সাঁওতালী মেয়ে ও অন্যান্য কবিতা
ভূমিকার বদলে
আনোয়ার পাশা [১৯২৮-১৯৭১] একজন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। জন্ম ১৯২৮ সালের ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। পিতা হাজী মকরম আলী ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। আনোয়ার পাশা ভাবতা আজিজিয়া উচ্চ মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন ১৯৪৬ সালে। পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আইএ [১৯৪৮], রাজশাহী কলেজ থেকে [১৯৫১] এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ [১৯৫৩] পাস করেন। মানিকচক হাই মাদ্রাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে বিভিন্ন স্কুল এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে [১৯৫৮-১৯৬৫] শিক্ষকতা শেষে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা ছাত্রাবস্থায়। রাজশাহী কলেজে বিএ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তিনি রচনা করেন ‘হাস্নাহেনা’ শিরোনামে একটি রম্যরচনা। দু’দশকের সাহিত্যজীবনে প্রকাশিত হয় দশটি গ্রন্থ ও পনেরটি প্রবন্ধ। তার মধ্যে আছে দুটি কাব্য সংকলন, একটি গল্প সংকলন, তিনটি উপন্যাস ও দুটি সমালোচনা গ্রন্থ। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সহযোগিতায় তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের চারটি কাব্য সম্পাদনা করেন। বহু পত্রপত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য নদী নিঃশেষিত হলে [১৯৬৩], রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা [২ খণ্ড ১৯৬৩, ১৯৭৩], নীড় সন্ধানী [১৯৬৮], নিশুতি রাতের গাথা [১৯৬৮], সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল [১৯৬৮], নিরুপায় হরিণী [১৯৭০], রাইফেল রোটি আওরাত [১৯৭৩], সমুদ্র শঙ্খলতা উজ্জয়িনী ও অন্যান্য কবিতা [১৯৭৪] ইত্যাদি।
রাইফেল রোটি আওরাত উপন্যাসটি রচিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী আল বদরদের একটি দল তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রতিধ্বনি পাঠকের কথা বিবেচনা করে তাঁর একগুচ্ছ উপস্থাপন করেছে। লেখাতে আছে যেমন জনসংস্কৃতির চিহ্ন আর স্বদেশ প্রেম, ঠিক তেমনি আছে মানবিক প্রেমের উদ্বেল আকাঙ্ক্ষা। আশাকরি পাঠক সেই আকাঙ্ক্ষায় অবগাহন করবেন।
নদী নিঃশেষিত হ’লে
নদী নিঃশেষিত হলে। তীরের নিতান্ত সংকাশে
একটি কিশোরী মন অচেনা পাতায় কাঁপে ত্রাসে।
সহসা এসে পথটি উত্তরে মোড় নিল।
মেঘরিক্ত প্রত্যহের অগ্নি স্নানে মাটি হয় ধুলো।
দীর্ঘ পিপাসার ঋতু পরিচিত পায়ের সাড়ায়
ঘূর্ণি হাওয়ায় রৌদ্রে পথে পথে সন্ত্রাস ছড়ায়।
জলের শেওলা তবু বাঁচবার বিচিত্র প্রয়াসে
একটি ফুল ফুটিয়েছে এই রুক্ষ অসম্ভব মাসে।
পাশে কোন সাথীহারা মসৃণ ডাহুকী গ্রীবা মেলে
কখনো দাঁড়ায়, ফের অত্যন্ত সন্তর্পণে এক পা বাড়ায়।
এখনো সজল আশা আছে তবে কোমল মাটি ও তৃণমূলে।
এখনো তাহ’লে কোন বুনোচরা গ্রামের আশায়
বর্ষার আশায় মাঝি নৌকো সারে। পার হবে এপারের লোক।
এখন রৌদ্রে বুঝি রাঙা হ’ল পৃথিবীর একটি অশোক।।
বোধিবৃক্ষ
পৃথিবীর কোনখানে ছিল যেন সেই কল্পতরু—
বোধিবৃক্ষ যার নাম, অনেক ফিরেছি পথে পথে
জরা-মৃত্যু-ব্যধি ভরা ধরণীর পর্বতে সৈকতে।
যদিও সীমুমঝড়ে উদ্বেলিত বাসনার মরু
যদিও সংসারী-আশা সম্ভোগের দীপ্ত-দাহ চায়
—তবুও কোথায় যেন অবচেতনের কুয়াশায়
একটি জোনাকি-দ্বীপ জ্বলে নেভে, সে অনেক দূর
আড়াই হাজার বছরের পথ, যেখানে প্রাণের
মৌনবাণী সুর হয়ে বাজেঃ মিছে এ বাঁচার জের
কেন টেনে চলা—যদি আমার দেশের মাটি এতই ভঙ্গুর!
তাই খোঁজা পথে পথে সেই বোধিবৃক্ষ যার ডালে
সাগর-পারের শ্বেত-কপোতেরা ডানা মেলে আসে,
যেখানে অত্যন্ত কাছে কল্লোলিত অমিত আশ্বাসে
অন্ততঃ একটি নদী তীরে যার আজো দূর শতাব্দীর বেণু।।
সাঁওতালী মেয়ে
সাঁওতালী মেয়ে দেহ-তরঙ্গে তারি
ছিল নাগিনীর কেতকী-বনের ঘুম,
শিপ্রা-তীরের মেঘ মেখে দুই চোখে
ফুল কুড়োতো সে পঞ্চবটীর বনে।
সাঁওতালি মেয়ে সেবার বরষা এলে
ধীরে গ’লে গেল শ্রাবণের বর্ষণে।
বৈদেহি গাঢ়-প্রাঙ্গণে মেলে ছায়া
আশ্বিনে কাঁপে শিউলি-শিথিল মায়া।
ধানে গানে সারা বসুধায় ফুলে ফুলে
নৃত্যচপলা সাঁওতালী মেয়ে, তার
পৌষের ঝুড়ি পূর্ণ কি বরাভয়ে!
বাতাসে ছড়ায় কুয়াশার কেশভার।
বাতাসে ছড়ায় চৈত্রের হাহাকার
এই বাংলার সবুজে শান্তি নেই।
কি যেন অথবা কে যেন এ-রাতে নেইঃ
সাঁওতালী মেয়ে মাঠে, তার হাতে বেণু।।
শেষ নেই
দিনের কেতু শুক্র গ্রহ ভোরের হাওয়ায়…
মাটির আশা বুকের ঝড় ধরায় প্রতি শাখায়
তোলে কী ধ্বনি! তারি স্বনন সারা সকাল ধ’রে
প্রতি শাখায় পাতার গায়ে আঁচড় কাটে, ক্রমেই
নতুন হয় পুরোনো আর পুরোনো যারা ঝ’রে
এবং ম’রে ঢাকে মাটির নগ্ন দেহ। বিনা পরিশ্রমেই
জীবন যায়, বেলাও যায় নিবিড় নিরুত্তাপে।
আবার সাঁঝে দিনের কেতু শুক্রগ্রহ কাঁপে…
ভালোবাসার দিন যে শেষ। বাঁশের পাতাগুলি
ক্রমেই ঝ’রে হয় বোঝাই শ্যাওলা-ঘেরা-তট।
দেহের তীরে টানে যে কারা বাঁকা-রেখার তুলি।
ক্রমেই রঙ একটি দুটি কোথায় যায় খোয়া।
ডালিম পাতা কাঁপিয়ে ডাকে সাঁঝের কাকাতুয়া।
অবশেষের শেষ তো নেই, আবার আসে ভোর
ফুরায় দিন, ফুরায় পৌষমাস,
আবার শুরু পুরনো ইতিহাস।
নটের গাছ মুড়ায় নাতো—জীবন মনে রেখো—
কথার কথা রূপকথা সে খালি।
কোথাও নেই মাটিতে চোরাবালি।
প্রেম
কখনো পড়েছ প্রেমে হে ঈশ্বর! বিশ্বের নগণ্য মানুষেরা
প্রেম জানে নাকো, শুধু অসংখ্য বন্ধন রচি কণ্ঠরুদ্ধ করি
সুখের ছলনা খোঁজে। তুমিও দিয়েছ বহু বিধি-নিষেধের
কাঁটাবেড়া,—
তোমার পাঠানো যতো জিতেন্দ্রিয় মহামানবেরা বগ্গা ধরি
আমাদের মন বেঁধে রাখে, আমাদের সুহৃদ ময়ূর-মন যাকে
কেন্দ্র করি মেলে তার আনন্দ-পেখম সেই প্রিয় রুচিরাকে
হে ঈশ্বর! তোমার প্রেরিত দূতে সংসারের চেনাবৃত্তে
পৈতৃক জীবনে
নিষ্প্রাণ বধুতে করে পরিণত,
যান্ত্রিকতা মেনে নেয় তোমারই নির্দেশ-নিপীড়নে।
এবং সকলে জানে প্রেম নহে যন্ত্রের বিবর্ণ আচরণ।
প্রেম নয় বারান্দার টবে-ফোঁটা অভ্যস্ত ফুলের প্রসন্নতা।
প্রেম এক অন্তহীন সম্ভাবনা জোয়ারের যন্ত্রণায় প্রত্যহ জাগ্রতা,
নতুন বিস্ময় আর অনাঘ্রাত-পুলকের বিবিধ বিস্তারে
প্রতিটি মুহূর্ত ভ’রে রক্তে ও শিরায় তার এক-একটি
নতুন স্পন্দন।
সমাজের ধ্বজাবাহী ধর্মীয় ঈশ্বর প্রেম জান না
একেবারে।।
সেই একজন
আজন্মের চিরচেনা পৃথিবীর জনতায় মিশে
সে এক পাগল ছিল। অবশ্যই চাঁদ চাহেনি সে,
অথবা চায়নি কোন পরশপাথর
স্পর্শে যার মাটি হবে সোনার আকর।
অভ্যস্ত বধূর মত রাত্রির নিশ্চিন্ত আশ্লেষে
কোন মূক বাসনায় চায়নি সেই আশ্চর্য রূপালি মাছ সমুদ্র
গভীরে।
সে শুধুই চেয়েছিল একাকী তিমিরে
আলোর আড়াল হ’তে চিরচেনা দৃশ্যের জগতে।
সে শুধুই চেয়েছিল একমাত্র আঁধার অধ্যায়
মৃত্যুকেই অনুপম ফুল জেনে। মৃত্যুরই কবিতা
আদ্যন্ত সাজিয়ে তাঁর জীবনের হিসেব-খাতায়
পুষে রেখেছিল মনে আশৈশব আস্থাহীনতার বিলাসিতা।
এবং সে চেয়েছিল আমের প্রাচীন ডালে বাদুরের প্রজ্ঞা-
পারমিতা।।
নোট: কবিতায় সংশ্লিষ্ট লেখকের বানানরীতি রাখা হয়েছে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন