ইরান: সহনশীলতার সাম্রাজ্য থেকে বিদ্রোহের প্রজাতন্ত্র

অ+ অ-

 

প্রকাশক খুঁজছিলেন এমন এক লেখক যিনি ইরানের এক খণ্ড ইতিহাস লেখার জন্য উপযুক্ত, যতটা সম্ভব প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমানের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত যিনি এক কভারে বাঁধতে পারবেন। হার্ডকভার সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে, বইটি প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার মতো, শিক্ষিত পাঠকের জন্য সহজবোধ্য, আবার বিশেষজ্ঞদের কাছেও একেবারে বিরক্তিকর নয়। মাইকেল অক্সওয়ার্থি এই কাজের জন্য বেশ উপযুক্ত প্রমাণিত হয়েছিলেন। তিনি ১৪ বছর ব্রিটিশ কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেছেন, যার শেষ দুই বছর কাটিয়েছেন ইরান বিভাগের প্রধান হিসেবে। বই প্রকাশের সময় তিনি ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের পার্সিয়ান ও ইরানি স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক। এর আগে তিনি নাদির শাহের জীবনী লিখেছিলেনএকজন মানুষ, যিনি আঠারো শতকের প্রথমার্ধে স্থানীয় প্রভাবশালী থেকে সমগ্র ইরানের শাসকে রূপ নেন এবং যার ক্ষমতা উত্তর দিকে ট্রান্সঅক্সিয়ানা পেরিয়ে, পূর্ব দিকে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। অক্সওয়ার্থি সাহেব বিশেষজ্ঞ, কিন্তু নিছক একাডেমিক নন, আর এই কাজটি তিনি চমৎকারভাবে সম্পন্ন করেছেন।

অক্সওয়ার্থি সাহেবের ইতিহাস মূলত রাজনৈতিক। অর্থাৎ, মূল লক্ষ্য হচ্ছেকোন সময়ে, কে কোন ভূখণ্ডের ওপর শাসন করেছে, সেই কাহিনি বোনা। ইতিহাসের অন্যান্য দিকবিশেষত ধর্ম ও সাহিত্যতিনি বিবেচনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেগুলো স্পষ্টতই গৌণ, মূলত ইরানের ভূমি (এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা) জুড়ে যুগে যুগে কার হাতে ক্ষমতা ছিল, সেই সুতোয় গাঁথা ইতিহাসই বইটির মেরুদণ্ড। তিনি শুরু করেন লিখিত নথি আসার আগের সময়ের মানুষদের নিয়েযেখানে ভাষাগত ও জেনেটিক প্রমাণই ইতিহাসবিদদের ভরসা। ইরানি ভাষাগুলো ইন্দো-ইউরোপীয়, যা বোঝায় তাদের ভাষাভাষীরা ইরানের মালভূমিতে এসেছিলেন আজকের রাশিয়ান স্টেপ অঞ্চল থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষার্ধে, নানা ঢেউয়ে অভিবাসন ও আক্রমণের মাধ্যমে। (পৃষ্ঠা-১) ইলামীয় সাম্রাজ্য ইরানি আক্রমণের আগেই বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়, আর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলছে এই অঞ্চলে বহু সহস্রাব্দ ধরে মানুষের বসবাস। বইয়ের শুরুতেই অক্সওয়ার্থি সাহেব এক নিখুঁত মন্তব্য রেখেছেন—“শুরু থেকেই, ইরানের ধারণা জাতি বা ভূখণ্ডের মতো নয়, বরং ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির জটিল বুননে বাঁধা। (পৃষ্ঠা-৩)

অক্সওয়ার্থি সাহেব খুব অল্প সময়য়েই প্রথম দিককার জনগোষ্ঠীগুলোমিদি, পার্সি, পার্থিয়ান, সগ্দীয়ান ও আরও অনেকেযাদের ইতিহাসে প্রথম আবির্ভাব মূলত গ্রিক বর্ণনার মাধ্যমে, তাদের পরিচয় করিয়ে দেন। এরপরই তিনি চলে যান ইরানের ইতিহাসে ধর্মের গুরুত্বের দিকে, শুরু করেন জরাথুস্ত্র সম্পর্কে জানা তথ্যের সংক্ষিপ্ত চিত্র দিয়ে। ভাষাগত ও পাঠ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অক্সওয়ার্থি সাহেবর সিদ্ধান্তজরাথুস্ত্র খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১২০০ বা ১০০০ সালের দিকে বেঁচে ছিলেন, অর্থাৎ ইরানি আক্রমণ ও অভিবাসনের সময়কালের আশপাশে।

জরাথুস্ত্রবাদী ধর্মের বয়স তিন হাজার বছরেরও বেশিআরও পুরনো, যদি ধরা হয় যে এটি বিদ্যমান দেবতা ও বিশ্বাসকে আত্মস্থ করেছিল। তবু এর প্রভাব আজকের ইরানেও ছায়ার মতো বিরাজমান। একদিকে বড় প্রভাব: জরাথুস্ত্রবাদে যে দ্বৈতবাদী চিন্তা আছে, তা ইরানের ধর্মীয় উদ্ঘাটন ও বিবর্তনে বারবার ফিরে আসে। অন্যদিকে ছোট প্রভাব: এই আর্চ-এঞ্জেলদের কয়েকজনের নামযেমন বাহমান, অর্দিবেহেস্ত, খোরদাদআজও আধুনিক ইরানি ক্যালেন্ডারে মাসের নাম হিসেবে টিকে আছে, এমনকি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অধীনে।

 

জরাথুস্ত্রীয় প্রতীক ফরুহার বা পারসিক পরবহর || ছবি: উইকিপিডিয়া

তিনি লেখেন—“অন্যান্য প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে জরাথুস্ত্র হঠাৎ একেবারে নতুন ধর্ম তৈরি করেননি। বরং তিনি বিদ্যমান ধর্মীয় আচারগুলো সংস্কার ও সরলীকরণ করেছিলেন (যেখানে ঐতিহ্যবাহী পুরোহিতদের কিছুটা বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল), আর তার ভেতর সঞ্চার করেছিলেন অনেক বেশি দার্শনিক ও নৈতিক গুরুত্ব এবং ন্যায়বোধের প্রতি জোর। (পৃষ্ঠা-৬)

অক্সওয়ার্থি আরও উল্লেখ করেন—“আধুনিক জরাথুস্ত্রবাদ অনেক বেশি একেশ্বরবাদী। আর এই পার্থক্যটিকে স্পষ্ট করতে অনেক গবেষক ধর্মের প্রাথমিক ধাপটিকে মাজদাবাদ বলেনযা এসেছে আহুরা মাজদা—‘সত্য ও আলোর স্রষ্টা-দেবতা’—এর নাম থেকে। (পৃষ্ঠা-৭)

জরাথুস্ত্রবাদী ধর্মের বয়স তিন হাজার বছরেরও বেশিআরও পুরনো, যদি ধরা হয় যে এটি বিদ্যমান দেবতা ও বিশ্বাসকে আত্মস্থ করেছিল। তবু এর প্রভাব আজকের ইরানেও ছায়ার মতো বিরাজমান। একদিকে বড় প্রভাব: জরাথুস্ত্রবাদে যে দ্বৈতবাদী চিন্তা আছে, তা ইরানের ধর্মীয় উদ্ঘাটন ও বিবর্তনে বারবার ফিরে আসে। অন্যদিকে ছোট প্রভাব: এই আর্চ-এঞ্জেলদের কয়েকজনের নামযেমন বাহমান, অর্দিবেহেস্ত, খোরদাদআজও আধুনিক ইরানি ক্যালেন্ডারে মাসের নাম হিসেবে টিকে আছে, এমনকি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অধীনে। (পৃষ্ঠা ৭)

ইরানের ইতিহাস আগেই কমবেশি জানা থাকার কারণে অক্সওয়ার্থি সাহেবের বর্ণনার শক্তিতে অসংখ্য নাম আর স্থানের মিছিলেও আমি কখনো বিভ্রান্ত হইনি। তিনি এমন অনেক জায়গায় দিকনির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে পশ্চিমা ইতিহাসের সামান্য ধারণা থাকা পাঠক সহজেই ইরানের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারে। প্রথমদিকের অধ্যায়গুলোতেই তিনি দেখান, কিরুস আর দারিয়ুসের সাম্রাজ্য তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে কেমন ছিলগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে আলেকজান্ডার জরাথুস্ত্রীয় ঐতিহ্যে এক ঘৃণিত চরিত্রে পরিণত হন। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি সম্প্রদায় ও রাজাদের সম্পর্ক, যা প্রমাণ করেবাগদাদের মতো স্থানে ইহুদি বসতি কত দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান।

কিরুসের সময় থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত এক দীর্ঘ রাজবংশের ওঠানামার কাহিনিসাম্রাজ্যগুলো যতবার তাদের সম্পদের সীমা ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়েছে, ততবারই বিশৃঙ্খল পতনে ভেঙে পড়েছে। এই গল্পের ছায়া দীর্ঘকাল পড়েছে ইরানের পশ্চিমদিকের শক্তিগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বেপ্রথমে রোম, পরে অটোমান সাম্রাজ্য। অটোমানদের সঙ্গে সংঘাত আরও জটিল হয়েছিল কারণ উভয় শক্তিই ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্ব দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল এক সূক্ষ্ম ধর্মীয় টানাপোড়েনঅটোমানরা মূলত সুন্নি ঐতিহ্যের প্রতিনিধি, আর ইরানি শাসন একের পর এক রাজবংশ পেরিয়ে ক্রমশ শিয়া চরিত্র ধারণ করেছে। অক্সওয়ার্থি সাহেব ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিয়ে দেখিয়েছেন, স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সুন্নি-শিয়া বিভাজন, তার সঙ্গে সুফিধারার ব্যাখ্যাও দিয়েছেনযেখানে দেখা যায়, তিনটি ধারাই কখনো ভেঙে গিয়েছে নানা উপদলে, আবার কখনো জন্ম দিয়েছে নতুন বিশ্বাসপদ্ধতির।

পশ্চিমে জোয়ার-ভাটার মতো ক্ষমতার পালাবদল চললেওইসলাম নিয়ে আসা আরব আক্রমণ ব্যতীতউত্তরদিক থেকে ইরানের ভূমি দুই বিশাল ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছিল: মঙ্গোল আর তৈমুরের আক্রমণ। দুটোই ইরানের জন্য স্বল্পমেয়াদি বিপর্যয় ডেকে আনে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই বিজেতাদের শাসনকাঠামো পারসিক প্রশাসক ও বণিকদের দ্বারা দখল ও পরিচালিত হয়। তিনি প্রায় হালকা ভঙ্গিতে উল্লেখ করেন, মঙ্গোলরা পারস্যে ঢোকার কিছুদিন আগেই মুসলিম পারসিক ও তুর্কিরা উত্তর ভারতে প্রবেশ করে গড়ে তোলে মুঘল সুলতানাতএক বিপুল সম্পদশালী সাম্রাজ্য, যা পরে পূর্ব দিকে বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এমন একাধিক সাম্রাজ্য কীভাবে শতাব্দী ধরে বৃহত্তর এশীয় প্রবণতার সঙ্গে খাপ খেয়েছিল; তিনি দেখিয়েছেন, সেই প্রবণতাগুলো ইরানের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসরে কীভাবে বাস্তব রূপ নিয়েছিল।

মঙ্গোল যুগের অন্যতম বিস্ময়কর বৈপরীত্য হলোএই সময়টাতেই পারস্য কবিতার এক বিরাট বিকাশ ঘটে। জন্ম নেয় এমন সব কবি, যাদের পঙ্‌ক্তি আজও প্রবাদে পরিণত হয়েছে, আর যাদের রচনা এখনও পারস্য সাহিত্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অক্সওয়ার্থি সাহেব ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের এই সাহিত্যজাগরণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, বইয়ের প্রায় দশভাগের একভাগ জুড়েই এই আলোচনা। তিনি শুধু সেই সব কবির শিল্প দেখাননি, যাদের নাম ইংরেজিভাষী জগতেও পরিচিত, বরং দেখিয়েছেন কবিতা ও ধর্মীয় ভাবনার আন্তঃসম্পর্কআর কীভাবে সেই কবিতাগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে।

আমি কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

হাফিজের কবিতাগুলো আজও বহু ইরানির মনে অস্বস্তি জাগায়। কিছু ধর্মপ্রাণ ইরানি সরাসরিই বলেন, এসব কবিতা আসলে মদ বা রতিকামনা নিয়ে নয়পুরোটাই আধ্যাত্মিক স্তরের কথা, আর কবিরা নিজেরা নাকি কখনো মদের ধারেকাছেও যাননি। সেটা সত্যি কি না (ব্যক্তিগতভাবে আমার সন্দেহ আছে) আলাদা প্রশ্ন; আসল কথা হলো, এই কবিতা তখনই কাজ করে, যখন কামুকতা আর মদিরতার স্বাদ বাস্তব। বরং এই বাস্তবতার কারণেই এগুলো আমাদের স্পর্শ করেতা কেবল মহৎ সাহিত্যই পারে। এ যেন আমাদের এমন কিছু মনে করিয়ে দেয়, যা আমরা কোনো এক সময়ে জানতাম, কিন্তু ভুলে বসেছিলাম। নইলে এই উপমাগুলো নিছক কৌশল হতো, আর নিয়মভাঙা বিদ্রোহ হতো কেবল এক অভিনয়। এই কবিতার অভিঘাত তার চেয়ে অনেক গভীর। পরবর্তী যুগে হাফিজকে অনুবাদ করে মুগ্ধ হন গ্যেটে, আর তার এই উচ্ছ্বাস ছিল ইউরোপের আরও বহু পাঠকেরই প্রতিধ্বনি। পার্সিদের কাছে হাফিজ এতটাই পূজ্য ছিলেন যে তার দিবানঅর্থাৎ তার সমগ্র কবিতা একখণ্ডে সংকলিত গ্রন্থভাগ্য গণনার জন্যও ব্যবহৃত হতো, এবং মাঝে সাঝে এখনও হয়। যারা নিজেদের ভবিষ্যৎ জানতে চান, তারা বইটি এলোমেলোভাবে খুলে দেখেন, আশায় থাকেন সেখানে এমন কোনো পঙ্‌ক্তি মিলবে, যা শুভলক্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। একমাত্র অন্য আরেকটি যে বইটি এইভাবে ব্যবহার হয়, তা হলো কোরআন। (পৃষ্ঠা ১১৪১১৫) (আমার অনুবাদ)

পাঠকের আগ্রহের কথা মাথায় রেখে ইরানের দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনার পর, অক্সওয়ার্থি সাহেব বইয়ের শেষ এক-তৃতীয়াংশ উৎসর্গ করেছেন বিংশ ও একবিংশ শতকের ঘটনাবলিকে। কখনো কখনো তার আগের অধ্যায়গুলোতে ধর্মীয় প্রেরণা ও গণঅভ্যুত্থানের যে আলোচনা আছে, তা আমাকে ভাবিয়েছেতিনি কি বর্তমান ইরানকে উল্টো করে অতীত পড়াচ্ছেন? ইতিহাসবিদদের কাছে এটা এক ধরনের পেশাগত ফাঁদ। তিনি অবশ্য শক্ত যুক্তি দিয়েছেন ইরানের ইতিহাসে কিছু পুনরাবৃত্তির আছেযেমন ধর্মীয় আন্দোলনগুলো শুরুতে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে সন্দেহ করে, পরে নিজেরাই নতুন কর্তৃত্ব গড়ে তোলে। তবু মাঝে মাঝে আমার মনে হালকা সংশয় জেগেছিল। নিঃসন্দেহে, আমার চোখে বিংশ শতকের ইরান মানেই ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের ছায়া; আর তাই পাহলভি রাজবংশের উত্থান যেন তাদের পতনের দিকেই ইঙ্গিত করে।

“ হাফিজের কবিতাগুলো আজও বহু ইরানির মনে অস্বস্তি জাগায়। কিছু ধর্মপ্রাণ ইরানি সরাসরিই বলেন, এসব কবিতা আসলে মদ বা রতিকামনা নিয়ে নয়পুরোটাই আধ্যাত্মিক স্তরের কথা, আর কবিরা নিজেরা নাকি কখনো মদের ধারেকাছেও যাননি। সেটা সত্যি কি না (ব্যক্তিগতভাবে আমার সন্দেহ আছে) আলাদা প্রশ্ন; আসল কথা হলো, এই কবিতা তখনই কাজ করে, যখন কামুকতা আর মদিরতার স্বাদ বাস্তব। বরং এই বাস্তবতার কারণেই এগুলো আমাদের স্পর্শ করেতা কেবল মহৎ সাহিত্যই পারে। এ যেন আমাদের এমন কিছু মনে করিয়ে দেয়, যা আমরা কোনো এক সময়ে জানতাম, কিন্তু ভুলে বসেছিলাম। নইলে এই উপমাগুলো নিছক কৌশল হতো, আর নিয়মভাঙা বিদ্রোহ হতো কেবল এক অভিনয়। এই কবিতার অভিঘাত তার চেয়ে অনেক গভীর।...”

 

ছবি: বিবিসির সৌজন্যে (De Agostini/Getty Images)

অক্সওয়ার্থি সাহেবের অন্যতম সাফল্য হলো, তিনি ইরান ও রাশিয়ার সম্পর্কের জটিলতা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেনকীভাবে প্রথমে ককেশাসের (রাশিয়া) ভূখণ্ড, পরে আজারবাইজানি জনগোষ্ঠীর এলাকা নিয়ে দুই শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলেছে। এই বিরোধ পেরিয়েছে একাধিক ইরানি রাজবংশ, আর সীমান্তের উত্তরদিকে ছুঁয়েছে রুশ সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্যন্ত। তিনি বিংশ শতকের ইরানে প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণা ও গোষ্ঠীগুলোর খসড়াটাও সুন্দর এঁকেছেন। দেখিয়েছেন, ১৯৭৯ সালের কিছু ধারণাযেমন ইসলামি ফকিহের শাসনব্যবস্থাআসলে পূর্ববর্তী প্রবণতারই নতুন সম্প্রসারণ। একইসঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন, সংবিধানিক ধারার রাজনীতি নানা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ব্যর্থ হয়েছে, তবু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।

সমগ্র বই জুড়ে তিনি জোর দিয়ে বলেন, শিয়া ইসলাম স্বভাবতই প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বের প্রতি সন্দেহপ্রবণ। এই প্রবণতা কাজ করে, যখন কোনো গোষ্ঠী অত্যাচারী রাজবংশের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়; আরেকভাবে কাজ করে, যখন সেই শিয়া মূল্যবোধের নামেই নতুন শাসনকাঠামো গড়ার চেষ্টা হয়।

বইয়ের শেষ দিকের অধ্যায়গুলো আমার ভালো লেগেছে, অক্সওয়ার্থি সাহেব খোলাখুলি নিজের মূল্যায়ন দেনবিভিন্ন দেশের কর্মকাণ্ড ও ইরানসংক্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করেন, যদিও কখনো কখনো আমি তাঁর সাথে পুরোপুরি একমত নই। যেমন, তিনি সমালোচনা করেছেন পশ্চিমা শক্তিগুলোর যেখানে ইরানকে তারা কোনো সক্রিয় সত্তা হিসেবে নয়, বরং কেবল পররাষ্ট্রনীতির বস্তু হিসেবে দেখেছে। তবে তিনি, যতদূর আমি বুঝি, ইরানের দিকটা আলাদা করে দেখেননিযে ইরানও প্রায়শই জর্জিয়ার মতো প্রতিবেশীকে নিজের পররাষ্ট্রনীতির বস্তু হিসেবে দেখেছে। তাছাড়া তিনি বারবার ব্রিটেনকে দোষারোপ করেছেন, কারণ তারা ইরানকে তাদের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতিতে তুলনামূলকভাবে গৌণ মনে করেছে। তার যুক্তি হলো, রাশিয়া-সংক্রান্ত নীতি বদলের মতো অন্য অগ্রাধিকারের জন্য ব্রিটেন বারবার ইরাননীতি উল্টে ফেলায়, তেহরানের চোখে তারা অবিশ্বস্ত হয়ে পড়ে এবং তার মূল্য পরে দিতে হয়েছে। এ সবকিছু সত্য হতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই নীতিপরিবর্তন ভুল ছিল। ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত সঠিকই ভেবেছিলেনরাশিয়া তাদের কাছে ইরানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্রনীতি তৈরি মানেই তো অগ্রাধিকার স্থির করা, আর প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষতির হিসাব কষে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

বইয়ের শেষ অধ্যায়ে অক্সওয়ার্থি সাহেব ২০০৮০৯ সালের ইরানি নির্বাচন ও বিক্ষোভের খুঁটিনাটি বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। এতদিন পরে এটা কিছুটা অতিরিক্ত মনে হয়, যদিও সে সময়ে তিনি যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছিলেন, সেগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভেতরের দুর্নীতি তার জনসমর্থন হারিয়েছে। নির্বাচিত কিছু আলেম ক্রমশ বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট ধারণা রক্ষা করতে; যে উপকরণগুলো ১৯৭৯ সালে ইরানের বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতীক ছিল, চল্লিশ বছর পর সেগুলো প্রায়ই দমনের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।

তিনি উদ্ধৃত করেছেন: [প্রেসিডেন্ট খাতামি] একাধিকবার [১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে] বলেছিলেন, তিনি মনে করেন তার সংস্কার কর্মসূচি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শেষ সুযোগযদি সংস্কার আটকে দেওয়া হয়, মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ সরকার চাইবে এবং পুরোপুরি ধর্মতান্ত্রিক শাসন ভেঙে দেবে। কিন্তু তার সংস্কার আটকে দেওয়া হয়েছিল…” (পৃষ্ঠা-২৭৭)

২০০৯ সালের যে বিক্ষোভ মূলত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পুনর্নির্বাচনের দাবি তুলেছিল, সরকার তা কঠোরভাবে দমন করে। আর ২০২২ থেকে শুরু হয়েছে নতুন এক তরঙ্গের গণঅভ্যুত্থান, যা ইরান সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। এখন খাতামির পূর্বাভাস যেন বাস্তব রূপ নিচ্ছেমানুষ চাইছে নৈতিকতা পুলিশের অবসান, নারীদের হিজাব পরার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি, আর ধর্মীয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া বহু দৈনন্দিন নিয়ন্ত্রণ ভেঙে ফেলা। তবে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের দাবি এখনো সর্বজনীন নয়। অন্তত, এখনো নয়।

অক্সওয়ার্থি সাহেবের A History of Iran পড়ে বোঝা যায়, ইরানের ইতিহাস এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের সভ্যতার কাহিনি। ইরানিরা শিখেছিল বাইরের প্রভাবকে গ্রহণ করে তা নিজের সত্তার ভেতরে রূপান্তর করার শিল্প। আরব, মঙ্গোল বা তুর্কিদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণও পার্সি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে পারেনি; বরং ইরান সাংস্কৃতিকভাবে তার বিজেতাদেরই জয় করেছে, গড়ে তুলেছে এক “Empire of the Mind, যার প্রভাব তুরস্ক থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আধুনিক যুগে এখন নতুন চ্যালেঞ্জইউরোপীয় শক্তিগুলো ধাপে ধাপে ইরানের সার্বভৌমত্ব খর্ব করছে, আর তার ফলে জন্ম নেয় বিদেশি হস্তক্ষেপ, জনবিদ্রোহ, এবং স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্ত চক্র। সাংবিধানিক বিপ্লব থেকে শুরু করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত, ইরান বারবার লড়েছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ব, স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক চাপের দ্বন্দ্বে। এই সমস্ত উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে একটি স্থায়ী স্রোত স্পষ্টইরানের জনগণ সবসময় চেয়েছে জবাবদিহিমূলক শাসন আর জাতীয় মর্যাদা। ক্ষমতার সঙ্গে তাদের এই কথোপকথন কোনোদিনই শেষ হয়নি, আর হয়তো কোনোদিনই হবেও না। অক্সওয়ার্থি সাহেব ২০১৯ সালের মার্চে প্রয়াত হন, কিন্তু তিনি বেঁচে থাকলে ইরানি মননে গণতান্ত্রিক ও সংবিধানিক চিন্তার পুনরাগমন নিশ্চয়ই চিনে নিতে পারতেন। তার বইটিও পাঠকদের সেই চেনার ক্ষমতা দেয়।

সূত্র: Axworthy, Michael. (2008, May 06). A History of Iran (384 pp.). Basic Books.