যেভাবে লেখা আবুল হাসানকে নিয়ে ডক্যু-ফিকশন
আবুল হাসানের জীবনভিত্তিক ডকুফিকশন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখার জন্য সব পথে যেতে পারিনি, কিছু পথে হেঁটেছি; আর দেখা পেয়েছি কতিপয় পথিকের। বিস্তর ভূমিকা না করে সরাসরি সেই পথ ও পথিকদের কথাই বলা যাক।
প্রথম পৃষ্ঠার মানুষটি
কবি ইকবাল হাসান [১৯৫২-২০২৩] ঝিনুক নীরবে সহো’র প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম চরিত্র। লিখতে শুরু করে প্রথম ইন্টারভিউটাও তাঁকেই করেছিলাম। অনেক ডকুমেন্টস দিয়েছেন। অনেক কথা বলেছেন। ভুল শুধরে দিয়েছেন।
২০১০-এর বইমেলায় তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। তিনি মারুফ রায়হানের সাথে নিজের বই নিয়ে [যুগলবন্দি–ইকবাল হাসানের কবিতা ও সৈয়দ ইকবালের চিত্রকর্ম] ক্যামেরার সামনে কথা বললেন। তারপর আমিও কথা বললাম আমার কবিতার বই মেঘপুরাণ নিয়ে।
আবুল হাসানের মৃত্যু শয্যায় তিনি পাশে ছিলেন। কখনো রাতে থাকতেন, কখনো গোসল করিয়ে দিতেন, অক্সিজেনের নল ঠিক আছে কিনা দেখতেন কিংবা কর্পূরের কৌটাটা এগিয়ে দিতেন। হাসানের মৃত্যুর পর তিনি শাহাদত চৌধুরীর নির্দেশে বিচিত্রার প্রচ্ছদ কাহিনি লিখেছিলেন; লেখাটির শিরোনাম ‘কপাটবিহীন ঘর’, তাঁর অনুবাদে ‘A Room Without Door’. একই সংখ্যায় ‘একজন কবির অসুস্থতায়’ শিরোনামে হাসানকে নিয়ে তিনি একটি কবিতাও লিখেছিলেন; আরো কবিতা ছিল শামসুর রাহমান আর আমজাদ হোসেনের। আমাকে ইকবাল ভাই সেই বিচিত্রার বেশ কিছু পাতার ছবি পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাঁর ‘কিছু কথা কথার ভিতরে’ বইতে এই লেখাটি আছে।
আবুল হাসানের মৃত্যুর আগের রাতে ডিউটি করে খুব ভোরে তিনি সুরাইয়া খানমকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারপর নিজের বোনের বাসা বাসাবোতে গিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তিন রাত অনিদ্র আবুল হাসানের মুখটা পীড়া দিচ্ছিল। না ঘুমিয়েই ইকবাল হাসান একটি কবিতা লিখে ফেলেন। সেই কবিতা নিয়ে বিচিত্রায় শাহাদত চৌধুরীর কাছে আসেন। শাহাদত চৌধুরী ততক্ষণে হাসানের মৃত্যু সংবাদ জেনে গেছেন কিন্তু ইকবাল হাসান জানেন না। ইকবাল হাসানকে ধাতস্থ হতে দিয়ে শাহাদত চৌধুরী তাঁকে কবির মৃত্যু সংবাদটি দিয়েছিলেন।
২৬ শে জুলাই ২০২০-এ আমি ‘ঝিনুকে’র প্রথম পর্বটি লিখে তাঁকে পাঠাই। তিনি বললেন, ‘তোমার লেখাটি ভালো হয়েছে, বেশ ভালো। বিচিত্রার কভারের ছবিসহ ফেসবুকে দিও; আমি শেয়ার করব।’ আরও বললেন, ‘কবি হাফিজুর রহমান আবুল হাসানের শেষ সময়ের সঙ্গী ছিলেন। ও সর্বক্ষণ পিজিতে থাকত। ওর ভূমিকাটা রেখো।’ আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, হাফিজই আবুল হাসানের বোন বুড়িকে বিয়ে করেছিল।’ পরে হাফিজ ভাইয়ের সাথে কথা হয়। তিনি বললেন, তাঁদের বিয়েতে অনুঘটক ছিলেন শহীদ কাদরী। আবুল হাসানের জীবনীতে পিজি হাসপাতালের অন্যতম সেবক হিসেবে কাজী সালাহউদ্দিনের উল্লেখ ছিল। তিনি ফুটবলার সালাউদ্দিন কীনা জানতে চাইলে ইকবাল ভাই প্রথমে ‘হ্যাঁ’ বলেন। আমি তখন ফুটবলার সালাউদ্দিনের ডাকনাম তূর্য ব্যবহার করে একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলাম। পরে খসড়া লেখা দেখে তিনি সেই ভুল শুধরে দেন। বললেন, কাজী সালাহউদ্দিন একজন কবি।
পরে ২০২১-এর ডিসেম্বর মাসেও ইকবাল হাসান ভাইয়ের সাথে কথা হয়। ডিসেম্বরের জাতক। ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালেও ঢাকায় ছিলেন। মেসেঞ্জারে কথা হয়েছে। জানতে চেয়েছিলেন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ কোথায় পাওয়া যাবে? আমি জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে পর্যাপ্ত কপি ছিল না বলে পাঠাতে পারিনি। এর পরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমিও তাঁকে দেখতে যাবার মতো সুস্থ হয়ে উঠিনি তখনও। শেষ কথা হয়েছিল মে মাসে। এখন বড় আক্ষেপ হয়।
সুরাইয়া খানমের প্রতিমা গড়া
‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লিখতে গিয়ে দুটি উপন্যাসেরও সহায়তা নিয়েছি। আহমদ ছফা ও দিলারা হাশেম–আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দুজন ঔপন্যাসিক। আমার কাছে আহমদ ছফার কথাসাহিত্যিক পরিচয়টাই প্রধান। আমি সুরাইয়া খানমের চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করে দেখাতে চেয়েছিলাম। এই বই দুটি আমাকে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি কামরুন জিনিয়ার পাঠানো মুক্তিযুদ্ধকালীন লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহের জন্য মাঠে নামা সুরাইয়া খানমের ছবি আর আসাদ আলম সিয়ামের পাঠানো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে বৃটিশ এমপির চিঠিতে তাঁর উল্লেখও আমার কাজের পক্ষে এসেছে। পরবর্তীতে পেয়েছি লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলনের ছবিতে সুরাইয়া খানমের উপস্থিতির ছবি।
ক. আহমদ ছফার উপন্যাস অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী
আহমদ ছফার উপন্যাসটি সত্য ঘটনাশ্রিত ছিল বলেই হয়ত তিনি চরিত্রগুলোর সামাজিক অবস্থান ও পারিবারিক জীবনের কথা ভেবে প্রধান চরিত্রগুলোর নাম বদলে দিয়েছিলেন। আর সময়ের ব্যবধানে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে এসে, আমি নামগুলো আসল নামগুলোর সাথে প্রতিস্থাপন করে নিয়েছিলাম। এক ধরনের ভয় যে ছিল না তা নয়, কিন্তু আমার লেখাটিকে পূর্ণাংগতা দেয়ার জন্য এই কাজটা জরুরী ছিল। আমি ছফা বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত হাননানের সাথে কথা বললাম। ছফার বাচনভঙ্গী কেমন ছিল সেটা খুঁজলাম সাখাওয়াত টিপুর কাছ থেকে। ছফার সংলাপ নিলাম টিপুর সম্পাদিত ছফার ইন্টারভিউয়ের বই বাছাই জবাব থেকে। ছফামৃত পড়লাম, ছফার স্মৃতিকথা, ছোট গল্প, ডায়েরি আর কিছু প্রবন্ধও পড়লাম।
ছফা, সুরাইয়া ও হাসানের পরিষ্কার অবয়ব এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। এখানে ছফা স্পষ্টবাদী, প্রেমিক হিসেবে আবেগাক্রান্ত আর কাজের স্পৃহায় বা পরোপকারের নেশায় ছুটোছুটি করেন, রাজনীতি ও সাহিত্য অন্ত প্রাণ; হাসান এখানে আত্মমগ্ন, উদাসীন, কখনো রূঢ় কিন্তু মায়াকাড়া যুবক; সুরাইয়ার পাণ্ডিত্য আছে, রূপ আছে, আবেগ আছে, অভিনয় দক্ষতা আছে, আর আছে মতিচ্ছন্নতা। আবুল হাসান দরিদ্র হলেও শৌখিন, শাদা সার্ট পছন্দ; অন্যদিকে সুরাইয়ার পোশাক মার্জিত ধরনের শাড়ি। পার্শ্বচরিত্রগুলোকে চিনতেও আমার অসুবিধা হয়নি।
সেই উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ আমার আখ্যানে পরিপূরক হয়ে বসে গেল। এইভাবে আহমদ ছফার 'ফিকশনে'র নির্বাচিত অংশ আমার লেখায় মন্তাজের মতো ব্যবহার করে আমার লেখাটিকে আরো নন-ফিকশনের কাছাকাছি আনা গেল।
খ. দিলারা হাশেমের উপন্যাস আমলকির মৌ
লিখতে লিখতেই কার কাছে যেন শুনলাম, দিলারা হাশেমের 'আমলকির মৌ' উপন্যাসে আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানমের ছায়া আছে। দিলারা হাশেম সুরাইয়ার বড় বোন, কাজেই ভাবলাম বইটিতে নিশ্চয়ই আমার জন্য অমূল্য কিছু অপেক্ষা করছে। আমি যে করেই হোক বইটি পেতে চাই কিন্তু সে বই তো প্রিন্ট আউট। করোনার সময়ে ইচ্ছা করলেই তো পুরনো বইয়ের বাজারে ঘুরে বই কেনা যায় না। আমি জানতাম আমাদের ছোট ভাই সাহিত্য রসিক তৈমুর চৌধুরী ইউপিএল-এর সত্ত্বাধিকারী মাহরুখ মহিউদ্দীনের বন্ধু। তৈমুরের মাধ্যমে ইউপিএল-এর আর্কাইভে রাখা একমাত্র কপিটি আমার হাতে আসে। বইটির জন্য মাত্র ১৬০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু বইটি সংগ্রহ করার হ্যাপা পোহাতে হয়েছিল বন্ধু কর্নেল শামীমুর রহমানকে।
বইটির শুরুতেই আবুল হাসানের ‘মীরা বাঈ’ কবিতার পুরোটাই ছাপা হয়েছে, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বইটি পড়ে শিক্ষয়িত্রী সারার চরিত্রটিকে শিক্ষয়িত্রী ও কবি সুরাইয়ার মতোই ব্যক্তিত্ববান ও আকর্ষণীয় মনে হল। সুরাইয়ার চরিত্রটি নির্মাণে বেশ কিছু চরিত্র ও মানবীর ছায়া এসেছে, তার একজন সারা; সুরাইয়া চরিত্রের বাকি আবছায়াটুকু গড়তে আমার পরিচিত কোনো কোনো নারীর বৈশিষ্ট কুড়িয়ে নিয়েছি। সারার অস্থিরতা ও সমাজের সাথে বোঝাপড়ার চিত্র দিলারা হাশেম মুন্সিয়ানার সাথে লিখেছেন। সারার সাথে শিল্পী ফিরোজের প্রথম দেখা হবার সংলাপের একটা অংশ ব্যবহার করলাম পাঠকদের জন্য সুরাইয়া ও হাসানের একটি বিকল্প প্রথম কথাবার্তা হিসেবে কল্পনা করে নিতে। এখানে সারা অর্থ্যাৎ সুরাইয়ার ব্যক্তিত্ব ও দর্শন খুবই স্পষ্ট।
গ. এবং মনসিজ
আমার জীবনের প্রথম উপন্যাসোপম লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি একটা সময়ে খুবই আনন্দ পাচ্ছিলাম। আমার লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক মনে হলেই সেখান থেকে মাধুকরীবৃত্তি করে আমার লেখায় আনতে পারছিলাম। ইসরাইল খান আমাকে সুরাইয়া খানমের কিছু অগ্রন্থিত কবিতা পাঠালেন। আর পাঠালেন কাপালিক সরকার সম্পাদিত ‘মনসিজ’ ছোট কাগজে প্রকাশিত সুরাইয়া খানমের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার। সেই আলোচনায় সুরাইয়া একজন সপ্রতিভ আধুনিক কবি, যাঁর কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা আছে, বাংলা কবিতা সম্পর্কে আছে দৃঢ় আশাবাদ। সুরাইয়া খানমকে একজন উদারপন্থী ও মানবিক মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলাম, নারী স্বাধীনতা ও নারীর অগ্রযাত্রা নিয়েও অনেক কথা বলেছেন। সেসব কথা সুরাইয়ার মুখে বসিয়ে দিলাম।
সুরাইয়া শেষের কবিতার লাবণ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর ছোট বোন দিলশাদ খানম বিখ্যাত হয়ে আছেন রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী চরিত্রের জন্য। এই বিষয়গুলোও কিছুটা পরোক্ষভাবে আমার আখ্যানে চলে আসে।
খায়রুল ইসলাম ভাই হাসানের মৃত্যুর পর পিজি হাসপাতালে গিয়েছিলেন অসুস্থ মহাদেব সাহাকে দেখতে। সেখানে তিনি সুরাইয়া খানমের দেখা পান। আমাকে এক কথায় সুরাইয়া সম্পর্কে বলেন, ‘খুবই গরজেস মহিলা।’ আমি আমার রাফখাতা আবুল হাসান ফেসবুক গ্রুপে ‘গর্জিয়াস’ লিখেছিলাম। আফতাব আহমদ সেই বানান ঠিক করে দেন। আমার বইয়ের পরিশিষ্টে এই সব ছোট ছোট বিষয়ের স্বীকৃতিও আছে।
সুরাইয়া ও আবুল হাসানকে ঘিরে কিছু মিথ আছে। যেমন, তাঁরা লিভ টুগেদার করতেন। কিন্তু আমি যা শুনেছি সব লিখিনি। কিছুটা যাচাই করে নিতে চেয়েছি। যে সংবেদনশীল বিষয়গুলো যাচাই করতে পারিনি তা আর রাখিনি। বুলবুল চৌধুরী ও সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ‘লিভ টুগেদারে’র একটা অস্পষ্ট চিত্র পেয়েছিলাম। আমি কোনো রেকর্ডার ব্যবহার করিনি বলে প্রমাণ করার সুযোগ নাই বলে এড়িয়ে গেছি। এর মধ্যে বুলবুল চৌধুরী, শওকত আহসান ফারুক, সাজ্জাদ শরিফ, জাহিদ হায়দার, টোকন ঠাকুর প্রমুখের ভাষ্য গ্রহণ করেছি। মোহাম্মদ রফিক ও নাসির আলী মামুনের লিখিত স্মৃতিকথা ব্যবহার করেছি। এছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে আলাপের সময় পাওয়া সুরাইয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্টের বিষয়গুলো টুকে নিয়েছি।
পৃথক পালঙ্কের দুটি ব্যাখ্যা আর বিউটি বোর্ডিং
আমি অনেকবার বাংলাবাজার গিয়েছি কিন্তু কখনো বিউটি বোর্ডিং দেখিনি। কিন্তু বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রেক্ষাপট ছাড়া আবুল হাসানের গল্পটা লেখা যাবে না। বুলবুল চৌধুরী বলেছিলেন ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান সাহিত্য আড্ডার এই পাদপীঠেই কায়েস চৌধুরীকে খুঁজতে গিয়ে হাসানের সাথে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল। রফিক কায়সার বলেছিলেন এখানেই আহমদ ছফা একবার হাসান, গুণ, সাযযাদ কাদির, রফিক কায়সারকে নিয়ে মিটিং করে নারিন্দার এক সাহিত্য সভায় যান। এই বৈঠকে ছফার মুখে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ জুড়ে দিয়েছি। সেগুলো সাখাওয়াত টিপু সম্পাদিত ছফার সাক্ষাৎকার গ্রন্থ [বাছাই জবাব] থেকে আর বাঙালি মুসলমানের মন থেকে গৃহীত। বিউটি বোর্ডিং এর বর্ণনা রফিক কায়সারের মুখে আর বেলাল চৌধুরীর স্মৃতিকথা থেকে নেয়া, আবহটা পেয়েছি বেলাল চৌধুরীর স্মৃতিকথায়, রফিক কায়সারের জবানিতে আর বিউটি বোর্ডিং নিয়ে পিয়াস মজিদ সংকলিত বই থেকে। আরো কয়েক জায়গায় বিউটি বোর্ডিং এর কথা এসেছে। সেই বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়েছি পরের বছরে। আমি মনে মনে যে ছবি ভেবে লিখেছিলাম, অনেকটা তেমনটাই দেখেছি।
সাহিত্যসভা শেষে হাসান আর গুণকে ঘুমাতে নিয়ে গেলাম নারিন্দার রঙিন মাছে ভরা চৌবাচ্চা অলা সেই মসজিদে, যেখানে ঘুমানোর কথা নির্মলেন্দু গুণের স্মৃতিকথায় আছে। মসজিদের বারান্দায় সকালবেলা ফেরার পথে আবুল হাসানকে লাশের খাটিয়াটি দেখাই। এটা পৃথক পালংক বিষয়ে আমার প্রথম ব্যাখ্যাটি দাঁড় করায়। এই পালংক শেষ বিদায়ের। হাসানের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে স্বপ্ন দৃশ্যে এই পালংকটি আসে। পৃথক পালংক হাসানের শেষ কবিতার বই। এই নামে তাঁর কোনো কবিতা নেই। তাই আমি নিজের বিবেচনা অনুযায়ী এই ব্যাখ্যাটি দাঁড় করাই। পালংকের দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি পাই বুলবুল ভাইয়ের কথায়। অসুস্থ অবস্থায় নানা জনশ্রুতির কারণে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুলবুলকে হাসান বলেছিলেন, ‘আমি ও সুরাইয়া এক গৃহে বাস করলেও আমাদের পালংক কিন্তু পৃথক।’
পৃথক পালঙ্কে আবুল হাসান তাঁর বিধুরতম ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লিখেছিলেন। বইটি সন্ধানী প্রকাশনী থেকে বের হয়; কবি হাতে পান মৃত্যুর সপ্তাহ তিনেক আগে। বইটি অলংকারবিহীনভাবে সুরাইয়া খানমকে উৎসর্গ করেছিলেন।
কবিদের গল্পে দুজন কথাশিল্পী
আমার লেখাটিতে হুমায়ূন আহমেদ ও মাহমুদুল হককে বাড়তি জায়গা দেয়া হয়েছে মনে হতে পারে। মাহমুদুল হকের সাথে হাসানের সরাসরি যোগসূত্র কোথাও পাইনি। কিন্তু মাহমুদুল হককে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন (হামিদ কায়সারের বরাতে জেনেছি) হাসানকে দেখে তাঁর মনে হয়েছে ‘ছেলেটার চোখেমুখে কবিত্ব, কিন্তু ছেলেটা বেশিদিন বাঁচবে না রে!’ এই বিষয়টা বইতে তো রাখতেই হবে। আবার কবি দিলওয়ারের সাথে হাসান আর গুণের একটা সুসম্পর্ক ছিল বলে জেনেছি। দিলওয়ার ছিলেন মাহমুদুল হকের বন্ধু। মাহমুদুল হক শহীদ কাদরীরও বন্ধু ছিলেন। এদিকে আহমাদ মোস্তফা কামালের সংকলিত মাহমুদুল হকের সাক্ষাতকারের বই হিরন্ময় কথকতা পড়ছি। তাঁর কিছু কিছু সংলাপ সেখান থেকে নেয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। আর শহীদ কাদরীর সাথে বিশেষ একটা দিনের ঘটনা তো পেয়েই গেছি। এইভাবে প্রিয় লেখক মাহমুদুল হককেও অনেকটা জায়গা দিলাম।
হুমায়ূন আহমেদ এই বইতে এলেন উপন্যাসের চরিত্র হিসেবেই। তাঁর সাথে আবুল হাসানের কোনো সাক্ষাৎ বা আলাপের সূত্র না পেয়েও হুমায়ূন আহমেদকে এই বইয়ের একটা চরিত্র হিসেবে নিয়ে এসেছি প্রথমত নির্মলেন্দু গুণ ও রফিক কায়সারের সাথে হুমায়ূনের বন্ধুত্ব, দ্বিতীয়ত হুমায়ূন বিজ্ঞানের ছাত্র আর আবুল হাসানের প্রথম প্রেমিকাও বিজ্ঞানের ছাত্রী; হুমায়ূনের ছোট বোন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এইসব বাস্তবতা মাথায় রেখে কথাশিল্পীর কল্পনা দিয়ে হুমায়ূনের ভাইবোনদের সঙ্গে একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে হাসানের প্রেমিকাকে লঞ্চে করে বরিশাল পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আরেক ছোট বোন মমতাজ বেগম শিখুর নামে পত্রিকায় নিজের লেখা কবিতা ছাপতে দিতেন। হাসানের বাড়ি পিরোজপুরের গ্রামে। হুমায়ুন আহমেদও মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে ছিলেন এবং তাঁর পুলিশ অফিসার বাবা মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের হাতে নিহত হন। হুমায়ূন আহমেদের বাবাকে নিয়ে ’৭১ সালে গ্রামে বসে লেখা বই আর তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলো এই সময়ে আবারও পড়া হয়। কাছেই আবুল হাসানের গ্রাম ঝনঝনিয়ায় থাকা হাসানের ছোট বোন হোসনে আরা খানম জানাচ্ছেন, তাঁদের গ্রামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে অনেক হিন্দু নারী মুসলমানদের বাড়িতে নির্ভয়ে সিঁদুর মুছে আত্মীয় সেজে থাকত। এই সব পরিস্থিতি তৈরি ছিল এবং বাকিটা নিজ দায়িত্বে তৈরি করে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদকেও ঝিনুকের একটা চরিত্র হিসেবে দাঁড় করালাম।
হুমায়ূন আহমেদ কবিও ছিলেন বটে; মাহমুদুল হকের ভাষাতেও কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়–কাজেই কবিদের গল্পে এই দুই কথাসাহিত্যিকের স্পেস পাওয়াটা অন্যায্য হয়নি নিশ্চয়ই।
‘প্রতীকের হাত ধরে অনেক প্রতীক’
গোলাপ ঝরে গেছে।
—আবুল হাসানের মৃত্যুতে আহমদ ছফার উক্তি
‘ঝিনুক নীরবে সহো’র জার্নি সম্পর্কে বলতে গেলে, এর পাশাপাশি একজন নবীন ও নবিশ কথাসাহিত্যিক হিসেবে একটা বিষাদঘন লেখা কীভাবে সামলেছি, মৃত্যুর দিকে ধাবমান প্রোটগোনিস্টের যাত্রাটিকে কীভাবে ইঙ্গিতময় করার করণকৌশল ঠিক করলাম, তারও কিছু কিছু বলা দরকার বলে মনে করি।
উপন্যাসটি শুরুই হয়েছে সরাসরি মৃত্যুদৃশ্য দিয়ে–এতে বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে কীনা সে নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা করতে হয়নি কেননা সবাই জানেন কবি মারা গিয়েছিলেন; জানেন, কীভাবে মারা গিয়েছিলেন। পরের অধ্যায় থেকে আমি কবির জীবন ভিত্তিক গল্পটা লিখতে থাকি, কিন্তু প্রতি অধ্যায়েই তাঁকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবার কৌশল খুঁজতে থাকি এবং শেষ অধ্যায়ে আবারো মৃত্যু কিংবা অমরতার দৃশ্য।
অসুখ নিয়ে কবির খুব স্পষ্ট মনোভাব ছিল, উপন্যাসে সেই উক্তি আছে, বার্লিনের ডাক্তারদের শেষ পরামর্শও সহজভাবে মেনে নেয়ার দৃষ্টান্ত আছে। কবি মৃত্যুকে ভয় পেতেন না কিন্তু অনিবার্যতা অস্বীকার করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে ছোটবেলা থেকেই অসুস্থতার কথা এসেছে, আমরা প্রস্তুত হয়েছি।
অসুস্থ হবার বেশ আগেই, কবি কিংবা ভবঘুরে জীবনের তুঙ্গ অবস্থায় এক মসজিদের বারান্দায় লাশের খাটিয়া দেখে কবি থমকে গিয়েছিলেন। তারপর সেই খাটিয়াটি অসুস্থ হবার পর কবির স্বপ্ন দৃশ্যে আসে। কবির শেষ বইয়ের নাম ‘পৃথক পালঙ্ক’ নামকরণের একটা ব্যাখ্যাও এই শব বহনের পালঙ্ক। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি অবশ্য ভিন্ন। কবির মৃত্যুর কয়েক মাস আগে কবির স্বপ্নে তাঁর প্রিয় কবি লোরকার মৃত্যুর কথা আসে, মৃত্যুর আগে লোরকার মৃত্যুবিষয়ক স্বপ্নের কথা আসে। এসব দিয়ে একটা আবহ তৈরি করা হয়। কবির কবিতার উদ্ধৃতিগুলোও সহজেই ইঙ্গিত সৃস্টিতে সহায়ক হয়েছে।
তবে ফুল এবং ফুলের রঙের ব্যবহার আরো সচেতন একটি প্রয়াস। 'ঝিনুকে' সচেতনভাবে কিছু জায়গায় ফুল ও রঙের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। একই ফুল দুই জায়গায় ব্যবহার করা ছিল চলচ্চিত্রের সিম্বলের মতো কিছু গড়ার প্রয়াস। তবে এমনভাবে ব্যবহার করিনি যাতে কোনো একটা মোটিফে দাঁড়িয়ে যায়। বেশি জায়গায় প্রয়োগ করা হয়নি যাতে পাঠকের মনে কৌতূহল বজায় থাকে, সাধারণ কোন প্রয়োগ মনে না হয়।
আবুল হাসান তাঁর শেষ জন্মদিনটা সুরাইয়া খানমের সাথে উদযাপন করেন। এটা আমি কোথাও পাইনি। লিখেছি। সেদিন সুরাইয়া সাথে করে এনেছিলেন লাল আর শাদা রঙের ফুল। ফুলগুলো বাংলাদেশে সহজলভ্য–রঙ্গন আর কাঠগোলাপ। তখনো ফুলের বানিজ্যিকীকরণ হয়নি, বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা ফুলই উপলক্ষে ব্যবহার করা হত।
শাদা শুভ্রতা, শান্তি ও বিশুদ্ধতার প্রতীক। লালের তাৎপর্য আছে আরো বিচিত্র অর্থে–ভালবাসা, যৌনতা, আনন্দ, প্যাশন, সাহস, আত্মত্যাগ এবং অনিবার্য ভাবেই : বিপদ।
রঙ্গন ভালোবাসা ও জীবনের প্রতীক। কাঠগোলাপ নতুন আরম্ভ ও লাবণ্য বোঝায়। অবশ্য বিশেষ ফুলের প্রতীকের অর্থ কী সেটা আমি আগে জানতাম না। সাধারণভাবে ফুল ও রং সম্পর্কেই সচেতন ছিলাম।
ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক হলেও চয়ন করা ফুল বেশি বেশি অকাল নশ্বরতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
শেষ অধ্যায়ে হাসানের কবর দেখে এসে এক ভক্ত জানালেন, কবির কবরে শাদা কাঠগোলাপ আর লাল রঙ্গন জড়াজড়ি করে এক কন্ট্রাস্টের সৃষ্টি করেছে। [খায়রুল ইসলামের ফেসবুক থেকে নেয়া]। এই দুটি ফুল আমি অনেক আগেই তাঁর শেষ জন্মদিনে প্রেয়সীর উপহার হিসেবে দেখিয়েছিলাম। আবার, আমি যেটা বোঝাতে চাইনি, এ থেকে সেই অর্থও করে ফেলা যায়: [কবির ঘনিষ্ট, অন্যদিকে তাঁর প্রেয়সীর প্রতি বিরূপ ছিলেন এমন অনেকে বলেছেন] প্রেয়সীই কবির মৃত্যু ত্বরান্বিত হবার অন্যতম কারণ।
জন্মদিনে ফুল উপহার হিসেবে দেখানোটা স্বাভাবিক। আবার ফুলের অকালে ঝরে পড়ার মতো নশ্বর বৈশিষ্ট্যও স্বাভাবিক। জন্মদিনে আর কবির মৃত্যুর পরের ঠাঁই কবরের গায়ে একই ফুল ব্যবহার করা [আসলে কবরের ফুলগুলো বাস্তবেই রঙ্গন আর কাঠগোলাপ ছিল, জীবদ্দশার ফুলগুলো কল্পনা] চলচ্চিত্রের ভাষায় সিম্বলিক শট ৷ এ হচ্ছে অনেক কিছু না লিখেও কিছু ইঙ্গিত পাঠকের ইন্দ্রিয়ের পাশে নিবেদন করে রাখা। এতক্ষণ যা লিখলাম তা বলাই বাহুল্য যে, একটা বাহুল্য।
আমি অই বাড়িতে একলা যাব, ডাইনে ওর সোনালি সবুজ গাছ
বামে দেখা যায় নীল অপরাজিতার ঝাড়, সামনে সাদা
সম্পূর্ণ নারীর মূর্তি।
আমি অই বাড়িতে একলা যাবো, ডাইনে ওর সুন্দর সাপের ফণা
দরজায় উড়ছে সবুজ শাড়ি সামনে শিশু সপ্রতিভ ফুল।
[আবুল হাসান]
দর্শন ও ভবঘুরেমি
শুরুতে বলছিলাম, আবুল হাসান গবেষণা উপযোগী কবি। তার শব্দচয়নও অভিনব এবং এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যা তাঁর আগে আর কারো লেখায় আমি দেখিনি। আবুল হাসানের একটি গল্পের নাম ‘নির্বাসনায় মাইল মাইল’। নির্বাসনা শব্দটি নির্বাসন শব্দের বিকল্প ভেবেও মনের খটকা দূর হয় না। তারপর খুঁজে দেখি নির্বাসনার অর্থ বাসনামুক্ত হওয়া—‘বাসনা মুক্ত হওয়া সম্ভব। সেই জন্যই জপ, ধ্যান, সাধনা এসব দরকার। যদি তুমি নির্বাসনা হও, তবে ভক্তি লাভ করতে পারবে।’
আবুল হাসান একজন প্রকৃত বোহেমিয়ান ছিলেন। ‘ঝিনুকে’ দেখানো হয়েছে তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ পড়েছেন। বার্লিন থেকে তাঁর চেকোস্লোভাকিয়ায় চিকিৎসার জন্য যাবার কথা ছিল। এই প্রেক্ষাপটে চেকোস্লোভাকিয়ার ‘বোহিমিয়া’ নামের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে।
আবুল হাসান হেরমান হেসের ‘সিদ্ধার্থ’ পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন, এমনকি তিনি উপন্যাসটি অনুবাদও শুরু করেছিলেন। এই তথ্য পেয়েছি রাইনহার্ট হেভিকের স্মৃতিকথায়। হাসান হয়তো তাঁর আত্মিক দর্শন খুঁজে পেয়েছিলেন এখানেই—‘সংসার বিষময় ঠেকে। জীবন শুধু বেদনা। সিদ্ধার্থের একটি মাত্র লক্ষ্য—শূন্য হয়ে যাওয়া; তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, আনন্দ ও বেদনা থেকে মুক্তি পাওয়া; অহংকে মরে যেতে দেওয়া। অহংকে দমন করে নিরাসক্ত হৃদয়ের শান্তি ও বিশুদ্ধ চিন্তার অভিজ্ঞতা অর্জন করা তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। অহং যখন পরাজিত ও মৃত, যখন সকল বিক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষা শান্ত হবে, তখন সেই অহংমুক্ত অন্তরে গোপনসত্তা জেগে উঠবে।’ [হেরমান হেস, সিদ্ধার্থ, অনুবাদ জাফর আলম।]
আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘হাসানের মৃত্যু হলেও ক্ষতি কি; অমৃতের সন্ধান সে তো পেয়েই গেছে!’ জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে আবুল হাসান বাসনামুক্ত হতে পেরেছিলেন, সন্তের আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত হতে দেখি, আর কবির সুনাম বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে ‘নির্বাসনায় মাইল মাইলে’র মতো মাইলের পর মাইল, এ এক পাঠক পরম্পরা; যে কারণে তিনি আজও সমান জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক।
নানা সূত্র থেকে গল্প এবং গল্পের চোরা স্রোত খুঁজে পেয়ে লিখতে লিখতে আমি বিশ্বাস করেছি রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতায়—‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি/ কবি তব মনোভূমি/ রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য।’ সেই সূত্রগুলো কেবল মন্তাজের মতো মিলিয়ে দিয়েছি, আর আমার নিজস্ব কল্পনা ও বিবেচনায় ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ তার অবয়ব পেয়েছে।
রফিক কায়সারের সাথে আলাপ
আমি যে তিন চারজন পাঠকের কাছে ‘ঝিনুক নীরবে সহো’র পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে রফিক কায়সার অন্যতম। তিনি আমার সাহিত্যের শিক্ষক, আমার স্যার। তিনি শুধু আমার পাণ্ডুলিপি নিয়েই মতামত দেননি, তিনি অসংখ্যবার টেলিফোনে ও মেসেঞ্জারে আমাকে আবুল হাসান ও সেই সময়ের অনেক কথা বলেছেন।
পাণ্ডুলিপি পড়া শেষ করে তিনি বলেছিলেন, তোমার লেখাটি বিশুদ্ধ উপন্যাসের সব শর্ত পূরণ করেছে। তা সত্ত্বেও আমি আমার লেখাটিকে ডকুফিকশন নামেই চিহ্নিত করতে চেয়েছি। মাঝে মাঝে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করতেন–তোমার লেখায় হাসানের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে হচ্ছে, ও কিন্তু একজন সার্বক্ষণিক কবিই ছিল। আমি স্যারকে আশ্বস্ত করে আমার লেখার শব্দচয়ন ও বাক্যগঠন নিয়ে কাজ করতাম। লেখার শেষ পর্যায়ে আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি তখন তিনি প্রথমে আমার কাছে, তারপর আমার স্ত্রীর কাছে, তারপর আমার বন্ধুদের কাছে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে নিয়মিত খোঁজ খবর নেন।
‘শঙ্খনীল কারাগারে’র নামকরণের ইতিহাস জানার সূত্রে আমার জানা ছিল স্যার হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদের সমসাময়িক [তিন বছরের জুনিয়র, কিন্তু সখ্যতা ছিল] অতএব, আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণের সাথেও তাঁর পরিচয় থাকা স্বাভাবিক। স্যারের কাছে সময় চাইলাম। ২০২০-এর নভেম্বর মাসের শুরুতে তিনি বললেন, মোশতাক আমি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি, প্রশ্ন করতে পারো!
তিনি প্রথমেই জানালেন,স্মৃতি আবছা হয়ে আছে, কিন্তু আড্ডায় সেসব ঝালাই হয় এবং মতান্তর কিংবা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু স্যার আমার সাথে কথা বলতে বলতে বিস্মরণ থেকে বেরিয়ে আসেন!
আবুল হাসানের সাথে স্যারের পরিচয় আগস্ট ১৯৬৮ সালে [আমার জন্মের বছর!] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর, যখন হাসানের ছাত্রত্ব নেই, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে ছাত্রদের সমান্তরাল একটা জীবন কাটাচ্ছেন। হাসানের সাথে, আহমদ ছফার সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রফিক কায়সারের পরিচয় হয়ে যায়। কিন্তু ময়মনসিংহবাসের কারণে তিনি আগে থেকেই নির্মলেন্দু গুণকে জানতেন ও তাঁর কবিতা পড়ে এসেছেন কণ্ঠস্বর, সমকাল, সংবাদ কিংবা দৈনিক পাকিস্তানে। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে কবিরা দিনভর আড্ডা দিতেন—বারোটা ফোল্ডিং চেয়ার ছিল, চায়ের দাম চার আনা, এক টাকায় তেহারি পাওয়া যেত আর ছিল প্রসিদ্ধ মাখন টোষ্ট। যাদেরকে ক্লাসে পাওয়া যায় না, তাদেরকে ক্যান্টিনে পেয়ে যাওয়া ছিল এক প্রলুদ্ধকর বিষয়।
ঊনসত্তরের মার্চ থেকে আন্দোলন শুরু হল। হাসান আর গুণ হলে রাত্রিযাপন করত। শরীফের ক্যান্টিনের বাইরে গুণকে সচরাচর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পাওয়া যেত, আর হাসানকে পাবলিক লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি, ইউসিস, জিন্নাহ এভেনিউতে ভারতীয় হাইকমিশনের লাইব্রেরিতে পাওয়া যেত। হাসান টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্ট কিংবা আনন্দবাজার পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করছে এটা একটা পরিচিত দৃশ্য ছিল। দিনের বেলা হাসান পত্রিকা অফিসেও যেতেন, সন্ধ্যার পর শহীদ কাদরীর কাছে যেতেন। হাসানের হাতে তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ বইটা দেখেছিলেন এবং ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়’ কবিতাটি সেখান থেকেই পড়েছিলেন বলে মনে করতে পারেন। গুণের কাছে পেয়েছেন বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ [মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায় কিংবা হে দেবদারু কবিতার খোঁজ পান সেখানে]। হুমায়ূন আহমেদ সারাদিনের ল্যাবের কাজ শেষ করে বিকেলের ভাঙ্গা হাটে আসতেন ক্যান্টিনে। মুখচোরা হুমায়ূন এক কোনে বসে চা খেতেন। কখনো সঙ্গী হতেন আনিস সাবেত। হুমায়ূন সাহিত্যের বই পড়তে যেতেন পাবলিক লাইব্রেরিতে। এখানেই দুজনের আলাপ। হুমায়ূন আহমেদ, রফিক কায়সারকে কবি বলে সম্বোধন করতেন–‘কবি, কী লিখলেন আজ?’ তাঁদের মধ্যে ‘আপনি’ সম্বোধন ছিল। গুণের সাথে হুমায়ূনের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। চায়ের আড্ডা শেষে হুমায়ূন ও রফিক কায়সার মহসিন হলে, যথাক্রমে পাঁচ তলা ও তিনতলায় যে যার রুমে ফিরে যেতেন। হুমায়ূন হাত দেখতে পারতেন, ম্যাজিক দেখাতে পারতেন এবং গান খুব পছন্দ করতেন। আহমদ ছফাই হুমায়ূনকে আবিষ্কার করেন এবং বলেন, এই ছেলে আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হবে।
আহসান হাবীব হাসানকে পছন্দ করতেন, সিকান্দার আবু জাফর নির্মলেন্দু গুণকে আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দু’জনকেই প্রশ্রয় দিতেন। লেখক সংঘের হাসান হাফিজুর রহমানের পক্ষপাতিত্ব ছিল হাসানের প্রতিই।
বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং কেন্দ্রিক একটা স্মৃতির কথা জানালেন রফিক স্যার। সম্ভবত ১৯৭০ সাল। আহমদ ছফার ডাকে গুণ, হাসান, হেলাল হাফিজ, শাহজাহান চৌধুরী, রফিক কায়সার প্রমুখ বিউটি বোর্ডিং-এ গিয়ে কাঁসার থালায় ভাত খান, বড় বড় কাঁসার গ্লাসে পানি পান করেন। একজন স্বাপ্নিক মানুষ ছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর নেতৃত্বে একটা সংক্ষিপ্ত সভার পর পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জে সাহিত্য সভায় যান। আবার ৭২-৭৩ সালে গুণ হয়ত বিউটি বোর্ডিং-এর আবাসিকেও থেকেছেন কিছুদিন। আহমদ ছফা হাসানকে স্নেহ করতেন ও তাঁকে নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করতেন।
রফিক স্যারের কাছ থেকে আরো জানলাম, চলমান অভিধান সাযযাদ কাদির গুণের বই প্রকাশে [১৯৭০] সাহায্য করেন, প্রুফও দেখেন। হুমায়ূন কবিরের প্রথম বই কুসুমিত ইস্পাত [১৯৭২]-এর প্রুফ দেখেন মুহম্মদ নূরুল হুদা। হুমায়ূন কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ছিলেন না, গবেষণা সহযোগী ছিলেন–প্রথমত মুনীর চৌধুরীর সাথে জীবনানন্দ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, মুক্তিযুদ্ধে মুনীর চৌধুরী শহীদ হবার পর অধ্যাপক মুনীরুজ্জামানের অধীনে কাজটি করছিলেন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকার রেফারেন্সও স্যার আমাকে দেন।
শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে এক দুপুরবেলা আবুল হাসান তাঁর 'মিস্ট্রেস: ফ্রি স্কুল স্ট্রিট' শিরোনামের অসামান্য কবিতাটি পড়ে শোনান, ছাপা হবার আগে। সীমিত সংখ্যক শ্রোতার মাঝে রফিক স্যারও ছিলেন। নির্মলেন্দু গুণের উত্থানপর্বের কবিতা ‘অসমাপ্ত কবিতা’ও [যেখানে হাসানের কথাও আছে] এই ক্যান্টিনেই তিনি পাঠ করেছিলেন। আমি দেখিয়েছি কবিতা দুটি একই রাতে একই আস্তানায় লন্ড্রির কাপড় মোড়াবার নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা হয়েছিল।
আবুল হাসান মাঝে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নভেরার গড়া ভাষ্কর্যের কাছে কিংবা রমনা রেস্তোরাঁয় এক কাপ চা নিয়ে কাগজ কলম হাতে উদাস হয়ে বসে থাকতেন। রফিক কায়সার এ নিয়ে তাঁকে খোঁচাতেন। কিন্তু কী বলে খোঁচাতেন সেটা আর তাঁর মনে নাই। আমি আমার বইতে কিছু একটা বসিয়ে দিলাম এরকম, ‘কী হাসান ভাই, ভাব এসেছে?’
রফিক স্যার আবুল হাসানকে হাসপাতালে দেখতে গেছেন, একবার আহসান হাবীবকেও কবির শয্যাপাশে পেয়েছিলেন। বার্লিন থেকে আবুল হাসান তাঁকে দুটি চিঠিও লিখেছিলেন। হাসানের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন তৎকালীন মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে বসে, যেখানে তিনি তরুণ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছেন ‘৭৪-এ ছাত্রত্ব ঘুচে যাবার পর।
রফিক কায়সার স্যারের সাথে আমার কথপোকথনগুলো ডায়েরিতে সাংকেতিক ভাষায় লেখা ছিল। এবারে বিস্তারিত লিখে রাখার সুযোগটা নষ্ট করলাম না।
এবারে রফিক কায়সারের মন্তব্যগুলোর দু-একটা উল্লেখ করা যাক:
হাসানের মৃত্যুদৃশ্যে তাঁর মা উপস্থিত ছিলেন। আমি এটাকে বোদলেয়ারের মৃত্যুশয্যায় তাঁর মায়ের উপস্থিতির সাথে তুলনা করেছিলাম। স্যার বললেন, এভাবে লিখলে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ থাকবে। আমি বাদ দিলাম।
সানজীদা খাতুনের বইতে পেয়েছিলাম রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বানচাল করতে মোনায়েম খান এক ট্রাক গুন্ডা পাঠিয়ে অনুষ্ঠানের পরে মঞ্চ ভেঙ্গে দিয়েছিল। স্যার এতে দ্বিমত পোষণ করেন।
রফিক স্যার হুমায়ূন আহমেদকে 'ঝিনুকে'র একটি কষ্টকল্পিত চরিত্র [লেখকের আত্নসমালোচনা] হিসেবে দাঁড় করানোর ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। তিনি কি সেলিব্রেটি [এই কথাটি রফিক স্যারের] বলে আমার উপন্যাসে তাঁকে এনেছি কীনা? আমি কিছু একটা উত্তর দিয়েছিলাম। তিনি আমার শিক্ষক বলেই হয়তো উত্তরে পাস মার্ক দিয়েছিলেন, লেটার মার্ক দিতে পারেননি।
সর্বোপরি ‘ঝিনুক নীরবে সহো’কে তিনি বিশুদ্ধ উপন্যাসই বলেছেন। এ নিয়ে তাঁর একটি ভিডিও কথিকা আছে।
বুলবুল ভাইয়ের কথা: জীবনের আঁকিবুঁকি
বুলবুল চৌধুরী তাঁর মৃত্যু শয্যায় আকুতিভরা কণ্ঠে বলছিলেন, আর ছয়টা মাস বাঁচতে চাই, আর একটা বই লিখতে চাই! কী বিষয়ে বই লেখার পরিকল্পনা ছিল, জানা হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে থেকে তিনি আমাকে কিছু অমূল্য তথ্য দিয়ে গেছেন—টেলিফোনে দীর্ঘ ইন্টারভিউতে আর তাঁর নিজের লেখা স্মৃতিচারণমূলক দুটো বইয়ের মাধ্যমে। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
আমার লেখাটির খবর পেয়ে হামিদ কায়সার একদিন জিজ্ঞেস করলেন, আমি বুলবুল চৌধুরীর সাথে কথা বলেছি কীনা? তিনি বললেন, আবুল হাসানকে নিয়ে উপন্যাস লিখবেন অথচ বুলবুল ভাইয়ের সাথে কথা বলবেন না, এটা একটা পাপ হবে! তিনিই আমাকে বুলবুল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। বুলবুল ভাইয়ের কাছে হামিদ সম্ভবত আমাকে নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা বলে থাকবে। বুলবুল ভাই বললেন, আমি শুনেছি আপনি একটা ভাল কাজ করছেন। এরপর তিনি তাঁদের বন্ধুত্ব ও সাহিত্যচর্চার স্মৃতির ভাণ্ডার উজার করে দিলেন। তার সবই আমার বইতে রাখার চেষ্টা করেছি। আমি তো আগেই লিখে ফেলেছি বুলবুল চৌধুরী আর আবিদ আজাদ মিলে হাসানকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বুলবুল ভাই বললেন, তিনি কখনো কবিকে হাসপাতালে দেখতে যাননি। কিন্তু সাজানো গল্পটা আর ফেলে দিইনি। বুলবুল ভাই আমাকে আবুল হাসানের একটি অগ্রন্থিত কবিতা দিয়েছিলেন [সাধু হে আনন্দ পেতে দাও], কবিতাটি তার সম্পাদিত সবাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ষাটের দশকে। আরেকটি অপ্রকাশিত কবিতা আমাকে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি গাজীপুরের কালীগঞ্জে কোনোদিন যাওয়া হলে নিয়ে এসে আমাকে দেবেন বলেছিলেন। বুলবুল ভাইয়ের আর কালীগঞ্জ যাওয়া হয়নি। তিনি তাঁদের এক বন্ধুর লেখা একটি স্মৃতিকথার সূত্র ধরেও কিছু স্মৃতি পুনরুদ্ধার করেছেন। কিন্তু সেই লেখাটি কাব্য আর ভাবালুতায় ভরা এমনটি বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, আপনিই পারবেন, লিখেন, আমিই প্রকাশক খুঁজে দিব, কিছু টাকাপয়সাও যাতে পান, সে ব্যবস্থা করে দিব।
বুলবুল ভাইকে ফোন করলেই বলতেন, ডাক্তার! কেমন আছেন? কি শুনতে চান? আমি তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এক কথায় বলতেন, ভালো না। তারপর এ নিয়ে আর কোনো আলোচনায় আগ্রহ দেখাতেন না। আমি কথা বলার সময় দ্রুত কলম চালিয়ে লিখে নিতাম, কিন্তু আমার অজান্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কথাবার্তার কিছু কিছু অংশ ফোনে রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। একুশে পদক পেয়ে গেলেন এর মধ্যেই। আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম, শুরুতে পল্টনে এক বন্ধুর আলো বাতাসভরা বারান্দায় বসে কথা বলতে চাইলেও তারিখ মিলাতে পারছিলেন না, পরে করোনার প্রকোপ বাড়াতে আর সামনাসামনি দেখা করতে রাজি হলেন না। বললেন, দেখা কইরা কি করবেন? আপনার কি কি জানার আছে আমি তো বলছিই। প্রতিবার টেলিফোনেই তিনি প্রায় আধা ঘন্টা করে সময় দিতেন। আমাকে ফাঁকি দিয়ে হামিদ কায়সার বাংলাবাজারে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে এসেছিলেন। আমার এই আফসোস আর মিটবার নয়।
নীল দূতাবাস ও রানি মৌমাছি
ভালোবাসি দুঃখজনক তোমার গালের তিলকে,
সলোমেকে যেমন ভালোবেসেছিলেন রিলকে!
—জাহিদুল হক
আমি জাহিদুল হকের কবিতার বিশেষ ভক্ত। দুর্বল মুখস্তবিদ্যা নিয়েও তাঁর কিছু কবিতা আমার মুখস্ত আছে। ‘ঝিনুক’ লেখার সময় আবুল হাসান ও সুরাইয়ার সাথে তাঁর ঘনিষ্টতা, তাঁর ইয়োরোপমনস্কতা আর বিশেষভাবে জার্মান অভিজ্ঞতার কারণে তাঁকে স্মরণ করি ও তাঁর শরণ নিই। পৃথিবীতে হাসানের শেষ দৃশ্যেও তিনি সুরাইয়ার সাথে হাসানের পাশে ছিলেন। সুরাইয়া খানমের মৃত্যু নিয়েও তাঁর কবিতা আছে। জাহিদ ভাই আবুল হাসানের সুহৃদ; তিনি সুরাইয়া খানমের ছোট বোন রক্তকরবী নাটকের নন্দিনী খ্যাত দিলশাদ খানমেরও বন্ধু। তারপর সুরাইয়া খানমও তাঁর বন্ধু হন।
বাংলা কবিতায় তিনি বিশেষ একজন; গানকে কবিতার কাছাকাছি আনার জন্য জীবনব্যাপী কাজ করে গেছেন, কথ্যকে বেঁধেছেন ছন্দে, পরিমিতি বোধ অনন্য তাঁর—অতিকথন নেই আর আছে অদ্ভুত রকমের সব এল্যুশনের ছড়াছড়ি—ভালো পাঠক না হলে যার রস আস্বাদন করা সম্ভব না।
আমি ‘ঝিনুক’ লিখতে শুরু করেছি বলার পর জাহিদ ভাই আমাকে অনেকবার ফোন করেছেন, বেশিরভাগই নিজে থেকেই, আমাকে এই বইয়ের জন্য রসদ দিয়েছেন তো বটেই, বিভিন্ন আলাপে আমার সাহিত্যবোধকেও সমৃদ্ধ করেছেন। যখন বইটা বেরিয়ে গেল, আমি খুব অসুস্থ। সে কারণে আগের দুটো মাস জাহিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তাঁকে বই প্রকাশের সংবাদ দিয়ে ঠিকানা চেয়ে নিয়েছিলাম প্রকাশককে দিব বলে। তিনি বই হয়ে গেছে শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন।
‘ঝিনুক নীরবে সহো’তে দিওতিমা, সলোমে, মাদাম সামতিয়ের গল্প আছে। এই গল্পগুলো মক্ষীরানি বোঝানোর জন্য জাহিদুল হক আমাকে বলেছিলেন। শিল্প সাহিত্যের ইতিহাসে কবি/ শিল্পীদের একজন মক্ষীরানি থাকার দৃষ্টান্ত আছে। জাহিদ ভাই কি বলতে চেয়েছিলেন জানি না; আমি এই মক্ষীরানির উপমাটি সুরাইয়া খানমের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলাম। জাহিদ ভাইয়ের শিল্পের ইতিহাসের গল্পগুলো বার্লিনে হাসানের বিদায় ভোজের আগে তাঁর দুই জার্মান শিল্পী বন্ধুর মুখে সংলাপ হিসেবে বসিয়ে দিলাম। টেলিফোনে শুনে দিওতিমাকে নিওটিমা লিখেছিলাম। দ্বিতীয় সংস্করণে সে ভুল শুধরে নিচ্ছি।
ল্যু আন্দ্রিয়াস সলোমে মূলত একজন মনোসমীক্ষক ছিলেন। নারী স্বাধীনতার প্রতীক। দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসে, ডাক্তার সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কবি রাইনার মারিয়া রিলকে, বহু ভাষাবিদ অধ্যাপক কার্ল অ্যান্ড্রিয়াস দার্শনিক পল রি—এঁরা সবাই তাঁর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
মাদাম সামতিয়ে প্রেরণা দিয়েছেন বোদলেয়ার, নের্ভাল ও গতিয়েকে। দিওতিমা প্রেরণা ছিলেন হোল্ডারলিনের। ফ্রিডা কাহলো প্রেরণা দিয়েছেন ট্রটস্কিকে। আমি পরে এই রানি মৌমাছিদের জীবনকাহিনি পড়ি; কোনোটা কৌতূহলোদ্দীপক, কোনোটা ট্রাজেডিতে ভরা। সলোমে, নীতসে আর কার্লকে নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছে; সেই পোস্টারের ছবি আর ট্রেলার দেখে আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গেছে।
আমি এই তিনজনের সাথে কহলিল জিব্রানের মক্ষীরাণিকেও যুক্ত করে দেই। শেষে উপসংহারে এসে জার্মান বন্ধুরা যখন হাসানের কাছে বাংলাদেশের মক্ষীরানির কথা জানতে চাইছিল, তখন হাসানের কল্পনায় সুরাইয়ার মুখটা ভেসে আসে, এমনটা লিখেছিলাম। হাসানের মৃত্যুর পর ’৭৬ থেকে ’৮২ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে সুরাইয়ার অবস্থান তুঙ্গে ওঠে, তিনি তখন মক্ষীরানি হয়ে উঠেছিলেন বললে ভুল হবে না।
মক্ষীরানি বিষয়ক অধ্যায়টি জাহিদ ভাইয়ের সাথে কথপোকথন থেকে লেখা। জাহিদ ভাইয়ের গল্প শুনে বিচিত্রা অফিসের শাহাদত চৌধুরীর সাথে সুরাইয়ার ঘটনা [যার সূত্র পেয়েছিলাম আহমদ ছফার লেখায়], পূর্বানী অফিসের ঘটনা, রেডিও অফিসের ঘটনা ইত্যাদি লিখি।
আবুল হাসানের সাথে জাহিদুল হকের অনেকগুলো ঘটনা বইতে আছে—রেডিওতে কবিতা পড়া, আড্ডা দেয়া, তাঁকে কবিতা উৎসর্গ করার পর আবার ঝগড়া করে হাসানের নিজের হাতেই ছিঁড়ে ফেলা, একসাথে নিউ মার্কেটে যাওয়া ইত্যাদি। কবিতা নিয়ে জাহিদ ভাই অনেক কথা বলেছেন আমাকে। সে সব কথার কোনোটি তাঁর মুখে, কোনোটি আবুল হাসানের মুখে বসিয়ে দিয়েছি।
জাহিদ ভাই একদিন বলছিলেন, আমরা বলি কবি শামসুর রাহমান; কিন্তু ওরা বলে মিস্টার এলিয়ট। আমরা কবির নামের আগে ‘কবি’ না বসালে আহত হই। আমিও এই শিক্ষাটা নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আরেকটা কথা বলেছিলেন, ‘আই অলওয়েজ লাভ টু লুজ।’ আর আমার ক্ষেত্রে?–আমি হারিয়ে ফেলি কিন্তু হারিয়ে ফেলতে পছন্দ করি না। আমি হেরে যাই কিন্তু হেরে যেতে ভালোবাসি না। অবশ্য জিতে গেলেও বিষন্ন হই!
এক যুগ কেটে গেছে অপচয়ে,
সঞ্চয়ে শুধু তোমার মুখটি ছাড়া
কিছু নেই, কিছু নেই!
‘ঢাকার মানু’ আবু বাকারের হাত ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুঁইয়া ইকবাল
পত্রিকায় নির্মলেন্দু গুণের একটা লেখায় পেলাম তাঁদের বন্ধু আবু বাকার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটা উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাসে যুদ্ধের সময় সদরঘাটে হাসানের পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেছেন, যে ঘটনার কথা গুণ আগে কখনো শুনেন নাই। তবে ঘটনাটি সত্যি; আবুল হাসান কোনো কারণে বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। হুমায়ুন কবিরও বিষয়টা জানতেন।
আমি তখন ঝিনুক লিখছি। আবু বাকার ভাইকে খুঁজে বের করে জানুয়ারি মাসে [২০২১] তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় চলে গেলাম। তিনি বেতারে কাজ করতেন। অনেক স্মৃতিকথা শুনলাম—আড্ডা, চট্টগ্রাম ভ্রমণ, জয়দেবপুরে দৈব পিকনিক, মালিটোলা পতিতালয়ের সামনে সাহিত্যসভা করা ইত্যাদি। তিনি তাঁর লেখা সেই উপন্যাসটি [একাত্তরে ঢাকার মানু, জ্যোতি প্রকাশ] আর নাটকের বই আমাকে উপহার দিলেন। ফোনে ভূঁইয়া ইকবালকে ধরিয়ে দিলেন। ভূঁইয়া ইকবাল আমাকে দুটো ঘটনার কথা বললেন—চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সম্মেলন ‘আনন্দমেলা’য় হাসান ও গুণের যোগদান ও নিউমার্কেটে হাসানকে শামসুর রাহমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। ভূঁইয়া ইকবালের এসএম হলের পাশের রুমেই সাংবাদিক ও হাসানের বন্ধু মাহফুজুল হক থাকতেন। ভূঁইয়া ইকবাল বললেন, মাহফুজ হাসানকে ভাইয়ের মতো দেখত, হাসানকে বিছানা ছেড়ে দিয়ে সে মেঝেতে ঘুমাত। তিনি বললেন, হাসানের মতো এমন মধুর স্বভাব খুব কম মানুষেরই হয়। ছেলের মাধ্যমে ইমেইলে ষাটের দশকে তাঁর সম্পাদিত পূর্বলেখে ছাপা হওয়া আবুল হাসানের দুটো অগ্রন্থিত কবিতা পাঠিয়ে দিলেন পর দিনই। ভূঁইয়া ইকবাল জুলাই মাসে [২০২১] মারা যান।
আবু বাকার ভাই হাসানের একজন শিষ্যের [আনিসুর রহমান মণ্ডল] সাথেও ফোনে আলাপ করিয়ে দেন, যিনি জয়দেবপুরের পিকনিকের ঘটনাটি ডিটেইলে বলেছিলেন।
আবু বাকার ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ আলাপের ভিত্তিতে ঝিনুকের বিভিন্ন পৃষ্ঠা বাস্তবানুগ ও সমৃদ্ধ হতে পেরেছে। তাঁর মাধ্যমে সাহিত্যিক সিরাজউদ্দিন আহমেদের সাথেও যোগাযোগ হয় এবং বুদ্ধদেব বসুর বইকে কেন্দ্র করে হাসানের সাথে তাঁর একটা স্মৃতির কথা জানতে পারি।
সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথা: হাসানের মেডিকেল হোস্টেল অধ্যায়
কবির জীবনীতে সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নামটি পেয়েছিলাম; তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও আবুল হাসান যখন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকতেন তখন তাঁর রুমেই থাকতেন। ফেসবুক ঘেঁটে সুকান্তদাকে পেলাম; তিনি আছেন কোলকাতায়। ডাক্তারির পাশাপাশি লেখালিখির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন। একদিন ডা. জাকির হোসেন স্যারের সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেকালের সাহিত্যিক পরিবেশের কথা আলোচনার সময়ও সুকান্তদার কথা শুনলাম।
সুকান্ত চ্যাটার্জির সাথে কথপোকথনে মেডিকেল হোস্টেলে হাসানের প্রথম হৃদরোগ ধরা পড়া, কাক পত্রিকার প্রকাশ, ’৭১ সালে হাসানের হাসপাতালবাস, হাসানের পাণ্ডুলিপির ট্রাংক ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারি।
৭ এপ্রিল ২০২১ তারিখে তিনি জানালেন “আবুল হাসান ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ এর মার্চ এবং তারপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের E/7 রুমে বলতে গেলে আমার সঙ্গেই থাকত।“
৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে তিনি আমাকে রুমটার অবস্থান জানালেন—দোতলায়, পুকুরপাড়ের দিকে।
আরো জানালেন “ই ব্লকের প্রায় সবার সঙ্গেই হাসানের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ওখান থেকেই ‘৭৩ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি হাসান 'কাক' নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন বার করেছিল, তাতে ওর গল্প ছিল ‘অবনী ও অবশিষ্ট’।” ‘ইসরাইল খানের বরাতে জানতে পারি সুকান্ত চট্টোপাধ্যেয় সম্পাদিত ঢাকা মেডিকেল কলেজের অগ্রগামী গোষ্ঠী থেকে প্রকাশিত ১৯৭২ সালের একুশে সংকলন ‘উপদ্রুত পলাশে’ ‘অবনী ও অবশিষ্ট’ নামে আবুল হাসানের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। তবে, ‘কাক-এর কোনও সহ-সম্পাদক ছিল কিনা আমার ঠিক মনে পড়ছে না। হাসানের গোটা কুড়ি ডায়েরি আমার কাছে ছিল, হোস্টেল ছাড়ার পর সেগুলো জগন্নাথ হলে আমার এক পরিচিতের কাছে যত্নেই রাখা ছিল। ১৯৯২ সালের ঢাকার দাঙ্গার পর তিনি কলকাতায় পালিয়ে আসেন, মহামূল্যবান অপ্রকাশিত সেসব ডায়েরির কী গতি হয়েছে বলতে পারব না।’
প্রসঙ্গত, সালাহউদ্দীন জাকী ও ওমর শামসের লেখা থেকে সূত্র পেয়ে কাক নিয়ে বিশদ লিখেছি। কাকের প্রচ্ছদ জয়নুল আবেদিন করেছিলেন। নতুন সংস্করণে জয়নুলের সাথে হাসানের সাক্ষাতের কথাও আছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে জানালেন, 'ঝিনুক নীরবে সহো' সম্প্রতি হাতে পেলাম। পড়তে পড়তে বন্ধু আবুল হাসানের অনেক স্মৃতি মনে পড়ল। আবুল হাসান পাকাপাকিভাবে সুরাইয়া খানমের কাছে চলে যাবার আগে পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজে হস্টেলের ই/৭ রুমে আমার সঙ্গেই ছিল। আপনার অবগতির জন্যে একটি তথ্য জানাই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত আবুল হাসান কিন্তু তার নিজের হৃদরোগ সম্পর্কে অবহিত ছিল না। ঢাকা শহর তখন উত্তাল। সে সময় একদিন রাতে জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে আবুল হাসান ই/৭-এ ফিরে এল। আমার রুমমেট আব্দুস সালাম [মাসুদ আহমদ নয়] এবং সাইদুল ইসলাম একটা স্টেথোস্কোপ জোগাড় করে আনল এবং সেদিনই আবিষ্কৃত হল ওর হার্টে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। পরদিনই তাকে মেডিকেল ওয়ার্ডে ভরতি করা হল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর হস্টেল ফাঁকা হয়ে গেল। হাসপাতালে হাসানের দেখাশুনোর জন্যে আমি রয়ে গেলাম। ২৩ মার্চ সকালে আমার ধুম জ্বর এল, দুপুরে আলিয়া মাদ্রাসার পাশে পপুলার হোটেলে খেয়ে এসে অচেতনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে আর খেতে যাবার মতো অবস্থা ছিল না। পরদিন সন্ধের পর একটু সুস্থ বোধ করায় হাসপাতালে গিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই, সমস্ত ওয়ার্ড ফাঁকা। আবুল হাসানও চলে গেছে। মেডিকেল কলেজ থেকেই দৈনিক ইত্তেফাকের রাহাত খানকে ফোন করে জানতে পারি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সব আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁরই পরামর্শে আমি আর হস্টেলে ফিরে না গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে কমলাপুর স্টেশনে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাব বলে চিটাগাং মেল ধরি। পরবর্তী অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ।
পরে পাওয়া তথ্যগুলো অনুসারে বইতে হাসানের অসুস্থতার কালানুক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে হাসান নির্দিষ্টভাবে কোথাও থাকতেন না। একই সময়ে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথের হোস্টেলেও থেকেছেন, এসএম হলে তো ছিলেনই।
‘অনিন্দ্য’র শিবলী ভাই
আমার লেখার শুরু থেকেই কীভাবে যে অনিন্দ্য সম্পাদক হাবীব ওয়াহিদের [শিবলী ভাই] সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল তা মনে পড়ছে না। হয়তো স্বয়ংক্রিয় এই যোগাযোগ! উনি নিয়মিতভাবে লেখার খোঁজ খবর নিয়েছেন, আর কতভাবে যে সাহায্য করতে চেয়েছেন তার তালিকা করা সম্ভব না। কোন বই, কোন তথ্য, কোন ছবি কার কাছে পাওয়া যাবে, কার সাথে কথা বলে নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে সে সবের হদিশ দিতেন। বরং আমার পক্ষেই সব সূত্রের সাথে যোগাযোগ করা হয়ে উঠেনি। শিবলী ভাইয়ের দেয়া সূত্রগুলো খুঁজতে গেলে এই বই লিখতে আমার পাঁচ বছর সময় লেগে যেত! তিনি আমাকে বইয়ের ভেতরের অলংকরণের জন্য স্কেচ ব্যবহার করতে বলেছিলেন। আমি স্কেচের একটা তালিকাও করেছিলাম—অধ্যায় অনুসারে ৬৪ অধ্যায়ে ৬৪ টি স্কেচ! কিন্তু শেষবধি তাড়াহুড়ার কারণে সেটা আর করা হয়নি।
কিছুধ্বনি পত্রিকার আবুল হাসান সংখ্যাটির [ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬] কপি আনওয়ার আহমদের পুত্র নাজিম আনওয়ার রূপমের কাছ থেকে জোগাড় করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন। আমি রূপম ভাইয়ের কাছ থেকে কিছুধ্বনি সংগ্রহ করে এনেছিলাম। এটি ছিল আবুল হাসানময় এক ভাণ্ডার।
রাহাত খান কিছুদিন আগে মারা গেছেন। শিবলী ভাই বলতেন, রাহাত খান বেঁচে থাকলে উনি অনেক কিছু বলতে পারতেন আপনাকে। রাহাত ভাই আর নীনা ভাবী আবুল হাসানকে খুব ভালোবাসতেন। হাসানের গল্প লেখার সূত্রে দুজনের যোগাযোগ। নীনা ভাবী হাসানকে তার ঔষধ কিনে দিতেন। বাসায় ভালোমন্দ রান্না হলে হাসানকে বাসায় নিয়ে যেতেন।
আমি অসুস্থ হবার আগেই শিল্পী ভাই আমাকে খালিদ আহসানকে নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখিয়ে নিয়েছিলেন অনিন্দ্যের জন্য। সেই পত্রিকার কপি আমাকে হেলথ এন্ড হোপের বিছানায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেদিন করোনা থেকে সাবধানতার কারণে তিনি কেবিনে ঢোকেননি, তাঁর চেহারা দেখতে পাইনি, কণ্ঠ শুনেছিলাম।
'দক্ষিণায়নের দিন'
—শাহজাদা, তোর কাছে থাকতে এলাম!
—আমি যদি শাহজাদাই হই, তাহলে আপনি কবিতার রাজাধিরাজ! আপনার যতদিন খুশি থাকবেন।
[কাল্পনিক সংলাপ, ঝিনুক নীরবে সহো]
সেই থেকে মাস ছয়েকের জন্য আবুল হাসানের ঠিকানা হল ১১৩ সাউথ হোস্টেল, ঢাকা কলেজ। শিল্পী ধ্রুব এষ ‘ঝিনুক’ পড়ে হাসান হাফিজ ভাইকে আমার কথা বলেছিলেন। তিনিও আবুল হাসানের কবিতা নিয়ে কাজ করার সূত্রে আমাকে স্মরণ করেছিলেন মাস তিনেক আগে। আমি ‘ঝিনুক’ লেখার সময় আর হাসান হাফিজ ভাইয়ের কাছে যেতে পারিনি, যদিও সাখাওয়াত টিপুর কাছ থেকে ফোন নাম্বার জোগাড় করেছিলাম।
যাহোক, ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলে বাস করার সময়ই আবুল হাসানের যে তুমি হরণ করো প্রকাশিত হয়। কবি প্রায়ই গভীর রাতে ফিরতেন। কাজ করতেন প্রথমে গণবাংলায়, পরে জনপদ পত্রিকায়। অত রাতে ক্যান্টিন তো আর তাঁর জন্যে বসে নেই। হাসান হাফিজ ভাইয়ের পলিটেকনিকের বন্ধুদের আবিস্কৃত ইলেকট্রিক হিটারে কবি দুটো ডাল ভাত ফুটিয়ে খেতেন। লন্ড্রিতে গিয়ে ময়লা জামাটা ধুতে দিয়ে অন্য কারো একটা ধোপদুরস্ত জামা পরে বেরিয়ে যেতেন ফুটপাত বদল করার অভিযানে। দামি কাগজের এক তা'য় একটামাত্র লাইন লিখে মনঃপুত না হলে ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। আবুল হাসান, প্রিয় শাহজাদাকে ‘ভিতর বাহির’ [যে তুমি হরণ করো] নামের একটি কবিতাও উৎসর্গ করেছিলেন।
হাসান হাফিজ ভাইয়ের কাছে আরো এমন অনেক কিছুই শুনলাম যেগুলো আমার লেখাকে সমর্থন করে। আবুল হাসান যে পান খেতে পছন্দ করতেন তা আগে জানতাম না। তিনি খুব সাধারণ খাবার পছন্দ করতেন; হাসান হাফিজের ভাষায়, ‘জীবন ধারণের জন্য যেটুকু না খেলেই নয়, সেটুকুই খেতেন।’
লিখে রাখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির—কয়েকটি উদাহরণ
আবুল হাসান সম্পর্কে আর নতুন তেমন কিছু পাবার আশা নেই বুঝতে পেরে লেখাটা যখন গুটিয়ে আনছিলাম, আমি সে সময় শহীদ কাদরী আর আহমদ ছফার চরিত্র দুটো নিয়ে আরেকটু কাজ করি। আদনান সৈয়দের শহীদ কাদরী বিষয়ক বই, আল মাহমুদের স্মৃতিচারণ আর শঙ্খচিল পত্রিকার শহীদ কাদরী সংখ্যাটি শহীদ কাদরীকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। শহীদ কাদরীর মুখে সংলাপ বসাতে সুবিধা হয়েছে এই দুটি বই পড়ে। আহমদ ছফার সাথে বিউটি বোর্ডিংয়ের মিটিংয়ের কথা রফিক কায়সার ফোন করে জানিয়েছিলেন। সেই দৃশ্যে আমি নিজের বুদ্ধিতে আহমদ ছফার মুখে বাংলাদেশের রেনেসাঁস সম্পর্কিত কথাবার্তা বসালাম। বানানো কথাগুলো মিশে গেল সাখাওয়াত টিপুর সাক্ষাৎকার গ্রন্থ আর ছফার বাঙ্গালী মুসলমানের মন বইয়ের উদ্ধৃতির সাথে।
ডকুফিকশনটি লেখার বছরে আমি অন্যান্য যে সব বই পড়েছি, সেসব বইয়ের প্রভাবও পড়েছে। রফিক আজাদকে এনেছি তিনি আবুল হাসানের নামটা বদলে ভূমিকা রেখেছিলেন আর একজন মুক্তিযোদ্ধা কবির চরিত্রটি খুবই কাঙ্ক্ষিত ছিল বলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রে স্পেনের গৃহযুদ্ধে নিহত লোরকাকে নিয়ে আসি। লোরকা হাসানেরও প্রিয় ছিলেন। লোরকার মৃত্যুদৃশ্য হাসানের মৃত্যুর আগে তার স্বপ্নে চলে আসে, এটা চলচ্চিত্রের ভাষা থেকে এসেছে। চলচ্চিত্রের ভাষা থেকে আরও এসেছে নারিন্দার মসজিদে দেখা খাটিয়ার পৃথক পালঙ্ক হয়ে স্বপ্নে দেখা দেয়া। আরো একটি জায়গায় চলচ্চিত্রের ভাষা আছে, সেটা অন্যত্র বলব।
আবুল হাসান সূর্যোদয় দেখতে পছন্দ করতেন। লোরকার মৃত্যুদৃশ্যের স্বপ্নের ভয়াবহতায় বিধ্বস্ত হাসানের ঘুম ভাঙল মহাদেব সাহার বাসায়, মহাদেব তখন সূর্য পুজোর মন্ত্র পড়ছেন। হিন্দু ধর্ম শিক্ষার বই থেকে মন্ত্রটা বসিয়ে দিলাম, হাসানকেও শিখিয়ে দিলাম।
আসমা চৌধুরী আমাকে কবিতায় বরিশাল বইটি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, আবুল হাসানের প্রেমের কবিতাতেও এক ধরনের বৈরাগ্য আছে। আমি এই কথাটি সুরাইয়া খানমের খুবই আবেগময় একটা সংলাপে ব্যবহার করলাম। সুদীপ্ত হাননান আমাকে আহমদ ছফার গল্প সমগ্র আর ছফার উপন্যাস বিষয়ক বইটি পাঠান। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীর গল্পটি বাস্তব হিসেবে দেখানোর পটভূমি হিসেবে এই বইটি [আহমদ ছফার উপন্যাসের তাত্ত্বিক দিক] ব্যবহার করেছি।
গানের ধুয়া থেকেই পুরো গানটি নির্মাণ করার আনন্দ নিয়ে লিখেছিলাম পুরান ঢাকায় হাজেরা খাতুনের ঠুমরীর আসরের ঘটনাটি। গাজী আজিজুর রহমানের লেখা ‘কবিদের কবি’ বইতে পেয়েছিলাম হাসান যখন দশম শ্রেণিতে আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন, সে সময়ে হাজেরা খাতুনের ঠুমরির আসর থেকে ফিরে এসে কবিতা লিখে ফেলতেন। এইটুকু সূত্র ধরেই সেই গল্পটি লিখেছিলাম। সেখানে গল্পের অনুষঙ্গ হিসেবে বৈজু বাওরা চলচ্চিত্রের উল্লেখ, ঠুমরিতে রাধার বিভিন্ন অনুভূতির প্রকাশের উল্লেখ, ঠুমরির পৃষ্ঠপোষক লখনৌয়ের নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি।
ইসরাইল খান
ইসরাইল খান আমাকে সুরাইয়া খানম সম্পর্কে এন্তার তথ্য দিয়েছেন; তাঁর দেয়া তথ্য আমাকে সুরাইয়া খানমকে বাস্তবসম্মতভাবে নির্মাণে সাহায্য করেছে। আবুল হাসানের একুশে সংকলনে প্রকাশিত কবিতার ঠিকুজি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। সত্তর দশকে বেতার বাংলা বা আশির দশকে ঊষালোকে প্রকাশিত আবুল হাসানকে নিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন। অতটা কাজে লাগেনি, কিন্তু নিরন্তর পাঠিয়ে যাচ্ছিলেন। খোঁজ দিচ্ছিলেন কণ্ঠস্বর পত্রিকার একটি সংখ্যা আবুল হাসানকে উৎসর্গ করা হয়েছিল; সে সংখ্যায় ছাপা একটা গ্রুপ ছবি থেকে আমি একটা টুকরো গল্প পেয়ে গেলাম। পুরনো বিচিত্রার পাতার ছবি তুলে পাঠিয়েছেন। নিজের কাজে লাইব্রেরিতে গিয়ে তিনি আমার কাজে লাগবে এমন তথ্যের দিকেও দৃষ্টি রাখতেন। এ ছিল এক অতুলনীয় সহযোগিতা।
প্রশমন: নুরা পাগলা
কিছু কিছু ভিন্ন ধরনের রস না থাকলে এত দীর্ঘ কাহিনী পড়তে হয়তো বিরক্তিকর লাগতে পারে ভেবে হাইকোর্টের মাজারে নূরা পাগলার ঘটনা থেকে কিছু কিছু বিষয় এসেছে। ‘ঝিনুকে’র কাহিনীর প্রয়োজনেই দু তিনবার হাইকোর্টের মাজার এসেছে। কিন্তু নূরা পাগলার মাজারে বিদেশি মস্তানের আগমন ও অন্তর্ধানের নিউজ, নূরা পাগলার গ্রেফতারে তরুণ ভক্তদের নগ্ন হয়ে মিছিল করার হুমকি—এসব অতিবাস্তব দৃশ্যের অবতারনা এসেছে ১৫ আগস্টের পরের সময়টা লিখতে লিখতে নির্মলেন্দু গুণের জাতির জনক হারিয়ে নিঃস্ব ও বিভ্রান্ত বোধ করা, সেই সাথে সুরাইয়ার সাথে প্রেমের কারণে হাসানকে হারিয়ে বন্ধুহীন হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে জটিল একটা পরিস্থিতিকে প্রশমণ করার জন্য। সাথে ছিল আজম খানের উত্থানপর্বের টুকরো গল্প। এই পরিস্থিতির পরেই নির্মলেন্দু গুণ কিছুদিনের জন্য অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান। নূরা পাগলা আর আজম খান বিষয়ক তথ্যগুলো বন্ধুবর অমি রহমান পিয়ালের দেয়া। গভীর রাতে মেসেঞ্জারের বাক্সো উপচে পড়তো পিয়ালের পাঠানো স্ক্রিন শট, ছবি আর তথ্যে।
প্রচ্ছদ বিষয়ে কথা
আবুল হাসানের জীবনটি আমার মনের প্রেক্ষাগৃহে একটি শাদাকালো চলচ্চিত্রের মতো ভাসতো। তাই ঝিনুক নীরবে সহোর প্রচ্ছদ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম ষাটের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের পোষ্টার—দুই তিনটি এক রঙা পটের উপরে চরিত্রগুলোর শাদাকালো ছবি। এতে সেই সময়টা, অর্থাৎ ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সালের আবহটাও ভাল বুঝা যাবে। এ ধরনের প্রচ্ছদ করার জন্য রাজীব দত্তকেই উপযুক্ত মনে হল। আমি প্রকাশককে বিষয়টা জানালেও রাজীবের সাথে যোগাযোগ করলাম নিজেই। সেটাই তাঁর সাথে আমার প্রথম আলাপ। আমার চাওয়াটা বুঝিয়ে বলে প্রচ্ছদে আবুল হাসানের ছবি কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রাখার পর সাথে নির্মলেন্দু গুণ, আহমদ ছফা ও সুরাইয়া খানমকে রাখতে বললাম। শহীদ কাদরীর অল্প বয়সের ছবি পাচ্ছিলাম না দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর ছবি বাদেই প্রচ্ছদ শুরু হল। আমার ইচ্ছা ছিল ব্যাক কাভারে হাসানের সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁর সময়ের আরো পনের কুড়িজনের ছবিও যুক্ত হোক। রাজীবকে বিষয়টা জানালেও পরে আর এটা নিয়ে বায়না বা জোরাজুরি করিনি। রাজীব বললেন, আগে তাঁকে প্রচ্ছদের জন্য নামলিপি তৈরি করতে হবে। দ্রুততার সাথে নামলিপি তৈরি করে আমাকে দেখালেন। নিরবে বানানটির ক্ষেত্রে পরে কবির বানানরীতি গ্রহণ করা হয়। সেই নামলিপিটি এখন একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। হলুদ রঙের আধিক্যটি আমার অনুরোধে কমালেন। আমি কবিদের ছবি পাঠালাম। কিন্তু সব ছবি তো আর গ্রাফিকসে ভাল আসে না। রাজীব নিজেও কিছু ছবি খুঁজে দেখালেন। চারজনের মোটামুটি একই সময়ের ছবি। তিন রঙের পটভূমির উপর ছবিগুলো বসিয়ে দেখালেন। পটের রং যে কতবার বদলানো হয়েছে তাঁর ইয়ত্তা নাই। ধূমপানরত শহীদ কাদরীর ঘাড়ে হাত রাখা হাসানের ছবিটি শেষ প্রচ্ছদে ছাপা হল, চমৎকার এক গ্রাফিকস ভারসন, যার নিচে অবধারিতভাবেই ছাপা হয়েছিল আবুল হাসানের ছোট্ট কিন্তু অবিস্মরণীয় সেই কবিতা ঝিনুক নীরবে সহোর তিনটা লাইন।
আমি তখন রোগশয্যায়। একদিন দেখলাম আবুল হাসানের সাথে শহীদ কাদরীর একটি ছবি প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। রেক্সের সামনে। ছবিটা সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর তোলা। রাজীব শুরু থেকেই ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফটোগ্রাফার বা প্রকাশকের অনুমতির কথা বলে আসছিলেন। আর এই ছবিটা তো আমি বইয়ের ভিতরেও ব্যবহার করতে চাই। কাজেই অনুমতি নিতেই হবে। জাকী ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতির জন্য শাকুর মজিদ ভাইকে অনুরোধ করি। শাকুর ভাই জানালেন অনুমতি পাওয়া যাবে কিন্তু অরিজিনাল ছবিটা পাওয়ার দুরাশা করো না। আর প্রথম আলোর অনুমতি নেয়ার ব্যাপারটা দেরি হতে থাকে কেননা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ঘটনা নিয়ে সাজ্জাদ শরিফ ভাই তখন খুব ঝামেলায় ছিলেন। এর মধ্যে শাকুর ভাই জাকী ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানান উনি ছবিটা ব্যবহার হলে খুবই খুশি হবেন। মেসেঞ্জারে কথাবার্তার স্ক্রিনশটও পাঠান আমাকে। রাজীব শহীদ কাদরীর ছবিটিও গ্রাফিক্স করে প্রচ্ছদের নিচের দিকে বসিয়ে দেন। প্রচ্ছদের গায়ে ‘ডকুফিকশন’ লেখা থাকতে হবে এ ব্যাপারে আমি অনঢ় ছিলাম, কেননা সচতনভাবেই আমি চাচ্ছিলাম এই বইটিকে কেউ যেন উপন্যাস না মনে করেন। সিনেমার পোষ্টার হিসেবে আরো বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য রাজীব লিখে দিলেন ‘শ্রেষ্ঠাংশে কবি আবুল হাসান’। এটি আমার মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলেন কিন্তু আমার খুবই মনে ধরেছিল। দেখে খুশি হয়ে গেলাম। যেদিন ফাইনাল প্রচ্ছদটির ছবি পাঠিয়ে এআই ফাইল পাঠানোর জন্য ইমেইল এড্রেস চাইলেন, আমি তখন কেমোথেরাপির ক্যানুলা হাতে, নার্স এসে দাঁড়িয়ে আছেন কী একটা করবেন বলে, আমি ক্যানুলা দেয়া হাত নেড়েই টাইপ করছি—খুবই অসুস্থ তখন; রাজীবকে ‘না, না! আমাকে পাঠাবেন না, প্রকাশকের মেইলে পাঠান’ বলে তাঁকে নিরস্ত এবং অপ্রস্তুত করে দিলাম। সেদিনই প্রথম তাঁকে জানিয়েছিলাম যে আমার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে।
এই প্রচ্ছদ অনেকে অপছন্দ করলেন, অনেকে খুবই পছন্দ করলেন; কিন্তু যাঁরা অপছন্দ করেছিলেন তারাও ধীরে ধীরে পছন্দ করতে শুরু করলেন। শাহাদুজ্জামান বললেন, আবুল হাসানের মতো কবির জীবন নিয়ে লেখার সাথে হালকা ধরনের প্রচ্ছদ বেমানান। হাফিজুর রহমান বললেন, এটা কোনো প্রচ্ছদই হয়নি, বদলে ফেলা উচিত। তখন আমারও মনে হচ্ছিল প্রচ্ছদ আরেকটু গাম্ভীর্যময় হলে ভাল হত। ইমতিয়াজ মাহমুদ প্রথমে পছন্দ করেননি, বললেন চটকদার মনে হচ্ছে, কিন্তু রাজীবের নিশ্চয়ই এ নিয়ে আলাদা ভিশন আছে। পরে বললেন, প্রচ্ছদের আলাদা আকর্ষণের কারণে বইটা আরো একশোটা বইয়ের মাঝেও চোখ পড়বে আলাদা ভাবে।
রাজীবের দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা আর শৈল্পিক বিবেচনাবোধ অসাধারণ।
উৎসর্গ
ঝিনুক নীরবে সহো’র উৎসর্গ পাতায় আছে—
আরেক আবুল হাসান—
অকালপ্রয়াত কবিবন্ধু আমার
কামরুজ্জামান উবাইদুল্লাহর [১৯৬৬-১৯৯৩]
স্মৃতির উদ্দেশে
আমার বন্ধু উবাইদুল্লাহ। ক্লাস সেভেন থেকে এসএসসি পর্যন্ত একসাথে পড়েছি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। আমি ঈর্ষা করতাম ওর কবিপ্রতিভাকে। আমার তুলনায় সে পরিণত কবিতা লিখত ঐ বয়সেই। উবাইদুল্লাহ ছিল খুবই আবেগপ্রবণ, কোমল স্বভাবের ছেলে।
সুকান্ত আর তাঁর বন্ধু অরুণাচল বসুর চিঠির ভাষায় প্রভাবিত হয়ে [যেমন—প্রভূত আনন্দদায়কেষু, আশানুরুপেষু, কিংবা রেগে গেলে—অরুণ শর্মা ইত্যাদি সম্বোধন] কবিবন্ধু উবাইদুল্লাহর সাথে পত্রালাপ করতাম। আমরা ডাকযোগে নিজেদের হাতে লেখা পত্রিকা বিনিময় করতাম নিয়মিত। পাঠাতাম কবিতা, রম্য লেখা, নিজেদের ছবি। সে আমাকে কক্সবাজার সৈকতে বেড়ানোর ছবি পাঠিয়েছিল। এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে বছর তিনেক আমাদের এই পত্র যোগাযোগ ছিল।
কবিবন্ধু কামরুজ্জামান উবাইদুল্লাহর সাথে আমার অনেক পরিকল্পনা ছিল, স্বপ্ন ছিল। নাম ছাপানোর ছলে বার্ষিকীতে আলতামিরার গুহাচিত্র নিয়ে লিখেছিলাম যৌথভাবে, ইচ্ছে ছিল কোনো একদিন এক মলাটে কবিতার বই করব দুই বন্ধু মিলে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশুনা করছি, তখন সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায়। উবাইদুল্লাহর অনুবাদে রবার্ট হেরিকের ‘ড্যাফোডিলের প্রতি’ পড়ে প্রতিদিন ঝরে পড়া ফুলটির জন্য হাহাকার আরো বাড়ে—
তোমারি মতো আমরাও একদিন
ঝরে যাবো, পৃথিবীর ডালপালা থেকে।
যেমনি ভাবে—
অপেক্ষার প্রহরগুলো তোমার
চৈতের দাবদাহে বৃষ্টিকণার মতও
বিশোষিত হয় প্রতিদিন,
মুকতার মতও সকালের শিশিরগুলোও
হারিয়ে যায় চিরতরে
কখনও ওরা আর
আসে না তো ফিরে!
জানিয়ে রাখি, আমাদের দু জনেরই প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল অনিয়মিত সাহিত্য প্রকাশনা শেখ রফিক সম্পাদিত ডাহুকের পাতায়, ক্লাস নাইনে; আমার দুটি লিমেরিক [হবুচন্দ্র আসছে দেখে, পাবলোর ফড়িঙ] আর উবাইদুল্লাহর কবিতা ‘একুশ তুমি’। ক্যাডেট কলেজের সর্বশেষ কলেজ ম্যাগাজিনে আবারও একুশে নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ আছে, আছে কবিতাও। আমি লিখেছিলাম একুশে নিয়ে ইংরেজি কবিতা! উবাইদুল্লাহর মৃত্যু সংবাদ হয়ত তাঁর মৃত্যুর কিছু দিন পরে পেয়েছিলাম, আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শেষের ধাপে। দৈনিক পূর্বকোণে ‘কুমুর বন্ধন’ নামে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলাম, কিন্তু সেই লেখা আর পাওয়া সম্ভব হয়নি [কুমু ওর পরিবারদত্ত ডাকনাম ছিল কীনা নিশ্চিত নই, তবে ‘কামরুজ্জামান’-এর অপভ্রংশ হিসেবে আমরা এ নামেও ডাকতাম।]
দোহাই
দোহাই অর্থ রেফারেন্স, এটা সলিমুল্লাহ খানের লেখা থেকে পাওয়া। কিন্তু ‘ঝিনুক নীরবে সহো'তে রেফারেন্সের বদলে লিখেছিলাম তথ্যসুত্র ও ভাবনা সূত্র—এটা শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেলে’র আদলে। আমার বইয়ের বিবলিওগ্রাফির সাথেই নিজের বক্তব্য রেখেছিলাম—‘ক্রাচের কর্নেলে’র রেফারেন্স অংশের মতো করে—বিস্তারিত পাঠসূত্র ও ভাবনা সূত্র সাজানো হয়েছিল বইয়ের শেষে। তবে দ্বিতীয় সংস্করণে সামনে একটা ভূমিকা যোগ করাতে রেফারেন্সের সেই গঠনটা আর নাই। ‘ক্রাচের কর্নেলে’র বইটাও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সময়ের দাবিতে—কেননা ‘ঝিনুকে’র বিস্তার ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫; আর আগেই বলেছি সময় এই লেখায় নিজেই একটি চরিত্র। রেফারেন্সের ক্ষেত্রে অল্প অবদানগুলোকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখার একটা চেষ্টা আছে। উদাহরণস্বরূপ, একাত্তর সালে বিজয়ের আগে আগে বিমান হামলার সময় আবুল হাসান কলাবাগানে শাহাদাত বুলবুলের মেসে ছিলেন। বিমান হামলা মাথায় নিয়েই হাসান জায়গা বদল করছিলেন। এই লেখাটুকু পড়ে আমার বন্ধু মহাকাশ মিলন জানিয়েছিলেন যে একাত্তর সালে তারা কলাবাগানেই থাকত। পশ্চিম আকাশে একটা প্লেনের দগ্ধ ডানা দেখার স্মৃতি তার মনে আছে। আমি এই লাইনটা দিয়ে অধ্যায়টা শেষ করলাম। বইয়ের রেফারেন্স অংশে মিলনের কথাও থাকল। যে সকল বই, পত্রপত্রিকা, দলিলপত্র, অনলাইনের লেখা, ফেসবুকের পোস্ট ইত্যাদি থেকে তথ্য ও সুত্র পেয়েছি প্রায় সবগুলোই বইয়ের রেফারেন্সে লিখে ঋণ স্বীকার করেছি। বইপত্রের ক্ষেত্রে কবির জীবনের উপাদান আছে এমন আর কবির সময়কে ধারণ করেছে এমন বইগুলোর আলাদা তালিকা করা আছে। যাদের কাছে ছোট বা বড় সাক্ষাতকারের মাধ্যমে তথ্য পেয়েছি, তাঁদের কথা তো লিখেছিই।
নামকরণ প্রসঙ্গে
ক্যাডেট কলেজে ‘ডাহুক’ নামে একটি ‘অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশিত হত। আমাদের সময়ে দু তিনটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। সাইক্লোস্টাইলে ছাপা, প্রচ্ছদে চারুকলার শিক্ষক তৌফিক হোসেন চৌধুরী স্যারের বিমূর্ত নির্মেদ কাজ—ভাবতাম সেটা পাখিও হতে পারে, মশালও হতে পারে। প্রথম পাতায় সাহিত্যের প্রাক্তন শিক্ষক আবদুল্লাহ আল-আমিন স্যারের লেখা ‘নামকরণ প্রসঙ্গে’ ছাপা হয়েছিল। সেখানে ডাহুক একটি নির্জনতা প্রিয় জলাশয়ের পাখি উল্লেখ করে ক্যাডেটদের সাথে দারুণ উপমা দিয়েছিলেন। ডাহুক, পাখির মেলায় অপাংক্তেয় থেকে নির্জনে ধ্যানস্থ অবস্থায় মাঝে মধ্যে গোপন সাধনার দ্যুতির স্ফুরণ ঘটায়। তখন থেকেই বুঝতে শিখেছি, কোনো সাহিত্যকর্মের নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চূড়ান্ত একটা শৈল্পিক বিষয়।
আমি যখন ব্যাংকের চেক বই বা অফিসের কেজো পৃষ্ঠার বাইরে অন্য কোথাও আমার সাক্ষর দিই, সেখানে অবধারিতভাবেই একটি ঝিনুক এঁকে দিয়ে আসছি অনেক বছর ধরে। আমার পক্ষে ঝিনুক আঁকা সহজাত; কিন্তু ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ নামের কবিতাটি লেখা আবুল হাসানের জন্যে ছিল লোনা সাগর সেঁচে একটা বেদনার ক্রিস্টাল গড়ার মতো শৈল্পিক কাজ। আমি শুনেছি কবি আবুল হাসান ‘ঝিনুক নী]রবে সহো’ কবিতাটি তাঁর কোনো এক দুঃখী বোনের সহনশীলতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন। ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ আবুল হাসানের একটি ছোট্ট কিন্তু স্মরণীয় কবিতা। কিন্তু আমার বইয়ের নামকরণটি অত সহজেই নির্ধারণ করা যায়নি। বইটির নামকরণের জন্য আবুল হাসানের ‘আবুল হাসান’ শিরোনামের অসাধারণ কবিতার ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে’ এই লাইনটি ছিল মাথায়। এখান থেকে ‘লাব্যণ্যময় পাথর’, ‘সে এক লাবণ্যময় পাথর’ নামগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে। একবার ‘লাবণ্য পাথর’ শিরোনামে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেয়াতে কবি ও শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বললেন এখানে ব্যাকরণগত ত্রুটি হচ্ছে। এছাড়াও ‘কবিতার রাজপুত্র’, ‘রহস্য প্রধান এলাকা’, ‘গোলাপের নিচে নিহত কবি’ এই শিরোনামগুলোও বিবেচনায় ছিল। কিন্তু ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ নামটির মধ্যে আবুল হাসানের বেদনার্ত জীবনের নির্যাস আরো পরিস্কারভাবে ফুটে ওঠে বলেই মনে হয়েছিল। বইটির নামকরণে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই, এ যেন গঙ্গার জলে গঙ্গা পূজো।
‘লিভিং ডকুমেন্ট’
যখন বুঝতে পারলাম আপাতত আবুল হাসান সম্পর্কে আমি আর তেমন নতুন কিছু পাব না, তখন আস্তে আস্তে লেখাটির জাল গুটিয়ে আনতে থাকলাম। এই সময়েই আমার কর্কট রোগটি শরীরে জাল বিছাচ্ছিল। আমি বইটির দ্রুত সমাপ্তি টেনে দেয়ার পক্ষপাতী ছিলাম।
আমি এক মাসের মতো পাণ্ডুলিপিটা ফেলে রাখলাম। ক্রাচের কর্নেল, একজন কমলালেবু, নভেরা ও সুনীলের প্রথম আলো পড়তে শুরু করলাম। পাশাপাশি গালিবের জীবনভিত্তিক উপন্যাস শামিম আহমেদের ‘কোলকাতায় গালিব’ পড়লাম। জীবনভিত্তিক উপন্যাস লেখার করণকৌশল দেখার উদ্দেশ্যেই বইগুলো পড়ছিলাম। কোনো ফরমুলা পেয়ে গেলে শেষবার সম্পাদনার সময়ে প্রয়োগ করব—এরকমটাই ভাবছিলাম। গালিবের দুই সত্ত্বায় বিভক্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে শামীম আহমেদের কাজটা পছন্দ হল। আবুল হাসানকেও কিছু সিদ্ধান্তের জায়গায় দ্বিধাবিভক্ত করে দিলাম। ক্রাচের কর্নেলের রেফারেন্সিং এর কৌশলটি পছন্দ হল।
‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখা শেষ করার পরপরই চিকিৎসকগণ আবিষ্কার করলেন বাস্তবে আমি আমার নিজের মস্তিষ্কের কুঠুরিতেও মুক্তার চাষ করে বসে আছি! তখন আমি কিছুদিনের জন্য চোখে দুটি ছবি বা দুটি অক্ষর দেখতে শুরু করলাম। ডাক্তার আমার বাম চোখের চশমার কাচটি ঘোলা [ফ্রস্টেড] করে দিলেন। পাণ্ডুলিপি নিয়ে আর কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। লম্বা উদ্ধৃতিগুলোর একটা অংশ নিজের ভাষায় লিখার ইচ্ছা ছিল, সেটা আর সম্ভব হল না। আর সঙ্গত কারণেই আমার লেখালিখির অন্যতম মূলমন্ত্র শামসুর রাহমান কথিত ‘সংহত কর বাক, থামাও প্রগলভতা’র জায়গায় সুবিচারের অভাবে কিছু প্রগলভতা হয়তো রয়ে গিয়েছিল।
নতুন সংস্করণে সেসব কাটিয়ে উঠবার একটা প্রচেষ্টা ছিল। সেই সাথে কিছু নতুন পাওয়া বাস্তবভিত্তিক গল্পের আঙ্গিকে আবুল হাসানের ব্যক্তিত্বের নতুন কিছু দিক সংযোজন করা হয়েছে, নতুন বই ও পত্রিকার রেফারেন্স যুক্ত হয়েছে। যেমন, একদিন কাটাবনের ‘প্রকৃতি’তে গিয়ে সুব্রত বড়ুয়ার সাথে দেখা হতে তাঁর মুখে একটা হীরের টুকরো গল্প পেয়েছিলাম। আবুল হাসানের জার্মান শিল্পীবন্ধু রাইনহার্ট হেভিকের একটি কুড়ি পৃষ্ঠার জার্মান পাণ্ডুলিপি অবলম্বন করে স্টিফেন মার্সিনিয়াকের পাঠানো নতুন কিছু তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত পাণ্ডুলিপিটি আগাপাশতলা দেখে দিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ।
আমার মনে হয় ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ কবি আবুল হাসানের মতোই একটি চিরসবুজ দলিল বা লিভিং ডকুমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবারও নতুন সংস্করণ হলে তা আবারো নতুন একটা বইই হবে।
দারুণ লাগলো
কাজী তাপস
জুলাই ২৩, ২০২৩ ১৮:৪৪