মার্চ টু ঢাকা

অ+ অ-

 

তিতাসের হাত দেখে একবার বলেছিল মেঘনাদেখবি, তিনদিন পর কাশ ফুটবে। যেদিন কথাটা বলেছিল, সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। তিতাস বলছিলদিদি, তুমি যে কি বলো না। এই বৃষ্টির মধ্যে কাশফুটবে? আমিতো ওয়েদার অ্যাপসে দেখলাম, আরো চারদিন বৃষ্টি। মাকে বলেছি, বৃষ্টি হলে স্কুলেও যাবো না। মেঘনা বলেআরে তোর ওই সব অ্যাপস কি হাওয়া বুঝে। এই যে তোর হাতের তালুতে যে হাওয়া এসে জমা পড়ছে, তাতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কাল থেকে রোদ।

তিতাস জানতে চায়তুমিই তো বলো, ভাদ্রে ঘন বরষা নামে। মেঘনার উত্তরহুম। কিন্তু শোন, তোর আর আমার মতো আকাশেরও কাশ দেখতে ইচ্ছে করছে। হাওয়ার কাশে দোলা দিতে আর তর সইছে না। ঠিক ঠিক, পরদিন রোদ উঠলো তাতিয়ে। এবং তিনদিন পর বাড়ির চারপাশ কাশফুলে ভরে উঠলো। মেঘনা উত্তরের যে ঘরটায় থাকে, তার সঙ্গের বারান্দা ওর প্রিয়। এমনিতেই পুরো বাড়ি জুড়ে বারান্দার অভাব নেই। যত ঘর তত বারান্দা। দুই-একটা বাড়তিও আছে। কিন্তু মেঘনা ঘর থেকে বের হয় কম। বই পড়ে। ল্যাপটপে কিছু লিখে। কখনও কখনও ফোনে কথা বলে। স্বর সবসময়েই দেয়াল স্পর্শ না করার মতো। দুই-একবার অবশ্য ওকে চিৎকার করতে দেখা গেছে। কার সঙ্গে, কেন? বাবা-মায়ের মতো তিতাসও কখনও জানতে চায়নি। তিতাসের সঙ্গে মেঘনার আলাপ হয় প্রতিদিনই। মেঘনা যখন বই পড়ে, তিতাস পাশে বসে মুঠোফোন বা টিভিতে খেলা দেখে। বাংলাদেশের খেলা থাকলে মেঘনা সবকিছু বাদ দিয়ে খেলাই দেখবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না  থাকলে মেঘনা মোটামুটি বাড়িতেই থাকে। এনিয়ে মা প্রায়ই বাবাকে বলে, তোমার মেয়ের কি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেও ইচ্ছে হয় না? খাবার টেবিলেও এ প্রসঙ্গ আসে। মেঘনা উত্তর দেয় না কখনও। বাবার সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ আলাপ তুলে। আলাপের শিরোনাম হয়ে আসে ইসরাইল, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, ইউক্রেন, ইহুদি, খৃস্টান, মুসলমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা, ফেইসবুক-ইউটিউবের ভাইরাল ইস্যু। বাবা বুঝতে পারেন, মায়ের আশংকাউৎকণ্ঠা ঠিক না। মেয়ে আছে পৃথিবীর সঙ্গেই।

বাবার জন্মদিন ঘিরে মেঘনার প্রস্তুতি সারা বছরের। যেদিনটায় জন্মদিন শেষ হলো, পরের মিনিট থেকেই আবার আগামী জন্মদিন নিয়ে পরিকল্পনা শুরু। তিতাস নিজের জন্মদিনকেই জাতীয় ঘটনা ভেবে থাকে। অন্যদের জন্মদিন নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তবে বাবার জন্মদিনকে একটু পাত্তা দেয়। এবার দেখতে পাচ্ছে মেঘনা বাবার জন্মদিন নিয়ে কথা বলছে কম। দিন এগিয়ে এলেও আয়োজন নিয়ে কারো সঙ্গে কথা নেই। বাবার কাছেও ঐ দিন ঘিরে কোন বায়না নেই। তিতাস প্রথম প্রথম ভেবেছে, দিদি হয়তো সবাইকে একসঙ্গে সারপ্রাইজ দেবে কিছু একটা করে। কিন্তু সেই লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তিতাস একদিন বললদিদি, বাবার জন্মদিনে এবার কোথায় খাবো আমরা? মেঘনার উত্তর নেই। তিতাসের আবার জিজ্ঞাসাতুমি কিছু রান্না করে বাবাকে চমকে দেবে?  নাহ এবারও নির্লিপ্ত ওর দিদি। মেঘনার স্রোত স্থির। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সেই স্রোতের নিচে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তিতাসের এই আবহাওয়া বোঝার কথা নয়। বাবা বুঝতে পারছে। তিতাস শুধু জানে, দিদির যে বন্ধুরা হলে আছে বা ক্যাম্পাসে, ওরা ঝুঁকিতে আছে। দিদিদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝামেলা হচ্ছে। বাবার সঙ্গে দিদি এনিয়ে কথা বলে। যে দিদি টিভির দেখে চোখ রাখে না, সেই দিদিও এখন টিভির সামনে থেকে উঠে না। দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর চোখে ছানি পড়িয়ে রাখা। ওর মধ্যদিয়েই যতোটুকু দেখা যায়। তাতেই দুই ভাইবোন আঁতকে উঠে। বিদেশের চ্যানেলগুলোও ঘেঁটে বেড়ায় দিদি। সেই সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ। ওদের খোঁজখবর রাখা। বাবাকেও বলে রেখেছে, যদি কোন বন্ধু বিপদে পড়ে তবে যেন তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। মেঘনার মাঝে কয়েকদিন চঞ্চলতা দেখা গেলেও হঠাৎ ও চুপ হয়ে যায়। যেমন ঝড়ের পর চুপ হয়ে যায় প্রকৃতি। বাবার সঙ্গেই কথা চলে ওর। বন্ধুরা দেয়াল ভরিয়ে দিচ্ছে স্লোগানে। যখন ওদের কোন স্লোগান দরকার হয়, বাবার কাছ থেকে চেয়ে নেয় মেঘনা। একটা স্লোগান বেশ ছিলতোরা আমার মেয়েকে মারছিস ও যে বাংলাদেশ।

সেদিন রাতভর বৃষ্টি হলো। সকালে তিতাস জেগে দেখে, মেঘনা ঘুমায়নি। ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। কাকে কি করতে হবে এসব। তিতাস তাকাতেই মেঘনা চুপ হয়ে গেল। একটু পর চলে গেলো বারান্দায়। তিতাস পিছু নিলো না। ঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছিল কিছু শব্দমার্চ টু ঢাকা, এক দফা, শহীদ মিনার, ধানমন্ডি, টিএসসি, রুবানা, শিখা, সোহেল, বিপ্লব, সানজানা, অনিকেত। এবং পরের কথাগুলো শুনে চমকে গিয়েছিল তিতাস। ওর বুক কেঁপে উঠেওরা গুলি করবে। আমরা থামবো না। আমি আজ তোদের সঙ্গে আবাহনী মাঠের সামনে থেকে যোগ দেবো। তিতাসকে কেউ তেমন করে কিছু না জানালেও, টিভি দেখে ও জেনে গেছেঅনেক মানুষ মারা গেছে মিছিলে গিয়ে। ইউটিউবে খেলা দেখতে গিয়ে গুলি করার ভিডিও দেখেছে ও। কিন্ত এখনতো পুরো ইন্টারনেটই বন্ধ হয়ে আছে। মেঘনা নাস্তার টেবিলে জানালোআবাহনী মাঠে শিল্পী সমাজের একটা প্রতিবাদ সমাবেশ আছে। সেখানে যোগ দিতে যাবে ও। তিতাস অবাক হয়ে দেখলো মা-বাবা কেউ মেঘনাকে না করলো না। মা বরং বলল, মেঘনার সঙ্গে সেও গিয়ে দাঁড়াতে চায়। মা মা আর তিতাস সেদিন মেঘনাকে নিয়ে আবাহনী মাঠে গেল। তুমুল বৃষ্টি। মা ও মেঘনা নামে। তিতাস গাড়ি থেকে নামলো না। দেখলো সবাই এই বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় কিছু লেখা বা আঁকার চেষ্টা করছে। একজন লম্বা মতো মানুষ, নিজের মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝ রাস্তায়। দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছিল তিতাসের। মা ফিরে আসে কিছুক্ষণ পর। মেঘনা আসে না। মেঘনাকে রেখেই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল ওরা।

মেঘনা সেদিন রাতেও বাড়ি ফেরেনি। কথা হয়েছে সবার সঙ্গে। তিতাসের সঙ্গেওবলতো দেখি, এক দফা এক দাবি। তিতাসের সাথে স্লোগানে কণ্ঠ মেলাতে পারে না। কেঁদে ফেলে ভয়েতুমি কখন আসবে? জলদি আসো আমার ভয় করছে। মেঘনা ওকে বলেদেশ স্বাধীন  করে ফিরবো বুঝনি। তিতাস ফোন মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেমা, বাংলাদেশ না স্বাধীন দেশ? দিদি আবার স্বাধীন হবে দেশ, এসব কি বলছে। মা বলে, মা চোখ মুছে। একটা দেশ যে কতোবার স্বাধীন করতে হয়। তিতাস টিভি খুলে বসে আছে। সব টিভিই এখন মিছিল দেখাচ্ছে। একটি হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার পর মিছিল বেড়েছে। কিন্তু কোন মিছিলে তিতাস দেখতে পায় না মেঘনাকে। মেঘনা ফেরেনি। ওর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বন্ধুরা বলছে, শহীদ মিনারের দিকে ছিলো ও। ওখানে পুলিশ গুলি করার পর আর মেঘনাকে কেউ দেখেনি। বাবা-মা, বন্ধুরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে দেখেছে, মেঘনার খোঁজ মেলেনি। তিতাসের ঘুম ভেঙেছে ভোরে। আকাশে সাদা রোদ্দুর। মেঘেদের আল্পনার মাঝে ও দিদিকে খুঁজে। দিদি কি দেখতে পাচ্ছে কাশফুল ঘিরে আছে ওদের বাড়িটা।