বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিধ্বনি’ পাঠের অভিজ্ঞতা

অ+ অ-

 

প্রতিধ্বনি
প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২৪
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: রাজীব দত্ত
প্রকাশনী: প্রতিধ্বনি প্রকাশন
মোট পৃষ্ঠা: ৩৬৮
মূল্য: ৬০০ টাকা

বাংলাদেশে সাহিত্য পত্রিকার ধারণা একটু ক্লিশে। ব্যাপারটা শুনতে একটু খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। সত্যিটা বলা মাঝে-মধ্যে ভালো। সেই সত্যিটাই বলতে চাচ্ছি। কিছু গল্প-কবিতা আর প্রবন্ধের সমন্বয়ে সাহিত্য পত্রিকা করার প্রবণতা বেশ শক্তিশালী। কিন্তু এই শক্তিশালী প্রবণতার বিপরীতে নতুন করে সাহিত্য পত্রিকা ছাপা হলো, এদের ওয়েব-পত্রিকাও আছে, প্রতিধ্বনি এই সাহিত্য পত্রিকার নাম। তবে প্রতিধ্বনির মতো সাহিত্য পত্রিকা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আর হয় নাই, বা হচ্ছে নাবিষয়টি এমনও নয়। অনেক পত্রিকাই ইতিহাসে ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।

সাক্ষাৎকার অংশ দিয়ে এই পত্রিকার সূচনা। তা কেবল দৈশিক লেখকদের নিয়ে নয়; বৈদেশিক লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারও এই পত্রিকা ছেপেছে, বাংলায় অনুবাদ করে। যা পেয়েছে নতুন মাত্রা। যে কোনো সাহিত্যিককে নিয়ে লেখা সমালোচনামূলক প্রবন্ধের চেয়ে লেখকের মন্তব্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাঠক কিংবা সমালোচক তো লেখকের লেখা পড়ে মন্তব্য করেন। মাঝে মাঝেই এই মন্তব্য ঠিক হয় না। ভুলভাল মন্তব্যও সংযোজিত হয় নির্ধারিত লেখকের ভাগ্যে। লেখা বস্তুটি যে ধারা আর ধারণায় প্রকৃত রূপলাভ করলো, সেই ধারা আর ধারণার ভুল ব্যাখ্যাও তৈরি হয়ে যায়। এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য লেখকের ব্যক্তি-মানস আর সাহিত্য-মানসের সম্পর্ক বোঝাও অতীব জরুরি। সাক্ষাৎকার এই ব্যাপারটাকে সহজ করে তোলে। প্রতিধ্বনির এই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে এমন বেশ কিছু সাক্ষাৎকার। সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাৎকারটা পঞ্চাশের দশকের সাহিত্যান্দোলন কেবল নয়, সমগ্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাহিত্যান্দোলনের ধারা ও ধারণা সম্পর্কে জানা-বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া রবার্তো বোলানিও, মাহমুদ মামদানি, নাওমি ক্লেইন, টি এস এলিয়ট প্রমুখের সাক্ষাৎকার কেবল সাহিত্যের বিষয়-আশয় নিয়ে নয়; সমাজ-রাষ্ট্রসহ বহুবিধ বিষয় এইসব সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট হয়েছে।

ইতিহাস সমস্ত জ্ঞানজগতের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাস-চর্চার ধারা যেন অনেকাংশেই শুকিয়ে আসছে ক্রমশ। আর পুরোনো জমানার ইতিহাসতত্ত্ব এখনো ইতিহাস চর্চার পদ্ধতি হিসেবে ইতিহাসের লোকজন ব্যবহার করে। কিন্তু এই পত্রিকায় ইতিহাস বিষয়ে প্রকাশিত লেখাগুলোতে প্রচলিত ঐতিহাসিক মতকে যেমন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, তেমনি করে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের খোঁজও করা হয়েছে। বিষয়টি চমৎকার। মতিউর রহমানের গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর খোঁজে এই ধারার উত্তম উদাহরণ। আর চিঠিপত্র অংশে হাসান আজিজুল হকের অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পুরোনো সময়ের বাস্তবতাই নতুন করে ধরা দেয়।

 

ইতিহাস সমস্ত জ্ঞানজগতের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাস-চর্চার ধারা যেন অনেকাংশেই শুকিয়ে আসছে ক্রমশ। আর পুরোনো জমানার ইতিহাসতত্ত্ব এখনো ইতিহাস চর্চার পদ্ধতি হিসেবে ইতিহাসের লোকজন ব্যবহার করে। কিন্তু এই পত্রিকায় ইতিহাস বিষয়ে প্রকাশিত লেখাগুলোতে প্রচলিত ঐতিহাসিক মতকে যেমন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, তেমনি করে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের খোঁজও করা হয়েছে।

 

ভাষা সকল জ্ঞানকে সংরক্ষণ আর প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা পালন করে। ভাষার দর্শন দর্শনচিন্তার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্টিন হাইডেগার জার্মান দার্শনিক। সত্তা সময় আর বস্তুর অবস্থা বিষয়ে তাঁর দর্শনচিন্তা বিখ্যাত। ভাষা সম্পর্কেও তাঁর লেখাগুলো ভাষার দর্শন-চর্চার জন্য জরুরি। হাইডেগারের ভাষা শীর্ষক প্রবন্ধের অনুবাদ ভাষার দর্শন সম্পর্কে নতুন ধারণাই প্রদান করবে। এছাড়া উপভাষা নিয়েও একটি আলাদা অংশ এই পত্রিকায় বিদ্যমান। উপভাষা বিষয়ে কথা-বার্তা একটু কমই হয় বৈকি। কিন্তু এই পত্রিকাতে উপভাষা বিষয়ক পাঁচটি লেখা উপভাষা চর্চার বিষয়টিকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ করে লেখাগুলো কেবল ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত নয়, একই সাথে তা সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের সাথেও সম্পৃক্ত।

প্রতিধ্বনিতে নিয়মিত বিভাগের হিসেবে আছে বেশকিছু গল্প। কবিতা ব্যাপারটা নেই। নেই কোনো উপন্যাস। কেন নেই সেই প্রশ্ন হয়তোবা অনেকগুলো উত্তরে শেষ করা যাবে। কিন্তু কবিতা আছে অনুবাদে। বিদেশি কবিদের। আর গল্পকার হিসেবে যাঁরা গল্প লিখেছেন: ওয়াসি আহমেদ, আফসানা বেগম, নাসরীন জাহান, আসিফ নজরুল, খোকন কায়সার, তানজিনা হোসেন। এঁরা বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে সেলেব্রেটিই বলা যায়। গল্পকাররা যে গল্পগুলো লিখেছেন, সেই গল্পগুলো যতোটা বিমূর্ত তার চেয়ে বহুগুণ মূর্ত। সমাজ-রাষ্ট্র, সর্বোপরি দুনিয়ায় ঘটে যাওয়া নানা বিষয় তাঁদের গল্পের বিষয়।

পত্রিকাটির সর্বশেষ সংযোজন সিনেমা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ। আর্ট ফ্লিম নিয়ে। আর্ট ফ্লিম, আর্ট ফ্লিমের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, আর্ট ফ্লিম নির্মাণে রাষ্ট্রীয় অনুদান, ফ্লিমমেকারের স্বাধীনতাএই সমস্ত বিষয় লেখাটির বিষয়বস্তু। সামগ্রিকভাবে এই পত্রিকাটি অনেকাংশেই শুদ্ধ নন্দনচিন্তা আর আনন্দবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে একটি উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব প্রদান করেছে। অর্থাৎ একটি পত্রিকা মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যে জরুরি হতে পারে, তা এই পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব। পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন কবি ও অনুবাদক সাখাওয়াত টিপু।