গল্পে নতুন ভাবনার জানালা

অ+ অ-

 

মে মাসের মাঝামাঝি এক তপ্ত গুমোট অন্ধকার রাতে টেকনাফ হেলথ কমপ্লেক্সের কম্পাউন্ডে অন্ধকার চিরে এক জোড়া উজ্জ্বল সাদা গোল আলো জ্বলতে দেখা গেলে ওয়ার্ডবয় তাহির ছুটতে ছুটতে এসে আরএমও তপন বড়ুয়ার ঘুম ভাঙালো। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে তপন তখন কাঠের টেবিলটার ওপর মাথা রেখে মাত্রই চোখ দুটো মুজেছিল।

গল্পের নাম সূতানলী রাত। লেখক তানজিনা হোসেন। তিনি পেশায় চিকিৎসক ও অধ্যাপক। ছোটগল্পের অসাধারণ প্লট উপস্থাপন, থিম, চরিত্রায়ন, ঘটনা, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘর্ষ এবং এনডোমেন্ট তিনি এমন ভাবে রচনা করেন, যা পাঠকের জন্য নতুন জানালা খুলে দেয়। পাঠককে ভাবতে শেখায়। তাঁর গল্প মানুষের জীবনযাপনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দিকগুলোকে তুলে এনে বৃহত্তর আবেদন রেখে যায়। সূতানলী রাত, যে রাত বিষাক্ত সাপের মতো পিচ্ছিল, বিষময়, অসহনীয় ভয়ংকর যন্ত্রণার, আমরা যা দেখতে চাই না, তেমনই এক কাহিনি বলা হয় এখানে। আট হাজার প্লাস শব্দের এই গল্পটির প্রেক্ষাপট দেশের মানুষ জানেন, তারা শুনেছেন সেই যন্ত্রণাময় অডিও, অসহ্য অসহায়ত্ব নিয়ে খুঁজে ফিরেছেন বিশ্বাস আর প্রাণের নিরাপত্তা। তাদের চেতনায় ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলেছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতি ধিক্কার আর প্রতিবাদ। লেখক একটি গল্পের মাধ্যমে সেই শোনা ঘটনাকে নিজস্ব চিন্তন আর উপস্থাপনের কৌশলে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তাঁর কুশলতায় সংশ্লিষ্ট হয় আরও চরিত্র আরও ঘটনা।  সূতানলী রাত অনলাইন একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে। যতদূর মনে পড়ে তখন গল্পের শেষটি অন্যরকম ছিল। গল্পটি সম্প্রতি গ্রন্থিত হলে সেখানে পরিশেষে কিছু সংযোজন হয়। যেমন: তারা জানতে পারে না যে, ফোনের অপরপ্রান্তে একটি আকুল কণ্ঠ বারবার চিৎকার করে বলতে থাকেবাবা তুমি কথা বলতেছ না কেন? বাবা, ও বাবা তুমি কথা বলতেছ না কেন? এই আর্তনাদে সচেতন পাঠকের মনে পড়ে যাবে সেই ঘটনা। একরামুল হক, টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর এবং টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ২০১৮ র ২৬ মে মাদক বিরোধী অভিযানে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। তার নিহত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তের মোবাইলে ধারণকৃত অডিও কথোপকথন ফাঁস হলে দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। (সূত্র: বিবিসি বাংলা।) এই আলোচিত অন্ধকার ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা সূতানলী রাত গল্পটি এতদিন পর গ্রন্থভুক্ত হয়েছে তানজিনা হোসেনের এ বছর প্রকাশিত লেখকের গল্প সমগ্র বইটিতে।

লেখক তানজিনা হোসেনের ছোটগল্প অনেক কুশলতার ফসল বলে মনে করার যথেষ্ট যুক্তি আছে। কেননা প্রতিটি গল্প কোনো-না-কোনোভাবে পাঠকের জন্য নতুন ভাবনার জানালা খুলে দেয়। গল্প সমগ্র-এ গ্রন্থিত হয়েছে লেখকের ২০০২ থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পগুলো, তবে বিশেষভাবে নির্বাচন করা হয়েছে দুটি বইয়ের গল্প। একটি তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ অগ্নিপায়ী এবং আরেকটি আমাদের গ্রামে রাজকন্যা আসার কথা ছিল। উল্লেখ্য যে, লেখকের আরও একটি ছোটগল্পের বই, যাতে চমকপ্রদ ভাবে একই শিরোনামে দশটি গল্প রয়েছে—‘এটা একটা প্রেমের গল্প হতে পারত শিরোনামের বইটির কোনো গল্পই এই গল্প সমগ্রতে নেওয়া হয়নি। একেবারে স্বতন্ত্র এই বইটি একক থাকাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন হয়তো তিনি।

বর্তমান সময়ে ছোটগল্পের মধ্যে তত্ত্ব ও তথ্য বিধৃত করার প্রবণতা দেখা যায় যা পাঠকের মনে নতুন চিন্তা ও চেতনার পরিসর বিস্তৃত করে। এর ফলে লেখক শুধু কল্পনা বা বাস্তব পৃথিবীর কোনো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেই ক্ষান্ত হন না, তাকে বিবিধ তথ্যের সঠিক উল্লেখ ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে হয়। প্লট, ইভেন্ট, চরিত্র, ঘটনার পরম্পরা বা সংঘর্ষ একটি কাঠামো বা সেটিংসের মধ্যে ধারণ করে লিখতে হয়। ফলে গল্প শুধুমাত্র অবসরের কালক্ষেপন নয়, গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক কখনো কখনো সুনির্দিষ্ট কোনো বার্তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেন। তানজিনা হোসেনও শুধু গল্প বলেন না, লেখেন; সেই লেখার মধ্যে তত্ত্ব ও তথ্যের পরিবেশনা থাকে। গল্পের সেটিংসের গুরুত্ব রেখে সেটির কাঠামোগত যে উপস্থাপন এবং সুপরিকল্পিত, কৌশলগত দিকটির প্রাধান্য থাকে,  থাকে গল্পের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিণতি। সুতরাং গল্পের মধ্যে ধাবমান সৃষ্টিশীলতা পাঠকের মননে গভীর প্রতিক্রিয়া বা প্রভাব তৈরি করে। তাঁর গল্পপাঠের জন্য পাঠকের সচেতন মনোজগত দাবি করে। গল্প পড়ে সময় কাটালাম, রস-আস্বাদন করলাম, ব্যস ভুলে গেলাম, পাঠককে এমন প্রতিক্রিয়ার বলয় থেকে সরিয়ে বা ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তবে কি গল্পগুলো জটিল? নিশ্চয়ই না। আমাদের চারপাশের শত শত ঘটনার মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনারই শিল্পিত উপস্থাপন সহজ-সরলভাবে নিজস্ব কৌশলী রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে পাঠকের যাত্রা শুরু করে দেয়। পাঠক যাত্রা শেষে উপলব্ধি করে নেন যে, আমাদের জীবনযাপনে চেনা এই সকল ঘটনার সদূরপ্রসারী প্রভাব অস্বীকার করা যায় না, এড়িয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নেই।

উদাহরণ স্বরূপ ঈশ্বরের সন্তান গল্পে মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দি একজন হিজরা হীরাকে নিয়ে খানসেনাদের ঠাট্টা-তামাশার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে যেমন, তেমনই যুদ্ধে নাম-পরিচয়হীন এক সন্তানকে লালনপালন করার মানবিক কাহিনি এতে বিধৃত হয়েছে। গ্রিক মিথোলজির কথা মনে পড়ে যায় এটি পড়তে গিয়ে। হার্মাফ্রোদিতাস গ্রিক দেবতা হার্মিস ও অপরূপা দেবী আফ্রোদিতির সুদর্শন পুত্র বিকেলে ঝরনায় গোসল করতে গেলে ঝরনার উপদেবী তার সৌন্দর্য ও পৌরষ দেখে পাগল হয়ে যান। তারপর উপদেবী ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই প্রার্থনা করেন যে, হার্মাফ্রোদিতাসের মধ্যে তাকে চিরকালের জন্য বিলীন করে দেওয়া হোক। এভাবেই সৃষ্টি হয় অর্ধেক নারী অর্ধেক পুরুষ। সমাজে যার পরিচিতি হিঁজড়া-খুনসা-বৃহন্নলা কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ। লেখক সেই হীরার মধ্যে মানবিক যে গুন দেখিয়েছেন সেটি উল্লেখযোগ্য। এসেছে বাইবেলের সূত্র। পিতা ব্যতিতই কি যীশু জন্ম নে নিন? তাই যুদ্ধসন্তান বা ঈশ্বরের সন্তানের মধ্যে তবে পার্থক্য কোথায়? প্রদীপবাবুর অশ্রু গল্পের প্রদীপ কুমারের সমস্যা ভারি অদ্ভুত, তেপ্পান্ন বছর বয়সি মানুষটি কাঁদেন; কিন্তু তাঁর চোখ থেকে কোনো জল পড়ে না। তিনি চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক কারণ অনুসন্ধান করেন। গল্পের রহস্য লূকিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ সময়ের শত শত ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা যা তার মস্তিস্কে অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল। গল্পে একসময় বিয়াল্লিশ বছর পর কাঁদেন প্রদীপ কুমার। তখন তার চোখের জল যেন মধুমতি নদীর অভিশপ্ত সকল রক্তের দাগ ধুয়ে দিতে থাকে। গল্পের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োজনীয় তথ্য যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছেন লেখক। দ্রৌপদী গল্পে যে সকল নারীরা রেলপথে ভারতীয় শাড়ি-কাপড় কোমরে বেঁধে দেশে এনে ব্যবসা করে অসহায় জীবনটিকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম বা প্রয়াস করে যান, তারই ছবি এঁকেছেন, যা আমাদের রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা বা জানা। ঘটনার নেপথ্যে ঘটনার সঙ্গে মহাভারতের দ্রৌপদী কাহিনি চলে আসে, যখন গল্পের প্রধান চরিত্র রাবেয়াকে স্টেশন প্লাটফরমে দাঁড় করিয়ে তার কোমর থেকে কাপড় উদ্ধার করে চলে বিডিআর। মানুষের জীবনযাপনের ও অপমানের করুণ এই কাহিনি পাঠককে অভিভূত এবং বিমর্ষ করে বইকি। গল্পের নাম প্রোষিতভতৃকা অর্থাৎ যে নারীর স্বামী বিদেশে অবস্থান করছেন। আমাদের সমাজে এমন নারী যেন অরিক্ষত। তারা শকুন আর হায়েনার নিত্য শিকার। এমনই এক নারী রেনুর জানালার ধারে এক জাম্বুরা গাছে একটি বউ কথা কও পাখি সারদিন ডেকে চলে। রেনুর মনের কথা আর কাকে বলে? তার বিয়ে তার প্রেম, স্বামীর প্রতি আবেগময় ভালবাসা-বিশ্বস্ততা, বিবিধ চক্রান্তে ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে বারবার পর্যুদস্ত হতে থাকার গল্প এটি। কামুক পুরুষের ষড়যন্ত্রে তার অপরাধ হয়, সালিশ হয়। অবশেষে একদিন সে সোনালি পাড় সবুজ শাড়ি গলায় জড়িয়ে আত্মহননের পথ নেছে নেয়। পরদিন জাম্বুরা গাছে রোজ অবিরাম ডেকে যাওয়া বউ কথা কও পাখিটিকেও মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতীকী বর্ণনায় উপস্থাপিত গল্পটি পাঠককে অভিভূত করে।

তানজিনা হোসেনের গল্পের ক্যানভাস বৃহত্তর বিষয়, জনগোষ্ঠী, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিধৃত করার চেষ্টায় নিমগ্ন। রয়েছে তত্ত্ব ও তথ্যের প্রায়োগিক উপস্থাপন, তুলনামূলক প্রতীকী বিশ্লেষণ, ভাষা ও বাক্যের সংযত অনুসরণ। অতিরিক্ত বয়ান থেকে মুক্ত ও পরিশীলিত। তঁর গল্প মানুষের জীবনযাপনের ব্যক্তিগত বা আমাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া বিষয় যেমন আছে, তেমনি বৃহত্তর সামষ্টিক ক্ষেত্রকে উদ্ভাসিত করার দিকেও ধাবমান। তাঁর লিখণশৈলী প্রমাণ করে যে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে লেখেন। গল্প সমগ্র-এর গল্পগুলো নিঃসন্দেহে পাঠকপ্রিয় হবে। তানজিনা হোসেনের গল্প সমগ্র প্রকাশ করেছে গ্রন্থরাজ্য। মোট গল্প সংখ্যা ২২টি। ২৪০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৫৮০ টাকা।