নোবেল বক্তৃতা || আলো ও সোনালি সুতো || হান কাং

অ+ অ-

 

|| হান কাং ||

হান কাং ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়ানজু শহরে জন্মগ্রহণ করেন। নয় বছর বয়সে তিনি পরিবারের সাথে সিউলে চলে যান। ইয়োনছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরিয়ান সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেন। তার বাবা বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। সাহিত্য ছাড়াও তিনি চিত্রকলা ও সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত ছিলেন যা তার পুরো সাহিত্যে কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে সাহিত্য ও সমাজ ম্যাগাজিনে হানের্ প্রথম কবিতা উইন্টার ইন সিউল প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালে শিম্মুন স্প্রিং লিটারারি কন্টেস্টে তার উপন্যাস রেড অ্যাংকর পুরস্কৃত হয়। ১৯৯৫ সালে লাভ অব ইয়েশু ছোট গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তিনি কথা গল্পকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯৮ সালে কোরিয়ার আর্ট কাউন্সিলের আর্থিক সহায়তায় আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক লেখা কর্মসূচি আওতায় তিনমাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

হান কাংয়ের উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার লাভ করে এবং হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাসটি ২০১৭ সালে ইতালির মালাপার্তে পুরস্কার অর্জন করে। নরওয়ের ফিউচার লাইব্রেরি প্রজেক্টের উদ্যোগে ২০১৯ সালে পঞ্চম লেখক হিসাবে ডিয়ার সন, মাই বিলাভড উপন্যাসকে মনোনীত করে যা ২১১৪ সালে প্রকাশিত হবে। গ্রিক লেসনসদ্য হোয়াইট বুক তার অন্যতম দুটি উপন্যাস। তার সর্বশেষ উপন্যাস উই ডু নট পার্ট ২০২৩ সালে ফ্রান্সের মেডিসি পুরস্কার ও ২০২৪ সালে এ্যামিলি গিমে প্রাইজ ফর এশিয়ান লিটরেচার লাভ করে। ২০২৫ সালে এর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হবে।

হান কাং উপন্যাসের কাহিনিতে প্রাচ্যের চিন্তাধারার সাথে মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিষাদ ও যন্ত্রণাকে সংযুক্ত করে উপস্থাপন করেন। ব্যক্তি মানুষের জীবন জিজ্ঞাসার সাথে ঐতিহাসিক ক্ষতকে মিশিয়ে মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করেন। তিনি অত্যন্ত নিপুণতার সাথে জীবিত ও মৃত, শরীর ও মন এবং অতীত ও বর্তমানকে শৈল্পিক গতিময়তা ও কাব্যিক শব্দে প্রকাশ করেন। হান কাং সমকালীন গদ্যের অন্যতম প্রভাবক। সাহিত্য মাধ্যমে মানবজীবনকে প্রগাঢ় রূপে প্রকাশের অবদান স্বরূপ ২০২৪ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

 

|| সম্পাদকীয় নোট ||

কোরিয়ান ঔপন্যাসিক হান কাং-এর আলো ও সোনালি সুতো শিরোনামের বক্তৃতাটি দেন ২০২৪ সালের নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানের অনুষ্ঠানে। নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশান সম্প্রতি প্রতিধ্বনি পত্রিকাকে বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশের কপিরাইট প্রদান করেছে। আমরা নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশানহান কাং-এর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। প্রতিধ্বনির জন্য এটি অনুবাদ করেছেন লেখক ও সমালোচক পলাশ মাহমুদ

 

নোবেল বক্তৃতা || আলো ও সোনালি সুতো || হান কাং

গত জানুয়ারিতে বাড়ি পাল্টানোর ঠিক আগে আগে স্টোররুমে জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম, একটা পুরানো জুতার বাক্স চোখে পড়লো। বাক্সটা আলতো করে খুললাম। দেখলাম ভেতরে আমার শৈশবের কিছু ডায়েরি রাখা আছে। এক গুচ্ছ পত্রিকার মাঝে একটা পুস্তিকা পড়ে আছে। প্রথম পাতার উপর দিকের কিনারায় লেখা আছে কবিতার বই। পুস্তিকাটা খুবই পাতলা ছিল। পাঁচটা এ-ফাইভ কাগজ মাঝখান থেকে ভাঁজ করে পিন দিয়ে আটকে রাখা। আমি শিরোনামের নিচে ঢেউ ঢেউ করে পেন্সিল দিয়ে দুইটি দাগ টেনে দিলাম। প্রথম দাগটা বাম দিক থেকে ছয় ধাপ সামনের দিকে টেনে দিলাম। অন্য দাগটা ডান দিক থেকে সাত ধাপ নিচের দিকে। এটা কি কোন প্রচ্ছদ ছিল? নাকি শুধুই হিজিবিজি আঁকিবুকি? ১৯৭৯ সাল, একটা ছোট বইয়ের পিছনের পাতায় আমার নাম লেখা। ভেতরের পাতায় একই মাপে সর্বসাকুল্যে আটটি কবিতা লেখা আছে। সামনে ও পিছনের প্রচ্ছদ পাতায় পেন্সিল দিয়ে হাত আঁকা। সময়ানুক্রমিকভাবে প্রত্যেক পৃষ্ঠার নিচে আটটি ভিন্ন তারিখ লেখা। আমার আটবছর বয়সী সত্তার লেখা চরণ এগুলো। একেবারেই অকৃত্রিম ও নির্মল। কিন্তু এপ্রিলে লেখা একটা কবিতায় আমার চোখ আটকে গেলো। কবিতাটা নিচের স্তবক দিয়ে শুরু হয়েছিল:

ভালোবাসা কোথায় থাকে?
আমার কম্পিত-স্পন্দিত বুকের ভেতর।
ভালোবাসা কাকে বলে?
দুটি মন বেঁধে রাখার সোনালি সুতো।

পড়ার মাত্র এক মুহূর্তে আমি চল্লিশ বছর আগের একদিনে ফিরে গেলাম। এক পড়ন্ত বিকেলের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একটা ক্ষুদ্র মোটা পেন্সিল, তার সাথে লাগোয়া বলপয়েন্ট, ইরেজার আর বাবার ঘর থেকে লুকিয়ে আনা ধাতব স্টেপলার। সবকিছু চোখে ভেসে উঠলো। এখনো মনে পড়ে আমি যখন জানতে পারলাম আমাদের পরিবার সিউলে চলে যাবে। বিভিন্ন জায়গায় লিখে রাখা কবিতাগুলো একসাথে করার একটা ঝোঁক চলে আসলো। আমি খুঁজে বের করতে লাগলাম ছেঁড়া কাগজে হিজিবিজি করে লিখে রাখা কবিতা অথবা নোটবুকের কিনারা থেকে, দিনলিপির মাঝে মাঝে লিখে রাখা কবিতা। সব একটা ভলিউমে জড়ো করলাম। মনে পড়ে আমি যখন আমার কবিতার বই লেখা শেষ করলাম তখন সেটা কাউকে না দেখানোর একটা ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি কাজ করছিল।

খুঁজে পাওয়া ডায়েরি আর পুস্তিকাগুলো আবার জুতোর বাক্সে রেখে যখন ঢেকে দিচ্ছিলাম, আমি মোবাইল ফোনে ওই কবিতাটার একটা ছবি তুলে রাখলাম। ছবিটা তুলেছিলাম কারণ আমার মধ্যে একটা বোধ কাজ করছিল যে সেই সময়ে লেখা শব্দ আর আজকে আমি যে লেখক হয়ে উঠেছি তার মধ্যে একটা ধারাবাহিক যোগসূত্র আছে। আমার বুকের ভেতর, স্পন্দিত হৃদয়, আমার মনের মাঝে, যে সোনালী সুতো বেধে রাখেএকটা সুতো যা আলো ছড়িয়ে দেয়।

 

*

ঠিক চৌদ্দ বছর পর আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। পরের বছর প্রকাশিত হয় প্রথম ছোট গল্প। আমি লেখক হয়ে উঠি। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটা লিখতে আমার প্রায় তিন বছরের বেশি সময় লেগেছিল। কবিতা বা গল্প লেখার পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে আমি বরাবরই উৎসুক ছিলাম এবং এখনও আছি। কিন্তু উপন্যাস আমাকে ভীষণভাবে টানে। এক একটা উপন্যাস লিখতে আমার এক থেকে সাত বছর পর্যন্ত দখল করে ফেলে। এই কারণে আমাকে অবশ্য আমার ব্যক্তিগত জীবনের অনেকটা অংশের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়। কিছু ব্যাপার এই সৃষ্টিশীল কাজে আমাকে বারবার টেনে আনে। একদিন আমি এই লেখার জগতে প্রবেশ করি। তারপর দীর্ঘদিন সেখানে থেকে যাই। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কিছু জরুরী ও অলঙ্ঘনীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে থাকি। তাই জীবনের সাথে সমঝোতা না করে আমার কোন উপায় থাকে না।

যতবার কোন উপন্যাস লিখতে বসি, আমাকে এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। এদের সাথে বাস করতে হয়, সহ্য করতে হয়। আমি যখন এই প্রশ্নগুলোর শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাই। আমি যখন প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করে ফেলি। তখন দেখি প্রশ্নগুলো প্রথমে যেমন ছিল শেষের দিকে তেমন আর থাকে না। লেখা শেষ হলে দেখি উত্তরের সাথে সাথে প্রশ্নের প্রকৃতি বদলে গেছে। তাই লেখা শেষ হলে আমি আর তেমনটা থাকি না যেমনটা লেখার শুরুতে ছিলাম। এই পরিবর্তিত আমির সাথে অন্য আরেক লেখা শুরু করতে হয়। পরের প্রশ্নটাও আগের প্রশ্নের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত থাকে। অনেকটা একটা মালার পুতির মতো। কিছুটা ডমিনোর মতো সমপাতিত হয়ে থাকে। সম্পৃক্ত থাকে, বহমান থাকে আর আমি নতুন কিছু লেখার দিকে ছুটে যাই।

২০০৩ থেকে ২০০৫ সময়কালের মধ্যে আমি দ্য ভেজিট্যারিয়ান উপন্যাসটা লিখছিলাম। সেই সময় আমি কিছু কঠিন যন্ত্রণাদায়ক প্রশ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম: একজন মানুষ কি পুরোপুরি নিষ্পাপ হতে পারে? কতটুকু সহিংসতাকে আমরা উপেক্ষা করে যেতে পারি? কেউ যদি মানবজাতির পরিচয়ে থাকতে অস্বীকার করে তাহলে তার সাথে কি কি হতে পারে?

নৃশংসতাকে না বলে কেউ যদি মাংস খেতে অস্বীকার করে। নিজেকে বৃক্ষ মনে করে পানি ছাড়া অন্য সব জল খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেয়। দ্য ভেজিট্যারিয়ান উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র এমনই এক পরিহাসমূলক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যায়। নিজের জীবন বাঁচানোর ডাকে মৃত্যুর দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। ইয়ং-হেই ও তার বোন ইন-হেই (গল্পের সহ-প্রধান চরিত্র) জীবনের দুঃস্বপ্ন আর সম্পর্কের ভাঙনের অসহ্য যাতনা থেকে নিঃশব্দে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু কাহিনির সমাপ্তিতে আবার এক হয়ে যায়। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যটা আমি একটা অ্যাম্বুল্যান্সর ভেতর রেখেছিলাম কারণ আমি চাচ্ছিলাম ইয়ং-হেই এই দুনিয়ায় বেচেঁ থাকুক। জ্বলজ্বলে সবুজ পাতা মাড়িয়ে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িটা দৌড়ে যাচ্ছিল আর বড় বোন পাশে বসে জানালা দিয়ে অপলক বাইরে তাকিয়ে ছিল। হয়তো কোন সাড়া পাওয়ার আশায়, হয়তো কোন গোপন ক্ষোভে। পুরো উপন্যাসটা একটা প্রশ্নের রাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। অনিমেষ দৃষ্টিতে উৎসুক হয়ে আছে, সবকিছুকে প্রত্যাখান করে যাচ্ছে। কোন একটা জবাবের জন্য অপেক্ষা করচ্ছে।

দ্য ভেজিট্যারিয়ান’-এর পরের লেখা ইঙ্ক অ্যান্ড ব্লাড উপন্যাসে এই প্রশ্নের পরম্পরা চলতে থাকে। সহিংসতাকে না বলতে গিয়ে জীবন ও জগতকে অস্বীকার করা একটা অসম্ভব ও অবাস্তব ব্যাপার। আমরা কি বাস্তবিক অর্থে গাছ হয়ে যেতে পারি? তাহলে কিভাবে আমাদের জীবন চলবে? এই রহস্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর মতো রোমান ও ইটালিক টাইপে ছাপা বাক্যগুলোও  একটি আরেকটির সাথে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় জড়িয়ে যায়। পুরো উপন্যাসে ইয়ং-হেই মৃত্যুর ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে গিয়েছে। তার বন্ধুর মৃত্যু যে আত্মহত্যায় হয়নি তা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। আমি উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে দেখিয়েছি ইয়ং-হেই কিভাবে মৃত্যু ও ধ্বংসের থেকে পালাতে মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। নিজের কাছে কিছু প্রশ্নগুলো রেখেছিলাম: মানুষ কি দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে? মানুষ কি কখনো জানতে পারবে সত্য কী?

আমার পঞ্চম উপন্যাস গ্রিক লেসনস’-এ এই প্রশ্নগুলোকে আরো এক স্তর গভীরে নিয়ে গিয়েছি। আমরা যদি সত্যি এই জগতে টিকে থাকতে চাই তাহলে কোন মুহূর্তটি এই বেঁচে থাকাকে সম্ভব করে তুলবে? একজন বোবা নারী ও একজন অন্ধ পুরুষ একটা অন্ধকার নির্জন রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের এই নিঃসঙ্গ পথ একটা বাঁকে এসে মিলিত হলো। আমি এই গল্পের সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। সেই অন্ধকার ও নির্জন পথে উপন্যাসের কাহিনি তার আপন ধীর গতিতে চলতে থাকে। নারীটি হাত বাড়িয়ে পুরুষটির হাতের তালুতে কিছু শব্দ লিখে দেয়। এই সামান্য আলোকোজ্জ্বল মুহূর্তটি এক অনন্ত পথের দিকে যাত্রা করে। চরিত্র দুটি একজন আরেকজনের কাছে তাদের জীবনের সবচেয়ে কোমল দিকগুলো প্রকাশ করে। এখানে আমি যে প্রশ্নটি রাখতে চেয়েছি তা হলো: এটা কি হতে পারে যে মানবজীবনের সবচেয়ে কোমল দিকগুলোর চরম আন্তরিকতাকে কদর করে করে আমরা এই ক্ষুদ্র ভয়ানক পৃথিবীতে টিকে থাকবো?

এই প্রশ্নের শেষ প্রান্তে পৌঁছে আমার পরবর্তী উপন্যাস নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ২০১২ সালের এক বসন্ত বেলায়, গ্রিক লেসনস প্রকাশের বেশি পরে নয়। নিজেকে বললাম এমন এক উপন্যাস লিখবো যা আলো আর উষ্ণতার আরো এক ধাপ সামনে নিয়ে যাবে। এই জীবন ও জগতকে এমনভাবে জড়িত করবো যা আরও উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ মানব সংবেদনকে প্রকাশ করবে। একটা শিরোনাম খুঁজে বের করলাম। প্রথম খসড়ার বিশ পাতা লেখার পর থামতে বাধ্য হলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরে কিছু একটা আমাকে এই উপন্যাসটি লিখতে বাধা দিচ্ছে।

 

*

তখন পর্যন্ত আমি গোয়ানজু সম্পর্কে কিছু লিখবো বলে ভাবিনি। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে আমার পুরো পরিবার গোয়ানজু ছেড়ে চলে যায়। আমার বয়স তখন মাত্র নয় বছর। ঠিক চার মাস আগে গোয়ানজুতে সেই ভয়ানক গণহত্যা শুরু হয়েছিল। কয়েক বছর পর একটা বইয়ের তাকে গোয়ানজুর গ্রন্থচিত্র বইয়ের শিরদাঁড়ার উপর থেকে নিচের দিকে চোখ পড়লো। আমার চারপাশে যখন কেউ ছিল না তখন আমি ছবিগুলো দেখে নিলাম। আমার বয়স তখন বারো চলছে। বইটিতে গোয়ানজুর অধিবাসী ও ছাত্রদের ছবির তালিকা ছিল যারা নতুন সামরিক শক্তির ক্যুয়ের প্রতিবাদ করেছিল বলে তাদের মুগুর, বেয়নেট ও বন্দুকের গুলিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মৃতদের পরিবার ও বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো বইটা গোপনে প্রকাশ, প্রচার ও বিলি করে যাচ্ছিল। এই বইটা সত্য ঘটনার সাক্ষ্য হিসাবে এমন সময় প্রচার করছিল যখন রাষ্ট্র শক্তি গণমাধ্যমকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সত্যকে বিকৃতভাবে তুলে ধরছিল। শিশু হিসাবে আমি তখন এই ছবিগুলোর রাজনৈতিক তাৎপর্যকে ধরতে পারিনি। এই বিধ্বস্ত চেহারার ছবিগুলো মানুষ সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন আমার মনে স্থায়ীভাবে রেখাপাত করেছিল। এই রকম কাজ কি একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে করতে পারে? তারপর আরেকটা ছবি দেখলাম যে ছবিতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে রক্তদান করার জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের সুদীর্ঘ সারি। এই রকম কাজ কি একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে করতে পারে? এই প্রশ্ন দুটি খুবই সাংঘর্ষিক ও পরস্পর বিরোধী মনে হলো। এই অসঙ্গতির গিঁট আমার পক্ষে খোলা সম্ভব নয়।

তাই ২০১২ সালের এক বসন্ত দিনে একটি দীপ্তিময় ও ইতিবাচক জীবনের উপন্যাস লিখবো বলে হাতে কলম তুলে নিলাম। আরো একবার এই অমীমাংসিত সমস্যার মুখোমুখি হলাম। বহুকাল আগেই মানুষের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাসকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। তাহলে কিভাবে আমি এই পৃথিবীকে আপন করে নিবো। আমি যদি জীবনে সামনের দিকে আগাতে চাই তাহলে এই জটিল ধাঁধাকে অতিক্রম করতেই হবে। আমার মনে হলো এই প্রহেলিকার পথ পাড়ি দিতে লেখালেখিই একমাত্র উপায়।

নতুন উপন্যাসের রূপরেখা ভাবতে ভাবতে সে বছর ভালোভাবেই কাটালাম। ১৯৮০ সালের মে মাসের গোয়ানজুকে নিয়ে ভেবে ভেবে বইয়ের একটা পর্ব তৈরি করে ফেললাম। ডিসেম্বর মাসে আমি মাংউল-দোয়ের সমাধিক্ষেত্র দেখতে গেলাম। দুপুর পেরিয়ে গিয়েছিল। আগের দিন ঘন তুষারপাত হয়েছিল। পরে যখন আলো কমে আসলো। বুকে উপর হৃদপিণ্ডের কাছে হাত দুটো ভাঁজ করে বরফাচ্ছন্ন কবরস্থান থেকে বের হয়ে আসলাম। মনে মনে বললাম পরবর্তী উপন্যাস একটা অংশ হিসাবে নয় বরং পুরো গল্পটা গোয়ানজুর প্রেক্ষাপটে লিখবো। ৯০০ জবান বন্দির সংকলনের একটা বই হাতে পেয়েছিলাম। এক মাসে প্রতিদিন নয় ঘণ্টা করে প্রতিটা বর্ণনা পড়েছিলাম। শুধু গোয়ানজু নয় রাষ্ট্রীয় সহিংসতার আরো কিছু ঘটনার-বিবরণ পড়ে ফেললাম। তারপর কালের উল্টো পথে গিয়ে আমি আরো কিছু ঘটনা খুঁজতে লাগলাম। আমি গণহত্যা নিয়ে পড়তে লাগলাম। ওইসব হত্যাকাণ্ড যা মানুষ দুনিয়া জুড়ে ইতিহাসের পরতে পরতে ঘটিয়েছে।

সেই সময়ে উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমার মনে দুটি প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিল। আমার মধ্য-বিশে লেখা প্রত্যেকটা নতুন ডায়েরির প্রথম পাতায় আমি নিচের লাইনগুলো লিখে রাখতাম।

বর্তমান কি অতীতের কাজে আসে?

জীবিতরা কি মৃতদের বাঁচাতে পারে?

যতই পড়ছিলাম আমার কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে এগুলো আজগুবি প্রশ্ন। মানবতার এমন দ্ব্যর্থবোধক বৈশিষ্ট্যের সাথে লড়াই করতে করতে আমার মাঝে মানুষের উপর ভঙ্গুর বিশ্বাসের অবশিষ্টাংশ পর্যন্ত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি উপন্যাসটা লেখা প্রায় ছেড়ে দিচ্ছিলাম। তারপর একদিন একটা নৈশ বিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষকের ডায়েরি পড়ছিলাম। এক লাজুক ও চাপা স্বভাবের যুবক পার্ক ইয়োং-যো। ১৯৮০ সালের মে মাসে সমগ্র গোয়ানজু জুড়ে স্বায়ত্বশাসিত নাগরিকদের সর্বোচ্চ সম্প্রদায়-এর হয়ে দশদিন যাবৎ অভ্যুত্থান হয়েছিল তাতে সে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। প্রাদেশিক প্রশাসনের প্রধান কার্যালয়ের কাছে ওয়াইডব্লিউসিএ-এর ভবনে তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। সৈন্যরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে জানার পরও সে সেখানে অবস্থান করছিল। সেই শেষ রাতে মৃত্যুর আগে আগে তার ডায়েরিতে লিখেছিল, কেন? ও খোদা! আমার বিবেক কেন থাকতেই হবে, যে বিবেক প্রতিনিয়ত আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এতো যন্ত্রণা দেয়? আমি যে বাঁচতে চাই।

এই বাক্যগুলো পড়ার পর আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গেলো যে আমার উপন্যাস আসলে কোন পথে অগ্রসর হবে। তাই আমার প্রশ্ন দুটো উল্টো দিক থেকে লিখলাম।

অতীত কি বর্তমানের কাজে আসে?

মৃতরা কি জীবিতদের বাঁচাতে পারে?

পরবর্তীতে আমার উপন্যাস হিউম্যান অ্যাক্টস লেখার সময় এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো: হ্যাঁ, অতীত সত্যিই বর্তমানের কাজে আসে এবং মৃতরা জীবিতদের বাঁচাতে পারে। আমি মাঝে মাঝেই সেই সমাধিক্ষেত্রটা দেখতে যেতাম এবং কেন জানি সেদিনের আবহাওয়া খুব পরিষ্কার থাকতো। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলতাম আর সূর্যের কমলা রঙের আলো আমার চোখের পাতায় ছড়িয়ে পরতো। এই আলোকে নিজের জীবনের রশ্মি মনে হতো। ওই আলো, ওই হাওয়া আমাকে অপার্থিব এক উষ্ণতায় মুড়িয়ে রাখতো।

ওই গ্রন্থচিত্রটা দেখার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত কিছু প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। মানুষ এমন নৃশংস হয় কিভাবে? একইসাথে এই মানুষই এমন মারাত্মক নৃশংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় কিভাবে? মানব প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলতে আসলে কি বুঝায়? মানবসৃষ্ট বিভীষিকা ও মানব মর্যাদার মধ্যবর্তী শূন্যস্থানের দুর্গম্য পথ অতিক্রম করতে আমার মৃতদের প্রয়োজন ছিল। হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাসের শিশু দো-হো যেমন তার মায়ের হাত ধরে টানাটানি করে সূর্যের দিকে যেতে প্রলুব্ধ করে।

মৃত, শোকাহত ও মৃত্যুঞ্জয়ীদের সাথে যা ঘটে গেছে তা তো আর আগের অবস্থায় ফেরানো যাবে না। আমি যা করতে পারি তা হলো আমার নিজের সংবেদন, আবেগ ও জীবনের স্পন্দন তাদেরকে ধার দিতে পারি। উপন্যাসের শুরু ও শেষে মোবাবাতির আলো জ্বালাতে পারি। উপন্যাসের প্রথম দৃশ্যটা পৌর ব্যায়ামগার থেকে শুরু করেছিলাম যেখানে নিহত দেহগুলো রাখা হয়েছিল আর শেষকৃত্যকর্ম সম্পাদন করা হয়েছিল। এখানে দেখলাম পনের বছরের দো-হো সাদা চাদর দিয়ে মৃতদেহগুলো ঢেকে দিচ্ছে, পাশে মোমবাতি জ্বালানো। প্রতিটা অগ্নিশিখার মাঝে ম্লান নীল রঙের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

এই উপন্যাসটির কোরিয়ান শিরোনাম হলো সুনিয়ন-ই-উনদা। শেষ শব্দ উনদা হলো উদা ক্রিয়ার বর্তমান রূপ যার অর্থ হলো আসা। যেই মুহূর্তে সুনিয়ন ছেলেটিকে দ্বিতীয় পুরুষ হিসাবে তুমি সম্বোধন করা হয়েছে (হতে পারে এটা ঘনিষ্ঠ তুমি অথবা অল্প ঘনিষ্ঠতার তুমি ডাক), সে ফিকে আলোয় জেগে উঠে বর্তমানের দিকে হেঁটে আসে। সে অশরীরী আত্মার পদক্ষেপে এগিয়ে আসে। যতই নিকটবর্তী হয় ততই বর্তমান হয়ে উঠে। যখনই কোনো স্থান আর কালে মানুষের নিষ্ঠুরতা আর মানব মর্যাদা চরম সমান্তরাল গতি চলে তখনই সেই সময় আর দেশকে গোয়ানজু বলে ডাকতে হবে। তখনই এই নামটি আর নির্দিষ্ট একটা শহরের নাম থাকে না। তার পরিবর্তে একটা সার্বজনীন নাম হয়ে উঠে। উপন্যাসটা লিখতে লিখতে আমার তাই মনে হয়েছে। এই নামটা আমাদের কাছে বারবার ফিরে আসে। দেশ ও কালের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পরে। সব সময় এটা বর্তমান। এমনকি এই মুহূর্তেও।

 

*

২০১৪ সালের বসন্তকাল। অবশেষে আমার উপন্যাসটা প্রকাশিত হলো। পাঠকরা বইটি পড়ে যে মর্মপীড়া অনুভব করেছে এটা জানার পর আমি খুই বিস্মিত হয়েছিলাম। কিছু সময় ভাবলাম উপন্যাস লেখার পুরো প্রক্রিয়ায় আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি আর পাঠকরা পড়ার সময় যে পীড়া বোধ করেছে এই দুয়ের মধ্যে কি কোন সংযোগ আছে। এই মানসিক দহনের পিছনে কারণটা কী হতে পারে? বিষয়টা কী এমন যে যখন আমরা মানবতার প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে চাই, যখন আমাদের এই আস্থা ভেঙ্গে পড়ে আর আমরা ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। বিষয়টি কী এমন যে যখন আমরা মানবতার প্রেমে পড়ি আর আমাদের এই ভালোবাসা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে তখন আমরা অর্ন্তবেদনা অনুভব করি। প্রেম কি বেদনার জন্ম দেয় নাকি বেদনা হলো ভালোবাসার নিশানা?

ওই একই বছর জুন মাসে আমি একদিন একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি একটা বিস্তৃত চারণভূমিতে হাঁটছিলাম। থেমে থেমে তুষার পড়ছিল। হাজার হাজার  কালো ভাঙ্গা গাছের গুড়িগুলো সমভূমিকে কালো কালো ফুটকি দিয়ে ভরিয়ে তুললো। প্রত্যেক শেষ গুড়ির পিছনে একটা করে সমাধির ঢিলা। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় আমি জলে নেমে পড়লাম। যখন পিছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম সমভূমির দূর প্রান্ত থেকে একটা সমুদ্র ধেয়ে আসছে যাকে আমি দিগন্তরেখা মনে করেছিলাম। এই রকম একটা জায়গায় এতো কবর কিভাবে আসলো? আমি অবাক হয়ে রইলাম। তার মানে কি সমতলের নিচের দিকে, সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা সমাধি টিলার হাড়গুলো নিশ্চয়ই জলে ভেসে গেছে? তার মানে কি উপরের দিকে সমাধি টিলার হাড়গুলো যেন জলে না ভেসে যায় সে জন্য এদের অন্য কোথাও স্থানান্তর করা আমার উচিৎ নয়? কিন্তু কিভাবে করবো? আমার কাছে কোন বেলচা পর্যন্ত নেই। পানির উচ্চতা ইতোমধ্যে আমার হাঁটু ছুঁয়ে ফেলেছে। আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমি জানালার বাইরে গাঢ় অন্ধকারের দিকে নিথর হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমার মন হলো এই স্বপ্ন আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বপ্নটা লিখে ফেললাম আর ভাবতে লাগলাম এই স্বপ্ন দিয়েই পরবর্তী উপন্যাস আরম্ভ করতে হবে।

এই কাহিনি কোথায় নিয়ে যাবে এই বিষয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না। যাই হোক এই স্বপ্ন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকগুলো সম্ভাব্য গল্পের শুরু। একবার লিখি তো আরেকবার কেটে ফেলি। অবশেষে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যেজু দ্বীপে একটা রুম ভাড়া নিয়ে প্রায় দুই বছর সেখানে কাটালাম। মাঝে মাঝে সিউল ও যেজু শহরের মধ্যে সময় ভাগাভাগি করে কাটালাম। বনের পথে, সমুদ্র তীরে ও গ্রামের পথ ধরে হাঁটতাম। প্রত্যেকটা মুহূর্তের যেজুর আবহাওয়াকে গভীরভাবে অনুভব করতাম। যেজুর আলো ও হাওয়া, বৃষ্টি ও তুষারপাত সবকিছু। আমার কাছে উপন্যাসের রূপরেখা ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাসের মতো করে আমি গণহত্যায় বেঁচে থাকা মানুষের জবানবন্দি পড়া শুরু করলাম। নানান লেখাপত্র নিয়ে নিবিড় অধ্যয়নে মগ্ন ছিলাম। এই পাশবিক বিবরণগুলো যাতে এড়িয়ে না যাই তার যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। ঘটনাগুলো এতোটা নৃশংস ছিল যে সেগুলো শব্দে প্রকাশ করা আমার জন্য দূরহ হয়ে উঠেছিল। তারপরও উই ডু নট পার্ট উপন্যাসটা লিখে ফেললাম। সেই নিকষ কালো গাছের গুড়ি, সেই উত্তাল সমুদ্র। স্বপ্ন দেখার সাত বছর পর এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো। উপন্যাসটি লেখার সময় নোটবুকে এই কথাগুলো লিখে রেখেছিলাম।

মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। জীবন মানে উষ্ণতা।

শীতল হয়ে যাওয়া মানে মরে যাওয়া। মুখের উপর বরফ গলে না গিয়ে জমে থাকা মানে আপনি মৃত।

কাউকে নিরুত্তাপ করে রাখা মানে আপনি তাকে মেরে ফেলেছেন।

ইতিহাসের মানুষ এবং মহাবিশ্বের মানুষ হয়ে উঠতে হবে।

হাওয়ার প্রবাহ ও সমুদ্রের স্রোত হয়ে উঠতে হবে। জল ও বাতাসের চক্রাকার প্রবাহ হতে হবে যা বিপুল এই বিশ্বকে বেঁধে রাখে, মানুষকে যুক্ত করে রাখে। আমি প্রার্থনা করি মানুষ যেন সংঘবদ্ধ থাকে।

উপন্যাসটার তিনটা পর্ব আছে। প্রথম পর্বটা অনেকটা আনুভূমিক ভ্রমণের মতো। কাহিনীর কথক কিয়ংহা সিউল থেকে পাহাড়ী দ্বীপ যেজুতে তার বন্ধু ইনসঙের বাড়ি যায়। বন্ধুর পোষা পাখিটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কাধে নিয়ে সে তীব্র তুষারাবৃত পথ পাড়ি দেয়। দ্বিতীয় পর্ব আবার একটা খাড়া পথে ভ্রমণের মতো। যেখানে কিয়ংহা ও ইনসঙ মানবতার কানাগলিতে এগিয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের শীতে যেজুর বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হারে হত্যা করে সমুদ্রের অতলে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। শেষ পর্বে তাদের দুজনকে সাগরে তীরে বসে মোমের আলো জ্বালাতে দেখা যায়।

যদিও উপন্যাসটা দুই বন্ধুকে ঘিরে অগ্রসর হয় কিন্তু তারা যখন মোমবাতি হাতে ঘুরে দাঁড়ায় তখনই গল্পের আসল প্রধান চরিত্রের আবির্ভাব হয়। এই দুই বন্ধু কিয়ংহা ও ইনসঙকে যে যুক্ত করে রেখেছে সেই ইনসঙের মা চংশিম। সে যেজু গণহত্যায় বেঁচে ফেরা এক নারী যে কি না তার ভালোবাসার মানুষের সামান্য দেহাংশ খুঁজে পেতে আপ্রাণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে শুধু অন্তিম সংস্কারটা ঠিকঠাকভাবে করবে বলে। তাই সে শোক পালন থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। নিজের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা জমা রেখে তার প্রেমকে বিস্মৃত হওয়া থেকে আগলে রেখেছে। সে তার প্রিয় মানুষকে শেষ বিদায় জানাতে অসম্মতি জানিয়েছে। প্রেমে ও বিরহের সমানুপাতিক ঘনত্ব, গভীরতা ও উত্তাপ নিয়ে তার জীবনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। এতোদিন যাবৎ আমি যে প্রশ্নগুলো করে যাচ্ছিলাম সেগুলো বোধহয় এই রকম: আমরা কতোটুক ভালোবাসতে পারি? আমাদের সীমারেখা কোথায়? শেষ অব্দি মানুষ হয়ে থাকার জন্য আমাদের ঠিক কতোটুকু ভালোবাসতে হবে?

 

*

উই ডু নট পার্ট উপন্যাসের কোরিয়ান সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে প্রায় তিন বছর হতে চলল। আমার পরবর্তী উপন্যাস লেখা এখনো শেষ হয়নি। তার পরের যে উপন্যাসটা লিখবো তার ভাবনা বহুকাল ধরে মাথায় কাজ করছে। এই বইটা হোয়াইট বুক উপন্যাসের সাথে সম্পর্কিত হবে। আমার বড় বোন যে কিনা জন্মের দুই ঘণ্টা পর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, আমার জীবনের কিছুটা সময় তাকে উৎসর্গ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে হোয়াইট বুক উপন্যাসটা লিখেছিলাম। আমাদের জীবনের শাশ্বত দিকগুলোতে দৃষ্টিপাত করাও আরেকটা কারণ ছিল। কোন লেখা কখন শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কিনা তা আগে থেকে বলা যায় না। তারপরও আমি লিখতে থাকবো, যত ধীরগতিতে হোক না কেন লেখা চালিয়ে যাবো। আমি আমার প্রকাশিত বইয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে নতুন বই লিখতে বসবো। ততক্ষণ লিখতে থাকবো যতক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে এমন এক কোনায় না পৌঁছি যেখানে থেকে তারা আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। ততদূর পর্যন্ত লিখতে থাকবো যতদূর পর্যন্ত জীবন আমাকে সঙ্গ দেয়।

যখন আমি বইগুলো থেকে দূরে সরে যাবো তারা আমাকে ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের জীবনচক্র পাড়ি দেবে। নিজেদের অভিষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে যাবে। ঠিক ওই দুইবোনের মতো অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতর চলতে থাকবে, জানালার বাইরে সবুজের অগ্নিচ্ছটা দেখতে দেখতে চলতে থাকবে। ঠিক ওই নারীটির মতো যে শীঘ্রই তার বাকশক্তি ফিরে পাবে। রাতের নিস্তব্ধতায় অন্ধ লোকটির হাতের তালুতে লিখতে থাকবে। ঠিক আমার বোনের মতো যে জন্মের দুই ঘন্টা পর মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে আর আমার মা আর্তনাদ করে বলতে থাকবে, মরো না প্লিজ, মরো না। এই আত্মারা কতো দূরে যাবে? আমার মুদিত নয়নের পাতার পিছনে প্রগাঢ় কমলা রঙের আভায় ওই আত্মারা মিলিত হচ্ছে। এই আত্মারা আমাকে অপার্থিব আলোর উষ্ণতায় জড়িয়ে রেখেছে। মোমবাতিগুলো জ্বলতে জ্বলতে কতো দূরে যাবে? প্রত্যেকটা বধ্যভূমিতে জ্বলতে থাকা বাতি কতদিন আলো দিবে? প্রত্যেকটা দেশ ও কাল একদিকে অর্থহীন সহিংসতায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে, অন্যদিকে কিছু মানুষ সংহত হয়ে আছে যারা কখনো বিদায় বলবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারা কি এই সোনালি সুতো বেয়ে জ্বলতেই থাকবে মোমবাতির সলতে থেকে সলতে, হৃদয় থেকে হৃদয়ে।

 

*

গত জানুয়ারিতে পুরাতন জুতোর বাক্সে খুলে যে কবিতার পুস্তিকাটা পেয়েছিলাম। সেই ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে আমার অতীত-সত্তা কি এক আত্ম-জিজ্ঞাসার ঘোরে লিখে রেখেছিল।

ভালোবাসা কোথায় থাকে?

ভালোবাসা কী?

অপরদিকে ২০২১ সালের শরতে  উই ডু নট পার্ট প্রকাশের ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার অন্তরস্থল থেকে নিচের দুটি প্রশ্ন নিয়ে অনেকবার ভেবেছি:

এই জগৎ এত নিষ্ঠুর ও বেদনাময় কেন?

এই পৃথিবী এতটা সুন্দর হয় কি করে?

বহুকাল যাবৎ আমার বিশ্বাস ছিল এই বাক্য দুটির মধ্যে বিদ্যমান চাপা উত্তেজনা ও আন্ত-দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই আমার লেখালেখির প্রেরণা। সর্বপ্রথম উপন্যাস থেকে সর্বশেষ পর্যন্ত যে প্রশ্নগুলো আমার মনকে নাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে এই দুইটি প্রশ্ন সবসময় একই রকম রয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুই বা তিন বছর আগে আমার মনে একটা সংশয় দেখা দিল। ২০১৪ সালের বসন্তে হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাসের কোরিয়ান সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমাদের জীবনকে সংহত করে যে ভালোবাসা ও বেদনা সে ব্যাপারে নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম। শুরু থেকে সাম্প্রতিক উপন্যাস পর্যন্ত  আমার সকল প্রগাঢ় আত্ম-জিজ্ঞাসা  কি শুধুই ভালোবাসার দিকে ধাবিত হয়নি? এটা বলা কি তাহলে ভুল হবে যে, ভালোবাসা হলো আমার জীবনের সবচেয়ে পুরাতন মৌলিক জিজ্ঞাসা?

১৯৭৯ সালে যে বাচ্চা মেয়েটি লিখেছিলভালোবাসা আমাদের সবচেয়ে গোপন কোটর আমার হৃদয়’-এ বাস করে (আমার কম্পিত-স্পন্দিত বুকের ভেতর)। আর  ভালোবাসা কি এই প্রশ্নের উত্তরে সে লিখেছিল (দুটি মন বেঁধে রাখার সোনালি সুতো)।

আমি যখন লিখি তখন আমার শরীর দিয়েও লিখি। সংবেদনের সকল মাধ্যম  মানে দেখা, শোনা, ঘ্রাণ, স্বাদ কোমলতা ও উষ্ণতা এবং শীতলতা ও কাতরতা সকল অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে পঙ্খানুপঙ্খু ভাবে প্রয়োগ করি। আমার হৃদপিন্ডের স্পন্দন, আমার দেহের জলখাবার, হাঁটা, দৌড়ানো, আমার শরীরে বাতাস, বৃষ্টি ও তুষারের স্পর্শ, আঙ্গুলের ছোঁয়া সবকিছুকে অনুভব করি। একজন নশ্বর মানুষ হিসাবে ওই সব প্রাণবন্ত সংবেদনগুলো আমার শরীর থেকে গল্পের চরিত্রের শরীরে শব্দের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেই। মনে হয় আমি যেন বৈদ্যুতিক প্রবাহ পাঠাচ্ছি। 

আমি যখন বুঝতে পারি এই প্রবাহ পাঠকের মধ্যেও পৌঁছে যাচ্ছে। আমি বিস্মিত হই। আমার মনের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এই মুহূর্তগুলোতে আমাদের যুক্ত করে রাখার জন্য ভাষার সুতোগুলোকে অনুভব করতে পারি। আমার এই প্রশ্নগুলোর সাথে পাঠকেরা কিভাবে এতো প্রাণবন্ত হয়ে সংযুক্ত থাকে বুঝতে পারি। আমার সুতোয় যে সকল পাঠকরা জড়িয়ে থাকেন বা যারা আগামীতে যুক্ত হবেন সবার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।

উৎস লিংক: Han Kang—Nobel Prize lecture - NobelPrize.org

Copyright © The Nobel Foundation 2024
Bengali Copyriht © pratidhwanibd.com