডুম ঢোল বাজে। ঢোলের তালে তেল-জরি মাখানো মহিষ দ্রুত হাঁটে। দলে দলে লোকজন ওরশে যাচ্ছে। তারা দেখে, একটা সাপের লেজ আরেকটার লেজে পেচানো। দুটি সাপ মুখোমুখি।

হায়দার হাসতে চায়। কিন্তু শরীরের কোনো অংশ নাড়াতে পারে না। সে কি কিরিচের ধারের উপর দাঁড়িয়ে আছে? নাকি মৃত্যু কিরিচের ধারের উপর দিয়ে হেঁটে তার খুব কাছে চলে এসেছে!

 

হায়দারদের ঘরটা রহস্যময় এক দ্বীপ। ঘরের সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যেতে পারে না। গেলে বাতাসে খবর হয়ে যায়। বড় বোন জানু কয়েকটা গালি দিয়ে ছেড়ে দিলেও শানুর সামনে পড়লে রক্ষা নেই। ঝাঁটা নিয়ে দৌড় দেয়। শুয়োরের পুত, কুত্তার বাচ্চা থেকে শুরু করে যত গালি আছে সব দেবে। তারপর বলবে, এখানে কেন এসেছিস? খচ্চরের বংশের সন্তান কোথাকার, তোকে ঝাঁটা ধোয়া পানি খাওয়াব।

একবার মিঠাবাড়ির ইসহাক এ রকম পরিস্থিতিতে পড়েছিল। বিষ খেয়ে চিত হয়ে পড়ে থাকা ইঁদুরের মতো হয়েছিল তার মুখ। হায়দার সেদিন বাড়িতে ছিল। শানুর হাত থেকে ইসহাককে ছাড়িয়ে নিয়েছে।

বাড়ি গিয়ে ইসহাক বলেছে, আজ দুটি সাপ মার্কার বাড়িতে গিয়েছিলাম। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। একেবারে পরিপূর্ণ গৃহস্থ। তাদের একটা বিড়াল আছে। বিড়ালের গলায় আছে একটা ঘণ্টা। ঘণ্টায় ওদের দুই মেয়ের ছবি। উঠানে আছে বড় মানকচু। কচুগাছের পাতার আড়ালে সবসময় একটা কুকুর বসে থাকে। কাউকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে।

মিঠাবাড়িতে তাদের নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছে।

 

পু

এই পৃথিবী শুধু দুই পায়ের অহংকারী মানুষের নয়, অন্যদেরও। ওরা তা মনে রাখে না। দ্বিপদী এসব মানুষ আমাদের কাছে দৈত্যের মতো। এদের জন্য মায়া থাকার কথা না। কেন মায়া করব? ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের পিষে মারে।

মনে হয়, হায়দার নামে ওই মানুষের নয়, মৃত্যু হচ্ছে আমার। পায়ের যন্ত্রণা, মা-বাবার মৃত্যুর দুঃখ ভোলার জন্য মাসখানেক আগে মারা যাওয়া ছোট বোনের কথা ভাবার চেষ্টা করি। ও মারা যাওয়ার পর মা পনের-বিশ দিন বিলাপ করে কান্না করেছিল।

রাস্তার পাশে জোরে হর্ন বাজায় মাইক্রোবাস। হর্নের শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয়। কয়েকজন লোক গাড়িটাকে থামিয়েছে। এই গাড়িতে তোলা হবে হায়দারকে।

মা যেন ডাকছে, পু, তুই কোথায়? তোকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? একটু আমার কাছে আয় বাবা। আমার হাতটা ধর।

মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে এক দল পিঁপড়া এসেছে। বিষণ্ন চোখে ওরা দেখে, একটা পুলিশ এদিকে আসছে। ওর চোখ ভালো নয়। পুলিশটার পা পড়ে ওদের লাইন ভেঙে যায়। কয়েকজন আহতও হয়।

রক্তের নিচে মা আর বাবা। আমি শুঁকছিলাম রক্তের গন্ধ, কিন্তু পাচ্ছিলাম শব্দের ঘ্রাণ। সবার বেদনা দেখতে পাচ্ছি। আমার কান্না আসছে।

হায়দারের মাকে দেখেছিলাম। মুখে চন্দন, ভুরুতে কাজল, কপালের মাঝখানে লম্বালম্বি কাজলের রেখা। আর দেখেছিলাম হায়দার নামের ওই লোকটাকে। এমন সাদা, টিপ দিলেই যেন চুলায় সিদ্ধ হওয়া ভাতের মতো গলে যাবে। গত রাতে ওর বউয়ের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে অনেকক্ষণ স্বপ্নের কথা বলেছিল। ওর চোখে, কপালে, বুকে আর ঠোঁটে স্বপ্নগুলোকে লেপ্টে থাকতে দেখেছিলাম। কিন্তু কখনো কখনো স্বপ্ন এক ফোঁটা রক্তের মধ্যে হারিয়ে যায়। দেখ, একটা চালের চেয়েও আমি ছোট। তবুও তো বেঁচে থাকি। কিন্তু মৃত্যু এসে কখন ভালোবাসা মুছে দেয় কেউ বলতে পারে না। আচ্ছা, মৃত্যু কি সত্যিই ভালোবাসা মুছতে পারে!

মনে হয়, রক্তের ভেতর থেকে মা বলছে, না।

সন্ধ্যার অন্ধকার সবকিছু ঢেকে ফেলার আগে শেষ বিকেলের আলোটা একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু চোখ দুটি জড়িয়ে আসছে। আমি উঠতে চেষ্টা করি। কিন্তু উঠতে গিয়ে পড়ে যাই।

যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, স্বপ্ন শেষ না হওয়ার আগে তার চলে যাওয়া বড় বেদনার। হায়দারের মতো আমারও তো একই অবস্থা। এই প্রথম মানুষটার জন্য কষ্ট লাগে, শূন্যতা অনুভব করি। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা জল।

 

মাটি

রক্তের পাশে ভেজা মাটি। অশ্রুর ছোঁয়া পেয়ে মাটি কাতর হয়, কান্না পায়। পিঁপড়ার জন্য তার মন কেমন করে। পাশাপাশি মানুষের ওপর তার রাগ হয়, তীব্র রাগ।