আনন্দযাত্রা
|| ১ ||
আরও মিনিট পনেরো পর প্রতিষ্ঠানটির সর্বময় কর্তার পদার্পণ ঘটলে ব্যানার হাতে অপেক্ষারত জনতার মাঝে একধরনের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আর মিনিট বিশেকের মধ্যেই এই অধিবেশনের সমাপ্তি কল্পনা করে কেউ কেউ হাঁফ ছাড়ে। কর্তার পেছনে থাকা নেতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হাতড়ে-পাতড়েও এই শোভাযাত্রায় স্লোগান দেওয়ার মতো কোনো উপযুক্ত বাক্য খুঁজে না পেয়ে তাদের সেই চিরপরিচিত ও বহুলব্যবহৃত স্লোগানটিই ধরে। কিন্তু আজকের শোভাযাত্রার বিষয়ের সাথে এটি বেমানান বলে জনতার আগ্রহ দেখা যায় না তেমন, অবশ্য অতিরিক্ত গরম আর পানির অভাবেও তাদের কণ্ঠ জোর পায় না। তবে অতি উৎসাহীরা প্যাঁ-পুঁ শব্দে ভুভুজেলা বাজানো শুরু করেছে—আনন্দ শোভাযাত্রা বলে কথা! একেবারে সামনে থাকা ব্যান্ডপার্টি ইতিমধ্যেই ট্রাম্পেটে সুর তুলেছে, ‘ও খায়রুন লো, তোর লম্বা মাথার কেশ।’ উন্নয়নশীলের দেশের সাথে খায়রুন সুন্দরীর লম্বা চুলের মিল খুঁজতে ব্যর্থ সাবিনা বাঁ-পাশের সবুজ বনে চোখ রাখে। বন ঘুরে দৃষ্টি তার নিবদ্ধ হয় সামনের রাস্তায়। মাস ছয়েক আগের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে রাস্তার পাশে লাগানো হয়েছিল মেহগনি আর শিশু গাছ। বেড়া দেওয়া হয়নি বলে প্রথম দুই দিনেই গরুছাগলে সব খেয়ে সাফা করে দিয়েছে। এ-নিয়ে এলাকার সাংসদের হম্বিতম্বিতে ইউপি চেয়ারম্যান মিনমিন করে জানিয়েছিল বাজেটের টাকা গাছের চাড়া কিনতেই শেষ, বেড়ার জন্য যদি আবার বরাদ্দ পাওয়া যেত...! বেড়ার জন্যও বরাদ্দ পাওয়া গেছিল পরে, মাসখানেক আগেই গরু-ছাগলের উদরপূর্তি হয়ে যাওয়ার পরও শিশু আর মেহগনির ভগ্নাবশেষকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কঞ্চির বেড়া দিয়ে। গাছ নেই বলেই বাঁশ কম লেগেছে, খরচও নিশ্চয় কম হয়েছে। রাস্তার ডানদিকে ভূতের বাড়ি হয়ে হুমড়ি খেয়ে-পরা বাঁশঝাড়গুলো দেখে সাবিনার মনে হয় এর মালিকের কাছে চাইলে অনায়াসেই খান বিশেক বাঁশ পাওয়া যেত বেড়া বানানোর জন্য। এখন অবশ্য সরকারি টাকায় করা ঘের সরকারি গাছেরই কবর ঘেরাও করেছে। এলাকার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পেরে এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে উন্নয়নের তবলায় চাটি মারছে…
|| ২ ||
‘কোন বেকুবের বুদ্ধি এইটা? গেইট বিশ ফিট হইলে বিলবোর্ডও বিশ ফিট হইতে হইব এই আবাল মার্কা জ্ঞানী কেডায়?’
‘শফিক স্যার কইছে লেখা বেশি, বোর্ড লাম্বা না করলে লেখা আটতো না।’ গালি খেয়ে মিনমিনে গলায় শব্দ তোলে ডাটা প্রসেসর জয়নাল।
‘লেখার ফন্ট আরেকটু ছোট করলেই এর তিন ডবল লেখা আটতো এর অর্ধেক সাইজে। অখন এত বড় বিলবোর্ড-এর লেখা মাইনষে পড়ব ক্যামনে, মই বাইয়া?’ রাগের চোটে গলার রগ ফেটে যেতে চায় ফিরোজের। ফিরোজ ফার্মেসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। অনেক দায়িত্ব তার। এই শোভাযাত্রার আয়োজনের ভার তাই তার উপরেই বর্তেছে। এদিকে জয়নাল বিলবোর্ডের যে সাইজ করেছে-- যেন বারো হাত কাকুরের তেরো হাত বিচি! ফিরোজের ক্ষোভ অতি যৌক্তিক। কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা কেউ বিলবোর্ড-এর এমন আকার মেনে নেবে না। সাধারণভাবে হিসেব করলে এই সাইজটা দারুণ, কিন্তু এই সাইজের বিলবোর্ডের লেখা পড়তে এর সামনে অন্তত তিরিশ ফুট জায়গা রাখা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানফটকের পাশে যেখানে এটাকে সেট করা হয়েছে তার সামনে দশ ফুট জায়গাও নেই। পুরো লেখা পড়তে হলে যেতে হবে রাস্তার ওপাড়ে, সেখানে গেলেও চলবে না, উঠতে হবে সেখানে থাকা মামা হোটেলের ছাদে। আর সামনে থেকে বকের মতো ঘাড় লম্বা করে এই ন্যারেটিভ লিস্টি পড়ার ধৈর্য ক-জনের হয় এই নিয়ে বিরক্ত হয় ফিরোজ। অবশ্য একটু পরই এই ভেবে হালকা হয়, আজকের দৈনিক কাগজেই লেখাগুলো গৌরচন্দ্রিকা আর উপসংহারসহ সবিস্তারে প্রকাশিত, আগ্রহীরা সেখান থেকেই পড়তে পারে। বিলবোর্ড ছাপানো কর্তব্য আর আড়ম্বরেরই অংশ, আদতে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়জন আর এটি পড়তে যাবে, এই ভেবে কিছুটা হালকা হয় ফিরোজ। সেই সাথে শান্তি পায় এই ভেবে যে সাদা প্লাস্টিকে লাল আর নীল রঙের বড়বড় অক্ষরগুলোর চাকচিক্য যেন উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির খবরই দিয়ে যাচ্ছে। সহ-সভাপতি শফিকের উপরও তো কম চাপ দেওয়া হয়নি। এক বিকেলের নোটিশে সব ব্যবস্থা তো তাকেই করতে হয়েছে। চিঠিটা নাকি পড়েছিল রেজিস্ট্রারের টেবিলেই। চিঠিটা সে দেখেনি কিন্তু শুনেছে সেদিনই সেটা এসেছে, স্বল্পউন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম কাটা গিয়ে উন্নয়নশীল দেশের নামের কাতারে গেছে, এই আনন্দে যেন সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আনন্দমিছিল করা হয় সেইরকম নির্দেশই ছিল মন্ত্রণালয়ের সিল মারা সেই পত্রে। আনন্দ মিছিলও যে এত ঝামেলার হয় সেটি প্রথম টের পেয়েছিল সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেবার প্রথম মন্ত্রী এলেন। ছোটবেলায় ফুটবল খেলায় জয়ী হলে কিংবা গাঁয়ে বেড়াতে এলে সারা বিকেল ভোট গণনা শেষে যখন টের পাওয়া যেত ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনে বড় চাচার কলসি ভোটের জোয়ারে উপচে উঠছে এবং সেই আনন্দে যখন পুরো গাঁয়ের মানুষ কোনো চিঠিপত্তর ছাড়াই কী এক অজানা সংকেতের ইশারায় ঠিক একইসময়ে হৈ হৈ করে জমায়েত হয়েছে। জানা সংকেত অবশ্য থাকতোই—ঢাক-ঢোলের শব্দ আর সমবেত জনতার জয়োল্লাস। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে আসা গতদিনের চিঠি যে-খবর দিয়েছিল সেটি আনন্দের হলেও আগের মতো পুলক জাগায়নি ফিরোজের মনে। বাকিদের বেলাতেও তার মতো কাণ্ডই ঘটতে পারে ভেবে আগেই অনুষদ আর হলগুলোর মাধ্যমে জোর দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের।
টানানো বিলবোর্ড-এর সামনে বেহায়ার মতো ঝুলে আছে কিছু দড়ি। সেই নিয়ে আরেকপ্রস্থ গালাগালি করে ফিরোজ প্রক্টর অফিসে ঢুঁ মারে, ভিসি স্যারকে আনতে যেতে হবে। খাড়া রোদে জনতা দাঁড়িয়ে আছে মেলা সময় ধরে, স্যার এলেই মিছিল শুরু হবে।
|| ৩ ||
সাবিনার অনুষদ যে জায়গায় অপেক্ষারত সেটি সূর্যের সরাসরি ভালোবাসায় মাখামাখি। মাথার মাঝখানটাকে গলিত সূর্যের উত্তাপে দ্বিখণ্ডিত হতে টের পেতে দেখে সাবিনা ‘সোনাঝরা দিন’ কথাটির বাস্তব মর্ম বোঝে। ঘাড়ের কাছে জমা হওয়া চিটচিটে ঘামে গলিত সোনার স্পর্শের স্বাদ পায় সে, তবে একটু পরই এই গরমেই এক ধরনের স্বস্তি মেলে। শীতল ঘামে কেমন প্রশান্তিও লাগে, অবশ্য মাথার উপর ফুটতে থাকা সূর্য তার গনগনে কিরণের ঝলকানিতে মুহূর্ত পরেই শরীরটাকে আবার ব্লকব্লাস্টার হিট করে দিচ্ছে! সাবিনার পাশে দাঁড়ানো দশম ব্যাচের মিতুল গরমে সেদ্ধ হয়েও তার আহ্লাদীভঙ্গি বজায় রেখে বলে ওঠে, ‘ম্যাম, এই রোদ্রে আর দশ মিনিট দাঁড়ালেই দেখবেন এইটা আনন্দের নয় লাশের মিছিল হয়ে গেছে।’
‘বালাই ষাট!’ ধমকে ওঠে সাবিনা। কিন্তু প্রকৃতির যে রুদ্র রূপ! এমন গরমেই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
‘দারুণ অগ্নিবাণে রে
হৃদয় তৃষায় হানে রে॥
রজনী নিদ্রাহীন দীর্ঘ দগ্ধ দিন
আরাম নাহি যে জানে রে’
দু-একজন আজ সেন্সলেস না হলেই হলো, এর চেয়ে অর্ধেক রোদে অর্থমন্ত্রী আসার দিনে সারবদ্ধ দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল ম্যাথের একটা মেয়ে। সেদিনও ‘মন্ত্রী এই এলেন, আর দশ মিনিট’ এমন আশ্বাসবাণী শুনতে শুনতে ঠা ঠা রোদে তারা দাঁড়িয়েছিল পাক্কা এক ঘণ্টা।
ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে সবে এক ঢোঁক গিলেছে সাবিনা, অমনি তাদের সারিতে পানি-পানি করে হল্লা ওঠে। পাশের মিতুলের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার হাত থেকে বোতলটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় সহকর্মী রাজন। ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেকটা সাবার করে সেটি ফেরাতে গেলে তার হাত থেকে সেটি লুফে নেয় আরেক সহকর্মী আঞ্জুমান। বোতলের আশা ছেড়ে দেয় সাবিনা। অভিজ্ঞতায় জেনেছে সে, প্রচণ্ড গরম ও অনেক মানুষের ভিড়ে বের করা পানির বোতল আর ফিরে পাওয়া যায় না। এবং মানুষ এই গরমে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে জেনেও সাথে পানি রাখে না, তারপর পানিপানি করে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনকে কারবালা বানিয়ে ফেললেও পরেরবার আর তাদের হুঁশ হয় না। তিনটা জিনিস সবসময় ব্যাগে রাখে সাবিনা, ছাতা, পানির বোতল আর সানগ্লাস। তিনটাই গরম উপশমকারী। বোতলটা অবশ্য শেষ অব্দি পাওয়া গেল, তবে সেখানে আর এক ফোঁটাও পানি নাই। তৃষ্ণার্ত মিতুলকে দেখে মায়া লাগে তার—থাকলে ওকে এক ঢোঁক পানি দেওয়া যেত। খালি বোতল ব্যাগে ঢোকাতে-ঢোকাতে সচেতন হয় সাবিনা; ভিসি স্যারকে প্রক্টরদের প্রটোকল আর বিভিন্ন সমিতি আর শিক্ষকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছে। কলাভবন থেকে শুরু করে রাজুর ক্যান্টিন হয়ে চারুকলা পেড়িয়ে, সেন্ট্রাল ফিল্ড দাপিয়ে প্রায় বিশ মিনিট তারা আনন্দ মিছিল করেছে। এই গরমে শিক্ষক, কর্মকর্তাই কাহিল নয় শুধু, ছাত্রছাত্রীরাও চিমসে গেছে। মিছিল শেষে তারা সকলেই মিলিত হয়েছে কৃষ্ণচূড়াতলায়। উপাচার্য মহোদয়কে মাঝে রেখে জনতা অর্ধচন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বহু পুরাতন এই প্রতিষ্ঠানের ঠাঁটবাটের গৌরবকে হাজারগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর জারুলের ঔজ্জ্বল্য—যদিও এখন এই ফুল ফোটার দিন নয়, তবুও সারা পৃথিবীর পরিবর্তিত আবহাওয়ার কারণে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো নির্লজ্জের মতো ফুল ফুটিয়ে রেখেছে। বেহায়া কিন্তু রঙিন ফুলগুলোর নিচে বড্ড ম্লান লাগে জনতাকে। এবার উপাচার্য আজকের শোভাযাত্রার মর্মার্থ ব্যাখ্যা করে সবাইকে এই শোভাযাত্রাকে আনন্দ ও উৎসবমুখর করে তোলার জন্য ধন্যবাদ জানাবেন। এই ধন্যবাদজ্ঞাপন উপলক্ষ্যে পাশের মাহিন ডেকোরেটর থেকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য দুটি স্পিকারও ভাড়া করে আনা হয়েছে। সঞ্চালক মিনহাজ উদ্দিন অল্প কথায় অতীতের স্বল্পোন্নত বাংলাদেশের অবস্থার সাথে বর্তমানের উন্নয়নশীল অবস্থার পার্থক্য তুলে ধরলেও জনতার ছটফটানি কমে না। দশটার র্যালি শুরু হয়েছে বারোটায়, এখন বাজে একটা। জনতার চোখে এখন উন্নতির নিদর্শন কেবল ঠান্ডা খাবার পানি, মাথার উপর ছাদ আর ঠান্ডা বাতাসে স্থির হয়ে বসার আনন্দ। ফিরোজ আর সাবিনা পাশাপাশি দাঁড়ানো এখন। সাবিনার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। অতিরিক্ত গরম কিংবা রোদ ওর সহ্য হয় না, মাথা অলরেডি এলার্ম দিচ্ছে, তার কাছে অবশ্য ছাতা আছে কিন্তু এত মান্যগণ্যের ভিড়ে সেটা খোলার সাহস পায় না সে। সাবিনার উশখুশ ভাব দেখে ফিরোজ কপালের ঘাম কাচাতে-কাচাতে বলে, ‘আরেকটু কষ্ট করো। এরপরই নিজের রুমে গিয়ে তুমুল জোরে ফ্যান ছেড়ে দিয়ো!’ পাশের মাইনুল নামের আরেক সহকর্মী টিপ্পনী কাটল, ‘ফিরোজ স্যার যা বলেন, ফ্যান ঠিক আছে কি না আগে জিগ্যেস করেন।’ সাবিনার সপ্রশ্ন ভঙ্গির উত্তরে এইবার মাইনুল বলে, ‘আমার রুমের ফ্যান নষ্ট। একমাস আগে ইঞ্জিনিয়ার দপ্তরে জানানো হয়েছে।’
‘হুম, ওদের তো আঠারো মাসে বছর’ উত্তরটা শেষ করে দেয় আঞ্জুমান। তাদের কথার হালকা গুঞ্জনে পাশের আরেক সহকর্মী ভ্রু কুঁচকে তাকালে ওরা নিজেরা নিজের মুখের সামনে আঙুল তুলে চুপ থাকার ভঙ্গি করে, তারপর নিঃশব্দে হেসে ফেলে একসাথে। ওদিকে শেষ হয়েছে মিনহাজের তুলনামূলক বয়ান। সে এবার সমাপনী বক্তব্যের জন্য মাইক্রোফোন তুলে দেয় বড়কর্তার হাতে। একটা বেজে দশ মিনিট, মাথাব্যথা বাড়ছে। ঠান্ডা বাতাসে বসে এক গ্লাস ঠান্ডার পানির পর এক কাপ চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে, ভাবতে ভাবতে সাবিনা তার বসার জায়গাটার কথা কল্পনা করে আনন্দিত হয়। এই জঙ্গম আর দশ মিনিটেই শেষ হবে জেনে তার ভালো লাগে।
|| ৪ ||
সামনে দাঁড়ানো বিশাল জনস্রোতে বুক ভরে যায় উপাচার্য সাব্বির এম হাসানের। তিনি বক্তৃতা দিতে ভালোবাসেন। আজ অবশ্য রৌদ্রের চাপে তার নিজেরও বেহাল দশা! এত গরম থেকে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে অবস্থান নিলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে এই আশঙ্কা থাকলেও, তার মনে এসির হাওয়া পরশ বুলিয়ে যায়। তিনি মনস্থির করলেন, বক্তৃতা যথাসম্ভব ছোট করবেন। মাইক্রোফোন হাতে নিতে নিতে মনেমনে ঝালাই করে নেন একটু আগে দপ্তরে বসে সাজানো কথাগুলোর। স্বল্পোন্নত দেশ কী, আর উন্নয়নশীল দেশ কী সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে আজ বুঝিয়ে দিতে হবে। আমরা যে আজ চীন, জাপান, রাশিয়ার সমকক্ষ এ-কথাগুলো তার বাকস্ফূর্তিতে ছাত্র-শিক্ষককে কেমন প্রেরণা দেবে তা ভেবে তিনি নির্ভেজাল পুলক অনুভব করেন। উদ্দীপণার নায়াগ্রাকে হাজার হাজার স্ফূরণের রূপ দিতে তিনি মাইক্রোফোন হাতে নেন। ফুঁ দিয়ে দেখেন ঠিক আছে কি না, মাত্র মিনহাজ কথা বলেছে সে নিশ্চয় সুইচ অফ করেনি, নাহ সুইচ অন আছে। সাউন্ড পরিষ্কার। তার তেজোদ্দীপ্ত বাকভঙ্গিমায় সেটি বিশেষ জোর পায়। সাব্বির সাহেব প্রথমেই ধন্যবাদ জানান সঞ্চালককে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দকে যারা এই রোদে এত কষ্ট স্বীকার করে এই আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছে। তারপর তিনি তার ক্যারিশমাটিক বাকভঙ্গিমায় স্বল্পোন্নত দেশের বর্ণনা দিতে শুরু করলে তার বাকস্ফূর্তি হঠাৎ নাই হয়ে যায়। সাব্বির সাহেব বলে যাচ্ছেন, কিন্তু জনতা উশখুশ করছে—‘কথা শোনা যাচ্ছে না’, ফিশফাশ জানায় জনতা। ‘স্পিকারে কী সমস্যা’, মাহিনের দোকানের চ্যাংড়া ছোকরাটা তো সামনেই আছে, সে কেন চেক দিচ্ছে না—ইত্যাকার বাক্যগুলো ধীরে ধীরে চড়তে থাকে। সাব্বির সাহেব এইবার মাইক্রোফোনের শব্দহীনতা টের পান। মাহিনের ছোকরাটি অবশ্য এর মধ্যেই তার কাজ শুরু করে দিতে রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙে ঢুকে গেছে। সে বের হল প্রায় সাথে সাথেই, হারামজাদাটা এমন ভঙ্গিতে সংবাদটা দিল যেন সেটি খুব আনন্দের! কেলানো দাঁতের ফাঁক দিয়ে উচ্চারিত তার ‘কারেন গেসে গা’ শব্দদুটির নিঃসরণে সমবেত জনতার মাঝে এইবার নৈরাশ্যের সুর ওঠে। সেটিতে উপাচার্য মহোদয়ের বক্তৃতা শুনতে না পারার দুঃখে, না ফেকাল্টিতে ফিরে গিয়ে ফ্যানের তলে বসতে না পারার কষ্টে তা অবশ্য বোঝা যায় না।
হা হা, এতো বেঙ্গাত্যক একটা গল্প এইভাবেও শেষ করা যায়! দারুণ হয়েছে।
সাহেদ
নভেম্বর ১৫, ২০২৪ ২৩:২৮