তিনটি অনুগল্প
|| সুধাময় ||
সুধাময়ের মোহনীয় কণ্ঠসুধায় উথাল পাথাল মোহিনীদের বসার ঘরের পড়ন্ত বিকেল। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী মোহিনী কবিতার অন্তর্গত দৃশাবলী অনুবাদের সূত্র খোঁজেন উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের পরতে পরতে। শ্রেণীকক্ষে মেধাবী শিক্ষকের কাছে ছক কষে কবিতার ব্যাকরণ শেখা যায়, কিন্তু বসার ঘরে চায়ের আড্ডায় কবিকণ্ঠে কবিতার পাঠ মননে ও মগজে অন্যরকম ঝড় তোলে।
মোহিনী ও সুধাময় একই কলেজে আলাদা বিষয়ে স্নাতকের ছাত্র, সময়ের হেরফেরে প্রতিদিন দেখা হয় না। রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র সুধাময়ের ব্যস্ত সময় কাটে মিছিলে-স্লোগানে। সঙ্গত কারণে কলেজে বিশেষ কারো সাথে একান্তে সময় কাটানো হয়ে ওঠে না। দীঘির পাড়, মহাশ্মশান, পৌর উদ্যানে কবিতার রূপকল্প, ছন্দ, উপমার দুরন্ত পাঠ চলে অবিরত। অধ্যাপক বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মোহিনীর সুধাময়ের সাথে এই অন্তরঙ্গ বোঝাপড়ার সঠিক নাম বা ব্যাকরণ জানে না দু’জনের কেউই। সুধাময় নিজের কবিতায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এই সম্পর্ককে শ্রেয়সী নামেই পরিচয় দেয়।
স্নাতক শেষ হতে হতে দু’জনের দেখা সাক্ষাতের উপলক্ষও কমতে থাকে। শুরু হয় জীবনের অন্য আয়োজন। বাবা-মায়ের পরিকল্পনাতে হঠাৎ করে অনাড়ম্বরভাবেই বিয়ে হয়ে যায় মোহিনীর। অল্পদিনের ভেতর প্রবাসী স্বামীর সাথে পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়া। আর পাকাপাকিভাবে কবিতার সাথে বসবাস শুরু হয় সুধাময়ের। এলোমেলো হয়ে যায় রাজনীতি, সমাজ, সংসার, হৃদয়ে সাথে বোঝাপড়ায় ছিন্নভিন্ন হয় বারংবার। মোহিনীর সাথে বিচ্ছেদ শ্রেয়সী হারানোর ব্যাথার চেয়েও বেশীকিছু মনে হয় সুধাময়ের।
মধ্যবিত্ত সংসারের বড় সন্তান সুধাময়ের এ বিলাসিতা বেশি দিন চলবে কেন? অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষা শিখতে হয় রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র সুধাময়কে। বাবার পেনশনের টাকায় উচ্চ শিক্ষার নামে মূলত সংসারের ভাগ্য ফেরাতে বিলেতে পাড়ি দিতে হয় সুধাময়কে। বন্ধুর বিনামূল্যের আশ্রয় মাত্র ছয় দিনেই শেষ হয়। বিলেতের মোহ ভাঙ্গে যায় সুধাময়ের। শুরু হয় অন্য আলোর খোঁজ। সরকারি চাকুরে বাবার আশ্রয়ে থেকে বিকেলে চায়ের আড্ডায় সমাজ বদলের স্বপ্নদেখা সুধাময়ের কাছে এ এক অন্য জীবনের প্রতিচ্ছবি।
বিদ্যার জোর কোন কাজেই আসে না, পায়ের জোরে দেশি খাবারের দোকানের প্রচারপত্র বিলি করে কোন কোন দিন দুই চার পাউন্ডের সংস্থান হয়। প্রচারপত্র বিলি করা নতুন বিষয় নয় সুধাময়ের কাছে, কিন্তু সাহেবদের বিলেতি কুকুরের তাড়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। হতাশ সুধাময় অল্প সময়ের মধ্যে বুঝে যান, এ সামান্য আয়ে সংসারের ভাগ্য ফেরাতো দূরের কথা নিজেরই টিকে থাকা অসম্ভব। পরিবারের স্বপ্নে জল ঢেলে ফেরার বিমানে চড়তে বাধ্য হয় সুধাময়। বিমান দেশের মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে শুরু হয় নতুন কবিতার চাষবাস। নিশ্চুপ আড়ালে চলে যায় সুধাময়। বছরের পর বছর স্মৃতি হাতড়ে মালা গাঁথে মোহিনীর প্রতিটি স্পর্শ বকুল।
কিছুদিন আগে করোনা মহামারি শুরু হলে, ভয়ানক অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘরে ফিরে সকলে। অন্যদের বন্ধিদশা অনায়েশে খুন করে সুধাময়ের একাগ্র নির্জনতা। এবার ঘর ছাড়ে সুধাময়, পথেপথে খুঁজে ফিরে নির্জনতা। দেখা হয় মৃত্যুর মুখোমুখি অসহায় মানুষের নিদারুন একাকিত্বের সাথে। অন্য অনেককে শুশ্রষার সন্ধান দিতে দিতে মহামারীর কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়,আর ফেরে না সুধাময়।
|| শ্রাবণের জ্যোৎস্না ||
মৃদুমন্দ বাতাস, অঝোরে ঝরছে রিমঝিম বৃষ্টি। জনালার ঘোলা কাঁচে অতিকায় চাঁদের ছায়া। থেকে থেকে শিশুদের কান্নার মতো অনাহারি কুকুরের অসহায় আর্তনাদ। ল্যাম্পোস্টের মৃদু আলোর নিচে বৃষ্টিভেজা জনশূন্য রাস্তায় নিঝুম রাতের নিরবতা। কিন্তু এখন মধ্যরাত নয়, মহানগরে রাতের প্রথম প্রহর মাত্র। হঠাৎ করেই এ ব্যস্ত নগরের সমস্ত কোলাহল গ্রাস করেছে করোনা মহামারি।
কিছুক্ষণ আগে দু’জন পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে—শ্রাবণকে একটি সাদা ব্যাগে ভরে নিয়ে গেছে বিশেষ সুরক্ষা পোশাক পরিহিত চার জন স্বেচ্চাসেবকের একটি দল। জ্যোৎস্নাই ট্রিপল নাইনে কল করে কর্তৃপক্ষকে শ্রাবণের মৃত্যু সংবাদটি জানিয়েছিল। পুলিশ সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে জ্যোৎস্নার নিকট থেকে শ্রাবণের যাবতীয় তথ্য ও আইডি কার্ডের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। পরিবারের কোন পুরুষ সদস্য উপস্থিত না থাকায়, স্বেচ্চসেবকরাই নিজ দায়িত্বে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করবে।
শোকে হতবিহ্বল জ্যোৎস্না একবারের জন্যও কাউকে বুঝতে দেয় নাই, পাশের রুমেই বিছানায় খুব যত্ন করে শোয়ানো ছিল মৃত সন্তানের নিথর দেহ। সবাই চলে যাবার পর, নয় মাস বয়সি একমাত্র সন্তানের বরফ শীতল দেহটি বুকে আগলে জানলায় দাঁড়িয়ে আছে শোকে স্তব্ধ জ্যোৎস্না। দু’চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরছে অশ্রুধারা। এ এমনই এক ভয়াবহ সময়, প্রবল শোকেও পাশে কোন সমব্যথী নাই। সঙ্গহীন মানুষ। বাইরে পূর্ণ চাঁদের আলোয় বিগলিত জ্যোৎস্নার মতো নিরবে ঝরে পড়ছে শ্রাবণধারা।
কয়েকদিন ধরে ধীরে ধীরে পচা তীব্র দুর্গন্ধে আশেপাশের বাতাস ভারি হয়ে উঠলে প্রতিবেশিদের টনক নড়ে, উদ্যোগি হন তারা। সপ্তাহখানেক পর এক নির্জন সকালে কয়েকজন প্রতিবেশির উপস্থিতিতে দরোজা ভাঙ্গা হয় শ্রাবণদের ফ্লাটের। বসার ঘরের ভেতর জানলার নিচে মেঝেতে পড়ে আছে দুটি অর্ধগলিত লাশ। বাড়িওয়ালা সনাক্ত করেন যুবতী মেয়েটি জ্যোৎস্না আর পাশে শিশুটি শ্রাবণ ও জ্যোৎস্নার নয় মাস বয়সি একমাত্র সন্তান প্রভাত।
|| খরপোষ ||
সাতাশ বছর পর খরপোষের মামলা দেখে প্রতিপক্ষের উকিলের মতো আপনাদের কেউ কেউও হয়তো হেঁসে উঠবেন। কিন্তু বিচারকের পক্ষে কি হেঁসে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব। সাতাশ বছর পূর্বে স্বামীর বাড়ী হতে দুই শিশুপুত্র সহ তাড়িয়ে দেওয়া হয় শবনমকে। স্বামী পরিত্যাক্তা শবনম যৌবনে মনে একপ্রকার ঘৃণা নিয়েই অনেক কিছু উপেক্ষা করেন। নানা রকম গঞ্জনা সহ্য করে বাবার বাড়িতে থিতু হন। এবাড়ি ওবাড়ি ঝিগিরি করে বড় করে তোলেন দুই ছেলেকে। বড় হয়েছে ঠিকই কিন্তু ছেলেরা কেউই মানুষ হয়ে উঠেনি। মাদকাসক্ত বড় ছেলে দিনের বেশিরভাগই ঝুপড়ির ঘরে ঘুমিয়ে কাটায়, রাতভর নেশা করে প্রায়দিনই ভোরে বাড়ি ফেরে। শবনমের বাবা বেঁচে থাকতেই বাড়ির আঙিনার একপাশে ঝুপড়িটি করে দিয়েছিলেন যা ভাইদের দয়ায় এখনও টিকে আছে। রুগ্ন ছোট ছেলেটার কিস্তির টাকার টং দোকানের আয়ে কোনরকম টিকে আছে তিনজনের জীবন। না এখন আর ঝি-গিরি করার শক্তি নাই শরীরে। নিভুনিভু সংসারের বাতি যেকোন সময়ে নিভে যাবে দোকানের কিস্তি ফেল করলে।
এখন আর ক্ষমতা না থাকলেও, চুরি ছেঁচড়ামি করে মেম্বার হয়ে এক সময় অনেক টাকা কামিয়েছে স্বামী মেরাজ সরদার। বাকি দুই পক্ষের স্ত্রী-সন্তানদের সাথেও সম্পর্ক ভালো না সরদারের। তিন তালাক বলে তাড়িয়ে দেয়ার পর সারা জীবনে একবারও যার মুখাপেক্ষী হয়নি শবনম, মনে প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়েও সাতাশ বছরের বঞ্চনার হিসাব কসতে হচ্ছে আজ তার সাথে। স্ত্রী হিসাবে দেনমোহর, নিজের ও সন্তানদের খরপোষ সব মিলিয়ে বর্তমান বাজারে বেশ মোটা টাকার দাবি তুলেছে উকিল। মরার পরের চিন্তা নাই শবনমের, যেকোন ভাবে দাফনের ব্যবস্থা করবে লোকজন। কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে আছে ভালোভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার নিশ্চয়তা চাই, চাই নিরাপদে শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার নিশ্চয়তা।
বেশ্যার ঘরে জন্ম নিয়ে এনজিওর দয়ায় অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা উকিল অনিমেষ এখন পিতৃ-পরিচয় জানে। কিন্তু সমাজের ঘৃণ্য এই লোকটার পরিচয়ে নিজেকে আর নোংরা করতে চায় না। অর্থলোভে নয় শবনমের মামলার মাধ্যমে যদি মেরাজ সরদারকে সর্বশান্ত করা যায়, তবেই মায়ের শেষ জীবনের চরম অর্থকষ্টের উপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন