সেলিম আল দীন ও ‘চাকা’য় স্বৈরাচার পতনের চিহ্ন

অ+ অ-

 

এখন বৃষ্টি পড়ছে, নাকি কাঁদছে আকাশ নিজেকে জিজ্ঞাসা করি! বিক্ষুদ্ধ মনের অস্থিরতায় মনে পড়লো সেলিম আল দীনকে, মনে পড়লো তাঁর চাকার কথা। নব্বইয়ের গণহত্যা তাঁকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাঁর কথানাট্য চাকা যারা পড়েছেন বা দেখেছেন তারা জানেন পাশ্চাত্য প্রভাব-বলয়ের বাইরে বেরিয়ে বাঙালি সমাজের নিজস্ব গল্প এবং যাপিত জীবনের নাটকীয় উপাদান সংগ্রহ করে তিনি কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হরগজ, হাতহদাই, চাকা, যৈবতী কন্যার মনসহ প্রভৃতি নাটকে তুলে ধরেছেন।

পাশ্চাত্য প্রভাবজাত বর্তমান নাট্যচর্চা আমাদের নাটককে ক্রমাগত দূরে ঠেলে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল যেখানে অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে হয়ে পড়েছিল শেকড়হীন। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা নাটক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের ও শিল্পদর্শনের সংস্পর্শে এসেছে। সেইসব শিল্পমাধ্যম ও দর্শন দ্বারা এ অঞ্চলের নাট্যকাররা প্রভাবিত হয়েছেন। তারা সেই দর্শন এবং আঙ্গিকে নাটক রচনার চেষ্টা করেছেন। ফলে আবহমান বাংলার সমৃদ্ধ নাট্যধারা বা নাট্যাঙ্গিকগুলো খুব স্বাভাবিক গতিতে সামনে এগুতে পারেনি। বাংলার সাধারণ মানুষের দ্বারা তৈরি হওয়া বাংলা নাটকের সুপ্রাচীন উৎসকে ছেঁটে ফেলে পাশ্চাত্য নাটকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মেকি ও প্রাণহীন সংলাপ প্রক্ষেপণ-সর্বস্ব নাটক নির্মাণের সমারোহ বেশি দেখা যায়। সেলিম আল দীন সেই প্রক্রিয়ার বিপরীতে কথা বলেছেন। তিনি শক্তভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, বাংলা নাটকের উৎপত্তি বাংলার জনপদ নাট্যক্রিয়া, পৌরাণিক ও লোককাহিনির মধ্য দিয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। যে সকল আঙ্গিকের ভিতর দিয়ে সহস্র বৎসর পূর্বে বা মধ্যযুগে পুরাণ নির্ভর কাহিনি, সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম নেওয়া কাহিনি, মঙ্গলকাব্য, কীর্তন ইত্যাদি বাংলা নাটকের ঐতিহ্যকে ধারণ করে এসেছে কথানাট্য এ-সকল আঙ্গিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সময়ে এসে বাংলা নাটককে ঐতিহ্যমুখী করার অভিপ্রায়ে বাংলা নাটকের জন্য একটি নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন সেলিম আল দীন। বাংলা জনপদের প্রান্তিক তথা ভূমিহীন নিম্নবিত্তের কৃষক-কামার-কুমোর-জেলে-তাঁতি ইত্যাদি প্রাকৃতজনের প্রাচীন জনপদ এবং বাঙালি সমাজের প্রান্তিক মানুষের নানামাত্রিক জীবনচিত্র পরম মমতায় মহাকাব্যিক নাট্যাঙ্গিকে ধারণ করতে চেয়েছেন। তিনি ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর চেয়ে বড় করে দেখেছেন মানুষকে। ফলে কোনো গোত্রের বা গোষ্ঠীর উপস্থাপক নন নাট্যকার সেলিম আল দীন; বরং তিনি প্রান্তিক জনমানুষের স্বর্গভূমি প্রাচ্যের একক নাট্যকথক। তিনি নাটক রচনায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; নাট্যাঙ্গিক নির্মাণে কুশলী সেলিম আল দীন অতীত কালের লোককথাকে আধুনিক মানববেদে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি বাঙালির মহাজীবনকে মহানাটকে রূপ দিয়েছেন। এ মহানাটকের পাত্রপাত্রীরা প্রকৃতপক্ষে বাংলা-জনপদের নিচু শ্রেণীর মানুষ। সোজা কথায় সেলিম আল দীন গ্রাম-বাংলার জীবনচিত্র প্রান্তিক জনমানুষের মধ্য দিয়ে অবলোকন করেছেন।

ব্যক্তিজীবনে ব্যবহারিক আচরণে অগোছালো থাকলেও সেলিম আল দীন তার শিল্পতত্ত্ব এবং সৃষ্টিশীল কর্মে এতটুকু অসচেতন ও অগোছালো ছিলেন না। দুটি ক্ষেত্রেই অনুসন্ধিৎসা ও ঐকান্তিক চেষ্টার সর্বাধিক ব্যয় করেছেন তিনি। দ্বিধাহীন ভাবেই বলা যায়, সেলিম আল দীনের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শিল্পতত্ত্ব। একই সঙ্গে তা বি-ঔপনিবেশিক সমাজের অভিব্যক্তি এবং উত্তর-আধুনিক শিল্পতত্ত্ব। একটি ধর্মীয় দর্শনে নিহিত নির্যাস নিংড়ে তাকে নতুন সাংগঠনিক কাঠামোদানের মধ্য দিয়ে যে নির্মিতি আলোচ্য তত্ত্বে লক্ষণীয় তাকে বিনির্মাণবাদের ধারায় দেখাও সম্ভব। সেলিম আল দীনের নাট্যোপাদান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তব ও সমকালীন জীবন থেকে আহরিত। সমকালীন সমাজ-জীবনের ভেতর দিয়ে নাট্যকার রওনা হন বাংলার প্রাচীন সমাজ-জীবন ও প্রান্তিক মানুষের জনপদে; যেসব মানুষের বসতি ওতোপ্রতোভাবে ভূমির সাথে সম্পৃক্ত, তারাই হয়ে ওঠে সেলিম আল দীনের নাটকের প্রাণ। তাঁর নাট্যকাহিনীতে জীবনের গভীর উপলব্ধি পাওয়া যায়।

সেলিম আল দীন নাটক উপস্থাপনে দেশীয় নাট্যাঙ্গিক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্বতার দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টা না হলে বাংলা নাটকের সমৃদ্ধ অতীতের কথা ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে, আমাদের নাটকের ইতিহাস আটকে যায় দুই শত বছরে। এ কারণে, এর প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে সেলিম আল দীন দেশীয় নাট্যাঙ্গিক নির্মাণে নিবেদিত হন। অনবরত নিরীক্ষার মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে দ্বৈতাদ্বৈত শিল্পদর্শনে বর্ণনাত্মক আঙ্গিকে নাটক রচনা করেন। এখানে কথাই মুখ্য। কথা মুখ্য বলেই তা কথানাট্য:

আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি, তাই এর নাম দিয়েছি কথানাট্য। গৃহাঙ্গনে কথক যে কিসসা বলেন দোহারদের সঙ্গে এ নাটকের আঙ্গিক পরিকল্পনায় সে রীতির শিক্ষাটা সক্রিয় ছিল। গ্রাম থিয়েটারের কাজে এ দেশের নানান অঞ্চলে যাই বলে এ দেশের শিল্প শস্যক্ষেতের নানান সুগন্ধি ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাই। পূর্ব পুরুষের সমৃদ্ধ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কৃষকের সাহস বাড়ে। নইলে একজন গায়েন আমার হাতের লেখায় সত্তর বাহাত্তর পৃষ্ঠার নাটক গাইবেন এ ধারণা ইউরোপীয় ধাঁচের নাটক থেকে পাবার কথা নয়।

কিত্তনখোলা থেকে সেলিম আল দীনের এই বাঁকবদল শুরু হয়। তিনি একেবারে ইউরোপীয় ধাঁচের সংলাপনির্ভর নাটক রচনা থেকে সচেতনভাবে সরে আসেন। চাকা, যৈবতী কন্যার মান, হরগজ ও স্বর্ণবোয়াল নাটকগুলো তিনি কথার শাসনে রচনা করেন। চাকা নাটকের গ্রন্থমুখে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন:

বাংলার ধূলিতে ও কাদার পটে অনবরত দাগ কেটে যাওয়া চাকার প্রতীকে সেলিম আল দীন মানুষের জীবনের যে মৌল কথাটিকে দেখতে পান, সেই কথা প্রকাশের জন্য তাঁকে সন্ধান করতে হয় কথাবিন্যাসের নতুন একটি চেতনাসংলাপ নির্ভর নাটক তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হয় না, আবার কেবল দেহছন্দ-নাচ-অভিনয় সকল কিছু তাকে এঁটে উঠতে পারে না, উপন্যাসের ধারা বর্ণনাও তার নিকট বলে মনে হয় না, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এবং ব্যক্তি-সমাজ-সংগ্রাম তাকে অবিরাম দুলিয়ে দিতে থাকে ভূত-ভবিষ্যত, এমত মুহূর্তে আমাদের এই নাট্যকার এক নতুন সাহিত্য মাধ্যম আবিষ্কার করে ফেলেনকথানাট্যনাটক, কবিতা, নাচ, গীত, উপন্যাস উপকথা ও কথকতার সমাহার।

বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এখানে একজন প্রধান গায়েন থাকে। তার সাথে থাকে দোহার। মূল গায়েন নেচে গেয়ে সুরে ও বর্ণনায় ঘটনা বা কাহিনি বলে যায়। সে বিভিন্ন বস্তু হাতে নিয়ে কাহিনির প্রয়োজনে প্রফস হিসেবে ব্যবহার করে। দোহারদের অনেকের কাছে ঢোল বা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র থাকতে পারে। মূল গায়েনের সাথে দোহারগণ মাঝে মাঝে বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করে। প্রয়োজনে তারা কণ্ঠ পরিবর্তন করে সেই চরিত্রের কাছাকাছি যেতে চায়। বর্ণনাত্মক এ আঙ্গিকগুলোর মধ্যে তারতম্যও দেখা যায়। তাঁর চাকা নাটকে উঠে এসেছে প্রান্তিক সাঁওতাল সম্প্রদায়ের দুই গাড়োয়ানের চিরায়ত মানবতাবোধ। চাকা এমন এক সমাজের কাহিনী যে-সমাজে লাশের সৎকারের ঠিকানা মেলে না। সমালোচক চাকা-র সমাজ সম্পর্কে মন্তব্য করেন

বেওয়ারিশ লাশের একটি আশ্রয় চাই, চাই সৎকারের মর্যাদা, মানবিক দায়বোধহীন শাসন ব্যবস্থায় সংসারের কেজো লোকেরা তার গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষম। সভ্য সমাজ মানুষ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববান হবে এটাই কাম্য। জীবিত মানুষের প্রতি কর্তব্য পালনে অভাবনীয় অনীহা যাদের তারা মৃতের জন্য কোনো দায়িত্ববোধ করে না। সেলিম আল দীন তাঁর নাটকে উল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ ও সামাজিক মানুষকে দেখেছেন।

চাকা কেবলই একটি নাটক নয় মূলত এটি আমাদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের একটি পাঠ। হাজার বছরের বাঙলার সংস্কৃতিকে আত্মপরিচয়ের মর্যাদায় অনুপ্রবিষ্ট হতে উদ্যোগী করে তোলে। বাঙালি হাজার বছরের গৌরবান্বিত সংস্কৃতিসমৃদ্ধ জাতি হলেও উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতে ঐতিহ্য-বিকাশের ধারায় দাঁড়াতে পারেনি এখনো। চাকা নাটকের মাধ্যমেই আমরা উপনিবেশ বিযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় এগুতে পারি। এ নাটকটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।

১৯৮৬-৮৭ সালের গণঅভ্যুত্থান আকস্মিকভাবে স্তব্ধ হলে অন্য সবার সঙ্গে আমিও সমান বিচলিত হই। রাজনৈতিক দলের বাদানুবাদের আবর্তে শহীদদের শব নামপরিচয়হীন দিগন্তের দিকে ভেসে যায়-এ রকম বেদনা এই চাকা নাটকের মূলে আছে।

সমকালীন একটি রাজনৈতিক বিষয়কে কথানাট্যে উপস্থাপন একটি চ্যালেঞ্জ ছিল বটে। এ ছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের পরিভাষাকে বর্তমান থিয়েটারে ব্যবহারের সাহস দেখিয়েছেন সেলিম আল দীন। চাকা শব্দটি গ্রামীণ জীবনে অতিপরিচিত একটি শব্দ। চক্র যানবাহনে পরিবহনে ব্যবহার হয় এ শব্দটি। একটি বৃত্তাকার যন্ত্রাংশ। কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অক্ষ বরাবর এটি ঘুরতে ঘুরতে যানবাহনটি এগিয়ে চলে। প্রতীকী ধারায় এটাও বলা যায় যে সভ্যতার শুরু হয়েছে মানুষের চাকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। চাকা সেলিম আল দীন-এর লোক-নাট্যরীতি অবলম্বনে রচিত একটি মর্মান্তিক নাটক। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও গণতন্ত্রের বিজয় এ নাটকের প্রেক্ষাপট। এই গণ-অভ্যুত্থানে অনেক দ্রোহী যুবক শাহাদৎ বরণ করে; কিন্তু তাদের সকলের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি, অনেকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন-কাফন পর্যন্ত পায়নি। কোনো কোনো ভাগ্যবানের মৃতদেহ আমাদের প্রান্তিকজনের সদিচ্ছায় কবরের মাটি পেয়েছে। নিম্নবিত্তের প্রান্তিক খেটে-খাওয়া মানুষের স্বাভাবিক মানবতাবোধের কারণে ঐসব ভাগ্যবানের মৃতদেহর সৎকার হয়েছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নাম-পরিচয়হীন এরকম এক ভাগ্যবান যুবকের লাশ বাংলার এক গ্রামের উদ্দেশ্যে গরুর গাড়িতে তুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গাড়ি রওনা হয়ে যায়, কাগজে অস্পষ্টভাবে লেখা ঠিকানার উদ্দেশ্যে। গাড়ির চাকা অবিরাম ঘুরে চলে কিন্তু গারোয়ান মৃত যুবকের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে পারে না। গারোয়ানের এই অবিরাম পথ চলা ও মৃত যুবকের বাড়ির সন্ধান করাই চাকা নাটকের বিষয়বস্তু। চাকা নাটকে কথকের বর্ণনার পুঙ্খানুপুঙ্খতায় তৈরি হয় গ্রামের ও পথের দৃশ্যসমূহ এবং তারই মধ্যে এসে পড়ে গুটিকয়েক চরিত্র, এবং কাহিনির একমুখী সরল অবয়ব। এ কথানাট্যের শুরু হয় এভাবে:

একদিন বৈশাখের কোন এক সকালে কাকেশ্বরী নাম গাঙের পাড়ে একটি গঞ্জ এলংজানি পূর্বদিকের সম্মুখে পশ্চিমে অবস্থান হেতু সুর্যালোকে স্থানে স্থানে ঝলমল করে।।

কোথায় কোথায় ঝলমল করে?

তবে শোন ধান তিল সরিষা ও গুড়ের আড়তের চালে যেখানে যেখানে ঢেউটিনের নতুন বান* সূর্যের প্রতিফলনও এক ধরনের আলোকিত ফলন এ কথা মান কিনা?

আর কোথায়?

হাটবারের সারে সার চালাঘরে এখন শূন্য বটে ভাঙা চালে প্লাস্টিকের ছাউনীতে।। আর কোন কিছু?

চাকা নাটকের মহড়ার দৃশ্য © ছবি: আনন্দ, প্রথম আলোর সৌজন্যে

চাকা নাটকটি রচনার পেছনে একটি রাজনৈতিক ঘটনার প্রভাব রয়েছে। ১৯৮৭ সালের দিকে যখন বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন চলছিল তখন নূর হোসেন নামের প্রায় অচেনা অজানা এক যুবক বুকে স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন। তিনি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নূর হোসেন ১০ নভেম্বর আকস্মিকভাবে পুলিশের গুলিতে মারা যান। এ ঘটনাটি নাট্যকার সেলিম আল দীনের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এ লাশের দায় কে নিবে? এই অজানা অচেনা যুবকের লাশটির কী হবে? কিভাবে পৌঁছে দিবে তার স্বজনের কাছে? রাষ্ট্রের এমন বিমূঢ় ঘটনায় নানাভাবে আন্দোলিত হয়ে ওঠেন নাট্যকার। নাটকটিতে নানা উক্তি, নানা বর্ণনায় সে-শঙ্কার রূপই প্রতিভাত হয়ে ওঠে। নাটকটিতে যখন বলেন—‘শহর থেকে একটি সরকারি লাশ এসেছে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানেই লাশের গন্তব্যে লাশকে পৌঁছানো বা নয়ানপুর কলেজের ছাত্রী রেহানা (১৯) যে ছেলেটাকে ভালোবাসে গোপন একটি রাজনৈতিক দলের সাথে কাজ করে, কিংবা এখন করুণা জাগে তাদের জন্য যারা তাকে হত্যা করেছেযারা তাকে ভুল ঠিকানার দিকে প্রেরণ করেছে*করুণা জাগে তাদের জন্য যারা পেট চিরেছে, হত্যার কারণ গোপন করেছে ইত্যাদি সংলাপ থেকে সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাট্যকার কোন বিষয়কে ইঙ্গিত করেছেন। সেলিম আল দীন নিজেই নাটকের কথাপুচ্ছে সে-দায় নিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক অভিপ্রায় নাটকের শরীরে নেইশিরায় হয়ত আছে। আমি ঠিক নিশ্চিত নইসমাজমনস্ক রাজনীতিপিপাসু পাঠক নাড়ি ধরে পাবেন কিনা তেমন উদ্বেলিত স্পন্দন তাদের নিজ নিজ ঘড়ি মিলিয়ে। না পেলে আমার অস্বস্তি নেই এই জন্য যে সমকালীন রাজনৈতিক আবেগ তাতে তড়িৎ ক্রিয়া করে নাআমি যদ্দুর জানি আমার কবিস্বভাব।

চাকা নাটকের কাহিনীবৃত্তে সেলিম আল দীন গ্রাম-বাংলার নিম্নশ্রেণীর ও নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। গ্রামের মানুষ সন্তানকে শহরে উচ্চ-শিক্ষাঙ্গনে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে নিয়ত উৎকণ্ঠা-উদ্বিগ্ন থাকে; কারণ তারা জানে না কার সন্তান কখন লাশ হয়ে বাবা-মার ঠিকানায় আসবে! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষে যেমন মানুষ অধীর উৎকণ্ঠায় প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে, একই অপেক্ষার পালা স্বৈরশাসনামলেও ছিল; না-জানি কার সন্তান কখন লাশ হয়ে ঘরে ফেরে! স্বৈরতন্ত্রের দুঃসময় চাকা-র কাহিনীতে ব্যক্ত করেছেন নাট্যকার। নাটকের আখ্যানভাগটা কী? এলংজানি নামে একটি গঞ্জ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কাকেশ্বরী নদী। গঞ্জের হাসপাতালে এক যুবকের লাশ পড়ে আছে। লাশটি পৌঁছে দেবার কোনো লোক নেই। বৈশাখের ভোরে একটি গরুর গাড়িতে জোর করে হাসপাতালের ডাক্তার পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় লাশটি তুলে দেয় গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে বাহের গাড়োয়ান ও সঙ্গীরা সারাদিন গাড়ি চালাতে থাকে। কিন্তু লাশের সাথে যে ঠিকানা দেওয়া হয় তাতে গাঁয়ের নাম খানিকটা মিললেও প্রকৃত ঠিকানা পায় না। বিভিন্ন স্থানে যায়। কিন্তু কোনো গাঁয়ের কেউ লাশটির দায়িত্বও নিতে চায় না। নয়ানপুর গ্রামের লাশটি নিয়ে উপস্থিত হলেও স্কুলের হেডমাস্টার নবীনপুরের বলে সন্দেহ হয়ে। শুরু হয় নবীনপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। এভাবে যেন এক অজানা গন্তব্য তাদের। পথিমধ্যে লড়াকু ষাঁড়দ্বয়ও আহত হয়। অপরিচিত এক বাজারে ভাত রেঁধে খায় গাড়োয়ান ও তার সঙ্গী। দীর্ঘ সময় কাটতে থাকে তাদের। লাশটিকে যখন কেউ গ্রহণ করছে না তখন লাশটির প্রতি প্রচণ্ড মায়া জন্মে বাহের গাড়োয়ানের। লাশটি তাদের সাথে থাকতে থাকতে একসময় যেন তাদেরই সঙ্গী হয়ে ওঠে। হোক অজানা অচেনা তবু তো মানুষের লাশ, তাই পথের ধারে অবহেলায় ফেলে যেতে পারে না মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষেরা। লাশের পচন-ধরা শরীরের গন্ধ-বাহিত বাতাস ডেকে আনে শেয়াল, কুকুর আর পিঁপড়ের সারি। বাহের গাড়োয়ানের সহ্য হয় না, বিপুল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে সঙ্গী লাশের শরীরকামী পিঁপড়ের ওপর। মৃত মানুষের শরীর জাগতিক সকল চাহিদায় নিরুৎসুক, কিন্তু জীবিত মানুষের ক্ষুধা অবিচলিত প্রশ্ন হয়ে বারবার বেঁচে থাকার মৌলিক শর্ত স্মরণ করায়। পথসঙ্গী অচেনা বন্ধুর লাশ বহনকারীরা পবিত্র মানসিক বিত্তে ভরপুর হয়ে কোথায় কোনো ঠিকানায় পৌঁছাতে না পেরে অবশেষে এক শীর্ণ নদীর বালুচরে নিজেরাই কবর খুঁড়ে জানাজা পড়ে লাশটিকে দাফন করে। বেনামি একটি মৃতদেহকে তার পরিজনের কাছে পৌঁছানোর আবর্তনের যে মানবিকযাত্রা সেটিই নাটকের মূল আখ্যানভাগ।

আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি তাই এর নাম দিয়েছি কথানাট্য। একে কথকতাও বলাা যায়। কিন্তু কথকতা অভিনয়রীতির নাম, নাট্যরীতির নয়। সেলিম আল দীনের এই বক্তব্যকে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় কেননা চাকা নাটকের ভাষা আঞ্চলিক হলেও এ সর্বজনীন অর্থই প্রকাশ করে। রূপক অর্থে নানা শব্দের ব্যবহার হয়েছে। গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির নানা বিশ্বাসগুলো নাটকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। বাঙালি জীবনে অভেদাত্মক জীবনবিশ্বাস এ নাটকের পরতে পরতে। বর্ণনা ও সংলাপে আবহমান বাঙালির গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে সাথে ফুটে উঠেছে নানা প্রথা, নানা রীতি, পরিবহন ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ নানা প্রযুক্তির রূপ। নানা উৎসব প্রসঙ্গ, চিকিৎসারীতি, খেলাধুলা ও ধর্মীয় বোধবিশ্বাস অনবদ্যভাবে প্রকাশিত। গ্রামীণ সংস্কৃতির যেন আন্তর্জাতিকতা। চরিত্র নির্মাণ; উক্তি-প্রত্যুক্তি রচনায় অসম্ভব জীবনঘনিষ্ঠে পৌঁছেছেন সেলিম আল দীন। বাহের গাড়োয়ান বাঙালির গ্রামীণজীবনের অনবদ্য প্রতিনিধি। বাহেরের হাতে যখন পঞ্চাশ টাকার নোট গুঁজে দেয় তখন তার নোটে ছাপা মসজিদের ছবির চেয়ে অন্য বিষয়ই মনের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। টাকার অভাবে যে খেপ ছেড়ে না দিলেও তার মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার অপরিসীম পরিচয় বিধৃত হয়ে উঠেছে। বাহের গাড়োয়ান গরুর গলায় ঘণ্টি বেঁধেছে। এ ঘণ্টি যেন গানের তালে তালে নাচে। বারবার মানিক পীর যেন তাকে আগলে রেখেছে। মৃত লাশটির সঙ্গে সঙ্গে যেন কারবার একটি মিল খুঁজে পায়। অলক্ষ্যেই বেদনার্ত হয়ে ওঠে।

আধুনিক সভ্য সমাজে মানুষকে যতদিন নির্মমতার শিকার হতে হবে ততদিন পর্যন্ত চাকা তার আপন নিয়মে মানবতার বাণী বহন করে মিহি সুরে কেঁদে চলবে। চাকা কথানাট্যে নাট্যকার দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন অর্থাৎ যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি কারণ নাট্যকারের ভাষায়, বাক্যের নিজস্ব পরিধিতেই এর অর্থজ্ঞাপকতা বিদ্যমান। এই সাধারণ একটি গল্পের সাথে জড়িয়ে থাকে জীবিত ও মৃতের মধ্যে এক দিনে তৈরি হওয়া সম্পর্ক, মানবিক বোধ, জীবিতদের অমানবিকতা, ধর্মের দায় এড়িয়ে চলা। চাকার সাথে চলমান ও থমকে যাওয়া জীবনের গভীর এক সম্পর্কও। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, সেলিম আল দীন নাটক রচনা করতে গিয়ে যেমন বিশেষ রচনাকৌশল গ্রহণ করেছেন, তেমনি এর বিষয়বস্তুও তিনি গ্রহণ করেছেন বাংলা জনপদের প্রান্তিক জনমানুষের জীবন-যাপন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি থেকে। সেলিম আল দীন রচিত নাটকের সংখ্যা অনেক। তিনি যখন নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন, তখন প্রথাগত ইউরোপীয় নাট্য-প্রভাব তাঁর ভেতর ছিল। তবে শুরু থেকেই তিনি বাংলা নাট্য-সাহিত্যকে ইউরোপীয় নাট্য-প্রভাব থেকে বের করে আনার জন্য সক্রিয় হয়েছিলেন। তিনি সমগ্র নাট্য-জীবনব্যাপী সচেষ্ট ছিলেনবাংলা নাটকে বাঙালি উপাদান ব্যবহার করে বাঙালিয়ানার প্রকাশ করতে। প্রথম-পর্বের অল্প কয়েকটি নাটকে তিনি সম্পূর্ণ ইউরোপীয় নাট্য-প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারলেও দ্বিতীয় পর্বের নাটকে সাফল্য অর্জন করেছেন। একথা সত্য যে, সেলিম আল দীন-এর নাট্য-প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় এই দ্বিতীয় পর্বের নাটক থেকেই শুরু হয়েছিল। এ পর্বেই সেলিম আল দীন নাটকে নিয়ে আসেন বাঙালির জীবন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির স্বাদ-গন্ধ; উপরন্তু এ সময় থেকে তাঁর নাট্য-পরিবেশনাতে ছিল ভিন্নতা; যে উপস্থাপন কৌশলে ছিল বাঙালিয়ানার ছাপ।

টীকা ও তথ্য-নির্দেশ

১.  সেলিম আল দীন, চাকা, ১ম-প্র, (ঢাকা: গ্রন্থিক, ১৯৯১), পৃ. শেষ প্রচ্ছদ (গ্রন্থমুখ)

২.  লুৎফর রহমান, ব্রতচারী শিল্পী, সেলিম রেজা সেন্টু সম্পাদিত, দুই বাংলার থিয়েটার, ০২ বর্ষ: ০২ সংখ্যা, (বগুড়া: শকুন্তলা প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ১৯৩-১৯৪

৩.  সাজেদুল আউয়াল, কালের কথক: সেলিম আল দীন, সেলিম আল দীন সম্পাদিত, থিয়েটার স্টাডিজ, ৮ম সংখ্যা, (ঢাকা: নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জুন-২০০১), পৃ. ১৩৭ (থিয়েটারওয়ালার বক্ষমান সংখ্যায় যা পুনর্মূদ্রিত)

৪.  ঢাকা থিয়েটার উৎসব স্যুভেনিরে দলের নাট্যাদর্শ, শেকড়ের সন্ধানে, মোসাদ্দেক মিল্লাত ও সাইমন জাকারিয়া সম্পাদিত, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, (ঢাকা: ১৬ মার্চ ২০০২), পৃ. ৩

৫.  রামেন্দু মজুমদার, সেলিম আল দীন: এক অসমাপ্ত মহাকাব্য, দৈনিক ভোরের কাগজ, (ঢাকা: ২৫ জানুয়ারি ২০০৮), পৃ. সাহিত্য সাময়িকী

৬.  অরুণ সেন, সেলিম আল দীন নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র, ১ম-প্র, (বগুড়া: দুই বাংলার থিয়েটার প্রকাশন, ২০০০), পৃ. ২৫

৭.  সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র ৪, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৯, পৃ. ১৫৩