কোকিলা

অ+ অ-


নূরী আজ সকালে এসেই বাহেরজানকে বলে রেখেছে, ‘নানী আইজ কইল আমাবাইশ্যা, আমারে কইলাম কালি হাঁজের আগেই বাড়ি যাইবার দিও।’ বারান্দায় বসে থাকা বাহেরজান মুখ খিঁচিয়ে জবাব দেন, ‘উঁ আইছে বেলা এক নল উঠাইয়্যা আবার ঢং! যা তাড়াতাড়ি গোবর গুলায়্যা দুয়্যারে গোবর দে, কামলারা ধানের বুজা নিয়ে আসতেছে।’ বাহেরজানের মুখ আর সহজে বন্ধ হতে চায় না, চলতেই থাকে—‘আমাবাইশ্যা অইচেতো কি অইচে! তোর গতরের যি রোঙ! আন্ধারের মধ্যি আইটা গেলি ভূতও তোরে দেখপো না! পাও নাড়া তাড়াতাড়ি, কাম কর।’ নূরী উঠানের মাঝে গোবরে পানি ঢেলে পা দিয়ে গোবর গোলাতে গোলাতে বাহেরজানকে বলে, ‘নানী তোমার চুল কয়ডা যুদি পাহা না অইতো তাইলি তুমি যে বইস্যা আছাও আমিতো বুঝতামই ন্যা, তুমিতো আমার চাইয়্যাও বেশী কালা!’ বলেই হাসতে হাসতে ভেঙে পরে নূরী, হাসির দমকে শ্রাবণের নদীর মতো ছোট ছোট ঢেউ খেলে যায় নূরীর শরীর বেয়ে।

নিড়ানো কাঁচির ফলার মতো ঈষৎ বাঁকানো ছোট্ট পাড়া। চার পাঁচ ঘর বড় গৃহস্থবাড়ির সামনে বড় বড় খড়ের গাদা, লম্বা গোয়াল ঘর, গরু বাঁধার আওলাঘর, দেখেই বুঝা যায় এরা সামর্থ্যবান গৃহস্থ। এদের বাড়িতে সারা বছরের জন্য দু-তিন জন করে বাঁধা কাজের মানুষ থাকে, তারপরও ফসল তোলার মৌসুমে তিনবেলা খাবারের পাশাপাশি মৌসুম শেষে ধামা চুক্তি ফসল দেওয়ার শর্তে ছুটা কাজের মানুষও রাখতে হয়। কিছু মাঝারি গৃহস্থ আছে এদের বাড়িতে সারা বছরের জন্য বাঁধা কাজর মানুষ দরকার হয় না। শুধু চৈতালি বা কার্তিক-অগ্রহায়নের ধান তোলার সময় মানুষ দরকার হয়। পাড়ার বাকি ঘরগুলোর প্রায় সবারই চলতে হয় অন্যের বাড়িতে কায়-কামলা দিয়ে।

এক সময় দূর কলকাতা হতে আসা হলুদ খামে ভরা চিঠি পড়তে  যেমন যেতে হতো সাহাপাড়ার বাবুদের কাছে, তেমনি সোনালী আবরণে ভরা শস্যদানা ঘর তোলার জন্য গৃহস্থদের আসতে হয় নূরীর নানীর কাছে, নূরীকে পাওয়ার জন্য। আশীতিপর বৃদ্ধা নূরীর নানীর নিজের উঠানে কোনদিন ফসল না উঠলেও সারাজীবন পাড়ার গৃহস্থবাড়িতে কাজের অভিজ্ঞতায় এখনো সে মাড়ির দাঁত দিয়ে চাল ভাঙ্গার কুট শব্দ শুনেই বলে দিতে পারে; মুড়ির ধান হলে আরো রোদে দিতে হবে কিনা! নাকি বেশি রোদ হয়েছে! যে ধান গোলায় তোলা হবে সে ধান আর কদিন রোদে দিতে হবে, আউলা ধানের রোদ কেমন হবে ইত্যাদি। একুশ বছর বয়সী নূরীও এই জ্ঞান অর্জন করেছে, কিছুটা অভিজ্ঞতা থেকে আর বাকিটা নানীর কাছে গল্প শুনে। নানীর বুকের ওমে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছে নূরী। মায়ের বুকের ওম সে পায়নি।

নানীর মুখে শুনেছে; আশ্বিনের ঝড়ের বছর পদ্মাপাড়ের বেশ কয়েকঘর নদীভাঙ্গা পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল তাদের পাড়ায়, শিকদার বাড়ির পালানে। সে বছর তার মা আর নানী দুজনই কাজ করছিলো কছিমুদ্দিন শিকদারের বাড়িতে। তার মায়ের বিয়ের বয়স নাকি পার হয়ে যাচ্ছিল, বয়স কুড়ি ছুঁই ছুঁই, কিন্তু গায়ের রঙ কালো বলে বিয়ে হচ্ছিল না। ঐ বছরই পৌষমাসের এক সন্ধ্যায় শিকদার বাড়ির বাইরের উঠানে এগার টাকা দেন মোহরে নূরীর মা অর্থাৎ মালার বিয়ে হয়, বর শিকদার বাড়িতে আশ্রিত নদীভাঙ্গা পরিবারের এক এতিম ছেলে, মহর খাঁ। বিয়েতে নূরীর নানা গহর আলীর যে খুব মত ছিল তাও নয় আবার অমতও ছিল না। বয়স্ক গহর আলী আগের মতো আর কায়-কামলা দিতে পারে না, বৌ আর মেয়ে মিলে ফসল তোলার মৌসুমে এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে যে ধান পায় তা দিয়েই বছর চালিয়ে নিতে হয়। বিয়ের পরে ছেলে তার বাড়িতে ঘরজামাই থাকবে, সংসারে একজন কামাই রোজগারের মানুষ বাড়বে!  এজন্য সে খুশি। কিন্তু সমস্যা হলো জামাই-মেয়ে থাকবে কোথায়? ঘর বলতে তো একখানা ছাপড়া! কছিমুদ্দিন শিকদার নিজের ঝাড়ের বাঁশ আর বাতার ছন দিয়েছিল ঘরের সাথে বারান্দার মতো একটা খুপড়ি বানানোর জন্য। পরের বছর আশ্বিন মাসের দশদিন বাকি থাকতে এই খুপরি বারান্দাতেই নূরীর জন্ম।

মুসলমান পাড়ার শেষ বাড়িটি নূরীর নানা গহর আলীর, তার বাড়ির ধ্বজা হতেই শুরু হয়েছে পায়ে হাঁটা পথ, কাপালি পাড়ার পায়ে হাঁটা পথ এখনো পানির নিচে, তাই কাপালি পাড়ার মানুষদের পশ্চিম দিকে কোথাও যেতে হলে গহর আলীর বাড়ি পর্যন্ত তাদের নৌকায় আসতে হয়। আজ বুধবার, হাটের দিন, কাপালি পাড়ার লোকজন গহর আলীর বাড়ির ধ্বজায় নৌকা বেঁধে রেখে হাটে চলে গেছে। ছোট দিনের বেলা, তাই বেলা ভাটি পরার আগেই লোকজন হাটে চলে গেছে। ঘাটে বাঁধা অলস নৌকা পূবান বাতাসে দোল খাচ্ছে, তারই একটি নৌকার গলুইয়ে বসে আছে গহর আলী, তার মনের ভিতরে চলছে শঙ্কা আর আনন্দের দোলাচাল। দুপুর হতে মেয়ে মালার প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে, চিৎকার করে কান্না করছে, এখন বেলা ডুবু-ডুবু কিন্তু ধাত্রী তোরাফের মা কিছুই করতে পারছে না! গহর আলী একবার ঘরের দরজার কাছে যাচ্ছে আবার নৌকায় এসে বসছে, এর মধ্যেই মাগরিবের আজান হয়। নৌকায় বসে ওজু করে চারোটে গামছা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায় গহর আলী, সালাম ফেরানোর আগেই তোরাফের মায়ের কণ্ঠ পৌঁছায় তার কানে—নাতিন অইছে! নাতিন! গহররে তাড়াতাড়ি ডাক দ্যাও! গহর আলী ঘরে ডুকে আনন্দের অতিশয্যে বলে ফেলে—চাচী নাতিনতো আমার কোকিলের বাচ্চার মতো ‍সুন্দর হইছে! ধাই তোরাফের মায়ের সোজা সাপ্টা জবাব—তাইলি তোমার নাতিনের নাম রাখলাম কোকিলা। কালাই ভালো, কালাই আমার ঘর রোশনাই করবো। আমার নাতিনির নাম রাখলাম আমি নূরী, আমি নূরী কইয়াই ডাহুম, ছোট্ট নূরীকে ছেঁড়া কাপড়ে জড়াতে জড়াতে স্বগোক্তি করে নূরীর নানী।

ছোট্ট নূরীর বয়স আজ ছয়দিন, ইঁদারার পাশে সকালের একফালি হলুদ রোদ্দুরে নূরীর জন্য পানি গরম দেওয়া হয়েছে। জন্মের পর আজ তার প্রথম গোসল। খেজুর পাতার পাটিতে পা মেলে বসে সরিষার তেল মেখে দিচ্ছে আর নাতনীর চোখে চোখ রেখে গল্প করছে নূরীর নানী। কাঁঠাল গাছের গোড়ায় ঘর লেপার মাটির ডিবিতে বসে এক পলকে তাকিয়ে আছে নূরীর নানা গহর আলী। তাকে উদ্দেশ্য করে নূরীর নানী গীত গাওয়ার মতো করে বলতে থাকে—আমার নাতিনির ফিল্যা চাইয়্যা থ্যাইহেন না! আমার নাতিনির যদি নজর লাগে! নাস্তার বেলা গড়াইয়্যা গেল, তাড়াতাড়ি কড়কড়া ভাত কয়ডা খাইয়্যা ফরাজীবাড়ি যান। আইজ আমার নাতিনির ছয় হাটুইর‌্যা। একটা কলম আর ইটু কাগজ নিয়ে আইসেন। ক্যাইলক্যা সকালে আবার ফেরত দিয়া আসুমানি। আসার সময় ফরাজীবাড়ির বড় বৌয়ের কাছথ্যা কাঠের একটা পুড়্যান খাইট্যা চাইয়্যা নিয়্যা আইসেন। ছোটিঘরে আইজ হারারাইত আগুন জ্বালান নাগবো, তাড়াতাড়ি আইস্যা একটা মাইজ ক্যালা পাতা কাইট্যা দিয়েন। আইজ র‌্যাইতি আমার নাতিনির ভাগ্য লেখা অইব। রাইতি আমার নাতিনির হিত্যানে মাইজ ক্যালাপাতায় কইর‌্যা কাগজ, কলম আর এক মুঠ ধান থুইয়া দিয়ুন নাগবো, তাইলি সে আমার নাতিনির ভাইগ্য ভালো অইবো, বড় গিরস্থ ঘরে বিয়া অইব।

শাওন মাসের শুরুতেই বছর চুক্তি রাখালদের কাজ শেষ হয়ে যায়, রাখাল বিদায়ের দিন কোন কোন গৃহস্থবাড়িতে পিঠা-আটা বানানো হয়, বিদায়ের দিন দুপুরে গৃহস্থের গরু-ছাগল নদী থেকে গোসল করিয়ে নিয়ে আসেন, সেই সাথে নিজেও গোসল করে আসেন। মাথায় জব-জবে করে সরিষার তেল মেখে দুপুরের খাবার খেতে বসেন। খেতে বসেই বাড়ির গিন্নি, বৌ-ঝিসহ সকল মহিলাদের কাছ থেকে ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেওয়া হয়ে যায়। শুধু এই বিশেষ একটি দিনে গৃহস্থ অপেক্ষা করে রাখালের জন্য। নতুন লুঙ্গি, গামছা ও গেঞ্জি পাশে রেখে গৃহস্থ দাওয়ায় বা বারান্দায় বসে থাকে রাখালের অপেক্ষায়। মহিলাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় গৃহস্থের পাশে। ‘দশ মাস আপনের বাড়িতে থাকছি, খাইছি কাম করছি এর মধ্যি ভুল-বেয়াদপি অইয়া থাকলি মাপ করইর‌্যা ‍দিয়েন’ বলে রাখাল বয়োজেষ্ঠ্য গৃহস্থের পা ছুঁয়ে সালাম করে। ‘আল্লাহ তোমার শরীর-গতর ভাল রাখুখ, সারাজীন যেনি খাইটা খাইব্যার পার’—গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন গৃহস্থ। গৃহস্থের হাত থেকে নতুন লুঙ্গি, গামছা ও গেঞ্জি হাতে নিয়ে আথালে বাঁধা গরু ছাগল আর গৃহস্থ উপস্থিত সবার দিকে একবার মমতাভরা চোখে তাকিয়ে বিদায় নেয় বছর চুক্তি রাখাল।

 শ্রাবণের ঢেউয়ে সাঁতরে বেড়ানো আমন ধান এখন শয্যা নিয়েছে আশ্বিনের ছিপছিপে জলে ভেজা কোমল মাটিতে, সোনালী শস্য প্রসবের জন্য। অগ্রহায়নের কোন এক কোমল রোদের সকালে কিষাণের মাথায় চড়ে সে পৌঁছে যাবে হাসিমাখা কোন কিষাণীর গৃহে।

কয়েক দিন পরেই আমন ধান কাটা শুরু হবে। বড় গৃহস্থরা বছর চুক্তি রাখালের খোঁজ করছে। গড়গড়ি বিলের ধান দেখে হাঁটু সমান কাঁদা মাড়িয়ে বলরাম মণ্ডল ভর সন্ধ্যায় এসেছে গহর আলীর বাড়ি। বলরাম মণ্ডল কাপালি পাড়ার মাঝারি গৃহস্থ। তার দুইজন রাখাল দরকার হয়না, জোয়ান-মর্দ একজন হলেই চলে। গহর আলীর মেয়ে-জামাই মহর খাঁ তিন কামলার কাজ একাই করতে পারে, গেল এক বছরে সে কথা এপাড়ার ছোট বড় সব গৃহস্থের কানে পৌঁছেছে। বলরাম মণ্ডল তার উদ্দেশ্যেই এসেছে। কিন্তু কছিমুদ্দিন শিকদার আগেই বলে রেখেছে—গহর তোমার জামাই পরিশ্রমী, কিষ্ষাণীও বুঝে ভাল, গেল বছর আমার বাড়ি প্যাটে-ভাতে আছিলো, কিছু মনে কইরো না, ই বছর পাঁচজন নিয়া বইসা মাইনা ঠিক কইরাই রাহুম। কছিমুদ্দন শিকদার এপাড়ার সবচেয়ে ধনী গৃহস্থ, তার কথার ওপর কথা চলে না। তাই বলরাম মণ্ডলকে ফিরতে হয় নিরাশ হয়ে। বলরাম মণ্ডল চলে যাওয়ার পর নূরীর নানীর মনে পড়ে, মেয়ে-জামাইটা শিকদার বাড়িতে বছর চুক্তি কাজে যাওয়ার আগে একদিন ভাল কিছু রান্না করা দরকার। তাই নূরীর নানাকে বলে—হুনেন, আইজ বুধবার নাতিনির বয়স অইলো চৌদ্দ দিন সামনে বুধবারে অইবো একুশ দিন, ঐদিন ছোটি উট্যাইয়া নাতিনির কামানী দিওন ন্যাগবো, আবার জামাইড্যাও কামে যাইবো! আপনে আটে থা একটা মাছ আইন্যা দিয়েন।

এশার আজান হচ্ছে, গহর আলী পুরনো তিল পরা পাঞ্জাবিটা কাঁধে ফেলে রওয়ানা দেয় মসজিদের দিকে। ‘ছোটিঘর বেশি রাইত তুরি উদল্যা নাহুন যাইবো না তাড়াতাড়ি আইসেন কইলাম’ বলেই ঘরের ঝাপ টেনে দেয় নূরীর নানী। ছোটিঘরের কাঠের আগুনে কাপড় গরম করে নাতনীর গা সেঁকছে নূরীর নানী। কোথায় যেন একটা যম ঘুঘু ডাকছে, ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠে নূরীর নানীর। মেয়ে মালার কাছ থেকে নাতনীকে নিজের কোলে নেয়, বুকের সাথে মিলিয়ে ধরে নাতনীকে। ‘মা, কানডা ইটু খাড়া কর দেহি’—মেয়ে মালার কথায় ভাল করে খেয়াল করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে নূরীর নানী, তারপর মুখ ফ্যাকাশে করে মেয়ে মালার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলতে থাকে—জিকিরের শব্দ, মুসুল্লিরা জিকিরে বাইর অইছে! এই ফিল্যা আসতেছে মনে অয়! তাইলি কি দেশে আবার কলেরা শুরু অইলো!

এক সময় কার্তিক মাস এলেই এলাকার সব মসজিদ হতে এশার নামাজের পর মুসুল্লিরা ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে জিকির করতে বের হতো, মহামারি থেকে পরিত্রানের আশায়। এ পাড়ার মসজিদ হতেও ইমাম সাহেবের সাথে সব মুসুল্লি বের হতো, পাড়ার ঐ মাথা হতে শুরু হতো শেষ হতো মুসলমান পাড়ার শেষ মাথায় এসে। কিন্তু গত কয়েক বছর দেশে কলেরা না হওয়াতে মানুষ আর জিকিরে বের হয় না। গহর আলী ঘরে ফিরেছে, জিজ্ঞাসু চোখে নূরীর নানী এবং নূরীর মা তাকিয়ে আছে তার দিকে। ‘হুন নূরীর মা ডরাইও না, আমাগো এহেনে এহোনো দেহা দেয় নাই, তয় খবর পাওয়া গেছে পেটকাটা কাশিমপুরের ঐ ফিল্যা নাকি কয়েকজন মারা গেছে’—থাক ওসব কতা, এ্যহন হুইয়া পরো। জিকিরের আওয়াজ বন্ধ হলে পুরো গ্রাম ডুবে যায় নৈঃশব্দ্যের অতলে। ভয় আর উৎকণ্ঠার অমানিশা ঢেকে ফেলে পুরো গ্রাম।

গত চার-পাঁচ দিন হলো মানুষের এবাড়ি-ওবাড়ি আনাগোনা কমে গেছে। কোন বাড়িতে কারো একবারের জায়গায় দুইবার বাহ্যি চাপলে মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নূরীর নানীর লবণ আর কেরোসিন তেল ফুরিয়ে গেছে! লবণ না হয় চেয়ে এনে চলা যায় কিন্তু কেরোসিন তেল? অগত্যা বাধ্য হয়ে নূরীর নানাকে বলা—আইজতো শনিবার, গাছ থ্যা কয়েক জোপা সুপ্যারি নামাইয়্যা ইটু বায়রা আটে যাইব্যা না? ঘরে নুন আর কিরাসিন তেল নাই, ছোটিঘর আন্দার থুয়া যাইবো না! জামাই মাতায় কইরা নিয়্যা যাইবেনে তুমি খালি হাতে যাইব্যা।

ঘরে আলো জ্বালাবার জন্য কেরোসিন নিয়ে গহর আলী বাড়ি আসে ঠিকই কিন্তু রাতে কয়েকবার বাহ্যি আর বমি করে পরের দিন সকালে নিজের জীবনের আলো নিভিয়ে রওয়ানা হয় পরপারের উদ্দেশ্যে। পুরো পাড়া নিথর হয়ে যায়, তবে গহর আলীর শোকে নয়, গ্রামে কলেরা হানা দিয়েছে সেই ভয়ে। আশেপাশের দু চার গ্রামের অনেক বাড়ির অনেকেই চলে গেছে! কিন্তু এক বাড়ি হতে পরপর তিন দিনে তিনজন মানুষ চলে গেছে এরকম বোধ হয় শুধু এ পাড়ার গহর আলীর বাড়ি ছাড়া কোথাও হয়নি! রবিবার চলে গেল গহর আলী আর মঙ্গলবার ও বুধবার তার অনুগামী হলো মেয়ে-জামাই মহর খাঁ এবং মেয়ে মালা। ইঁদারার পাশে আমগাছের নিচে তিনটি নতুন কবর। মাস খানেক হলো কলেরার প্রকোপ বন্ধ হয়েছে, কবরের মাটিতে শ্যাওলা জমতে শুরু করেছে, তবুও বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ ভারী করে নিঃশ্বাস ছাড়ে! রাত বিরাতে যারা এ পথ দিয়ে যায়, মাঝে মাঝে নূরীর কান্নার আওয়াজ তাদের পা ভারী করে দেয়, কেউ কেউ থেমে যায়, শ্যাওলা জমা উঠানের দিকে গলা বাড়িয়ে বলে—চাচী জাইগা আছাওনা! ম্যায়াডার গলায় ইটু পানি দ্যাও।

কার্তিক মাস যায় ফি বছর আবার কার্তিক আসে। দুঃখিনী পূবান হাওয়া বিলাপের সুর নিয়ে প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে নূরীর নানীর বুকে, গুমরে কাঁদে দুঃখের শ্বাস হয়ে। ইঁদারার পাশে আমগাছের নিচে কবরগুলো ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। জঙ্গলা ঘাসে ভরে গেছে উঠান, শুধু ছাপরার সামনে ঘাসহীন সামান্য একটু জায়গা কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের মতো টিকে আছে উঠানের চিহ্ন হিসেবে। গত কুড়ি বছর ধরে দুঃখের সাগরে সাঁতার কেটে নূরীর নানী এখন প্রায় চলৎশক্তিহীন, নোনাজলের অবিরাম ধারায় ক্ষীণ হয়ে গেছে চোখের দৃষ্টি, তাই প্রাকৃতিক প্রয়োজন না হলে প্রায় সারাদিনই কেটে যায় ঘরের ভিতর। ফজরের আজানের পর পরই নূরীকে বেরিয়ে পরতে হয় গৃহস্থবাড়ির উদ্দেশ্যে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। কোন কোন দিন আবার রাতও এক প্রহর পার হয়ে যায়। ফসল তোলার মৌসুমে সব গৃহস্থবাড়িতেই একই রকম কাজ, সে ‍শিকদারবাড়ি, তালুকদারবাড়ি কিংবা ফরাজীবাড়ি, যে গৃহস্থবাড়িই হোক না কেন; সাত সকালে যেয়ে বাসী চুলার ছাই ফেলা, গোয়াল ঘরের গোবর ফেলা, দু-একদিন পরপর উঠানে গোবর লেপা, ধানের মলন ঝাড়া, ধান উড়ানো, খড় শুকানো, ধান ‍সিদ্ধ-শুকানো করা। এসব করতে করতে প্রায় প্রতিদিনেই সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। কাজ শেষ করেই ঘরে ফেরা হয় না, এরপর আবার অপেক্ষা করতে হয় ভাতের জন্য। যে সব গৃহস্থবাড়িতে মানুষ বেশি সে সব বাড়িতে একটু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়, তারা খেতে বসে কয়েক বৈঠকে, প্রথম বৈঠকে বসে বাড়ির ছোটরা, তারপর বড়রা, সবশেষে শাশুড়ি বা বড় বৌ; বাড়ির বৌ-ঝি, রাখাল-চাকর ও কাজের মানুষেদের নিয়ে খেতে বসেন। নূরী গৃহস্থবাড়িতে খায় না, সে ভাত নিয়ে যায়, বাড়িতে যেয়ে নানীকে সাথে নিয়ে খেতে বসে। নূরীকে অপেক্ষা করতে হয় সবার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদিও  তৃতীয় বৈঠকে সবার সাথে তার বাসনেও ভাত-তরকারি দেওয়া হয়ে যায় কিন্তু রাখাল-চাকরদের খাওয়া শেষ না হলে তাকে এগিয়ে দেবে কে? এত রাতে তো আর একা একা যাওয়া যায় না!

সন্ধ্যা-রাত হলে নূরী কারো পরোয়া করে না, সে একাই চলে যায়, কিন্তু যদি এশার আজান হয়ে যায় বা ফরাজীবাড়ির উঁচু কড়ুই গাছে পেঁচা ডাকতে শুরু করে তখন আর একা যেতে সাহস পায় না। সবচেয়ে বেশি ভয় করে গোস্বাইবাড়ির খালি ভিটার কাছে, ভিটার কোনায় মস্তবড় শিমুল গাছ, সারাবছরই গাছের উঁচু ডালগুলোতে শকুনের আনাগোনা থাকে, রাতের বেলা যখন শকুনগুলো ডাকে মনে হয় যেন অন্তিম পথযাত্রী কোন শিশু কান্না করছে! অজানা আশঙ্কায় জান কেঁপে উঠে। এরকম রাত হয়ে গেলে গৃহস্থবাড়ির রাখাল চাকররা সাথে যায় এগিয়ে দিতে। কোন কোন রাতে গৃহকর্তা নিজেও এগিয়ে দিতে যান—নূরী নু যাই, তোরে আমি আইগ্যাইয়া দিয়া আসি আর কামলা ঠিক কইর‌্যা আসি, বলে হারিকেন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরেন গৃহস্থ নিজেই। গৃহকর্তা সাথে গেলে নূরীর ভয় একটু কমই করে, গোস্বাইবাড়ির ভিটার কাছে যেয়ে নূরী যখন বলে—নানা আমার ডর করতেছে! হাতে আগুন আছে না! ডর কিসির! তাড়াতাড়ি পাও চালাইয়্যা আট! গৃহস্থের এই ধমকে কাজ হয়। ভাতের বাসন আঁচলের ভিতর আরেকটু টেনে শক্ত করে ধরে দ্রুতবেগে পা চালাতে থাকে নূরী। ছোটবেলা হতে নূরী তার নানীর কাছে শুনে আসছে—এই শিমুল গাছটা ভালো না। গ্রামের অনেক মুরুব্বি দেখেছে, রাত গভীর হলে শিমুল গাছের ভুতটা একপা খালের এপারে আরেকপা খালের ঐপারে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ‍এখানে একটা খারাপ জ্বিনও থাকে, সে আবার সব সময় বের হয় না। সে বের হয় শুধু অমবশ্যার রাতে, রাতের অন্ধকারের চেয়েও কালো তার রঙ। অবশ্যার রাতে শোঁ শোঁ শব্দ করে বাতাসের বেগে ছুটে চলে গ্রামের এ-মাথা হতে ও-মাথা পর্যন্ত। চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হয়! কেউ সামনে পরলে তার আর রেহাই নেই! হাত-পা অবশ হয়ে সারাজীবন ঘরে পরে থাকতে হবে। এমন কি জবানও বন্ধ হয়ে যেতে পারে! প্রতিদিন গৃহকর্তা এগিয়ে দিতে যেতে পারেন না, অধিকাংশ দিন গৃহস্থবাড়ির রাখাল চাকররাই এগিয়ে দিয়ে আসে। শিমুল গাছের যে ভূত বা জ্বিনটাকে নূরী ভয় পায় তাকে কোনদিন দেখেনি, কিন্তু যে রাতে গৃহস্থবাড়ি হতে কেউ তাকে এগিয়ে দিতে সাথে যায়, এমন প্রায় রাতেই সে গোস্বাইবাড়ির খালি ভিটার কাছে যেয়ে অনুভব করে রোমশ শক্ত হাত তার কাঁধ ছুঁয়ে ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে, একুশ বছর বয়সেও কারো বুকে ঠাঁই না পাওয়া নূরী সে ছোঁয়ায় ইভের মতো নিষিদ্ধ গন্দম ভোগী হয়ে ঘরে ফিরে। 

ধান বা চৈতালী ফসল ঘরে তোলার মৌসুম শেষ হলে নূরীর বাঁধা কাজ শেষ, এরপর শুরু হয় ছুটা কাজ, যখন যে বাড়ি হতে ডাক আসে সে বাড়িতেই কাজ করে। নূরী বসে থাকার মেয়ে না! পাড়া বেড়ানোও তার কাজ! যেদিন কোন বাড়ি হতে ডাক আসে না, সেদিন নিজে থেকেই চলে যায় কোন গৃহস্থবাড়িতে, গৃহস্থ-গিন্নী বা বৌ-ঝিদের হাতের কাজ এগিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে বেশি যায় ফরাজীবাড়ি, এ বাড়ির বড় বৌ মাজেদা নূরীকে খুব মায়া করে, ছোট্ট নূরী যখন ওর নানীর সাথে কাজে আসতো, মাতৃহীন নূরীকে দেখে বড় মায়া হতো, তার নিজের মাতৃহীন ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যেত! এ মায়া ছোট্ট নূরীকে ছুঁয়ে যেত, এখনো সে টান অনুভব করে নূরী, তাই ফরাজীবাড়ি থেকে ডাক আসুক আর নাই আসুক, আষাঢ় শ্রাবণ মাসে যখন কোন গৃহস্থবাড়িতে কাজ থাকে না, তখন সকালে পান্তা খেয়েই নূরী চলে আসে ফরাজীবাড়ি—মামানি কি করব্যান নাগছেন! আমারে খবর দ্যান নাই ক্যা! বলেই ফরাজীবাড়ির বড়বৌ মাজেদার হাত থেকে কাজ টেনে নিয়ে করতে শুরু করে নূরী। ফরাজীবাড়ির বড়বৌ মাজেদার নিজের মেয়ে নাই, নূরীকে না দেখলে মাজেদার পড়ান পোড়ে। আমন ধান ঘরে তোলা হয়ে গেছে তিনমাস হতে চলল, তারপরও মেয়েটার দেখা নাই! মাঝে অবশ্য একবার ডেকে আনা হয়েছিল, পৌষমাসে, ভিজানো পিঠার গুরি কোটার জন্য। সামনে চৈত্রমাস, চেতালী তোলার সময়! নূরীকে না পেলে চলবে কি করে! উঠানে বসে এসব ভাবতে ভাবতে চাল ঝাড়ছে মাজেদা। ‘কিছু হুনছাও না বড়বৌ?’ বলেই পিঁড়ি টেনে পানের ডাবর নিয়ে বসে বাহেরজান। ছেলের বৌ মাজেদার উত্তরের অপেক্ষা না করে বাহেরজান বলতে থাকে—তোমার নিজির প্যাটের ম্যায়া নাই, খালি মাইনষির ম্যায়াগো নিগা দরদ করো! কার নিগ্যা দরদ করো দ্যাহো! ম্যায়াডা কি কাম করছে, ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! চাল ঝাড়তে ঝাড়তেই শাশুড়ির কথায় মনোযোগ দেয় মাজেদা, কিন্তু শাশুড়ির কথার শেষটুকু শুনে থেমে যায় তার হাতের কুলা, বন্ধ হয়ে যায় চাল ঝাড়া।

চৈত্রমাস এখনো শুরু হয়নি কিন্তু এ পাড়ায় বাওকুড়ানি শুরু হয়েছে চৈত্রমাস আসার আগেই! কথার বাওকুড়ানি! ছেলে-বুড়ো সবার মুখে একই কথা। কাজের অবসরে দুজন মানুষ এক জায়গায় হলেও একই প্রসঙ্গ। দূর বায়রা হাটে যেয়ে আরো দূর গাঁয়ের পরিচিত কারো সাথে দেখা হলেও সবার আগে আসবে এই প্রসঙ্গ। লজ্জায় এপাড়ার মুরুব্বিদের বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। এর একটা বিহিত না হলে আশেপাশের গ্রামের মানুষদের আর মুখ দেখানো যাচ্ছে না! এর দায় এপাড়ার সব বড় গৃহস্থদের, নূরী এপাড়ার সব গৃহস্থবাড়িতেই কাজ করে। সন্ধ্যায় পাড়ার সব মুরুব্বি বসেছে ফরাজীবাড়ির কাচারি ঘরে, মাগরিবের পর হতে কথা শুরু হয়েছে; গত বছর নূরী কোন গৃহস্থের বাড়ি কোন মৌসুমে কাজ করেছে, কোন গৃহস্থের বাড়ি অধিক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়, কোন গৃহস্থবাড়ির রাখাল-চাকর রাত্রিবেলা নূরীকে এগিয়ে দিতে যায় অথবা গৃহস্থ নিজেই যায়, ইত্যকার সব আলোচনা। বাগ বিতণ্ডাও হয়েছে খানিকটা। কিন্তু কোন সমাধান হয়নি। অবশেষে পাড়ার সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্য মুরুব্বি নইমুদ্দি শিকদারের কথায় সবাই থেমেছে—‘হুন মিয়ারা, নিজির‌্যা নিজির‌্যা ক্যাদা না ছিটাইয়্যা বিহিতির চিন্তা করো, অবিয়্যাইতা ম্যায়্যাডার প্যাটতো আর এমব্যাই অয় নাই! এই পাড়ার কোন কুত্ত্যাই এই কামডা করছে। নূরীর নানীর কাছে পেইদা পাটাও, তারে কও, হি জিনি বিষ্যুদবার রাইতি তার নাতিনরে নিয়া এহেনে থ্যাহে, তোমরা সবাই থাইহো। নূরী যুদি হাচা কতা কয়; ওর এই সব্বনাশ কিরা করছে, তাইলি তার হাতে ওর বিয়া পড়াইয়্যা দিওয়ার ব্যবস্থা করুন নাগবো। পাড়ার সবাই যদি আমার হাতে একমত থাহো তাইলি আর কতা বাড়ায়্যা কাম নাই, রাইত ম্যালা হইয়্যা গেছে, আর অমত হইলি তাও কইব্যার পার।’ নইমুদ্দিন ফরাজীর কথা শেষ হলে কাচারি ঘরে জুড়ে নেমে আসে শ্মশানের নিরবতা। চিন্তার বলিরেখা স্পষ্ট হয় সবার কপালে। হারিকেনের তামাটে আলোয় প্রবীণ মুখগুলোকে মনে হচ্ছে যেন শত বছরের ধুলো জমা বাকহীন প্রস্তর মূর্তি। পায়ের কাছে নিবু নিবু করে রাখা হারিকেনের দম বাড়িয়ে নৈঃশব্দ্যে ফরাজীবাড়ির কাচারী ত্যাগ করেন সবাই। রাতের আঁধারের চেয়েও বেশি তমশাময় কলঙ্কের কালি। রাতের আঁধারে ঢাকা মুখ হারিকেনের আলোয় চোখ রেখে ঘরের দোয়ারে পৌঁছায় ঠিকই, কিন্তু কলঙ্কের কালিতে ঢাকা মুখ দিনের আলোতেও পথ খুঁজে পায় না।

সেদিন রাতের বৈঠকে নইমুদ্দিন ফরাজীর কথার পর সন্দেহের বিষে নীল হয়ে গেছে পুরো গ্রাম, সম্মানহানির শঙ্কায় সম্ভ্রান্ত গৃহস্থরা যেন বোবা হয়ে গেছে। এক একটা দিন যেন বছর সমান। সন্ধ্যার পর ফরাজীবাড়ির যে কাচারি ঘরে হুক্কা না টানলে এ গ্রামের মানুষের মন জুড়াতো না, সে কাচারী ঘর আজ শব্দহীন আঁতুরঘর। স্বভাবশত মাগরিবের পর কাচারি ঘরে এসে বসে আছেন গৃহকর্তা নইমুদ্দিন ফরাজী, বসে আছেন আনমনা হয়ে, চোখ বন্ধ, কপালের বলিরেখায় চিন্তার ভাঁজ সুস্পষ্ট। তার বাড়িতেও তিনজন জোয়ান রাখাল কাজ করে, বেশি রাত হলে মাঝে মাঝে তারাও নূরীকে এগিয়ে দিতে যায়। ‘মিয়াভাই ঘুমাইছেন’ সমাজের পেয়াদা মজিদের ডাকে চিন্তায় ছেদ পরে নইমুদ্দিন ফরাজীর, পায়ের কাছে জলচৌকি দেখিয়ে বসতে বলেন মজিদকে। ‘আইজতো বুধবার, গ্রামের সবাইরে কইইছাও? নূরীর নানী নূরীরে নিয়্যা আসপোতো?’ নইমুদ্দিন ফরাজীর কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে পেয়াদা আব্দুল মজিদ। পাড়ার সম্মান! দেহা যাক কি হয়, রাইত হইয়্যা গেছে বাড়ি যাও, বলে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে আবার চোখ বন্ধ করেন নইমুদ্দিন ফরাজী। উৎকণ্ঠার রাত! কে জানে আগামীকাল এমন সন্ধ্যায় নূরী কার নাম বলবে! কুলটার কালি কার কপালে লেপে কলঙ্কমুক্ত হবে পাড়া!

ফাল্গুনের শেষ দিক, শীত পুরোপুরি চলে গেলেও শেষরাতের দিকে গায়ে কাঁথা টেনে নিতে হয়, মাকড়সার জালে এখনো কুয়াশা জমে, তবে খুব ভোরে। খেজুরগাছের নলে বসে বুলবুলিদের রস খাওয়ার দিনও প্রায় শেষের পথে, তবুও এ পাড়ার হারান গাছি এখনো রসের আশায় গাছে হাড়ি বাঁধে। খুব ভোরে বুলবুলি বা ফিঙ্গে রসে মুখ দেবার আগেই গাছে উঠে হাড়ি নামাতে।

উঠান জুড়ে গাঢ় নীল আলো, তার মধ্যে সোনারঙের পাড় দেওয়া সাদা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে নূরী। মায়াকাড়া চেহারার ছোট্ট এক শিশু দাঁড়িয়ে আছে নূরীর আঁচল ধরে। নীল রঙের রেশমী চুড়ির মতো এমন গাঢ় আর স্বচ্ছ নীল আলো জীবনে কখনো দেখেনি নূরীর নানী! কিযে সুন্দর লাগছে নূরীকে! পায়ে আলতা! হাতে মেহেদি! আধেক ঘোমটা খোলা মুখ! কাজল আঁকা চোখ! কোমর ছাপিয়ে নামা ঢেউ খেলানো চুলের গোছা বাতাসে উড়ছে! কালো নূরীকে আজ পরীর মতো লাগছে! পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা! চোখ ছল্ ছল্ করছে! ‘আয় বইন কাছে আয়! যাওয়ার সময় কান্তে নাই!’ বলে নূরীকে আদর করে গায়ে মাথায় হাত বুলাবার জন্য নূরীর নানী যত এগিয়ে যায়, নূরী তত পিছন দিকে যেত থাকে, পেছনে যেতে যেতে ইঁদারার পাশে আমগাছের নিচে ঘন জঙ্গলে ডাকা একুশ বছরের পুরনো কবরের কাছে চলে যায়! চমকে উঠে নূরীর নানী! ‘ওহেনে য্যাইসনা বইন! ওহেনে কব্বর!’ হারান গাছির চিৎকার চেচাঁমেচিতে ঘুম ভাঙ্গে নূরীর নানীর। বুক ধরফর করে উঠে! কোন রকমে অর্ধেক শরীর টেনে তুলে মাথার কাছে বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে শোনার চেষ্টা করে কি হয়েছে। কেউ একজন চিৎকার করে বলছে—তাড়াতাড়ি গাছে উঠো! দড়ি কাইটা নিচে নামাও! মনে অয় বাঁইচা আছে! কেউ বলছে বাঁইচা নাই! দ্যাহো না জিব্বা বাইরিয়্যা গেছে! তাড়াতাড়ি নইমুদ্দীন ফরাজীরে খবর দ্যাও। কেউ একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত বলে যাচ্ছে নূরীর নানী তাড়াতাড়ি আসো তোমার নূরী ফাঁস নিছে। কারো কোন কথাই যেন নূরীর নানী শুনতে পাচ্ছে না, ক্ষীণ আলোর চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইঁদারার পাশে আমগাছের নিচে ঘন জঙ্গলে ঢাকা পুরনো কবরের দিকে, সোনারঙের পাড় দেওয়া সাদা শাড়ি পড়া নূরী ফুটফুটে শিশুটিকে নিয়ে এখনো যেন ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে!