বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন

অ+ অ-

 

ভূমিকার বদলে

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ২৬ জুন, ১৮৩৮ সালে। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনা করেছিলেন বলে মান্য করা হয়। দুর্গেশনন্দিনী [১৮৬৫] ছিল তাঁর লেখা প্রথম স্বার্থক বাংলা উপন্যাস। তিনি মোট পনেরটি উপন্যাস লিখেছেন, যার মধ্যে একটি ইংরেজি উপন্যাসও রয়েছে। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, রাজসিংহ, দেবীচৌধুরানী, আনন্দমঠ, সীতারাম, রজনী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর, ইন্দিরা, রাধারানী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাসগুলোকে ঐতিহাসিক, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মতত্ত্ব প্রভাবিত প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রযেছে লোক রহস্য, বিজ্ঞান রহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, বিবিধ সমালোচনা, সাম্য, প্রবন্ধ পুস্তক, কৃষ্ণচরিত্র, বিবিধ প্রবন্ধ, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি।

বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্য সম্রাট উপাধি লাভ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম কমলাকান্ত। ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র মারা যান।বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন গদ্যটি বঙ্কিমের বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্য এখন আর বঙ্কিমচন্দ্রের জমানায় নেই। ভিন্নমত পোষণেরও অবকাশ আছে। তবে তার নিবেদনগুচ্ছের কোনো কোনো চিন্তা নতুন লেখকদের চিন্তার পথকে প্রসারিত করতে পারে। তাই সাহিত্যের লেখক ও পাঠকদের কথা বিবেচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আলোচিত নিবেদনটি প্রতিধ্বনিতে উপস্থাপন করা করা হলো।  

 

টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোক-রঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।

 

বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন

১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।

২। টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোক-রঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।

৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।

৪। যাহা অসত্য, ধর্ম্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ।

৫। যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্রতী, তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।

৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপ অকর্ত্তব্য। এটি সোজা কথা কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না।

৭। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে, তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্ম্মান্, কোটেশন্ বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না।

৮। অলঙ্কার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভাণ্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবেভাণ্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভাণ্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মত কদর্য্য আর কিছুই নাই।

৯। যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভাল না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভাল লাগিবে নাবন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে।

১০। সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেন না, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝান।

১১। কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।

১২। যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না। প্রমাণগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই।

বাঙ্গালা সাহিত্য, বাঙ্গালার ভরসা। এই নিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।

সূত্র: বঙ্কিম রচনাবলী ।। প্রথম প্রকাশ: মাঘ, ১২৯১ বঙ্গাব্দ