কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শব্দবিন্যাস
‘... গদ্য চলে যুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে, আর কাব্য নাচে ভাবের তালে তালে; গদ্য চায় আমাদের স্বীকৃতি; আর কাব্য খোঁজে আমাদের নিষ্ঠা। রেখার পর রেখা টেনে পরিশ্রান্ত গদ্য যে ছবি আঁকে, গোটা কয়েক বিন্দুর বিন্যাসে কাব্যের যাদু, সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তোলে আমাদের অনুকম্পার পটে। কাব্যের এই মরমী ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীকের সাহায্যে। শব্দ মাত্রেরই দুটো দিক আছে। একটি তার অর্থের দিক, অন্যটি তার রস প্রতিপত্তির দিক। গদ্যের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক ওই প্রথম দিকটার খাতিরে; গদ্যের শব্দগুলো চিন্তার আধার। কিন্তু কাব্য শব্দের শরণ নেয় ওই দ্বিতীয় গুণের লোভে, কাব্যের শব্দ আবেগবাহী।’ [কাব্যের মুক্তি। স্বগত। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পৃ-২৯]
মালার্মে মনে করতেন, কবিতাই কবির অন্বিষ্ট, সমস্ত চিন্তন কবিতাকে ঘিরে, কবির ক্রমিক বিবর্তনকে ঘিরে নয়। সুধীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয় ছিল না কাব্য; সমস্ত চেতনাকে নিঃশেষে মুছে দিয়ে মালার্মের প্রবর্তিত কাব্যতত্ত্বে পৃথিবীর শুদ্ধতম কবিতা লেখার বাসনা তাঁকে লোলুপ করেনি বরং আদিভূতে মিশে নিজের স্বাভাবিক রূপকল্প জিজ্ঞাসা তাঁকে রোমাঞ্চিত করেছে। সুধীন্দ্র কাব্যে ব্যক্তিমানুষ, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাসে বিপুল অন্বেষায় খুঁজেছে আপনাকে প্রকাশ করার ভাষা। আপন স্বরূপ জানার উৎকাঙ্ক্ষা, অতীন্দ্রিয়ে অনাস্থা, অক্ষমতাবোধ ও তজ্জনিত শূন্যবাদ তাঁকে করে তুলেছে সোহংবাদী। এই সোহংবাদ শুরু 'ক্রন্দসী' -তে পরিসমাপ্তি 'দশমি'-তে। সেখানে কখনই তিনি বিক্ষিপ্ত হননি, শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্দিষ্ট ছিল একই। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় যে মননের ছাপ মেলে সেটা এক অর্থে অংশত মেটাফিজিকাল। ক্ষণবাদে বিশ্বাসী হয়ে রোমান্টিক অণুপ্রেরণাবাদকে অস্বীকার করেও সুধীন্দ্রনাথের রূপকল্প, নিষ্ঠা ও রোমান্টিকের ব্যক্তিবাদ সুচরিতার্থ পরিণামে মিলেমিশে এক হয়েছে। বিষয়ের আত্মতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বীজশব্দ ও শব্দ প্রকরণ সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় নিঃসঙ্গ ব্যতিক্রম হিসাবে গদ্যের সার্বিক ভঙ্গিমা ও বিন্যাস অক্ষুন্ন রেখে অনুপ্রবেশ নিয়েছে।
সুধীন্দ্রনাথের দৃষ্টির বিস্তারে যে বিদেহ শব্দের প্রতি ঝোঁক ছিল তা পরিলক্ষিত হয়। এক মৌল বিষাদগ্রস্ত রূপ ও ব্যসকূটের ব্যবহার, অন্যভাবে Syllogistic pattern তাঁর হাতে নিপুণ। সমস্ত অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক ধরনের বিষণ্নতা সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রায় অনায়াস লক্ষিত হয়। হতাশা, স্বৈরাচার, অরাজকতা ও বেদনার স্মরণীয় অভিঘাতে দুর্মর উচ্চারিত হয়।
দিশাহারা চৈতন্য,
আলেয়াকে ধ্রুবতারা ভাবা, অকূল
পাথারে তাই মগ্নতরী আমার
যৌবন
[অপচয়, অর্কেস্ট্রা]
অন্তভৌম আমার সরিৎ
পৃথিবী ডোবায়
[নৌকাডুবি, ক্রন্দসী]
বিপ্রলব্ধ বিশ্বমানব বিষাদে
অঙ্গনে তুলি দেখায় অলস বিষাদে
[নান্দীমুখ। সংবর্ত]
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
সুধীন্দ্রীয় কাব্যে যে ভালেরিজাত ব্যক্তিমানসের রূপকল্প পরিলক্ষিত হয় তা কখনই অর্থহীন মনোরঞ্জনের জন্য নয়। সুধীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন: ‘যে শব্দ কোনো ভাষার অন্তর্গত নয়, যে শব্দ নিরর্থধ্বনির সাহায্যে আবেগ জানায়, কাব্যের চেয়ে মন্ত্রেই তার প্রয়োগ প্রশস্ত। লেখক ও পাঠকের মধ্যে অনুকম্পার সেতুবন্ধই যদি কাব্যের উদ্দেশ্য হয়, তবে কাব্যের শব্দ চিরদিনই অভিধানের মুখাপেক্ষী থাকবে।’ [কাব্যের মুক্তি। স্বগত। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পৃ-৩১]
সুধীন্দ্রীয় কাব্যচর্চা ও চর্যা সাধারণ বাঙালি কবিকূল থেকে ভিন্নতর। মার্লামের কাব্যদর্শনকে অন্বিষ্ট করেও কাব্যের 'আনন্দময় স্বরূপ সম্বন্ধে' রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মরণে উজ্জ্বল থাকবেন। কিন্তু এ সমস্ত ব্যতিরেকেও এমন বেশ কিছু শব্দ সুধীন্দ্রিয় কাব্যভান্ডার থেকে আহোরণ করা যায় যার অধিকাংশই সংস্কৃত সাহিত্যের অফুরন্ত ভান্ডারে তাঁর অবাধ প্রবেশাধিকার কেই চিহ্নিত করে। এগুলোকে সুধীন্দ্রীয় বীজশব্দ বলাই শ্রেয়। যে ধরনের শব্দ স্বভাবতই কৌতুহলদ্দীপকভাবে মনে আসে, সেগুলি যথাক্রমে:
অসূর্য। অনাদি। অপচারি। অলাতচক্র। অমা। অন্বিষ্ট। অন্বয়। আত্মহা। আবরি। প্রমা। প্রমিতি। বিজিগীষা। ব্যাজজীবী। ভ্রমিভ্রান্ত। বিলয়। সৌগন্ধী। গৃহ্য। মৎসর। বিসংবাদী। ব্যতিহার্য। নিদুটি। উদগীর্ণ। বৈকালী। ঊর্ণাজাল। শ্লথনীবি।
সুধীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে দার্শনিক মনবৈকল্যের সন্ধান মেলে। যদিও শব্দে পরম দর্শন বিষয়ক ব্যাখ্যা লাভের আত্মপ্রসাদ নেই। দেশী, বিদেশি, পরিভাষিক ও স্বল্পপ্রচলিত শব্দাবলী সুবিন্যাস ও অশৈথিল্যে কতটা আচরনীয়, সে অনুসন্ধান সুধীন্দ্রে নিয়তিই চলেছে। তাঁর কবিতার শব্দমালায় Image—চিত্রকল্প, Symbolist—প্রতীকী, Personality—ব্যক্তিস্বরূপ, Character—চরিত্র, Negative capacity—নৈরাত্মসিদ্ধি এবং Art for art sake—কলাকৈলব্যবাদ প্রভৃতি উপস্থাপনা নৈপুণ্য ও উৎকর্ষতা প্রমাণ করে।
সুধীন্দ্রনাথের কিছু কবিতায় ধর্ম ও দর্শনকে মনে পড়া অসংগত নয়; কিন্তু কবির অন্বেষণ হলো এক সুবিন্যস্ত ধারায় ‘To find concrete poetic equivalent of the philosophical system; Complete equivalent in vision.’ [T. S. Eliot: Dante, the sacred Woods]
সুধীন্দ্রনাথ ক্রমান্বয়ে পরিণত ও পরিবর্তিত হয়েছেন। তাঁর কবিতায় কখনো নিফাঁক প্রবাহমানতার কাব্যে কলাসিদ্ধির জন্য আধুনিকতার রীতি চতুরতা দেখা যায়নি।
আমি যারে চাই
তার মাঝে ভেদ নাই, দ্বন্দ্ব নাই, দেশ-কাল নাই;
মননে ও মনীষার, দেহে ও বুদ্ধিতে
একান্ত সে; বিসংবাদী উপাদান শিল্পে শুদ্ধিতে
যেমন নিস্ফল, সেও তেমনি সংগত—
বিকশিত আশুকান্ত ; নির্বিশেষে ফলে,
সে—অনাম চির সত্তা খুঁজি আমি নিজের অতলে।
[সন্ধান। ক্রন্দসী]
‘Poetry is the drama of two souls in one breast.’ সুধীন্দ্রে একথার বিস্তৃতি তেমন উপেক্ষণীয় নয়। প্রাকৃতিক বিচ্ছিন্নতায় চিরন্তন মূল্যবোধ না জেনেই তাঁর ভাবনা ক্রমান্বয়ে শিল্প বিস্তার করেছে অনাশ্রমমিতা মুছে বোধিশ্রমকে আভাষিত করে।
অসম্ভব একটি ভালো লেখা। ছোট্ট কিন্তু সংহত। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো একজন কবির কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ বিন্যাস নিয়ে এমন লেখা যেমন ব্যতিক্রমী, তেমনি দুঃসাহসী। এখনকার কবিদের কাছে সুধীন দত্তকে এইভাবে পৌঁছে দেবার জন্য লেখক ধন্যবাদার্হ। সেইসঙ্গে সম্পাদককেও বাহবা জানাই।
সুশীল সাহা
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩ ২০:০৪