রজনীকান্ত সেনের ফানা

অ+ অ-

 

এক

বাংলা সাহিত্যের পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন দুইটি দুঃখ নিয়ে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম দুঃখটি হলো, তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ দেখে যেতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ রহিতের এক বছর আগে ১৯১০ সালে তিনি মারা যান। দ্বিতীয় দুঃখটিও সকরুণ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় শিয়রে বসা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিজ কণ্ঠে গান শোনাতে পারেননি। কারণ, কণ্ঠনালীর ক্যান্সারে মৃত্যুর সাত মাস আগে তিনি বাকহারা হন। হাসপাতালে রবীন্দ্রনাথকে রজনীকান্তের লেখা গান গেয়ে শোনান তাঁর ছেলে ক্ষিতীন্দ্র ও মেয়ে শান্তিবালা। আর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং হারমোনিয়াম বাজান।

বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীত-সম্রাট হিসেবে বিবেচিত, তাদের বলা হয় পঞ্চকবি। রজনীকান্ত সেন সেই পঞ্চকবির একজন। অন্যরা হলেনরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১], কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬], দ্বিজেন্দ্রলাল রায় [১৮৬৩-১৯১৩], অতুলপ্রসাদ সেন [১৮৭১-১৯৩৪]।

ঈশ্বর ভক্তি ও স্বদেশ প্রেম রজনীকান্তের কবিতা ও গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য, মূল উপজীব্য। পরমের আরাধনা ও স্বদেশী আন্দোলন মুখর অভাবিত প্রতিভার অধিকারী রজনীকান্তের জীবন ছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরের। এই স্বল্পায়ু জীবনের পরতে পরতে ছিল মৃত্যুশোক, বিপর্যয় আর অসুখের শারীরিক যন্ত্রণা। একেরপর এক স্বজনের মৃত্যু, অর্থনৈতিক ধাক্কা আর ব্যাধি ছিল তাঁর জীবন জুড়ে। নয় সন্তানের মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ের মৃত্যু হয় তাঁর জীবদ্দশায়।

রজনীকান্ত সেনের জন্ম ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার বেলকুচির ভাঙাবাড়ি গ্রামে। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ও মা মনোমোহিনী দেবীর তৃতীয় সন্তান তিনি। গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। মনমোহিনী দেবীও সঙ্গীতানুরাগী। রজনীকান্তের শিক্ষা, কর্ম ও সাহিত্যচর্চার ডেরা রাজশাহীতে। তাঁর জ্যেঠামশাই গোবিন্দনাথ সেন ছিলেন রাজশাহীর নামকরা উকিল। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন নিম্ন আদালতের বিচারক বা মুন্সেফ। পরে সাবজজ হয়েছিলেন।

রজনীকান্তের লেখাপড়া শুরু হয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে এন্ট্রান্স [১৮৮৩], রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ [১৮৮৫] এবং কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বিএ [১৮৮৯] ও বিএল [১৮৯১] ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করেই রাজশাহী কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। কিছু দিন তিনি নাটোর ও নওগাঁয় অস্থায়ী মুন্সেফ ছিলেন।

ছোটবেলায় রজনীকান্ত ছিলেন দুরন্ত, ডানপিটে। পড়ালেখা করতেন না একদমই। তবে শৈশব থেকে তাঁর অসাধারণ একটি গুণ ছিল, যেকোনো গান শুনেই তার সুর, তাল আয়ত্ত করতে পারতেন।

অসুস্থতার কারণে রজনীকান্তের বাবা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চাকরি ছেড়ে দেন। জ্যেঠা গোবিন্দনাথও ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তখন তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারের হাল ধরেন জ্যেঠার দুই ছেলে বরদাগোবিন্দ ও কালীকুমার। রাজশাহীতে তাঁরাও ছিলেন দুঁদে উকিল। হঠাৎ অসুখে দুই ভাই মারা যান। এর কিছুদিন পর বরদাগোবিন্দের শিশুপুত্র কালীপদ ও রজনীকান্তের ছোটভাই জানকীকান্তের মৃত্যু হয়একজন কালাজ্বরে, আরেকজন কুকুরের কামড়ে।

এরপর ঘটে পারিবারিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়। সেন পরিবারের বিপুল টাকা এক কুঠিতে লগ্নি ছিল। সেই কুঠি দেউলিয়া হলে রজনীকান্তের পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ বয়সে সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে জ্যেঠা বরদাগোবিন্দ আবার ওকালতি শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই রজনীকান্তের বিএ পরীক্ষার আগে ও পরে বাবা এবং জ্যেঠারও মৃত্যু হয়।

রজনীকান্ত ১৮৯১ সালে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন। কিন্তু রুজি-রোজগারে তাঁর তেমন মনোযোগ ছিল না। ধ্যান ছিল কবিতায়-গানে-নাটকে, পরমার্থের খোঁজে। মোকাম ছেড়ে তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটত কবিতা লিখে, গান গেয়ে আর নাটক করে। সংসার চালাতেন জ্যেঠতুতো দাদা উমাশঙ্কর সেন। কিন্তু বছর কয়েক পরেই উমাশঙ্করের ক্যান্সার ধরা পড়ে। অনেক টাকা খরচ করেও উমাশঙ্করকে বাঁচানো যায় না। দেনার দায়সহ সংসারের সমস্ত ভার চাপে রজনীকান্তের ওপরে। ঠিক তখনই তাঁর জীবনে আসে সেই দুঃসহকাল। পর পর দুবছরে তাঁর দুই সন্তান ভূপেন্দ্রনাথ এবং শতদলবাসিনী মারা যায়।

অটল ঈশ্বর ভক্ত রজনীকান্তের জীবনে একের পর এক এভাবে নেমে আসে দৈবরূপ আঘাত। আঘাত তাঁকে আরও দশাপ্রাপ্ত করেছে। গানের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে তিনি অতিক্রম করেছেন সকল শোক। যে ঈশ্বর তাঁকে আঘাত দিয়েছেন, সেই পরমাত্মার কাছেই নিজেকে নিঃশর্ত সমর্পণ করেছেন তিনি। শতদলবাসিনী যখন মারা যায়, সন্ধ্যায়, বাইরের ঘরে এসে হারমোনিয়াম নিয়ে কবি অবিরাম গেয়ে চলেন

আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তা কিছু নাওনি।

তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ, প্রতিদান কিছু চাওনি।

মৃত্যুশোক আর বিপর্যয় ভরা রজনীকান্তের শেষ জীবনও কেটেছে ক্যান্সারের দুঃসহ শারীরিক যন্ত্রণায়। ১৯০৬ সালে ৪১ বছর বয়স থেকে রজনীকান্ত অসুস্থ হতে থাকেন। ১৯০৯ সালে তাঁর গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। কলকাতায় অনেক চিকিৎসা করে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। রজনীকান্ত তখন পরমের কাছে আরোগ্য লাভের আশায় চলে যান বারাণসীতে। কয়েক মাস সেখানে কাটান। এ সময় চিকিৎসা খরচ চালাতে বাণী এবং কল্যাণী বই দুটির স্বত্ব বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি। বারাণসী থেকে তাঁকে এনে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গলায় অপারেশন করে কোনোমতে বেঁচে যান, কিন্তু চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর গানের কণ্ঠ। গলায় ফুটো করে নল লাগিয়ে শ্বাস নিতে হতো তাঁকে। মাস সাতেক হাসপাতালে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে ১৯১০ সালে ১৩ সেপ্টেম্বরে মারা যান তিনি।

 

দুই

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কান্তকবি স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর প্রেম ও ভক্তিমূলক কবিতা, গানের জন্য। পরমাত্মার প্রতি অগাধ প্রেম, বিশ্বাস ও আস্থা প্রতিফলিত হয়ে তাঁর গানকে পরম দার্শনিকতায় স্বাতন্ত্র্য করেছে। জীবনের সমস্ত আনন্দে তিনি স্রষ্টাকে স্মরণ করেছেন। সমস্ত যাতনাকে গ্রহণ করেছেন ঈশ্বরের আশিষ রূপে। পুত্রের বিয়োগ ব্যথাও তাই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে কবিতা

তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দু নয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হাহারব।

স্রষ্টার প্রেমে সমর্পণে বিনয়ের সর্বোচ্চ নিদর্শন রজনীকান্ত। তাঁর গানে আত্মনিবেদনের তূরীয় আকুতি জীবাত্মাকে বিলীন করেছে পরমাত্মায়। যে কারণে তাঁর ভক্তিমূলক গান প্রার্থনারূপে এখনও গাওয়া হয় হয় উপাসনালয়ে।

তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে,
জানি না কখন ডুবে যাবে কোন অকুল-গরল-পাথারে!
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা, তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর মত্ত-বাসনা ঘুচায়ে!

আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া, বসে, আঁধারে মরি গো কাঁদিয়া
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু, দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।

তাঁর সমস্ত গানের ছত্রে ছড়িয়ে আছে পরম জীবনের এই আকুতি। বৈসয়িক লাভ-নির্মোহ রজনীকান্ত নিয়ত সাধনা করেছেন পরমাত্মার। জগতের সাফল্যের পিছে ছোটার প্রতিযোগিতাকে তুচ্ছ করে তিনি পরমার্থে জাগাতে চেয়েছেন জীবনকে।

ওরা চাহিতে জানে না, দয়াময়
ওরা চাহে ধন জন আয়ু আরোগ্য বিজয়
করুণার সিন্ধু কূলে বসিয়া মনের ভুলে
এক বিন্দু বারি তুলে মুখে নাহি লয়

তীরে করি ছুটাছুটি, ধুলি বাঁধে মুঠিমুঠি
পিয়াসে আকুল হিয়া আরো ক্লিষ্ট হয়
ওরা চাহিতে জানে না, দয়াময়।

তাঁর অগ্রজ সাধক কবি লালন [১৭৭৪-১৮৯০] যেমন বলেছেন দিন থাকতে দিনের সাধন কেন জানলে না/ সময় গেলে সাধন হবে না।লালনের অবতাররূপে রজনীকান্তও গেয়েছেন

জাগাও পথিকে, ও সে ঘুমে অচেতন
বেলা যায়, বহু দূরে পান্থ নিকেতন।
থাকিতে দিনের আলো
মিলে সে বসতি ভালো
নতুবা করিবে কোথা যামিনী যাপন।

কঠিন বন্ধুর পথ
বিভীষিকা শত শত
তবু দিবাভাগে নিদ্রাগত
একি আচরণ।

জীবের সকল যন্ত্রণা ভোগ করে বৈষ্ণব রজনীকান্ত একইসাথে ছিলেন পুবদেশের যিশু! পরমাত্মার প্রেমে ফানা রজনীকান্ত তাঁর অবর্ণনীয় শারীরিক যন্ত্রণা আর দুঃসহ শোকের শুচিতে নির্মল-মঙ্গল করেছেন মোটা কাপড়ের স্বদেশ। ভক্তি-প্রেম-সমর্পণ আর দুঃখ-রোগ-শোক সর্বংসহা রজনীকান্তকে তাঁর প্রেমাস্পদ আত্মস্থ করেছেন। দুঃখ দিয়েই তাঁকে শুদ্ধ করেছেন দয়াল। জীবন সায়াহ্নে রজনীকান্ত সাক্ষ্য দেন

আমায় সকল রকমে কাঙাল করেছে গর্ব করিতে চূর।
যশ ও অর্থ মান ও স্বাস্থ্য সকলি করেছে দূর।
ঐগুলো সব মায়াময় রূপে
ফেলেছিল মোরে অহমিকা কূপে
তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছ দীন আতুর
আমায় সকল রকমে কাঙাল করিয়া গর্ব করেছ চূর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার পর, শয্যাশায়িত বাকহারা রজনীকান্ত কবিতাটি রচনা করেন। উৎসর্গও করেন রবীন্দ্রনাথকে। অসুস্থ কবিকে দেখে বোলপুরে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথও একটি চিঠি পাঠান রজনীকান্তকে। রবীন্দ্রনাথের সেই বাণী রজনীকান্তের কাব্যসাধনার এক অনন্য মূল্যায়ন। চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন

সেদিন আপনার রোগশয্যার পার্শ্বে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর তাহাকে আপনার সমস্ত অস্থি-মাংস, স্নায়ু-পেশী দিয়া চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াও কোনোমতে বন্দী করিতে পারিতেছে না, ইহা আমি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম।... সুখদুঃখ-বেদনায় পরিপূর্ণ এই সংসারের প্রভূত শক্তির দ্বারাও কি ছোট এই মানুষটির আত্মাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিতেছে না? শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাইকণ্ঠ বিদীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাইপৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতিপত্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই। সচ্ছিদ্র বাঁশির ভিতর হইতে পরিপূর্ণ সঙ্গীতের আবির্ভাব যেরূপ, আপনার রোগক্ষত, বেদনাপূর্ণ শরীরের অন্তরাল হইতে অপরাজিত আনন্দের প্রকাশও সেইরূপ আশ্চর্য। কাঠ যত পুড়িতেছে, অগ্নি আরো তত বেশি করিয়াই জ্বলিতেছে।

রজনীকান্তের গানে রয়েছে ভক্তি, প্রেম ও সমর্পণের পরম নিষ্ঠা। তাঁর গানের সেই প্রজ্জ্বল, অপরাজিত শক্তির উৎস বৈষ্ণব ভাবতত্ত্ব। যেখানে পরমকে জীবের মধ্যে অনুভব করে পরমানন্দ লাভ করে মানুষ।

আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে তুমি অভাগারে চেয়েছ
আমি না ডাকিতে, হৃদয় মাঝারে নিজে এসে দেখা দিয়েছ।
চির-আদরের বিনিময়ে সখা! চির অবহেলা পেয়েছ
আমি দূরে ছুটে যেতে দুহাত পসারি ধরে টেনে কোলে নিয়েছ।

ও পথে যেও না ফিরে এস বলে কানে কানে কত কয়েছ
আমি তবু চলে গেছি ফিরায়ে আনিতে পাছে পাছে ছুটে গিয়েছ।
এই চির অপরাধী পাতকীয় বোঝা হাসি মুখে তুমি বয়েছ
আমার নিজ হাতে গড়া বিপদের মাঝে বুকে করে নিয়ে রয়েছ।

রজনীকান্তের সব প্রেমের গানে বাজে এমন বৈকুণ্ঠের সুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘যাহাকে আমরা ভালোবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই। এমনকি, জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা। প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্য-সম্ভোগ। সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে। বৈষ্ণবধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম-সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে।রজনীকান্তের গানে মর্ত্যের প্রেমে পাওয়া যায় সেই অনন্তলোকের পরিচয়।

প্রেমে জল হয়ে যাও গলে
কঠিন মেশে না সে
মেশে যে সে তরল হলে।

অবিরাম হয়ে নত
চলে যাও নদীর মত
কল কলে অবিরত ‘জয় জগদীশ’ বলে।

কিংবা

ধীরে ধীরে মোরে টেনে লহো তোমা পানে
আপনা হারায়ে আছি মোহ-মদিরা পানে।
প্রতি মায়া-পরমাণু আমারে করেছে স্থানু
টানিয়া ধরেছে মোরে নিঠুর কঠিন টানে।

ওহে, মায়া-মোহ-হারি নিগড় ভাঙিতে নারি
নিরুপায় বন্দী ডাকে অধীর-আকুল প্রাণে।

দেশপ্রেম নিয়ে রজনীকান্তের কবিতা ও গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর স্বাধীনতার সুখ কবিতাবাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,/ কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই পড়েন নাই, এমন বাঙালি বিরল।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তাঁর স্বদেশি গান—‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই পুরো বাংলায় গণ-আন্দোলন ও নবজাগরণের সৃষ্টি করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে একটি জনসভা হয়। এতে বিলাতি পণ্য বর্জন এবং স্বদেশি পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার নেতারা। ফলশ্রুতিতে আমেদাবাদ ও বোম্বাইতে দেশি বস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু সেই কাপড় বিলাতের মতো উন্নত ছিল না। সেই প্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেন এই অবিস্মরণীয় দেশপ্রেমের গান।

মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সূতোর সঙ্গে, মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই
আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ পরের দোরে ভিক্ষা চাই।
আয় রে আমরা মায়ের নামে এই প্রতিজ্ঞা করব ভাই
পরের জিনিষ কিনবো না, যদি মায়ের ঘরের জিনিষ পাই।

গানটি রচনার বিবরণ পাওয়া যায় ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের লেখায়। জলধর সেন জানান, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রজনীকান্ত কলকাতায় যান। সেখানে কয়েকজন যুবক তাঁকে আন্দোলনের জন্য একটি গান লিখে দিতে বলেন। তিনি সাথে সাথেই লিখতে বসেন। কিছুটা লিখে রজনীকান্ত ছুটে যান জলধরের প্রেসে। বাকিটা সেখানে লিখতে লিখতে বাঁধা হয় সুর। এরপর, সন্ধ্যার মধ্যে সেই গান কলকাতার পথে মিছিলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এই গান নিয়ে স্মৃতিচারণে লিখেছেন—“১৩১২ সালের ভাদ্র মাসে বঙ্গব্যবচ্ছেদ ঘোষণার কয়েক দিন পর কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরিয়া কতকগুলি যুবক নগ্নপদে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় গান গাহিয়া যাইতেছিল। এখনো মনে আছে, গান শুনিয়া আমার রোমাঞ্চ উপস্থিত হইয়াছিল।’’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রজনীকান্ত সেন ছিলেন সমসাময়িক কবি। রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছোট ছিলেন রজনীকান্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন তাঁর দুই বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের অনুপ্রেমী হয়েও পরবর্তীকালে কাব্যপ্রতিভায় তাঁদের সমান পঙক্তিতে অধিষ্ঠিত হন রজনীকান্ত। জমিদার ও ঋষিপ্রতীম রবীন্দ্রনাথ এবং বিলাতি কেতার দ্বিজেন্দ্রলালের পাশে নিতান্ত বাঙ্গালবেশী রজনীকান্ত স্বাতন্ত্র্য কায়েম করেছিলেন কেবল পূর্ববঙ্গের জল-মাটির অপার মহিমায়। রজনীকান্ত আলাদা ঘরানার কোনো বিশেষ সুর সৃষ্টি করেননি। প্রচলিত সুরের মধ্যে নিজের সারল্য, শরণাগতি মিশিয়ে করে তুলতেন অপরূপ। কলকাতার কেতাদুরস্ত বাগিচায় তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের সহজিয়া, অলৌকিক ভাটফুল। বাক্য ও শৈলীতে পূর্ববঙ্গের ক্রিয়াপদ ও সুষমা তাঁকে আসীন করেছে অনন্যমাত্রায়। যমুনা নদীর অপার বিশালতায় তিনি ফানা হয়েছিলেন অরূপ ঈশ্বর প্রেমে।

ঋজু, অকম্প্র কণ্ঠে কান্তকবি বলেছেন জীবনের ফাঁকির কথা। গেয়েছেন নির্মোহ জীবনের গান

ওরে, ওয়াশিল কিছু দেখিনে জীবনে, শুধু ভূরি ভূরি বাকি রে
সত্য সাধুতা সরলতা নাই, যা আছে কেবলি ফাঁকি রে।
...কত যে মিথ্যা, কত অসঙ্গত স্বার্থের তরে বলেছি নিয়ত
আজ পরম পিতার দেখিয়া বিচার, অবাক হইয়া থাকি রে।

কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, কবির কষ্ট দিয়ে কবিতা পুষ্ট হয়/ কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে/ কবিতা এমন এক পিতৃঘাতী শব্দের শরীর। রজনীকান্তেরও জীবন খেয়ে পুষ্ট হয়েছে তাঁর কবিতারা। তিনি এমনই এক প্রেম, সমর্পণ ও সারল্যের আরাধনা করেছেন, যেখানে তুচ্ছ হয়ে গেছে বৈসয়িক জীবন ও অস্থি-মাংসের শরীর। রোজনামচায় কবি নিজেই জানিয়েছেন, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই।