আলবেয়ার লামরিসের ‘লাল বেলুন’

অ+ অ-

 

লাল বেলুন। এক শিশুর গল্প, শিশুদের জন্য। আদতে লেখা ফরাসিতে—‘ল্য বালঁ রুজ [Le ballon rouge]। ছাপা হয়েছিল পারিতে, ১৯৫৭ সালে। বইটি ইংরেজিতে দি রেড বেলুন [The Red Balloon] নামে অনূদিত হয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে ছেপে বের হয়। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে এ বছরের গোড়ায়২০২৩ সালের একুশের বইমেলায়পেশায় সাংবাদিক কামরুন নাহার সুমীর হাত ধরে। প্রকাশক ঢাকার শৈশব প্রকাশ।

যতদূর জানা যায়, বইটির বাংলায় অনুবাদ এর আগে হয়নি। তবে, অনুবাদ হওয়াটা জরুরি ছিল। দেরিতে হলেও হয়েছে। বাঙালি শিশুরা বিশ্ব শিশুসাহিত্যের একটি ভাল গল্প তাদের মায়ের ভাষায় পড়তে পারছে। আর এ কারণেই, অনুবাদিকার ধন্যবাদ প্রাপ্য। এর আগে অবশ্য অন্তত দুটি ইন্দীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছে বইটি। লাল গুব্বারা নামে হিন্দিতে, নয়া দিল্লি থেকে; অরবিন্দ গুপ্তার হাতে; প্রকাশক ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি। এবং লাল ফুগা নামে মারাঠিতে, পুনে থেকে; কল্পনা সঞ্চেতীর হাতে; প্রকাশ করেছে কজা কজা মরূ প্রকাশন। দুইটি বই-ই প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ সালে; হিন্দিতে আগে, মারাঠিতে পরে। বই দুটোই দ্বিভাষিক; উদ্দেশ্য হয়ত শিশুদের গল্প পড়ানোর পাশাপাশি ইংরেজি শেখানো। এবং দুটি বইয়ের অলঙ্করণ প্রায় একই রকমের।

পথে-পাওয়া একটি টকটকে লাল বেলুন এবং এক বালকের বন্ধুত্বের গল্প। বালক নয়, গল্পে বরং বেলুনই প্রধান চরিত্র। বালক হল সূত্রধর, দুই অর্থেইগল্প এগিয়ে নিয়ে যায় এবং প্রায়ই বেলুনের সুতো ধরে থাকে। গল্পে আছে সারল্যের সঙ্গে সর্বনাশের মোকাবেলা। একই সঙ্গে আনন্দ, একাকিত্ব, হতাশা, মুক্তি এবং আশার আলো। পুরো গল্পে যতটা বলে-যাওয়া শব্দ, তার চেয়ে বেশি না-বলা কথা। ছবি-প্রধান গল্প। এতে শিশুরা নিজেদের মত ভাবতে শেখে।

বড় হওয়ার পর আমরা প্রায় কেউই শিশুদের মত করে চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু, একটি কথা স্পষ্ট যে এই গল্পটি শিশুমনে দাগ ফেলবার মত কিংবা শিশুর কল্পনাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে আনন্দ দেবার মত। বড়রাও যতটা সম্ভব ফিরে যেতে পারে শৈশবের কল্পনায়।

ধারণা করি, অনুবাদিকা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন। বেশ খানিকটা স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদে, দুটি বাক্য একসঙ্গে জুড়বার, কিংবা এক বাক্য ভেঙে দুটি করবার। দুয়েকটি বাক্যাংশ বাদ দেবার। তাতে কোথাও গল্পের রসভঙ্গ হয় না। বরং, ঝরঝরে হয়েছে এবং এতে করে শিশুদের বুঝতে সুবিধে হবারই কথা। তারপরও, দুয়েকটি বক্তব্য পেশ করতেই হয় অনুবাদ নিয়ে। অতীত কালের কোনও কোনও ক্রিয়াপদ ও-কারান্ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আবার তা নয় খানিকটা সম্পাদনার অভাবের চিহ্ন। দুয়েকটি জায়গায় সম্মানবাচক সর্বনামের অনুপস্থিতি, যদিও সম্মানটুকু ক্রিয়াপদে বর্তমান।

ফরাসি কঁসিয়ের্জ [concierge] বা ইংরেজি জেনিটর [janitor] বাংলায় হয়েছে আয়া, ৯ এবং ১০-এর পৃষ্ঠায়। ১৪-র পৃষ্ঠায়—‘বেলুন উড়ে চলে গেল না দেখে প্যাসক্যাল অবাক হলো, আবার তা অনেক বেশি অবাকও করল না। ফরাসিতে বাক্যের শেষাংশটা mais pas tellement’ বা ইংরেজিতে but not really as surprised as all that’; বাংলায় কিন্তু ততটাও নয় গোছের কিছু হলে ভাল হত।

১৭-র পৃষ্ঠায়—‘কোনো কিছু বলে দেওয়া ছাড়াই, ফরাসিতে sans être attaché’ বা ইংরেজিতে ‘without being led by a string’; বাংলায় সুতো ছেড়ে দেবার পরও গোছের কিছু একটা। এই পৃষ্ঠাতেই আছে—‘বেলুনকে যা করতে বলা হলো, প্রভুভক্ত কুকুরের মতে সব সময় সে তা-ই শুধু করল না; আরও বেশি করলএরকম একটা আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়; আদতে ঘটনাটা উলটো। ফরাসিতে ‘Mais, comme les chiens, le ballon n'était pas très obéissant’ বা ইংরেজিতে ‘But, like a dog, it didn’t always do as it was told’; বাংলায় সব সময় তা-ই যে শুধু করল তা নয় ধরনের কিছু একটা হলে খটকা লাগত না।

গল্পে এক জায়গায় গির্জা শব্দের ব্যবহার হলেও, বাকি দুই জায়গায় চার্চ শব্দটির ব্যবহার খানিকটা ছন্দপতন ঘটায়। আমাদের ছোটবেলায় চার্চের চেয়ে গির্জা শব্দটাই বেশি কল্পনাময় ছিল। সময়ের সঙ্গে কল্পনার অনুষঙ্গও কি পালটায়? ২৩-এর পাতায় রুম শব্দটির বদলে ‘ঘর’, অফিস ঘর’ বা অন্য কিছু হলে ভাল শোনাত। ২৯-এর পাতায় ফরাসি ‘pâtisserie’ বা ইংরেজি ‘bakeshop’-এর বাংলা ‘বেকারি শপ’ না হয়ে কেবল ‘বেকারি’ কিংবা ‘কেকের দোকান’ হলেই ভাল ছিল। অনুবাদে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার খানিকটা শহুরেপনার ধারণা দেয়

বইটির হরফসজ্জার ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। প্রথাগত ভাবে বাংলায় দাঁড়ি, প্রশ্নচিহ্ন, বিস্ময়চিহ্ন, সেমিকোলন এবং কোলনের পরে দুই শব্দের মাঝে যতটা ফাঁক বা স্পেস থাকে ততটাই থাকলেও, চিহ্ন পাঁচটির আগেও খানিকটা ফাঁক বসে। এই ফাঁক সাধারণত চিহ্নের পরের ফাঁকের অন্তত তিনভাগের এক ভাগ, আর সর্বোচ্চ অর্ধেক। বইটিতে বাকি সব চিহ্নের আগে কোনও ফাঁক না থাকলেও, দাঁড়ি এবং কোলনের আগে প্রমাণ মাপের এবং কখনও আরও বেশি ফাঁক বেশ চোখে লাগে। শিশুরা দেখে শেখে। ছোটবেলায় সেই দেখার চোখে বেঢপ একটা ছবি এঁকে দেওয়া ঠিক নয়।

বইটিতে ফরাসি নামগুলোর উচ্চারণ বডডো ইংরেজি-ঘেঁষা। অবশ্য বাঙালি পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় দেখে ইংরেজদের চোখে আর পৃথিবীর আর সব ভাষার উচ্চারণ করে ইংরেজদের জিহ্বায়। প্রচ্ছদসহ সব জায়গায় লেখকের নাম আলবার্ট লামোরিস। ফরাসি উচ্চারণের নিয়ম অনুযায়ী নামের প্রথম শব্দটি কাম্যুর আলবেয়ারের মত; আলব্যেরও হতে পারে। পরের শব্দটি লামরিস; তবে, লামোরিস লেখা যেতেই পারে—আলবেয়ার লামরিস। বালকটির নাম বইটিতে প্যাসক্যাল; পাসকাল হওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে, বইয়ের প্রথম ব্লার্বে নামটি পাসকেল হিসেবে ছাপা আছে দু-বারলেখক পরিচিতিতে স্নাতকের জায়গায় অনার্স কেমন যেন এতিম শোনায়।

বইটিতে বানান ভুল অর্থে ছাপার ভুল প্রায় নেই এখনকার বাংলা ছাপায় প্রায়শই বানান ভুল থাকে এন্তার। এটি বড় পাওনা। কেবল গ্রন্থসত্বের পৃষ্ঠায় অনুবাদিকার নামের ইংরেজি বানানে y-এর জায়গায় i হয়ে রয়েছে। আর এই পৃষ্ঠাতেই বইটির দাম বাংলায় ২০০ টাকা লেখা হলেও, ইংরেজিতে ২০০ ডলার ছাপা হয়েছে। গ্রন্থসত্বের পৃষ্ঠাই বোধ হয় বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বেশি প্রুফ-না-দেখা ব্যাপার। হরফযোজনা খানিকটা দুর্বল। আশা করা যায়, পরের সংস্করণে অনুবাদিকা এবং প্রকাশক এই রকম বিষয়গুলোর দিকে নজর দেবেন।

আরও কিছু কথা বাকি থেকে যায়। বইটি আদতে একটি স্বল্প-দৈর্ঘ্য ছায়াছবির গল্প-নির্ভর। আর লেখকও একজন চিত্রপরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজক। আর ছায়াছবিতে পরিচালকের ছেলে নিজের নামে অভিনয় করেছে বলেই বইটিতেও বালকের নাম একই। লামরিস ছায়াছবিটি বানানো শুরু করেন ১৯৫৩ সালে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে।

১৯৫৭ সালে ইংরেজিতে ছাপা হলে, বইটি নিউ ইয়র্ক টাইমসের বছরের সেরা অলঙ্কৃত শিশুদের বইয়ের পুরস্কার পায়। ফরাসি এবং ইংরেজি দুটি বইয়েই ছায়াছবি থেকে নেওয়া সাদা-কাল এবং রঙিন ছবি দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে। বাংলা অনুবাদে ছবিগুলো আঁকা নিয়াজ চৌধুরী তুলির। আদি ছবির অনুকরণে হলেও, আলাদা। এবং, বাংলা বইটির অলঙ্করণ হিন্দি এবং মারাঠি অলঙ্করণের চেয়ে নিঃসন্দেহে ভাল। তবে বিশেষ করে প্রচ্ছদের অলঙ্করণে মূল বিষয়টি আরেকটু বড় হলে জীবনের-চেয়ে-বড় কল্লনার বিশালত্ব ধরা যেত বলে মনে হয়। ছাপা এবং বাঁধাই চমৎকার।

নিউ ইয়র্ক থেকে ইংরেজি অনুবাদ ছেপে বের হবার পর, গল্পটিকে মঞ্চস্থ করবার জন্য নাটকে রূপান্তরিত করেন অ্যান্টনি ক্লার্ক। বইটি ১৯৯৯ সালে লন্ডনের ওবেরন বুকস লিমিটেড থেকে ছেপে বের হয়।

আজকের সময়ে ছোট-বড় সবাই যখন মোবাইল, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটারের স্ক্রিনে ব্যস্ত, সে সময়ে এই বইটি চাই এবং এরকম আরও বই চাই শিশুদের বইমুখী করবার জন্য; তাদের চিন্তার বিস্তারের জন্যঠাকুরমার ঝুলি এবং সেরকম ধ্রুপদী বইগুলো তো এখন অনেকের কাছেই অনেকটা অতীত।

লামরিস ১৯৬০ সালে আরেকটি ছায়াছবি তৈরি করেন ‘বেলুনে ভ্রমণ; ফরাসিতে ল্য ভোয়াইয়াজ অঁ বালঁ [Le Voyage en ballon] এবং ইংরেজিতে ‘স্টোঅ্যাওয়ে ইন দি স্কাই [Stowaway in the Sky] বা ‘দি ট্রিপ ইন এ বেলুন [The Trip in a Balloon]। লাল বেলুনের বালক পাসকাল লামরিস আর তার দাদা উদ্ভাবক অঁদ্রে জিলের সঙ্গে নিজেদের বানানো হট-এয়ার বেলুনে আকাশ ভ্রমণের গল্প। এই গল্পেরও ছাপা বই আছে। অনুবাদিকা এর অনুবাদে হাত দেবেন কি?