আপনি আচরি সদাচার [তৃতীয় পর্ব]

অ+ অ-

পড়ুনআপনি আচরি সদাচার [১ম পর্ব]

পড়ুনআপনি আচরি সদাচার [২য় পর্ব]

|| বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা

বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা নিয়ে আলাপ করার জটিল ও কঠিন প্রচেষ্টায় সামিল হবার প্রয়োজনে এই পদ্মা বদ্বীপের সাম্প্রতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটগত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কার্যক্রম বিবেচনায় রাখা জরুরি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববঙ্গ এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনসংস্কৃতি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার হয়। আগে থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাব তো ছিলই, পাকিস্তান আমলে স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চা মুখোমুখি হতে থাকে একের পর এক নিষেধ ও বাধা-বিপত্তির। চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রধান বাহন বৈচিত্র্যময় বাংলা ভাষাকে সরাসরি নিশ্চিহ্ন করার। তবে বাঙালির সংস্কৃতি মনস্কতার শক্তি সে অপচেষ্টা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার নজির বাঙালি স্থাপন করে। এরপরও তৎকালীন ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের বকধার্মিক শাসকগোষ্ঠী ও তাদের স্থানীয় আজ্ঞাবাহকরা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি কালচার হিসেবে প্রচার করতে থাকে এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দিতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতিবিনাসী বৈষম্যমূলক অর্থনীতি, শিক্ষা এবং নীতিবিধির শিকল। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কৃতি সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং অবশেষে রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে কায়েম করে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাভিত্তিক স্বাধীন, স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। আশা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিকশিত ও বিস্তৃত হবে বিশ্বময়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সংস্কৃতি অন্তঃপ্রাণ। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচার পরতে পরতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অপরিমেয় মমত্ব। এদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রধান উপাদানসমূহের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কেবল আবেগীয় পরিসীমায় আবদ্ধ ছিল না। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমেদের গানে তিনি কেবল মুগ্ধ হননি, তাঁর সঙ্গে করেছেন রাজনৈতিক আলোচনাও। সিলেটে জনসভা করতে গিয়ে সভার শুরুই করেছেন শাহ আব্দুল করিমের গান দিয়ে। তখন শাহ আব্দুল করিম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাৎক্ষণিক গান রচনা করে সুর দিয়ে জনসভায় গেয়েছিলেনপূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা/ চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা/ জনগণের নয়নতারা/ শেখ মুজিবুর রহমান/ জাগো রে জাগো রে কিষাণ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী অবস্থাতেও তিনি সহবন্দী বিপ্লবী ফণি বড়ুয়ার গান শুনে কেঁদেছেন। কারাগারে বসে বার বার তিনি মানসচক্ষে দেখেছেন দেশের নদী, প্রকৃতি ও সম্প্রীতিময় সংস্কৃত মানুষের মুখ। তাঁর ভাষণের ভাষা খাঁটি, দেশি এবং বাংলাদেশের ভাষা। কলকাতার বাবুদের সৃষ্ট তথাকথিত প্রমিত ভাষাভঙ্গি তিনি এড়িয়েই চলেছেন। তাঁর লেখাতেও সে ছাপ স্পষ্ট। আসলে জাতির জনক স্পষ্ট ধরতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা। তাঁর পোশাক, চলন-বলন, সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বন্ধুসুলভ, ভাইসুলভ, পিতৃবৎসল ব্যবহার, আচরণ, সাহস, বিশ্বাস, জেদ, সরলতা, ভালোবাসা, দেশপ্রেম স্পষ্টতই এদেশের সমন্বিত সংস্কৃতি দ্বারা জারিত। সেকারণেই তাঁর নেতৃত্বে দ্বিজাতিতত্ত্বের আলোকে প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের দুর্নীতি, দুঃশ্বাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রক্ষক্ষয়ী লড়াইয়ে বাঙালি রচনা করেছে ধর্মনিরপেক্ষ, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কিন্তু বেদনায়ক এই যে, এই রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের নীতিতে সম্পূর্ণ সাজাবার অবসর শেখ মুজিবুর রহমানের হয় নাই। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রারম্ভেই ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায়ন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির বাস্তবায়ন কৌশল সম্পর্কে বিবিধ প্রশ্নের সূচনা হয়েছিল। আজ বায়ান্ন বছর পেরিয়ে গেলেও সেসব প্রশ্ন অমিমাংসিত রয়েছে এবং জটিলতর হয়েছে। আর তার প্রভাব অবধারিতভাবে সংস্কৃতিতে পড়েছে। বলা বাহুল্য হবে না যে, আজ ধর্ম ও সংস্কৃতির ঠাণ্ডা লড়াই বর্তমান বাংলাদেশে বাস্তবত কঠিন রূপ পরিগ্রহ করেছে।

নতুন রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, জনগণের পুনর্বাসন, দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে নতুন রাষ্ট্রকাঠামোয় গণতন্ত্রহীনতার লক্ষণ ক্রমে দেখা দিতে থাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে রাষ্ট্রীয়, প্রতিরক্ষাগত এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা দূর করার যথাযোগ্য পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপের পূর্বেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কায়েমীগোষ্ঠীর হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশে বদলে যায় সংস্কৃতির প্রধান নিয়ন্তা রাজনীতির রূপরেখা। বদলে যায় সংবিধানের মৌলিক নীতি। এর ফলে ভয়াবহ আক্রান্ত, বিপর্যস্ত এবং বিপথু হয়ে পড়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি। মানুষের জীবনধারায় বহুমাত্রিক অনিশ্চয়তা ও দ্রুত বিবর্তনের পরিবেশে শুরু হয় সংস্কৃতির পেছন পানে ছোটা। গত শতকের নব্বই দশকের প্রারম্ভেই পুনরুজ্জীবিত হয় গণতান্ত্রিক ধারা। তবে, প্রকৃত অর্থে ১৯৭২ সালের সাংবিধানিক মৌলিক নীতিতে ফেরা সম্ভব হয় না। রাজনীতির লক্ষ্য জাতি গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার বদলে হয়ে ওঠে ক্ষমতারোহন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার মিশন প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেও জাতির সংস্কৃতি বিনির্মাণের প্রতি মনোযোগী হবার নজির সৃষ্টি করতে পারেনি। যদিও ইতোমধ্যে প্রণীত হয়েছে জাতীয় সংস্কৃতি নীতিমালা। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিবিধ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। তবুও সংস্কৃতির বিকৃতি, বিনাশ এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় আত্মপরিচয় প্রকাশক সহস্র উপাদানের বিলুপ্তি ও বিলুপ্তির ঝুঁকি নিরসন সম্ভব হয়নি। আজকে আমরা বাংলাদেশের জনসাধারণ এমনকি পারস্পারিক সম্ভাষণের পরিভাষা বিষয়েও বিভ্রান্তিতে আছি। আমাদের ভেবেচিন্তে সতর্ককতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হয় কাকে সালাম জানাবো, কাকে আদাব, আর কাকেই বা সম্বোধন করব ঔপনিবেশিক পরিভাষায় [হ্যালো, গুড মর্নিং, হাই, কি অবস্থা, কি খবর]। বুজতে পারি না যে, আলাপ শেষ করতে খোদা হাফেজ বলব, নাকি আল্লা হাফেজ; জয় বাংলা নাকি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ! সংক্ষেপে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি সংস্কার, প্রাগ্রসরতা, প্রগতিশীলতার ভেতর দিয়ে প্রসারিত হবার বদলে বিভ্রান্তিকর ও অনির্দিষ্ট রূপান্তরের পথে চলেছে। এরকম বিবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক অমিমাংসা, বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা অনেকখানি জটিল এবং অনির্দিষ্ট করে তুলেছে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা সম্বন্ধে আলাপ করতে গেলে পটভূমিগত এই নাটকীয় বিভ্রান্তি আবশ্যকীয়ভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনীতিই বর্তমান যুগে জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ কাঠামো, এমনকি ব্যক্তির জীবন, চর্যা ও সংস্কৃতি চর্চার অবাধ পরিবেশ বজায় রাখার, পরিচালনা করার সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান। এমন শক্তিশালী রাষ্ট্রকাঠামোর অধিবাসী হয়েও আজও নির্দিষ্ট করে বুঝতে পারি না, আমাদের পরিচয় প্রকাশক পোশাক কি, আমাদের ঘর-বাড়ির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কি, আমাদের সংস্কৃতি কি ধর্মানুসারী নাকি ঐতিহ্যানুসারী! ঐতিহাসিকভাবে, তত্ত্বগতভাবে ঝাপসা এক ধরনের বোঝাপড়া থাকলেও ব্যবহারিক জীবনে বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপ চিহ্নিত করা নিঃসন্দেহে জটিল এবং প্রায় অনির্দিষ্ট। দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু রাজা, আফগান, পাঠান, মুঘোল, তুর্কি, ফরাসি, পর্তুগিজ, ইংরেজ, ইরেজি সভ্যতা-তাড়িত উচ্চবর্ণের হিন্দু, পার্সিয়ান পীর কত বহিরাগত সংস্কৃতির মিশ্রণই তো কালে কালে অনির্দিষ্ট সংস্কৃতি তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে এই পাললিক ভূমির জনসাধারণের উপর। আজ দেখতে পাই, প্রাত্যহিক চর্যায় সহজেই জায়গা করে নিচ্ছে খাদ্য সংস্কৃতি হন্তারক কর্পোরেট খাদ্যপণ্য। কি নগর কি গ্রাম, শিশুখাদ্য থেকে বয়স্কখাদ্য সর্বত্রই নেতিবাচক পরিবেশ-অসম্মত, জলবায়ু-অসম্মত খাদ্য সামগ্রী। যে দেশের প্রতি গৃহে মুড়ি-খই ভাজা হতো, চিড়া কোটা হতো, সেই মুড়ি-চিড়া পর্যন্ত চলে গেছে কর্পোরেট কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে, বিশেষ শ্রেণির ব্যাংক একাউন্টে পুঁজি পুঞ্জিভূত করতে!

আমরা আমাদের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানসমূহকে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী, মৎসজীবী, শ্রমজীবী মানুষের জীবনধারাকে, পীড়িতে বসে খাবার অভ্যাস, খোলামেলা হাওয়াসমৃদ্ধ লতাগুল্ম-বৃক্ষশোভিত বাসগৃহ, আটপৌরে বা উৎসবের পোশাক, অঞ্চলে অঞ্চলে বিস্তৃত বৈচিত্র্যময় বুলি, নিত্য ব্যবহার্য বস্তুগত উপকরণ, আচার, আচরণ, অনুষ্ঠান, ছড়া, প্রবাদ, সঙ্গীত, নৃত্য, মেলা, যাত্রা, খেলা, বিশ্বাস, পারস্পারিক লেনদেন ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মুরুব্বী নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ সমাজ, নারী নেতৃত্বের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ, শষ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবারের সকল পরিজন মিলে শিশু লালন-পালন, পাড়ার শিশুদের উপর সামাজিক অভিভাবকত্ব ইত্যাদি যাবতীয় সংস্কৃতি অবেহলা করেছি। উপেক্ষা করেছি পশ্চাদপদ, ছোটলোক, অশিক্ষিতের জীবনধারা, অশ্লীল, অপরিশীলিত অভিধা দিয়ে। এসব আমরা করেছি ঔপনিবেশিক শিক্ষার কারণে, হৃদয়ে খোদাই হয়ে রয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদ আর আশরাফি প্রবণতার কারণে। বৈষম্যের বিষ সার্বিক পারিবারিক, সমাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে বহন করে চলার কারণে; যৌথ জীবন ভেঙে দিয়ে প্রতিযোগিতাময়, স্বার্থপরতাপূর্ণ একক জীবনে আবিষ্ট হবার কারণে। গ্রাম আমাদের কাছে অন্ধকার, সুবিধাহীন, শিক্ষাবঞ্চিত, চিকিৎসাবঞ্চিত, নাগরিক সেবাবঞ্চিত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন; নিরক্ষর, ঘর্মাক্ত, কুসংস্কারচ্ছন্ন, পিছিয়ে পড়াদের আবাসভূমি। কিন্তু সময় কোনোকিছুই নিত্য রাখে না। পিছিয়ে পড়াদের মধ্যে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে স্থানান্তর প্রক্রিয়া, বৈষয়িক উন্নত জীবনের লক্ষ্যে। আমরা গ্রাম ছেড়ে নগরে সুখ খুঁজছি, সমৃদ্ধি সন্ধান করছি বাংলাদেশের অবহেলার শিকার সংস্কৃতি উপেক্ষা করে পরদেশ ভূমিতে, অপর সংস্কৃতিতে। বিপরীতে, নগরীয় সমস্ত কৃত্রিম বাসনা ও ব্যবস্থাকে গ্রামের গহীনে ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো দেশকে অসুস্থ, স্থবির, শ্বাসরুদ্ধকর, পারস্পারিক সম্পর্কহীন, যন্ত্রশাসিত, জিন প্রযুক্তির প্রবৃদ্ধিময় কঠোর নগর রাষ্ট্র হবার বাসনার বিকাশ ঘটাচ্ছি জাতির হৃদয়ে। মানবিক মিথস্ক্রিয়াহীন পরিসরে মানুষের সমাজ বা সংস্কৃতি কোনোকিছুরই শ্বাস-প্রশ্বাসের অবকাশ ও পরিসর অবশিষ্ট থাকে না।

ফলে, আমাদের স্বরূপ কি, আমাদের স্বাতন্ত্র্য কি এই বৈচিত্র্য ও ভিন্নতায় ভরা সাংস্কৃতিক বিশ্বে? আত্মপরিচয়ের সন্ধানেই উত্থাপন করতে হয় এই প্রশ্ন। কেননা, আমাদের সংস্কৃতির ঐকান্তিক উপাদান আমাদেরই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। বিখ্যাত সংস্কৃতি পণ্য শীতল পাটি ব্যবহারের সাধ্য আর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেই। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আরেক বিশ্ব-স্বীকৃত প্রতীক জামদানি পরিধানের সাধ্য আর আপামর নারীকুলের নেই। ইউনেস্কো চিহ্নিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ আমাদের বাউলগান এখন বাউলদের গুপ্ত সাধনা ও মানবিক জগত থেকে ছিনতাই হয়ে খপ্পরে পড়েছে তথাকথিত আধুনিক বেশের মেটালিক হাই ভোল্টেজ তারকা শিল্পী ও প্রযোজকদের সংস্কৃতি ব্যবসার। তারোপর, ধর্মের উগ্র প্রতিনিধিরা বাউলদের আক্রমণ করছে, হত্যা করছে, চুল কেটে দিচ্ছে, তাদের আবাস জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ক্ষত-বিক্ষত করছে এই রাষ্ট্রের আইনী কাঠামোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! অতএব, আমরা কীভাবে স্পষ্ট ব্যখ্যা করব আমাদের সংস্কৃতির রূপরেখা! আমাদের বিদ্যায়তন, বিদ্যা-বিষয়, বিদ্যার্জনের লক্ষ্য কেবলই সংস্কৃতি থেকে ছিন্ন হবার, কেবলই ধনতন্ত্রের দাস হবার। আমরা দামি খাদ্য চাই, ঝকঝকে পোশাক চাই, ইট-কংক্রিটে অবরুদ্ধ প্রাইভেসি সমৃদ্ধ প্রাণবায়ু নিরোধক চকচকে বাড়ি চাই। প্রতিবেশিতা চাই না, সংঘবদ্ধতা চাই না, আত্মীয়তা চাই না। চাই গ্রাম ত্যাগ করে নগরীয় নাগরিকতার জাতে উঠতে। দেশ ত্যাগ করে চাই বৈশ্বিক আভিজাত্যের অংশ হতে! আমাদের বিখ্যাত আতিথিয়েতায় ভাটা পড়েছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী যুথবদ্ধতা ভেঙে দিয়েছে আমাদেরই লোভ, লালসা, পরদ্রব্য প্রীতি, প্রবঞ্চনা প্রবণতা! আমরা তো ভুলেই গেছি মানুষ হতে গেলে সংস্কৃতি থাকতে হয়। সংস্কৃত হতে হয়। সংস্কৃতির উন্নতির জন্য সামষ্টিক যত্ন থাকতে হয়। সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে পরম্পরায় সঞ্চারিত হবার মুক্ত ও অবাধ পথ থাকতে হয়। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রবৃদ্ধিমুখী ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, বিপর্যস্ত করে চলেছে আমাদের সংস্কৃতিকে। সংস্কৃতি ছাপিয়ে প্রবলতর হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্মানুভূতি। প্রকট হয়ে উঠেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হিসেবে ইসলামী কট্টরতা অনুসরণের নসিহত। হায়ারার্কিক রুচিবোধ, অপরকে ছোট করে, ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে নিজেকে বড়, সুশীল, সক্ষম, শুদ্ধ, ধার্মিক, স্বচ্ছল, সফল প্রমাণ করার হীন প্রবণতাময় সংস্কৃতির দিকে উদ্ভ্রান্ত আদিম ভ্রমণ আমাদের বাংলাদেশে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। সংস্কার বলতে আমরা এখন বাহ্যিক পরিশীলন বুঝি, অবকাঠামোর উত্থান বুঝি। সাফল্য বলতে বুঝি, ধনী ও সকলের সেরা এবং ক্ষমতাবান হওয়া। সেরা হয়ে সকল অপরকে ছোট করে দেখাই আমাদের এখন সর্বজনীন প্রবণতা। এবং সেরারা বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করে না। সেরাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এই দেশে, এই সমাজে নেই। বাউল সমাজের আজও প্রচলিত প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক খাদ্যাভ্যাস আমাদের কাছে ব্যাকডেটেড। পাশ্চাত্য সভ্যতার নৈতিকতাবোধের নিন্দায় আমরা মুখর, অথচ পাশ্চাত্যের প্রতি প্রবল টান আমাদের সংস্কৃতির হাল ফ্যাশন। বাংলাদেশের মৌলিক সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন অতি ধনী হয়ে ওঠা পরিবারের শিশুরা বাংলাদেশে বেড়ে ওঠে না; এই দেশে, এই সমাজে, এই সংস্কৃতি পরিসরে থাকেই না। এখানে বিনির্মাণের বদলে উপেক্ষার সংস্কৃতি আজ শক্তিশালী। হয়তো তাই, অনির্দিষ্টতাই বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপ কিংবা অরূপ।

নিশ্চয় আমরা সংস্কৃতিহীন নই। আমরা এখনও ভাত না খেয়ে একদিনও যাপন করি না যেহেতু। অভ্যাসের নির্দিষ্টতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সব মানুষ একই ভাত খায় না। কেউ মোটা ভাত, কেউ চিকন। ভাত মানে তো ভাত কেবল নয়, তরকারিও সঙ্গে। তরকারি জোটে না তো সবার একইভাবে, পুষ্টি চাহিদামাফিক। বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে, মানুষ তাই, যা সে খায়। আমরা ভিন্ন ভিন্ন খাই, বিভিন্ন আচরণ করি। বলি যে, আমরা আসলে শংকর জাতি। তাই আমাদের সংস্কৃতি অনির্দিষ্ট। একে শুদ্ধাচার বলা চলে না। শুদ্ধাচার তো কোড অফ কনডাক্ট দ্বারা নির্দিষ্ট হবার কথা। নির্ণায়ক থাকার কথা। শুদ্ধাচারহীন হয়ে সংস্কৃতিমান হবার দাবি করা চলে না। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করে অপসংস্কৃতির ধারক-বাহক হবার চেয়ে প্রবঞ্চনা আর হয় না।    

 এ কথাও সত্য, রাজনীতি, নব অর্থনৈতিক বিন্যাস, নতুন শ্রেণিবিভক্ত পরশ্রীকাতর সমাজেও সংস্কৃতির নিজস্ব শক্তি ও যাত্রাপথ কোনো না কোনোভাবে অব্যাহত থাকে। কাজেই, সবকিছুর পরেও সকল বৈরিতার বিপরীতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি তার প্রবাহ ঠিক পথ নতুনভাবে নির্মাণ করতে সক্ষম। বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রবহমানতা তাই সংকুচিত হলেও ফুরিয়ে যায়নি এর পরম্পরার প্রবণতা। তা বোঝার জন্য আমাদের প্রবেশ করতে হয় আজকের কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, ব্রাত্য, গ্রামীণ সংস্কৃতি সাধক সমাজ, নারী সমাজ এবং পরম্পরাগত জীবনধারার গভীরে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি যে কত বৈচিত্র্যময়, পরিবর্তনশীল এবং অভিযোজন ক্ষমতা সম্পন্ন, তার সন্ধান, চর্চা, উদ্‌যাপন অবলোকনের সুবিস্তৃত মাঠ জনজীবনে রয়েছে। গঙ্গা যেখান থেকে পদ্মা, সেখান থেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। পঞ্চাশ বছরে নিরন্তর প্রকৃতি ও মানুষের ব্যক্তিক, পারিবারিক, উৎপাদনগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ঋতু বৈচিত্র্যগত, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক গমনাগমনের চির পরিবর্তমান ধারা ও রাজনৈতিক বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এই স্বাতন্ত্র্য বহমান। এখানে জনশিক্ষা, চিন্তাচর্চা, পরিবেশনা শিল্পের বিবিধ প্রবণতা মানুষের জীবনের অংশ হয়ে বেঁচে আছে। আজও মনসার পালা বা বিষহরির গান কিংবা পদ্মা পুরাণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবনোপলব্ধি ঘটে। আজও গম্ভীরা, পটগান, কবিগান, কীর্তনের আসর, পুঁথিকাব্য লোকশিক্ষার শক্তিশালী উপদান হয়ে দেশের প্রত্যন্ত আনাচেকানাচে প্রবলভাবে চর্চিত হয়। এখনও বিয়ের গানের কদর ফুরায়নি। বাউলের জীবন দর্শন, সঙ্গীত সংশ্লিষ্টতা, সহজিয়া সাধনা আজ সারা পৃথিবীর গবেষক, চর্চাকারী, সমাজ বিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানীদের আগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা স্পষ্ট করার রাষ্ট্রীয়, অরাষ্ট্রীয়, একাডেমিক পদক্ষেপের ঘাটতি দূর হলে নিশ্চয় নির্দিষ্টতা নির্মাণ করা সম্ভব। রাজনীতি তথা সরকার ব্যবস্থা ক্ষমতা-প্রিয়তা পরিহার করে সাম্য ও মৈত্রীর নীতিতে জনজীবন পরিচালনার দায়বোধ সম্পন্ন হয়ে উঠলে বাংলাদেশের সংস্কৃতির রূপরেখা অনন্য রূপে চিহ্নিত হতে পারবে। সংস্কৃতি-বিচ্ছিন্ন শিক্ষা দ্বারা এবং দুর্বৃত্তায়িত প্রক্রিয়ায় রচিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে হয়ে উঠতে হবে জনগণ-কেন্দ্রিক, বাংলাদেশের মৌলিক সংস্কৃতি সাপেক্ষ। কেবল বৈষয়িক উন্নতি সংস্কৃতি বিনির্মাণের বদলে বিনষ্টই করবে। বাংলাদেশের মানুষের চিরায়ত সংস্কৃতি সহিষ্ণু, মানবিক, নৈতিক, সর্ব-ধর্ম-সমন্বিত, প্রকৃতি বান্ধব, পারস্পারিক সম্প্রীতির সংস্কৃতি হিসেবে বিকশিত ও বিশ্বময় বিস্তৃত হবার যাবতীয় শক্তি ধারণ করে। প্রয়োজন সংস্কৃতি খাতকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। 

 

|| বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে প্রযুক্তির প্রভাব

সাম্প্রতিককালে পুরো পৃথিবী লাগামহীন প্রযুক্তি উত্থানে মত্ত। বলা যায় মানুষ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত অসীম চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে জিন সম্পাদনায় মানবশিশু সৃষ্টির প্রযুক্তি পর্যন্ত অর্জন করে ফেলেছে। বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্গানিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিপজ্জনক প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে মানুষ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারস্থ হতে একটুও কসুর করছে না কেউ। বিদ্যায়তনিক জগতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এখন পাঠ্য বিষয়। সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও প্রযুক্তিগত অত্যাধুনিকতার যুগে প্রবেশ করেছে, যদিও বাংলাদেশে প্রযুক্তি জগতে মৌলিক উদ্ভাবন নেই বললেই চলে। তবে, এদেশে প্রযুক্তি-দক্ষ এক বৃহৎ প্রজন্ম নিশ্চয় তৈরি হয়েছে, যাদের অনেকেই কাজ করছে আন্তর্জাতিক পরিসরে সুনামের সঙ্গে, সৃষ্টি করছে ইনোভেটিভ সফ্টওয়ার। সরকার গ্রহণ করেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঐতিহাসিক প্রকল্প। স্মার্ট সিটি, স্মার্ট ভিলেজ প্রতিষ্ঠায় সরকারের পাশাপাশি বিপুল উৎসাহিত বেসরকারি খাত। সাধারণ মানুষের জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব আচমকাই বদলে দিয়েছে সার্বিক সামজিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক পরিকাঠামো। প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি ব্যবস্থাকেও নবরূপ দান করেছে, ঘটাচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল উৎপাদন ব্যবস্থার বিস্তৃতি। মোবাইল ফোন, ফেসবুক, ইন্টারনেট, বিকাশ, মোবাইল ব্যাংকিং, ভিডিও কল ইত্যাদি ছাড়া একদিনও আর কল্পনা করতে পারছে না এমনকি নিরক্ষর, দরিদ্র, বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের মানুষও। এবং এই ত্রস্ত পরিবর্তন ঘটেছে জনসাধারণের ন্যূনতম প্রযুক্তি শিক্ষা বা প্রযুক্তি উপযুক্ত সচেতনতা ছাড়াই। বৃহৎ বানিজ্য, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসা, পণ্য বিপণন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কেনাকাটা, যোগাযোগ, চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ, গণপরিবহণ, পর্যটনসহ প্রায় সকল খাত অভিযোজন করে নিচ্ছে প্রযুক্তি। ফলে, সকল শ্রেণির, ধর্মের, অর্থনৈতিক অবস্থার, সামাজিক অবস্থানের বিভিন্ন প্রকার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়েছে বহু মাত্রায়। তবে, সমস্যা হলো শ্রেণি বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি সুবিধা সবার জন্য, এমনকি সব ক্ষেত্রেও সমান হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশে। করোনা মহামারীর সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ থাকার পর যখন, অনলাইন পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা আরম্ভ করলো, আমরা বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলাম যে প্রযুক্তি সুবিধা সকল মানুষের কাছে যেমন পৌঁছায়নি, তেমনি পৌঁছালেও প্রযুক্তির কার্যকর প্রয়োগে আমরা নিদারুন পশ্চাদপদ। যোগাযোগে, নিরাপত্তায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রযুক্তি ব্যাপক সহায়ক যেমন হয়েছে, তেমনি যানজট নিরসনে আমরা প্রযুক্তি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি; পারিনি প্রযুক্তিযুগের নতুন নতুন অপসংস্কৃতি, যথা, সাইবার অপরাধ, অনলাইন যৌন হয়রানি, জুয়া, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, মিথ্যা তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে। প্রযুক্তি বৈষম্যের এবং প্রযুক্তি যুগের বৈপরীত্যময় পরিবর্তনের এ কেবল এক-আধটি উদাহরণ মাত্র, যার সূত্রপাত মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্যের গভীরে, নৈতিকতার অবক্ষয়ে, শুদ্ধাচার ও সংস্কৃতি বিমুখতার মৌলিক পরিস্থিতিতে। এইসব আর্থ-সামাজিক-শিক্ষাগত ও চেতনাগত দুর্বলতা সত্ত্বেও, আজকের বাস্তবতা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যখন প্রযুক্তি সবকিছু ছাপিয়ে নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে মানুষের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধগত পরিবর্তনের। প্রযুক্তির চরম সুবিধা গ্রহণে অপ্রস্তুত ও অপ্রশিক্ষিত মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাসের জগত এবং সর্বপরি সংস্কৃতি পরিচালনা, পরিবর্তন, নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করছে অসমভাবে বিকশিত প্রযুক্তি। প্রযুক্তি বিশ্বায়নের গতি অবিশ্বাস্য দ্রুতগামী করেছে। দেশে দেশে, জতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে অনিবার্যভাবেই তাই অঙ্গীভূত হয়েছে প্রযুক্তির সংস্কৃতি। প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তি সৃষ্ট কৃত্তিম যান্ত্রিক মানুষ, যার মুখোমুখি প্রাকৃতিক মানুষের অস্তিত্ব নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে।

এই নতুন বাস্তবতায়, বাংলাদেশের জনসংস্কৃতি দৃশ্যমানভাবেই প্রভাবিত। আমরা লক্ষ্য করছি সংস্কৃতির নবতর বিন্যাস। শিশু ও তরুণ-তরুণীদের খেলাধুলা ও বিনোদনের পরিসর ইতিমধ্যে সংকীর্ণ ও প্রায় বিলুপ্ত হবার ফলে বাংলাদেশের তারুণ্য বৈচিত্র্যময়ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে প্রযুক্তি জগতে। তথ্য সংগ্রহে, শিক্ষা কার্যক্রমে, আর্থিক কর্মকাণ্ডে এবং সবচেয়ে বেশি বিনোদনের প্রয়োজনে হাজারও শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীসহ প্রায় সকল বয়সী মানুষ প্রযুক্তি ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জীবন-যাপনে যুক্ত হয়েছে টিকটক, ব্লগিং, ভ্লগিং, গ্রুপ চ্যাট, গ্রুপ কল, ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব লাইভ, ভার্চুয়াল রিলেশনশিপসহ বহুবিধ নতুন নতুন সাংস্কৃতিক উপাদান। বহুজন যুক্ত হতে শুরু করেছে ক্রিপ্টো কারেন্সির সঙ্গে। বাংলাদেশের মানুষ আর নদীর কিনারে, বড় গাছের তলায়, বাড়ির বহিরাঙ্গনের টং-এ, উঠোনে, খানকা বা কাচারি ঘরে, চায়ের দোকানে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে না। যেখানেই থাকুক চোখ তাদের মোবাইল ফোন স্ক্রিনে। তথ্যের জন্য খবরের কাগজ পড়া, বিনোদনের জন্য, জ্ঞান চর্চার জন্য বই পড়ার অভ্যাসে ক্ষয় ধরেছে। ইউটিউব, গুগল, এক্স, ফেসবুকের রাজ্যে সারাবিশ্বের মানুষের মতো বাঙালিরও বিচরণ চোখে পড়ার মতো। ইন্টারনেটেই সেরে নেয়া যাচ্ছে বেশিরভাগ সামাজিক, পেশাগত ও বানিজ্যিক কাজ। মানুষের সময় কাটছে পর্ন সাইট থেকে শুরু করে ধর্মীয় সাইটে চোখ রেখে। প্রযুক্তির ভালো ও মন্দ দুই রকম প্রভাবই আছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পারস্পারিক মত বিনিময়ে যেমন আশা জাগানিয়া শাহবাগ আন্দোলন বা কিশোর-কিশোরীদের যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের নজির সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ঘটছে জঙ্গিবাদের প্রচারণা কিংবা গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যার উদাহরণও তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। প্রযুক্তি এমন এক যোগাযোগ সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে যেখানে রক্তমাংসের উপস্থিতি ছাড়াই ব্যক্তি তার অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারে দেশের তো বটেই এমনকি পৃথিবীর সম্ভাব্য ও পছন্দের যেকোনো প্রান্তে। ফলে, সমাজ বা সম্প্রদায়ের ধারণা স্থানীয় ঐক্য ছাপিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভার্চুয়াল সমাজ ও সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি। প্রযুক্তির কারণে বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে নতুন ভাষা ব্যবস্থা। প্রযুক্তিগত যোগাযোগ মাধ্যম প্রসারের প্রাথমিক পর্যায়ে রোমান হরফে বাংলা লিখতে হতো, এখন বাংলা হরফে সহজে লেখা যায়। তবু রোমান হরফের ব্যবহার রয়েই গিয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন বাংলা শব্দও। বাংলায় হাজির হয়েছে প্রোফাইল, স্ট্যাটাস, পোস্ট, আনফ্রেন্ড, ফিড, পেজ, গ্রুপ, মিম, ইমোজি, ফ্রেন্ডের স্থলে ফ্রান্স কত কি! প্রমিত বাংলা ভাষা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে প্রযুক্তি মাধ্যমে। নানা অঞ্চল ও প্রমিতের মিশ্রণে জন্ম নিয়েছে ভাষার কীয়েক্টাবস্থা! বেড়েছে শব্দ নিয়ে খেলার প্রবণতা, স্ল্যাং প্রয়োগের ঝোঁক। এর প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়ছে বাস্তব ব্যক্তিদের জীবনে, সমাজে, সংস্কৃতিতে। এই প্রযুক্তিক বাস্তবতায় চিরায়ত এবং পরম্পরাগত আবহমান সংস্কৃতির স্থান একবারেই নেই তা নয়। প্রযুক্তি ভিত্তিক ডিজিটাল সমাজেও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নবায়ন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এই নবায়নের দৃশ্যমান প্রারম্ভ সূচিত হয়েছে সাম্প্রতিক করোনা মহামারীকালে।

তৃণমূল পর্যায়ে, প্রভাবশালী নগরীয় সংস্কৃতি বলয়মুক্ত জনসংস্কৃতি অভিযোজিত হয়েছে প্রযুক্তিগত মোবাইল ফোন ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যম, যথা, ইউটিউব, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপসহ নানা ভার্চুয়াল মাধ্যমে। বাউল সাধু-গুরুগণ সরাসরি স্থানীয় নতুন প্রজন্মসহ দীক্ষাদান করছেন নানান দেশের অদেখা শিষ্যদের। কীর্তন, পালা, কবিগান, গম্ভীরা, বিয়ের গান, ভাওয়াইয়া, মাজার কেন্দ্রিক সংস্কৃতি, ওয়াজ সংস্কৃতি, উৎসব, পার্বন, মেলা সবকিছুর লাইভ বা রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত, প্রকাশিত, প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গীতে, পুঁথিতে, পালায়, কবিগানে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তির নানা অনুসঙ্গ দেহতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, আধ্যাত্মবাদের ভাব প্রকাশের প্রতীক ও সংকেত হিসেবে।

প্রযুক্তির কারণে তৈরি হওয়া সংস্কৃতির নতুন প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিকে সদাচারী, শুদ্ধাচারী হিসেবে দেখতে চাইলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি কাঠামো ও পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই বলেই মনে হয়। প্রযুক্তি মাধ্যম প্রবলভাবে ব্যক্তি জীবনের দিকে মানুষকে ঠেলে দিলেও ব্যক্তির লক্ষ্য চূড়ান্তভাবে সমাজ, সম্প্রদায় ও সমষ্টি। প্রযুক্তি সর্বস্ব হয়ে ওঠা ব্যক্তি মানুষ কেবল মনস্তত্ত্বিক ও শারীরিকভাবেই বদলে যাবে তাই নয়, বদলে যাবে ব্যক্তি মানুষের সমষ্টি, সম্প্রদায় ও সমাজও। সুতরাং সংস্কৃতিকে আমরা জাতিগতভাবে কী রূপে দেখতে চাই, তার নিরিখে প্রযুক্তি জগতকে উপযুক্ত করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানকেই পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রই আর এককভাবে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে না। কেননা, প্রযুক্তির আকাশের কোনো সীমা নেই, মানুষের সৃষ্টি প্রযুক্তির সীমা বেঁধে দেওয়ার একমাত্র উপায় মানুষে মানুষে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। সেই ঐক্য ভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতার ঐক্য হয়ে উঠতে হবে আবশ্যকীয়ভাবে। সে কারণে পুরো বিশ্বকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। অন্যথায়, স্থানীয় সংস্কৃতি, জাতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি যে পরিভাষাতেই চিহ্নিত করি না কেন জাতি-পরিচয়, গোষ্ঠী-পরিচয়, সম্প্রদায়-পরিচয় প্রকাশক সংস্কৃতির যাবতীয় অভিব্যক্তির মধ্যে আমাদের বিলীন হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে, তেমন আশঙ্কা আমরা করতে চাই না। যেকোনো পরিস্থিতিতে সংস্কৃতি তার স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করার শক্তি ধারণ করে বলেই তা সংস্কৃতি। প্রযুক্তির দাসে পরিণত হওয়ার সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি মানুষ মেনে নিতে সক্ষম হবে না। প্রযুক্তি যেহেতু মানুষেরই সৃষ্টি, সুতরাং মানুষ প্রযুক্তিকে নিজেদের প্রয়োজনেই সংস্কৃতির অধীন করে তুলবে।

    

১০ || বাংলাদেশে সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যত

সংস্কৃতির সুবিশাল পরিসর। তাতে সদাচার ও অসদাচার একাকার হয়ে বিরাজ করে। লালন বলেছেন, এক দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তাই। সংস্কৃতির সদাচার ও অসদাচার নির্দিষ্ট হয় স্থান, কাল, আদর্শ, বিশ্বাস ও সংশ্লিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতের সাপেক্ষে। সাধারণভাবে সংস্কৃতি সদাচার ও অসদাচারের ধারণাকে সমন্বিতভাবে ধারণ করে। তবে, সংস্কৃতি অধীন জাতি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তি পরম্পরায় অর্জিত মূল্যবোধ দ্বারা সদাচারী সংস্কৃতি ঐতিহ্যগতভাবে  আকাঙ্ক্ষা ও লালন-পালন করে। এই চিরায়ত প্রত্যাশার শক্তিই জীবনাচার, আচার-ব্যবহার, শিল্পবোধের সংস্কার সাধনে মানুষকে ব্যাপৃত করে। সংস্কৃতির পটভূমি রচিত হয় স্থান-বিশেষের প্রাণ-প্রকৃতি, উৎপাদন ও বিপণন, অর্থনীতি, সমাজ কাঠামো, সমাজের মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতা ও মিথস্ক্রিয়া, চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির ধরনের সাপেক্ষে। এর কোনোকিছু স্থির, নিত্য নয়, সদা পরিবর্তনশীল। এই ভিত্তিতে সংস্কৃতির ভবিষ্যত নির্ভর করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মাচরণ, যোগাযোগ অবস্থা ইত্যাদির বর্তমান ও চলমান চর্চা ও প্রবণতার উপর। তার মানে হলো, সংস্কৃতির ভবিষ্যত অনুমান করা যায় মাত্র, নির্দেশ করা যায় না, তবে, সংস্কৃতিপথ নির্মাণের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে প্রত্যাশিত পথে পরিচালিত করা সম্ভব।

সুতরাং বাংলাদেশের সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে বর্তমান সময়ের স্থানীয় ও জাতীয় উৎপাদন ও বিপণন, এই পললভূমির প্রাণ-প্রকৃতি ও ভূবৈশিষ্ট্যের মৌলিকত্ব সুরক্ষার প্রচেষ্টা, স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া ও তাতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ, অধিবাসীদের স্থানান্তর ও পরিভ্রমণ প্রবণতা, তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় মানুষের যোগাযোগ আচরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ কার্যক্রম ইত্যাদির উপর।

বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বিশ্ব ব্যবস্থায় সকল দেশ, জাতি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তি তাদের সমস্ত সাতন্ত্র্যবোধ সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকতার অংশ। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে বিনিময় এখন কেবলই পণ্য ও জ্ঞানে সীমায়িত নয়, সংস্কৃতিগত বিনিময়ও আজ অনিবার্য, আবশ্যকীয় এবং স্বাভাবিক। তবে বাস্তবতা এই যে, এই বিনিময় যজ্ঞে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রসার দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে যতটা ঘটেছে, অন্যান্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ততটা নয়। এর পেছনে আছে আন্তর্জাতিকতার রাজনীতি, ভাষার ঔপনিবেশিকতা, পশ্চিমা বিশ্বে পুঞ্জিভূত অর্থ, ক্ষমতা ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য। অনুন্নত, স্বল্পন্নত বা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের পরাশক্তি নির্ভরতা ভাষা ও সংস্কৃতির এই উপনিবেশায়ন অপ্রতিহতভাবে অব্যাহত থাকার পটভূমি পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। পাশ্চাত্য প্রযোজিত ও পরিচালিত তথাকথিত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার এই ধারাবাহিক প্রভাব থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতিও মুক্ত নয়। দুর্বল অর্থনীতি ও রাজনীতি চর্চার অপরাপর জাতিরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এই সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের পার্থক্য নিশ্চয় রয়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভিযোজনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে মিশ্রণ ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির। এ দেশে তাই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিও প্রবলরূপে প্রস্ফূটিত হবার অবকাশ পায়নি। বরং, আধুনিকতা ও ধর্মানুভূতির বৈপরীত্যময় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবনধারা ও চর্যা অনির্দিষ্ট হয়ে উঠেছে। এর ফলে, বাংলাদেশের চিরায়ত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথার পরম্পরা থেকে বেরিয়ে আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানুষের উদ্ভব ঘটলেও, মানুষের সংস্কৃতিগত লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা অস্পষ্ট। সংস্কৃতির ভবিষ্যত নির্মাণ যে নতুন প্রজন্মের পরম্পরাগত জীবনধারার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়, সেই নতুন শিশুদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার বিপর্যয় বাংলাদেশে অস্বীকার করার জো নেই। এ কারণেই মূলত এদেশের সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যত বিষয়ে নিশ্চয় করে কথা বলা যায় না।

তবে, সংস্কৃতি যেহেতু মানুষের আত্মপরিচয়ের ধারক, বাহক ও সঞ্চারক, সংস্কৃতির ভেতরেই যেহেতু আছে মানুষের সংগ্রামী প্রবৃত্তি, শেকড় অনুসন্ধানের আবেগ, স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের প্রচেষ্টা, সংস্কৃতির সুতরাং বিলোপ সম্ভব নয়। পরিবর্তন অবশ্যই সংস্কৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতির সৃষ্টি, অর্জন, মূল্যবোধ ইতিহাস কোনো না কোনো ফর্মে সংরক্ষণ করে রাখে পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কৃতিক রূপরেখা নির্দিষ্ট করার জন্য। অতএব, বাংলাদেশের সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যত বাংলাদেশের জনসাধারণ নিজেদের মতো করে নির্মাণ করবেই। মানুষের সার্বিক সংস্কৃতি চর্চা স্বাধীন ও স্বতস্ফূর্ত রাখতে রাষ্ট্র ও প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রেণি, একাডেমিকস, নাগরিক সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা সেই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে যে ভূমিকা পালন করবেন, সংস্কৃতির রূপরেখা তদনুযায়ী রূপান্তরিত হবে। প্রজন্মের সংস্কৃতিগত রুচি, প্রবণতা, আচার-ব্যবহার নির্মাণে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, তথা শিক্ষা, অর্থনীতির বিন্যাস পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও পরিচালনার ভার সরকার ও রাজনীতিকেই গ্রহণ করতে হয় দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। অতএব, আজকের রাষ্ট্রনীতি, সরকার ব্যবস্থা, সংস্কৃতি সুরক্ষা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম, চর্চা ও পদক্ষেপের ফলাফলই হবে বাংলাদেশের সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যত। সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব, মানুষের সাম্য, ন্যায় বিচার, বৈচিত্র্যেময় অভিব্যক্তির স্বাধীনতা, পরধর্মে ও আচরণে সহিষ্ণুতা, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি চর্চাকারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বিশ্বাস ও মর্যাদাগত নিরাপত্তা, নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহি সংস্কৃতির সুষম সমন্বয়, তাদের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা, শিল্পের ও সাহিত্যের স্বাধীনতা, সংগঠিত হবার স্বতঃস্ফূর্ততা, বৈষম্যহীন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সংস্কৃতি বান্ধব শিক্ষা ইত্যাদি বিধানের মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হবে বাংলাদেশের সদাচারী সংস্কৃতির প্রত্যাশিত ভবিষ্যত। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতি স্ফূর্তি পায় মানুষের যৌথতার ভেতর দিয়ে। রাষ্ট্রই উৎসাহিত করবে জনগণের যৌথতা। বিভাজন, বৈষম্য এবং ঐতিহ্য অবহেলার সামাজিক ও রাজনৈতিক মেশিনগুলো পরিহার করে কায়েম করতে হবে সদাচারী সংস্কৃতি। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা উজিয়ে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আজও চর্চিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পরম্পরা। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তি দুনিয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাধক শিল্পী, কারিগরদের পাশপাশি সর্বস্তরের জনগণ সাংস্কৃতিক অভিযোজনের কার্যকর সক্ষমতা প্রদর্শন করে চলেছেন। এই শক্তির স্ফূরণ ঘটার সহজ, ভয়হীন, নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ। রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে আমরা ধনতান্ত্রিক সমাজ ও সম্পদের বিকাশে রত হব বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে, নাকি কাউকে বাদ না দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সুরক্ষা ও বিকাশে সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সক্রিয় হবো। এই জাতীয় সিদ্ধান্তের আলোকেই গড়ে উঠবে বাংলাদেশের সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যত।

   

১১ || বাসযোগ্য স্বদেশ ও বিশ্ব নির্মাণে সংস্কৃতি ও সদাচার

মহাবিশ্বে পৃথিবী বাসযোগ্য বলেই এখানে গড়ে উঠেছে মানব বসতি। পৃথিবীর প্রাণিজগতে মানব সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় পরিচয় ক্রমে বিকশিত হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য, মানুষের সংস্কৃতির নিরিখে। সভ্যতার উদ্ভবের পূর্বকালে আদিম সমাজে শ্রেণিভেদ ছিল না বলে সংস্কৃতিভেদ গণ্য হতে পারেনি। উৎপাদন ও সম্পদের মালিকানা ব্যবস্থার বিবর্তনের সমান্তরালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ক্ষমতাবান ও অক্ষম বা ক্ষমতাহীন, পরিচ্ছন্ন ও অপরিচ্ছন্ন, পরিশীলিত ও অপরিশীলিত, বিবাহ ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, সুন্দর ও কুৎসিত এবং পণ্ডিত ও মূর্খের ব্যবধান ও বৈষম্য ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চাগত আচরণ তথা সংস্কৃতি। বহুমাত্রিক ব্যবধানের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠা আজকের সংস্কৃতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজের বাসিন্দা হয়ে অশ্রেণিময় সমাজের স্বপ্ন দেখার শুরু ঊনবিংশ শতকেই, বিশেষ করে কাল মার্ক্সের যুগান্তকারী অশ্রেণির সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের চিন্তাসূত্রে। মানুষ মূলত বিশ্বাস করে মানুষে মানুষে সমান মর্যাদায়। ধর্মে, দর্শনে, কাব্যে, রাজনীতি বিজ্ঞানে মানুষই কেন্দ্রে। এমন সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিরল যেখানে নীতিগতভাবে বৈষম্য, আধিপত্যবাদ সমর্থন পায়। অথচ সভ্যতার দুর্ভাগ্য এই যে, এমন সমাজ নেই বললেই চলে, যেখানে বাস্তবে বৈষম্য ও আধিপত্যবাদের বিলোপ সম্ভব হয়েছে। এক শতাব্দীরও কম সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া অশ্রেণিময় সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সমাজতন্ত্রিক নীতি, আদর্শ ও কার্যক্রমের রাজনৈতিক পরাজয় এই বৈষম্যকে প্রকট করে তুলেছে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আজ মানুষের সংস্কৃতি আত্মকেন্দ্রিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে বিকশিত হয়েছে সারা বিশ্বে, বাংলাদেশেও। অর্থ ও পেশির শক্তি খাটিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষ কেবল ক্ষমতাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই নয়, শোষণ করে চলেছে তাবৎ প্রাণ-প্রকৃতি রাজ্য। নিয়ন্ত্রণ করছে নদনদীর প্রবাহ, দখল করছে প্রাকৃতিক সম্পদ, বাজনা বাজিয়ে চলেছে কেবলই বিত্ত-বৈভব-বিলাসের ঝাঁ চকচকে উন্নতির, যার নিচে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং হারিয়েছে ভূ-প্রকৃতিতে মানুষেরই হাতে গড়ে ওঠা প্রতিবেশ। পরাশক্তি নির্দেশিত অপরিকল্পিত, অবকাঠামোগত নয়া উদারবাদী উন্নতির চাপে কৃষি-নির্ভর, প্রকৃতি-নির্ভর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে বঞ্চনার জীবন। শিল্প বিকাশের প্রভাব পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়িয়ে পূর্বেও বিস্তৃত হয়েছে সাম্প্রতিক শতাব্দীতে। বাংলাদেশও এই রিলে রেসে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে বিশ্বস্রোতের প্রবণতায়। ফলে, আজকে আবারও বাসযোগ্য বিশ্ব ও স্বদেশ নির্মাণের যুগচিন্তা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিঃসন্দেহে ভীত, বিশেস করে এই কারণে যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বাসযোগ্য প্রতিবেশ ধ্বংসের পেছনে দায় একমাত্র মানুষেরই।

এই মহাবিশ্ব, বিশ্ব, স্বদেশ, বিদেশ, সমাজ, সম্প্রদায়যাই বলি না কেন, সকল বিবেচনায় স্থানীয় ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির মূল উপাদান মানুষ। মানুষের সংস্কৃতিগত পরিচয় আসে ইতোমধ্যে বিরাজিত পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব থেকে লাভ করা অনুভব ও অভিজ্ঞতা প্রথমত ব্যক্তি মানুষের মনোজগতে সঞ্চারণের মাধ্যমে। এই অন্তরস্থিত সঞ্চারণ বিশ্লেষিত হয়ে নির্দিষ্ট সমাজ, সম্প্রদায় বা জাতির অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তির কার্যক্রমে, আচরণে, ভাষায়, আচারে, শিল্পে অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত হবার মাধ্যমেই রূপ পায় সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি। প্রজন্মে প্রজন্মে, কালে কালে, স্থানে স্থানে সংস্কৃতির ভিন্নতা স্বদেশে, বিদেশে, অঞ্চলে ও বিশ্বে বৈচিত্র্যেময় রূপে বিরাজ করে। মানুষের সংস্কৃতিই জন্ম দেয় সভ্যতার। তবে সভ্যতার বিনাশে সংস্কৃতি লোপ পায় না, বরং নবায়িত সংস্কৃতি এগোয় নতুন সভ্যতার দিকে। মানুষের জীবনবোধ যত বৈচিত্র্যময় হয়, ততই পাখা মেলে সুস্থধারার সদাচারী সংস্কৃতি। সদাচারী সংস্কৃতির বলেই সৃষ্টি হয় সভ্যতা, নতুন মূল্যবোধ, মানবিক উৎকর্ষ। সুতরাং বাসযোগ্য স্বদেশ ও বিশ্ব বিনির্মাণে ব্যক্তি, সমাজ, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রে সংস্কৃতি ও সদাচারের চর্চা, প্রতিষ্ঠা ও প্রসার সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ প্রকৃতির সন্তান। মানুষের সংস্কৃতিতে তাই স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক বিন্যাসের প্রভাব। আধুনিক কালে মানুষ মূলত পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আলোড়িত হয়ে নব প্রত্যাশার শৃঙ্খলাময় সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হবার বাসনা লালন করে, লালিত সংস্কৃতির আলোকে বিরাজিত রাষ্ট্রকাঠামোয় আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রকাশিত হতে চায়। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে চিন্তার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই অতএব গড়ে উঠতে পারে বাসযোগ্য স্বদেশ ও বিশ্ব। স্বদেশের সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক হবে, নাকি ধনতান্ত্রিক, অথবা সমাজতান্ত্রিক নাকি কমিউনিস্ট, ধর্মীয় নাকি ধর্মনিরপেক্ষ অথবা ধর্মহীন, কিংবা সাম্প্রদায়িক নাকি অসাম্প্রদায়িক, শ্রেণি বৈষম্যের নাকি শ্রেণিহীনতা প্রধানত নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ের সমন্বয়সাধনমূলক কার্যক্রমের উপর, যে কার্যক্রমের লক্ষ্য হবে মানুষ ও প্রকৃতি এবং মানুষের আত্মপরিচয়বাহী বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির উন্নয়ন। বলাই বাহুল্য, উন্নত সংস্কৃতি সদাচারী বা শুদ্ধাচারী সংস্কৃতির সমার্থক। সংস্কৃতি যেহেতু মানুষেরই সৃষ্টি করা ভাবনা, মূল্যবোধ, কার্যক্রম, আনুষ্ঠানিকতা ও অনানুষ্ঠানিকতার সমাহার, সুতরাং ভাবনার স্বাধীন পরিসর পেলে মানুষই অন্তরে চিহ্নিত করবে তার আত্মপরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি, নিজেদের প্রয়োজনে সে মৌলিকতাকে সুসংহত করবে, ঘটাবে প্রয়োজনীয় মনোজাগতিক পরিবর্তন, স্থির করবে প্রতিবেশের বাসযোগ্যতাস্বদেশে এবং বিশ্বে।

            

১২ || উপসংহার

পরিশেষে, মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতি বলতে আমরা সদাচারী সংস্কৃতিই বুঝতে চাই। সংস্কৃতির অসদাচার স্বীকার করতে দ্বিধা থাকা উচিত অবশ্যই নয়, তবে অসদাচার পরিত্যাগ করেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষের সংস্কৃতি, তথা সদাচারী সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো সেই শক্তি যা মানুষের চিন্তায় ও কাজে উন্নতিশীলতা, উৎকর্ষমানতা, সৌন্দর্যমানতা, উত্তরণশীলতা, প্রগতিশীলতা ও পূর্ণতা প্রয়াসের মধ্যে বিরাজ করে। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের সজ্ঞান ও অজ্ঞান সংস্কার প্রচেষ্টা। জীবনযাত্রার, শিক্ষার ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজের সমাজ ও পরিবেশকে উন্নত, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার যে প্রবণতা, চিন্তা ও চেষ্টা, তারই মধ্যে নিহিত থাকে সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে সর্বজনীন কল্যাণবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ ও ন্যায়নিষ্ঠা থাকে।  ব্যক্তির চরম বিকাশের এই যুগে সদাচারী সংস্কৃতির প্রারম্ভিক কর্তা ও বিধেয় ব্যক্তি মানুষ। ব্যক্তি-জীবনে, সমাজ-জীবনে, সম্প্রদায়গত জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে, বিদ্যায়তনে, কর্মক্ষেত্রে, বিনোদন জগতে, শিল্পে, সাহিত্যে, ব্যবসায়, বাস্তুতন্ত্রে, ব্যবহারে, আচারে, আনুষ্ঠানিকতায়, পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়ায়, যৌথ ও সামষ্টিক জীবনে শঠতা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও লোভের প্রবণতা ও প্রচেষ্টামুক্ত ব্যক্তি মানুষের বিকাশ সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকের সদাচারের যোগফলই সমাজের সদাচার। পুরাণে বলে, আপনি আচরি ধর্ম, পরকে শিখাও। আমরা বলতে চাই, আপনি আচরি সদাচার, গড় সদাচারী সংস্কৃতি।

তবে, জনগণের ন্যায়বোধ বিকাশে ব্যক্তির একক ভূমিকা আজকাল রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে কার্যকর হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, সমাজিক কাঠামোর বর্তমান আলগা চেহারার কারণেই। এক্ষেত্রে সদাচারী জাতীয় সংস্কৃতির উন্মেষে রাষ্ট্রীয় তথা রাজনৈতিক পদক্ষেপই কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। রাষ্ট্রের, রাজনীতির, সরকারের লক্ষ্য হবে ব্যক্তি ও সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অন্যায় কমানো এবং ন্যায় বাড়ানোর সংস্কৃতি সমুন্নত করা। একইসঙ্গে, শিক্ষা, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, মানবাধিকার, শিল্প, সহিত্য, নাট্য, নৃত্য, সঙ্গীত, পালা, পার্বন, মেলা, খেলা ইত্যাদি সৃষ্টি ও চর্চার শর্তহীন, স্বাধীন পরিবেশ, অবকাঠামো, প্রতিবেশ, আর্থিক পরিকল্পনা ও বরাদ্দ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকেই বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে হবে। তবে, সংস্কৃতির স্বাধীনতাকে অপসংস্কৃতির, সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির, বাঙালির আত্মপরিচয়বাহী চিরায়ত ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর উপাদানের স্বাধীনতা হিসেবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দুর্বৃত্তায়িত সংস্কৃতি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যাতে গ্রহণ না করতে পারে, সে ব্যাপারে সচেতন সুরাহাও জাতীয় সংস্কৃতি উন্নয়ন পদক্ষেপের অন্তর্ভূক্ত হবে।

সংস্কৃতি তো জীবনযাপন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে পরিশীলনের দিকে, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি ও বৈষম্যহীনতার দিকে ক্রম প্রাগ্রসরতারই নাম। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে সদাচারী সংস্কৃতিবোধ অর্জন ও চর্চার ভেতর দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আত্মগঠনের, পরিবেশ ও প্রতিবেশের বাসযোগ্যতা বিধানের, প্রত্যেক নাগরিকের সম অধিকার নিশ্চয়তা। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকঅর্থাৎ সমাজের নেতা ও পরিচালকদের দুর্নীতিমুক্ত ও সংস্কৃতিমান ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করাই হবে জাতীয় সংস্কৃতি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার ভিত্তিক পদক্ষেপ। কেননা, নেতা ও পরিচালকদের সাংস্কৃতিক আচরণের আলোকেই জনসাধারণ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এমনকি অতি দরিদ্র শ্রেণিরও জীবনযাত্রার মান প্রভাবিত হয়, উন্নত হয়। সংস্কৃতি তথা সকলের ন্যায়-অন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ, প্রগতিবোধ ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ জাগ্রত করতে পরামর্শ ও নির্দেশনার চেছে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সদাচার চর্চার উদারণ সৃষ্টি করাই সত্যিকার অর্থে কার্যকর উদ্দীপকের কাজ করবে। যতদিন শ্রেণির অস্তিত্ব আছে, ততদিন অপ্রভাবশালী শ্রেণি প্রভাবশালী শ্রেণির প্রভাবেই সংস্কৃতিমান হবার পথ পাবে, সংগঠিত থাকবে এবং নিজের আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবে।

মনোজাগতিক ও পারিপার্শ্বিকতার উন্নতির সমন্বয়েই সংস্কৃতি প্রাগ্রসর হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দেখা, শোনা ও অভিজ্ঞতাকে আচরণ ও অভিব্যক্তি দ্বারা চর্চা করার মাধ্যমে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনধারণ করে। কার্যক্রম ও রুচিবোধ দ্বারা, অর্থাৎ, সংস্কৃতি স্রষ্টা, সংস্কৃতিজাত ও সংস্কৃতি নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিনিয়ত মানুষ নিজেকেই সৃষ্টি করে চলে। এই সৃষ্টিশীলতায় বিরাজ করে অগ্রগতির সজ্ঞান ও সচেতন প্রয়াস, থাকে সাধনা ও সংগ্রাম। সাধনা ও সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায় মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা। এভাবে আত্মা থেকেই সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা, আত্মাকে তথা আত্মকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে মানুষ যাপন করতে চায় সন্তুষ্টির ব্যক্তি জীবন, সম্প্রীতি ও প্রগতির সামাজিক, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। সংস্কৃতিমান মানুষ প্রতিষ্ঠা করে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। সুতরাং কেবল নীতিগত উদ্দেশ্য ও নীতিকাঠামোই শেষ কথা নয়। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির সদাচারী সংস্কৃতির চর্চাই শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ, পরিচয় স্বাতন্ত্র্য বিশিষ্ট জাতি গঠনের প্রধানতম কৌশল ও কার্যক্রম। 

পাঠসূত্র

১. শেখ মুজিবর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১২; কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭
২. ড. পৃথ্বিলা নাজনীন নীলিমা (সম্পাদনা), আহমদ শরীফ রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড ও সপ্তম খণ্ড), আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৪
৩. মোতাহের হোসেন চৌধুরী, সংস্কৃতি-কথা, নবযুগ প্রকাশনী, ২০১৫
৪. সাইমন জাকারিয়া, প্রণমহি বঙ্গমাতা, ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৮-২০১৮
৫. Alan Dundes, Interpreting Folklore, Indiana University Press, 1980
৬. Timothy Rice, Ethnomusicology-A very short introduction, Oxford University Press, 2014
৭. ১৯৭২ সালে রচিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
৮. জাতীয় সংস্কৃতি নীতি ২০০৬
৯. গোপাল হালদার, সংস্কৃতির রূপান্তর, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলিকাতা, ১৯৬৫
১০. আহমদ ছফা, বাঙালী মুসলমানের মন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮১
১১. জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ২০১২২
১২. শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নীতিমালা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ২০১৭