অনিশ্চিতিতেই শুরু, আর শেষ দ্বন্দ্বে
একাশ্রয়
আহসান হাবিব
প্রকাশক: পানকৌড়ি প্রকাশন
প্রচ্ছদ: সায়েম রানা
প্রকাশকাল: ২০২০
মূল্য: ৫০০ টাকা
একাশ্রয় বইটির লেখক আহসান হাবিব। এটি তার প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসের নায়ক আকাশ একজন মধ্যবিত্ত। সে বাসা ভাড়ার জন্য শহরে হন্যি হয়ে ঘুরছে। ‘টু-লেট’ দেখে সে একটি বাসায় মালিকের কাছে ভাড়া চায়। ব্যাচেলর জেনেও মালিক বাসা ভাড়া দেওয়ার জন্য রাজি হয়। বাসা ভাড়ার অগ্রিমও নেয়। কিন্তু সন্ধ্যেয় বাসায় ওঠার জন্য গেলে বাড়িওলা বাধ সাধে। অগ্রিম টাকা ফেরত দিয়ে বলে, দুঃখিত আপনাকে বাসা ভাড়া দেওয়া যাবে না। কারণ ব্যাচেলরকে বাসা ভাড়া হয় না। এমন ঘটনায় স্তম্ভিত আকাশ কথা বাড়ায় না। এক অনিশ্চিত জীবন দিয়েই উপন্যাসের কাহিনির শুরু হয়।
লেখক সহজ ভাষায় উপন্যাসের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন এক জীবনের কষ্টের পয়ার, মহাপয়ার ও বেদনার ঘন সন্নিবদ্ধ এক একটা ভাঁপর টেনে টেনে। সংকটের আঁটোসাটো চার দেয়ালের গণ্ডি না মেপে, সৃজনশীলতার এক মহার্ঘতায় ঘিরে কাহিনিকে চালান করে দিয়েছেন বোহেমিয়ান এক জীবনের অতল সুরে। সুদূর শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত এক সময়কে মিউজিয়ামে নিটোল কাচের বলয়ে বেঁধে রাখা পিসের মত শব্দের সজ্জাময়। কাহিনির টানটান উত্তেজনায় ভরপুর উপন্যাস এটি। উপন্যাসের দ্বিতীয় গুণ—বলবার ভঙ্গি, ভাষার কোমলতা, গোছানো ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা। যা কথার প্রাচীর দিয়ে পাঠককে আবষ্টি করে রাখে।
একাশ্রয় উপন্যাসের নায়ককে মনে হয়, জগত-সংসারের সবচেয়ে পরিণত কোন এক মানুষ। একই সঙ্গে দুর্ধর্ষ যুক্তিবাদী, আর অতিনম্র ভাবালু প্রেমিক—যে পোড়ে বুদ্ধির ঝাঁজে! বাহুবল ক্ষাত্রবীর্য, বীরভোগ্য বিধি বিড়ম্বিত—যেন সব কিছুতেই সর্বেসর্বা হবার পরেও হতভাগা সে। একেই বুঝি বলে ‘বেদের মহিমা ঠেকে সপ্তরথী ব্যুহে অপৌরুষ’ লেখকের কলমে উঠেছে এক বিষণ্ন অবিশ্বাসের কাহিনি, আর্তি উঠেছে অসম্পূর্ণতার। পিতা হয়ে ওঠার, বোধ করি, ‘বাবা সর্বস্ব’ হবার দায় রয়ে গেছে ঘটনা প্রবাহে। সেই গভীর ঋণ পালন করতে চাইলেও তো পারে না কেউ কেউ। গভীরভাবে চেয়েও পায়নি সে। সব দায়কে চাইলেও যেমন পাশকাটিয়ে ফেরা যায় না, তেমনি ফেলা যায় না অতীত জীবনের সাথে জড়িত পরিবার-পরিবেশকে—বোনের মৃত্যু, শৈশবের বন্ধু হাটখোলা, মাছধরা, গাছে গাছে ঢিল ছোড়া, সাইকেল দৌড়, শিশির ভেজা, ঠাণ্ডায় জমাট হাতের তালু, ঘাসের পোকা ফড়িং, আধহাঁটু জলে পাটক্ষেতে হাঁসের জলকেলি।
‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’—সংসারে আসে মৃত্যুর নিজস্ব এক শ্বাসরুদ্ধ করা শোক। বোনকে হারিয়ে শূন্যস্থানের সেই হাহাকার যেন বুকের খাঁচায় ডানা ঝাপটানো পাখি কান্না কেঁদে ফিরে। লেখক বলেন, ‘কিছুই শোকের মত শুদ্ধ নয়।’ ‘কিছুই শোকের মত দ্রষ্টা নয়’—এই সত্যটাই মেনে নিয়ে পথ চলা স্মৃতির হাতছানিকে উপেক্ষা করে। মানুষের জীবনে শোক নানা প্রকার। কিন্তু বিচ্ছেদের শোক সবচেয়ে প্রকট। জীবনকে শোক নির্লিপ্ত করে বিবশ সন্ধ্যার মতন। যেমন হা হা করা প্রশ্ন তোলে, মনে কি আশায় দাঁড়িয়েছি শূন্য হাত মেলে? তখন কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না।
লেখক যেন জীবনের অলংকৃত জীবনী এঁকেছেন অধ্যায়ে অধ্যায়ে। কথাগুলো তো নিজেরই অজান্তে মানুষের নিয়তি-অক্ষর রচনা করেছেন লেখক। এভাবেই কষ্টের জীবন যাপিত-ঐতিহ্যের প্রান্তসীমায় নিজেকে বসিয়ে রাখেন, আর বোঝেন নিজ স্থানটিকে, যে দর্শন, যে চোখ দুটি একেবারে নিজস্ব চিন্তার ছলে। পিছল পৈঠায় পড়ে ঘট যেমন ভেঙে যায়, ঠিক যেন হুট করেই সংসারটা ভেঙে গেল। এতদিনের সংসারের একটি পূর্ণায়ত গানের মত গমক-ঠমক, ব্যঞ্জনা—যা রপ্ত করেছিল, আজ যেন সব অনর্থক! কিন্তু না পরক্ষণেই কাহিনির নায়ক গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েছেন তার গায়কী অস্তিত্ব, সাংসারিক অস্তিত্ব, তার পিতৃত্বের অস্তিত্ব নিয়ে। কারও সন্তানের অস্তিত্ব আসলে সৃজনশীল অস্তিত্বের সঙ্গে কোথাও বেজোড় নয়, বেমানান নয় মোটেও। তবুও রিক্ত হতে হচ্ছে কেন?
লেখক যেন জীবনের অলংকৃত জীবনী এঁকেছেন অধ্যায়ে অধ্যায়ে। কথাগুলো তো নিজেরই অজান্তে মানুষের নিয়তি-অক্ষর রচনা করেছেন লেখক। এভাবেই কষ্টের জীবন যাপিত-ঐতিহ্যের প্রান্তসীমায় নিজেকে বসিয়ে রাখেন, আর বোঝেন নিজ স্থানটিকে, যে দর্শন, যে চোখ দুটি একেবারে নিজস্ব চিন্তার ছলে। পিছল পৈঠায় পড়ে ঘট যেমন ভেঙে যায়, ঠিক যেন হুট করেই সংসারটা ভেঙে গেল।
তবে কিছু জিনিস লেখক এখানে ধোঁয়াশা করে রেখেছেন। কেন শিপ্রার সঙ্গে এতটা মনোমালিন্য কেনইবা অনিচ্ছা সত্বেও বাসা ছাড়তে হচ্ছে। বুঝলাম বৈবাহিক বিচ্ছেদ। কেন এই বিচ্ছেদ? কারণ নিয়ে যদি একটু গভীরে যেতেন তবে গল্পটি আরও প্রাণ পেত। এমনকি সংসার কেন ভাঙছে? কিসের অপারগতা? কিসের অভাববোধে? আর ভাঙা পরিবারের শিশুর দুর্গতিগুলোইবা কেমন? যখন কিনা সন্তানদের জিজ্ঞেস করা হয়, কাকে বেছে নেবে মা নাকি বাবা। একটি শিশুর উপরে কতটা মানসিক চাপ দেয়া হয় যে সারা জীবন এই গ্লানি নিয়েই হয়তো পার হতে হয়। যদিও ধরেই নিচ্ছি, একটি সৃজনশীল জ্ঞান পিপাসু মানুষকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে এই পরিবারটিতে। সাথে এটাও উপলব্ধিত যে আকাশের রোজগার কম স্ত্রীর চেয়ে। রাশি রাশি উদাহারণ সমাজে আছে। মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পায় পারিবারিক নমনীয়তার কারণে। সংসারে অনেক চাকুরীজীবি নারী পুরুষের চেয়ে বেশি আয় করেন। এটাই বুঝলাম, আকাশ আর শিপ্রার দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ। মা যেহেতু বাড়িটি সামলান, ভালো আয় করেন, সেই তুলনায় বাবাটা বেজায় ভালো এবং কেয়ারিং হলেও সমাজ বাস্তবতার দৈনন্দিনতায়, বেছে নেবার ভাষ্যটি উদগ্র হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কাছে, অর্থ সংকটাপন্ন সংগ্রামী জীবনের কাছে। বেছে নিতেই হয় অর্থ ও ক্ষমতার দিকটা। সন্তানকে ছেড়ে দিতে হয়ে বাবার হাতটাও।
লেখক কল্পনাকে বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি দূরে কোথাও কোথাও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। হুট করে নারী সাক্ষাতেই কুপোকাত ব্যাপার অনেকটা চারিত্রিক স্খলন ও ব্যক্তিত্বহীনতার ইঙ্গিত বহন করে। পাঠক মনে করতেই পারেন, হয়ত এমন একটা দূষিত গুণ আকাশের আছে, যে কারণেই সংসারটা ভেঙে যাচ্ছে। কারণ শিপ্রার মনোভঙ্গির কোনো ব্যাপারই এখানে উল্লেখ করেননি লেখক। এই জায়গাটাতে একটু সংহত হতে পারতেন। বুঝলাম, ভাঙা ঢোলে সুযোগ পেলে সবাই এক আধবার বারি মারে। আকাশের মন ছিল উদাস শূন্য কলসের মতো। তবে কি লেখক নারী সম্মান দেখাতে গিয়েই শিপ্রা চরিত্রের ভাঁজ খোলেননি। কখনো কখনো এসব অতিরেকের বিপুল আয়োজন পাঠক মনকে একটু থমকে দেয়। গবেষণার ভিত্তিতে উপন্যাস নির্মাণের যে বিশিষ্টতা অর্জন, তার দিকেই কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিতে পারে অনেকের কাছে। তবুও বলছি, কিছু বই মলাটের ভেতরে বন্দি থাকে, থেকে যায় তাদের নিজস্ব বলয়ে, নিজের পৃথিবীতে, অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডের মত—একাশ্রয়ও তাই।
কিছু অতিরেক সত্ত্বেও ‘একাশ্রয়’ একটা ভাল উপন্যাস। সমকালীন রাজধানী ঢাকাতে ব্যাচেলরদের রেন্টাল অভিজ্ঞতা ভালো নয়। বাসা পেতে জুতোর তলা ক্ষয় করতে হয়। যা আকাশের ভাড়া বাসা সন্ধানে টু-লেট সাইবোর্ডে চোখ ও হৃৎপিণ্ড আটকে থাকার আকুতিতে টের পাওয়া যায় উপন্যাসের আদিতেই। ব্যতিক্রম এ সংকটের পথ ধরেই কাহিনির পাতা বাড়তে বাড়তে একটা আস্ত উপন্যাস হয়ে ওঠে একাশ্রয়। প্রথম প্রথম একই রুটিন মেনে রোজকার বের হওয়া, রাস্তায় রাস্তায় টু-লেট দেখা কিছুটা নিষ্প্রাণ ও স্থবিরতায় একঘেয়ে হয়ে রইল। কিন্তু পথের এই টু-লেট থেকেই ঘটনা পরম্পরার অতি নাটকীয়তা শুধু যে বিশ্বাসের বাস্তবতাকে আঘাত করে তাই নয়, সংকট মুহূর্তে চরিত্রদের আচার-আচরণ ও দীর্ঘ বচনগুলোও অবিশ্বাস্য মনে হয়। মাঝে মাঝে ঘটনা গতি হারিয়ে একই জায়গায় পুনরাবৃত্তি ঘটে, ফলে কাহিনি কোথাও কোথাও আলগা লাগে। কিন্তু ঘটনা চলতে থাকে—কখনো রিক্সার চাকার ঘূর্ণনের মতো, আবার কখনোবা বাসের চাকার গতির মতো। তবে উপন্যাসটি অনিশ্চিতি দিয়ে শুরু আর শেষ হয় দ্বন্দ্বে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন