আপনারে আপনি চিনি নে

অ+ অ-

 

আলোর ঝিলিক জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে ধ্রুবর চোখে তীব্র জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। দিনের শুরুতেই ধ্যাৎ তারিকার ছাই বলে বিছানা ছাড়ল সে। গতরাতে জানালা আটকানো হয়নি, এখন জানালা বন্ধ করতে যাচ্ছে। জানালার খিড়কিতে হাত দিতেই কানে ঢুকল সা রে গা মা জাতীয় কিছু আওয়াজ। পাশের বাড়ির মেয়েটি রোজ সকালেই রেওয়াজ করে। ধ্রুবর মাথা ধরে যায়। মেজাজ বিগড়েছে, মুখে স্বাভাবিকভাবেই খিস্তি চলে এসেছে। ধ্রুব আর জানালা বন্ধ করল না।

বিরক্তি নিয়ে সে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এল ছাদে। বাতাসে শরীর কেমন যেন শিরশির করছে। সেই সাথে তলপেটে ধ্রুব প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে। ধ্রুব সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। নিচতলায় দেখে বাচ্চাটি ন্যাংটো হয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। বাচ্চাটির ছোট্ট দাঁত দুটি বের হয়েছে, থুঁতনি বেয়ে লালা পড়ছে।  ধ্রুবর খুব নোংরা লাগছে। দ্রুত নামার সময় ধ্রুব আরও অনুভব করল গায়ে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ছে। উপরে ভেজা শাড়ি ঝুলিয়েছে, টপটপ করে পানি ঝরছে। ধ্রুরব গা ঘিনঘিন লাগছে।

নিচে টয়লেটঘরের সামনে খালি গায়ে লুঙ্গি পরা ভুঁড়িওয়ালা লোকটি বদনা হাতে নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটির দরজা বন্ধ। ধ্রুবর মেজাজ একেবারে খিঁচড়ে যাচ্ছে। লোকটিকে দেখতে বিশ্রীরকম অসহ্য লাগছে।     

রাস্তায় উঠতে প্যাঁচ প্যাঁচে কাদার মাঠ পার হতে হয়। পায়ে মাটি লাগলে খুব ঘিন ঘিন লাগে। রাগে ঘাসগুলোকে লাথি মারতে ইচ্ছা করে। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে পানি জমে আছে। উপরি জ্বালা টিপটিপ করে বৃষ্টিও আরম্ভ হচ্ছে।

এই বৃষ্টির মধ্যে একদল বাচ্চা-কাচ্চা ফুটবল খেলা আরম্ভ করেছে দেখে মেজাজ আরও চড়াও হলো। তাদের গা কাঁদায় নোংরা হচ্ছে, চুল ভিজে মুখ নাক বেয়ে পানি ঝরছে। ধ্রুবর মনে হলো এদের কী মা-বাপ নেই। মনে মনে ধ্রুব এদের মা-বাপ তুলে গাল দিল।

ধ্রুব রাস্তায় উঠেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। খুবই ভ্যাপসা, অসহনীয় গরম লাগছে তার। রাস্তার পিচগুলো পিছলা হয়ে আছে। স্যান্ডেলের ফাঁক দিয়ে ইট আর পিচের টুকরা পায়ে লাগছে। যন্ত্রণা লাগছে।

পা ছেড়ে যন্ত্রণা মাথায় ছড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে খালি গাঁয়ে, ঘামে ভেজা কালো রঙের কয়েকজন মিস্ত্রী রড সোজা করছে। একজন রডে একটা গুঁড়ি ধরেছে, আর বাকি তিনজন বড় হামাম হাতুড়ি দিয়ে বাঁকানো রড সোজা করছে। একেকটা বাড়ির বিকট আওয়াজ ধ্রুবর একেবারে চান্দিতে ঘা দিচ্ছে। তাতানো রোদে ঘুরে মাথা ধরে আছে, তার উপর কানের পর্দা ফাটানো চান্দির ঘাতে কুৎসিত ধরনের বাজে যন্ত্রণা হচ্ছে। ধ্রুব অসচেতনভাবেই গাল দিয়ে বসল।

বিকেলের রোদের আলো কমে আসছে, অন্ধকার ঘনাচ্ছে। রেললাইনের ধার ধরে সে হাঁটছে। তার চোখে পড়ল কয়েকটা মহিলা ধপধপ করে হাঁটছে, কেউ কেউ রেলের ধারে চাটাই বিছিয়ে বসেছে, বোঝা যাচ্ছে তারা শোওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধ্রুবর এদেরকে  বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে। সে আবার গালি দিল।

ধ্রুব যখন ঘরে ফিরল তখন রাত বেশ গভীর। ছাদে দাঁড়িয়ে সে দেখে আকাশ তারায় ভরা, চাঁদ উঠেছে। তারাগুলোকে দেখে তার মনে হচ্ছে তীর-তলোয়ার আর আকাশের চাঁদটিকে মনে হচ্ছে দৈত্যের চোখ। ধ্রুব চোখ জ্বালা নিয়ে ঘরে ঢুকল।

সারাদিনের দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে ঢুকামাত্রই ভ্যাপসা একটা গন্ধে ধ্রুব-র বমি ভাব এলো। সে ওয়াক করে উঠল।

পিপাসায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকে ধ্রুব গ্লাসে পানি ঢালল। পানির গ্লাসটি টেবিলে রাখার সময় হঠাৎ মাথায় চক্কর অনুভব করছে। সে বসে পড়ল। মাথা ভার ভার লাগছে। জিহ্বা কেমন তিতা তিতা হয়ে আছে। চোখে জ্বালা ধরেছে, খুব অন্ধকার, অন্ধকার লাগছে। নাকে কেমন একটু বোঁটকা গন্ধ ঢুকে গেছে, বিশ্রী রকম নোংরা বমি ভাব হচ্ছে। কানে কেমন যেন একটা ড্রিম ড্রিম আওয়াজ ভাসছে, মগজের এপার-ওপার বাড়ি দিচ্ছে। শরীরের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে, লোমকূপে পেরেক ঠুকা, বর্শার শূল বিধার মতো একটা বোধ হচ্ছে।

ধ্রুব টেবিলে মাথা গুঁজে বসেছে। চোখ আধা বোঁজা, চারপাশ অন্ধকার, অন্ধকার লাগছে।

হঠাৎ ক্যামন একটা কাঁপন অনুভূত হলো। শো শো আওয়াজ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে শো শো ধ্বনিগুলোর তীব্রতা কমতে কমতে থেমে যেতেই হু হু হো অ... সুরের সাথে ভো ভো... শো শো সুর মিশছে। অ আ ই শি হি...-এর সাথে তা তা ঢাপ ঢাপ তাল বাজছে। চোখের পাতার ভিতর নিকষ কালো অন্ধকার দেখছে, গাঢ় অন্ধকার ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে, কালো থেকে ধূসর রঙে পরিবর্তন হচ্ছে। ধুসরও পাল্টে যেতে যেতে হালকা হলুদ হয়েছে। হলুদ আলো জ্বলজ্বলে হতে হতে ফর্সা সাদা কিরণ ফুটে উঠেছে। গুমোট, ভ্যাপসা গন্ধে নাকে জ্বালা ধরেছে, হঠাৎ নাকের ভিতর বেলি ফুলের ঘ্রাণ ভাসছে। জিহ্বাতে তিক্ত স্বাদ লেগে আছে। মাড়ির সাথে জিহ্বা ঘষা লাগলে জ্বলে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে তিতা কমছে, মুখের ভিতর টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদ হচ্ছে। শরীরের স্নায়ু বেয়ে খুব আগুন পোঁড়া চুলকানি হচ্ছে। গরম ধীরে ধীরে কমছে, ত্বক দিয়ে শীতল একটা স্রোত বইছে। বরফ গলা পানির মতো, জলপ্রপাতের স্রোতের মতন একরাশ শীতলতা মাথা থেকে গা বেয়ে পা পর্যন্ত বয়ে বেড়াচ্ছে। একটুকু আলোর ছোঁয়া লাগছে, মিঠে রোদে শরীর জুড়াচ্ছে।

গাঢ় আঁধারের আবরণ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। ধোঁয়া বয়ে বেড়াচ্ছে আর এর মাঝে কারো কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। মৃদুভাবে একটু কলকাকলি ভেসে আসছে। কোথায় যেন আধাচেনা আধাচেনা এক সুর, ঝংকার বাজছে। সেই সাথে একটি গন্ধ ধীরে তীব্র হচ্ছে, গন্ধটি একটু একটু পরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে, অনেকদিন আগে এই গন্ধটি সর্বক্ষণই তাকে ঘিরে থাকত।

মনের মধ্যে কে যেন উঁকি দিচ্ছে, খুব ধূসর ঝাপসা একটা মুখ স্পষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে মুখটি বহুবার দেখা খুব বেশি পরিচিত একজনের। খুব ফিসফিস করে কে যেন ডাকছে, ডাকটি অনেকবার সে শুনেছে,আয়রে বাবা...সেই সাথে খুব চেনা চেনা এক গন্ধ ভেসে আসছে। বহুবার পাওয়া এক অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে।

ধ্রুব এখন মুখ দুটি চিনতে পারছে। এক গাঢ় অন্ধকার গর্ভ থেকে যখন সে প্রথম আলোর ঝলকানিতে বের হয়, শ্বাসের সাংঘাতিক চাপে কেঁদে ওঠে তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা সয়ে সয়ে ক্লান্ত আর সেই সাথে প্রশান্তমাখা একান্ত আপন এক মুখ দেখে পরম ভরসা পেয়েছিল। মনে পড়ে, দুটি চোখ তাকে দিশা দিচ্ছেদেখিয়ে দিচ্ছে আলো ভরা এক পথের, যে পথের ধুলায় ধুলায় ছড়ানো আছে অযুত নিযুত দীপমালা। খুব মৃদু স্বর তাকে কানে কানে বলছে—‘তুমি এসেছো এক অনিন্দ্য সুন্দর জগতে, আনন্দ ভরা জীবন নিয়ে। নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তার গায়ে, তাকে পরশ বুলাচ্ছে, আর প্রাণকে দিচ্ছে প্রচণ্ড শক্তি, মাতৃ জঠরের পরম আশ্রয় থেকে বেরিয়ে খর-তাপ-রৌদ্র, ঝড়-বৃষ্টি-বাদল, কনকনে-হাড় কাঁপুনে শীতের সাথে লড়াই করবার জন্যে। তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে একটি চুমুতার সমস্ত শরীরে এক অনাবিল সুখ অনুভব করছে, মন-প্রাণ-দেহ নবধারা জলে পবিত্র হয়ে উঠছে।      

শরীর জুড়ে পরম এক চাপ অনুভব করছে। খোলা আকাশের নীচে কোলে বসে থাকার একটি অনুভূতি হচ্ছে। খুব নির্ভবানায় আব্দার করার ইচ্ছা মনের মধ্যে চাপছে। হাত ধরে খুব কৌতুহল নিয়ে থপ্‌থপ্ করে হাঁটা, এই পড়তে পড়তে এক হাত ধরে শা উড়ে কোলে চড়া আর হি হি করে হাসার কথা মনে পড়ছে।

দৃশ্যগুলো ঝাপসা হয়ে ভেসে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে গাছের ডালেডালে পাতার মেলা, আবার পাতা ঝরছে, আবার পাতায় বোঝাই হচ্ছে। মুকুল ধরছে, ফল ফলছে আবার মুকুলের গোছা। ধীরে ধীরে ফুলগুলো গোছা থেকে ফুলছে, আবার শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, ফের ফুলে উঠছে। 

ধ্রুব ঠিকমত বুঝে উঠতে পারছে না। নিজের অস্তিত্বের উপস্থিতি নিজের মাঝে ঠিকমত ধরা দিচ্ছে না। সময়ের কোন আবর্তের ঘূর্ণিচক্রে সে ঘুরপাক খাচ্ছেএ প্রশ্নের কোন সুস্পষ্ট উত্তর মিলছে না। হঠাৎ করেই ধ্রুবর মুখ থেকে চিৎকারের মত আওয়াজে একটি প্রশ্ন বেরিয়ে এল—‘কে?

খুব চেনা স্বর দূর থেকে ভেসে আসছে (মেয়েলি কণ্ঠে),বু বু বু... মুমমু... আ আ আ...

সাথে আরো যোগ হল পুরুষ কণ্ঠ, আচোআচো... গুজি গুজি বাবু...

ধ্রব নিজের ভিতর থেকেই একটি সুর শুনতে পেল,ই হি হি হি...

স্বরটি আরও স্পষ্ট হয়ে আসছে (মেয়ের গলা), পটো... টাপো... পটা... টপা...

তার পাশাপাশি আরও কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে, টুপলু করে না... টুপলু করে না...

চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘের পর মেঘের মেলা, মাঝে মাঝে আলোর ঝলক। সবুজের পর সবুজ মাঠ, আর চারিপাশে লাল-কমলা-হলদে-সবুজ-আসমানি নীল রঙের মেলা। সাত রাঙা আচল পরিয়ে আকাশের মেঘে মেঘে কোন এক নাচুনি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টির শেষে ফেরা সূর্যের আলোর ঝিলিক পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ঝর্ণার মতো ঝরছে আকাশ পাহাড়ের পথ ধরে। কোন দূর থেকে ভেসে আসছে একটি সুর। বাঁশির সুরে ভেসে আসছে টুন টুন টুন টুন উঁ  উঁটু টু উঁটু টি...। ঘ্রাণ ভেসে আসছে, বকুল ফুলের গন্ধ কেমন করে যেন চারিপাশকে ভরে রেখেছে, ফুলের গন্ধকে কেমন যেন আপন বন্ধুর মতো মনে হচ্ছে। ঝির ঝির হাওয়া বইছে, শীতল এক স্রোত শরীর বেয়ে বেয়ে যাচ্ছে।

ঠক্ ঠকা ঠক্ শব্দ হচ্ছে। এবড়ো খেবড়ো একটি পিণ্ডকে ঠুকে ঠুকে মসৃণ করা হচ্ছে, এর মাঝে কোথাও গোল, কোথাও তেকোণা, কোথাও বাঁকা রেখাএকের সাথে এক মিলে একটি সুশৃঙ্খল আকার নিচ্ছে। এর প্রতিটি বাঁককে মনে হচ্ছে নিখুঁত, নিপুণ হতের ছোঁয়া এর প্রতিটি ভাজে ভাজে। ঠুকঠাকঠুক আওয়াজের সাথে হা রে রে রে সুর মিলে খুব তেজময় ধ্বনির ঝংকার বয়ে আনছে মনের অন্দরে, সমস্ত শরীরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চাঞ্চল্য জাগানো শিহরণ।

মনে হচ্ছে কোন সুদূর থেকে পুঁ... ঝিক্, ঝিক্... পুঁ... আওয়াজ ভেসে আসে, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ প্রকট হয়ে শোনা যাচ্ছে হেইয়ো..হেইয়ো...’—সুরটুকু কেবল কানকেই ভরিয়ে দিচ্ছে না, পুরো শরীরেই কেমন এক উদ্দীপনা আর তোলপাড় করা ঢেউ বয়ে নিয়ে আসছে। অনুভূত  হচ্ছে কোন প্রান্তর থেকে ভেসে আসা রঙ্গ বীণার বাজনায় নদী সমুদ্র নেচে উঠছে, তার সাথে তাল মিলাচ্ছে চাঁদ-তারা। যেন কোন এক যাদুকর এঁকেছে জীবন ভর তপস্যায় রাঙা তৈল চিত্র, সেইসাথে সুর ছড়িয়ে যায়... রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও গো...। ধূসর রঙে ঢাকা আকাশের নিচে ধুধু বালি কণার ছড়াছড়ি, এরমাঝে চাঁদের আলো পড়েছে।

হঠাৎ চোখের পাতার উপর আলো পড়ল। ধ্রুবর মুখের উপর মৃদু আলো। আলোর কণাগুলোকে কেমন যেন মিঠে লাগছে। কোথা হতে কিশোরী  কণ্ঠের সুর ভেসে এল... চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি’—ধ্রুব জানালার কাছে চলে এল। তার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, আহ্! মন আর কান দুইই কোন এক জায়গায় মিশে গেছে। তুমি হে প্রভু’—কলিটিকে পরম আপন মনে হচ্ছে। ধ্রুবর অনুভূত হচ্ছে, তুমি চিরমঙ্গল সখা হে তোমার জগতে... সুরের রেশ তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির দিকে গেল। সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, শিশুটি হামাগুঁড়ি দিচ্ছে। গুটুম গুটুম শরীরের  পিছনটি ডানে-বাঁয়ে দুলছে, চোখ দুটো গোল গোল, আর মুখের সামনের ছোট্ট দুইটা দাঁত বের করে হি হি করে হাসছে। ধ্রুবর পুরো মনোযোগ শিশুটির দিকে, সে দাঁড়িয়ে দেখছে। মনের মধ্যে খুব মুগ্ধতা আর খুব ভাল লাগা এক অনুভূতি ভর করেছে। ধ্রুব আবার হাঁটতে শুরু করল, সাথে ছন্দের ঝঙ্কার, ছোটো খোকা বলে অ আ/ শেখেনি সে কথা কওয়া।  

ছন্দের তালে তালে সে চলছে- হঠাৎ পানির ছিটা লাগল। টপটপ করে আরো কয়েক ফোঁটা পানি গায়ে লাগল। শরীর জুড়ানো এক ভাব হচ্ছে, আরাম লাগে। হাওয়াতে শাড়িগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে, ধ্রুবর মনে হচ্ছে যেন মাঝ সমুদ্রে হালকা ঢেউ উঠেছে । মনে হচ্ছে শরীর ভাসিয়ে নেয়া স্রোত শরীরে পরশ বুলাচ্ছে। কানের ভিতর সুরস্রোত বাজে নাচে নাচে তপন তারা নদী সমুদ্র নাচে।

মনের মাঝের নাচুনি শরীরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। শরীর মনের দুলুনি নিয়ে ধ্রুব নিচে নামল। টয়লেটের সামনে লুঙ্গি পরা খালি গাঁয়ে ভুঁড়িওয়ালা লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুব অবাক হয়ে দেখছে, তার মনে একটি প্রশ্ন উঁকি দিল, কোন্ সেই ভাস্কর যে সুনিপুণ হাতে একে গড়েছে। গোলগাল মুখের মাঝে উঁচু হয়ে চোকা নাকআবার তার নিচেই কী সূক্ষ্ণ ভাঁজ আর গর্ত আর উপরে কোটরে থাকা সাদা-কালো রঙে তৈরি দুটি চোখ। আর শ্যামলা মুখের মাঝে লাল রঙের ঠোঁট কী সুন্দর ফুটেছে। আর গোলাকার মুখটি বেয়ে চোঙার মতো নেমেছে ঘাড়-গলা আর তার পর আরো বড়ো গোল হয়ে গেছে বিশাল ভুঁড়িটি। সব মিলিয়ে নির্মিত হয়েছে আশ্চর্য, অসামান্য একটি শিল্পকর্ম। কবে যেন পথের এক গায়কের গলায় শুনেছিল... সামান্যে কী তার মর্ম বোঝা যায়...।

ধ্রুব পথে নামল, ঘাসে ঢাকা পথ। চলতে চলতে পায়ের তলে নরম ঠেকছে, খুব আরাম। হালকা দমকা হাওয়ার সাথে একটু খানি বৃষ্টি, ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে থই থই করছে পানি। পানির মধ্যে সূর্যের কিরণ চিকচিক করছে। ধ্রুব পায়ের আঙুলগুলো ভিজালো। পা বেযে বেয়ে শীতল অনুভূতি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ধ্রুব আপন মনে এলোমেলো কলির সুর ভাজল... ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি/ বনের পথে যেতে...। আর একই সাথে প্রচন্ড আনন্দে হাত পা ছুঁড়ে ইচ্ছে করছে তার। ঠিক মনের মাঝে উত্তাল ঢেউ ওঠা মুহূর্তেই ধ্রুব দেখে কাদা মাটিতে মাখামাখি করে, বৃষ্টির পানিতে ভিজে একদল বাচ্চা-কাচ্চা ফুটবল খেলছে। খুব মধুর উৎসবময় লাগছে মুহূর্তগুলোকে। কৃষ্ণচূড়ার আভা দিকে দিকে ছড়িয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। টপ্‌টপ্ বৃষ্টি পড়ছে, ধ্রুবর মনের মাঝে হঠাৎ করে ছন্দের তাল জেগেছে, সে আপন মনেই বলে উঠল, ঝম্‌ঝম্ বিষ্টি পড়ে/ ভাইবোন খেলা করে

ধ্রুব অনুধাবন করতে পারছে তীব্র প্রাণশক্তির প্রকাশকে, অনুভব করছে প্রচণ্ড উত্তাপ। উত্তপ্ত দাবদাহে চারিপাশ তেতে উঠেছে। প্রচণ্ড উত্তাপের দহনের সাথে ছড়াচ্ছে তীব্র শক্তি। হঠাৎ পাথর কেটে পথ বানাতে পথে নামতে ইচ্ছে হচ্ছে। সূর্যের কঠিন কিরণে পিচ গরম হয়ে উত্তাপ বিকিরণ করছে। ধ্রুবকে আলোড়িত করে তুলছে প্রচণ্ড শক্তির দহন। হাত-পা ছুঁড়ছে ভয়ংকর বিপ্লবী তেজে, বলে উঠছে—‘জ্বলে পুঁড়ে মরে ছাড়খার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়। ইচ্ছাগুলো আরো সুতীব্র হলোবৃষ্টির পানি শুকিয়ে দেয়া তপ্ত পথে নেমে। উত্তাপের ধোঁয়া ছড়ানো পিচগলানো পথে  হাঁটতে হাঁটতে সারা শরীরে প্রবল এক ঝাঁকুনি অনুভব করছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীব্র গলনে তাপ আর ছড়ানো পোঁড়া গন্ধে নিজের প্রতাপশালী এক অনুভূতির দহন হচ্ছে। কেন যেন, আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালো,/আমার এ ধূপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো’—কলিগুলো মনে হল। সুরের রেশ মিলাতে মিলাতেই বিকট শব্দের তাল যোগ হল। ধ্রুব দেখছে কয়েকজন মানুষ বিশাল আকারের হামাম নিয়ে বাঁকানো রড সোজা করছে, মাঝে একজন চরম সাহস নিয়ে ঘুঁটি ধরে আছে। ধ্রুবর আশংকা একটু এদিক ওদিক হলেই মাঝের মানুষটির হাত গুঁড়িয়ে যেতে পারে বা হামামের সাথে হামামের সংগর্ষে যে কারো মাথা ফেটে যেতে পারে। কিন্তু খালি গায়ের এই কয়েকজনের মধ্যে আশংকার লেশ মাত্র নেই, চোখে আছে প্রচণ্ড প্রত্যয়। ধাম ধাম বাড়ির শব্দে ধ্রুব আপন মনেই বলে উঠল, মাটির পৃথিবী-পানে আঁখি মেলি যবে/ দেখি সেথা কলকল রবে/ বিপুল জনতা চলে/ নানা পথে নানা দলে দলে/ যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য-প্রয়োজনে/ জীবনে মরণে।

তীব্র দাবদাহের সাথেই ধ্রুব হেঁটে যাচ্ছে, সাথে সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছে। রোদ কমতে শুরু করেছে, তীর্যক হয়ে বিকেলের রোদের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ছে। পিচ ঢালা রাস্তার জ্বল জ্বলে আলো কমে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। পশ্চিমের আকাশে গোধূলির রঙ, আকাশ ভরে লাল রাঙা আভা ছড়াচ্ছে। লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে, হালকা আাঁধারের ভারে। আরে সেই সময় পথের ধারে পাটি বিছিয়ে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে কয়েকজন মহিলা। কেই হাত-পা মেলে, কেই চুল ছেড়ে, আবার তাদের পাশ দিয়ে ধপ্ধপ্ করে হেঁটে আসছে ঘামে ভেজা আরেক মহিলা। ধ্রুব চিন্তা করল, এই মেয়েদের কেউ ইট ভাঙে, কেউ গার্মেন্টেসে কাজ করে, কেউ হয়তো ফেরি করে তাদের জীবিকা মেটায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্বাপদ সংকুল এই শহরে তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা কবচ বানাচ্ছে, আর নির্মাণ করছে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি। এরা নারী মুক্তির আন্দোলনেও নেই, জেন্ডার জেন্ডারও করে না। প্রাণ অতিষ্ঠ করা ষ্টের মাঝেও প্রাণ খুলে কথা বলছে, হাসছে। আবার, ধ্রুব  কবিতার কাছে ফিরে গেল— ‘ওরা চিরকাল/ টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল;/ ওরা মাঠে মাঠে/ বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে/ ওরা কাজ করে/ নগরে প্রান্তরে।

তারা ভার রাতে ধ্রুব হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে ধ্রুব ঘরের দিকে ফিরছে। চিলোকোঠায় দাঁড়িয়ে ধ্রুবর চোখ আকাশের দিকে চলে গেল। আকাশে তারা পাশে তারার মেলা। ধ্রুব মনে মনে বিন্দুর মতো তারাগুলোর যোগ করছে। অদৃশ্য রোখারা হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে উঠলদেখলে মনে হচ্ছে একটি শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে। পাশে চাঁদ। ধ্রুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে চাঁদটি হয়ে যাচ্ছে মায়ের কপালের টিপ। ধ্রুব হাত-পা ছুঁড়ে প্রচণ্ড উল্লাসে চিৎকার করে উঠল—‘মা-আমি এখানে।