নাটক ‘রিমান্ড’—মুক্তির তালাশ

অ+ অ-

 

মরিবার হলো তার সাধ’—জীবনানন্দ দাশের এই সাধকে অনেকটাই যেন বুকে নিয়ে হাঁটছেন নাট্যকার এবং নির্দেশক শুভাশিস সিনহা। আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতার যুক্তি এবং মৃত্যুতেই মুক্তি’—এটিকে ঘিরে এবং অন্যান্য প্রানীর চেয়ে মানব-প্রকৃতির ভিন্নতার ওপর ভর করে দ্বার-দেরাজহীন ঘরের স্বপ্ন দেখিয়ে চলছেন একজন লেখক। সেই ঘরের খুঁটি, আদর্শ ও জীবনে আছে মুক্তির সমীকরন। সেই লেখক কাঠগড়ায়। লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগতাঁর লেখায় প্ররোচিত হয়ে অনেকেই জীবনকে খারিজ করে মৃত্যুর সাধটুকু পেতে চায়। লেখককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এভাবে জীবন যে এক ধরনের নৈরাজ্যের উৎপাদন, সেটারই সংলাপ দিয়ে শুরু হৃৎমঞ্চ প্রযোজনায় নাটক রিমান্ড

পৃথিবী নামক কারাগারে আমরা সকলে আসলে নিজের কাছেই রিমান্ডে থাকি। সেই কারাগার থেকে মুক্তির জন্য নিজের জীবন হননের স্বাধীনতার বাঁশি বাজান এক যাদুকর। জীবনকে নয়, মৃত্যুকেই ভালোবাসার যুক্তি তার ঝুলিতে।  তিনি আদতে লেখক, যিনি রিমান্ডে পুলিশ আফিসারের সঙ্গে তাঁর জীবন দর্শন নিয়ে অবিচল থাকেন, রয়ে-সয়ে কখনও কখনও তর্ক তোলেন। লেখকের সেই তর্কে ওভেনের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে একই সঙ্গে মুক্তি এবং মৃত্যুর সাধ নেওয়া যেন সিলভিয়া প্লাথ উড়ছেন দর্শকের সামনে। জীবনের গতিকে ঈর্ষা করে তাকে থামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হেমিংওয়ে। নারীর জন্য নিজের একটি কামরার স্বপ্ন দেখানো এবং অনেক নারীর জীবনের কুঠুরিতে বসত করা ভার্জনিয়া উলফও ঘোষণা করেছিলেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই আসল মুক্তি।

জন্ম, ভালোবাসা, বেঁচে থাকার আকুতি সবই এক মোহকোনটিই সত্য নয়। সবই এক-একটি আবরন, আড়াল, যেগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষ কেবলই নিজেকে গোপান করে, বন্দী করে। কারণ নিজেকে দেখলেই হয়তো সে আর বেঁচে থাকতে পারবে না। তার দেহ এবং মন কোনটিই স্বাধীন নয়, বরং আড়ষ্ট, জীবনের প্রতি নৈরাশ্য তৈরিতে যথেষ্ট।

রিমান্ডে পুলিশ অফিসার অনর্গল প্রশ্ন বানে আক্রান্ত করতে চান লেখককে। তার বিপরীতে লেখক কখনও স্থির, কখনও অনবরত নিজেকে ভাঙছেন। সেই ভাঙনের শব্দ নেই, আছে বোধের শাসন। তাই্ দর্শকের মন উচাটন। তারাও এক গোলক ধাঁধায় ঢুকেছেন, তাইতো, তাইতো, এই জীবন কী সত্যি? নাকি সবই ভ্রম, এক হেলুসিনেশন। সত্য তাহলে কোথায়? কেন আমরা নিজেকে এই সত্য-মিথ্যের নাগরদোলায় চড়িয়ে দোল খাচ্ছি? এ জীবনের সীমানা কই? আমরা যে জীবন যাপন করছি সেটি তবে আসল নয়? সবই কী তবে নৈরাশ্যের সঙ্গে এক জটিল বোঝাপড়া?

রিমান্ড নাটকের দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূর, জ্যোতি সিনহা, কামাল উদ্দিন কবির ও অন্যরা

নাটকে লেখককে জেরা আলাপনে গিয়ে ঠেকে। পুলিশ অফিসার কণ্ঠে, শারীরিক ভঙ্গিমায় তাপ ছড়ায়। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু আসে যায় না লেখকের। বরং আলাপ আগায় ব্যক্তি থেকে জাতি-রাষ্ট্রে। সেখানেও ধীর লয়ে লেখকের অবস্থানদেশ, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বলে কিছু নাই আসলে। এগুলো সবই মানুষের তৈরি, কল্পনা, মায়া। হ্যাঁ এই লেখক নৈরাজ্যবাদী, তিনি জীবন নামক এক প্রহসন নিয়েই অনবরত প্রশ্ন ছুঁড়েছেন। তার অবস্থানে তিনি ভীত নন। বরং পুলিশ অফিসারকেই তিনি যেন এক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিযেছেন।

মানুষের জন্মের স্বাধীনতাও কদাচিৎ। নিজের জন্মের ঢাকনাও তিনি তুলেছেন সময় নিয়ে, স্বস্তি-অস্বস্তির দ্বিধাকে অনেকটাই যেন ছুঁড়ে দিয়ে। বলেছেন, একজন যৌনকর্মীর গর্ভেই তার জন্ম। জন্ম-জন্মান্তরের দর্শন তার কলমকে করেছে টনটনে, কারণ এর ওপর ভর করেই তিনি মৌলিক সংহারে পৌঁছেছেনপৃথিবীর সকল জন্মই কাঙ্ক্ষিত নয়। ভালোবাসার নয়। তাহলে জন্মের এতো জয়গান কেন? অস্তিত্বের ইতিহাসকে তবে কী আমরা পাশ কাটাই? নাকি সযত্নে লুকিয়ে রাখি, অস্তিত্বের সংকটকে খোলসে ঢোকাতে? এই ভাবনায় মূলত অস্তিত্ববাদীতাকেই সঙ্গ দিয়েছেন লেখক।

পুলিশ অফিসার যতোটা তার রাগ আর তেজস্বীয়তার ছড়ি ঘুরিয়ে ঘায়েল করতে চেয়েছেন লেখককে, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে লেখক যেন তার সঙ্গে আলাপে জড়াতেই আগ্রহী। লেখক স্থির, তবে ভীত নন। বরং স্বাধীনতার প্রশ্নেই তিনি অনেকটাই দেমাগী। তার সঙ্গে আলাপে বেশ আগ্রহী তরুন পুলিশ অফিসার। কিন্তু সেই আলাপে আছে কিছুটা ঘৃণা, বিরক্তি। আবার আছে কিছুটা কাটাহীন মায়া, যে মায়াকে আস্কারা দিতে চান না অফিসার।

নানা আড়মোড়া ভেঙে জীবনকে দেখার আকুতি, উঁকি-ঝুঁকি দেয়া বুদবুদ আছে এই নাটকে। তবে সেই অনুভূতি সংকটহীন নয়, তৃষ্ণার্তও নয়, আবার নিরসনেরও নয়। এ এক অপার বিস্ময়, যাকে জীবনানন্দ দাশ বিপন্নতার জালে বেঁধেছেন।

রিমান্ড নাটকের দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূর ও জ্যোতি সিনহা

প্রতিনিয়তই সাম্পর্কিক অস্তিত্ব নিয়ে নিমগ্ন আমাদের ধাক্কা দেয় বস্তুগত নানা দেনা-পাওনার খানা-খন্দ। তাই্তো পুলিশ আফিসারের জন্মের ইতিহাসের পর্দা ওঠানোর সারদে কাঁপেননি লেখক, বিব্রতও হননি। এমনকি কণ্ঠ হতকচিত ছিলো না তার। বরং তিনি সেটাকে এক ঈর্ষণীয় ভঙ্গিতে গ্রহণ করেছেন এবং স্বীকারোক্তির জমিনে আরেকটু হেঁটে বলেছেন, এটি তিনি আগেই জানতেন।

নাটকটি দেখতে আসা অনেকেই নিজেকে খুঁজেছেন এই্ নাটকের মধ্যে। সবচেয়ে যে প্রশ্নটি কিলবিল করেছে মাথায়, সেই প্রশ্নটি হলোপৃথিবীরূপী কারাগার থেকে মুক্তি আছে কী? মুক্তি নেই কিংবা হয়তো আছেও, কারণ

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত
ক্লান্ত করে:

নাটকটি শেষ হয়েছে এভাবেই। এ ক্লান্তি দেহের নয়, এ ক্লান্তি হাহাকারের, সংকটের, সংশয়ের। যে সংশয় আর ভাংচুর নিয়ে আলাপ করতে আমরা প্রায়শই আগ্রহী হই না। কারণ নিজেকে মেলে ধরা এবং নিজেকেই রিমান্ডে নেয়া সবচেয়ে কঠিন।

তবে লেখক কেন আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তির সুধা মাখতে চাননি? লেখককে বার বার এই প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন পুলিশ আফিসার। কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। তবে কী তাহলে তিনি জীবনের আকাঙ্ক্ষা-অনাকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই মুক্তি খুঁজছেন? জীবনই কী তবে মুক্তির বাসর? সেই বোঝাপড়াতেই আগ্রহী শুভাশিস সিনহা। আমি নিশ্চিত, শুভাশিস সিনহার মুন্সিয়ানায় নাটকের সংলাপগুলো এলোমেলো করেছে অনেক দর্শককেই। প্রায় আশিকে আলিঙ্গন করা আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে জ্যোতি সিনহা সত্যিই মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। নাটকটি দুটো চরিত্রকে ঘিরেই বোনা হয়েছে। তবে আরও কয়েকটি ছোট ছোট চরিত্র নাটকটির ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়েছে। পরিশেষে এটুকু বলা যায়, নাটকটি ব্যক্তির অস্তিত্ব ও বাস্তবতার নানা বিষয়কে সামনে এনেছে। যা চিন্তার খোরাক জোগাবে।