সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষা ও নির্মাণ-প্রকৌশল

অ+ অ-

 

বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় প্রবন্ধ-সাহিত্য আধুনিক কালের সৃষ্টি। ঊনবিংশ শতাব্দীর  প্রথমার্ধ  থেকেই বাংলা সাহিত্যের শাখা হিসেবে প্রবন্ধ-সাহিত্যের যাত্রার সূত্রপাত। মূলত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরী [১৭৬১-১৮৩৪], রামরাম বসু [১৭৫৭-১৮১৩], মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার [১৭৬২-১৮১৯] এবং উনিশশতকে খ্রিস্টান পাদ্রী, শ্রীরামপুর মিশনারি কর্তৃক দিকদর্শন [১৮১৮] পত্রিকায় খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার, ধর্মের মাহাত্ম্য, নীতিকথা, উপদেশবার্তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করার জন্য; তাঁরাই সবপ্রথম গদ্যে রচিত ছোট-ছোট নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনার প্রারম্ভিক সূচনা করেছিলেন। তারও পরে ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে রাজা রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩], ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [১৮২০-১৮৯১], অক্ষয়কুমার দত্তের [১৮২০-১৮৮৬] লিখিত গদ্যসাহিত্য থেকেই বাংলা আধুনিক প্রবন্ধসাহিত্যের উৎপত্তি। সেজন্য ‘কালক্রম হিসেবে প্রবন্ধ বাংলা অন্যান্য গদ্য-সাহিত্যের মধ্যে অগ্রজ বলে বিবেচিত।’ ‘বিশেষতঃ সবুজপত্র [১৯১৪] পত্রিকা প্রকাশের পর থেকে বাঙালি লেখকগণের দৃষ্টিশক্তি বিস্তৃতি ও বিশ্বচৈতন্যবোধের পরিব্যাপ্তি ঘটেছে এবং অনিবার্যভাবেই প্রবন্ধ ভাব ও ভাষার অভাবনীয় যে শ্রীবৃদ্ধি; তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১], বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৭০-১৮৯৯], রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী [১৮৬৪-১৯১৯] ও প্রমথ চৌধুরীর [১৮৬৮-১৯৪৬] প্রবন্ধ রচনার দ্বারাই প্রবন্ধসাহিত্য স্বকীয়তায় উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্যে প্রখর ও বৈশিষ্ট্যে  প্রদীপ্ত’। বলাবাহুল্য, উনিশশতকে ‘অক্ষয়কুমার দত্তই [১৮২০-১৮৮৬] সর্বপ্রথম ইংরেজি আদর্শের অনুসরণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র বিষয়বস্তু অবলম্বনে ক্ষুদ্রকারে তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেছেন।’ এঁর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘প্রস্তাব ও প্রবন্ধ’ এই দুটি শব্দই ব্যবহার করতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। পাশ্চাত্যে মঁতেন, স্কটল্যাণ্ডে ষষ্ঠ জেমসই এঁর লেখায় ইংরেজিতে প্রথম প্রবন্ধ শব্দটির প্রথম ব্যবহার দেখা যায়। এমনকি সমসাময়িকলগ্নে ভারতবর্ষে প্রবন্ধ শব্দটি সাহিত্যদর্পণকার আচার্য বিশ্বনাথ ব্যবহার করেছিলেন কাব্যাদির বিভিন্ন উপাদানগত আবশ্যিক সঙ্গতি বোঝাতে। এমনকি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত অলংকারিকেরা ঔচিত্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাকে বলতো প্রবন্ধৌচিত্য। অন্যত্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যেকোনো রকমের প্রকৃষ্ট বন্ধন বোঝাতেই ‘প্রবন্ধ’ শব্দটি ব্যবহার দৃশ্যগত হয়। সেখানে প্রবন্ধের বিভাগ-উপবিভাগরূপে লাচারী-প্রবন্ধ, পয়ার-প্রবন্ধ, পাঁচালী-প্রবন্ধ প্রভৃতি প্ররিলক্ষিত হয়।’ সর্বসাকুল্যে আজকের আধুনিক সাহিত্যের মাধ্যম বিচারে প্রবন্ধ শক্তিশালী গদ্য রচনা বিশেষ। বস্তুত, প্রবন্ধে পাঠক ‘সাহিত্যের অনুভূতিতে উপলব্ধ সত্যকে তিনি দেখেন পারেন বস্তুর আপেক্ষিকতায়।’ আর এই অনুভূতি ও ভাবনার নিবন্ধ অর্থাৎ ‘সাহিত্যকে স্থূলভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়-ভাবের সাহিত্য বা রস এবং জ্ঞানের সাহিত্য’ উপরন্তু, যেকোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ, বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বিতর্কিত বিষয়ে পাঠককে একটি নীতিসিদ্ধ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে প্রবন্ধ সাহায্য করে। এই রকম বিচার-বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ‘প্রবন্ধ’ শব্দটি বাংলা সাহিত্যে শক্তিশালী শাখারূপে গৃহীত হয়; প্রধানত দুটি শাখা—ক. মন্ময়, খ. তন্ময়। ‘মন্ময়’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক স্বাধীন বিচরণকারী। এখানে ব্যক্তিগত কোনো বিষয়বস্তুকে রসগ্রাহ্য করে তোলেন প্রাবন্ধিক। আর তন্ময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, তথ্য, জ্ঞান, তত্তগত্ব ভাবমণ্ডল দ্বারা আবর্তিত। সর্বোপরি, নির্মাণ প্রকৌশল এ বুদ্ধিদীপ্ত রচনাশৈলী, সুসংহত বিষয়বস্তু, তত্ত্ব-তথ্যের সংমিশ্রণে যুক্তিনিষ্ঠ সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষাত্মক উপস্থাপনা, সাবলীল ভাব-ভাষার সৌকর্য প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র শাখা-প্রশাখার মধ্যে ‘প্রবন্ধ সাহিত্য’ দৃঢ় শক্তিশালী শাখারূপে জায়গা করে নিয়েছে। আর তা মূলত নির্মাণ-প্রকৃতির বাঁক-বদলের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত; যা বিভিন্ন দশকের বিভিন্ন লেখকের হাতে প্রবন্ধের ফ্রেম, নির্মাণ-প্রকৌশল পরিবর্তিত হয়েছে নানাবিধ আঙ্গিকে। তাঁদেরই একজন প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী [১৯৩৬—]। তাঁর প্রবন্ধসমূহ বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য; রচনা ও প্রকাশের ভিন্নতাসম্পন্ন, ভাষার স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল, আঙ্গিকের অভিনবত্বে অসাধারণ। সেই সাথে আনন্দজনক ও উদযাপনীয় ভাষাশৈলী'র সারল্যতায় এবং গভীরতার যুগ্ম-গুণে ভাস্বর বলে নিবিষ্ট গবেষক আর সাধারণ পাঠক-উভয়েরই সহজ প্রবেশাধিকার ঘটে। নিচে বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের ইতিহাসে খ্যাতিমান প্রাবন্ধিকদের সাথে বিশশতকের শক্তিশালী প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষা ও নির্মাণ প্রকৌশলের তুলনামূলক বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার ভেতর দিয়ে বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যে তাঁর সৃজনী প্রতিভার স্বাতন্ত্র্যতা ও সার্থকতার দিকটি উপস্থাপিত হয়েছে। 


প্রবন্ধৌচিত্য বা প্রবন্ধ মানেই চিন্তামূলক, বুদ্ধিগ্রাহ্য ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণধর্মী রচনা। তত্ত্ব, তথ্যনির্ভর, চিন্তা ও মনন বহিভূর্ত হালকা-চটুল রচনা প্রবন্ধ হতে পারে না। প্রাবন্ধিক তাঁর তথ্যনির্ভর যুক্তিনিষ্ঠ মননশীল রচনাকে পাঠকের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেন; যাতে তাঁর বক্তব্য, বিষয় সুসংহত, সুবিন্যস্ত এবং সংক্ষিপ্ত হয়। প্রবন্ধের ভাষা হবে গদ্য এবং তার গাঁথুনি হবে সুদৃঢ়। পাঠকের কাছে তা সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহীবোধ সম্পন্ন হবে। এক কথায় কল্পনা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে আশ্রয় করে প্রাবন্ধিক ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন-ইতিহাস, সমাজ-রাজনীতি, সাহিত্য-শিল্পকলা প্রভৃতি ব্যাপার নিয়ে যে সমস্ত তত্ত্বকেন্দ্রিক ও বস্তুগত চিন্তামূলক গদ্যনিবন্ধের ভেতর দিয়েই  প্রবন্ধসাহিত্যের প্রাবন্ধিক  শৈল্পিকগুণ বজায় রাখে।’ অবশ্য বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩] প্রবন্ধ রচনায় ‘যে পরিমাণে বেদান্তপন্থী ও সমাজসংস্কারক ছিলেন; সে পরিমাণে সাহিত্যরসিক ছিলেন না। তাঁর প্রবন্ধে ভাষায় সৌন্দর্য বিশেষ না থাকলেও এক কথায় বলা যায় তাঁর মধ্যে বলা ও লেখার দৃঢ়তা ছিল।’ বস্তুত, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে সামগ্রিক প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর মধ্যে প্রথমত বিষয়বস্তু ও নির্মাণ প্রকৌশল অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধ লেখার সময় তাঁর জীবনদর্শন, বাস্তবমুখী প্রবণতা, সাহিত্য ও প্রগতিশীল ভাববৈদগ্ধ লেখক সত্ত্বাকে বিচিত্র ভাবনায়, চিন্তার কল্পনার প্রবাহকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক ও আন্তর্জাতিকতার প্রভৃতি ক্ষেত্রে চিন্তায় প্রসূত হয়। যেখানে বিষয়বস্তু, যুক্তি পারস্পর্য বৈজ্ঞানিকতা, নিঃস্পৃহা প্রাধান্য রেখেইে শিল্পসচেতন প্রাবন্ধিক  প্রবন্ধ-সাহিত্য রচনা করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যে বিশশতকের শক্তিমান প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর সাহিত্যভাবনা, সমাজ-রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে আত্মমগ্নতায় রচিত  প্রবন্ধসমূহ ‘ভাবে, ভাষায় ও নির্মাণরূপে যেমন স্বতন্ত্র ও বিচিত্র; তেমনি তা বহুমুখী ধারায় বিকশিত। যা তাঁর অনুপ্রম সৃজনী-প্রতিভার প্রকাশ।’ খ্যাতনামা একজন সাহিত্য সমালোচক লিখেছেন:
সাহিত্য বা শিল্পে ভাবের সত্যকে উপ্রলব্ধির জন্যে কল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। সেখানে সৌন্দর্যচেতনা সৃজন, একমাত্র কল্পনার দ্বারাই সম্ভব। মানুষ তখনই শিল্পীসত্তায় পরিণতি লাভ করে যখন তার  চেতনায় কল্পনার প্রবাহ ক্রিয়াশীল থাকে। এর ফলে সে নিজের মধ্যে বহুকে আর বহুর মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়। কল্পনার সাহায্যেই বস্তু পৃথিবীর বাস্তব, উপলব্ধির সত্যে পরিণত হয়।
১০
অর্থাৎ, প্রবন্ধ রচনা করার ক্ষেত্রে প্রাবন্ধিকের ভেতরকার মননশীল চিন্তা, যুক্তিধর্মী মনন, তথ্যবহুলতা,  জ্ঞাননিষ্ঠতা এবং পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার ক্ষমতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যা তাঁর শাণিত প্রবণতাকে চিন্তাশীল আবেগঘন বেষ্টনী সৃষ্টি করে পাঠকের মনে। এতে পাঠক আনন্দ পেতে পেরে; মৃদু হাস্যরসে নতুন চিন্তা-চেতনায় আপ্লুত হতে পারে। যা শিল্পীমানসের বস্তুজগত নিয়া ভাবনার নিত্যনতুন এক অভিন্ন সত্ত্বা। যেখানে সে তাঁর প্রকাশভঙ্গির  মধ্য দিয়ে যেরূপ নতুন চিন্তা সৃষ্টি করে অন্যের মনন উদ্বেলিত করে প্রভাবিত করতে পারে; তা অন্য কোনো প্রাণী সাধন করতে পারে না। আর এই একটি কারণেই শিল্পী ‘ঐন্দ্রজালিক তথা স্রষ্টা।’১১ নিম্নে প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী'র রচিত প্রবন্ধের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো: 

ক. আমার এক তরুণ বন্ধু মনে হলো খুব রেগেছেন। রাগাটা স্বাভাবিক। অনুরাগ না-থাকলে রাগই স্বাভাবিক। দেশে তো অনুরাগের পাত্র পাওয়া ভার, রাগ তাই যেখানে সেখানে। অনেক রাগ ভালো লাগে দেখতে, সুন্দর লাগে, যদি অবশ্য নিজে পাত্র না হই রাগের। তবে তলাতে আমার সাধারণত ভয় করে। যদি উঠতে না পারি।১২
খ. অত্যন্ত ইহজাগতিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উদারহৃদয় মানুষও কি করে যে মৌলবাদী হয়ে পড়েন তাঁর একটি শিক্ষামূলক উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মানবতাবাদী এই ঔপন্যাসিক তাঁর অতিউজ্জ্বল সূচনা ও অসামান্য জীবনঘনিষ্ঠ বিকাশ সত্ত্বেও শেষ জীবনে পৌঁছে গিয়েছিলেন আধুনিক হিন্দু মহাসভার কাছাকাছি। বলার অপেক্ষা রাখে না বোধ করি যে, হিন্দু মহাসভা ও জামাতে ইসলামীর ভিতর আকাশ-পাতাল ব্যবধান মনে হলেও চরিত্রে তারা একই, মৌলবাদী তারা উভয়েই-সমানভাবে।১৩
গ. আমাদের সবচেয়ে সৃজনশীল এলাকা হচ্ছে কৃষি। সেখানে কর্মীর অভাব নেই। শত শত বছর ধরে বাংলার শ্রম দিচ্ছে, উৎপাদন করছে, মানুষের জন্য খাবার সরবরাহ করছে। এই কৃষক আবার মুক্তি আন্দোলনেও অংশ নিয়েছে। যেমন একাত্তরে।১৪

অর্থাৎ, প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর  প্রবন্ধে বিষয় নির্মাণে “মন্ময়-তন্ময়” উভয়ধর্মী ধারার প্রবন্ধই সন্নিবেশিত হয়েছেন। এতে প্রাবন্ধিক তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুর সাথে মতানৈক্য, সাহিত্যিকদের পরিবর্তনশীল আচরণ ও রাজনৈতিক দলের মৌলবাদীতা, কৃষি, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি সর্ম্পকে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রথমত, আমরা তাঁর প্রবন্ধ সৃষ্টির বিষয়বস্তুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তা হলো; ধর্ম-রাজনীতি-ইতিহাস-অর্থনীতি তাঁর প্রবন্ধের মূল উপজীব্য বিষয়বস্তু হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষত বাঙালি মুসলমানদের অধঃপতিত হবার কারণ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসন, আমলাতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ইতিবৃত্ত। লোকজ সমাজের নিরন্ন মানুষের জীবন সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ এবং নাগরিক সমাজে বসবাসকৃত ব্যক্তি মানুষের জীবনাচরণ ও অন্তর্বিরোধ তাঁর সমস্ত প্রবন্ধ রচনারই প্রধান বিষয় বিবেচ্য। শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, ব্যক্তি মানুষের স্বার্থান্ধতা, শোষণ-বঞ্চনা প্রভৃতি দেখে তিনি যে ক্ষুব্ধ থেকে বিক্ষুব্ধ  হোন; তা সমকালের সমস্ত পারিপার্শ্বিকতাকে শক্তভাবে ধারণ করে প্রাঞ্জল ও অর্থব্যক্তি বর্ণনাত্মক রীতিতে চিত্রায়ণে তিনি সিদ্ধহস্ত। উপরিউক্ত প্রবন্ধে সচক্ষু দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আরো প্রতীয়মান হবে  যে, তাঁর প্রবন্ধের ভাষা অন্যান্য প্রাবন্ধিকদের মতো গুরুগম্ভীর নয়। কঠিন সব তথ্য-তত্ত্ব টেনে আনেননি প্রবন্ধে। তিনি কঠিন বিষয়কে সহজ, সাবলীল ও মাধুর্যমণ্ডিত সহকারে গাল্পিক বুননে অধিক আগ্রহী। ভাষায় বাক্য গঠনে দীর্ঘ লাইনের ব্যবহার উপেক্ষা করেছেন। ছোট-ছোট বাক্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এতে করে পাঠক খুব সহজেই কি পড়ছেন; তা যেমন তাঁর চিন্তাকে নাড়া দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেই সাথে প্রাবন্ধিকের বক্তব্যের সাথে নিজের ভাবনা-চিন্তার একটা  যোগ-সাজুয্য তৈরি করতে পারছেন।


প্রবন্ধের শৈল্পিকগুণের বিষয়বস্তুর পরপরই প্রয়োজনীয় শিল্প উপাদান হল তার প্রকাশভঙ্গি। কোনো বিষয় পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য প্রকাশভঙ্গির কোনো বিকল্প নেই। কেননা প্রকাশভঙ্গিই লেখাকে চলমান ও গতিশীল রাখে। নির্মাণশৈলীই শিল্পীর অন্যতম শৈল্পিকসত্তা অর্থাৎ ‘প্রকাশভঙ্গিই প্রবন্ধের প্রাণস্বরূপ।’১৫ কারণবশত ‘কোনো গ্রন্থ বা শিল্প যখন বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে, তখন উত্তমরূপে বিচার করা হয়ে থাকে যে, সেই শিল্পের খ্যাতি উক্ত বিষয়বস্তুর জন্য না; রচনা-ভঙ্গির জন্য।’১৬ তাঁর এই রচনাভঙ্গির একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো প্রবন্ধের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নির্মাণে বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের মার্কসীয় দর্শনের যে ধারা আছে, তিনি সেই ধারার উত্তরাধিকারী কিন্তু আঙ্গিকগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই বৈসাদৃশ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সরাসরি মার্কসীয় দর্শন বা মতামত তিনি আলোচনায় টেনে আনেন না। বরঞ্চ মার্কসীয় দর্শনের উপর আস্থা রেখে অন্ধকারে টর্চ হাতে উপর থেকে আলো ফেলেন তিনি। নিম্নে উল্লিখিত বক্তব্য থেকে এ বিষয়টা  পরিষ্কার রূপে ধরা পড়ে আমাদের কাছে। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বলেন: 
ভয়। চতুর্দিক দিয়ে ভয় ঘিরে ধরছে মানুষকে। জীবিকার নয় কেবল, জীবনেরও। তরূণদের উচ্ছৃঙ্খলতা এই ভয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। অন্ধকারকে ধমক দিলে সে যাবে না, লাঠিপেটা করলেও লাঠিরই ক্ষতি। তাহলে কি দূর হবে অন্ধকার? জবাবটা সোজা। আলো জ্বেলে। শিক্ষার আলো তো সেই কতকাল ধরেই জ্বালাচ্ছি আমরা। কিন্তু অন্ধকার তো বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছে না। আসল শিক্ষা হচ্ছে রাজনৈতিক শিক্ষা। অন্ধকার দূর করতে হলে যথার্থ রাজনৈতিক শিক্ষা আবশ্যক। দক্ষিণের নয়, বামের। দক্ষিণের রাজনীতি অন্ধকারের মিত্র।
১৭
অর্থাৎ, তিনি এখানে সমাজে ও রাষ্ট্রে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার পাশাপাশি জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার কথা বলছেন। যে কথা কার্ল মার্কস তাঁর দর্শনে প্রলেতারিয়েত শ্রেণিকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার আহবান জানিয়ে ছিলেন। কারণ গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষ একদিকে যেমন সামাজিক জীব, সেই সাথে রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণী। আর এই রাজনৈতিক বিচারবোধ জাগ্রত না হলে মানুষ তাঁর নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সুষ্ঠু ও গঠনমূলক আলোচনা ব্যতীত রাষ্ট্র প্ররিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। উপরন্তু, রাষ্ট্রীয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে অবলা প্রাণীতে পরিণত হয়। আর এসব চিন্তাপ্রসূত কথা তিনি তাঁর প্রবন্ধে ব্যক্ত করতে গিয়ে দীর্ঘ বাক্য ব্যবহারের আশ্রয় নেননি। ব্যবহার করেননি জটিল তত্ত্ব কিংবা উদাহরণ। অত্যন্ত সাবলীলভাবে, সহজেই বোধগম্য হয় এমন শব্দের ব্যবহার করেছেন ভাষার পরতে পরতে। অর্থাৎ তাঁর ‘প্রবন্ধের ভাষা সরস, সুললিত ও অলংকৃত এবং রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি তাঁর প্রবন্ধগত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সহজ সহৃদয় সামাজিকের ন্যায় সাধারণ্যে এমন সুন্দরভাবে প্ররিবেশন করেছেন যে, তাঁর পূর্বসূরী  কোন প্রবন্ধকারের মধ্য দিয়া তা সার্থকরূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি।’১৮ সাহিত্য সমালোচক প্রমথ চৌধুরী প্রবন্ধের ভাষা নিয়ে লিখেছেন:
কেবলমাত্র পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা গেছে সংস্কৃত শব্দ বর্জন করলেই যে আমাদের  মোক্ষলাভ হবে, তা নয়। আমরা লেখায় স্বদেশী ভাষাকে যেরূপ্র বয়কট করে আসছি, সেই বয়কটও আমাদের ছাড়তে হবে। বহুসংখ্যক বাংলা শব্দকে ইতর বলে সাহিত্য হতে বহিষ্করণের  কোনোই বৈধ কারণ নেই।  মৌখিক ভাষার  কেবলমাত্র পড়ে পাওয়া চৌদ্দ-আনা গেছে, সংস্কৃত শব্দ বর্জন করলেই যে আমাদের মোক্ষলাভ হবে, তা নয়। আমরা  লেখায় সাধু এবং ইতর, উভয় প্রকারেরই শব্দ আছে।  যে শব্দ ইতর বলে আমরা মুখে আনতে সংকুচিত হই, তা আমরা কলমের মুখ দিয়েও বার করতে পারিনে। কিন্তু  সে সকল কথা আমরা ভদ্রসমাজে নিত্য ব্যবহার করি, যা কোনো হিসেবেই ইতর বলে গণ্য নয়, সেই সকল বাক্যকে সাহিত্য  থেকে বহির্ভূত করে রাখায় ক্ষতি শুধু সাহিত্যের। অন্যান্য জীবের মতো ভাষারও একটা আকৃতি ও একটা গঠন আছে।
১৯
উপরিউক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রবন্ধেও অলংকার, সুলিলত ভাব,ভাষার অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেই ক্ষেত্রে আমরা ভাষা ব্যবহারে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দৃঢ় সচেতনতা লক্ষ্য করি। তিনি বাক্যে সহজ, সরল, সাবলীল শব্দ চয়ন করেছেন। প্রচুর সংস্কৃত এবং ইংরেজি শব্দমিশ্রিত বাংলা বাক্য গঠনে বিরত থেকেছেন। মানুষের বোধগম্য মুখের শব্দ অর্থাৎ চলিত ভাষার ব্যবহারে তিনি দৃঢ় সচেতন। মানুষ বুজবে না, কিংবা পড়তে গেলে শব্দগত ঝামেলায় পড়বে এমন একটা আঙ্গিকগত চিন্তা তাঁর মধ্যে লক্ষণীয়। এক কথায় শুদ্ধ ও প্রচলিত বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সচেতন; কিন্তু তাই বলে বিদেশি তথা ইংরেজি,সংস্কৃত, আরবি,ফারসি ভাষার শব্দ একেবারে ব্যবহার করেননি ঠিক এমনটা নয়। সর্বদাই লক্ষ্য রেখেছেন, মানুষ বুজতে পারবে এমন সব শব্দের ব্যবহার বজায় থাকুক। উল্লেখ্য প্রমথ চৌধুরী [১৮৬৮-১৯৪৬] তাঁর সমসাময়িককালে দেখেছেন; অনেক সাহিত্য শিল্পীরাই বাংলা বর্ণে সংস্কৃত শব্দে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত নির্ভর মডেল দেওয়ার প্রবল চেষ্টা চালিয়েছিলেন। হালে এমনকি পাকিস্তানি শাসনামলেও [১৯৪৭-১৯৭২] পূর্ব বাংলায় আইয়ুব খান উর্দু-আরবি ফর্মে বাংলা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও প্রতিরোধের মুখে তিনি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হোন। কিন্তু দৃষ্টত, বিশ্বব্যাপী ভাষিক সাম্রাজ্যেবাদের কারণে বাংলাকে আজকাল ইংরেজি অনুকরণে, ইংরেজি ভাষার ফ্রেমে বেঁধে ফেলার আয়োজন চলছে। ভাষার যে একটা স্বাভাবিক গ্রহণ ও বর্জনের বৈশিষ্ট্য আছে তা ক্রমশ লুপ্ত করে দিয়ে; আমাদের  কি সাহিত্য, কি নাটক, কি সিনেমা, গল্প, উপন্যাস কিংবা প্রিন্ট- ইলেকট্রনিক মিডিয়া সর্বত্র এ আক্রমণ পরিলক্ষিত। বরঞ্চ বাংলা ভাষা গ্রহণ-বর্জনের স্বাভাবিক পথে সমৃদ্ধ না হয়ে  বিকৃত হচ্ছে। প্রাবন্ধিক  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেও ইংরেজি সাহিত্যের একজন সাবেক অধ্যাপক ও পণ্ডিতমন্য; একই সাথে শিক্ষাবিদ ও গবেষক। ফলে তিনি জানেন; মাতৃভাষা ছাড় পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষা অন্তরের ভাষা হতে পারে না। যতই বিদেশী ভাষা মানুষ শিখুক না কেনো; অন্তরকে, মননকে পরিশীলিত করতে, নিজেকে প্রাণবন্ত করে তুলতে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। আর  সেজন্যই  প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেই তাঁর প্রবন্ধে ভাষার ব্যবহারে ছিলেন নিরীক্ষাধর্মী। তিনি তাঁর প্রবন্ধে লিখেন: 
ভাষা সেতুর মতো, আবার সিঁড়ির মতোও। এই সেতু অন্য মানুষের কাছে নিয়ে যায় আমাকে, অন্য মানুষকে নিয়ে আসে কাছে। একটি নয়, অসংখ্য সেতু। আমি পূর্ব-পশ্চিমে যাই, যাই উত্তর-দক্ষিণে, অতীতে চলে যায়,  যেতে পারি ভবিষ্যতেও। কত অজানা মানুষ মিলে কত সাধনায় সৃষ্টি করে রেখে গেছেন আমার জন্য, উত্তরাধিকার  রেখে  গেছেন, যাকে আমি নিজের বলে দাবি করতে পারি, জ্ঞান ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আবার সিঁড়িও। আমাকে নিচে থেকে ওপরে নিয়ে যায়, এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে। শব্দগুলো নিরেট নয়, পাথর নয়, তারা পাখির মতো, উড়তে ভালোবাসে নতুন নতুন দিগন্তে, পাখাতে করে গন্ধ নিয়ে আসে আকাশের, খবর নিয়ে আসে দূর দূরান্তের।
২০ এই নিয়ে প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাক্ষাৎকারে আমাদের বলেছেন:

আমি লেখার সময় ভাবতাম যে, আমার  লেখা যদি মানুষ না-ই বুঝতে পারে, তাহলে তো এ লেখার কোন সার্থকতা নেই। আমাদের সময়ে অনেকেই লিখতেন বেশ পাণ্ডিত্য নিয়ে; আর অনেক কঠিন কঠিন সব শব্দ ব্যবহার করতেন, তখন তাঁদের লেখা পড়ে আমার কাছে মনে হতে লাগল মানুষের জন্য লেখা মানুষকে পড়তে হলে খুব শব্দগত ঝামেলায় পড়তে হবে; তাই আমি প্রথম থেকেই এ বিষয়ে খুব সচেতন ছিলাম এবং  চেষ্টা করেছি প্রাণান্তর করার জন্য। তুমি [গবেষক] যদি আমার পাণ্ডুলিপি দেখো তাহলে বুঝবে কতবার যে শব্দ, লাইন কাটাকাটি করেছি। আমার কাছে কোনো কিছু লেখা মানেই হলো; আমি যা বলতে চাই তা যেন, কেউ পড়া মাত্র বুঝতে পারে।২১

অর্থাৎ, প্রাবন্ধিকের ভাষ্যনুযায়ী, প্রবন্ধে  ভাষা ব্যবহারে সর্বদা তিনি অত্যন্ত সচেতন থেকেছেন। লেখক হিসেবে তিনি জানতেন, মনোভাব যথাযথভাবে উপস্থাপনের মধ্যেই রয়েছে তাঁর  শৈল্পিক মনের সার্থকতা। ভাষার স্বচ্ছতা,পরিচ্ছন্ন, অর্থব্যক্তি ও প্রাঞ্জলতা যতবেশি হবে, ভাষা তবেই তা পাঠকের কাছে সহজবোধ্য হবে। লেখক কি বলতে চাচ্ছেন এবং কতটুকু সহজবোধ্য করে তুলে ধরতে পেরেছেন সেটাই যথার্থ রচনা।  সেক্ষেত্রে ‘ভাষার প্রথম গুণ-স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা। এই গুণ স্টাইলের মূল ভিত্তি ভূমি। অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা, ধোঁয়াটে ভাব বর্জন করাই ভাষার সাধনা।’২২ আর যিনি যথার্থ শিল্পী তিনি এ সাধনা করেন। কেবলমাত্র সাধনাই  শ্রেয় নয়, সেজন্য দরকার শিল্পী মনের স্বচ্ছ চিন্তা-চেতনার প্ররিপূর্ণ বিকাশ। এক্ষেত্রে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্য রচনার ভাষা যেমন স্বচ্ছ, তেমনি উপমা, প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা সন্নিবেশিত সহজ-সরল শব্দ রচনার মিশেল। নিমোক্ত উদ্ধৃতি সহযোগে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে উনিশ ও বিশশতকের প্রারম্ভের প্রবন্ধ রচনায় প্রাবন্ধিকদের ব্যবহৃত বাংলা ভাষার সাথে প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষাগত পার্থক্য ও প্রয়োগ কৌশল নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধে ব্যবহৃত ভাষা নিম্নরূপ:

রাজার এইরূপ নিরপেক্ষ ও সদ্বিবেচনাপূর্ণ বচন প্রপঞ্চ। শ্রবণগোচর করিয়া অমাত্যগণ চমৎকৃত হইয়া কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! আপনি যে অত্যুচবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, আপনার এ উক্তি তদুপ্রযুক্তই বটে। নির্ধারিত দিবস উপস্থিত হইল। যথাযোগ্যস্থানে উপবেশন করিলেন। প্রথম সমাগমোচিত শিষ্টাচার পরম্পরা পরিসমাপ্ত হইলে, সকলে উৎসুক চিত্তে দশরথের মুখ নিরীক্ষণ করিয়া রহিলেন।২৩

প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ভাষা নিম্নরূপ:

মনুষ্যে মনুষ্যে সমানাধিকার বিশিষ্ট। স্ত্রীগণও মনুষ্যজাতি, অতএব স্ত্রীগণও পুরুষের তুল্য অধিকারীশালিনী। যে যে কার্য্যে পুরুষের অধিকার আছে, স্ত্রীগণেরও সেই কার্য্যে অধিকার থাকা ন্যায়সঙ্গত। স্ত্রীগণ সকল দেশেই পুরুষের দাসী। যে দেশ স্ত্রীগণকে পিঞ্জারাবদ্ধ করিয়া না রাখে, সে দেশেও স্ত্রীগণকে পুরুষের উপর নির্ভর করিতে হয়, এবং সব্বপ্রকারে আজ্ঞানুবর্ত্তী হইয়া মন যোগাইয়া থাকিতে হয়। এই প্রথা সর্ব্বদেশে এবং সর্ব্বকালে চিরপ্রচলিত থাকিলেও এক্ষণে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে এক সম্প্রদায় সমাজতত্ত্ববিদ ইহার বিরোধী। তাঁহারা সাম্যবাদী।২৪

প্রাবন্ধিক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রবন্ধের ভাষা নিম্নরূপ:

কালের কুটিল চক্রে শিক্ষা আজকাল বিজ্ঞানশিক্ষা, সাহিত্যশিক্ষা, ধর্ম্মশিক্ষা, নীতিশিক্ষা, ইতিহাসশিক্ষা, হাতে কলমে শিক্ষা বা টেকনিক্যাল শিক্ষা ইত্যাদি নানা উপাধিতে অলঙ্কৃত হইয়া সহস্র শ্রেণিতে বিভক্ত হইয়াছে; এবং কোন শিক্ষা ভাল আর কোন শিক্ষা মন্দ এই তর্কের কোলাহলে দিগন্ত প্রতিধ্বনিত হইতেছে।২৫

প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষা নিম্নরূপ: 

যুদ্ধের দিনগুলোতে মেয়েরাই ছিল সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে। তাদের দুর্ভোগই ছিল সর্বাধিক। একে তারা বাঙালি, তদুপরি নারী। পুরুষদের অনেকে পালিয়ে যেতে পেরেছে। প্রাণভয়ে তারা মেয়েদেরকে ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। যারা যুদ্ধ গেছে তাদের বাড়ির মেয়েরা বিপদে পড়েছে। কারণ  মেয়েদের পক্ষে পলায়ন ছিল দুঃসাধ্য। দেহের গঠন, জামাকাপড় ও নারীত্ব সবই ছিল তাদের বিপক্ষে।২৬

প্রথমত, উপরিউক্ত প্রাবন্ধিকদের ব্যবহৃত বাংলা ভাষা অত্যন্ত অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট। কোনো  কোনো  ক্ষেত্রে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ, সমাস সাধিত শব্দ, ক্রিয়া পদের দীর্ঘ ব্যবহার অনুসৃত হয়েছে। আর তা হবারই কথা। কারণ, বাংলা ভাষার প্রারম্ভিক বিকাশের  দিকে এই  প্রাবন্ধিকগণ বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছেন। সামাজিক বিন্যাস ও উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে ভাষাও পরিবর্তনশীল। সেক্ষেত্রে উনিশ শতকে ব্যবহৃত বাংলা ভাষা বিশশতকে এসে পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষণীয় যে, উল্লেখিত প্রাবন্ধিকগণ প্রবন্ধে অগাধ ভাষাগত পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও  সহজ ও  বোধগম্য শব্দ পরিহার করে গেছেন। পক্ষান্তরে  প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পূর্ণরূপে  বৈপরীত্য। তিনি একজন পাণ্ডিত্যজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও প্রবন্ধে বাংলা ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন-মনস্কে স্বচ্ছ, স্পষ্ট, সাবলীল ও অর্থব্যক্তিসম্পন্ন সদ-গুণাগুণ বজায় রেখে চলেছেন। সমাসবদ্ধ, সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার যথাসম্ভব এড়িয়ে, ছোট-ছোট বাক্য গঠনের জন্য ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্ত ব্যবহার করেছেন অবলীলাক্রমে। এখন নিম্নে প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে বিশশতক ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর সমসাময়িক কালের প্রাবন্ধিক যথা—বদরুদ্দীন উমর [১৯৩১—], আবুল ফজল [১৯০৩-১৯৮৩], আহমদ শরীফ [১৯২১-১৯৯৯], আহমদ ছফা [১৯৪৩-২০০১], হুমায়ুন আজাদ [১৯৪৭-২০০৪], আনিসুজ্জামান [১৯৩৭-২০২০], যতীন সরকার [১৯৩৬-], আবুল কাশেম ফজলুল হক [১৯৪০—], অজয় রায় [১৯৩৫-২০১৯], রণেশ দাশগুপ্ত [১৯১২-১৯৯৭], সরদার ফজলুল করিম [১৯২৫-২০১৪], হাসান হাফিজুর রহমান [১৯৩২-১৯৮৩], হায়দার আকবর খান রনো [১৯৪২] প্রভৃতি প্রাবন্ধিকদের একটা তুলনামূলক ভাষাগত আলোচনা তুলে ধরা হলো: 
প্রাবন্ধিক আবুল ফজলের প্রবন্ধের ভাষা নিম্নরূপ: 

ঊনবিংশ শতাব্দির  শেষে ও বিংশ শতাব্দির সূচনায় জাতীয়তা ও জীবনের মূল্যবোধের তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের মানবতাবোধ বাংলাদেশের ভাবজীবনে এক প্রবল আলোড়নের সঞ্চার হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের  রেনেসাঁসের অপূর্ব ভাব-সাধনার ইতিহাস ও তার সঙ্গে পরিচয় এই আলোড়ন দিয়েছিল প্রবল প্রেরণা। কাব্যের ক্ষেত্রে এই প্রেরণার প্রথম মানসপুত্র মধুসূদন এবং তার পরিণত রূপ রবীন্দ্রনাথ। সদ্য জাগ্রত ও সবেমাত্র আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষায় কিছুটা ছোঁয়া যে লাগেনি তা নয়।২৭

প্রাবন্ধিক আহমদ ছফার প্রবন্ধের ভাষা :

সকলে মনে করেছিলেন এ জাতির আত্মপ্ররিচয়ের সংকট মোচন হয়ে গেল। ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর বদলে একটা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত নির্মাণ করার মত বস্তুগত ভিত্তি, গণভিত্তি এবং দার্শনিক ভিত্তি এই প্রচণ্ড সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তৈরি করতে পেরেছে। আসলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল ভারত উপমহাদেশ, মুসলিম বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ।২৮

প্রাবন্ধিক যতীন সরকার রচিত প্রবন্ধের ভাষা ও বাক্য গঠন নিম্নরূপ:

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দলিলপত্রেও ভূসম্পত্তির উপর ব্যক্তি অধিকারের চেয়ে সামূহিক অধিকারের সাক্ষ্যই বেশি করে মেলে। লোকসমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে তো সামূহিক চেতনাই মূল, সমাজ-বিচ্ছিন্ন  দ্বৈপায়ন-প্রতিম ব্যক্তির স্থানে সেখানে নেই। আদিম সাম্যবাদী সমাজে সম্পদ বলতে তো সামাজিক সম্পদই বুঝাত; আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থার ভাঙনের মধ্য দিয়ে শ্রেণিবিভক্তির উদ্ভবের পরও অধিকার বঞ্চিত লোকসমাজের চৈতন্য দৃঢ়ভাবে সমাজ সম্পৃক্তই থেকে যায়। অবিরাম শ্রেণি-সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় একের পর এক যেসব শোষণমূলক সমাজ বিধানের উদ্ভব ঘটে।২৯

প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফের প্রবন্ধ রচনার ভাষা নিম্নরূপ:

এ যুগের মানুষের মধ্যে সমাজ সদস্য হিসেবে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কিংবা বৈশ্বিক-আন্তর্জাতিক; বঞ্চিত গুণের-মানের-মাপের-মাত্রার ব্যক্তি হিসেবে ন্যূনতম মাত্রার-মাপের-মানের বিজ্ঞানমনস্কতা প্রযুক্তি গুরুত্ব ও প্রভাব চেতনা আর যুক্তিনিষ্ঠ বৌদ্ধিক জীবনচর্যা প্রত্যাশিত। এই দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার স্বস্তিতে, শান্তিতে, নিরুপদ্রবে নিরাপদে জীবনযাপনের গরজবোধের অনুভব-উপলব্ধি বিকাশের দরুণ।৩০ 

প্রাবন্ধিক বদরুদ্দীন উমরের প্রবন্ধের ভাষা নিম্নরূপ:

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণি নিজেদের অর্থনৈতিক জীবন সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণির সঙ্গে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও দল এটা করে থাকে। যারা উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত থাকে, যেমন ১৯৪৭ সালে ছিল ভারতের শাসকশ্রেণী, তারা প্রধানতঃ উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এটা করলেও তার সঙ্গে থাকে নানা ধরনের দুর্নীতি। কিন্তু উৎপাদনের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক থাকে না; তারা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা ফেরানো বা ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য আশ্রয় নেয় লুণ্ঠন, চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা ও সন্ত্রাসের।৩১

উপরিউক্ত বিশশতকের প্রাবন্ধিকদের সাথে প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনার বিষয়বস্তু, ভাব ও ভাবগত ঐতিহ্যসূত্রে ঐক্য থাকলেও তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, বাক্য গঠন ও নির্মাণ প্রকৌশলে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যতা দৃষ্টিগোচর হয় আমাদের সন্নিকটে। যেমন প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষারূপ—

সত্তর শতাংশ গরীব মানুষই পৃথিবীকে নষ্ট করেছে। তারা পরিবেশকে ক্রমাগত দূষিত করে তুলেছে। একথা বলা হবে। নোংরারাই নোংরা করে, বলবে না একথা যে, পরিবেশের আসল শত্রু গরীব মানুষ নয়, শত্রু হচ্ছে ধনীরা। ধনীরাই তেল পোড়ায়, প্রকৃতিকে পণ্যে পরিণত করে, পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়, নানা রকমের  বোমা উদ্ভাবন করে এবং তা নিক্ষেপ করে, যুদ্ধ তারাই বাঁধায়। পুঁজিবাদের লালসার শেষ নেই। সে মুনাফা চায়। সে ভোগবাদিতাকে উগ্র করে তোলে। তার মুনাফার কুঠারে অরণ্য সাবাড় হয়, এবং মানুষকে সে ঠেলে দেয় আরণ্যক অন্ধকারে-হানাহানি ও সংঘর্ষে। মৈত্রী আসে না।  পুঁজিবাদীরা পৃথিবী জুড়ে আজ মৌলবাদকে উস্কানি দিচ্ছে, বিশেষ করে গরীব দেশগুলোতে। এতে তাদের দুটো লাভ। এবং যদি আধুনিক বুর্জোয়ারা দেশ চালাতে না পারে, তবে মৌলবাদীরা তাদের জায়গায় আসতে পারবে। বুর্জোয়ার বিকল্প সামন্তবাদীরা নয়, বিকল্প মৌলবাদীরা।৩২

অর্থাৎ, উক্ত তুলনামূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষাগত কিছু স্বাতন্ত্র্যতা ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। আর তা হলো: প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষার সরল ও প্রাঞ্জলতা এবং দুর্বোধ্য শব্দের ব্যবহার বর্জন। অর্থাৎ উপরোক্ত প্রাবন্ধিকদের ভাষায় ব্যবহৃত বাক্যাংশে বেশ দীর্ঘ ও জটিল শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। যদিও কখনো কখনো তাঁরা ছোট বাক্য ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁদের রচনার মধ্যের ভাবব্যঞ্জনা ঘোলাটে ও তিরিক্ষি স্বভাবের। বরঞ্চ রসাত্মক, অনুভূতি ও আবেগহীন তথ্যপূর্ণ বাগম্বড় অসাঢ়তায় প্রবন্ধগুলো পাঠকের মধ্যে একটা আলাদা অনুসন্ধান, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা-জিজ্ঞাসু আবহ তৈরি করতে সক্ষম না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধৈর্য হানি ঘটবে, বিরক্তিবোধ হবেন এমনটা অকল্পনীয় নয়। প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক্ষেত্রে অনেকটা স্বকীয় ও স্বাতন্ত্র্য। ভাষারীতি নির্মাণে তিনি স্বতন্ত্র স্টাইল ব্যবহার করেছেন। বাক্যকে নিজের মতো করে ভেঙ্গেছেন; সেই সাথে গদ্যে ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। যেমনটা ‘বিষয় অনুসারেই ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। যে রচনা সকলেই বুঝতে পারে এবং পড়ামাত্র যার অর্থ বুঝা যায়, অর্থগৌরব থাকলে তাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা।’৩৩ প্রবন্ধের ভাষার কারুকার্য ও বাক্য গঠনে তিনি যথেষ্ট সচেতনতার মধ্য দিয়ে রসাত্মক, চিত্তাকর্ষণ ও সাবলীল ভঙ্গিতে মাঝারি, সংক্ষিপ্ত বাক্য গঠন করেছেন। প্রয়োজন ব্যতীত তিনি সকল ধরনের দীর্ঘ লাইন ব্যবহারে বিরত থেকেছেন। তাঁর প্রবন্ধের ভাষায় কোনো কৃত্রিমতা, অস্বচ্ছতা, তৎসম ও সমাসবহুল শব্দের ব্যবহার নেই। চলিত ভাষায় তিনি শ্লেষ পরিহারেও দৃষ্টিচক্ষু নিবদ্ধ রেখেছেন। বরং বাক্য গঠনে তিনি সংক্ষিপ্ত অর্থবোধক বাক্য রচনা করেছেন। এবং প্রবন্ধের ভাষায় যতি বা বিরাম চিহ্নের ব্যবহার খুব বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। আর এর ফলেই তিনি বড়বড় বাক্যকে ভেঙে যথাসম্ভব সুখপাঠ্য, সহজ-সরল বাক্যে রূপান্তর করতে পেরেছেন। 
পরিশেষে বলতে চাই, শিল্পকর্মের ভেতরে প্রাবন্ধিকের নিরপেক্ষতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা রক্ষা করা অতীব প্রয়োজন। চিন্তার ক্ষেত্রে সাহিত্যিকের মন কখনো বিশেষ করে মহৎ সৃষ্টির বেলায় পক্ষপাতিত্ব করে না। তবে আমাদের ‘সাহিত্যিক দৃশ্যের প্রীড়াদায়ক ব্যাপারটি হলো যে, এর বিশাল অংশ জুড়ে আছে নীরসতা, উষরতা ও তার বন্ধ্যাত্বের প্রাণহীনতা, শূন্যতা ও নিষ্ফলতা। আমাদের সাহিত্যে সাধারণভাবে নিরপেক্ষভাবে সৌন্দর্যবোধ, সার্বজনীন উচ্চভাব, অতলান্ত সংবেদনশীলতা, সুতীব্র বেদনাবোধ ও সর্বজয়ী আবেদনের পরিচয় পাওয়া যায় না।’
৩৪ যেটুকু পাওয়া যায় তা সীমার মাঝে অসীমের চিৎকার। যার কারণে আমাদের শিল্প-সাহিত্য বোদ্ধারা সজীব হয়েও নির্জীব। প্রাবন্ধিকদের বর্ণনা ও উদ্বৃতিসমূহ তুলনামূলক পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধে তাঁর ভাষাশৈলীর বড় একটি সাফল্য নিহিত আছে গদ্যের গতিশীলতায়। তিনি গল্পের ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করেছেন। গল্পের ভেতর পাঠক যেমন কখনো মোহিত, ভাবোবেগ আপ্লুত কিংবা আকর্ষিত হয়; তাঁর প্রবন্ধও সেরকম। গাল্পিক প্রবণতা তাঁর প্রবন্ধের ভাষাকে করেছে গতিশীল। ‘শিল্পে প্রকৃতির মতো বৃত্ত, ছবি দেখা আর ছবি আঁকা তাঁর স্বভাব। চলমান জীবনমানের দ্বারপ্রান্তে ছুটে চলা জগৎকে তিনি তাঁর নির্বিকার মন দিয়ে দেখেন’৩৫ আর সেসব বিষয়সমূহকে তিনি গাল্পিক আবরণে এঁকে দিয়েছেন প্রবন্ধে। তাইতো ‘শূন্যতার বিরুদ্ধে ফর্মের লড়াই যাই হোক, মেঝে-দেওয়ালের শূন্যতা ভরাট করেই হোক কিংবা শুকনো কাঠামোর অন্তর্হিত শূন্যতাই হোক।’৩৬ সেখানে তিনি গাল্পিকধর্মী নাটকীয় কাব্য গুণসমৃদ্ধ এক নতুন রচনীনীতি সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন।  বাক্যসংযম অসাঢ়তায় তাঁর প্রবন্ধের ভাববৈদ্ব্যকে প্রাণ-প্রাচুর্য বুননে উদ্ভাসিত করেছেন। প্রায়ই তিনি ‘প্রসঙ্গ ধরে অতীথ স্মৃতিতে চলে যান, তাতে গল্পের পুরনো অংশটা বলা হয়ে যায়। কখনো এবং প্রায়ই বিবরণে বিস্তৃত হয়ে ওঠেন। তবে তাঁর ধরনটা এই বিবরণ বা ‘ন্যারেশন’, ঘটনা বা ‘অ্যাকশন’, বর্ণনা বা ‘ডেসক্রিপসন’ এবং সংলাপ বা ‘ডায়ালগ' এই কয়টি উপাদানে বিন্যস্ত। যেখানে গাল্পিকতা যথেষ্ট থাকে। কিন্তু তাঁর রচনারীতি মূলতঃ পরিচিতি এবং সরল ধরনের।’৩৭ এই সরলরৈখিক ব্যক্তি জীবনের গভীর জীবনবোধ, অন্তর্লোকের মর্মবেদনা, রহস্য, সংস্কারমুক্ত মনের ভাবনাই প্রবন্ধের ভাষাতে উপমা, রুপক, অলংকার, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি ব্যবহারে স্পষ্ট মৌলিকত্ব এবং রূপকল্পে অপ্রতিরোধ্য বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয়ের পাশাপাশি যথেষ্ট অলংকারসমৃদ্ধ তাঁর ‘ভাষার শৃঙ্খলাবোধ বাষ্পের অন্তর্নিহিত অবস্থিত; সেখানে উপস্থাপিত বক্তব্য ও ভাবভঙ্গিমা ছন্দ ও স্বাদুতায় পাঠকের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারে আছে সৌজন্যতা, আসক্তি, হাস্যরসবোধ।’৩৮ সর্বোপরি, তিনি  প্রবন্ধে যে গল্প বুনেন একবারে গদ্যের সাথে পদ্যের ভাব রস মিশিয়ে। তাঁর গাল্পিক ধাঁচের প্রবন্ধে গদ্যের গুণ যেন চিত্তাকর্ষক ‘কবিতারই গুণে’৩৯ পাঠককে বিমোহিত করার তীব্র আকর্ষণ। যেখানে তাঁর সময়ের অন্যান্য প্রাবন্ধিকরা এই বিষয়টি প্রবন্ধ রচনায় তুলে আনতে দৃঢ়সম্পন সচেতন ছিলেন না। আর এখানেই আধুনিক বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষা ও নির্মাণ-প্রকৌশলে তাঁর স্বার্থকতা।

তথ্যসূত্র 

১. বদিউর রহমান, সাহিত্য স্বরূপ, গতিধারা, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ১৮৩
২. অধীর দে, আধুনিক বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের ধারা, ২য় খণ্ড, উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১০
৩. উদ্ধৃত, ইমদাদুল হক মামুন, প্রবন্ধ সাহিত্য : একটি নবমূল্যায়ন, চিত্রা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ৩১-৩২
৪. হীরেন চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্য-প্রকরণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৪০৬, পৃ ২০৭
৫. মোহাম্মদ হারুন -উর-রশীদ, শব্দের শিল্পরূপ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৫
৬. হীরেন চট্টোপাধ্যায়,পূর্বোক্ত, পৃ.২০৬ 
৭. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, মডার্ণ বুক এজেন্সী, কলকাতা, ১৩৭৮, পৃ. ৫৭০
৮. হীরেন চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ.২০৬-২০৭
৯. অধীর  দে, আধুনিক বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের ধারা, ২য় খণ্ড,  পূর্বোক্ত, পৃ.১৪
১০. শ্যামশ্রী বিশ্বাস সেনগুপ্ত, রবীন্দ্র নন্দনতত্ত্বের সাহিত্যের পথে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১১, পৃ ১৩-১৪
১১. সন্তোষ গুপ্ত, শিল্পের কথা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১১৪
১২. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃ. ৮৬
১৩. তদেব, পৃ. ১২২-১২৩
১৪. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পুঁজিবাদের দুঃশাসন, রোদেলা, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ১৬৫
১৫. বদিউর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ.১৯১
১৬. মোহিতলাল মজুমদার [সম্পা.], বিদেশী প্রবন্ধ সঞ্চায়ন, কমলা বুক ডিপো, কলকাতা, ১৩৫৯, পৃ. ১৮০
১৭. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রবন্ধ সমগ্র ৪, বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ৫৪-৫৮
১৮. অধীর দে, পূর্বোক্ত, পৃ.১৫
১৯. প্রমথ চৌধুরী, প্রবন্ধ সংগ্রহ, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, ১৯৫২, পৃ. ২৬৪-২৬৬
২০. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রবন্ধ সমগ্র ৫, বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১০, পৃ. ১৪১-১৪২
২১. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে গবেষকের  সাক্ষাৎকার, দোসরা জানুয়ারি, ২০২২, সময়: ১১-২.০০, টিএসসি, ঢাকা 
২২. অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়, বাংলা গদ্যরীতির ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৬৭, পৃ. ১৪
২৩. প্রমথনাথ বিশী [সম্পা.], বিদ্যাসাগর রচনাসম্ভার, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা, ১৩৬৪, পৃ. ২৪৪-২৪৫
২৪. যোগেশচন্দ্র বাগল [সম্পা.], বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৬৯, পৃ. ৩৯৯
২৫. বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য [সম্পা.], রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র, গ্রন্থমেলা, কলকাতা, ১৩৮২, পৃ. ৩৫৫
২৬. সিরাজুল ইসলাম  চৌধুরী, উত্তরাধিকারের অনিবার্য প্রশ্ন, অবসর, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১৯৯
২৭. মাহবুবুল হক [সম্পা.], শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ : আবুল ফজল, কথা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ১৩৪-১৩৫
২৮. নূরুল আনোয়ার [সম্পা.], আহমদ ছফা রচনাবলি, উত্তর খণ্ড, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১৩৫
২৯. যতীন সরকার, বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৯, পৃ. ১২৬-১২৭
৩০. আহমদ শরীফ, বিশ্বাসবাদ-বিজ্ঞানবাদ-যুক্তিবাদ-মৌলবাদ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ১০০
৩১. বদরুদ্দীন উমর, বাঙলাদেশে ইতিহাস চর্চা, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬, পৃ. ১৬
৩২. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রচনা সমগ্র ৫, বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১০, পৃ. ২৮৭
৩৩. নাড়ুগোপাল  দে, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ : বিষয় ও আঙ্গিক, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ১৭৫
৩৪. মুজীবুর রহমান খাঁ, সাহিত্যের সীমানা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৬৭, পৃ. ৩৫-৩৬
৩৫. শীতল  চৌধুরী, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পে শিল্প ও নির্মাণ, প্রতিভাস, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ১৫
৩৬. নন্দীতা পাল, অরুণ মিত্র সৃজন ও স্বাতন্ত্র্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৯, পৃ. ১৭৪
৩৭. সফিকুন্নবী সামাদী, তারাশঙ্করের ছোটগল্প : জীবনের শিল্পিত সত্য, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ১৮৬
৩৮. বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ সংকলন, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩৮৯, পৃ. ২৫ 
৩৯. তদেব, পৃ.২১