বিরুদ্ধ সময়ের নোট: রফিক আজাদের কবিতার দায়!

অ+ অ-

 

বাংলা ভাষার আধুনিক কবি রফিক আজাদ। রোমান্টিক রবীন্দ্রোত্তর তিরিশি আধুনিকতার বিকাশ পরবর্তীকালে তার বেড়ে ওঠা। ফলে বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় আধুনিকতার চিন্তার যে ছায়া বাংলাভাষাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল, রফিক আজাদ তারই ধারাবাহিকতার অংশ। উত্তাল ষাটের দশকেই রফিক আজাদের চিন্তা আর কবিতার বিকাশ ঘটে। উদ্দাম, সহজ আর বোহেমিয়ান জীবনাচরণের জন্যও তিনি আলোচিত। তবে আধুনিক কবিতার যে বৈশিষ্ট্যনাগরিক বিচ্ছিন্নতা, সমকালীন বাস্তবতা, সময়ের চাপ, রাজনৈতিক মনস্কতা, ব্যক্তির নিঃসঙ্গতাসবই তার কবিতায় দৃশ্যমান। বস্তুত তিনি কবিতাকে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার দায়ে পরিণত করেছিলেন। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নয়, বরং কাব্যে তিনি সমাজ বাসনার ভাষায় রূপান্তর করেছিলেন। তার প্রথম অসম্ভবের পায়ে কাব্যগ্রন্থ পরখ করলে এটা টের পাওয়া যায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।

 

ঘড়ির কাঁটায় স্থির, সমর্পিত, হে আমার অন্তরঙ্গ অবিচ্ছিন্ন চাঁদ,
তোমার যাদুতে মুগ্ধ এই আমি শতচ্ছিন্ন কাঁথার একায়
হিরণ্ময় নক্ষত্রের মেলা এক বসিয়েছি অবাস্তব স্বপ্নের বিন্যাসে:
একটা বয়স আছে অবোধ শিশুর দল শতাধিক পুতুলে যখন
জননীর মতো সোহাগ বিলোতে চায়,—
ন্যাকড়ার টুকরোয় তারা কী উজ্জ্বল জামা তৈরি করে,
চুমোয় আচ্ছন্ন করে সারি-সারি পুতুলের নির্বিকার মুখ!
শিশুদের মতো আমি,— মুখাবয়বসর্বস্ব,—ভাঙা এই একটি পুতুলে
আমারও আজন্ম খেলা, সারাবেলা—দুপুরে-রাত্রিতে।

ঘড়ির কাঁটায় স্থির, সমর্পিত, হে আমার অন্তরঙ্গ অলীক লণ্ঠন,
সর্বক্ষণ জ্ব’লে যাও তুমি, তোমার মুখশ্রীখানি
কী মসৃণ আলো ফ্যালে দুর্গন্ধে আমার!
অবাস্তব উটপাখি, তোমার পিঠের ’পরে চ’ড়ে
জরায়ুতে চ’লে যাই, ভবিষ্যতে যাই…
খটখটে মৃত্তিকায় শিকড় চারিয়ে দিই, কিংবা
আইয়ো-র শিঙয়ের মতো বাঁকানো শৈশব ঘুরে আসি!
শিখাহীন অলৌকিক তোমার আগুনে পুড়ে যায়—
পরিত্যক্ত বাঁশঝাড়, গাছপালা, গোপন বাগান!

ঘড়ির কাঁটায় স্থির, সমর্পিত, হে আমার অন্তরঙ্গ জীবনদেবতা,
তালের শাঁসের মতো রাতে আনো অপার বেদনা;
সাবানের মতো তুমি পিছলিয়ে যাও
ব্যক্তিগত বাথরুম থেকে কোথা কোন্ স্বর্গলোকে!
আমার বাস্তব-স্বপ্নে কখনো আসো না আর ফিরে।
তবে অশ্রুজল ছাড়া ঐ-পদপল্লবে
আর কী দেবার আছে? …কেবল চোখের জলে ভ’রে দিতে পারি
একটু অদৃশ্য, শুষ্ক বঙ্গোপসাগর।।

[অসম্ভবের পায়ে | ১৯৭৩]

 

রফিক আজাদের কবিতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। একটি, রাজনৈতিক মনস্কতা আর অন্যটি নাগরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে রোমান্টিকতার দিকে ধাবিত হওয়া। প্রথমত, সমকালীন রাজনৈতিক মনস্কতা তার কবিতাকে জাতীয়তাবাদের দিকে নিয়ে যায়। না হলে রফিক আজাদ কিভাবে লিখেন, ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব। তবে ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’—প্রকৃত কবি না হলে এমন বাক্য লেখা সম্ভব নয়। সম্ভবত বাংলাভাষায় ক্ষুধা নিয়ে সেরা কবিতাটি লিখেছেন রফিক আজাদ। এমন কবিতার জন্য তাকে মাশুলও গুণতে হয় স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ ও তৎপরবর্তী পাকিস্তানের দুঃসহ-শাসনামলের বাস্তবতা তার রাজনৈতিক চিন্তার জন্ম দেয়। ফলে মানুষের মুক্তি তার আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে। এই মুক্তি নিছক ব্যক্তির মুক্তি নয়। আপামর সমাজের মুক্তি। গণমানুষের মুক্তি। মুক্তিকে তিনি অধিকার রূপেই দেখতেন। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও গণমানুষের মুক্তি অধরা থেকে যায়। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কবিতায় তিনি রাজনৈতিক বিদ্রোহী রূপে হাজির হন।

 

বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
বালক জানে না তো পুষবে অনুরাগ
হৃদয়ে কতদিন, কার বা চলা-পথে
ছড়াবে মুঠো-মুঠো বকুল ফুলগুলো;
কোথায় যেতে হবে, যাবে না কোন দিকে,
ব্যাপক হাঁটাহাঁটি করবে কোন পথে!

বালক জানলো না—মানুষ ম্লানমুখে
কেন যে তারা গোনে; পায়ের নীচে কার
কেন যে ফুল ঝরে, কতটা ফুল ঝরে!
মানুষ ভুল পথে গিয়েছে কত দূর,
বেপথু কাকে বলে বালক জানে না তা!

বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই—থাকে না, নিরুপায়—
যে আসে সে-ই জানে—ভুলের দামে কিনে
আনে সে প্রিয় ম্যাপ—পথিক ম্রিয়মাণ,
উল্টোরথে চ’ড়ে চলেছে মূল পথ!

বালক জানে না তো অর্থনীতি আর
মৌল রাজনীতি—উল্টো ক’রে ধরে
সঠিক পতাকাটি—পতাকা দশদিশে
যেনবা কম্পাস স্বদেশ ঠিক রাখে।

বালক জানে না সে বানানে ভুল ক’রে
উল্টাসিধা বোঝে: সঠিক পথজুড়ে
পথের সবখানে কাঁটার ব্যাপকতা!
বালক ভুল ক’রে পড়েছে ভুল বই,
পড়ে নি ব্যাকরণ, পড়ে নি মূল বই!
বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল,
সাঁতার না শিখে সে সাগরে ঝাঁপ দ্যায়,
জলের চোরাস্রোত গোপনে ব’য়ে যায়,
বালক ভুল ক’রে নেমেছে ভুল জলে!

বালক জানে না তো জীবন থেকে তার
কতটা অপচয় শিল্পে প্রয়োজন।

পাথর বেশ ভারী, বহনে অপারগ
বালক বোঝে না তা—বালক সিসিফাস
পাহাড়ে উঠে যাবে, পাথর নেমে যাবে
পাথুরে পাদদেশে!—বিমূঢ়, বিস্মিত
বালক হতাশায় অর্তনাদ ক’রে
গড়িয়ে প’ড়ে যাবে অন্ধকার খাদে।
বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল,
ফুলের নামে কত কাঁটারা জেগে থাকে
পুরোটা পথজুড়ে, দীর্ঘ পথজুড়ে—
বালক জানে না তা, বালক জানে না তো!
বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

[পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ | ১৯৮৫] 

 

দ্বিতীয়ত, আধুনিকতার অবক্ষয় মানুষকে রাষ্ট্র, সমাজ বিচ্ছিন্ন করে তোলে। আধুনিক সমাজ ব্যক্তির যে নিরঙ্কুশ বিকাশের কথা বলে সেটা পরাহত হয়। এমনই পরাহত সমাজে কবি আশ্রয় চান, প্রেমিকার কাছে প্রেমের কাছে। ফলে রফিক আজাদ বলেন, ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,/ পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;/ ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,/ বিরহ-বালুতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি;/ ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি/ খুব করে ঝুঁকে থাকা;/ ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি,/ বৃষ্টির একটানা ভিতরে-বাহিরে/ দুজনের হেঁটে যাওয়া;/ ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির/ পেয়াালা সামনে/ অবিরল কথা বলা;/ ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-/ যাওয়া কথার পরেও/ মুখোমুখি বসে থাকা। [ ভালবাসার সংজ্ঞা : রফিক আজাদ]

কবি ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া এমন সংজ্ঞা দাঁড় করালেন। এই ঝুঁকি শুদ্ধ প্রেম নয়, প্রেমের পরেরও অর্জন। আর বিপ্লব আর বিদ্রোহকে যত রোমান্টিকই আখ্যা দেই না কেন, শেষ নাগাদ সেটা ঝুঁকিই। কারণ প্রেমকে তিনি রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে মেলাতেন। নাগরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মানুষের যে মুক্তির বাসনা, কবিকে সেটা প্রেমের মত আচ্ছন্ন করে রাখত।  মুক্তিযুদ্ধ আর জাতীয় আকাঙ্ক্ষা তার কাছেই ঝুঁকিরই নামান্তর। ফলে তিনি জাতীয় সংকটকালে থেকেছেন মিছিলের অগ্রভাগে। যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। যেই যুদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রের। কবির সেই স্বপ্ন একাত্তরে সফলও হয়েছে।

জীবনের দীর্ঘ পথে কবি ভালবাসা বিলিয়েছেন অকাতরে। তবে কতটুকু পেয়েছেন সেই প্রশ্ন আপেক্ষিক। ইহকাল ছেড়ে কবি রফিক আজাদ বিদায় নিয়েছেন এক দশক গত হলো। বিস্মৃত পরায়ন সময়ে কবি হয়তো ঘুমিয়ে আছেন কোনো বাক্যের বিরতিতে, কোনো শব্দের অন্তরে, কোনো এক প্রেমের আকুতিতে, কোনো এক ঘুমন্ত পাঠকের স্মৃতিতে, কোনো এক ভাবের মায়ায়। হয়তো জেগে উঠবেন একদিন বাংলা ভাষায়, বাংলা কাব্যের জমিনে। আজ আমরা বললাম, ভবিষ্যতে অন্যরা বলবেন। কবির জন্য আমাদের অশেষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।

 

সংযুক্ত কবিতা

ভাত দে হারামজাদা

ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে—প্রতিপলে—সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি—যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে জ্বেলে দ্যায়
প্রভুত দাহন—তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবী
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি—কারো বা খ্যাতির লোভ আছে
আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর—
ভাত চাই—এই চাওয়া সরাসরি—ঠাণ্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই—মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই:
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী;
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা
চাইনিতো: নাভি নিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক—যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও
জেনে রাখো: আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।

যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন—
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে:
থাকবে না কিছু বাকি—চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই—
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে।

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেল না নয় আজ

ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।