গল্পে সমকালীন সমাজের কথা
একজন সচেতন লেখক তার চক্ষুষ্মত্তা দিয়ে সমাজের নানানরকম সঙ্গতি-অসঙ্গতি পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণের এ পূর্বাপর কখনো হয় লেখকের ব্যক্তিগত যাপিত জীবনের মিশেলে, কখনো হয় কল্পনারসের অয়নবৃত্তে, আবার কখনো তা উঠে আসে সরাসরি, প্রবহমান-ছুঁইছুঁই-বাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতার দিগদিগন্ত থেকে।
অপরদিকে একটি ভালো বই হচ্ছে অনেক সুতীব্র ও প্রমথিত ভাবনাসমূহকে উসকে দেওয়ার একটি উপক্রমণিকা মাত্র। শুধুমাত্র ভাবনা উসকে দিয়েই বইয়ের মৌলিক কাজটি ফুরায় না, বরঞ্চ তা পাঠকের মনোজগতকে করে চরমভাবে তাড়িত এবং আবেগকে করে তোলে অসংবরণীয়। ক্ষেত্র যা-ই হোক না কেন, পাঠক তাঁর ঢিমাতেতালা ভাব দূর করে নিবেদিতচিত্তে উসকে ওঠা ভাবনার গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের দিকে সন্তুষ্টচিত্তে সম্মুখে ধাবিত হয়।
বেশ কয়েকদিন আগে পড়লাম কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেনের চমৎকার একটি গল্প ‘After Breaking News’ শিরোনামে। ঢাউলি বুকস, ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত Our Many Longings Contemporary Short Fiction From Bangladesh-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গল্পটি। গল্পটির বিষয়বস্তু ও উপস্থাপন চমৎকার লেগেছে। আফটার ব্রেকিং নিউজ পড়ার পিঠাপিঠি সময়ে ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ পড়ার সুযোগ হলো। চমৎকার লেগেছে। মোট একুশটি গল্প আছে এ গ্রন্থে।
গল্পগুলোর বিষয়বস্তু নিরেট এবং তীব্র-আগ্রহ জাগানিয়া। লেখক চমৎকারভাবে সমকালীন সমাজকে ধারণ করেছেন, ভেঙ্গেছেন গল্পের সনাতন-মৌরসীপাট্টা এবং ঘটে চলা অন্যায় ও অবিচারের প্রতি অস্ত্র হিসেবে ছুড়েছেন তীব্র থুৎকার! এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে যেয়ে লেখক আশ্রয় নিয়েছেন কিছু রূপক-অলংকার ও পরাবাস্তবতার বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতির।
কড়া বাস্তবতার গল্পের পাশাপাশি পাঠকের জন্য পরাবাস্তব থিমের গল্পকে লেখক উপস্থাপন করেছেন একটু অন্যরকম ও ভিন্ন আঙ্গিকে। পাঠককে এনে দাঁড় করিয়েছেন বাস্তব ও অবাস্তবের ঠিক মাঝামাঝি, দিয়েছেন কিছু ফুরসত ভাবনা করার, কিছু চিন্তা করার। গল্প থেকে একটু উদ্ধৃতির সাহায্য নেয়া যাক—
খগেন জানে চল্লিশ বছর ধরে একটা খুন সে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছে। এমনকি কত স্বপ্নে খুনটা সে করেও ফেলেছে। সকালে উঠেই নিজের অক্ষমতার জন্য আফসোস হয়েছে। কিন্তু আজ যখন সত্যি সত্যি জানতে পারল চেয়ারম্যান খুন হয়েছে, একবারও মনে হয়নি খুনটা সে করেনি। কিন্তু সে মনে করতে পারছে না খুনটা সে কীভাবে করেছে। তাই দারোগা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা তোর কাজ?’
‘জে, হতি পারে।’ সে সরাসরি উত্তরটা দিতে পারে না।
‘হতে পারে মানে? কোনো সন্দেহ আছে?’
‘আমারই মেরি ফেলার কতা। ক্যান্ত আমার কিছু মনে পড়চি না।’ (পৃষ্ঠা ১০)
বইয়ের প্রথম গল্প ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’। আপাতদৃষ্টিতে একজন খুনির পুলিশের শেখানো ইচ্ছাকৃত-স্বীকারোক্তি দেওয়াকে কেন্দ্র করেই এর মূল পটভূমি। খুব চমৎকার একটা গল্প! শুধুমাত্র চমৎকার শব্দটি ব্যবহার করে চলে গেলে এ গল্পটির প্রতি তীব্র অন্যায় করা হবে। সোয়া-দুই পাতার গল্পটি পড়তে পড়তে সামনের দিকে অগ্রসরমাণ পাঠকের জন্য চমক রয়েছে গল্পের একদম শেষ অনুচ্ছেদে—মুক্তিযুদ্ধের আবহে। অল্প পরিসরে শব্দের কুশলী ব্যবহার মুগ্ধতা বাড়িয়ে দেয়। ভাবনাচিন্তার অবকাশ ও ধক-করা সমাপ্তি পাঠককে নিশ্চিতভাবে ধাবিত করে পরবর্তী গল্পে। উৎকৃষ্টতার সারাৎসার তো ঠিক এখানেই।
বাস্তব একটি গল্পের রেশ শেষ হওয়ার ঠিক পরের গল্পের নাম ‘শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে’—যেখানে মাথাবিহীন মানুষদের গল্প বলার ছলে লেখক সমাজে ফি বছর ঘটে চলা অন্যায় ও অবিচারের প্রতি আমাদের না-দেখা, প্রতিবাদ না-করার মনোভাবকে ব্যঙ্গ করেছেন। উটপাখির নীতি কিংবা চরম নিস্পৃহতার প্রতি লেখকের তীব্র ভর্ৎসনা একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে সহজে অনুমেয়।
‘বউ আর মেয়িকে ঘরের মধ্যি আটকি রেকি পুড়ি মারলু পাকিস্তানিরা। দেশ স্বাধীন হলি একা মানুষটাকে পাগল বানি’ দেশছাড়া করলি তুমরা। একুন আবার স্পাই বুলি পুলিশের হাতে তুলি দিচ্ছ, আর কত অবিচার করবা মানুষটার উপর? মা এবার চড়া কণ্ঠে বলে।
আস্তে। ছেলিরা ঘুমাচ্ছি। বাবা ধমকের সুরে থামিয়ে দেয়। বাড়িজুড়ে আদিম নীরবতা নেমে আসে। (পৃষ্ঠা ২৩)
তৃতীয় গল্প ‘স্পাই’-ও চরম অবিচার, নিষ্ঠুরতা ও বঞ্চিতকরণের বয়ান। জেনেশুনে ও বুঝে, অত্যন্ত সচেতনভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করার ফিকিরকে কেন্দ্র করে এ গল্প নিশ্চিতভাবে পাঠকের দিকে ও সমাজের দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করে। একটু উল্লঙ্ঘন করে ঊনিশ নম্বর গল্পের (গল্প না বা নিছক কল্পনা) দিকে চোখ ফেরানো যাক। শকুর পেয়াদা ও তার মেয়ে কল্পনাকে ঘিরে এ গল্প। বাস্তবতার কষাঘাতে পল্লিতে ঠাঁই হওয়া কল্পনার গল্পটি শেষ করার পর পাঠকের মনে আরও একটি ধাক্কা মতো লাগবে, এটা নিশ্চিত। এ গল্পের সমাপ্তিও পাঠকের মনে চোরকাঁটা হয়ে গেঁথে থাকবে কিছুক্ষণ।
বর্তমানে বিশ্বে সাহিত্য-রচনা-আলোচনায় ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু-বাস্তবতা খুবই চর্চিত একটি বিষয়। যদিও জাদু এবং বাস্তবতা—এদুটো শব্দ পরস্পরের ঠিক বিপরীত। আমাদের সাহিত্যে হরহামেশাই খুঁজে পাই নিরেট বাস্তবতার দুর্দান্ত বয়ান, যা জাদুময় কাল্পনিক উপাদানগুলোকেও খুব সহজে অতিক্রম করে। লেখক মোজাফফর হোসেনের কয়েকটি গল্পে বাস্তবতা এমনভাবে হাজির হয়েছে, যেখানে পারিপার্শ্বিকতা জাদুর উপাদানগুলোকে খুব সহজেই অতিক্রম করেছে। লোককাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন হয়নি যদিও দুয়েকটি গল্পে উপকথা ও পুরাণের উপস্থিতি জাজ্বল্যমান। বইয়ের ষোল ও সতেরো নম্বর গল্প ‘ফের প্রতিযোগিতায় খরগোশ-কচ্ছপ’ ও ‘সিসিফাস হাসে ঈশ্বরের হাসি’ সে সাদৃশ্য বজায় রাখে। ভিত্তি যা-ই হোক, ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শ্লেষ উদগীরণ হয়েছে এ গল্পগুলোতেও।
নামাজ শেষ করে মসজিদের এক পাশে মজিদকে ডেকে নিয়ে যান হুজুর। ফিসফিস করে বলেন, 'আমার প্রস্তাবটা ভেবি দেখো মজিদ মিয়া। এই দুর্যোগের মাঝে তুমার পরিবারের একখান গতি হইবে।'
মজিদ কোনো কথা বলে না। গোরস্তানের দিকে পা বাড়ায় সে। গেল বছর অনাবৃষ্টিতে মা মরছে, এইবার অতিবৃষ্টিতে ছেলেটা গেল। আশ্রয় আর হালের গরুটা ভেসে গেল গাঙ্গে; এখন মেয়েটার জীবনটাও...! (মসজিদ, পৃষ্ঠা নং ১২০)
বইয়ের শিরোনামযুক্ত গল্প ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ পরাবাস্তববাদ-আশ্রিত একটি চমৎকার গল্প। সাধারণভাবে মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ একটি অসম্ভব ব্যাপার তবে লেখক বাস্তবে দাঁড়িয়ে অবাস্তব এ কৌশলের দ্বারস্থ হয়েছেন সমাজে বিরাজমান তীব্র অন্যায়, অবিচার ও নৃশংসতার বর্ণনা দিতে—
বিশ্বের নব্বইভাগ মানুষ পশুর মতো খেটে মরছে, আর দশ ভাগ মানুষ কেমন ভোগ করছে দেখেছিস? সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র সব ব্যর্থ। ক্ষমতার রাজনীতিকে আমরা দোষ দিই, আসল অপরাধী হলো শিল্পপতিরা। না, অপরাধী আমরা, শ্যালা মধ্যবিত্তরা। হারুন বলে। ছাত্ররাজনীতি করত, সুযোগ পেলেই রাজনীতির কথা শুরু করে দেয়। আমি শিল্পীমানুষ, ওর কথায় তেমন আগ্রহ খুঁজে পাই না। সমাজ পরিবর্তন এখন শিল্পীদের কাজ না। শিল্পবিমুখ সমাজে সে সুযোগ আর নেই। (পৃষ্ঠা নং ২৯)
বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলোর মধ্যে ‘যে জীবন ফুটবলের’ ‘মিসিং পিৎজা বয়’ ‘পুনরুত্থান’ ও ‘বিড়াল-পোস্টমর্টেম’ও পরাবাস্তব-ভাবাশ্রিত চমৎকার গল্প যা পাঠকের ঢুলনি দূর করে লেখকের কুশলতা ও সক্ষমতার প্রমাণ দেয়।
চমৎকার ও দুর্দান্ত এ গল্পগ্রন্থ পাঠপূর্বক কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেনের লেখার ভঙ্গি, বাস্তব-অবাস্তব-পরাবাস্তবের সংশ্লেষে সহজ-সরল পরিবেশনা, গল্পের নিরেট বুনন, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতনের প্রতি তীব্র শ্লেষ ও সাবলীলতার চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায়, যা ফ্ল্যাপের বর্ণনার (কিয়দংশের) ঠিক বৈপরীত্য প্রদর্শন করে পাঠকের সতর্ক মনযোগের জোর দাবি জানায়—‘গল্পহীনতার গল্প নয় এগুলো; তবে সতর্ক মনোযোগে গল্প খু্ঁজতে গেলে পাঠক খেই হারাবেন।’
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন