শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’
ষাটের দশকের (১৯৬০-১৯৬৯) প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬)। সর্বতোভাবে নাগরিক, প্রবল আত্মমগ্ন ও গভীর বিশ্লেষণপ্রবণ এই কবি—উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮), আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)—এই চারটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই বাংলা কাব্যধারায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা—বিরলপ্রজ এই কবির সপ্রতিভ গভীরতার অনন্য স্বাক্ষর। নগর জীবনের সমসাময়িক অস্থিতিশীলতা, হতাশা, নৈরাজ্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতা ও প্রেমহীনতায় কাব্যগ্রন্থটিতে এক কাঠিন্যের ব্যঞ্জনা অনুভূত হয়। ক্রমে প্রেমের প্রাবল্য ও এ-সম্পর্কে কবি-কল্পনার আধিক্য কাব্যটিতে দান করে কোমলতার লালিত্য। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের আলোকে নাগরিক ও ব্যক্তিগতজীবনের বৈক্লব্য কী করে ভালোবাসা ও প্রেমের মাধ্যমে আপাত-তিরোহিত হচ্ছে তার সূত্রানুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
|| ১ ||
বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ এক অধ্যায় ষাটের দশক (১৯৬০-১৯৬৯)। শাসকশ্রেণির অগণতান্ত্রিক আচরণ ও অনাচারের বিরুদ্ধে এই দেশের জনতা সংঘবদ্ধ হতে শেখে ষাটের দশকেই। আত্মশক্তি সম্পর্কে বিশ্বাসী হয়ে স্বৈরতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে বাঙালির প্রথম উদ্বুদ্ধ হওয়ার সময় ষাটের দশক। বিদ্যমান সমাজকাঠামোকে ভেঙে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন, স্বৈরশাসনের আগ্রাসন, আমলাতন্ত্রের প্রতাপ এবং এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থানে সমাজজীবনে এক পালাবদলের সুর সংযোজিত হয় এই সময়ে, যার অনুরণনে আন্দোলিত হয় শিল্প-সাহিত্যের প্রাঙ্গনও। সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এই ঘাতক সময়ের মুখোমুখি হন বাংলাদেশের শিল্পী ও সাহিত্যিকবৃন্দ এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্র থেকে উদ্যত করেন তাঁদের শৈল্পিক হাতিয়ার। বিষয়-বিন্যাস, মতাদর্শ ও আঙ্গিক-স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করেন নিজেদের অবস্থানকে। কাব্যজগতে এই নবস্বরের আঙিনায় ক্রমান্বয়ে আবির্ভাব ঘটে অরুণাভ সরকার (১৯৪১-২০১৪), রফিক আজাদ (১৯৪১-২০১৬), সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২-২০০৩), মোহাম্মদ রফিক (১৯৪৩-২০২৩), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), মহাদেব সাহা (জ. ১৯৪৪), আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩-২০২৩), নূরুল হক (১৯৪৪-২০২১), অসীম সাহা (১৯৪৯-২০২৪), নির্মলেন্দু গুণ (জ. ১৯৪৫), হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪), মাকিদ হায়দার (১৯৪৭-২০২৪), আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫), হুমায়ুন কবির (১৯৪৮-১৯৭২), মুহম্মদ নূরুল হুদা (জ. ১৯৪৯) প্রমুখের। শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) এই ধারাবাহিকতারই সংযোজন।
|| ২ ||
উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮)—মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই তিনি বাংলা কাব্যধারায় স্থায়ী হন। শহীদ কাদরীর শেষ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)-সহ বিচার করলে তাঁর কবিতার রূপান্তর ও ক্রম-উত্তরণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তাঁর কবিতার ‘প্রথম থেকে নগরের ব্যস্ত জীবন, নস্টালজিয়া, ক্লিন্নতা, রুগ্নতা, হীনতা, অবক্ষয় ও শূন্যতার চিত্র’ (শহীদ ইকবাল ২০১৩: ১০১)। ক্রমে উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন কবি আত্মপরিচয়ের সংকটে নিজের ব্যক্তিগত একাকিত্বে নিমজ্জিত হন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ উত্তরাধিকারকে তাঁর প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে ধরা হলে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমাকে কবির কাব্যপ্রতিভার বিস্তারের প্রকাশ বলা যায়। শাসনব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতি কটাক্ষ, নগরজীবনের ক্লান্তি ও হতাশা ইত্যাদির পাশাপাশি এই গ্রন্থ থেকেই তিনি ক্রমশ আত্মজৈবনিক, মানস উন্মোচনে অকপট এবং জীবন প্রসঙ্গে নিরাসক্ত ও নির্মোহরূপে প্রকাশিত হন। তাঁর কবিতার প্রবণতা ও কাব্যগ্রন্থের স্বল্পতা সম্পর্কে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের মন্তব্য স্মরণ করা যায়:
সময়, সমাজ, স্বদেশ, দূরদেশ, পরিপার্শ্ব এই সব নিয়ে কথা হয়—লেখকের রচনায় কী পরিমাণ প্রভাব ফেলে ওইসব। কিন্তু সময়, সমাজ, স্বদেশ, দূরদেশ, পরিপার্শ্ব ইত্যাকার বিষয় লেখককে রচনাবিমুখও করে।
(জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ২০১৬: ৪০)
কবির দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হলেও তাঁর কবিতা অক্ষয় উপাদান হিসেবে সজীব থাকে পাঠকহৃদয়ে। আর তাই কবির মৃত্যু হলেও কবিতা চিরঞ্জীব। ষাটের দশকের কবিত্বের উন্মত্ততায় শহীদ কাদরীর যে-স্বতন্ত্র অবস্থান, তা তাঁর অব্যবহিত পরেও বলিষ্ঠ আকার নিয়ে শক্ত একটা অবস্থানে স্থির থাকে পাঠকের সামনে। শহীদ কাদরী এমন একটি নাম, যেটি শুনলেই মনে পড়ে যায় ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট লেফট্’। কবির জন্ম কলকাতায় হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকার অলিগলিতে। নর্দমা, ডাস্টবিনের পচা গন্ধ কিংবা বাসের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে নিয়েই তাঁকে প্রতিনিয়ত ঘরের বাইরে বের হতে হয়েছে জীবিকার প্রয়োজনে। আর তাই ‘নাগরিক কবি’ অভিধাটি স্বভাবতই কবির প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর হয়ে ওঠে। বৃষ্টিবিধৌত নগর, উদ্বান্ত অস্থির মন, চোখ-ঝলসে-দেওয়া আলোকচ্ছটা, বিজ্ঞাপনের ঝিলিক, স্বাধীনতার মধ্যকার পরাধীনতা, শুশ্রূষাবিহীন জীবন, অর্থহীন সামাজিকতা এবং তার বিপরীতে কবির অবাধ্য মন কখনো ক্লান্ত পথিক হয়ে ‘লোহা’, ‘তামা’, ‘পিতল’ ও ‘পাথরের’ মধ্যে আশ্রয় খোঁজে। আর এই ক্লান্ত- বিধ্বস্ত কবি শহীদ কাদরী আর কেউ নন, ষাটের দশকের দেশ-কাল-রাজনীতি-সমাজনীতির পরিপূরকে কিংবা সম্পূরকে ব্যক্তির অস্থির মনস্তত্ত্বের ধারক। একান্ত নিঃসঙ্গতা ও তারই ফলে বেদনাবোধের যে অস্থিরতা—যা পরবর্তী কালে সময়ের পরম্পরায় এক জটিল রূপ ধারণ করেছে—তার বেড়াজালে আটকে-পড়ে-যাওয়া এক সাধারণ মানুষ শহীদ কাদরী, যিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চেয়েছেন কবিতাকে আশ্রয় করে।
সাহিত্যের মানদণ্ডে ষাটের দশকের সমৃদ্ধি নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। এই সময়ে যে-জমজমাট অবস্থা বিরাজ করছিল ঢাকায়, বিশেষত রাজনৈতিক ঘটনাগুলো—যেমন আটচল্লিশের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, মোটামুটি বিশাল এক সময়ের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে নির্মিত হয়েছে কবির কাব্যমনোজগৎ। আর তারই ধারাবাহিক প্রকাশ তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ। যদিও মধ্যবর্তী কিছু মাস জার্মানিতে, কিছু বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন কবি এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন আমেরিকায়, কিন্তু তাঁর মূল তিনটি কাব্যগ্রন্থ তার আগেই রচিত হয়ে গেছে ঢাকার মুমূর্ষু নাগরিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে। দৈনিক সংবাদ (১৯৫১)-এর কাজের চাপ কিংবা অস্বস্তিতে পরিপূর্ণ ঢাকায় বিপুল জনতার আলিঙ্গনের মাঝেও ‘অনাত্মীয়ের মতো একাকী’ কবির কবিসত্তার বিনির্মাণ ঘটেছে ঢাকা-কেন্দ্রিক নাগরিকতাকে অবলম্বন করে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, নগরকেন্দ্রিক এক কবিত্বশক্তির নাম শহীদ কাদরী। অবশ্য পূর্বসূরি সমালোচকদের মতো বায়তুল্লাহ্ কাদেরীও তাঁর এই প্রবণতাকে পাশ্চাত্য পঠনের সূত্রে সৃষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন:
আবাল্য নাগরিক এই কবির দর্শনচেতনা ও কাব্যবোধ নির্মিত হয়েছে মূলত তিরিশবাহিত বাংলা কবিতা এবং পাশ্চাত্য কাব্যপাঠের সূত্রে; অর্থাৎ বোদলেয়ার (Charles Baudelaire 1821-1867) ও এলিয়ট (T. S. Eliot 1883-1965)-র কাব্যপাঠে। ইঙ্গ-মার্কিন কবিতার সমকালীন প্রবাহও এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে।
(বায়তুল্লাহ্ কাদেরী ২০০৯: ৫৫-৫৬)
তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি রচিত হয়েছে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ বলা যায়, প্রায় এক দশকের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের নির্যাস ধারণ করে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। ফলে গ্রন্থটির শুরু থেকে শেষ অব্দি নির্মিত হয়েছে তৎকালীন ঢাকার সমসাময়িক অনিশ্চয়তা, নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতাকে মৌল উপাদান করে। পাশাপাশি ছিল কবির ব্যক্তিক অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতা, হতাশা ও অন্তহীন হাহাকার সেই সঙ্গে প্রেমহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে আক্ষেপ এবং পরবর্তী কালে সীমাহীন প্রেমসর্বস্বতার কারণে ভাবাবেগ ও ফ্যান্টাসি। ফলত কাব্যগ্রন্থের শুরু থেকে প্রবাহিত রাষ্ট্র ও নগরজীবনের দুর্ভেদ্য নাগপাশের ফলে উদ্ভুত কাঠিন্য ক্রমান্বয়ে কোমলতার দ্যোতনা সৃষ্টি করে। এই দ্যোতনাময়তায় আপাতত-মুক্তি ঘটে শাসনতন্ত্রের রক্তচক্ষু ও নাগরিক বিশৃঙ্খলা থেকে।
গ্রন্থের প্রারম্ভেই দেখা যায় রাষ্ট্রনীতির পরিচয়বাহী কবিতা ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফ্ট’। ব্যবহৃত ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি তার প্রকাশভঙ্গি ও ভাব মিলিয়ে যে কাঠিন্য ধারণ করে তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ বহন করছে কবিতাটি। কবিতাটির নামেই রাষ্ট্রতন্ত্রের কঠোর শৃঙ্খলার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্বাধীনতা দিবসের সাঁজোয়াবাহিনী, রেসকোর্সের কাঁটাতার, কারফিউ, মন্ত্রীর কালো গাড়ি, রাজবন্দি, মিছিল থেকে না—ফেরা শব্দগুলো ক্রমান্বয়ে কবিতার নামটিকেই বিস্তৃত করে তুলছে। রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আহত মজুরের গোঙানির শব্দে, নিষিদ্ধ প্যামফ্লেটে ও গোপন ছাপাখানার মাধ্যমে রাষ্ট্রতন্ত্রের পেষণ ও এর বিপরীতে পুঞ্জীভূত বিদ্রোহের আভাস পাওয়া যায়। ফুটবল-মাঠে উঁচু ডায়াসে রাখা মধ্যদুপুরের নিঃসঙ্গ মাইক্রোফোনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্তঃস্বারশূন্যতাও প্রকাশিত হয়েছে। ‘মহিলা বন্ধুর সঙ্গে এনগেজমেন্ট বাতিল’, ‘পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থ সেমিনার’ বাক্যাংশগুলোর মাধ্যমে যেমন রাষ্ট্রতন্ত্রের জড়ত্বের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি ‘নিহত সৈনিকের বিধবা স্ত্রী’ কিংবা ‘ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন যুদ্ধাহত’-এর চিত্রকল্প রাষ্ট্রের ব্যর্থতারই গোপন ছবি এঁকে যাচ্ছে। কিন্তু বিধবা স্ত্রীর সুপ্ত ক্রন্দন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারও চাপা পড়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের ‘লেফ্ট রাইট লেফ্ট’-এর পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে। এই কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা ও তার পৌনঃপুনিকতা শুধু রাষ্ট্রতন্ত্রের নিজের দুর্বলতার ঢাল; কবিতাটির শেষের দুলাইনে যার যথার্থ উপস্থাপন:
রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতা মানেই
লেফ্ট্ রাইট, লেফ্ট্ রাইট, লেফট্!
(শহীদ কাদরী, ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাই লেফ্ট’ ২০১০: ১২)
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কবির কাম্য ছিল, কিন্তু রাষ্ট্রের কথায় তিনি ফিরে যান পূর্ববর্তী শঙ্কাগ্রস্ত সময়ে, যেখানে তিনি সম্মুখীন হয়েছিলেন ১৪৪ ধারা, সাঁজোয়াবাহিনী, ধাবমান খাকি জিপের মতো আতঙ্ককর পরিস্থিতির। কবিতাটি সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
নগর রাষ্ট্রে পরিণত এবং নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পন্ন। ঐ সময়ে বিশ্বময় চলছে কোল্ড ওয়র, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং আগ্রাসন-বিরোধী সংগ্রাম। গোটা পৃথিবীতে চাষাবাদ অস্থিরতার। এ-অবস্থায় সংকোচন-প্রসারণে নির্ধারিত হয় কবির কর্মজগৎ তথা কবিতার বিশ্ব। কবির উপমা-চিত্রকল্প যেন তৈরি হয়ে যায় তাঁর চারপাশে। কবির অস্থিরতা এবং পৃথিবীর অস্থিরতা দু’য়ের হামলা টের পাওয়া যাচ্ছে কবির পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায়।
(মহীবুল আজিজ ২০১৩: ১৫৪)
সমকালীন মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা অভিব্যক্ত হয়েছে ‘সেলুনে যাওয়ার আগে’ কবিতাটিতে। এ কবিতায় কবির আবির্ভাব ‘আউটসাইডার’ রূপে। কবি আউটসাইডার হয়ে প্রকাশিত হতে অনিচ্ছুক, তাই সামাজিক হতে গিয়ে নিজের অবাধ্য চুলকে বাধ্য করতে অর্থাৎ লম্বা চুল কেটে ছোট করে ভদ্রস্থ হতে কবিকে যেতে হচ্ছে সেলুনে। শাসন মানতে না চাওয়া কবির মনের এক সার্থক রূপক তাঁর ক্রমলক্ষমান চুল, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিশীলিত বন্ধুবান্ধব, সামাজিক শৃঙ্খলা সমগ্র কিছুকে অগ্রাহ্য করে এই চুল বেড়ে উঠছে ‘কদর্য কাকের মতো’ই। সুশীল সমাজের কাছে কবির এই চুলের অহঙ্কার সহনীয় নয়, তাই দশজন সাধারণ মানুষের মতোই তাকে ছোট হতে হবে। ‘উগ্র’ চুলের ‘অসামাজিক’ কবি সামাজিক হতে তাই সেলুনে চলেছেন। তারপরেও কথা থেকে যায়:
তবুও সে আমার চুল
অন্ধ
মূক ও বধির চুল মাস না যেতেই
আহত অশ্বের মতো আবার লাফিয়ে উঠছে অবিরাম
(শহীদ কাদরী, ‘সেলুনে যাওয়ার আগে’, ২০১০: ১৪)
পঙ্ক্তিটি কবির অনিয়ন্ত্রিত মন, যাকে শতচেষ্টাতেও নিয়মের মাঝে আটকে রাখা যাচ্ছে না, তারই শৈল্পিক রূপায়ণ। কবি প্রচলিত মূল্যবোধের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে চান সামাজিকতার খাতিরে, কিন্তু তাঁর অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খল মনোভঙ্গিকেও চেপে রাখতে পারেন না। একই সঙ্গে সামাজিক হতে না পারার বেদনাবোধ ও অহংকারের দ্বৈরথেও তিনি আক্রান্ত হন।
শহীদ কাদরীর কবিতার সাধারণ সুর আত্মনিমগ্নতা। চলমান নৈরাজ্যে কবি কীভাবে ক্রমান্বয়ে আত্মমগ্ন হয়ে স্কিৎসোফ্রেনিক (মানসিক রোগাক্রান্ত) হয়ে উঠছেন তারই প্রকাশ ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া’ কবিতাটি। কবিতার শুরুতেই একটা উত্তাপ পাওয়া যায়। ‘চারদিকে বিস্ফোরণ করছে টেবিল’ বাক্যটির মধ্য দিয়ে আমরা এক চাঞ্চল্য টের পাই, যাকে আরও প্রগাঢ় করে তুলছে ‘জরুরি চিঠির মাঝামাঝি শব্দ-চিহ্ন দিতে’ ভুলে যাওয়া সেক্রেটারি। ঠিক পরের পঙ্ক্তিতে ‘হেমন্তের বিবর্ণ পাতার মতো ঝরে পড়া জাহাজব্যাপারির ধারালো জিহ্বা’ সামাজিক অবক্ষয় ও অন্তঃসারশূন্যতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ‘ক্রমশ পেটের মধ্যে গর্জে ওঠা গ্রেনেডের শব্দ’, ‘হলুদ গন্ধক-ঠাসা শিরা’, ‘হৃদয়ের মধ্যে ছদ্মবেশী গেরিলার উপস্থিতি’, ‘ট্যাঙ্ক’, ‘রক্তের সাঁকো’, ‘গোলন্দাজ’ প্রভৃতি উপমার মাধ্যমে যা শিল্পিত হচ্ছে, তা বর্তমানে দাঁড়িয়ে পূর্ববর্তী ভয়ঙ্কর স্মৃতিসুদ্ধ উসকে দিচ্ছে। অবশ্য এর বিপরীতে অবস্থান কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকের।
একটি চিৎকারে ঝলসে গেলো কয়েকটা মুখ,
একটি নিবিড় আলিঙ্গনের আয়ুষ্কালে
৬০,০০,০০০ উদ্বাস্তুর উদ্বিগ্ন দঙ্গল
লাফিয়ে উঠলো এই টেবিলের ’পর;
বেয়নেটের ছিঁড়ে যাওয়া নাড়ি-ভুঁড়ি চেপে,
বাম-হাতে রেফ্রিজারেটর খুলে পানি খেলো
যে লোকটা, তাকে আমি চিনি, কতবার তার সাথে
আমার হয়েছে দেখা
পত্রিকার স্টলে
প্যান-আমেরিকানের বিজ্ঞাপনে
(‘সেলুনে যাওয়ার আগে’, ২০১০: ১৪)
ধারণা করা যায়, কবির পূর্বপরিচিত এই লোক, যে ফ্রিজ খুলে পানি পান করল, সে কবির আপন সত্তা। হয়তো তাই, কবি মহা-উল্লাসে নিজেই নিজেকে নিমন্ত্রণ। করেন প্রাত্যহিক ভোজনোৎসবে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা নানা ধরনের। মাংসের নানা দেশীয় রান্নার সুবাসে যে-ভিন্নার্থক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, কবিতার ভাবনাকে যে-অনন্য কৌশলে গ্রথিত করেছে, তা তার নামভূমিকায় সার্থক রূপ লাভ করতে পেরেছে। কবিতাটি সমকালীন অস্থিরতাকে মর্মে-মর্মে ধারণ করেছে। কবির মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। এ-সময়ের প্রায় প্রতিটি মানুষ এমনই এক স্কিৎসোফ্রেনিক। ব্যক্তিমানসের অস্থিরতার আরেক উদাহরণ ‘ছুরি’, আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায় ‘পাখিরা সিগন্যাল দেয়’ কবিতায়। আবার নগর জীবনে ব্যক্তির টিকে থাকার লড়াই ও অনিশ্চয়তার শৈল্পিক উপস্থাপন ‘টাকাগুলি কবে পাবো?’ কবিতাটি।
‘নিষিদ্ধ জর্নাল থেকে’ কবিতাটির নামই সমকালের গোপন ইশতেহারটি প্রকাশ করছে। ইশতেহারটি অবশ্য প্রথম দিকে একটা শাদামাটা ডায়েরিই ছিল, কালে যা 'নিষিদ্ধ জর্নাল' হয়ে উঠছে। কবিতাটির নামের মাঝেই ভিন্ন দুই অর্থের সন্ধান পাওয়া যায়; প্রথমত, সময়টা এমন যেখানে বাক-স্বাধীনতা নেই। অধিকার নিয়ে উচ্চরব হচ্ছে নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, এর মধ্য দিয়েই পুঞ্জীভূত হচ্ছে বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহ ক্রমশ পথ খুঁজে নিচ্ছে বিস্ফোরিত হওয়ার। কবিতার শুরুটা লক্ষ করা যাক:
রেস্তোরাঁ থেকে যে ছেলেটা রোজ
প্রাতরাশ সাজিয়ে দিতো আমার টেবিলে
তে-রাস্তার মোড়ে তাকে দেখলাম শুয়ে আছে রক্তাপ্লুত শার্ট প’রে,
বন্ধুর ঘরে যাওয়ার রাস্তায় ডিআইটি মার্কেটের ভস্মাবশেষ,
প্রতিরোধের চিহ্ন নিয়ে বিবর্ণ রাজধানী দাঁড়িয়ে রয়েছে,
তার বিশাল করিডোর শূন্য।
(‘নিষিদ্ধ জর্নাল থেকে’, ২০১০ : ২৯)
প্রকরণগত প্রচেষ্টাহীন এই আটপৌরে কাব্যভাষার কারণেই পঙ্ক্তিগুলো নির্মোহ ভঙ্গিতে বয়ান করছে সেই সময়ের নৃশংতার কথা। যে ছেলেটা প্রতিদিন কবির টেবিলে সকালের নাস্তা রেখে যেত, রাস্তার মোড়ে পড়ে থাকা তার মৃতদেহও কবির হৃদয়ে কোনো রেখাপাত ঘটায় না আজ। কেননা, অহরহ ঘটে যাওয়া এমন নৃশংস যজ্ঞে কবি এখন অভ্যস্ত। আর তাই এক সময়কার জমজমাট ঢাকা নগরীর খাঁ-খাঁ শূন্যতায়ও কবি নির্লিপ্ত থাকেন, কারণ সময়টা নির্লিপ্ত থাকার, নিশ্চুপ থাকার। কবির অন্তরালের হাহাকার উহ্য থাকে বলে পাঠকের দ্বিধান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সবাই এই শহর ছেড়ে চলে গেলেও কবির মতো কেউ-কেউ ধ্বংসস্তূপ আঁকড়ে পড়ে থাকেন। কেননা তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। পরিত্রাণের কোনো উপায়ও তাদের জানা নেই। ‘পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলার আঘাতে ভেঙে যাওয়া ভায়োলিনের মতো বাংলাদেশ’ বাক্যটি ও ‘মৃত কিশোর’ শব্দদুটির মধ্য দিয়ে হিরণ্ময় দেশমাতৃকার পচনশীলতা দেখানোর চেষ্টা করা হলেও, পরবর্তী স্তবকেই কবি কারফিউ শুরু হওয়ার ঠিক আগেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে শুনিয়ে দেন কয়েকটি অক্ষর, ‘স্বা-ধী-ন-তা’। মৃতপ্রায় শহরে, ধ্বংসস্তূপের মাঝে, অন্ধকার নিয়তির মধ্যেও মানুষ খুঁজে পেতে চায় একবিন্দু আলোর আভাস, বেঁচে থাকার অবলম্বন। দীর্ঘশ্বাসেও গোপন থাকে আশার আশ্বাস। আর তাই ‘স্বা-ধী-ন-তা’ শব্দটির সৃষ্টি অজান্তে ও অন্যমনস্কভাবে হলেও সেটা হয়ে ওঠে একক সৃষ্টি। সময়ের সৃষ্টি, সময়ের দাবি। কবিতাটির যে বিশেষ দিকটি লক্ষণীয়, তা হলো নৃশংসতার বয়ানে নির্মোহ ভাবভঙ্গির সঙ্গে সময়ের প্রয়োজনের অভূতপূর্ব সম্মিলন। সমসাময়িক অনিশ্চয়তা, শাসনব্যবস্থার নৈরাজ্য ও যুদ্ধোত্তর হতাশার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় ক্রমান্বয়ে ‘আইখম্যান আমার ইমাম’, ‘একবার দূর বাল্যকালে’ ও ‘যুদ্ধোত্তর রবিবার’ প্রভৃতি কবিতায়। আবার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কবির মনোভাব, তাঁর দৃষ্টিতে স্বাধীনতার স্বরূপ প্রকাশিত ‘স্বাধীনতার শহর’ কবিতাটি:
স্বাধীনতা, তুমি কাউকে দিয়েছ সারাদিন
টো-টো কোম্পানির উদ্দাম ম্যানেজারি করার সুবিধা
(‘স্বাধীনতার শহর’, ২০১০: ৩৫)
ভাবের দিক থেকে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি কবিতাটিকে কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯- ২০১৬) ‘স্বাধীনতা তুমি’ (বন্দী শিবির থেকে, ১৯৭২) কবিতার অনুগামী মনে হলেও দুটি কবিতাই ভিন্ন আঙ্গিকের। আবার ‘হে হিরণ্ময়’ কবিতায় কবি শ্রান্ত শরীরে বিশ্রাম নিতে আজকাল যে চেয়ার দেখেন সেটিকে তার পোষমানা বাঘের মতো মনে হয়। নির্ভর করার মতো তিনি একটি বেঞ্চি কিংবা টুলও খুঁজে পান না। তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে শৈশবের অদম্য জাহাজরূপী সেই হাতলহীন চেয়ারটিরই অনুসন্ধান করছেন, আজ যেখানে বসে অন্তত কোনো তরুণ কবির কণ্ঠ শুনে হৃদয় জুড়াতে পারেন। কবিতায় ব্যবহৃত ‘হিরণ্ময় চেয়ার’ কবির সুপ্ত আকাঙ্ক্ষারই রূপক।
‘ব্ল্যাকআউট’ শব্দটি ঘুরেফিরেই এসেছে শহীদ কাদরীর কবিতায়। এই গ্রন্থের ‘ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়’ কবিতাটি ছাড়াও এই শব্দটির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধচলাকালীন জরুরি অবস্থা বোঝাতে আইন প্রয়োগ করে সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতিই ব্ল্যাকআউট। এছাড়াও শব্দটির নানামাত্রিক অর্থ আছে। নেশা-পরবর্তী ঘুমভাঙা অবস্থায় পূর্ববর্তী স্মৃতির বিলোপকেও ব্ল্যাকআউট বলা হয় এবং এটিও বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। তবে কবি যে প্রথম ব্যবহারকেই বিবেচনা করেই কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন তা কবিতাপাঠেই অনুমেয়। কেননা এই কবিতায় শব্দটি যুদ্ধের অসহায় অবস্থার দ্যোতক হিসেবে এসেছে। কোনো দেশের উত্থান কিংবা পতন দুটিই নির্ভর করে রাষ্ট্রনীতির উপর। সম্ভাবনার নিয়ন্ত্রকও রাষ্ট্রতন্ত্র। নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শাসনব্যবস্থা প্রয়োজনে দেশের সম্ভাবনার সকল আলো লুকিয়ে ফেলতে পারে। দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্রীড়াদণ্ডের অধিকারী শাসনতন্ত্র—এই বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে ‘ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়' কবিতায়। কবিতাটিতে ‘পূর্ণিমা’ শব্দটি একটা ভিন্নমাত্রা যোজনা করে। এর প্রথম চারটি স্তবকে ক্রমান্বয়ে বিকশিত স্বদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়, যা শৃঙ্খলিত বিদেশি পতাকার নিচেও প্রজ্জ্বলিত থাকে নিজস্ব আলোয়। ‘প্রচণ্ড শীতের রাতে’ও ‘ধমনীতে অনুভব করে আকাঙ্ক্ষার উত্তাপ’ যাতে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যঞ্জনা অনুভূত হয়। শেষ অর্থাৎ পঞ্চম স্তবকে কবি কবিতার মধ্যকার ভাবটিকে উন্মুক্ত করে দেন এভাবে:
আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিল নিদারুণ নির্বিকার,
সুরক্ষিত দুর্গের মতন আমাদের প্রতিরোধে সে হলো সহায়,
ব্ল্যাকআউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে
বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলো দেখেছি:
আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হ’য়ে
(‘ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়’, ২০১০: ৩৪)
কবিতাটি তৎকালীন প্রেক্ষাপটের সম্পূরক এক কম্পন তৈরি করে পাঠকমননে। আবার ব্ল্যাকআউটের অন্ধকারেও পূর্ণিমার আলোয় উদ্ভাসিত উঠোনের যে-চিত্রকল্প ভেসে ওঠে তা দিভ্রান্ত নাবিকদের বাতিঘর-অভিগামিতাই মনে করিয়ে দেয়। ‘ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়’ কবিতাটি সমকালীন শাসনব্যবস্থার নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শৈল্পিক রূপায়ণ।
প্রেম, ভালোবাসা ও কামনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ পাওয়া যায় তার প্রেম পর্যায়ের কবিতাগুলোয়। শব্দ, কল্প, ভাব, ভাষা আর রূপের অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে তার এই পর্বের কবিতাগুলোয়। এইসব কবিতায় সর্বজনীন প্রেমের রূপ যেমন এসেছে তেমনই প্রকাশিত হয়েছে প্রেমের ব্যর্থতা হাহাকার ও শূন্যতার চিত্রও। এই পর্বের ‘মাংস মাংস মাংস’ কবিতাটি ব্যর্থ-প্রেমের নান্দনিক রূপায়ণ, প্রেমানুসন্ধানে ব্যর্থ কবির কামনায় আসক্ত হওয়ার প্রকাশ। ডব্লিউ, বি. ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩১) ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের (১৯০১-১৯৬০) যুগপৎ প্রভাব উপলব্ধ হয় কবিতাটিতে। মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাটি ভাব, ভাষা, অলঙ্কার ও চিত্রকল্পের সুসমন্বয় আর পরিমিতিবোধের শিল্পিত উপস্থাপন। কবি শুরুতেই জানিয়ে দেন:
আমাকে রাঙাতে পারে তেমন গোলাপ
কখনও দেখি না।
(‘মাংস মাংস মাংস...’ ২০১০: ৩১)
কবিতার প্রারম্ভেই ব্যবহৃত ‘কখনও’ শব্দটি কিছুটা অস্বস্তিকর মনে হয়। বরং ‘কোথাও’ শব্দটি ইতিবাচক অর্থদ্যোতক। কিন্তু পরের পঙ্ক্তিতে ‘তবে কাকে, কখন, কোথায়/ধরা দেবো’ শব্দগুলোয় অভিব্যক্ত হয় পূর্ববর্তী পঙ্ক্তির ‘কখনও’ শব্দটির যৌক্তিকতা। কবি প্রথমেই ‘কখনও’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন পরের ‘কাকে, কখন, কোথায়’ শব্দগুলোকে অর্থবহ করবেন বলে। প্রথম দুই পঙ্ক্তিতেই কবিতাটির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঠ না করলে সমস্ত কবিতার শক্তি সম্পর্কে অজানাই থাকতে হয়। সম্পূর্ণ কবিতাটিতে শব্দের খেলা একে ভিন্নতর যোজনা যুক্ত করে। শব্দ নিয়ে এই সচেতন ক্রীড়া কবিতাটিকে আড়ষ্ট করেনি, বরং এক ধরনের প্রাঞ্জলতা দান করেছে। আর ভাবের বিচারে বলা যায়, যে নির্দিষ্ট গোলাপটি কবি পছন্দ করেন, সেটির দেখা পান না। কিন্তু ইতস্তত বিচরণে তিনি দেখতে পান গোধূলিবেলায় সবকিছুই লাল দেখায়—যা গোলাপের লাল নয়, বারাঙ্গনার মুখের সস্তা ‘রুজ’-জাতীয় প্রসাধনের রঙিন আভার সঙ্গে যার লালিমার তুলনা করা যায়। গোধূলি নিজেই বিভ্রমসৃষ্টিতে সিদ্ধ। কবি তাই বিভ্রান্ত হন—ভালোবাসা নয়, কামনায়; ‘মাংস’ সেই কামনার প্রতীক। কামনার প্রতীক হিসেবে কবি মাংসকে ঘুরেফিরে ব্যবহার করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থের ‘বন্ধুদের চোখ’ কবিতাটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ‘মাংস, মাংস, মাংস...’ কবিতায় রংহীন শৈশবের রঙের অনুসন্ধানে তারুণ্যে এসে কবি দেখলেন ‘ছুরির ডগার চকমকে ঔজ্জ্বল্য’, কিন্তু তার অনর্থের দিক সম্পর্কেও কবি ওয়াকিবহাল থাকেন এবং এর পরেই তিনি আক্রান্ত হন দ্বান্দ্বিকতায়:
তবে কি হাত রাখবো ছুরির বাঁটে? সবুজ সতেজ
রূপালি রেকাবে রাখা পানের নিপুণ কোন খিলি নয়,
(‘মাংস, মাংস, মাংস...’, ২০১০: ৩১)
তিনি ছুরির বাঁটে হাত রেখে সবুজ কেটে লাল রক্ত বের করতে চান। এটি সেই সবুজ যেখানে খিলিপানের সতেজতা নেই। তারপরও এর মধ্যেই কবি খুঁজে ফেরেন হারানো শৈশবের তারুণ্যের রাঙানো দিনগুলো। একটি অবুঝ ও সবুজ হৃদয় কী করে গোলাপের লালের সতেজতার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বারাঙ্গনার সান্নিধ্যে ক্রমেই বস্তুবাদী হয়ে ওঠে তারই শিল্পসফল প্রকাশ ‘মাংস, মাংস, মাংস...’ কবিতাটি। ‘একবার শানানো ছুরির মতো’ কবিতাটিও প্রেম প্রসঙ্গে কবির আস্থাহীনতার রূপায়ণ। ‘জতুগৃহ’ দুর্বিষহ প্রেমের শৈল্পিক কথন। অপরপক্ষে ‘গোধুলি’, ‘এই সব অক্ষর’ তারই পরিচয়বাহী। ‘এই সব অক্ষর’-এ কবি প্রেমের যাতনা থেকে মুক্ত এক খাঁটি প্রেমিক। যিনি প্রেয়সীর নাম লেখার জন্য ‘নিসর্গের স্বাচ্ছ থেকে বর্ণমালা ধার করেন, ‘সভ্যতার কাছ থেকে’ চেয়ে নেন ছুরি। তবে এই পর্বের কবিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন কবি, বিশেষত ভাঙাগদ্য। ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ কবিতায় প্রবহমান ভাঙাগদ্যেরই স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ দেখা যায়:
ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
(‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’, ২০১০: ৫৯)
কবিতাটির সূত্রে আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম কবিতায় পুনরায় দৃষ্টিপাত করা যাক, ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট্ রাইট লেফট্ সেনাবাহিনীর এই মার্চপাস্টে কাব্যের শুরুতেই যে শাসনতন্ত্র ও কঠোর শৃঙ্খলার পরিচয় পাওয়া যায়, ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’য় এসে মনে হয়, প্রথম কবিতাটির ভাবনারই বিনির্মাণ ঘটছে গ্রন্থশেষের এই কবিতায়। ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট, লেফ্ট’ ভেঙেই নতুন করে গড়ে উঠছে ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা'। কেননা, এই কবিতাটির ভাষাভঙ্গিতে—যা সকল বস্তুবাদী শব্দের মধ্যেও নিজস্ব এক ঐন্দ্রজালিক আবহের সৃষ্টি করে—প্রথম স্তবকেই আমাদের সেই পূর্ববোধে ফিরিয়ে নেয় যে, আমরা প্রথমে রাষ্ট্রকে পেয়েছি নিয়মনীতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে। একই সঙ্গে সেই বোধেই আর এক নতুন বোধ জন্ম নেয় যে, সেই একই রাষ্ট্র এবার ভিন্ন নীতিতে, ভিন্ন সাজে সজ্জিত হচ্ছে কেবল কবির মানসপ্রতিমাকেই অভিবাদন জানানোর জন্য। কবি অবশ্য ‘আমি এমন ব্যবস্থা করবো’ বাক্যের মাধ্যমে পাঠককে এটিও জানিয়ে দেন যে, প্রযোজিত কর্মকাণ্ডে কবি নিজেই ক্রিয়াশীল থাকবেন। নয় স্তবকে লেখা কবিতাটির সাতটি স্তবকই শুরু হয়েছে ‘ভয় নেই’ শব্দ দুটিকে অবলম্বন করে এবং এর পরেই জানা যায়, কবি কী-কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাঁর মানসপ্রিয়াকে অভিবাদন জানানোর জন্য। সেনাবাহিনী বন্দুককামান ফেলে কাঁধে গোলাপগুচ্ছ নিয়ে মার্চপাস্ট করে যাবে, অস্ত্রযানগুলো অস্ত্র ফেলে ভায়োলিনসাজে সজ্জিত হবে, মিগ-৫২ কিংবা মিগ-২১ নামক যুদ্ধবিমানগুলো গোলাবর্ষণের পরিবর্তে চকলেট, টফি ও লজেন্স বর্ষণ করবে। ‘চকলেট’, ‘টফি’ ও ‘লজেন্স’ শব্দতিনটির ব্যবহারে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে কবি যে তীব্রতার দেন, তা কবিতাটিতে উপস্থাপিত বর্তমানের আধুনিক রূপকটিকেই যেন প্রকট করে দেয় আমাদের চোখে। এই শব্দত্রয় ‘ভালোবাসা’, ‘আদর’ ও ‘চুম্বন’-এর প্রতিনিধিত্ব করছে এই সময়ে এসে।
এরপর আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সবগুলো গণভোট পাবে শুধু একজন প্রেমিক, যিনি কবি নিজেই। বিরোধী দলের অধিনায়ক হবেন গায়ক, সীমান্তরক্ষীর ভূমিকায় অস্ত্রকাঁধে হিংস্র চেহারার রক্ষীর বদলে থাকবে লাল-নীল-সোনালি মাছ। মাছগুলো আসলে কী মাছ? আমাদের চোখে ভেসে ওঠে অ্যাকুয়ারিয়ামের গোল্ডফিশ যেগুলো রঙিন আভা নিয়ে অনাবিল ভালোবাসাই বিলিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। কবি আরও জানিয়ে দেন, সীমান্তে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো চোরাচালান নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। প্রতিটি স্তবকেই যুদ্ধের ভয়াবহতা নির্ণয়কারী শব্দসমূহ ক্রমে ভিন্ন সব চিত্রকল্পের অবতারণা করছে, যেগুলোর উপমা, রূপক প্রভৃতির বিচার শেষে পাঠককে ‘ভালোবাসা’ শব্দটির সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে এই ভালোবাসার অবস্থান কবিতায় ব্যবহৃত রাষ্ট্রতন্ত্রের নিয়মনীতি ও বস্তুবাদিতার বিপরীতে। প্রায় প্রতিটি পঙ্ক্তিই বাস্তবতা ভেঙে এমন এক অপার্থিব জগতে পাঠককে ভ্রমণ করায়, ভাবনাগুলো খুব উদ্ভট জেনেও তাদের হয়তো বিশ্বাস করতে পারে যে, ‘একটি লাল গোলাপ’ কিংবা ‘চন্দ্রমল্লিকা’ ভাঙালে অন্তত ‘চারলক্ষ টাকা’ পাওয়া যাবে। ‘একটি বেলফুল’ দিয়ে পাওয়া যাবে ‘চারটি কার্ডিগান’। এত অঙ্ক এত সংখ্যা থাকতে চার অঙ্কটিকেই কবি বেছে নিয়েছেন, হয়তো চারকে জোড় সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করে। এই জোড় সংখ্যা হয়তো যুগল প্রেমের উপলব্ধিজাত। কবি শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রিয়াকে সম্ভাষণের জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেন কঠোর রাষ্ট্রতন্ত্রকেই ব্যবহার করে:
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা
(‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’, ২০১০: ৫৯)
সমকালীন রাজনৈতিক নৈরাজ্যের মধ্যেও জীবনের সুন্দরতম রূপকল্প কবি দেখতে পান, যা বিপরীতমুখী কিন্তু সাধারণ কাব্যভাষার মধ্য দিয়েও এক অনুপম মুগ্ধতার বিনির্মাণ ঘটিয়ে যায়। ‘রাষ্ট্র মানে লেফ্ট রাইট লেফ্ট’ কবিতাটির পরের এই কবিতা সমস্ত গ্রন্থের পাঠের ভেতরের পাঠে নিয়ে যায় পাঠককে। ফলে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, গ্রন্থটির নামকরণের যৌক্তিকতাও। রাষ্ট্রতন্ত্র তার প্রতিটি নিষ্ঠুর ক্রিয়াকৌশল ভুলে গিয়ে সদর্থক ভঙ্গিতে কবির প্রিয়তমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে—এই পরিস্থিতি কষ্ট-কল্পনা হলেও পাঠক এর ইতিবাচক আবেদনকেই সম্মান জানায়। এভাবেই ‘সমুদয় বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা, অনাচার থেকে আচার, অশান্তি থেকে শাস্তি, অপকর্ম থেকে কর্ম এবং অস্ত্রের বদলে পুষ্পকে আবাহন করেন কবি’ (হাবীবুল্লাহ সিরাজী ২০১৬: ৯৮)। এটি স্পষ্ট যে কবির কাব্যরচনার কাল বাংলাদেশের অস্থির সময়, আর তাই গ্রন্থটিতে উঠে এসেছে স্বাধীনতা—কারণ তা অন্তর্বর্তী ও পরবর্তীকালের অস্থিরতা, চেতনার মাঝে ভূতের ও পূর্ববর্তী, পাশাপাশি উঠে এসেছে নাগরিক চেতনার মাঝে স্মৃতিকাতরতা ও বস্তুনিষ্ঠ প্রেম এবং প্রেম-ভালোবাসা ও কামনার অন্তরালে সুপ্ত থাকা অন্তহীন অবসাদ। গ্রন্থটিতে ক্রমশ এক খাঁটি আধুনিক কবির সন্ধান পাওয়া যায়, বিনি আত্মমগ্ন অবস্থায় যে নিজস্বতার প্রকাশ করেন, তা ক্রমেই তাঁকে নার্সিসিস্ট করে তোলে। জীবন সম্পর্কে ইতিবাচকতার ইঙ্গিত দিয়েও তিনি আত্মবিবরে গুটিয়ে যান। সমালোচক যথার্থই বিশ্লেষণ করেছেন:
কবিতার আদ্যন্ত পাঠ থেকে তাঁর চেতনার এক ধরনের রূপান্তরের পরিচয় আমরা লাভ করতে পারি। এই রূপান্তর নিঃসন্দেহে চরম শূন্যতা থেকে, আশ্রয়হীনতা থেকে, অবক্ষয়ের অন্ধকার থেকে একটা ইতিবাচক বোধের দিকে ধাবমান। কিন্তু কবির মেধাবী সূক্ষ্ম নাগরিক দৃষ্টি বারবার রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েই আত্মসংবরণ করেছে।
(রফিকউল্লাহ খান ২০০২: ১৫১)
ভাবের গভীরতা, কাব্যভাষা নির্মাণে অনাড়ম্বর ভঙ্গি, ব্যাকরণগত কাঠামো-সৃষ্টির বিশিষ্টতা, শব্দপ্রয়োগের মুন্সিয়ানা, সুগভীর ছন্দজ্ঞান, অলঙ্কার-ব্যবহারে পরিমিতিবোধ প্রভৃতির সমন্বয়ে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা বিশেষ ভাব ও শিল্পসমৃদ্ধ কাব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়:
তার প্রতিটি কবিতাই বুদ্ধি দীপ্ত ও ঝকঝকে। তার ভাষা অত্যন্ত ঋজু সংকেতময় ও তীব্রগতিসম্পন্ন। ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নিরক্ত ধমনিতে শহীদ নতুন রক্তোচ্ছ্বাস এনে দিয়েছেন। স্বোপার্জিত মুদ্রা অঙ্কিত করেছেন তার কাব্যপ্রতিমায়।
(বেলাল চৌধুরী ২০১৬: ৪৩)
তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কাব্যগ্রন্থটি বহির্পাঠ ও অন্তর্পাঠ দুইয়ের মাধ্যমেই পাঠককে জানান দেয় যে, রাষ্ট্রতন্ত্রের কঠোরতাকে ভেঙে দিয়ে তার ভেতরের মানবিকতাবোধের জাগরণের প্রথম প্রয়াস কবি তাঁর পক্ষ থেকেই শুরু করতে চান—এক বিচ্ছিন্ন মানস নিয়ে ও রাষ্ট্রের অংশ হয়েই। মননশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাব্যভাষায় ব্যক্তি ও সমাজজীবনের টানাপড়েনকে তিনি গভীর আসক্তি ও অনাসক্তির দ্বৈরথে রূপ দেন পরিণত কাব্যরুচিতে।
‘তাঁর উপমা ও প্রতিমা দুই-ই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিতুলনার দক্ষতায়, দুই মেরুর একত্রনিবেশে, দুই স্তনের সন্দীপক যৌথ ভূমিকায়’
(আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১৬: ১০৭)।
|| ৩ ||
সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কাব্যগ্রন্থটিতে দেশ-কাল-রাজনীতি, আত্মজৈবনিকতা, মানস-উন্মোচন, প্রেম-ভালোবাসার বিভিন্ন পর্যায়ের উপস্থাপনে অর্থাৎ ভাবের সদর্থক ও নঞর্থকের সংকট শেষে পাঠকমননে শেষ পর্যায়ে অনুরণন জাগায় ইতিবাচকতার। ‘রাষ্ট্র মানে লেফ্ট রাইট লেফ্ট’-এর কাঠিন্যের কোমল রূপান্তর ঘটে ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’য় রাষ্ট্রের দ্বারা কবিপ্রিয়াকে অভিবাদন জানানোর মাধ্যমে। রুক্ষ ও রুদ্র পরিবেশের মাঝে একে বিনির্মাণ করেই তিনি হয়ে ওঠেন ভালোবাসার কবি। আর মাঝখানে তিনি পাঠককে ভ্রমণ করিয়ে নেন এক অস্থির অবরুদ্ধ নগরের মধ্য দিয়ে, যেখানে সবাই চলে গেলেও কবি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর নাগরিক যন্ত্রণাকে ধারণ করে।
রচনাপঞ্জি
আব্দুল মান্নান সৈয়দ (২০১৬): ‘শহীদ কাদরী’, শালুক, সম্পাদনা: ওবায়েদ আকাশ, বর্ষ ১৮, সংখ্যা ২১, ঢাকা
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (২০১৬): ‘ব্যক্তিগত শহীদ’, শালুক, সম্পাদনা: ওবায়েদ আকাশ, বর্ষ ১৮, সংখ্যা ২১, ঢাকা
বায়তুল্লাহ্ কাদেরী (২০০৯): ‘যাটের দশকের কবিতা: বিষয়’, বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা: বিষয় ও প্রকরণ’, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা
বেলাল চৌধুরী (২০১৬) : ‘আড্ডাবাজ এক কবি’, শালুক, সম্পাদনা: ওবায়েদ আকাশ, বর্ষ ১৮, সংখ্যা ২১, ঢাকা
মহীবুল আজিজ (২০১৩): ‘যাটের কবিতা’, নান্দীপাঠ, সম্পাদনা: সাজ্জাদ আরেফিন, সংখ্যা ৫, ঢাকা
রফিকউল্লাহ খান (২০০২) : ‘শহীদ কাদরী’, বাংলাদেশের কবিতা: সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর, একুশে পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা
শহীদ ইকবাল (২০১৩): ‘বিশীর্ণ নাগরিক নক্ষত্র: ১. আব্দুল গনি হাজারী ২. শহীদ কাদরী ৩. সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্’, বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস: ১৯৪৭-২০০০, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা
শহীদ কাদরী (২০১০) : ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট্ রাইট লেফট’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
(২০১০): ‘সেলুনে যাওয়ার আগে’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
(২০১০): ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
(২০১০): ‘নিষিদ্ধ জর্নাল থেকে’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
(২০১০): ‘মাংস, মাংস, মাংস...’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
(২০১০): ‘ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
(২০১০): ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, অবসর, ঢাকা
হাবীবুল্লাহ সিরাজী (২০১৬): ‘দাঁড়াও আসছি’, শালুক, সম্পাদনা: ওবায়েদ আকাশ, বর্ষ ১৮, সংখ্যা ২১, ঢাকা
তথ্যবহুল উপস্থাপনা!
রুমি আক্তার
জানুয়ারি ১১, ২০২৫ ২২:২৩