মাতা ও পুত্র
১
খিলগাঁওয়ের একটি সরু গলির ভিতরে অবস্থিত একটি আবাসিক ভবনে আগুন লেগেছে। এই ভবনের তিনতলার একটি বাসায় ইমরানরা থাকে। একতালা ও দোতলায় বাড়িওয়ালা গোডাউন বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে। গোডাউনে কি ধরনের মালামাল রাখা হয় সেটা ইমরান জানে না। আগুন লাগাতে সেখান থেকে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ হচ্ছে। ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ইমরানের সামনে পরীক্ষা। গতকাল থেকে ক্লাস স্থগিত। তাই সে রাত জেগে পড়াশুনা করে তার কামরায় ঘুমাচ্ছিল। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। তাদের ভবন থেকেই এরকম ভয়ংকর আওয়াজ আসছে দেখে সে দরজা খুলল। সে দেখতে পেল সারা সিঁড়ি ধোয়ায় ছেয়ে গেছে আর ধ্রিম ধ্রিম করে নিচে রাখা ড্রামগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছে। আগুন কতটুকু জায়গায় ছড়িয়েছে সেটা দেখার জন্য সে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামার চেষ্টা করল। আর ঠিক সেই মূহূর্তে দোতলা আর তিনতলার মাঝামাঝি জায়গায় রাখা আরেকটি ড্রাম বিকট শব্দে ফেটে আগুন তিনতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকল। মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? ইমরান বলল, আমাদের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। বাবা-মায়ের কামরার সাথেই একটা ব্যালকনি আছে। সে সেখানে প্রবেশ করে দেখতে চেষ্টা করল। নিচে নামার কোন উপায় আছে কিনা। হ্যাঁ, উপায় আছে। ব্যালকনির পাশ দিয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা লোহার পাইপ দেয়ালের সাথে লাগান আছে যেটা দিয়ে ব্যালকনির পানি নিচে চলে যায়। সেখান থেকে সে নিচের দিক পরীক্ষা করে দেখল। একতলা আর দোতলার জানালা আর ব্যালকনি দিয়ে কালো ধোঁয়া আর আগুনের শিখা বেরুচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই পাইপ বেয়ে নিরাপদে নিচে নামা সম্ভব। কিন্তু মা?
মা-তো পা ভেঙ্গে আজ বিশ দিন হলো বিছানায়। তার পায়ে প্লাস্টার করা। ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাথরুমে যাওয়া-আসা, রান্নার সময় বুয়াকে নির্দেশনা দেয়া এগুলো শুধু করতে পারেন। ইমরান ভাবতে লাগল, আমি না-হয় বাঁচলাম, কিন্তু মা-কে বাঁচাব কিভাবে? মা-কে ছেড়ে সে কোনোভাবেই একা পালাবে না। মা তার কলিজা। মা তার প্রাণ। মায়ের জন্য সে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। ভাইয়া-তো বিয়ের এক বছর হতে না হতেই বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। মিলি আপুর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে এখন সে এবং তার মা-বাবা এই বাসাটাতে থাকে। বাবা গেছেন অফিসে। চাকরি আছে আর বছর খানেক। ছোট বেলা থেকেই সে তার মায়ের খুবই ভক্ত। মায়ের টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা, মায়ের অসুখ-বিসুখে মায়ের সেবা-যত্ন করা, মায়ের পাশে থাকা এসব কাজ সবচেয়ে বেশি সে-ই করে থাকে। মায়ের একটু কিছু হলে সে-ই সবচেয়ে বেশি বিচলিত হয়। মা তার তিনটি সন্তানকেই ভালবাসেন। কিন্তু এই সন্তানটির জন্য অন্যদের চেয়ে একটু বেশি আদর, স্নেহ এবং ভালবাসা সবসময়ই প্রদর্শন করতে কার্পণ্য করতেন না। তার জন্য মায়ের ভালবাসাটা একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই বেশি।
দেখতে দেখতে তাদের সারা ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তাদের বাসায় প্রবেশের দরজা আগুনে পুড়ছে। সে আর তার মা কাশতে লাগল। মা বললেন, তুই ব্যালকনির ওই পাইপ বেয়ে নিচে নেমে যা। আমার কথা ভাবিস না। আল্লাহ হায়াত দিয়ে থাকলে বাঁচব। নইলে মরে যাব। তুই পালা। ইমরান মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, মা। এই বলে সে মায়ের হাতটি দুহাতে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। আরো বেশি ধোঁয়া ঘরে ঢুকতে থাকায় দুজনেই এক সাথে কাশতে শুরু করল।
বাইরে উৎসুক জনতার ভিড়। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়েছে আধা ঘণ্টা হলো। কিন্তু তারা আসলেও এই সরু গলিতে কিছুতেই গাড়ি ঢুকাতে পারবে না। নীল আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। আরো উঁচুতে তিনটে চিল ঘুরে ঘুরে চক্কর দিচ্ছিল বিস্তীর্ণ নীলিমার অন্তহীনতার মাঝে। এতকিছুর মাঝেও একটি পথের কুকুর নিশ্চিন্ত মনে দুগ্ধ পান করাচ্ছিল তার পনের দিন বয়স্ক শাবকগুলোকে এই গলির শেষ প্রান্তে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে শুয়ে থেকে। শাবকগুলো একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিঃশঙ্ক চিত্তে স্তন্যপান করে যাচ্ছিল। শীতকাল বলে রোদে কোনো উত্তাপ নেই। বাতাস বইছে না কোনো দিক থেকেই।
২
ইমরান পায়েলকে ভালবাসে কিনা সেটা সে জানে না। পায়েলের মাঝে তার মায়ের প্রতিরূপ খুঁজে পেয়েছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। অথবা মায়ের প্রতি ইমরানের যে ভালবাসা সেটা ফ্রয়েডীয় কিনা সেটা বিশেষজ্ঞরাই ভাল বলতে পারবেন। ফ্রয়েডীয় পণ্ডিতেরা বলেন যে, যেসব পুরুষেরা মায়েদের প্রতি অত্যধিক আসক্ত থাকেন তারা অন্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক অর্থাৎ শারীরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে অপারগ হয়। এজন্যই ডি এইচ লরেন্সের লেখা সানস এণ্ড লাভারস উপন্যাসের নায়ক বুঝতে পেরেছিল যে যতদিন তার মা জীবিত থাকবেন ততদিন সে অন্য কোন নারীর সাথে কার্যকর শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে না। তাই একদিন সে তার মাকে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল। ইমরান পায়েলকে খুবই পছন্দ করে। পায়েলের কথা সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোন বিরক্তি ছাড়াই শুনতে পারবে। সে যখন গালে টোল নিয়ে হাসে তখন তার রিনঝিন ধ্বনি ইমরানের হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। তার শ্যাম্পু করা ঝকঝকে চুলের সুঘ্রাণ তাকে মুগ্ধ করে। সে অবাক বিস্ময় নিয়ে পায়েলের লাবণ্যে ভরা মুখের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে। তার ফুটন্ত যৌবনের তপ্ত লাভা-স্রোতের প্রতি সে দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে। পায়েল যখন বলে, এই বোকা, তোর প্যান্টের চেইন খোলা কেন? তখন সে তার নিজের অন্যমনস্কতার জন্য নিজেকে তিরস্কার করে লজ্জা-মাখা মুখ নিয়ে প্যান্টের চেইন আটকায়। কিন্তু তার ভুল ধরিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা তার ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে কোন কিছু খাওয়া শেষে মুখ মুছে ফেলার পরও যখন কোন খাদ্যকনা ভুলবশত তার গালে লেগে থাকে, আর পায়েল সেটা তার নরম আঙুল দিয়ে তুলে ফেলে দেয়।
আজকের পর থেকে ক্লাস সাসপেন্ড থাকবে। তাই ইমরান সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকেই তার না বলা কথাগুলো পায়েলকে বলবে। দুজনে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চা, সিঙ্গারা খাচ্ছিল আর কথা বলছিল। ইমরানের পরনে জিনস, টি-শার্ট এবং কালো জ্যাকেট। সুঠাম দেহের অধিকারী। মুখে দু-সপ্তাহের বেশি না কামানো দাড়ি। পায়েল সাদা সালোয়ারের উপর পেয়াজ রঙের কামিজ এবং তার উপর কফি কালারের শাল চড়িয়েছে। ইমরান তার কথাগুলো বলার জন্য সঠিক মূহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময় পায়েলের ফোনে একটা কল আসল। সে ফোনে কথা শেষ করে ইমরানকে বলল, আমাকে এখনি উঠতে হচ্ছে। মা ফোনে বলল বাবা নাকি অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আমি এখনি হসপিটাল যাচ্ছি। ইমরান বলল, আমি আসব? সে জবাব দিল, দরকার নেই। এই বলে পায়েল চলে গেল। ইমরানের কথাগুলো অব্যক্তই রয়ে গেল।
৩
দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। তাই তাদের বাসায় সন্ধ্যা বেলায় রান্না-বান্না হয়। আজ বুয়া আসতে পারবে না সেটা সে সকাল বেলা জানিয়ে দিয়েছিল। তাই আজ রাতে ইমরান ভাত রান্না করে ডিম ভাজি করল। এটাই রাতের খাবার। রাতের খাওয়ার পালা শেষ হলো প্রায় রাত দশটায়। তার সিগারেটের নেশা আছে। খুব বেশি একটা খায় না। দিনে তিন-চারটে হয়তো লাগে। রাতের খাওয়া শেষ হলে সে সিগারেট খেতে বের হয়। সে কখনো ঘরে সিগারেট খায় না। এখনই সে বের হবে। মা-বাবা দুজনেই বললেন যে তাদের ঔষধ লাগবে। তাই সে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর একটা গরম সোয়েট শার্ট পরে বের হলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখে যে দোতলা আর তিন তলার মাঝে সিঁড়ির যে স্থানটি রয়েছে সেখানেও ড্রাম রাখা হয়েছে। সে চিন্তা করল এই বাসায় আর থাকা যাবে না। বাসা বদল করতে হবে। কারণ এসব কিসের ড্রাম কে জানে! যদি রাসায়নিক পদার্থের হয় তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে আর রক্ষে নেই। মারা পড়বে সবাই। কিন্তু এই বাসায় ভাড়া তুলনামূলক-ভাবে কম। ভাইয়া যদি মাসে মাসে আরো কিছু টাকা বাড়িয়ে দিত তাহলে হয়তো বাসা বদল করাটা অনেক সহজ হতো। সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে মাসে মাসে এর চেয়ে বেশি আর এক টাকাও তার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। তাই ঠিক এই মূহূর্তে বাসা বদল করা সম্ভব হচ্ছে না। ইমরান একটা টিউশনি করে। সেখান থেকে যে টাকা পায় সেটা দিয়ে তার আসা-যাওয়া, হাত খরচ, আর বই-পুস্তকের ব্যয় সে বহন করে। বাবার কাছ থেকে কোন টাকা সে নেয় না। গলির মাথায় একটি চায়ের দোকানে সে চা-সিগারেট খায়। ওখানে আরো কয়েকটি মুদির দোকানও আছে। সে চায়ের দোকানে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে ছাড়তে ছাড়তে পায়েলের কথা ভাবছিল। গত পরশু-তো সে তার কথাগুলো বলতে পারল না। এখনো ফোনে কথা হয়। কিন্তু সব কথা কি ফোনে বলা যায়? সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার সময়ও-তো সেসব কথা বলা যাবে না। তাহলে? তাকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। চা-সিগারেট খাওয়া শেষ হলে সে একটি পাউরুটি আর ঔষধ কিনে ঘরে ফিরল। মা-বাবাকে ঔষধ বুঝিয়ে সে তার নিজের কক্ষে প্রবেশ করল।
৪
ভবনটির একতলা আর দোতলা থেকে দাউদাউ করে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা জানালা আর ব্যালকনি দিয়ে বেরুচ্ছিল। এখন আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। তিনতলার ব্যালকনি দিয়ে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছিল। জনতা দেখতে পেল তিন তলার ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে এক যুবক বেরিয়ে ব্যালকনিতে এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করল প্রথমে। তারপর সে ব্যালকনির পাশের পাইপ বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। জনতা আল্লাহ, আল্লাহ বলে চিৎকার দিল। একজন দুহাত তুলে মুনাজাত করল আল্লাহ তুমি ওই ছেলেটাকে বাঁচাও। ছেলেটি পাইপ বেয়ে নিচে নামার সময় দোতলার ব্যালকনি থাকে নির্গত আগুনের হল্কা তার গায়ে লাগল। তবুও সে এসব উপেক্ষা করে একতলার কাছে এসে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ল। জনতার মধ্য থেকে কয়েকজন এসে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এম্বুলেন্সে চড়িয়ে দিল। গাড়িটি সশব্দে স্থান ত্যাগ করল।
৫
আগুন লাগার দেড়ঘণ্টা পর অগ্নিনির্বাপক বাহিনী এসে ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর আগুন নেভাতে সক্ষম হলো। বিল্ডিংটির একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু পঞ্চম তলাটি অক্ষত আছে। তারা সেই ভবনের তিনতলা থেকে দুটি এবং চারতলা থেকে একটি মোট তিনটি পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার করল। তিনতলা থেকে উদ্ধারকৃত মৃতদেহ দুটি তখনো পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
গল্পটা চমৎকার।
খোকন দাস
মার্চ ৩১, ২০২৪ ১৩:১৭