তানজানিয়ান-ব্রিটিশ লেখক আব্দুলরাজাক গুরনাহর নোবেল বক্তৃতা

|| আব্দুলরাজাক গুরনাহ ||
আব্দুলরাজাক গুরনাহ বিখ্যাত তানজানিয়ান-ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ১৯৪৮ সালের ২০ ডিসেম্বর তানজানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিপীড়নের কারণে তিনি তানজানিয়া ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তানজানিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ, ঔপনিবেশিক শাসন এবং বাস্তুচ্যুতির অভিজ্ঞতা তার লেখনীতে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
গুরনাহর রচনায় শরণার্থী, নির্বাসন, পরিচয় এবং সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। তার লেখায় আফ্রিকার ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে প্যারাডাইস (১৯৯৪), বাই দ্য সি (২০০১), ডেজারশন (২০০৫) এবং আফটারলাইভস (২০২০)। ২০২১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
গুরনাহ তাঁর সাহিত্যে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন যা বিশ্বসাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মাতৃভাষা সোয়াহিলি হলেও তিনি ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তার লেখায় সোয়াহিলি এবং আরবি সংস্কৃতির ছোঁয়া স্পষ্ট। একজন অধ্যাপক হিসেবে তিনি কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন এবং উদীয়মান লেখকদের জন্য হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার উৎস। তার সাহিত্য কেবল শরণার্থী মানুষের দুঃখকষ্ট নয়, বরং তাদের আশা এবং সাহসের গল্পও তুলে ধরে। গুরনাহর কাজ বিশ্বজুড়ে পাঠকদের কাছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং মানবিক অভিজ্ঞতার গভীরতা উপলব্ধি করার দারুণ সুযোগ করে দিয়েছে।
|| অনুবাদকের নোট ||
২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী আব্দুলরাজাক গুরনাহ এই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ সালে। নোবেল পুরষ্কারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, তিনি এই পুরষ্কারটি অর্জন করেছেন, ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশের মধ্যকার শূন্যস্থানে উদ্বাস্তু মানুষের নিয়তির প্রতি তার আপসহীন ও সহানুভূতিশীল অন্তর্দৃষ্টির জন্য। নোবেল প্রাইজ আউটরিচ প্রোগ্রাম সম্প্রতি প্রতিধ্বনি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদের অনুমতি প্রদান করেছে। আমরা নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশন, আব্দুলরাজাক গুনরাহ ও সংশ্লিষ্টজনের কাছে কৃতজ্ঞ।
ছবি: আব্দুলরাজাক গুরনাহ || কৃতজ্ঞতা: alchetron.com
আব্দুলরাজাক গুরনাহর নোবেল বক্তৃতা || লেখালেখি
অনুবাদ || আহসানুল করিম
লেখালেখি সবসময়ই ছিল আনন্দের। এমনকি স্কুলে পড়ার সময়ও গল্প কিংবা শিক্ষকদের মতে যা কিছু আমাদের উৎসাহী করে তুলতে পারে এমন সব বিষয়ে লেখালেখি করার ক্লাসের জন্য রুটিনের অন্য যে কোন ক্লাসের চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। তখন সকলে চুপচাপ হয়ে যেত, ডেস্কে ঝুঁকে স্মৃতি ও কল্পনার জগৎ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু তুলে আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। শৈশবের এইসব চেষ্টায় নির্দিষ্ট কিছু বলার ইচ্ছা, কোনো স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা মনে করার তাগিদ, কোনো দৃঢ় মতামত প্রকাশ করার আকাঙ্ক্ষা, কিংবা কোনো অভিযোগ তুলে ধরার সাধ ছিল না। যে শিক্ষক আমাদের প্রবন্ধ লেখার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অনুশীলন হিসেবে এটি করাতেন তাকে ছাড়া প্রয়োজন ছিল না আর কোন পাঠকের। লিখতাম কারণ আমাকে লিখতে বলা হতো, লিখতাম কারণ কাজটি করার মাঝে আমি সেরকম আনন্দ পেতাম।
বহু বছর পরে, যখন আমি নিজেই একজন স্কুল শিক্ষক হলাম, তখন আমাকে বিপরীত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলো। নীরব শ্রেণিকক্ষে আমি বসে থাকতাম, আর ছাত্ররা তাদের কাজে মনোনিবেশ করত। তা দেখে ডি. এইচ. লরেন্সের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে যেত, যার কয়েকটি লাইন এখানে উল্লেখ করছি:
‘দ্য বেস্ট অফ স্কুল’ থেকে কিছু চরণ
যখন আমি শ্রেণিকক্ষের তীরে বসে থাকি, একা,
ছেলেদের দেখি, পরণে গ্রীষ্মকালীন জামা
তারা লিখছে, তাদের গোল মাথাগুলো ঝুঁকে আছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে:
এবং একজনের পর একজন
মুখ তুলে তাকায় আমার পানে,
খুব নীরবে ভাববে বলে,
যেন দেখছে, তবু দেখছে না।
আর তারপর সে আবার ফিরে চায়, একটুখানি নিজের কাজের
আনন্দমাখা উত্তেজনায় মুখ ফিরিয়ে আমার থেকে,
যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেছে, ধরা দিয়েছে যা ছিল পাবার।
আমি যে লেখালেখির ক্লাসের কথা বলছিলাম কিংবা যা এই কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় তা পরবর্তী সময়ের লেখালেখির মত ছিল না। কোন তাড়না, দিকনির্দেশনা, পুনঃলিখন কিংবা অসংখ্যবার ঢেলে সাজানোর ব্যাপার ছিল না তখন। শৈশবের এই লেখাগুলো লিখতাম সরলরেখার মত, খুব বেশি দ্বিধা বা সংশোধন ছাড়াই, একেবারে সাদাসিধেভাবে। একইভাবে পড়ার সময়ও পড়তাম একরকম মুক্তমন নিয়ে নির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা ছাড়া। তখন আসলে বুঝিনি এই কাজগুলো কতটা ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। কখনো কখনো, সকালে স্কুলের জন্য তাড়াতাড়ি উঠার তাড়া না থাকলে এত রাত পর্যন্ত জেগে পড়তাম যে কিছুটা অনিদ্রায় ভোগা আমার বাবা বাধ্য হয়ে আমার ঘরে এসে বাতি নিভিয়ে দিতে বলতেন। সাহস করে তাঁকে বলা যেত না যে, তিনিও তখনো যেহেতু জেগে আছেন তবে আমার জেগে থাকতে সমস্যা কোথায়। কারণ বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলা যেত না। যাই হোক, তিনি তার অনিদ্রার সময়টা আলো নিভিয়ে অন্ধকারেই কাটাতেন, যাতে আমার মাকে বিরক্ত করা না হয়। ফলে তার বাতি নেভানোর নির্দেশটি গ্রহণযোগ্যতার সাথেই বহাল থাকত।
প্রথমেই আমি ভাবতে শুরু করি, বাড়ি থেকে সেই বেপরোয়াভাবে পালিয়ে আসার সময় আমি কী রেখে এসেছিলাম। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি আমাদের জীবনে এক চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসে, যার ঠিক বা ভুল দিকগুলো ১৯৬৪ সালের বিপ্লব-পরবর্তী পরিবর্তনের কারণে উদ্ভুত নৃশংসতার পিছনে আড়াল হয়ে গিয়েছিল: ধরপাকড়, মৃত্যুদণ্ড, নির্বাসন, এবং অন্তহীন ছোট-বড় অপমান আর দমনপীড়ন।
পরবর্তীকালে লেখালেখি শৈশবের এলোমেলো অভিজ্ঞতার তুলনায় বেশ শৃঙ্খলাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবে তা কখনোই আনন্দহীন ছিল না এবং বলতে গেলে কখনোই জবরদস্তির হয়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে এক ভিন্ন ধরনের আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডে এসে বসবাস শুরু করার আগে আমি পুরোপুরি সেটা বুঝতে পারিনি। সেখানেই দেশের জন্য আকুলতা এবং আগন্তুক জীবনের মর্মবেদনার মাঝে এমন অনেক বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করি যা আগে কখনো করিনি। দীর্ঘদিনের দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্নতার সেই সময় থেকেই আমি ভিন্ন ধরনের লেখালেখি শুরু করলাম। ক্রমে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, আমার কিছু বলার আছে, কোন একটি কাজ সম্পন্ন করার আছে, অনুশোচনা ও অভিমানগুলোকে বের করে এনে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রথমেই আমি ভাবতে শুরু করি, বাড়ি থেকে সেই বেপরোয়াভাবে পালিয়ে আসার সময় আমি কী রেখে এসেছিলাম। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি আমাদের জীবনে এক চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসে, যার ঠিক বা ভুল দিকগুলো ১৯৬৪ সালের বিপ্লব-পরবর্তী পরিবর্তনের কারণে উদ্ভুত নৃশংসতার পিছনে আড়াল হয়ে গিয়েছিল: ধরপাকড়, মৃত্যুদণ্ড, নির্বাসন, এবং অন্তহীন ছোট-বড় অপমান আর দমনপীড়ন। যা ঘটছে তার ঐতিহাসিক এবং ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে তা এই ঘটনাগুলোর মাঝে একজন কিশোরের পক্ষে তখন পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা সম্ভব ছিল না।
ইংল্যান্ডে বসবাসের কেবল শুরুর বছরগুলোতেই আমি কিছু বিষয় নিয়ে ভাবার সুযোগ পেয়েছিলাম, যেমন—একে অপরের উপরে যা কিছু আমরা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি তার কদর্য দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা অথবা যে মিথ্যা আর ভ্রান্ত ধারণাগুলো দিয়ে আমরা নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতাম সেগুলোকে ফিরে দেখা। আমাদের ইতিহাস ছিল খণ্ডিত, বহু নিষ্ঠুরতার প্রসঙ্গে নীরব। আমাদের রাজনীতি ছিল বর্ণভিত্তিক, যা সরাসরি বিপ্লব-পরবর্তী উৎপীড়নের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। যেখানে সন্তানের সামনে তাদের বাবাদের হত্যা এবং মায়ের সামনে তাদের মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো থেকে দূরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছিলাম, কিন্তু মানসিকভাবে ছিলাম গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। হয়তো যারা সরাসরি ঘটনাগুলোর পরিণতি ভোগ করছিল তাদের মাঝে থাকলে যতটা পারতাম তার চেয়ে এইসব স্মৃতির প্রভাব মোকাবেলায় অপারগতা অনুভব করছিলাম। এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন আরও কিছু স্মৃতির ভারে আমি বিপর্যস্ত ছিলাম। যেমন সন্তানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বাবা-মায়ের নিষ্ঠুরতা, সামাজিক বা লিঙ্গ সম্পর্কিত গোঁড়ামির কারণে মানুষকে পরিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা, কিংবা এমন বৈষম্য যা দারিদ্র্য ও পরনির্ভরশীলতাকে জিইয়ে রাখতো। এই বিষয়গুলো সব মানুষের জীবনে উপস্থিত এবং এগুলো আমাদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যতিক্রম নয়। তবে সাধারণত এগুলো নিয়ে চিন্তা আসে না, যতক্ষণ না পরিস্থিতি আপনাকে এসব নিয়ে সচেতন হতে বাধ্য করে। আমার মনে হয়, যেসব মানুষ দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকে পালিয়ে পেছনে ফেলে আসা মানুষদের থেকে দূরে নিরাপদ জীবনে পৌঁছে যায় তাদের এরকম বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। অবশেষে এক সময় আমি এই ভাবনাগুলো নিয়ে লেখালেখি শুরু করি—গোছানো বা সংগঠিত উপায়ে নয়, বরং নিজের মনোজগতে থাকা কিছু বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তাকে স্পষ্ট করে তুলে সামান্য স্বস্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে।
সময়ের সাথে সাথে এটা পরিষ্কার হয়ে এলো যে দারুণ অস্বস্তিকর কিছু ঘটছে। একটি নতুন, সরলীকৃত ইতিহাস নির্মিত হচ্ছে। এই ইতিহাস যা ঘটেছে তাকে বদলে ফেলছে, এমনকি মুছে দিচ্ছে। আবার সেই ঘটনাগুলোকে বর্তমান সময়ের সুবিধা অনুযায়ী নতুন করে তৈরি করছে। এই নয়া সরলীকৃত ইতিহাস কেবল যারা সবসময় নিজেদের পছন্দমতো কাহিনি নির্মাণের স্বাধীনতা ভোগ করা বিজয়ীদের অনিবার্য কারসাজি ছিল না, বরং এমন সব ভাষ্যকার, গবেষক, এমনকি লেখকদের ইচ্ছামত তৈরি হচ্ছিলো যাদের আসলে আমাদের সম্পর্কে কোন প্রকৃত আগ্রহই ছিল না। যারা আমাদের এমন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছে যা শুধু তাদের নিজেদের বিশ্বদর্শনের সঙ্গে মিলে যায়। তাদের প্রয়োজন ছিল একটি জাতির মুক্তি ও প্রগতির স্রেফ চিরচেনা বয়ান তৈরি করা।
আমাদের বাবা-মায়েদের কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের চেয়ে আমরা কিছুটা অন্যরকমভাবে ঔপনিবেশিকতার সন্তান ছিলাম। এর মানে এই নয় যে আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম কিংবা আমাদের পরকালে যারা এসেছে তারা ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। আমি বলতে চাইছি যে আমরা এমন একটা সময়ে বড় হয়েছি এবং শিক্ষিত হয়েছি যা ছিল সাম্রাজ্যবাদের চরম আত্মবিশ্বাসের যুগ, অন্তত আমাদের পৃথিবীতে। যে সময়ে প্রভুত্ব নিজেকে মিষ্টি কথার আড়ালে লুকিয়ে রাখত, আর আমরাও সেই ছলনার সঙ্গে মানিয়ে চলতাম।
তখন প্রত্যাখ্যান করা জরুরি হয়ে পড়েছিল এমন এক ইতিহাসকে, যে ইতিহাস উপেক্ষা করেছে বয়ে যাওয়া সময়ের সাক্ষ্যবহনকারী বস্তুগত নিদর্শনগুলোকে, যেমন বিভিন্ন স্থাপনা, নানাবিধ অর্জন, আর সেইসব কোমলতা যা জীবনকে সম্ভব করে তোলে। বহু বছর পরে, আমি আমার শৈশবের শহরের পথে পথে হেঁটেছি আর দেখেছি ক্ষয়িত স্থাপনা, স্থান, আর ধূসরিত, দন্তহীন এবং অতীতের স্মৃতি হারানোর ভয় নিয়ে দিন কাটানো মানুষ। সেই স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার একটি প্রচেষ্টা জরুরি হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল যা সেখানে ছিল তা নিয়ে লেখা প্রয়োজন। সেই মুহূর্ত ও গল্পগুলো উদ্ধার করা দরকার যেগুলোর মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেদের জীবন এবং পরিচয়কে বুঝতে শিখেছিল। জরুরি হয়ে উঠেছিল নির্যাতন এবং নিষ্ঠুরতার কথা লিপিবদ্ধ করা। যে কথাগুলো আমাদের আত্মতৃপ্ত শাসকেরা আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
ইতিহাসের আরেকটি বোঝাপড়া নিয়েও কথা বলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। এটি আমার কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো যখন আমি ইংল্যান্ডে সেই বয়ানের উৎসের কাছাকাছি এসে বসবাস শুরু করি। জাঞ্জিবারে থাকাকালীন ঔপনিবেশিক প্রভাবে প্রভাবিত শিক্ষা অর্জনের সময় এসব এতটা স্পষ্ট ছিল না। আমাদের বাবা-মায়েদের কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের চেয়ে আমরা কিছুটা অন্যরকমভাবে ঔপনিবেশিকতার সন্তান ছিলাম। এর মানে এই নয় যে আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম কিংবা আমাদের পরকালে যারা এসেছে তারা ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল। আমি বলতে চাইছি যে আমরা এমন একটা সময়ে বড় হয়েছি এবং শিক্ষিত হয়েছি যা ছিল সাম্রাজ্যবাদের চরম আত্মবিশ্বাসের যুগ, অন্তত আমাদের পৃথিবীতে। যে সময়ে প্রভুত্ব নিজেকে মিষ্টি কথার আড়ালে লুকিয়ে রাখত, আর আমরাও সেই ছলনার সঙ্গে মানিয়ে চলতাম। এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন আমাদের অঞ্চলে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনগুলো সেভাবে বেগবান হয়নি এবং ঔপনিবেশিক শাসনের লুটপাট আমাদের মনোযোগ সেভাবে আকর্ষণ করেনি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সান্ত্বনা খুঁজে নেওয়ার জন্য ছিল তাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক হতাশা এবং আত্মপ্রবঞ্চণা। হয়তো স্বচ্ছভাবে বা যথেষ্ট গভীরতার সাথে তারা বুঝতে পারেনি, কীভাবে ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে জীবন বদলে গিয়েছে। আমাদের দুর্নীতি এবং দুঃশাসনের কিছু অংশও যে সেই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের ফল, সেটিও তারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি।
এগুলোর মাঝে কিছু কিছু বিষয় আমার কাছে ইংল্যান্ডে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠছিলো। তবে তার কারণ এই নয় যে আলাপচারিতায় বা শ্রেণিকক্ষে এমন লোকজনের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়েছিল যাদের কাছ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ পেয়েছিলাম। বরং এর কারণ ছিল এই যে—আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম তাদের নিজেদের গল্পে আমার মতো একজন মানুষকে তারা কীভাবে স্থান দিত, তাদের লেখায় এবং নিত্যদিনের আলোচনায়, টিভি বা অন্যান্য মাধ্যমে বর্ণবাদী সব কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হাসি, দোকানপাটে, অফিসে বা বাসে প্রতিদিনের সাক্ষাতে বেখেয়ালে প্রকাশিত বৈরিতায়। সেই ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় আমি কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু ঠিক যেভাবে গভীরভাবে পাঠের দক্ষতা অর্জন করেছিলাম, তেমনি একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল আমার মাঝে আমাদের প্রতি ঘৃণা ও অবমাননা লালন করা মানুষজনের আত্মতৃপ্ত বয়ানকে প্রত্যাখ্যান করে লেখালেখি করার।
কিন্তু যতই উদ্দীপক ও সান্ত্বনাদায়ক হোক না কেন লেখা শুধু লড়াই আর বিতর্কের জন্য হতে পারে না। লেখালেখি তো কোনো একটি বিষয় কিংবা সমস্যা নিয়ে নয়, বরং এটি মানবজীবনকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করার বিষয়। তাই এক সময় নিষ্ঠুরতা, ভালোবাসা এবং দুর্বলতা লেখার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। আমি বিশ্বাস করি, লেখার কাজ হলো বিকল্প সম্ভাবনাগুলোকে দেখানো, যা কঠোর কর্তৃত্ববাদী চোখে ধরা পড়ে না, যা আপাতদৃষ্টিতে যে মানুষকে ছোট মনে হয় অন্যদের অবজ্ঞা সত্ত্বেও তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তাই আমি মনে করি এই বিষয়েও লেখা প্রয়োজন, এবং তা সত্যনিষ্ঠভাবে করা উচিত, যেন দোষ এবং গুণ উভয়ই প্রকাশ পায় এবং মানুষ সরলীকরণ ও সাধারণীকৃত ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। যখন এ প্রচেষ্টা সফল হয় তখন এক ধরনের সৌন্দর্যের জন্ম হয়।
আর এভাবে দেখার প্রবণতা দুর্বলতা ও অপূর্ণতাকে জায়গা করে দেয়, নিষ্ঠুরতার মাঝে কোমলতাকে খুঁজে পেতে সহায়তা করে, এবং অপ্রত্যাশিত স্থান থেকেও দয়ামায়ার উৎস খুঁজে নিতে শেখায়। এসব কারণেই লেখালেখি আমার জীবনের একটি মূল্যবান এবং আকর্ষণীয় অংশ হয়ে উঠেছে। অবশ্যই জীবনের আরও অনেক দিক রয়েছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। কিছুটা অলৌকিকভাবেই বলা যায়, লেখালেখির যে তারুণ্যময় আনন্দের কথা আমি শুরুতে বলেছিলাম, এতগুলো দশক পেরিয়ে গেলেও তা এখনও আমার মাঝে রয়ে গেছে।
শেষ করছি সুইডিশ একাডেমির প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আমার এবং আমার কাজের প্রতি এই মহান সম্মান দেওয়ার জন্য। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
উৎস লিংক: https://www.nobelprize.org/prizes/literature/2021/gurnah/lecture/
Copyright © The Nobel Foundation 2021
Bengali Copyriht © pratidhwanibd.com
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন