একখানি আরজি ও অন্যান্য কবিতা
শরৎচন্দ্র পণ্ডিত
কবি, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক। জন্ম ২৭ এপ্রিল, ১৮৮১ সালে বীরভূম জেলার নলহাটি থানার অন্তর্গত সিমলাদ্দি গ্রামে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজে দাদাঠাকুর নামেই তিনি পরিচিত। যিনি মুখে মুখে ছড়া, হেঁয়ালী ও হাস্য কৌতুক রচনা করতেন। তার রচিত নানান হাসির গল্প বাংলা সাহিত্যের অমর কীর্তি। দুটি পত্রিকা ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ ও ‘সেরা বিদূষক’ এবং ‘বোতল-পুরাণ’ পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। দারিদ্র্যের কারণে শরৎচন্দ্র এন্ট্রান্স পাশ করে বর্ধমান রাজ কলেজে এফ.এ. ক্লাসে ভর্তি হলেও পড়া শেষ করতে পারেননি। জীবিতকালেই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন দাদাঠাকুর। তাঁর জীবন নিয়ে ষাটের দশকে একটি ছায়াছবি নির্মিত হয়, যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যে ছবি বিশ্বাস জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
একখানি আরজি
দরিদ্রতা বনাম দরিদ্র
চৌকি বিধাতার নসিবী আদালত।
বাদী-দরিদ্রতা, পিতাশ্রী-বিধাতা,
সাকিম-মরত্তপুর,
পেশা–দেগদারি, ধরি গোবেচারী,
করে সব আশাচূর।
বিবাদী–দরিদ্র, চারিদিকে ছিদ্র,
পিতা-মাতা নাই তার,
সাকিম বিহীন পেশা হচ্ছে ঋণ,
অন্নাভাবে হাহাকার।
দাবি–এই বিবাদীর যা আছে আপন
বাবত–স্বত্ত্বসাব্যস্তসহ দখল পালন।
বাদীর বর্ণনা এই, … ধর্ম অবতার!
বিবাদীতে জন্মাবধি দখল তাহার।
বিবাদী ভুমিষ্ঠ হয়ে দীনের কুটিরে,
অল্পদিনে করে শেষ মা-বাপ দুটিরে।
তদবধি করি বাস বাদীর ছায়ায়,
পালিত হইয়াছিল পরের দয়ায়।
বাদীর দোহাই দিয়া বিদ্যালয় হতে
শিখিয়াছে বিদ্যাটুকু কেবল মুফোতে।
যৌবন নিশ্চয়ই লুপ্ত হইত পাপেতে।
রক্ষা করিয়াছি এরে অভাব রূপেতে।
আছিনু বিবাদী সনে আমি অহরহ,
সেকারণে সবেএবে করে অনুগ্রহ।
বিধিদত্ত শর্ত আছে দেখাতে পারিব—
আঁতুড়ে ধরিয়া এরে শ্মশানে ছাড়িব।
বিবাদী সেসব শর্ত করিয়া লঙ্ঘন,
করিতে সচেষ্ট মোর উচ্ছেদ সাধন।
রাতারাতি বসিবার চাহে রাজপাটে,
খণ্ডিয়া বিধির বিধিযা আছে ললাটে।
আকাঙ্ক্ষার পরামর্শে আমারে ত্যাজিয়া
ধনী হতে চান ইনি সম্পদে ভজিয়া।
অত্র এলাকার এই বিবাদী মোকামে,
নালিশের হেতু হইয়াছে ক্রমে-ক্রমে।
বাদীর প্রার্থনা করি বিবেচনা,
ডিক্রি দাও যেন তাকে;
(ক) পুত্র-পৌত্রাদি, ক্রমে এ বিবাদী
বাদীর দখলে থাকে।
(খ) সঞ্চি ত নিধি অঞ্চ লে বাঁধি
বঞ্চিত যেন হয়।
বাঞ্ছিত ফল লভিতে কেবল
লাঞ্ছনা যেন সয়।
এই মামলায়, খরচা যাপাই,
হয় যেন সবডিক্রি,
থালা-ঘটিবাটি বাস্তুভিটে-মাটি
করিয়া লইব বিক্রি।
আমি শ্রীদরিদ্রতা
প্রকাশিনু যে যে কথা।
সত্য সব মম জ্ঞানমতে।
ত্র্যহ স্পর্শ শনিবারে
বারবেলা ঠিক করে
স্বাক্ষর করিনু আদালতে।
জ স ১৩২৬ । ৬ বর্ষ ২ সংখ্যা
মামলা জিত
দাদা ঠাকুর! আজকে তোমার
দেখছি ভারি মেজাজ খোস!
ডিক্রি বুঝি পেলে মামলা
করে বিষম যোগসাজোস?
মানুষ হাকিম করলে বিচার;
তারে দিলে খুব ফাঁকি।
উপরে যে হাকিম আছে
ঠকাতে তায় পারবে কি?
টিপ সহিতে কাজ সারিলে
সাক্ষী দিয়ে দুই কি তিন,
সে হাকিম তো নেন না প্রমাণ
নিজেই দেখেন সরজমিন।
ঠেঙায় করে ও কিনিয়ে
তাড়াতাড়ি দিচ্ছ ছুট?
মামলা জিতে আজকে বুঝি
দিতে হবে হরিরলুট!
মামলা জিতে যে ভোগ দিবে
হরি যদি নেন তো আজ;
তাহলে ঠিক বুঝব আমি
হরিও তোমার মামলাবাজ।
হলপ করে নিলে হাতে
তামা-তুলসি-গঙ্গাজল।
আজকে যেফল ফললো তোমার
ফলবে তাহার উল্টোফল।
মিছে করে মামলাজিতে
ভাবছো তুমি বুদ্ধিমান।
হয়ত নিবে গরু দুটি
না হয় নিবে বাস্তুখান।
ভাবছো আমায় করলে জব্দ
করলে আমার সর্বনাশ।
তোমার শাস্ত্র সত্য হলে
তোমার হবে নরকবাস।
দেনাদারের গরু যাবে
ভুগবে নরক ডিক্রিদার।
বলুন দেখি পাঠক মশায়!
কাহার জিত আর কাহার হার।
বিদূষক ১৩২৯ । ১ বর্ষ ২ হর্ষ
আমার দেহ
এইদেহ-মাঝে যেখানে যা সাজে
তাই দিয়ে তুমি সাজিয়ে রেখেছ।
দুশ্চিকিৎ স্যব্যাধি দিয়ে নিরবধি
যত গরম সব ঠাণ্ডা করেছ।
বদ খেয়াল কত দিয়েছ মস্তকে
কপালেতে দিয়েছ হে লেখে,
সরষে ফুল সদা দেখাইছ চোখে
দিব্য দৃষ্টি মোর হরিয়া নিয়েছ।
হৃদয়ে দিয়েছ কুবাসনা কত,
জঠরাগ্নি জ্বলে পেটে অবিরত,
এরই তরে আমি পর-পদানত,
অনুগত ভৃত্য করিয়া ফেলেছ।
চরণে আমার দিলে মায়া বেড়ি
দারা-সুত-সুতা এ যেবিষমভারি।
কয়েদির মতো ঘানি গাছে জুড়ি
দিবানিশি কত যাতনা দিতেছ।
বিদূষক ১৩৩০ । ১ বর্ষ ২৯ হর্ষ
উড়্ যা বাঙালি উড়্ যা
উড়্ যা, বাঙালি! উড়্ যা!
ঘরসে বহুত দূর যা!
বেগর, হাকিমকা পুর যা,
পুলিশ সব ঘর ঢুঁড় যা।
কুত্তা, বিল্লি, শের,
পাকড়া যায়েগা ঢের
জলদি, মৎ করো দের!
(তেরা) নসিবকা বহুত ফের।
বাঙালিকা বাচ্চা,
কোই নেহি হ্যায় সাচ্চা,
খুনি, ডাকু, লোচ্চা
লাটকা কানুন আচ্ছা।
বেগর পরোয়ানা,
মেরাসাথ-সাথআনা
বরোবর জেহালখানা,
খাও সরকারি খানা।
ওকিল-বেরিস্টার
সব হোগা নাচার
মেরা বাত দো-চার
ইসমে হোগা বিচার।
জেরাজুরি না কহনা
চুপ্-চাপ্সে রহনা
সবহি জুলুম সহনা,
না সাফাই না বাহানা।
মগর, হো যাও খালাস
ঘর চলা যাও বাস,
(মেরা) মিল গিয়া হ্যায় পাশ
শেখায়ে তকা নেহি ত্রাস।
এহি কানুন মে বহুত ফয়দা,
ইস্মে মেরা কিম্মত কায়দা
বাঢ় গিয়া কুছ জেয়াদা
অ্যায়সি মিলেগা চিনি ঘিউ
অ্যায়সি মিলেগা ময়দা।
যব মোদি মাঙ্গেগা দাম
তব বোল্ দেউঙ্গা হাম,
তিন আইনমে তেরা নাম,
বাপ কহাকে মোদি মুঝকো
দেগা তিন সেলাম।
ভাতুয়া বাঙালি মছলি খোর,
টুট গিয়া হ্যায় তুঁহারা জোর,
মেরা হাতমে কানুনকা ডোর,
বাআদে উঙ্গা ডাকু-চোর।
বিদূষক ১৩৩১ । ২ বর্ষ ১৬ হর্ষ
বিদূষকের শ্যামা বিষয়ক
(রামপ্রসাদী সুর)
আমায় দে মা রাজা করি।
আর উপোসকরে থাকতে না রি।
দন্ত অন্ত হল মাগো,
কিসে চিবাই ছোলা-মুড়ি,
হালুয়া ভিন্ন চলে না মা
রাবড়ি খেলেও খেতে পারি।
পেটের জ্বালায় গলি-গলি
চেয়ে-মেগে কেবল ফিরি
চরণ যে মা আর চলে না
না হলে মা মোটরগাড়ি।
খালি পেটে বাতাস ঢুকে
ক্রমে ফুলে যাচ্ছে ভুঁড়ি,
টাকা দিতে (া) আকার ভুলে
টাক দিলি মা কপাল জুড়ি।।
বিদূষক ১৩২৯ । ১ বর্ষ ৩ হর্ষ
নোট: শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের কবিতাগুলো নেওয়া হয়েছে ভারবি সংস্করণ থেকে। আমরা ভারবির প্রকাশক গোপীমোহন সিংহরায়ের কাছে কৃতজ্ঞ।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন