ইয়ুন ফস্সের গল্প ‘পাথুরে স্বপ্ন’
|| প্রসঙ্গ কথা ||
এবারের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ইয়ুন ফস্সে নরওয়ের একজন নাট্যকার ও লেখক। হেনরিক ইবসেনের পরে তাঁর লেখা নাটকই নরওয়ে ও ইউরোপে সর্বাধিক মঞ্চায়িত। বহির্বিশ্বেও তাঁর কদর কম নয়। ‘নয়া ইবসেন’ অভিধা দিয়ে তাঁকে উনিশ শতকে ইবসেনের নাট্যধারার আধুনিকায়নের কৃতিত্বও দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আপন প্রতিভার গুণেই বরণীয় হয়েছেন। নাটকের পাশাপাশি তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ ও শিশু সাহিত্যও রচনা করেছেন। ২৮ টি নাটকসহ তাঁর বইয়ের সংখ্যা সত্তরের অধিক। নোবেল কমিটি ইয়ুনকে সৃজনশীল নাটকগুলোর জন্য পুরস্কৃত করেছে এবং বলেছে, তিনি অজ্ঞেয় ও বোধের অতীতকে ভাষা দিয়েছেন। অনূদিত গল্প Dreamed in Stone তাঁর Scenes from a Childhood নামক গল্প সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে। ‘পাথুরে স্বপ্ন’ হল একটি ইমপ্রেশনিস্টিক সংলাপ যা বিচ্ছিন্নতার ছবিগুলোকে কোনো এক জাদুমন্ত্রে স্তরে স্তরে জাগিয়ে রাখে। এই গল্পটিতে ফস্সের সিগনেচারবাহী অনিবার্য কাব্যিক আবহটি আছে, যা অচেতন মনকে ধরে রাখার জন্য তিনি ব্যবহার করেন; আর আছে আমাদের আবেগ আর অভিজ্ঞতার মাঝে সংঘর্ষের মুহূর্তগুলোর সঞ্চয়ন।
ইয়ুন ফস্সে: ছবি © Tom A. Kolstad/Samlaget
গল্প || পাথুরে স্বপ্ন
কেউ সেই তুষারধ্বসটা দেখতে পায়নি। কেননা এটি খুবই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল। দিনের পর দিন তো নয়ই, এমনকি ঘন্টার পর ঘন্টা বা মিনিটের পর মিনিটেও বলা যাবে না, তবে এটি ভেঙে পড়ছিল। পুরোটা সময়জুড়ে এটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছিল, এবং এটি একটি তুষারধ্বস ছিল। এটি অবশ্যই একটি তুষারধ্বস ছিল, কেননা এ ছাড়া আর কীইবা হতে পারে?
কিন্তু এটি কি কাদার মতো পিছলে পড়েছিল?
না, এটি কাদার মতো পিছলে পড়েনি, ববং ছিল এক ধরনের আকস্মিক ও অদৃশ্য ঝাঁকুনির দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
কিন্তু কেউ না কেউ তো এটি দেখেছে?
না, কেউ দেখেনি। হয়তোবা কেউ দেখে থাকতে পারে যারা আসলে দেখতে চায়নি। অথবা, কেউই এটা দেখেনি। ঝাঁকুনিগুলো খুব দ্রুত ঘটে গিয়েছিল, ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি।
কিন্তু এক্ষেত্রে তুমি এটিকে আসলে তুষারধ্বস বলতে পারো কি?
হ্যাঁ, এটি তুষারধ্বসই ছিল।
মাঝখানে কোথাও কোনো ভুলত্রুটি হচ্ছে নাতো?
কেন একথা জিজ্ঞেস করছ?
আমার মনে হয় কোথাও কোনো একটি ভুলত্রুটির ফলে শেষমেষ এটি ভেঙে পড়েছিল।
হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় সেখানে অনেকগুলো ছোট ছোট ফাটল ছিল, বড় নয়, অসংখ্য প্রায়-অদৃশ্য সব ফাটল।
হ্যাঁ এটা এরকম হতে পারত। কিন্তু এই ছোট ছোট প্রায়-অদৃশ্য ফাটলগুলো কী কোনোভাবে একত্র হয়ে একটা বড় ফাটলে পরিণত হয়েছিল, একটা খাদের মতো।
হ্যাঁ হ্যাঁ, খাদের মতোই অনেকটা।
|| ২ ||
কীভাবে এটি এত ধীরে ধীরে, এমন অদৃশ্যভাবে ধীরে ভেঙে পড়ল, আমি কিছুতেই সেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
হ্যাঁ, তুমি ইতোমধ্যে এ কথা বলেছ।
জ্বি।
কিন্তু তুষারধ্বসটা নিজেই, এটা সত্যিসত্যিই হঠাৎ করেই এসেছিল।
হ্যাঁ।
হ্যাঁ, এবং তুমি বলেছ যে ওখানে বেশ কয়েকটি তুষারধ্বস ছিল এবং তারপরে এটি জাস্ট সেখানে এসে পড়েছিল।
আমি জাস্ট সেখানে শুয়ে পড়েছিলাম।
তুমি শুধু সেখানে শুয়ে পড়েছিলে।
জ্বি, আমি ঠিক সেখানে শুয়ে পড়েছিলাম, আমার বাড়ির সামনের দিকের সিঁড়িতে।
তারপর?
তারপর কারো কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং আমি উঠে বসতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না, এবং কেউ আমাকে উঠতে সাহায্য করল। আমি সেখানে দাঁড়ালাম। তারপর একটা দরজা খুললাম। আমি ঘরে ঢুকলাম, তারপর দরোজা বন্ধ করলাম।
তারপর?
আমি আর কিছু মনে করতে পারি না। তারপর আমি নিজেকে মেঝেতে আবিষ্কার করলাম। মেঝে থেকে উঠলাম। আমি দাঁড়ালাম। আমি হাঁটলাম।
তারপর?
তারপর মনে হল, আমাকে এখন শুয়ে পড়তে হবে।
আচ্ছা।
তারপর আমি আবারও জেগে উঠলাম। আমি কিচেন টেবিলের পাশে শুয়েছিলাম। তারপর আমি ভাবছিলাম আমাকে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
|| ৩ ||
এটি মোট তিনবার ভেঙে পড়ে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল; আমার ঘুমের মধ্যে এক ধরনের কুয়াশা ভাসছিল, কিন্তু ভিতরে কোথাও এক ধরনের কাঁপুনি ছিল, যেনবা গতিশীল পাথরের কণা বা ধীর তুষারধ্বসের মধ্যে ছোট ছোট পাথর, এত ধীর যে একে ঠিক তুষারধ্বস বলা যায় না।
হ্যাঁ, তুমি বলেছ।
জ্বি।
এবং তারপর?
কেউ তুষারধ্বস দেখেনি।
তুমি একা ছিলে।
জ্বি, আমি একা ছিলাম, হ্যাঁ।
এবং সম্ভবত এই কারণেই এটি একটি তুষারধ্বস ছিল না।
না, হয়তো না।
কিন্তু তেমন একটা কিছুই।
হ্যাঁ।
তারপর আমরা কিছুক্ষণ নীরব থাকি।
এবং এখন।
এখন।
তুষারধ্বস নিয়ে তুমি কী ভাবছ? পাথরগুলো সব গেল কোথায়?
তারা সেখানে ঠিক শুয়েছিল, কিন্তু তারপর তারা আবার আলাদা হয়ে গেল।
আচ্ছা।
|| ৪ ||
পাথরের টুকরো, এই পাথরগুলোও, ছোট ছোট পাথর, ধূসর কুয়াশায় ঝিকমিক করছে। তারা হালকাভাবে জ্বলে উঠল কিন্তু তারা জ্বলে উঠল, এবং তারপর চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল এবং আমি দেখলাম যে আমি একটি সোফায় শুয়ে আছি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি দরজার বাইরে গেলাম।
আমি বের হয়ে দরজা বন্ধ করলাম। আমি হাঁটলাম। বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন ছিল। এবং তখন সেটি আবারও ভেঙে পড়ল। আমি ফুটপাতে শুয়ে ছিলাম। আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে আমি ফুটপাতে শুয়ে আছি। কেউ একজন ছুটে এল। সে আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। আমি বাসে উঠতে চেষ্টা করলাম কিন্তু আরেকজন ছুটে ছুটে এসে বলল যে আমি এ বাসে যেতে পারব না, এ বাসটা আমার মতো কারো জন্য নয়, লোকটা বলছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে আমি কী বাসে বসতে পারব না, আর লোকটা বলছিল, না, না, এই বাসটা আমার মতো কারও জন্য না। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, সে একজন নারী ছিল, সে হেসে মাথা নাড়ল। এর অর্থ—হয়তো সে কিছুই বলেনি, অথবা সে হয়তো না বলেছিল। এবং তারপর, আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে মনে হয় এরকম হয়েছিল, যে লোকটি আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল সে এসে আমাকে একটা গাড়িতে তুলে দিল, সেটা একটা ট্যাক্সি ছিল। সে আমাকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে দিল, আমি বসে পড়লাম এবং ড্রাইভার আমাকে নিয়ে চলতে শুরু করল। ড্রাইভার লোকটি বলছিল যে, সে প্রায়শই শূন্যতা নিয়ে ভাবত, সবকিছুর মধ্যেই কীভাবে শূন্যতা থাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, সবকিছুর মধ্যেই শূন্যতা আছে।
আচ্ছা।
আমি তাকে পাথর টাথর সম্পর্কে কিছু বলিনি।
না অবশ্যই বলোনি।
তুষারধ্বস বিষয়েও না।
না, তুমি অবশ্যই এ নিয়ে কথা বলোনি।
এবং তারপর আমরা গাড়িতে বসে ছিলাম এবং আমরা দুজনের কেউই কিছু বলিনি। আমরা দীর্ঘ সময় এভাবেই বসে রইলাম।
পাথর আর তুষারধ্বস নিয়ে তুমি যেসব কথাবার্তা বলছ তা আমার পছন্দ হচ্ছে না। এসব ভুয়া কথা, আসলে তুমি প্রকারান্তরে মিথ্যা কথা বলছ।
জ্বি, ব্যাপারটা ওরকমই মনে হয়।
তাহলে তুমি এসব কথা বলছ কেন?
আমি সেটা পুরোপুরি জানি না।
না, এটা জানা সম্ভবত অত সোজা না।
|| ৫ ||
পাথরগুলো গান গায় এবং তারা গান গায় না। কুয়াশা দূর হয়ে যাবার পরেও পাথরগুলো সেভাবেই পড়ে থাকল, একটার গায়ে আরেকটা হেলান দিয়ে, ওগুলো এত সুন্দরভাবে শুয়ে থাকল, যেনবা তাদেরকে আশ্চর্যজনকভাবে কোনো এক নিপুণ রাজমিস্ত্রী একসাথে সাজিয়ে রেখেছে, তুষারধ্বসের পরেও তারা সেইভাবে সেখানে পড়ে আছে। তারপর আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
হ্যাঁ, সেটাই।
এবং তারপর আমরা হাসি, হ্যাঁ আমরা হাসি, তুষারধ্বসের পরেও হাসি।
হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে, তুমি একটা গাড়িতে বসে ছিলে। আর যে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল সে তোমাকে বলছিল যে সবকিছুর মধ্যেই কিছু শূন্যতা আছে। তারপর কী হল?
হ্যাঁ, ট্যাক্সিতে, এবং আমরা শূন্যতা নিয়ে কথা বলছিলাম, কীভাবে এটি সবকিছুর পিছনে এবং সব কিছুর মধ্যেই আছে, এটি যেখান থেকে এসেছে সেখানেই থাকে, গাড়ি চালক লোকটি বলছিল।
হ্যাঁ, ট্যাক্সি ড্রাইভার।
জ্বি, সেই লোকটাই, হ্যাঁ, সে বলেছিল যে শুরুর আগে ঈশ্বর ছাড়া কিছু ছিল না, ঈশ্বর থেকেই সবকিছু শুরু হয়েছিল, সে বলেছিল, হ্যাঁ যে লোকটি গাড়ি চালাচ্ছিল, সে একথা বলেছিল।
এটা ভাল বলেছিল।
যেনবা কিছুই ভেঙে পড়ছে না। কিন্তু সবকিছুই ধূসর দেখাচ্ছিল, কুয়াশার ভেতর যেমন থাকে।
ধূসর পাথরের মত, তুমি বলেছ।
হ্যাঁ, তবে গাড়ি থেকে একটু হালকা দেখাচ্ছিল।
ট্যাক্সিতে।
হ্যাঁ।
এবং তারপর?
আচ্ছা, তারপর ট্যাক্সি থেকে নেমে এয়ারপোর্টে ঢুকলাম। এবং তারপর সবকিছু ভেঙে পড়ল। আমি মেঝেতে শুয়ে ছিলাম এবং তারপর যখন আমি উপরের দিকে তাকালাম তখন দেখলাম আমার চারপাশে প্রচুর লোক এবং কেউ আমার নাড়ির গতি পরীক্ষা করে দেখছে এবং বলছে, সে দুর্বল, এবং তখন একজন লোক একটা হুইলচেয়ার নিয়ে এসে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল। এবং আমি সেখানে বসলাম এবং সে বলল যে আমি হয়তো বিমানে উঠতে পারব, তারা আমাকে পরীক্ষা করে দেখবে, সে বলল, এবং সে আমাকে পানি খেতে দিল এবং তারপর সে আমাকে অন্য যাত্রীদের আগেই হুইলচেয়ারে করে বিমানে তুলে দিল, এবং আমরা যখন বিমানের দরজায় পৌঁছলাম তখন কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল...
কে?
...একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট আমার সাথে দেখা করল এবং বলল, আমাকে বিমানে চড়বার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং তারপর তারা আমাকে বিমানে তুলে দিয়ে আমাকে সামনের সারিতে বসিয়ে দিল এবং অন্য কেউ একজন...
আরেকজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট?
...আমার কিছু চাই কিনা জিজ্ঞাসা করল এবং আমি বললাম আমি একটু পানি খেতে পারলে মন্দ হত না এবং তারপর আমাকে একটু পানি দেওয়া হয়েছিল। পাথর আর পানি। পাথর, পাথর আর পানি। এবং আমি ছিলাম একটা তুষারধ্বস, পাথরের টুকরো, এবং পাথরগুলো ধূসর কুয়াশাবৃত ছিল, যা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া পাথর থেকে কিছুটা উজ্জ্বল বলে মনে হয়েছিল, এবং তারা ছিল নিখুঁতভাবে সাজানো, একে অপরের পিঠের সাথে জুড়ে যেন তারা নিজেদেরকে একটা দেয়ালের মতো সাজিয়েছে। একটা সুন্দর দেয়াল।
হ্যাঁ, তুমি এটা ইতোমধ্যে বলেছ. আমি ভাবছি যে পাথর এবং তুষারধ্বস সম্পর্কে তোমার এইসব কথাবার্তা মিথ্যা এবং কোনো কিছু গোপন করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তবে আমি মনে করি এর মধ্যে হয়ত কিছু একটা থাকতে পারে।
সুন্দর একটা নতুন দেয়াল।
এবং তারপর?
এবং তারপর আমাকে হুইলচেয়ারে করেই বিমান থেকে নামানো হয়েছিল। আমি বলেছিলাম যে আমি হাঁটতে পারব কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি কারণ ওরা ভেবেছিল আমি হয়ত আবারও পড়ে যেতে পারি, এই কারণেই আমার জন্য হুইলচেয়ারে থাকাই ভাল এবং তারপরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল, হ্যাঁ, তোমার মনে আছে, তাই না?
না, আমি তোমাকে নিয়ে যাইনি।
না, না এটা তুমি না, অন্য কেউ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, এবং সে আমাকে তার গাড়িতে করে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল, এবং আমি শুয়ে পড়লাম, এবং আমি সেখানে শুয়ে পড়লাম এবং আমি একটি তুষারধ্বস ছিলাম, আমি একটি পাথর ছিলাম যা অনেকগুলো পাথরে রূপ নিয়েছিল, একটি তুষারধ্বস, তুষারধ্বস চলতে থাকে আর অন্যদিকে আমি শুয়ে থাকি, এবং তারপর তুষারধ্বস চলতে শুরু করে এবং নিজের দিকেই ঘুরে, আমি ঝাঁকুনি খাই, আমি ঝাঁকুনি খেতে থাকি এবং ঝাঁকুনি খেতে থাকি এবং তারপর ঝাঁকুনিটা একটু কমে যায়। আমি ঝাঁকুনি খেতে খেতে দেখতে পাই কুয়াশার মধ্যে সবকিছুই ধূসর পাথর এবং সবকিছুই ধীর তুষারধ্বস। ধীর, এবং ধূসরের মধ্যে কিছু সাদা মেশানো ছিল, এটি সাদা বলে দৃশ্যমান ছিল না তবে এটি কি সাদাই ছিল?
সেটা কি তুষারের মতো সাদা?
না , তুষারের মতো নয়, সাদাও নয়, সাদার মতো দেখতে, তুষার নয় কিন্তু তুষার... না এটা সাদা ছিল না, তুষারও ছিল না, ধুসর, কেবলমাত্র ধুসর, ধুসরতর... কেবল একটা সাধারণ ধূসর রং যদি এটি পাথরগুলির জন্য না হত তাহলে এখন আর সেখানে থাকত না, সেই তুষারধ্বস যা নিজেকে এত সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিয়েছিল, যে পাথরগুলো সেখানে এত সুন্দরভাবে এবং চুপচাপ পড়েছিল যদিও আমি কেঁপে উঠেছিলাম। ... এবং আমার ছেলে আমার জন্য রাতের খাবার তৈরি করেছিল কিন্তু আমি খেতে পারিনি, এবং সে আমাকে এক বোতল ভদকা এনে দিয়েছিল এবং তাতে আমার ঝাঁকুনিটা একটু কমে গেল এবং আমি শান্ত হয়েছিলাম এবং তারপরে আমি সেখানে কিংবা সেই ধূসর ঝকমকে পাথরগুলোর মধ্যে ঘুমিয়েছিলাম। আমি ঘুমিয়েছিলাম, আমার বেশি কিছু মনে নেই, আমার হালকা হালকা মনে আছে এবং তারপরে তারা একটা স্ট্রেচার নিয়ে এসে বলল যে আমাকে পোশাক পরতে হবে এবং তারপর তুমি বললে, সে জামাকাপড় পরতে পারবে না, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না কী অবস্থা, এবং আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম এবং তারা আমাকে একটি বাথরোব পরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হল, এটাই আমার জন্য সহজ ছিল এবং তারপরে আমি স্ট্রেচারে শুয়েছিলাম। আর আমার আবারও ঝাঁকুনি হতে লাগল। এবং আমি দেখলাম যে তুষারধ্বসটা চলে গেছে। আমিই ছিলাম সেই তুষারধ্বস।
কিন্তু পাথরগুলো এখনও সেখানে পড়ে আছে, একটি দেয়ালের মতো সাজানো, যদিও সেগুলো ভেঙে পড়েছিল।
আমিও তাই মনে করি। কারণ মনে হচ্ছে সেই তুষারধ্বসের ভেতরকার পাথরগুলো আমি নিজেই।
|| ৬ ||
তুমি ছিলে এমন একটা খাদ যাতে ফাটল ধরে অনেকগুলো পাথরে পরিণত হয়েছিল, আর তারপর পাথরগুলো সেখানে পড়ে থাকল, সুন্দর একটা দেয়ালের মতো।
জ্বি। হ্যাঁ, এরকমটাই মনে হচ্ছে, এখন আমার সেটাই মনে হচ্ছে।
আচ্ছা। আর খাদটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?
খাদটা এখন আর নেই।
এবং পাথরগুলো তাদের নিজস্ব নতুন ধরণের এক সজ্জায় ঝিকমিক করছে।
হ্যাঁ। আগে যেটা খাদের মধ্যে ছিল তা এখন পাথরগুলোর মধ্যে চলে এসেছে।
আর একসাথে বিছানো পাথরগুলো কি একটা ঘরের মতো দেখায়?
হ্যাঁ।
সেই ঘরে কী কিছু আছে?
আমার মনে হয় আছে। আমি সেখানে কিছু দেখতে পাচ্ছি।
এবং তারপর আমরা নীরবে বসে থাকি।
যে লোকটি বলছিলেন যে সবকিছুর মধ্যেই শূন্যতা আছে।
হ্যাঁ। তার কি খবর?
না কোনো খবর নাই।
|| ৭ ||
এই ধীর গতি, সবকিছু ভেঙে পড়া, এবং তারপরে হঠাৎ করে, অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে, আচমকা দমকা হাওয়ার মতো। তারপর সব নীরব। বড় ফাটলের সাথে এর আলো, তারপর ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য তুষারধ্বস এবং তারপরে এই আকস্মিক নড়ে ওঠা, আচমকা এই ভেঙে পড়া। এবং তারপর পাথরগুলোর কথা, কুয়াশার মতো ধূসর, কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি—ম্লান কিছু আলো নিয়ে ঝিকমিক করছে, অল্প একটু আলো, এত হালকা, অনেকটা ছাইয়ের মতো, পাথরের উপর ছাই চাপা আলোর মতো দেখতে। তারপর পাথরের পর পাথর। আমি পাথরের দেয়ালের ঘরের ভেতর, আমার পাথর, অন্য মানুষের পাথর, এবং সেখানে আলো রয়েছে, আকাশ থেকে নেমে আসছে অদৃশ্য এক তীব্র আলো, পাথর থেকেও আলো আসছে। শূন্যতার আলো আসছে। পাথরে পাথরে সেই শূন্যতার আলো। পাথরে আসছে ভালোবাসার আলো।
|| ৮ ||
আমি ভিতরে ঢুকি, পাথরের আড়াল নিই, এবং আমি বসে থাকি। আমি বসে বসে পাথরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি দেখতে পাই যে এটাই আমি। আমিই পাথর: পাথরগুলো ঠিক আমার মতো নয়, কিন্তু আমার মধ্যে যে আমিটা আছে তার মতো। আমি পাথরগুলোর মাঝখানে গিয়ে আমার জায়গা নিই, আমি দুদিকে দুহাত প্রসারিত করে ক্রুস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি একটা ক্রুস দেখতে পাই। আমি নিচে তাকাই। আমি উপরে তাকাই। আমি বসে থাকি। আমি পাথরগুলোর দিকে তাকাই, এত সুন্দর করে সাজানো, দেয়ালজুড়ে পাথরের পর পাথর। আমি উঠে দাঁড়াই। আমি দাঁড়িয়ে থাকি।
|| ৯ ||
আর তখন তুমি এসে আমার হাত ধরলে। আর পাথরগুলো বলে যে ভালোবাসা বিরাজ করে, ভালোবাসা আছে।
তুমি ভয় পাওনি?
না, কখনোই না।
কিন্তু তুমি তো মৃতপ্রায়।
আমি মরতে ভয় পাইনি।
আমিও মরতে ভয় পাই না।
না।
অনুবাদ ও ভূমিকা ► মোশতাক আহমদ
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন