কবিতার অনুবাদ: প্রসঙ্গ বনলতা সেন

অ+ অ-

 

অনুবাদ একেকজনের কলমে একেকভাবে প্রস্ফূটিত হয়। পাঠক যদিও ভালমন্দের ব্যাপারে তার মত-অনুভব প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু তাও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। একেক পাঠকের কাছে একেকজনের অনুবাদ ভাল লাগে বা লাগতে পারে। কারণ তাদেরও আছে নিজস্ব রুচি ও শিল্পবোধ। পাঠক কেবল বলতে পারেন, এটি ভাল লেগেছে, ওটি ভাল লাগেনি। কিন্তু তিনি অনুবাদের বৈধতা বা সাফল্যের চূড়ান্ত নির্ণায়ক নন। আমরা বলতে পারি, অনুবাদ নানারকমের হয় এবং এদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব। আমরা এখন সেই কাজটিই করবো।  

জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনেকেই অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন কবি নিজেও। অন্যান্য যারা তার কবিতার অনুবাদ করেছেন তাদের মধ্যে দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; একজন হলেন ক্লিনটন বি. সিলি [বই: A Poet Apart: A Literary Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1899-1954)] এবং অন্যজন ফকরুল আলম [বই: Jibanananda Das: Selected Poems with an  Introduction, Chronology, and Glossary]। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদককে কিছু ডিলেমার মুখোমুখি হতে হয়, যেমন১. অনুবাদ কি আক্ষরিকভাবে মূলানুগ হবে, না কি অনুবাদে স্বাধীনতা নেওয়া যাবে, ২. কবিতার ছন্দমিল ও ধ্বনিবৈশিষ্ট্য কি রক্ষিত হবে, না কি অর্থরক্ষার খাতিরে এসব বিসর্জন দেওয়া যাবে, ৩. কবিতার গঠন বা আকার কি একই থাকবে, না কি তা বদলানো যাবে, ৪. সাংস্কৃতিক ও ভূপ্রাকৃতিক শব্দাবলি [নামবিশেষ্য] কি অনূদিত হবে, না কি তার বর্ণান্তর হবে, ৫. ব্যাকরণবৈশিষ্ট্য ও বিরামচিহ্ন কি একই রকম থাকবে, না কি তা পরিবর্তিত হবে। অনুবাদককে এসব বিষয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুবাদকর্ম সম্পন্ন করতে হয়। এক্ষেত্রে একজন অনুবাদকের সিদ্ধান্ত আরেকজন থেকে পৃথক হতে পারে। অনুবাদকের সিদ্ধান্ত থেকে তার চিন্তাভঙ্গিরও প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভিন্ন চিন্তাভঙ্গির কারণে তাদের শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনও পৃথক হতে বাধ্য। তবে অনুবাদকের কোন সিদ্ধান্ত ভাল আর কোন সিদ্ধান্ত খারাপ সে ব্যাপারে রায় দেওয়া মুশকিল। কোনো সিদ্ধান্তই মন্দ নয় যদি সেটি সুফল প্রদান করে। অনুবাদ একেকজনের কলমে একেকভাবে প্রস্ফূটিত হয়। পাঠক যদিও ভালমন্দের ব্যাপারে তার মত-অনুভব প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু তাও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। একেক পাঠকের কাছে একেকজনের অনুবাদ ভাল লাগে বা লাগতে পারে। কারণ তাদেরও আছে নিজস্ব রুচি ও শিল্পবোধ। পাঠক কেবল বলতে পারেন, এটি ভাল লেগেছে, ওটি ভাল লাগেনি। কিন্তু তিনি অনুবাদের বৈধতা বা সাফল্যের চূড়ান্ত নির্ণায়ক নন। আমরা বলতে পারি, অনুবাদ নানারকমের হয় এবং এদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা সম্ভব। আমরা এখন সেই কাজটিই করবো।  

আমরা জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতাটি পাঠ করি এবং কে কিভাবে সেটির অনুবাদ করেছেন তা লক্ষ করি। আমরা এখানে মূল কবিতাটি এবং তার সঙ্গে তিনটি অনুবাদ লিপিবদ্ধ করছি। অনুবাদক তিনজন হলেন: জীবনানন্দ দাশ [কবি নিজে], ক্লিনটন বি. সিলি ও ফকরুল আলম। এরপর থেকে তারা তিনজন তাদের নামের প্রথম অংশ দিয়ে উল্লিখিত হবেন। এখানে অনুবাদকের যোগ্যতা সম্পর্কে একটু বলে নিই। অনুবাদক হওয়ার প্রথম শর্ত হলো দুই ভাষার [উৎস ভাষা ও লক্ষ্য ভাষা] উপর গভীর দখল। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদকের দ্বিতীয় একটি যোগ্যতা থাকতে হয়কবিতা লেখা অথবা কবিতা বোঝা। আমাদের নির্বাচিত তিনজন অনুবাদকের দ্বিভাষিক যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম ও তৃতীয়জনের মাতৃভাষা বাংলা এবং তারা দুজনেই ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছেন এবং পেশাগতভাবে ইংরেজি পড়িয়েছেন। দ্বিতীয়জনের মাতৃভাষা ইংরেজি এবং তিনি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা শিখেছেন, বাংলাদেশে থেকে; বাংলা ভাষার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তার রয়েছে। কাজেই তিনি বাংলা ভাল জানেন/বোঝেন বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। তার একটি বিশেষ সুবিধা হলো, ইংরেজি তার মাতৃভাষা, ফলে তার প্রকাশ ইংরেজির চলমান প্রথা-অভ্যাসের সমানুবর্তী হবে এমনই প্রত্যাশিত। কবিতা লেখার ব্যাপার যেখানে জড়িত, জীবনানন্দ কবি এবং উঁচুমানের কবি। বাকি দুজন কবি না হলেও কবিতার উঁচুমানের পাঠক ও শিক্ষক, তার সঙ্গে গবেষকও বটেন। আমরা তাদের কাব্যজ্ঞান ও কাব্যবোধের ওপর অনায়াসে আস্থা রাখতে পারি। আদতে তিনজনই তারা অধ্যাপক ও পণ্ডিত। অনুবাদক হিসেবে তাদের কোথাও কোনো কমতি নেই। যদিও অনেকে মনে করেন কবিতার অনুবাদ করতে হলে অনুবাদককে নিজে কবি হতে হবে, আমি সেরকম মনে করি না। কবিতা অনুবাদকের জন্য ভাষাজ্ঞান ও কবিতাজ্ঞানই যথেষ্ট। অনুবাদের কাজটি টেকনিক্যাল, এবং এর জন্য দরকার টেকনিশিয়ান। আমরা এবার কবিতা অনুবাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাই। 

 

মূল || বনলতা সেন

হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

 

|| জীবনানন্দ দাশের অনুবাদ

Long I have been a wanderer of the world, 
Many a night,
My route lay across the sea of Ceylon somewhat winding to 
The seas of Malaya.
I was in the dim world of Bimbisar and Asok, and farther off 
In the mistiness of Vidarbha.
At moments when life was too much a sea of sounds,
I had Banalata Sen of Natore and her wisdom.

I remember her hair dark as night at Vidisha
Her face an image of Sravasti as the pilot,
Undone in the blue milieu of the sea,
Never twice saw the earth of grass before him,
I have seen her, Banalata Sen of Natore.

When day is done, no fall somewhere but of dews
Dips into the dusk; the smell of the sun is gone
Off the Kestrel’s wings. Light is your wit now,
Fanning fireflies that pitch the wide things around.
For Banalata Sen of Natore. 

 

|| ক্লিনটন বি. সিলির অনুবাদ

For thousands of years I roamed the paths of this earth,
From waters round Sri Lanka, in dead of night, to seas up the Malabar Coast.
Much have I wandered. I was there in the gray world of Ashoka
And of Bimbisara, pressed on through darkness to the city of Vidarbha.
I am a weary heart surrounded by life's frothy ocean.
To me she gave a moment's peace—Banalata Sen from Natore.

Her hair was like an ancient darkling night in Vidisha,
Her face, the craftsmanship of Sravasti. As the helmsman when,
His rudder broken, far out upon the sea adrift,
Sees the grass-green land of a cinnamon isle, just so
Through the darkness I saw her. Said she, "Where have you been so long?"
And raised her bird's-nest-like eyes—Banalata Sen from Natore.

At day's end, like hush of dew
Comes evening. A hawk wipes the scent of sunlight from its wings.
When earth's colors fade and some pale design is sketched,
Then glimmering fireflies paint in the story.
All birds come home, all rivers, all of life's tasks finished.
Only darkness remains, as I sit there face to face with Banalata Sen.

 

|| ফকরুল আলমের অনুবাদ

For a thousand years I have walked the ways of the world, 
From Sinhala's Sea to Malaya's in night's darkness, 
Far did I roam. In Vimbisar and Ashok's ash-grey world 
Was I present; Farther off, in distance Vidarba city's darkness, 
I, a tired soul, around me, life's turbulent, foaming ocean, 
Finally found some bliss with Natore's Banalata Sen. 

Her hair was full of the darkness of a distant Vidisha night, 
Her face was filigreed with Sravasti's artwork. As in a far-off sea, 
The ship-wrecked mariner, lonely, and no relief in sight, 
Sees in a cinnamon isle signs of a lush grass-green valley, 
Did I see her in darkness; said she, "Where had you been?" 
Raising her eyes, so bird's nest-like, Natore's Banalata Sen. 

At the end of the day, with the soft sound of dew, 
Night falls; the kite wipes the sun's smells from its wings; 
The world's colours fade; fireflies light up the world anew; 
Time to wrap up work and get set for the telling of tales; 
All birds home—rivers too—life's mart close again; 
What remains is darkness and facing me—Banalata Sen!

এখানে একেকজনের অনুবাদ একেকরকম সৌন্দর্য বিকিরণ করছে। একেক অনুবাদের স্বাদ একেক রকম। কার অনুবাদ কার চেয়ে সবল বা দুর্বল হয়েছে তা বিচার করা আমার উদ্দেশ্য হয়। আমার উদ্দেশ্য তাদের অনুবাদের একটি তুলনামূলক আলোচনা করা। আমরা শুরুতে যে পঞ্চডিলেমা-সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেছিলাম সেসবের নিরিখে অনুবাদগুলো বিশ্লেষণ করবো।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের তিনজন অনুবাদক অনুবাদের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় তাদের নিজ নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। জীবনানন্দ একটু বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদের ব্যাপারে; অনুবাদেও তিনি সৃষ্টিশীল। ক্লিনটন ও ফকরুল যথাসম্ভব মূল আঁকড়ে ধরে থেকেছেন, ফলে তাদের অনুবাদ অধিকতর বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। মা তার নিজের সন্তানের কান যেভাবে মলতে পারেন, অন্যেরা সেভাবে পারেন না। জীবনানন্দ অনুবাদে মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন।

১. মূলানুগতা: তিনজন অনুবাদকের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ নিজেই অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন। যেমন আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, / আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। এই লাইনদুটোর অনুবাদ তিনি করেছেন এভাবে:  At moments when life was too much a sea of sounds, / I had Banalata Sen of Natore and her wisdom. বাংলায় ক্লান্তির কথা ছিল, ইংরেজিতে সেটি নেই; বাংলায় সমুদ্রের যে ফেনা ছিল, তা রূপান্তরিত হয়েছে  শব্দ/sound-এ; বাংলায় যে দু-দণ্ড শান্তি ছিল, ইংরেজিতে তা হয়ে গেছে wisdom বা প্রজ্ঞা। পুরো অনুবাদেই এরকম বিচ্যুতি [নেতিবাচক অর্থে নয়] আছে। এটি স্পষ্ট যে বাংলা কবিতাটিকে মূলঘনিষ্ঠভাবে অনুবাদ না করে তিনি একে পুনসৃজন করেছেন। ফলে দুটোর স্বাদ কিছুটা আলাদা হয়। এরূপ অনুবাদকে অনেকে translation বলেন না, বলেন transcreation. অন্যদিকে আমরা যদি বাকি দুজনের অনুবাদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো, তারা মূলানুগ থাকার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন। ক্লিনটন: I am a weary heart surrounded by life's frothy ocean. / To me she gave a moment's peace—Banalata Sen from Natore.” ফকরুল: “I, a tired soul, around me, life's turbulent, foaming ocean, / Finally found some bliss with Natore's Banalata Sen. এই দুই অনুবাদে বাংলার কোনো শব্দ-ভাব বাদ পড়েনি। মূলানুগ হওয়ার কারণে এই দুজনের অনুবাদ অধিক বিশ্বস্ত। অন্যদিকে কবির নিজের অনুবাদ হয়তো অধিকতর ভাবঋদ্ধ এবং শ্রীময়ী। 

২. ছন্দমিল ও ধ্বনিসাম্য: কবিতার ছন্দমিল ও ধ্বনিবৈশিষ্ট্য রক্ষা করাকে জীবনানন্দ ও ক্লিনটন তেমন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু ফকরুল গুরুত্ব দিয়েছেন। যেহেতু প্রতিটি ভাষার ছন্দতত্ব ও ধনিতত্ত্ব আলাদা, এজন্য অনুবাদে ছন্দমিল ও ধ্বনিসুষমা রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। অধিকাংশ সময় কবিতার অর্থের দিকেই মনোযোগ নিবিষ্ট থাকে। যদি অর্থকে খাটো করে ছন্দমিলধ্বনি অলংকারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় তবে তা শ্রুতিমধুরতা অর্জন করলেও বিশ্বস্ততা হারাতে পারে। সেই ভয়ে অনেকে ওপথ মাড়াতে চান না। বাংলায় কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা এবং প্রতিটি স্তবক a-b-a-b-c-c অন্তমিলে বিন্যস্ত। জীবনানন্দ ও ক্লিনটন অনুবাদ করেছেন ফ্রি ভার্সে, যা সচরাচর কাঙ্ক্ষিত। ফকরুলের অনুবাদে অন্তমিলের শব্দগুলো আমরা লক্ষ করতে পারি: প্রথম স্তবক [World-darkness-world-darkness-ocean-Sen], দ্বিতীয় স্তবক [Night-sea-sight-valley-been-Sen], তৃতীয় স্তবক [Dew-wings-anew-tales-again-Sen]। একেবারে নিখুঁত না হলেও অন্তমিলের এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। প্রতিটি শব্দেরই রয়েছে নিজস্ব ধ্বনিব্যঞ্জনা। পাশাপাশি একাধিক শব্দে একইরকম স্বর বা ব্যাঞ্জন ধ্বনি থাকলে অনুপ্রাস তৈরি হয়। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা”—বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রবাদপ্রতিম এই লাইনটি আ-কার ও র-ধ্বনির অনুপ্রাসে লালিত্যময়; এটি কি অনুবাদে আনা আদৌ সম্ভব? জীবনানন্দ খানিকটা চেষ্টা করেছেন—“I remember her hair dark as night at Vidisha। এখানে remember her hair dark অনুপ্রাস তৈরি করেছে। ক্লিনটনের অনুবাদে—“Her hair was like an ancient darkling night in Vidisha দৈবাৎ মিলে গেছে ধ্বনি—“Her hair, an ancient। ফকরুলের অনুবাদেও আংশিকভাবে অনুপ্রাসের স্পন্দন পাওয়া যায়। Her hair was full of the darkness of a distant Vidisha night। এখানে her hair-এ র ধ্বনি এবং  darkness, distant, Vidisha-তে ধ্বনির পৌনপুনিকতা বিদ্যমান।

৩. আকার বা সংগঠন: আমরা লক্ষ করলে দেখবো, কবিতার গঠন বা আকার রক্ষায় ক্লিনটন ও ফকরুল যেমন যত্নশীল  ছিলেন, জীবনানন্দ তেমনটি ছিলেন না। বাংলা কবিতায় প্রতিটি স্তবক ছয় চরণবিশিষ্ট। কিন্তু জীবনানন্দের অনুবাদে প্রতিটি স্তবক হয়েছে পাঁচ চরণের। [লক্ষণীয়, প্রথম স্তবকের প্রথম তিনটি লাইন দীর্ঘ হওয়ায় সেগুলো দু লাইন করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে; আমরা এগুলোকে এক লাইন হিসেবেই গণনা করবো।] ফলে মূল কবিতায় মোট চরণসংখ্যা ১৮, ইংরেজিতে হয়েছে ১৫। ষড়পদী [sestet]-কে কেন যে জীবনানন্দ পঞ্চপদী [quintet] বানিয়ে দিলেন তা বোধগম্য নয়। হয়তো সংক্ষিপ্তায়নের নীতি তার মাথায় কাজ করছিলো। তার সংক্ষিপ্তকরণের তোড়ে ভেঙ্গে পড়েছে বাক্যের ভবন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শব্দফুলের বাগান। বিপর্যয়ের [নেতিবাচক অর্থে নয়] একটি নমুনা আমরা এখানে পাই: twice saw the earth of grass before him, / I have seen her, Banalata Sen of Natore. সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, / তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন? / পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। কোথায় গেলো দারুচিনি দ্বীপ, কোথায় অন্ধকার, কোথায় কুশল জিজ্ঞাসা, কোথায় পাখির নীড়ের মতো চোখ, আর কোত্থেকেই বা আসলো দুইবার দেখা? এখানে ভাবসম্পদ হারানোর চিহ্ন বিস্তর। একইভাবে দুমড়েমুচড়ে গেছে এই জায়িগাটিও- তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; / সব পাখি ঘরে আসেসব নদীফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; / থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। অনুবাদে দাঁড়িয়েছে এরকম: Light is your wit now, / Fanning fireflies that pitch the wide things around. / For Banalata Sen of Natore. কোথায় গল্প, জীবনের লেনদেন, অন্ধকার, মুখোমুখি বসা? এই সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাগুলো অনুবাদে অন্তর্হিত। তার বদলে এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা। অনুবাদে এমনতর পরিবর্তন প্রত্যাশিত নয়। মূল কবিতাটি জীবনানন্দ নিজেই লিখেছেন বলে তাকে কারো কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়ার দরকার হয়নি। অন্য কেউ হলে তাকে ফায়ারিং লাইনে দাঁড় করানো হতো। 

৪. নামবিশেষ্য: ভৌগোলিক ও অন্যান্য নামবিশেষ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, তিনজনই সেগুলো রেখে দিয়েছেন। তবে এগুলোর অবয়বে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সিংহলকে জীবনাবন্দ বলেছেন Ceylon, ক্লিনটন Sri Lanka এবং ফকরুল Sinhala। মালয়কে ক্লিনটন ইংরেজিতে লিখেছেন Malabar, অন্য দুজন লিখেছেন Malaya। অশোককে জীবনানন্দ লিখেছেন Asok, ক্লিনটন Ashoka এবং ফকরুল Ashok। স্থানবিশেষ্য নাটোর [Natore] একইরূপে আছে। আমরা অন্যত্র লক্ষ করি ধানসিঁড়ি, কাশ, কার্তিক, দোয়েল, শালিক, শ্যামা, হিজল, তমাল, বট ইত্যাদি শব্দ অপরিবর্তিত রেখে দেওয়ার প্রবণতা। বাংলা না জানা ইংরেজি ভাষার পাঠকের জন্য এসব শব্দের রেফারেনশিয়েল মিনিং বোঝা কষ্টকর হলেও কনটেক্সট থেকে বাক্যের ভাব বুঝতে তাদের অসুবিধা হয় না। অনেক সময় পাঠকদিগকে সহায়তা করার জন্য এসব শব্দের অর্থ ফুটনোট বা এন্ডনোটে দেওয়া হয়। আলোচ্য কবিতায় চিলের উল্লেখ আছে, কিন্তু কেউ একে চিল হিসেবে রেখে দেননি। তিনজনই এর অনুবাদ করেছেন যথাক্রমে kestrel, hawk, kite, যদিও এরা তিনটি আলাদা প্রজাতির শিকারী পাখি।

৫. বাক্যের ব্যাকরণ: বাক্যগঠনের দিকে তাকালে দেখি, জীবনানন্দ বাংলা বাক্যকে ইংরেজিতে ভিন্নভাবে সাজিয়েছেন; অন্য দুইজন মোটামুটি ব্যাকরণ রক্ষা করে চলেছেন। কবিতার প্রথম লাইন হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”—জীবনানন্দ এর অনুবাদ করেছেন Long I have been a wanderer of the world। মূল বাক্যে একটি ক্রিয়াপদ ছিল, কিন্তু সেটি হয়ে গেছে বিশেষ্যপদ। ফলে হাঁটার ঘটনা নয়, মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছে যে হাঁটে তার ওপর। বাক্যটিকে ক্লিনটন অনুবাদ করেছেন এভাবে: For thousands of years I roamed the paths of this earth এবং ফকরুল অনুবাদ করেছেন: For a thousand years I have walked the ways of the world। তাদের বাক্যের গঠন মূলের কাছকাছি; তাদের অনুবাদে হাঁটা ক্রিয়াপদটি এসেছে। কিন্তু তারপরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তারা কেন ক্রিয়ার কালটি পুরোপুরি রক্ষা করেননি? মূল বাক্যটিতে পুরাঘটিত ঘটমান বর্তমান কাল [present perfect continuous tense] আছে; ক্লিনটন ব্যবহার করেছেন সাধারণ অতীত কাল [simple past tense] এবং ফকরুল ব্যবহার করেছেন পুরাঘটিত বর্তমান কাল [present perfect tense]। যদি বাক্যের ব্যাকরণ মানতেই হয়, তাহলে এর ব্যাকরণসম্মত অনুবাদ হতে পারতো এরকম: For thousands of years I have been walking down the path of the earth। তাতে কি অনুবাদ ব্যাকরণগতভাবে আরো মূলানুগ হতো না? আমার জানামতে, অন্তত তিনজন অনুবাদক এই ব্যাপারে চিন্তা করেছেন। একজন হলেন অনুপম ব্যানার্জি; তিনি অনুবাদ করেছেন এভাবে: For ages I have been walking the paths of this earth। দ্বিতীয়জন হলেন অরুণ সরকার; তিনি লিখেছেন: For thousand years I have been walking all over the world। তৃতীয়জন সৌমিক বসু; তার ভাষান্তর: For a thousand years I have been walking upon the bosom of my earth। জীবনানন্দের অনুবাদে অনেক ঘুরেছি আমি হয়ে গেছে my route; শিশিরের শব্দের মতন হয়ে গেছে no fall somewhere but of dews। এভাবে জীবনানন্দ মূলের ব্যাকরণবৈশিষ্ট্যকে অমান্য করেছেন বারবার। বিরামচিহ্নের ব্যাপারে অন্য দুজনের তুলনায় ফকরুল অবলম্বন করেছেন অতিরিক্ত সতর্কতা। বিরামচিহ্ন বাক্যশৈলির অংশ যেখানে প্রবাহমানতা ও বিরতি যুগ্মভাবে উচ্চারণ ও ভাবোৎসারে সূক্ষ্ম ভূমিকা রাখে অতি সংবেদনশীল পাঠকের কাছে। আমরা দেখি, সব পাখি ঘরে আসেসব নদীফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;”-এর অনুবাদ ফকরুল করেছেন দুটি ড্যাশ এবং বাক্যান্ত সেমিকোলনসহ। All birds home—rivers too—life's mart close again; ক্লিনটন ড্যাশের বদলে ব্যবহার করেছেন কমা এবং জীবনানন্দের অনুবাদে ড্যাশের কোনো পাত্তাই নেই। ব্যাকরণ ও বিরামচিহ্ন ব্যবহারের ব্যাপারে কোন স্বতঃসিদ্ধ সর্বমান্য নিয়ম নেই। এর ব্যবহার নির্ভর করে ভাষারীতির ব্যাপারে অনুবাদকের সংবেদনশীলতার ওপর।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের তিনজন অনুবাদক অনুবাদের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলায় তাদের নিজ নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। জীবনানন্দ একটু বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদের ব্যাপারে; অনুবাদেও তিনি সৃষ্টিশীল। ক্লিনটন ও ফকরুল যথাসম্ভব মূল আঁকড়ে ধরে থেকেছেন, ফলে তাদের অনুবাদ অধিকতর বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। মা তার নিজের সন্তানের কান যেভাবে মলতে পারেন, অন্যেরা সেভাবে পারেন না। জীবনানন্দ অনুবাদে মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন। বাকি দুজন অনাত্মীয় হিসেবে ভদ্র ও আনুষ্ঠানিক আচরণ করেছেন; গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। আমার কাছে তিনজনের অনুবাদই সমানভাবে আদরনীয়। তাদের অনুবাদের তুলনামূলক আলোচনা থেকে উৎকৃষ্টতার বহুত্ব সম্পর্কে আমার তাত্ত্বিক অনুমান শক্ত ভিত্তি লাভ করেছে।  

বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপঠিত কবিতাগুলির মধ্যে একটি। আমরা এ পর্যন্ত যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের ছাড়াও আরো অনেকে এই কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। যেমন: মার্টিন কার্কম্যান, জো উইন্টার, মেরি ল্যাগো, পুরুষোত্তম দাস, তরুণ গুপ্ত, প্রীতিশ নন্দী, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, আনন্দ লাল, সুকান্ত চৌধুরী, হায়াৎ সাইফ, অঞ্জনা বসু, জয়দীপ ভট্টাচার্য, অমিতাভ মুখার্জী, শান্তনু সিনহা চৌধুরী, তন্ময় স্যান্নাল, মালবিকা রায় চৌধুরী, সৌহার্দ্য দে, গাজী আবদুল্লাহ হেল বাকি, অমিত মুখার্জি, ওসমান গনি, মৌলিনাথ গোস্বামী, প্রমুখ। প্রত্যেক অনুবাদই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সেই বৈশিষ্ট্যসমূহ তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে এনে বিশ্লেষণ করতে পারলে অনুবাদসাহিত্য লাভবান হয়। এখানে খারাপ-ভালো, উচ্চমান-নিম্নমান, সফল-অসফল, সার্থক-অসার্থকের প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর। অনুবাদ বিচারের জন্য সর্বোচ্চ আদালত নেই। শব্দ ও বাক্য যদি অভিধান ও ব্যাকরণের বিরুদ্ধে না যায় তবে সেটিকে মেনে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।