কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!

অ+ অ-

 

আচ্ছা, ধরো, আমি যদি কারও সঙ্গে প্রেম করি, তোমার কেমন লাগবে? গোমড়ামুখো লেখক স্বামীর কাছে সাহানা চৌধুরী কথাটা জানতে চাইলেন।

করো প্রেম। আমার আবার কেমন লাগবে? কিছুই লাগবে না আমার। স্বামী উত্তর দিলেন।

বিছানায় গেলে? সাহানা আবারও প্রশ্ন করলেন।

তুমি যদি স্বামী থাকার পরও অন্যের সঙ্গে বিছানায় যাও, সেটাতে আমার কি যায় আসে বলো? আমি তো এই অন্যায় করিনি। তুমি যদি এমন অন্যায় করে বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত থাক, ভালো থাক, তাহলে আমার সমস্যা কোথায়? এটা তো আমার বিষয় না, এটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যক্তিগত বিষয়।

তোমার খারাপ লাগবে না?

নাহ, আমার খারাপ লাগবে কেন? স্বামীর নির্লিপ্ত উত্তর, অন্যায়টা তো আমি করছি না, তুমি করছ। খারাপ লাগলে তোমার লাগা উচিৎ।

আমার সঙ্গে থাকতে পারবে তুমি?

তোমার সঙ্গে থাকতে না পারার কি আছে!

পাঠক, আপনারা হয়তো নিশ্চিত হয়েছেন, সাহানার স্বামী মাতাল অবস্থায় কথাগুলো বলছেন অথবা তার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে।

নাহ, পাঠক, আপনাদের ধারণা পুরেপুরি ভুল। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় কথাগুলো বলছেন। আর হ্যাঁ, তিনি জাত লেখক হলেও জীবনে কোনদিন এক ফোঁটা মদও স্পর্শ করেননি।

এখন নিশ্চয় আপনারা আমার দিকে তেড়ে আসছেন, আমিই মাতাল হয়ে এমন উদ্ভট আর বানোয়াট গল্প বলতে শুরু করেছি বলে। পাঠক, শুনুন, আমার দুঃখের কথা শুনুন, আমি লেখক হলেও মদ আমার গলা দিয়ে নামে না। লেখক সমাজে একটু জাতে ওঠার জন্য কতই না চেষ্টা করেছি মদ গেলার! কিন্তু পারিনি! মদ মুখে নিলে মনে হয় আগুনের কুণ্ড আমার মুখে ঢুকেছে। আর গন্ধ সে আর কি বলব! হলহল করে বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দেই। পেটে দূরে থাক, মদকে গলায় ঢুকাতে পারিনি কোনদিন!

আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, গল্পটি কিন্তু আমি বানিয়ে বলছি না। দাম্পত্য জীবনের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে না এমন উদ্ভট বিষয় নিয়ে গল্প বানানোর সাধ্য আমার নেই। দাম্পত্য জীবনের এমন সংজ্ঞাহীন কিন্তু একদম সত্য কাহিনীটি আমি আমার বন্ধু সাফিনের কাছে শুনেছি। সাফিন, সাহানা চৌধুরীর বড় নাতি। ছেলেবেলা থেকে সাফিন দাদির কাছেই বড় হয়েছে। এমন না যে সাফিনের মা, বাবা নেই। মা, বাবা আছেন। সবাই এক বাড়িতে একসঙ্গেই থাকেন। তবে দাদিই সাফিনের মা, দাদিই তার বাবা, দাদি তার বন্ধু, দাদি তার সব, সবকিছু।

একদিন সন্ধ্যায় আষাঢ়ের থমথমে মেঘের মতো মুখ করে সাফিন এলো আমাদের বাসায়। আমাকে জানাল, জানিস, দাদি আমাদের সঙ্গে থাকতে চাচ্ছে না, বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চায়।

কথাটা শুনে আমি থ বনে গেলাম!

আমরা অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু কোনভাবেই শুনছে না। যাবেই বলে দাদি গোঁ ধরে আছে। সাফিনের গলা ধরে এলো।

কি আশ্চর্য কথা! একটা মানুষ ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনি নিয়ে এমন ভরা সংসার ত্যাগ করে কেন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চাইছেন! সাফিন আমার খুব ভালো বন্ধু, একদম ছেলেবেলা থেকে। ওর দাদির সঙ্গে আমারও বেশ খাতির। সাফিনরা তো দাদিকে কখনও কোন অবহেলা করে না। ওর বাবা, চাচা আর ফুফু মিলে জায়গা কিনে নিজেরা বাড়ি বানিয়েছেন। সেখানে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে, সবাই নিজেদের পরিবার নিয়ে থাকেন। পরিবারের প্রথম নাতি সাফিনের টানেই ওর দাদি ওদের ফ্ল্যাটেই থাকেন। প্রতিবছর ওদের বিশাল পরিবারের সবাই একসঙ্গে দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানেই যাক না কেন দাদিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। কোন কারণে দাদি যদি না যায়, সেই ট্যুরে সাফিন আর যায় না। কেউ তো অবহেলা করে না তাঁকে। আর সাফিন এখন বিশাল চাকুরি করে। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় পুরো পরিবারে ওর বেশ কর্তৃত্ব। ওর এত আদরের দাদির সামান্য অবহেলা সে সহ্য করবে না। প্রয়োজনে ও দাদিকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে। আমি ভেবে কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না। বিষয়টা আমার কাছে খুবই গোলমেলে লাগছে। তবে আমার বিশ্বাস, দাদির জেদের কাছে অন্যরা হার মানলেও সাফিন কোনভাবেই হার মানবে না। কোনভাবেই সাফিন ওর দাদিকে যেতে দেবে না বৃদ্ধাশ্রমে। আর সবার বাধা অতিক্রম করে, বিশেষ করে সাফিন রাজি না হলে ওর দাদি কোনভাবেই যেতে পারবে না। তাঁর তো বেশ বয়স হয়েছে, গতবছর সত্তরতম জন্মদিন বেশ ধুমধামের সঙ্গেই আমরা পালন করলাম। এই বয়সে তিনি তো আর একা একা বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন না। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের সাহায্য ছাড়া তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি এমন একটি জেদ করছেন, যে জেদ পৃথিবীর কোন সুসন্তানের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

একদিন সাফিন এলো, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, নীড় হারা পাখির মতো ওর চোখ দুটি অসহায়। দেয়ালের দিকে সর্বশান্ত চোখ দুটি মেলে উদাস গলায় বলল, সবার বাধা উপেক্ষা করে আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে দাদিকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি।

যে সাফিন দাদি না গেলে, দাদিকে ছাড়া আনন্দ করবে না বলে দেশ ও দেশের বাইরে কোথাও পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে যায় না, সেই সাফিন নিজে উদ্যোগী হয়ে দাদিকে বৃদ্ধাশ্রমের মতো জায়গায় রেখে এলো! আমি ওর দিকে তেড়ে গেলাম, শালা, দাদির সঙ্গে সঙ্গে তোরও কি মাথাটা খারাপ হয়েছে!

সাফিন এবার নড়েচড়ে বসল, ওর চোখের দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে দূরে কোথাও যেন হারিয়ে গেল। আনমনে গলায় বলতে শুরু করল, তুই তো জানিস, নিঃস্বার্থভাবে কাউকে ভালোবাসলে, তার ভালো লাগাটা, তার চাওয়া-পাওয়াটাই একজনের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে। আমার চাওয়া নয়, দাদির চাওয়াটাই আমার কাছে মূখ্য।

হাঁদারাম! এমন সুন্দর পারিবারিক বন্ধন ছেড়ে সুস্থ মাথায় কেউ কোনদিন বৃদ্ধাশ্রমের মতো জায়গায় যেতে চায়! বৃদ্ধ বয়সে এসে তোর দাদির মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে এই সহজ বিষয়টা বুঝতে পারলি না! এই বয়সে এসে এমন হতেই পারে। দাদিকে মানসিক ডাক্তারের কাছে না নিয়ে যেয়ে তুই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলি! বোকার হদ্দ কোথাকার!

সাফিন এবার আমার দিকে স্থির চোখে তাকাল, ওর চোখের দৃষ্টি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। বলল, দাদির মাথায় কোন গোলমাল দেখা দেয়নি। দাদি একদম সুস্থ। এই বয়সে এসেও তার মাথাটা একদম একশত ভাগ ঠিকঠাক আছে। তুই তো লেখক, আমি তোকে দাদির জীবনের পুরো কাহিনীটি বলছি, তুই সাজিয়ে গুছিয়ে গল্পটি লেখ। কিন্তু শর্ত একটাই আমার আসল নাম ব্যবহার করতে পারবি না। গল্প লেখার জন্য সারাক্ষণ প্লট খুঁজতে কেমন মরিয়া হয়ে ছুটতে দেখি তোকে। আমি তোর ছেলেবেলার বন্ধু, আমি যদি তোকে একটা গল্পের প্লট দিতে পারি তাহলে আমার খুব ভালো লাগবে। আমার বেদনাকে নিয়ে সেই গল্পটা হলেও তোকে একটা গল্পের প্লট দিতে পেরেছি, এটা ভেবে শান্তি পাব!  

সাফিনের মুখ থেকে শোনা ওর দাদির জীবনের সত্য ঘটনাটি আমি আপনাদেরকে সাজিয়ে গুছিয়ে গল্প আকারে বলছি।

 

||  ||

সাহানা চৌধুরী, সারা জীবন যিনি একলা হাতে তার সংসারের হাল ধরে সংসার নামক বিশাল সমুদ্রটার বড় বড় ঢেউ সামলিয়ে তীরে এসে পৌঁছেছেন। অনেক বড় বড় ঢেউ এসে যখন তাকে ডুবিয়ে নিতে চাইত তখনও তিনি সেই সংসারের হাল ছাড়েননি, বরং শক্ত হাতে সেইসব ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করেছেন। এখন সব ঝড় ঝাপটা সামলিয়ে তীরে পৌঁছে গেছেন। দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, এক মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আমেরিকায় স্কলারশিপ পেয়ে ডক্টরেট করেছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। এই দিনটি দেখার জন্য, এই দিনের সুখ উপভোগ করার জন্য তিনি এতদিন একা হাতে প্রাণপন লড়াই করেছেন। আজ  তীরে এসে নিজ হাতে গড়া সুখের নীড় ছেড়ে কেন তিনি চলে যেতে চাচ্ছেন!

জামান সাহেব, সাহানা চৌধুরীর স্বামীর নেশা লেখালেখি করা। পেশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকতার বাইরে যেটুকু সময় পান সবটুকু লেখালেখির পেছনে ব্যয় করেন। সাহানা চৌধুরী একা হাতেই সংসার আর বাচ্চাদের সামলান। সাহানা ব্যাংকে চাকরি করেন। সাংসারে কে এল, কে গেল, কোন খোঁজ জানেন না বা নেন না জামান সাহেব। একটা উদাহরণ দিলে আপনারা সংসারে জামান সাহেবের ভুমিকা সম্পর্কে আরও ক্লিয়ার ধারণা পাবেন। তার ছেলেমেয়ে কোন ক্লাসে পড়ছে সেটা তাকে জিজ্ঞেস করলে কোনদিনও বলতে পারবেন না। তার মানে তিনি যে কোনদিন শোনেননি, তা নয়। শুনেছেন, কিন্তু সংসার ছেলেমেয়ে তার আগ্রহের বিষয় নয়, এজন্য এসব তার মাথায় থাকে না। তার মাথায় শুধু লেখার প্লট ছাড়া আর কিচ্ছু থাকে না। স্বভাবে তিনি গুরুগম্ভীর। লেখক, আবার গুরুগম্ভীর। বোঝেন অবস্থা। সাহানা চৌধুরীর সঙ্গে সারাদিনে দু-একটা কথার বেশি হয় না। রোমান্স বা প্রেম জিনিসটা তাদের দাম্পত্য জীবনে কখনই ছিল না। এখনও নেই। এক বিছানায় শোয়ার কারণে দুটি শরীর একসঙ্গে মিলিত হয়। আপনাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে, তাহলে সাহানা চৌধুরী স্বামীকে কি ভালোবাসেন না? অবশ্যই ভালোবাসেন। সাহানা চৌধুরী স্বামীকে ভালোবাসেন, তার যত্ন-আত্মীর কোন কমতি করেন না। বরং অন্য স্ত্রীদের তুলনায় অনেক বেশিই যত্ন-আত্মি করেন বলা যায়। শিক্ষকতার বাইরে জামান সাহেব সারাদিন লেখালেখি নিয়েই থাকেন বলে খাওয়া-দাওয়ার কোন হুঁশ থাকে না। অফিসের হাজারও ব্যস্ততার মধ্যে ফোন করে সময়মতো খাওয়া-দাওয়ার কথা স্বামীকে মনে করিয়ে দেন সাহানা। নিজের কাপড়-চোপড় ময়লা হলেও কাপড়গুলো ধুতে হবে এই হুঁশ তার স্বামীর থাকে না। সাহানা সবসময় খেয়াল রাখেন, কোন কাপড় কখন ময়লা হচ্ছে, সময়মতো ধুতে দেন তিনি। এককথায় বাচ্চাদের যেভাবে যত্ন নেন তিনি, ঠিক তেমন করেই তার স্বামীর যত্ন নেন।

স্বামীর এমন উদাসীনতার কারণে তিনি কিন্তু স্বামীর উপর মোটেই বিরক্ত নন। তিনি স্বামীকে ভালোবাসেন, স্বামীর প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি নেই তার। আর ভালোবাসার মানুষের জন্য কোনকিছু করতে বিরক্ত হয় না কেউ।

স্বামী তাকে ভালবাসে, কিন্তু সে ভালবাসা একদম অন্যরকম। সাহানা চৌধুরী খুব বুদ্ধিমান মানুষ। আর সেকারণে তিনি খুব সুখী। তার ধারণা বোকা মানুষরা সারাক্ষণ সুখের পেছনে ছুটে ছুটে হয়রান হয় কিন্তু সুখ তাদের কাপালে জোটে না। সুখ যে তাকে জড়িয়ে  আছে সেটা বোঝার বুদ্ধি তার নেই। চারপাশে জড়িয়ে থাকা অনেক সুখের বিষয় আছে যেগুলোকে নিয়েই যে কেউ অনায়াসে সুখী হতে পারে। সাহানা মনে করে জীবন একটাই, চোখের নিমিষে বিশ বছর, ত্রিশ বছর, চল্লিশ বছর পার হয়ে যায়। ফুৎকারে দেখব জীবনটা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সেদিনই তিনি দেখলেন তার মা যুবতী মহিলা, কি তার দাপট আর কি তার তেজ! ভাইবোনরা সবাই তার ভয়ে থরথর কাঁপতেন। সেই মা আজ মৃত্যুশয্যাই। চোখ বুজলেই তিনি তার দারোগার মতো যুবতী মাকে দেখতে পান।  মনে হয় এই তো কদিন আগের মা। এখন তিনি মৃত্যু শয্যায় ধুকছেন! সেই জীবন নিয়ে এত হাহুতাশ করার কি আছে! যেটা আছে সেটা নিয়েই সুখী হও।

সাহানা চৌধুরীর বুকটা মাঝে মাঝে হাহাকার করে ওঠে। আপনারা হয়তো এতক্ষণে ঠোঁট উল্টিয়ে বলছেন, খুব তো এতক্ষণ সাহানা চৌধুরী একজন সুখী মানুষ, সুখী মানুষ বলে ঝড় তুললেন! তার সুখী হওয়ার দর্শনও ঝাড়লেন! এখন আবার একথা বলছেন! পাঠক, আমি এখনও আমার কথায় অনড়! তিনি খুব সুখী মানুষ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কারও বুক যদি এক মিনিটের জন্য হুহু করে ওঠে তাহলে বাকি ২৩ ঘণ্টা ৫৯ মিনিটের সুখ কি মিথ্যা হয়ে যাবে। আপনারাই বিচার করুন পাঠক, তিনি সুখী নাকি অসুখী?

বৃষ্টি হলে তার এই হাহাকারটা বেড়ে এক মিনিটের জায়গায় দুমিনিট হয়ে যায়। আকাশে গোল বড় চাঁদটা যখন আলো ছড়ায় তখন তার হাহাকারটা তিন মিনিট হয়ে যায়। আহা! আমার যদি এমন কেউ থাকত বৃষ্টিতে জড়াজড়ি করে ভেজার, হাত ধরাধরি করে চাঁদ দেখার! জীবনে একটি বারের জন্যও তার এমন সুযোগ হয়নি। এই সাধ মেটেনি তার। প্রেম করেনি সে। বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করেছে।

বিয়ের পর বেশিরভাগ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছুদিন মাখো মাখো প্রেম থাকে। বছর কয়েক পর দুজনের সেই প্রেম আপনাআপনি মিইয়ে আসে। কারও কারও ক্ষেত্রে এইমাত্র নেভানো সলতের মতো হালকা রক্তিমাভার মতো প্রেম জেগে থাকে। কারও ক্ষেত্রে সলতেটা একদম কালচে রূপ ধারণ করে। প্রেম কি প্রেমের সামান্যতম কোন আভাও থাকে না। একদম কালো ছাই আর কি। প্রেম একটা কলি যেটা সবার বুকের মধ্যেই থাকে। বিয়ের আগে বা পরে সুযোগ পেলেই সেটা ফোটে। একটা নির্দিষ্ট সময় থাকার পর ফুল যেমন শুকিয়ে যায় তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময় পর প্রেমেরও মৃত্যু ঘটে। এটা জীবনের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

কিন্তু সাহানার প্রেম কলি হয়েই আছে বুকে। ফুল হয়ে ফোটার সুযোগ পায়নি। সেকারণেই তার এই হাহাকার। অনার্স পাস করেই বিয়ে হয়। দারোগার মতো মার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করা সম্ভব হয়নি তার। বিয়ের পর পরই জমজ  দু ছেলে জন্মায়। ওদেরকে একটু বড় করতে না করতেই দুই বছরের মাথায় মেয়ের জন্ম। এর বছর দুয়েক পর সাহানা চাকুরিতে ঢোকে ব্যাংকে। সোহেল, তার সিনিয়র কলিগ সাহানার জীবনে মালি হয়ে আসে। তার বুকের মধ্যে থাকা প্রেমের কলিটি  সোহেলের যত্ন আত্মিতে ফুল হয়ে ফোটে। সাহানা দেখতে খুবই সুন্দর। সোহেল তার চেয়ে ৫-৬ বছরের বড়। সোহেলের সঙ্গে সে অফিস শেষে আধো অন্ধকারে হাঁটে, নিরিবিলি কোন পার্কে বসে। দুজনেই বিবাহিত। জনবহুল জায়গায় যাওয়া রিস্কি, কেউ দেখে ফেললে! সোহেলের অবশ্য ডিভোর্স হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে গাড়ি ফেলে আধো অন্ধকারে তারা ছাতা মাথায় দিয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। সোহেল সাহানার দিকে যখনই কামনার হাত বাড়ায় তখনই সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করার বাইরে সোহেলকে সে আর কোন সুযোগ দেয় না কখনও। সোহেল সাহানাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে, সাহানা তা টের পায়। সোহেল সেই হাত ধরা সাহানাকে নিয়েই প্রেম চালিয়ে যায়। এ বিষয়ে সোহেল কখনও কোন অভিযোগ করে না। তবে হ্যাঁ, সোহেল তো মানুষ,তাও আবার পুরুষ মানুষ। মাঝে মাঝে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে চায়, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু সাহানা এগুলোকে কখনও প্রশ্রয় দেয় না।

সোহেলের সঙ্গে প্রেম করার কারণে স্বামীর প্রতি তার মায়া, মমতা, ভালেবাসা একটুও কমেনি বরং এক ধরনের অপরাধ বোধে ভোগার কারণে সেগুলো আরও দ্বিগুণ বেড়েছে। সারা দিন-রাত লেখার টেবিলে মুখ গুঁজে থাকা বেচারা স্বামী তা টের পায় না। অন্য কোন স্বামী হলে বউয়ের এই পরিবর্তনটা ঠিক ঠিক টের পেত, কারণটা না বুঝতে পারলেও।

সাহানার ভেতরের আমির সঙ্গে যুদ্ধ চলে সারাক্ষণ। ভেতরের আমিটা বলে, তুমি বিবাহিত হয়ে স্বামী, বাচ্চাকে ফাঁকি দিয়ে যে কাজটা করছ, সেটা কি ঠিক হচ্ছে?

সাহানা ঝংকার দেয়, কেন ঠিক নয়, একশবার ঠিক, হাজারবার ঠিক। যার সঙ্গে বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পার করলাম কিন্তু বুকের মধ্যে প্রেমটা কলি হয়েই রয়ে গেল, সে তো আমার কলিটাকে ফুল হয়ে ফুটতে দেয়নি। সেই কলি এখন ফুটতে চাইলে আমি ঠেকাবার কে? জীবনের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আছে না! সেটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারি না আমরা। এটা ঘটবেই, এটা ঘটতে দেয়াই উচিত। বিয়ের পর কতদিন জামানকে বলেছি, চলো না জড়াজড়ি করে গান শুনি, বৃষ্টিতে ভিজি।

সে প্রতিবারই বলেছে, আশ্চর্য কথা, গান শুনতে ইচ্ছে করছে গান শোন, আমাকে লাগবে কেন? যাও, বৃষ্টিতে ভেজ। তুমি কি এখনও এত ছোট, একা বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে না! বিরক্ত হয়ে জামান বলে, কেন যে আনন্দ করার জন্য তোমার আর একজনকে লাগে বুঝি না!

সাহানা দাঁত কিড়মিড় করে, আরে গর্দভ! বিয়ের পর আমি একা তো সবকিছু সামলাই। এমন অদ্ভুত স্বামীও যে দুনিয়ায় আছে, জানতাম না! আরে হাঁদারাম! প্রেম কি একা করা যায়! প্রেম একা করা গেলে আমি সেটাও একাই করতাম। মানুষের পেট থেকে ওর জন্ম হয়নি, মনে হয় কেউ শুধুমাত্র লেখালেখি করার জন্য একটা প্রোগ্রাম সেট করে ওকে ছেড়ে দিয়েছে দুনিয়ায়।

সাহানা এবার ভেতরের আমিটার দিকে চোখ রাঙ্গায়, আমি তো মানুষ নাকি! খাওয়া, ঘুমের মতো প্রেমও তো জীবনের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি ফুল গাছ যখনই মালির সঠিক পরিচর্যা পাবে তখন ফুল ফুটবেই। তুমি চাইলেই এই ফুল ফোটা বন্ধ করতে পারবে না। সোহেল আমার জীবনে মালি হিসেবে এসেছে, আমার প্রেমের ফুল ফুটবেই। আমি ঠেকাব কিভাবে! তাছাড়া আমি তো সংসার, সন্তান, স্বামীর প্রতি দায়িত্বে কোন অবহেলা করি না। কাউকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করি না। আর সবচেয়ে বড় কথা সোহেলের সঙ্গে হাত ধরাধরির বাইরে আর কোন ঘনিষ্ঠতা নেই আমার। বাসে, মার্কেটে গেলেও তো কত কিছু ঘটায় পুরুষেরা। আর সোহেল শুধু হাত ধরে তাতেই দোষ!

এক বৃষ্টি স্নাত সন্ধ্যায় সোহেল আর সাহানা বেরিয়েছে। দুজন নিরিবিলি এক রাস্তায় হাঁটছে। একটা ছাউনির নিচে ওরা বসল। চারিদিকে বেশ নিরিবিলি। সামনে এক বিশাল গাছের পাতা ভেদ করে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে লাইটের আলোয় এক একটা হীরক খণ্ড মনে হচ্ছে। সোহেল সাহানার হাতে হাত রেখেছে। সাহানার খুব ইচ্ছে করছে সোহেলের বুকে মাথা রেখে দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে এই বৃষ্টিতে ভিজতে। মধ্যরাত পর্যন্ত সাহানা বাড়ির বাইরে থাকলেও ওর স্বামী কিছু বলবে না। খুব জোর একটা ফোন দিয়ে জানতে চাইবে, তুমি ঠিকঠাক আছ? কখন ফিরবে একথাটাও জানতে চাইবে না। কার সঙ্গে আছি সেটাও জানতে চাইবে না। বাচ্চাদের দেখাশুনার জন্য একটা মধ্যবয়স্ক বুয়া আছে। সাহানার ফিরতে দেরি হলে ওদের সে খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়। স্বামীর দিক থেকে সে একদম ফ্রি। কিন্তু সাহানা নিজের বিবেকের কারণেই তার এই চাওয়াটাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।

সাহানার কখনও সোহেলের সঙ্গে শারিরিক সম্পর্ক করার ইচ্ছে হয় না। কখনই না। বিষয়টা হয়ত একারণে, এই সম্পর্কটা তো ওর স্বামীর সঙ্গে আছে। শুধু ওর ইচ্ছে করে সেহেলের সঙ্গে জড়াজড়ি করে বৃষ্টিতে ভিজতে, পুর্নিমার রাতে ওর কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখতে। দুজন হাতধরা ধরি করে হাঁটতে। সোহেল ওর দিকে পলকহীন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকুক, এগুলোই সে চায়।
একদিন সাহানা তার ভেতরের আমিকে বলে, সোহেলের কাছ থেকে আমি যেগুলো চাই সেগুলো কি পাপ, সেগুলো কি অন্যায়?

ভেতরের আমিটা গোঁয়ারের মতো বলে, অবশ্যই পাপ, অবশ্যই অন্যায়। যে কাজ তোমার সমাজ, তোমার পরিবারের সামনে করতে পার না, যে কাজ লুকিয়ে করতে হয় তাই পাপ, তাই অন্যায়।

 

|| ২ ||

সোহেল আমি বিবাহিত, বাচ্চার মা। আমার এ রিলেশন থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। প্লিজ, তুমি আমাকে হেল্প করো। সাহানার কণ্ঠে আকুতি।

সাহানা তোমার বেঁধে দেওয়া গণ্ডি তো আমি অতিক্রম করি না কখনও। সোহেলের কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পরে, তবুও কেন আমাকে এই শাস্তি দিতে চাও তুমি? তুমি কি ভয় পাচ্ছ, এই গণ্ডি হয়তো তুমিও একদিন অতিক্রম করবে, আমিও অতিক্রম করব?

নাহ, সোহেল, আমি কখনই এই গণ্ডি অতিক্রম করব না। সাহানার কণ্ঠ বেশ দৃঢ়, আমি তোমার সঙ্গে কোনদিন শারীরিক সম্পর্ক করব না। সমাজের কাছে এটা অন্যায় বা আমার বিবেকের দংশন হয় সেকারণে নয়। আমার এই সম্পর্ক করার কখনও ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে কিন্তু জোর করে নিজেকে বিরত রাখছি বিষয়টা এমন নয় মোটেও। চেতন, অবচেতন মনে কখনই আমার এই ইচ্ছে জাগে না, জাগবেও না কোনদিন। আর আমি বিশ্বাস করি তুমি কখনও আমি না চাইলে জোর করবে না।

একদম ঠিক ধরেছ। সোহেল আশ্বস্ত গলায় বলে, আমার তো তাতে কোন সমস্যা নেই সাহানা। আমি সেটা মেনে নিয়েই তোমার সঙ্গে আছি এবং থাকতে চাই। শারীরিক সম্পর্ক তো তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমার আছে কিন্তু সেখানে তুমি তো সুখী নয়। আমার বউয়ের সঙ্গেও আমার এই সম্পর্ক থাকার পরও আমরা সুখী হতে পারিনি। আমার বউ এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছে, তুমি পারনি। আসলে আমাদের বাচ্চা নেই বলেই হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে। আমি আসলে মানসিকভাবে তোমাকে পেয়েই সুখী, খুশি। আমি যখন ভাবি এতবড় পৃথিবীতে আমার এমন একজন আছে, যে আমার কথা ভাবে, একদম নিঃস্বার্থভাবে। আমার প্রতি তার কোন দাবি নেই। এটাই তো প্রকৃত ভালোবাসা। মাঝে মাঝে হয়তো আমি তোমার কাছে একটু বেশি চেয়ে বসি, না পেয়ে জোর তো করি না সাহানা। আজ থেকে আমি আর তোমার কাছে সেটুকুও চাইব না, কথা দিলাম। তোমার স্বামীর দিক থেকেও তুমি তো ফ্রি, মানে তুমিই তো বলেছ, তিনি এই সম্পর্কটা জানলেও কিছু বলবেন না তোমাকে। সংসারটা ভাঙ্গতে চাও না তুমি। সেটা ভাঙ্গার রিস্ক তো নেই। তাহলে তুমি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছ?

সাহানা সেদিন ওর স্বামী জামানের কাছে আবারও জানতে চেয়েছিলো, সত্যি সত্যি যদি আমি কারও সঙ্গে বিছানায় যাই। তুমি কি আমার সঙ্গে থাকতে পারবে?

তোমার সঙ্গে থাকতে আমার কোন সমস্যা নেই। তবে আমি জানি, এত সাহস তোমার নেই। জামান সেদিন কেন জানি ওর মনের ঢাকানাটি একটু খুলে দিয়েছিল, এগুলো করার জন্য বুকের পাটা থাকতে হয় বুঝলে। তোমার বুকের সেই পাটা নেই। তুমি আমাকে যতটা চেন তার চেয়ে হাজারগুণ তোমাকে ভালোভাবে চিনি আমি। লেখকরা মানুষের মন পড়তে পারে। কারও সঙ্গে একটু-আকটু ফুটুস-ফাটুস করতে পার হয়তো। সেটা করা ভালো, সেটাতে তোমার মন ভালো থাকবে।

আমি যদি কারও সঙ্গে বিছানায় যাই তাহলে ওর কি সত্যি সত্যি খারাপ লাগবে না? নাকি ও বিশ্বাস করে আমার সেই সাহস নাই বলে আমি সেই কাজ কখনও করতেই পারব না? এজন্যই ও কি এতটা নির্ভার থাকে আমাকে নিয়ে? কিন্তু এই ফুটুস-ফাটুসই বা করতে দিবে কেন আমাকে অন্যের সঙ্গে? ও তো অন্য মেয়ের হাত ধরলে আমার কলিজা ছ্যাৎ করে উঠবে। যদিও জানি ও জীবনে কারও হাত ধরবে না, সেই বোধই তো নেই। থাকলে তো আমার হাতই ধরত। আমার হাত পুরাতন লাগলে তো নতুন কারও হাত ধরবে। আমার হাতটা তো আনকোরাই রয়ে গেছে ওর কাছে!

কি হলো সাহানা? কি ভাবছ? সোহেল জানতে চায়।

সাহানা কোথায় যেন এতক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিল। সোহেলের কথায় সম্বিত ফিরে পেল। এবার সোহেলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে, তোমার ধারণা একদম ভুল সোহেল, আমি দাম্পত্য জীবনে অসুখী নয়। আমি সুখী। আমি তোমার কাছে সুখ খুঁজতে আসিনি।

তাহলে তুমি আমার সঙ্গে জড়িয়েছ কেন? সোহেল প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, স্বামীর সঙ্গে সুখী না হলেই সাধারণত মেয়েরা প্রেমে জড়ায়। ব্যতিক্রম হয়তো আছে। ব্যতিক্রম তো আর উদাহরণ হতে পারে না। পুরুষদের কথা অবশ্য আলাদা। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে সুখী পুরুষও অন্যের সঙ্গে ইচ্ছে করে জড়ায়। আসলে পুরুষদের মন ও শরীরের মেকানিজমই আলাদা। আমি একজনও মেয়ে দেখিনি যারা স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকার পরও অন্যের সঙ্গে জড়ায়।

তাহলে পুরুষরা কার সঙ্গে জড়ায়? পুরুষদের সঙ্গে? যার সঙ্গে জড়ায় সে তো মেয়েই নাকি? সাহানাও পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ে।

হ্যাঁ, তারা মেয়ে। তবে তারা এমন মেয়ে ছিল না। তাদেরকে তাদের স্বামীরা বাধ্য করেছে এমন মেয়ে হতে। সোহেলের গলা ধরে আসে এবার,  আমার নিজের ছোট বোন স্বামী সংসার নিয়ে খুব সুখে জীবন কাটাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন সে দেখতে পায়, তার স্বামী তার এক ডিভোর্সী দূর সম্পর্কের ননদের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়েছে। ওর স্বামী কিন্তু ডিভোর্সি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে। কোন সংসারি মেয়ের সঙ্গে নয়। এরপর আমার বোন তার এক কলিগের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পরে। ও সংসার ভাঙ্গতে চায় না সন্তানদের কথা ভেবে। এভাবেই ওদের সংসারটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনরকমে টিকে আছে। জানি না কতদিন টিকবে। আমরা সবসময় বলি, সংসার ছেড়ে চলে আসতে। কিন্তু সে নারাজ। আমরা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে দেখি একটা মেয়ে স্বামী সংসার থাকার পরও অন্য রিলেশনে জড়িয়েছে। কিন্তু আমরা তার ভেতরের খবর জানি না। আমি হলফ করে বলতে পারি, স্বামী সংসার নিয়ে সুখী কোন মেয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে কোন রিলেশনে জড়ায় না। স্বামীরা আগে অপরাধ করে বলেই স্ত্রীরা অপরাধের পথে পা বাড়ায়। অপরাধ বা যেকান ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েই মেয়েরা অন্য রিলেশনে জড়ায়।

স্বামীর সঙ্গে সুখী হওয়ার পরও তুমি কেন জড়িয়েছ আমার সঙ্গে সাহানা? আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না। সোহেল প্রশ্ন করে।  

সোহেলের কথাটা যেন সাহানার কানে ঢোকে না। সে আপনমনে বলে চলে, আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে সোহেল। একটা সম্পর্কে থেকে তোমার সঙ্গে এমন সম্পর্কটা চালানো ঠিক নয়।

নাহ, আমি মানি না, সে তোমাকে ভালবাসে। সোহেলের কণ্ঠ খুব দৃঢ়, দাম্পত্য জীবনের ভালবাসা এমন হতে পারে না। সে যদি তোমাকে ভালবাসত তাহলে তুমি অন্য পুরুষের সঙ্গে জড়ালে তার কষ্ট হতো। তোমাকে ভালবাসে না বলে তোমার কোন কিছুতেই তার কিচ্ছু যায় আসে না। তুমি একথা খুব ভালো করেই জান, সে তোমাকে ভালবাসে না। আর সেকারণেই তুমি আমার সঙ্গে জড়িয়েছ। কিন্তু তুমি সেটা আমার কাছে স্বীকার করো না কখনও। বরং উল্টা পাল্টা যুক্তি দাও।

আমি  জানি, একথা তুমি বিশ্বাস করবে না, এটা বিশ্বাস করার কথা নয়। সাহানার কণ্ঠ বেশ শান্ত, তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, একথা সত্যি আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে। সবার ভালেবাসা একরকম নয় সোহেল। কেউ ধরে রেখে ভালোবাসা প্রকাশ করে, কেউ ছেড়ে দিয়ে ভালেবাসা প্রকাশ করে। আমার ভালো থাকাটা ওর চাওয়া, আমি যদি অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে ভাল থাকি, তাহলে সে খুশি। আমি যদি ওর কাছ থেকে কখনও চলে যেতে চাই, ও একটা বারের জন্য বলবেও না, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি কষ্ট পাব। ওর কষ্টটা ওর কাছে বিষয় না। আমার ভালো থাকাটা ওর কাছে মূল বিষয়। ও সবসময় বলে, আমার কাছে থেকে যদি তুমি কষ্ট পাও, তাহলে তুমি চলে যেতে পার।

তোমার কষ্ট হবে না, আমাকে ছেড়ে থাকতে? সাহানা জানতে চেয়েছিল স্বামীর কাছে।

 সে উত্তর দেয়, তোমার ভালো থাকাটা আমার কাছে জরুরি।

সাহানা বলে চলে, পৃথিবীতে হয়তো এমন ভালোবাসা বিরল। কিন্তু আছে। এই ভালোবাসার সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা গতানুগতিক দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসা থেকে আলাদা। মানুষের জীবন কত বিচিত্র। কত বিচিত্র মানুষের ভাবনা!

তুমি আমাকে ভালোবাস না, সাহানা? সোহেলের কণ্ঠে আবেগ ঝরে পরে।

ভালোবাসি। ভালেবাসা তো ফুরোবার জিনিস নয়, যে একজনকে ভালোবাসলে অন্যকে ভালোবাসা যাবে না। সাহানা বলে, আমি তোমাকেও ভালেবাসি। তোমার প্রতি আমার দাবি নেই একথা ঠিক কিন্তু চাওয়া আছে।

বলো, আমি তোমার সব চাওয়া পূরণ করার চেষ্টা করব।

নাহ, সেটা পারবে না। অন্তত এখন পারবে না। তুমি দিতে পারলেও আমি নিতে পারব না। সাহানা বলে।

আগে চাওয়াটা বলো। সোহেল অনুনয় করে।

আমি চাই তোমার কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখতে। আমি চাই বৃষ্টিতে জড়াজড়ি করে ভিজতে। আমি চাই দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটতে। আমি চাই দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে। অসুখী বলে নয়, আমি শুধু এই চাওয়াগুলো পূরণ করতে তোমার কাছে এসেছি।

সবসময় সুখী হওয়ার ভান কেন করো তুমি, সাহানা। সোহেল এবার হা হা করে হেসে ওঠে, এখন তো পরিষ্কার, তোমার এই চাওয়াগুলো পূরণ হয়নি বলেই তুমি অসুখী আর সেকারণেই তুমি আমার কাছে এসেছ।

যারা সুখী তাদের কি সব সাধ পূরণ হয় বলেই তারা সুখী? নাহ, মোটেই তা নয়। সাহানা বলে চলে, খোঁজ নিয়ে দেখ একজন অসুখী মানুষের যত সাধ পূরণ হয়েছে তাদের চেয়ে একজন সুখী মানুষের অনেক কম সাধ পূরণ হয়েছে। একজন মানুষ তখনই সুখী যখন সে তার সাধ পূরণ না হলেও সুখে থাকতে পারে। ধরো কারও একটা গাড়ী কেনার শখ, এটার জন্য তো সে অসুখী হয় না। এই শখটা সে পূরণ করতে চায়। শখ হওয়াটা মানুষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা ঘটবেই। সবাই তার নিজ নিজ শখ পূরণ করতে চায়। ধরো গাড়ি কেনার যাদের শখ তাদের মধ্যে কেউ কেউ গাড়ি কেনার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে। গাড়ি কেনা না হলে তারা অসুখী হয়। আবার কেউ হয়তো এই শখটা পূরণ হচ্ছে না বলে বুকের মধ্য একটা হালকা অতৃপ্তি নিয়েই দিব্বি সুখে জীবন কাটাতে পারে। গাড়ি না পেয়ে কেউ পৃথিবীর সেরা অসুখী হয়ে জীবন কাটায়, কেউ গাড়ি না পাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে সুখেই জীবন কাটাতে পারে।

আমারও এটা একটা শখ বলতে পার। প্রেমের কুঁড়ি সব নারীর মধ্যেই  থাকে। কোন কোন স্বামী এই কুঁড়িটার যত্ন নিয়ে  ফুল হিসেবে ফোটায়। কিন্তু কোন কোন স্বামী প্রেমের এই কুঁড়ি ফুটাতে পারে না। কুঁড়িটি বুকের ভেতর আঁকুপাকু করে ফোটার জন্য। এই আঁকুপাকুকে সর্বস্ব করে কেউ অসুখী হয়। কিন্তু আমি এটাকে পাত্তা না দিয়ে অন্যান্য হাজারও সুখের উপকরণকে আঁকড়ে ধরে সুখী হয়েছি।

তোমার সুখী হওয়ার উপকরণগুলো কি? সোহেল জানতে চায়।

হাজারও উপকরণ আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি। প্রথমত তুমি যেটাকে অসুখী হওয়ার মূল কারণ বলছ সেটাই আমার সুখী হওয়ার মূল কারণ। বিয়ের পর থেকে এপর্যন্ত আমি যে পরিমান স্বাধীন জীবন যাপন করেছি এটা খুব কম মেয়ের পক্ষেই  সম্ভব। আমি খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে। আমি কোথায় গেলাম,কার সঙ্গে গেলাম, কি করলাম, কখন ফিরলাম সেটা নিয়ে আমার স্বামীর কোন মাথা ব্যাথা নেই। শুধু এটার জন্য আমার পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী  মানুষ হওয়া উচিত। কারণ আমার চারপাশে বিবাহিত  বা অবিবাহিত কোন মেয়েকে আমার মতো এমন নির্ভার হয়ে সময় কাটাতে দেখিনি। বুদ্ধিহওয়ার পর থেকে বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত এমন অবাধ স্বাধীনতা আমি উপভোগ করিনি কখনও। বিয়ের আগে আমি আমার ইচ্ছেমতো সময় যাপন করতে পারিনি। মা-বাবার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জীবন শেষ। আমার মনেহয় মা,বাবার কারণে বেশিরভাগ অবিবাহিত মেয়েদেরই একই সমস্যা। সমস্যা বলছি একারণে, মা,বাবার বিধিনিষেধ মেয়েদের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে মঙ্গল হলেও স্বাধীনতা খর্ব হয় ঠিকই। আর বিয়ের পর তো স্বাধীনতার প্রশ্নই আসে না বেশিরভাগ মেয়ের ক্ষেত্রে।  

যাইহোক যেটা বলছিলাম, আমি অসুখী বলে তোমার কাছে আসিনি সোহেল। আমার শখ, আমার একজন প্রেমিক থাকবে, যার হাত ধরে আমি বৃষ্টিতে ভিজব, রোদে হাঁটব, জড়াজড়ি করে যার সঙ্গে পূর্ণিমা দেখব, আকাশ দেখব। যে  শখগুলো পূরণ করা জীবনে কখনই সম্ভব নয় বলে আমি মনেকরি সেগুলোকে আমি ছেড়ে দেই। সেগুলোর পেছনে ছুটি না আমি। সেগুলো পাইনি বলে নিজের সুখ নষ্ট করি না কখনও। যে শখগুলো পূরণ করতে পারব বলে মনে হয় আমার কাছে, সেগুলোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাই, কিন্তু সেজন্য নিজের সুখ কখনও নষ্ট করি না। আমার এই চাওয়াগুলো পূরণ করা সম্ভব বলেই আমি এটার পেছনে ছুটছি। বিয়ের পর ভেবেছিলাম স্বামীই আমার প্রেমিক, ওর দ্বারাই আমার শখগুলো পূরণ হবে। কিন্তু দেখলাম সে আসলে শুধু স্বামী, প্রেমিক নয়। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে আমি আমার এই শখ, আমার চাওয়াগুলো পূরণ করব। কিন্তু এখন দেখছি, বিবেক আমাকে দংশন করছে।

আমার স্বামীর কাছ থেকে আমি কখনই এই চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারিনি। সেকারণে ভেবেছিলাম, হয়তো আমার বিবেকের দংশন হবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল, বিবেকের দংশন আমাকে প্রতিমুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত করছে। সেকারণে আমি সরে যেতে চাই। তবে আমি মনে করি, আমার এই শখগুলো পূরণ করা সম্ভব।

সাহানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবে, এরপর আবার শুরু করে, আমি মনেকরি স্বামী, সন্তান, সংসারের প্রতি যখন আমার দায়িত্ব শেষ হবে। যখন আমি আমার সংসার থেকে ছুটি নিতে পারব, তখন এমন একটা বয়স হবে, যখন আমি আমার এই শখগুলো পূরণ করলে আমার বিবেকের দংশন হবে না। এই শখগুলো এমন, একটা সংসারে থেকে, একটা দায়িত্বের মধ্যে থেকে, একটা সম্পর্কের মধ্যে থেকে, একটা বয়সের মধ্যে থেকে এই শখগুলো পূরণ করা উচিৎ নয় বলে আমি মনে করি। সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে এখনকার এই বয়সটা পেরিয়ে গেলে আমি আমার শখগুলো পূরণ করতে পারব সোহেল।

 

|| ৩ ||

বিশাল বড় গেটটা পেরিয়ে সাহানা চোধুরীর ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ পুরো পরিবার বৃদ্ধাশ্রমের   ভেতরে প্রবেশ করে। তারা সবাই আজ তাকে দেখতে এসেছে। এক সপ্তাহ হলো তিনি এখানে এসেছেন। তার অতি আদরের নাতি, সাফিন তার দাদিকে একটু আড়ালে নিয়ে চুপি-চুপি জানতে চায়, দাদি তোমার শখগুলো পূরণ হচ্ছে তো, ঠিক ঠাক মতো? দাদি ফোকলা দাঁতে হাসে।

পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা অবাক হয়ে ভাবে, কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!