কিংবদন্তি এলি উইসলের আত্মজীবনী ‘নাইট’

অ+ অ-

 

২০১৬ সালে মে মাসের কোনো একদিন অবসরপ্রাপ্ত এক সচিবের সঙ্গে গল্প করছিলাম। তিনি পড়াশোনা জানা মানুষ, যার রুচি ও জ্ঞানের ওপর আমার আস্থা আছে। সেদিন তিনি এলি উইসলের নাইট বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। অন্তর্জালে বইটির পিডিএফ কপি পেলাম। পড়লাম!

কৈশোরে সেবা প্রকাশনী অনূদিত রবিন হুড পড়ার সময় গল্প যত এগিয়েছে রবিনের প্রতি ভালোবাসা তত গভীর হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে তাঁর মৃত্যু দৃশ্য পড়ার সময় কেঁদেছিলাম। বই পড়ে বুকের ভিতর চিনচিনে কষ্টের অনুভূতির সেটাই প্রথম অভিজ্ঞতা! এরপর পথের পাঁচালি পড়তে গিয়ে চোখ ভিজেছে বারবার। দুর্গা যখন বলেছিল, চিনিবাসের ভারি তো খাবার। বাবার কাছ থেকে দেখিস রথের সময় চারটে পয়সা নেবোতুই দুটো, আমি দুটো। তুই আর আমি মুড়কি কিনে খাবোখানিকটা ভাবিয়া ভাবিয়া অপু জিজ্ঞাসা করিলরথের আর কতদিন আছে রে দিদি? এই দৃশ্যে কিংবা অপু যখন তাকের উপর মাটির কলসিতে সেজ ঠাকুরদের বাড়ি থেকে দুর্গার চুরি করা সেই ছোট্ট সোনার কৌটাটা খুঁজে পেলতখন, বই মুড়ে কান্না সংবরনের বৃথা চেষ্টা করেছি। অপুর সঙ্গে আমিও ঢিল মেরে ওই কৌটাটা পুকুরে ফেলেছিলাম, যাতে পৃথিবীর আর কেউ জানতে না পারে! দিদির গোপনীয়তা সুরক্ষিত থাকল শুধুই অপুর, আমার আর পুকুরের ঘোলা বুকে!

সে সব কোমল হৃদয় এক কিশোরের আবেগ। পরিণত বয়সে বই পড়ে অশ্রু বিসর্জনের সৌভাগ্য খুব একটা হয় না! রোদ বৃষ্টিতে নরম পলল শিলা কঠিন হয়েছে, মন সংবেদনশীলতা হারিয়েছে। তথাপি আটচল্লিশ বছর বয়সে নাইট পড়ে স্যাঁতস্যাতে ভেজা মনে অনুধাবন করেছিলাম, এই বই পড়ার আগেই যদি জীবনাবসান হতো তবে জীবনটা অসম্পূর্ণ রয়ে যেত!

বাংলাদেশের আর দশটা কিশোরের মতোই হলোকাস্টের সঙ্গে আমার পরিচয় আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কিত বইয়ে এ সব পড়লেও, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ডামাডোল, ইহুদি-মুসলমানদের ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিভেদ ইত্যাদি কারণে প্রকৃত ঘটনার চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতই প্রাধান্য পেয়েছে। ব্যক্তি মানুষ বা গোষ্ঠীর কষ্টগুলো যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি আর অর্থনীতির দাবার চালে হারিয়ে গেছে। নিরপেক্ষভাবে হলোকাস্টকে অনুধাবন করার সুযোগ পাইনি, তাড়নাও অনুভব করিনি। নাইট আমার সেই উদাসীনতায় ছন্দপতন!

কিশোর এলি উইসলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অনাড়ম্বর, নির্ভেজাল, সংক্ষিপ্ত ও সুদৃঢ় বর্ণনা নাইট। বর্ণনা এত মূর্ত, এত প্রাঞ্জল, এমন জীবন্ত যে ধর্ম, রাজনীতি, পক্ষ-বিপক্ষ, দেশ-জাতি, মানচিত্র, স্বার্থ, এমনকি ভালো-মন্দ, দুঃখ-আনন্দ সব ছাপিয়ে নিজের অস্তিত্বকে আবিষ্কার করেছি এক কিশোরের আত্মা ও দেহের মাঝে। বুকে ধারণ করেছি তার অসহায়ত্ব, কষ্ট, রাগ, আবেগ আর বিশ্ব মানবতা ও ঈশ্বরের ওপর তার কোমল বুক উপচিয়ে প্রচণ্ড অভিমান!

ট্রান্সসেলভেনিয়ার ছোট্ট শহর সিগেট রোমানিয়ার ভূখণ্ডে। ১৯৪০ সালের আগস্টে নাৎসি জার্মানির চাপে সিগেট হাঙ্গেরির অংশ হয়। এক মাস পর, নভেম্বরে, নাৎসি জার্মান সমর্থনকারী অক্ষ শক্তিতে যোগ দেয় হাঙ্গেরি। মার্চ ১৯৪৪ সালে জার্মানি হাঙ্গেরি দখল করে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে রোমানিয়া পুনরায় সিগেট ফেরত পায়। বাবা-মা, বড় দুই বোন আর ছোট বোন জেপোরাকে নিয়ে এলির পরিবারের আবাস সিগেটে। বাবা-মা একটা দোকান চালাতেন। হিলডা আর বিয়া ঘরের কাজে সাহায্য করতো। আমার স্থান পড়ার ঘরে। আনন্দঘন এক সুখি কৈশোর এলির পাওনা ছিল। ১৯৪১ সালে তের বছরের এলি ওই দূরবর্তী ছোট শান্ত শহরেও শুনতে পায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধের চেয়েও ভীতিকর সংবাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধন। আশঙ্কা-ভীতি, অবিশ্বাস-অনুমান, ঘটনা-দুর্ঘটনা, বিতর্ক, আশা-নিরাশা, গুজবসব মিলিয়ে এক গুমোট পরিবেশে কাটতে থাকে সিগেটবাসীর দিন। আমরা প্রতি সন্ধ্যায় লন্ডন রেডিও শুনতাম। সেখানে উৎসাহ ব্যঞ্জক সংবাদ পরিবেশন হচ্ছে: জার্মানি আর লেনিনগ্রাদে দৈনিক বোমাবাজি, দ্বিতীয় রণক্ষেত্রের প্রস্তুতি। এবং সেইমতো আমরা, সিগেটের ইহুদিরা, সুদিনের প্রতীক্ষায় থাকলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম সুদিন শীঘ্রই আসবে। এভাবেই ১৯৪৩ সাল কেটে গেল।

১৯৪৪ সালের বসন্তে রাশিয়ার রণক্ষেত্রে জার্মানির হেনস্থা হবার সংবাদে সিগেটবাসীরা উৎফুল্ল। হিটলার আর তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। হাঁ, আমরা সন্দেহ করেছিলাম। আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে তার দৃঢ় সংকল্পকে আমরা সন্দেহ করেছিলাম। একটা সমগ্র জাতিকে বিলুপ্ত করা? বিশ্বের এতগুলো দেশে ছড়িয়ে থাকা এক জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা? লক্ষ লক্ষ মানুষকে! এই বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে তা কিভাবে সম্ভব? এবং এভাবেই, যুদ্ধকৌশল, কূটনীতি, রাজনীতি এবং ইহুদিবাদী আন্দোলনসহ সকল বিষয়ে আমাদের গুরুজনেরা সচেতন হলেনকিন্তু নিজেদের নিয়তি নিয়ে নয়।

অবশেষে দরজায় এসে দাঁড়ায় জার্মান সাঁজোয়া যান। ১৯৪৪ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সিগেটের দুইটা গেটৌতে পার্শবর্তী গ্রামগুলোর অধিবাসীসহ আনুমানিক ১৪,০০০ ইহুদি অবরুদ্ধ হয়। অধিকাংশ লোকই ভেবেছিল যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত, রেড আর্মি আসা পর্যন্ত, আমরা গেটৌর মধ্যে থাকবো। তারপর সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। জার্মান বা ইহুদি কেউই গেটৌ শাসন করতো না, গেটৌ শাসন করতো ভ্রান্ত মোহ।

১৯৪৪ সালের বসন্তে রাশিয়ার রণক্ষেত্রে জার্মানির হেনস্থা হবার সংবাদে সিগেটবাসীরা উৎফুল্ল। হিটলার আর তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। হাঁ, আমরা সন্দেহ করেছিলাম। আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে তার দৃঢ় সংকল্পকে আমরা সন্দেহ করেছিলাম। একটা সমগ্র জাতিকে বিলুপ্ত করা? বিশ্বের এতগুলো দেশে ছড়িয়ে থাকা এক জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা? লক্ষ লক্ষ মানুষকে! এই বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে তা কিভাবে সম্ভব?

মোহ ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। মাস খানেকের মধ্যে গেটৌর ইহুদিদের ট্রেনে করে পাঠানো শুরু হলো অজানা গন্তব্যে। মে মাসে তৃতীয় সপ্তাহে এলির পরিবারকে ওঠানো হলো পশুবহনকারী রেলগাড়িতে। প্রতি বগিতে আশি জন। কিছু রুটি, কয়েক বালতি পানি। গিজার পিরামিডের পায়ের কাছে ভূগর্ভস্ত কোঠায় পাওয়া গিয়েছে একটা নৌযান। ১৪২ ফুট লম্বা ১৯ ফুট চওড়া নৌযানটা রাখা হয়েছিল যাতে ফেরাউন খুফু সেটায় চড়ে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারে! নরকে প্রবেশের জন্য যদি তেমন একটা ট্রেন থাকে তবে সেটা সিগেট থেকে আউসউইৎজ পর্যন্ত এলিকে বহন করা ট্রেনের চেয়ে অধিক নারকীয় হবার সুযোগ নাই! 

গন্তব্য সম্পর্কে ট্রেন যাত্রীদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। চতুর্থ রাতে ট্রেন থামে আউসউইৎজ স্টেশনে। পোল্যান্ডের ক্রাকাও শহর থেকে ৬৬ কিলোমিটার পশ্চিমে আউসউইৎজ। ট্রেন থেমে আছে। ধীর গতিতে অপরাহ্ন কাটলো। তারপর বগির দরজা খুললো। আমাদের মধ্যে দুজনকে পানি আনার অনুমতি দেয়া হলো। তাঁরা ফিরে এসে জানালো এই স্থানই আমাদের চুড়ান্ত গন্তব্য। স্বর্ণের একটা ঘড়ির বিনিময়ে তারা তথ্য সংগ্রহ করেছে। এখানে আমরা ট্রেন থেকে নামবো। এখানে একটা শ্রম শিবির আছে। শিবিরের পরিবেশ ভাল। পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করা হবে না। শুধু যুবারা কারখানায় কাজ করবে। বৃদ্ধ ও অসুস্থরা চাষের জমিতে কাজ করবে। আস্থা পাখা মেলে আকাশে উড়াল দিল। মুহূর্তে পূর্ববর্তী দিনগুলোর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেলাম। আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম।’ তাঁদের সর্বশেষ এই ভ্রম কাটতে বেশিক্ষণ আপেক্ষা করতে হয়নি।

আউসউইৎজ বন্দি শিবিরের সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বিরকিনাও বন্দি শিবির। এলি উইসলের সহযাত্রীদের নিয়ে ট্রেন ঢুকলো বিরকিনাও। ট্রেন থেকে নেমে সারিবদ্ধভাবে বন্দি শিবিরে ঢোকার সময়, ‘এস এস বাহিনীর এক সদস্য হাতের ডান্ডা ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে এসে নির্দেশ দিল: পুরুষরা বাম দিকে! মেয়েরা ডান দিকে। শান্ত, নিস্পৃহ, ভাবলেশহীন, নিরাবেগ ভঙ্গিতে উচ্চারিত ছয়টা শব্দ। ছয়টাই সাধারণ, সংক্ষিপ্ত শব্দ। অথচ এই সেই মুহূর্ত যখন আমি আমার মাকে হারালাম, তখন চিন্তা করার সময় ছিল না। আমার হাতে বাবার হাতের চাপ টের পেলাম। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে দেখলাম আমার মা, আমার বোনেরা ডান দিকে চলছে। জেপোরা মায়ের হাত ধরে আছে। আমি দেখলাম তাঁরা দূরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছে; মা আমার ছোট্ট বোনের সোনালী চুলে হাত বোলাচ্ছেন, যেন তাকে রক্ষা করার আশ্বাস। এবং আমি হাঁটছি বাবার সঙ্গে, অন্যান্য মানুষের সঙ্গে। আমি তখনো জানতাম না, এটাই সেই ক্ষণ, এটাই সেই স্থান, যেখানে আমি আমার মা আর জেপোরাকে চিরতরে হারালাম।’

বন্দি শিবিরের প্রথম রাত এলি উইসলের স্মৃতিতে ও অস্তিত্বে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে!

‘কখনোই আমি ভুলবো না সেই রাত, বন্দি শিবিরে প্রথম রাত, যে রাতের কারণে আমার জীবনটা সাত স্তরে সীলমোহরকৃত এক সুদীর্ঘ রাতে পরিণত হয়েছে।
কখনোই আমি ভুলবো না সেই ধুম্রকুন্ডলী ।
কখনোই আমি ভুলবো না শিশুদের সেই ছোট্ট কোমল চেহারা যাদের দেহকে আমি এক নিরব আকাশের নীচে ধোঁয়ায় পরিণত হতে দেখেছি।
কখনোই আমি ভুলবো না সেই অগ্নিশিখা, যা আমার বিশ্বাসকে চিরতরে গ্রাস করেছিল।
কখনোই আমি ভুলবো না নিশিরাতের মতো সেই নীরবতা, যার কারণে বেঁচে থাকার আগ্রহ থেকে আমি বঞ্চিত সারা জীবন। 
কখনোই আমি ভুলবো না সেই মুহূর্তগুলো যা হত্যা করেছে আমার ঈশ্বরকে, আমার আত্মাকে, পুড়িয়ে ভষ্ম করেছে আমার স্বপ্ন।
কখনোই আমি ভুলবো না, এমনকি যদি আমাকে ততোদিনও বাঁচতে হয় যতদিন ঈশ্বর বাঁচবে। 
কখনোই না।’

মে মাসেই এলি ও তাঁর পিতাকে বিরকিনাও থেকে আউসউইৎজ বন্দি শিবিরে স্থানান্তার করা হয়। সাড়ে তিন কিলোমিটার পথের দুই পাশে বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বেড়া। সেখানে একটু পরপর কালোর ওপর সাদা রঙে কঙ্কালের মাথা আাঁকা সাইনবোর্ডে লেখা, সাবধান। মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ।’ এলি ভাবে, ‘কি নির্মম পরিহাস। হেথায় এক চিলতে জায়গাও কি আছে যেথায় মানুষ মৃত্যু ঝুঁকি মুক্ত?

এলির ভাবনা, এলির দুশ্চিন্তা, এলির জীবন বদলে যেতে থাকে দ্রুত গতিতে‘আমি আর ভীত নই। আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত। আমরা যাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাঁরা আর আমাদের ভাবনায় নাই। কেউ একজন বললোকে জানে তাঁদের সঙ্গে কি ঘটেছে? কিন্তু তাঁদের নিয়তি নিয়ে আমরা চিন্তা করছিলাম না। আমাদের চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে। ইন্দ্রিয় ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। কুয়াশায় সবকিছু আবছা হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন আর কোনো কিছুই আঁকড়ে ধরি না। নিজেকে রক্ষা করার, নিজের সম্মানকে রক্ষা করার সহজাত প্রবৃত্তি আমাদের লোপ পেয়েছে। কোনো এক মুহূর্তে যখন স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হলাম, আমি আতঙ্কিত বোধ করলাম, মনে হলো আমরা অনন্ত শূন্যতায় লক্ষ্যহীন ঘুরতে থাকা কতিপয় অভিশপ্ত আত্মা, পথভ্রষ্ট আত্মা, মহাশূন্যে অনন্তকাল বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়ানো যাদের শাস্তি, আমরা পরিত্রাণ খুঁজছি, অচেতন হবার উপায় খুঁজছি, যদিও তা খুঁজে পাবার কোনোই সম্ভাবনা নাই।’

জুনের মাঝামাঝি তাঁদেরকে পাঠানো হয় বুনা শ্রম শিবিরে। প্রতি মুহূর্ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জীবনকে আর একটা দিন টেনে নেয়া, আরেকটা সূর্যোদয়, আরেকটা সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাঁচার অনিশ্চিত অসম যুদ্ধ। বাধ্যতামূলক কাজ, আত্মার অপমান, চাবুক, লাঠির বাড়ি, অকথ্য গালিগালাজ, কারণে-অকারণে শাস্তি, সকালে কালো কফি, রুটি, দুপুর এবং রাতে পাতলা স্যুপ, রুটি, শোবার তাক, রোল কল, গন শৌচাগার, ক্ষুধার্ত পেটে শেষ শক্তি বিন্দু নিংড়ে দেয়া শ্রমের বিনিময়ে বাঁচার জন্য অতিরিক্ত একটু সময় ক্রয়! এখানে শবদাহ চুল্লিগুলো বইয়ে লেখা অবিশ্বাস্য গল্প নয়, ইতিহাসের পাতার কোনো কালিমা নয়, চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রূঢ় জীবন্ত বাস্তব! চুল্লির চিমনি দিয়ে রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীন ধোঁয়া আকাশে ছড়িয়ে পরে। মানুষের মাংস পোড়া উৎকট গন্ধ প্রতি নিঃশ্বাসে নাক দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে, মগজে, হৃৎপিন্ডে, শিরায়-শিরায়, রক্ত কণিকায়, অস্তিত্বে এবং আত্মায় ছড়িয়ে পড়ে। চলমান বর্তমান কাল বা প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস টেন্সের একমাত্র উদাহরণক্ষুধা! শুধুমাত্র একটা বিষয়ই তখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, প্রাত্যহিক স্যুপের বাটি, আমার ভাগের বাসি রুটি। রুটি, স্যুপএই ছিল আমার সম্পূর্ণ জীবন। আমি আর কিছুই না, শুধুই একটা দেহ। হয়তো তার চেয়েও কম একটা ভুভুক্ষু পাকস্থলি। একমাত্র পাকস্থলিই সময়ের হিসাব রাখতো।’

আর ছিল বাছাই! স্বাস্থ্য পরীক্ষা! মাঠের মাঝে নির্বাচকদের সামনে দিয়ে জীবন হাতে নিয়ে দৌড়াও! দৌড়াও যদি বাঁচতে চাও অতিরিক্ত আরেকটা দিন। জোরে দৌড়াতে না পারলে তুমি কাজের অনপুযুক্ত। সুতরাং নির্ধারিত ওই লাইনে গিয়ে দাঁড়াও, যার শেষ মাথা অবধারিতভাবে শবদহন চুল্লি! বাছাইয়ের আগে এক ব্লক প্রধান বন্দিদের বলেন, এখনি বাছাই শুরু হবে। তোমরা সম্পূর্ণ নগ্ন হবে। তারপর একজন একজন করে তোমরা এসএস ডাক্তারের সামনে যাবে। আশাকরি তোমরা পাশ করবে। কিন্তু তোমাদের সকলেরই উচিৎ হবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। ঐ কক্ষে যাবার আগে হাত-পা নড়াচড়া করো, নিজের দেহে রঙ ফিরিয়ে আনো। ধীরে হাঁটবে না, দৌড়াও! দৌড়াও, যেন শয়তান তোমার গোড়ালিতে ভর করেছে! এসএসদের দিকে তাকিও না। নাক বরাবর সোজা দৌড় দিবে!’ ক্ষণিক বিরতি নিয়ে সে আবার বলে: আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, ভয় পেও না।’

বন্দিশালা থেকে মুক্তির জন্য বন্দিরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো। ধর্মীয় উৎসবেও বন্দিরা একত্রিত হয়ে ঈশ্বর বন্ধনায় অংশ নিত। অপমানে অভিমানে কিশোর এলি উইসলের মন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। প্রায়শ্চিত্ত দিবসে সে উপবাস করেনি—‘যখন স্যুপ গলাধকরণ করছিলাম, তা ছিল বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ, তাঁর বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ।’ ইহুদি পঞ্জিকা অনুসারে বছরের শেষদিনে প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রার্থনায় যোগ দিলো। প্রার্থনা পরিচালনাকারীর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘মহিমান্বিত হোক ঈশ্বরের নাম...’ অভিমানি কিশোর এলি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না      

মহিমান্বিত হোক ঈশ্বরের নাম? আমার শরীরের প্রতিটা কোষ বিদ্রোহ করে। কেন আমি তাঁর প্রশংসা করবো? কেন? হাজার হাজার শিশুকে গণকবরে পুড়িয়ে মারতে দিয়েছেন এজন্য? শ্মশানে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ছয়টা চুল্লি চালু রেখেছেন এজন্য? এমনকি সাবাথ এবং পবিত্র দিনগুলোতেও যে চুল্লির প্রজ্জ্বলন বন্ধ হয় না। তিনি তাঁর অপরিসীম শক্তি দিয়ে আউসউইৎজ, বিরকিনাও, বুনা এবং আরও অগণিত মানুষ মারার যেসব কারখানা তৈরি করেছেন, সে জন্য? কিভাবে আমি উচ্চারণ করতে পারি যে তিনি সর্বশক্তিমান, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধিকর্তা! কিভাবে আমি তাঁর প্রশংসা করতে পারি যিনি সকল জাতির মধ্যে আমাদেরকেই নির্বাচন করেছেন দিন-রাত অত্যাচারিত হবার জন্য, আমাদের পিতারা, আমাদের মাতারা, আমাদের ভাইয়েরা নিশ্চিতভাবে চুল্লির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখার জন্য। তুমি আমাদের নির্বাচন করেছো তোমার পূজাবেদিতে জবাই করার জন্য, সে কারণে মহিমান্বিত হোক তোমার পবিত্র নাম?’

বুনার বন্দিরা যে কারখানায় বাধ্যতামূলক শ্রম দিত সেখানে জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য সিনথেটিক তেল ও রাবার তৈরি হতো। সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ আমেরিকার বোমারু বিমান বুনার কারখানা আক্রমণ করে। আকাশ থেকে নিজেদের মাথার ওপর বোমা পড়ছে অথচ বন্দিরা আনন্দিত! ভয় পাইনি। ব্লকের ওপর একটা বোমা পড়লে শত শত বন্দি নিহত হবে। কিন্তু আমরা মৃত্যুভয়ে ভীত নই। অন্তত, এই মৃত্যুদূতের কাছে আমরা শঙ্কিত নই। প্রতিটা বোমার আঘাতে আমরা পরমানন্দ অনুভব করছিলাম, আমরা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছিলাম। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আক্রমণ চললো। আহা! যদি দশ ঘণ্টা, একশো ঘণ্টা ধরে চলতো।’

এবং আমি, গুপ্ত রহস্যপূর্ণ মতবাদের প্রাক্তন সাধক, অনুধাবন করলাম, বিধাতার চেয়ে মানুষ অধিক শক্তিশালী, অধিক মহান। আদম-হাওয়া যখন তোমার আদেশ অমান্য করেছিল, তুমি তাঁদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিলে। যখন নুহ্ নবীর বংশধরদের ওপর অসন্তুষ্ট হলে, তুমি মহাপ্লাবণ আনলে। যখন সোদোমবাসীরা তোমার আনুকূল্য হারালো, স্বর্গ থেকে তাদের ওপর অগ্নিবৃষ্টি আর নরক যন্ত্রণা বর্ষণ করলে। কিন্তু এই মানুষগুলোকে দেখো, যাদেরকে তুমি বিশ্বাস ঘাতকতার সঙ্গে পরিত্যাগ করেছো। তারা অত্যাচারিত, গ্যাস চেম্বারে আর জ্বলন্ত চুল্লিতে দগ্ধ, মৃত্যুর মুখোমুখি প্রতিটা মুহূর্ত। তারা কি করছে? তারা তোমার উপাসনা করছে। তোমার নামের প্রশংসা করছে!’

বুনার বন্দিরা যে কারখানায় বাধ্যতামূলক শ্রম দিত সেখানে জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য সিনথেটিক তেল ও রাবার তৈরি হতো। সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ আমেরিকার বোমারু বিমান বুনার কারখানা আক্রমণ করে। আকাশ থেকে নিজেদের মাথার ওপর বোমা পড়ছে অথচ বন্দিরা আনন্দিত! ভয় পাইনি। ব্লকের ওপর একটা বোমা পড়লে শত শত বন্দি নিহত হবে। কিন্তু আমরা মৃত্যুভয়ে ভীত নই। অন্তত, এই মৃত্যুদূতের কাছে আমরা শঙ্কিত নই। প্রতিটা বোমার আঘাতে আমরা পরমানন্দ অনুভব করছিলাম, আমরা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছিলাম। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আক্রমণ চললো। আহা! যদি দশ ঘণ্টা, একশো ঘণ্টা ধরে চলতো।’ বিমান আক্রমন শেষে, ব্লক থেকে সবাই বেরিয়ে আসলাম। বারুদ আর ধোঁয়ার গন্ধভরা বাতাসে শ্বাস নিলাম, আমাদের চোখ আশায় দীপ্ত।’

এক বন্দি শিবির থেকে অপর বন্দি শিবিরে মার্চ করে স্থানান্তরের নামই দেয়া হয় মৃত্যুর মিছিল’ বা ‘ডেথ মার্চ! ক্ষুধার্ত, ভগ্নস্বাস্থ্য, দুর্বল বন্দিদের চলার গতি শ্লথ হলেই সৈন্যদের বন্দুকের গুলি অথবা মিছিলে পদদলিত হয়ে পদে পদে মৃত্যু। ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি বুনা থেকে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। গন্তব্য গ্লেবেজ। এলি আর তার বাবার জন্য সুযোগ এসেছিল এই মৃত্যুর মিছিল থেকে পরিত্রাণ পাবার। তারা বুনার হাসপাতালে থেকে যেতে পারতো। কিন্তু সেখানকার ভাগ্য অনিশ্চিত। এলি বাবাকে প্রস্তাব দেয়, চলো আমরা অন্যদের সঙ্গে বন্দি শিবির ত্যাগ করি।’ বাবা বলেছিলেন, প্রার্থনা করি আমাদের এই সিদ্ধান্তের জন্য পস্তাতে না হয়, এলাইজার’। বস্তুত হাসপাতালে থেকে গেলেই ভালো হতো। যারা চিকিৎসা কেন্দ্রে রয়ে গিয়েছিল তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে আমি জানতে পেরেছিলাম। আমরা বন্দি শিবির ত্যাগ করার দুদিন পর রাশিয়া বাহিনী তাদেরকে উদ্ধার করেছিল।’ বিরামহীন তুষারপাতের মধ্যে এই মৃত্যুর মিছিলে’ রওয়ানা হয়েছিল ৫৬,০০০ বন্দি। ৩৫ মাইল দূরে রেল স্টেশনে পৌঁছাতে ১৫,০০০ বন্দির মৃত্যু ঘটে। এলি উইসল আর তার বাবা আবারও পশুবহনকারী রেলবগিতেএবারের বগি ছাদহীন। প্রতি বগিতে একশো জন। চলন্ত ট্রেনে যমদূতের উদ্দাম নৃত্য। এক জায়গায় ট্রেন থামলে বগি থেকে মোট বিশটা মৃহদেহ ফেলা হলো। তারপর রেলগাড়ি আবার চলা শুরু করল, পিছনে, পোল্যান্ডের তুষারাবৃত প্রান্তরে পড়ে রইলো শত শত পরিত্যক্ত উলঙ্গ মৃতদেহ, কোনো সমাধি ছাড়াই।’ চার দিন পর গভীর রাতে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছায়। শেষ দিনটা ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। আমরা বগিতে একশোর মতো যাত্রী ছিলাম। বারো জন গন্তব্যে পৌঁছুলাম। তাঁদের দুই জন, আমি আর বাবা। আমরা বুচেনওয়েল্ডে পৌছালাম।’ বুচেনওয়াল্ড বন্দি শিবির মূল জার্মান ভূখণ্ডের ভিতর।

বুচেনওয়েল্ডে ২৯ জানুয়ারি ১৯৪৫ এলির বাবার মৃত্যু হয়। এপ্রিলের ১০ তারিখ এলি উইসল মুক্ত মানুষ। বুচেনওয়াল্ড স্বাধীন হবার তিন দিন পর, কোনো এক ধরনের বিষক্রিয়ায় আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমাকে হাসপাতালে পাঠানো হলো এবং দুই সপ্তাহ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাটালাম। একদিন, যখন দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পেয়েছি, উল্টো দিকের দেয়ালের আয়নায় নিজেকে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই গেটৌর সময় থেকে নিজেকে দেখিনি। আয়নার গভীর থেকে এক মৃতদেহ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকা তার চোখের সেই দৃষ্টি আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যায়নি।’

একটি ইহুদি সংগঠন বুচেনওয়াল্ড বন্দি শিবির থেকে উদ্ধারকৃত ৪২৭ জন কিশোরকে ফ্রান্সে পুনর্বাসন করে। এলি উইসল তাদের মধ্যে একজন। তার দুই বড় বোন বেঁচে ছিলেন যাদের সঙ্গে তিনি ফ্রান্সে একত্রিত হন। এলি পড়াশোনায় মনোযোগী হন, বিশেষ করে ইহুদি ধর্মতত্ত্ব। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৫ সালে আমেরিকা যান। ১৯৬০ সালে নাইট প্রকাশিত হয়। ঐ বছর বইটি পুলিৎজার পুরষ্কার পায়। তিনি একজন স্বনামধন্য মানবাধিকার কর্মি ও লেখক। ১৯৮৬ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, এলি উইসল, নেলসন মান্দেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাদার তেরেসা, অং সান সুচি এবং নরম্যান বোরলাগবিশ্বের মাত্র সাতজন ব্যক্তি নোবেল শান্তি পুরষ্কার, ইউএস প্রেসিডেন্টসিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল অর্জন করেছেন। ২০১৬ সালের ২ জুলাই ৮৭ বছর বয়সে এলি উইসল মৃত্যু বরণ করেন।

আমি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আউসউইৎজ আর বিরকিনাও বন্দি শিবির ভ্রমণ করার ভুল(!) করেছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই নরকের ছোট ছোট দুটো মডেল। মানুষ হত্যার সুপরিকল্পিত দক্ষ দুই কারখানা! কোনায় কোনায় মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি। মৃত্যু এখানে পণ্য, মৃত্যুই অভিষ্ঠ লক্ষ্য! হিটলারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ রাইখফুয়েরার হিমলার, ডা. মেনগেলেসহ নাৎসি নেতারা নরকের বর্ণনা থেকেই বন্দি শিবিরের স্থাপত্য নকশা পরিকল্পনা করেছিলেন!

ভালোবাসার বিপরীত শব্দ ঘৃণা নয়, ভালোবাসার বিপরীত শব্দ উদাসীনতাThe opposite of love is not hate, it is indifference!—এলি উইসলের বিখ্যাত উক্তি!