পয়েন্ট অফ স্যাচুরেশন

অ+ অ-

 

এক

যাক বাবা, অবশেষে রোদ উঠলো। যুগ যুগ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে একেবারে! 

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামিনা চারপাশ দেখে। সবকিছু স্বচ্ছ, সুন্দর। একটানা তুমুল বৃষ্টি প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে শান্ত, স্নিগ্ধ এক অবয়ব তৈরি করে দিয়ে গেছে। শেষ বিকেলের রোদ গলে পড়ছে বটলব্রাশের পাতাগুলোর উপর। আর তার লাল লাল ফুলগুলো সেই রোদ গায়ে মেখে দুলে দুলে খুব হাসছে। সামিনার চোখ যায় বাগানের পূব দিকে। আমন্ড গাছে নতুন কুঁড়ি দেখে বুঝতে পারে ফুল ফুটতে বেশি দেরি নেই। ঝিরঝিরে বাতাসে বাগানের গাছগুলো গা ঝাড়া দিয়ে উঠলে আরেক পশলা বৃষ্টি হবে ভেবে ভুল হয় সামিনার। সামিনা আকাশ দেখে। টুকরো টুকরো মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, পূর্বাভাস বলছে আজ আর বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। ওর কৌতূহলী চোখ আকাশের এধার থেকে ওধার দেখে। দেখে না আসলে খোঁজে। এই এক গোপন প্রেমবৃষ্টি শেষে রংধনু খোঁজা। যদিও রংধনু খুব বেশি আয়ু নিয়ে আসে না, তবু সাতটি রঙের ক্ষণকালীন সখ্যতা ওকে রাঙিয়ে দিয়ে যায় অনেকটা সময় ধরে, সেই কিশোরীবেলা থেকে।             

বুঝলা বুবু, বৃষ্টির সাথে সাথে যদি রোইদ দেখ বুঝবা রংধনু উঠবো, দাদু বলেছিলো। কথাটি শুনে কেমন রোমাঞ্চ হয়েছিলো সামিনার। সত্যি বলছো দাদু? মিছা কমু নাকি তোমারে?, দাদু কপট রাগ করে। সত্যি আর মিথ্যা, দাদুর প্রতি সামিনার ছিল গভীর অন্ধবিশ্বাস। তাছাড়া দাদু এমন এমন সব তথ্যের ভাণ্ডার ছিল যে সেসব শুনলে সামিনার চোখ গিয়ে উঠতো কপালে। গায়ের লোম যেতো দাঁড়িয়ে। মোটকথা রোমাঞ্চিত না হয়ে উপায় থাকতো না। এই যেমন দাদু একবার বললো একজন মানুষের শরীর তার হাতের সাড়ে তিন হাত। সাত বছরের সামিনা আর ওর পাঁচ বছরের ভাই সায়েম এই তথ্য শুনে পুরাই থ! সে কী উত্তেজিত! দুজনে কিছুদিন পড়ে রইলো এই নিয়ে। যাকে পায় তাকেই তথ্যটি পাচার করে আর শরীর মাপার বায়না ধরে। আর মাপামাপি শেষ হলে দুজনে মহৎ কিছু আবিষ্কারের আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়ে।    

দাদুর ভক্ত হলেও সামিনারা দাদুকে কাছে পেত খুব কম। বছরে এক কি দুইবার। বৎসরান্তে ফসল তোলা শেষ করে সামিনাদের বাসায় বেড়াতে এলেই কেবল দাদুর সাথে দেখা হওয়ার সু্যোগ মিলতো। তবে কখনও ডাক্তার দেখানো বা অন্য কোন জরুরী কাজে দাদুকে জেলা সদরে আসতে হলে সেটি হতো উপরি পাওনা। একবার এলে দাদু সামিনাদের সাথে থাকতেন সাকূল্যে তিন কি চারদিন তবে সাতদিনের বেশি কখনই না। দাদু আসা মানে তাই সামিনাদের আনন্দোৎসব। দুই ভাইবোন সারাক্ষণ দাদুর পিছে পিছে। দাদু খায় তো ওরা খায়। দাদু টেলিভিশন দেখে তো ওরাও দেখে। দাদু হামানদিস্তায় পান ছেঁচে তো দুই ভাইবোন গোল হয়ে বসে থাকে। পান ছেঁচা শেষ হলে দাদু মুখে দেয়। মাখনের মত মিলিয়ে যায় সে পান। খানিক পর লাল লাল হয়ে ওঠে ঠোঁটগুলো। সামিনার দেখতে খুব ভাল লাগে।

খাবা বুবু? দেখ কি মিহি দানা! কৌতূহলী সামিনা মাকে লুকিয়ে সেই পান খায়। খাওয়া শেষ হলে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ফেলে। কারণ মা জানতে পারলে পান তো খেতে দিবেই না উলটা রেগেমেগে একাকার হবে। তবুও সে খায়। দাদু যা করে তা করতে তার ভাল লাগে বলে খায়। দাদুর প্রতি ভালবাসা থেকে খায়। তবে সায়েম খায় না। কারণ একবার শ্বাসনালীতে পানসুপারীর কণা আটকে সে-কি কাণ্ড! সামিনার মায়ের চেঁচামেচিতে ওর বাবা এক প্রকার বাধ্যই হলেন দাদুকে ধমক দিতে, বাচ্চাদের এইসব দেন কেন আম্মা? একটা দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? ইতস্তত দাদু চোখমুখ শক্ত করে ঘরে বসে থাকলেন। কোথাও নড়লেন না। চলে যাওয়ার আগেও নাতি-নাতনীদের থেকে দূরে দূরে থাকলেন। কথা বললেন না। কাছে ডাকলেন না। এমনিতে দাদু এলে ওরা দুই ভাই বোন দাদুর সাথেই ঘুমাতো। কিন্তু ঐ ঘটনার পর সেটিও বাদ পড়ে গেলো। 

সামিনার আম্মা পছন্দ করতেন না তাই সামিনাদের দাদুবাড়ি মুখি হওয়া হতো কালেভদ্রে। দাদুর ওভাবে চলে যাওয়ায় সামিনা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। কিছুদিন পর মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও এক প্রকার জেদ করেই বাবার সাথে দাদুর কাছে যায় ও। বাবাও মানা করেনি যদিও বুঝেছিল সামিনার এই জেদের ফলাফল পরবর্তীকালে সাংসারিক ঝড় হয়ে নেমে আসবে তার ওপরই। এসেছিলও। সামিনার মা সামিনার বাবাকে দায়ী করেছিল মেয়েকে ফুসলিয়ে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য।    

সামিনাকে দেখে দাদু যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেল। যেন শৈশবের দুই সখীর অনেকদিন বাদে দেখা! দাদু জড়িয়ে ধরে আদরে আহ্লাদে ভরিয়ে দিলেন আত্মজকে। কতকিছু যে রাঁধলেন! তারপর নিজ হাতে মুখে তুলে খাওয়ালেন। বিকেলে দুজনে পাড়াময় ঘুরে ঘুরে ফসলের জমি, সবজি ক্ষেত, ধান মাড়াই, খড়-ভূসি দিয়ে পশুর খাবার তৈরি দেখতে দেখতে চলে গেল বড় ধান ক্ষেতটায়। বৃষ্টির পর গোরস্থানের পাশ ঘেঁষে খোলা প্রান্তরে অপরূপ এক রংধনু দেখে সামিনা সেদিন দাদুর কাছে জেনেছিল রোদ-বৃষ্টিতে মাখামাখি মানেই রংধনু। এর আগে সে অনেকবার রংধনু দেখেছে, জানে রংধনুর সাতরঙ এবং এই সাতরঙের অন্য নাম বেনীআসহকলা, কিন্তু রংধনুর পেছনে রোদ-বৃষ্টির সংযোগটি ওর জানা ছিল না। সামিনার অদ্ভুত অনুভূতি হলো এবং এরপর থেকে রোদ-বৃষ্টি একসাথে দেখলেই রংধনু খোঁজা হয়ে ওঠে ওর প্রিয় কাজ। কিশোরী থেকে তরুণী, তরুণী থেকে যুবতী, যুবতী থেকে পৌঢ়, পৌঢ় থেকে বৃদ্ধ হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে কত না দুপুর-বিকেল সে স্থির তাকিয়ে থেকেছে আকাশের দিকে! কত কত দিন শুধু ঐ সাতটি রঙ একঝলক দেখবে বলে মাঠের এপার থেকে ওপার ঘাস, কাদা পায়ে মাড়িয়ে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ভর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে!           

 

দুই  

এক ঝুম বৃষ্টিদিনে মোহন মাস্টার পড়াতে এলেন একেবারে শেষ বেলায়। সামিনা মনে মনে খুশি হয়েছিল এই ভেবে যে আজ বোধ হয় আর স্যারের কাছে পড়তে হবে না। বসে বসে বাতাসের তোড়ে জবা গাছটার হেলদোল দেখতে দেখতে ভাইবোনে ঠিক করলো কতগুলো জবা ফুটেছে তাই গুণে দেখবে আর বৃষ্টির জোর কমলেই ছুটবে মাঠের দিকে। স্যারকে দেখে মনটাই মরে গেলো যেন! চুপচাপ পড়ার টেবিলে বাধ্য মেয়ের মত কোনমতে ঘণ্টা পার করে এক দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো পাড়ার পিছনের মাঠটায়। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি বাতাসের তোড়ে এসে পড়ছে মুখের ওপর। পশ্চিমের আকাশে এক চিলতে আলো ধরে রেখেছে দিনের আয়ু। মরে যাওয়া আলোতে এধারে ওধারে ঘাড় ঘোরাতেই মোহন মাস্টার। রংধনু দেখবি? ঐদিকে আয়। সামিনা সরল বিশ্বাসে মাস্টারের পিছু নেয়। তারপর অনেক অনেক মেঘবাদলের বিকেলে সাতরং খুঁজে বেড়ানো ছোট্ট মেয়েটি বীভৎস এক সন্ধ্যার মুখোমুখি হয়। বোনকে খুঁজতে গিয়ে সায়েম ভয়ে জড়োসড়ো, কাঁদামাখা এক জড় মূর্তিকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। মায়ের চিৎকার আর বাবার হতবিহবল চেহারার দিকে তাকিয়ে সামিনার কোন হেরফের হয় না। বোধশূন্য অনুভূতিতে কাঁপতে কাঁপতে একসময় ধপাস করে পড়ে যায় মেঝের উপর।   

খবর পেয়ে সামিনার বড় খালা এলেন, সাথে বড় খালু। চোখ খুলে সামিনা মাকে কাঁদতে দেখে আর পাশের ঘর থেকে বাবার চাপা অথচ রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, আমি বলছি দুলাভাই, মেয়েকে সাবধানে রাখতে। বলছি মেয়ে বড় হইতেছে। আমার কথা শোনে নাই। মেয়েকে যেখানে সেখানে যাইতে দেয়। যখন তখন। সামিনার দুচোখ বুজে আসে। চোখের পাতাগুলো কেমন ভারী হয়ে আসে। ওর কারও দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। খানিকক্ষণ পর মা আর বড়খালা মিলে ওকে কোথাও নিয়ে যায়। অপরিচিত একজন নারী কণ্ঠ যখন জানতে চায় কি সমস্যা? সামিনা বুঝতে পারে ও একজন ডাক্তারের সামনে বসে আছে। সামিনার মা কাঁদতে কাঁদতে বিকেলের বৃত্তান্ত দিতে থাকলে ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ককিয়ে ওঠে। দুইহাতে কে যেন ওর জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে, আর ও প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর। সামিনা চিৎকার করে জ্ঞান হারায়।    

সেই রাতটা ক্লিনিকেই থাকতে হলো ওদের। বড়খালা রাত বাড়লে বাড়ি ফিরতে চায়। বিদায় বেলায় বোনকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, মেয়ে নাবালক। নাবালক হইলে মান নষ্ট হয় না। শোকর কর। এই ঘটনা যদি সাবালক হইলে ঘটতো! কি হইতো বুঝতে পারোস? কেউ বিয়ে করতো? সামিনা মাকে খানিকটা ভরসা পেতে দেখে। হ্যাঁ, নাবালক। তাহমিনা আর ও তো সমান। দুইজনের কেউই এখনও মাসিক পায় নাই। সামিনা সব শোনে, আবার শোনে না। কারো কোন কথা ওর মগজে সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। কি ঘটে গেছে? কেন ঘটলো? কি এর ফলাফল? নাবালক, সাবালক ইত্যাদি কেন মা-খালার আলোচনার বিষয়বস্তু এসবের কোনকিছুই ভাবার মত অবস্থায় নেই সে। তাছাড়া এ-জাতীয় আলোচনা ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তাভাবনা করার মত বয়সই ওর না। নয় গিয়ে কেবল পড়েছে দশে। সারা গায়ে ব্যথা আর জড় অনুভূতি নিয়ে ছিন্নভিন্ন একটি সন্ধ্যার দুঃসহ যন্ত্রণায় ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। ও মা মা করে ডাকতে থাকে।           

এরই মধ্যে জানা গেল মোহন মাস্টার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। সামিনার বাবা মোহন মাস্টারের খোঁজে তার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত ঘুরে এসেছে কিন্তু কেউ তার কোন হদিস দিতে পারেনি। সামিনার বাবার এই কাজটিকে বড়খালু সাধুবাদ জানাতে পারে না।  

কেন ঘা খুঁচায়ে বড় করতেছো? এখন তো আমরা জানি। ওই বদমাইশের পিছনে লাইগা থাকলে আরও লোক জানাজানি হইবো। 

সামিনার বাবা ক্ষোভ ঝাড়ে, তাই বইলা এমনেই ছাইড়া দিবো দুলাভাই?    

কি করবা? থানা-পুলিশ? মানসম্মান থাকবো কিছু? মানুষের সামনে মুখ দেখাবা ক্যামনে? চুপচাপ থাকো। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবো।   

সামিনার বাবার যেন বোধদয় হয়। আর কোন কথা বলে না। লোকটির চোখেমুখে অস্থিরতা। সারাক্ষণ একটা ক্ষোভ চেপে রেখে অল্পতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলছে। স্ত্রীর সাথে কথা বলতে গিয়ে সবকিছুতেই তর্ক বাঁধিয়ে শেষমেশ স্ত্রীকে দোষারোপ করতে করতে ঝগড়ার ইতি টানছে এই বলে যে তার জন্যই মেয়ের আজকে এই অবস্থা। সামিনার মা প্রথমে গলা চড়ায় তারপর কাঁদতে থাকে। গত কয়েকদিনে অসংখ্যবার তাকে শুনতে হয়েছে যে মেয়ের মা হওয়ার কোন যোগ্যতাই তার নেই। কেননা মেয়ের মায়ের আলাদা হুঁশ লাগে। বাড়তি সতর্কতা লাগে। সেসব তার নাই। সামিনা বোঝে না বাবা কেন এই একই কথা বারবার মাকে শোনাচ্ছে। রংধনু খুঁজতে গিয়েছিল সে। এতে মায়ের দোষ কোথায়? ওরই বা দোষ কোথায়?  

ক্লিনিক থেকে ফেরার পর প্রথম আসে শমসেরের মা। সামিনা কাঠের পুতুল! নড়ে না। ওর মা ঠেলে দেয় ভিতরের ঘরে, কোন শব্দ যেন না শুনি। এই ঘর থেকে একদম বের হবি না। সামিনা মাথা নাড়ে কিন্তু বোঝে না কেন তাকে চুপ থাকতে হবে? এমনিতেই গত কয়েকদিনে ঘরবাড়ি ঝিম ধরে আছে। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলছে না। উচ্চস্বরে কি কেউ কারো সাথে ঠিক মতো কথাই বলছে না। সামিনার বাবা যদিও মুহূর্তে মুহূর্তে অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন তবে তা যেন চার দেয়ালের বাইরে না যায় তেমন এক ধরনের সতর্কতা তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বাড়ির সবার একসাথে খাওয়াদাওয়া, সন্ধ্যার পর টেলিভিশন দেখাও বন্ধ। আগেকার কোন রুটিনই কেউ মেনে চলছে না। বরং প্রতিবেলায় ওয়াক্ত পেড়িয়ে যাওয়ার দীর্ঘক্ষণ পর পর্যন্ত জায়-নামাজের উপর বসে কোরআন তেলাওয়াত করা এখন সামিনার মায়ের নতুন রুটিন।     

কি গো সাড়াশব্দ নাই ক্যা তোমাগরে? কুনোহানো গেছিলা? শমসেরের মায়ের প্রশ্নে থতমত সামিনার মা বলে, না কই আর যাবো?   

দেখলাম না কয়দিন!

ও ও ও আপার বাসায় গেছিলাম।

একদিন তো তোমার বইনরেই আইতে দেখলাম সন্ধ্যা সময়? তুমি কখন গেলা?

গেলাম আপার সাথেই। 

শমসেরের মায়ের পিছু পিছু ভুলুর মা। দুজনেই সামিনাদের নিকটতম প্রতিবেশী। গেল মঙ্গলবার বড় মাঠে কার ম্যায়ার জানি সর্বনাশ হইছে? শুনছো নাকি?, ভুলুর মা ফিসফিস করে। 

শমসেরের মা তাল দেয়, পাড়ারই ম্যায়া শুনলাম।  

জানি না বলে সামিনার মা কাজের বাহানা ধরে। প্রতিবেশীরা সামিনার মায়ের উত্তরের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই বলতে থাকে, বেশি বড় না নাকি! ছোট ম্যায়া। সামিনার বয়সী হইবো। সবাই তো তাই কইতাছে। 

সামিনা কই? এই বলে ভুলুর মা হঠাৎ ঘরের ভিতর, বারান্দায় ইতিউতি তাকাতে শুরু করে। শমসেরের মাকেও এই প্রশ্নের উত্তর জানতে বেশ উৎসাহী হতে দেখা যায়। সামিনার মা যখন বলে, ঘুমায়, দুই প্রতিবেশীর কাউকেই এই উত্তরে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে দেখা যায় না। দুপুর বেলা ঘুমায়?’—প্রতিবেশিদের আপাত নির্দোষ এই প্রশ্ন সামিনার মাকে ধৈর্যহারা করে তোলে, কেন দুপুরবেলা ঘুমানো কি মানা? রাগো ক্যান? রাগার মত কি কইলাম?, শমসেরের মা যেতে যেতে বিরক্তি প্রকাশ করে।    

ওরা চলে গেলে সামিনা মাকে আরেকদফা কাঁদতে দেখে। কিসের সর্বনাশ? কার সর্বনাশ? কার কথা বললো শমসেরের মা? ওকেই বা খুঁজলো কেন ভুলুর মা? ওরা কি তবে ওর কথাই বললো? ওর কিভাবে সর্বনাশ হয়েছে? আর এই শুনে মা কাঁদছে কেন সামিনা ভেবে আকূল হয়। এতসব বিষয়আশয় না বুঝলেও সামিনা বোঝে যে ওর চেনাজানা পরিবেশ আর আগের মত নেই। বাবা-মা, ভাইসহ আশেপাশের সবাই কেমন বদলে গেছে। বদলে গেছে সে নিজেও। এক প্রকার গৃহবন্দী জীবন তার। স্কুল বন্ধ, খেলাধুলা বন্ধ, সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসা বন্ধ। আগে দুই ভাইবোন একসাথে স্কুলে গিয়েছে, বাড়ির বাইরে, রাস্তায়, মাঠে সবার সঙ্গে খেলাধুলা করেছে। এখন সায়েম একা একাই স্কুলে যায়, খেলে, না হয় চুপচাপ পড়ে। সামিনার মা দিন দিন আরও বেশি সময় ব্যয় করতে থাকে জায়নামাজে। বাবাও কাজ ছাড়া তেমন একটা বাইরে যায় না। বাইরের জগতের সাথে সামিনার যোগাযোগ বলতে তাহমিনা। তাহমিনা আর ওর বাবা-মা ছাড়া ওদের বাসায় কেউ আসেও না। একটা বৃত্তবন্দী জীবন। যে বৃত্তের ভেতরটা একদম ফ্যাকাশে। কোন রঙ নেই।     

রংহীন সেই সময়ে একদিন দাদু এসে পড়লেন। সামিনা, সায়েম দুই ভাইবোন পুরোনো সময়ে ফিরে গেলো যেন! আশ্চর্য ব্যাপার হলো সামিনার মা শ্বাশুড়ির সাথে আগের মতো আচরণ করলেন না। বরং একটু স্বস্তিই পেলেন যেন! সামিনার কত কথা দাদুর সাথে। দাদুর উপস্থিতিতে, গায়ের গন্ধে কি যেন আছে! এই মানুষটা আশেপাশে থাকলে ওর সবকিছু বর্ণিল মনে হয়। সামিনাকে বিগত কিছুদিনের গুমোট পরিবেশ থেকে এক ঝটকায় মুক্তি এনে দেয় দাদুর সঙ্গ।     

দাদু এলো আর কাকতালীয় এক ঘটনা ঘটলো। সেই সেদিনের মত সারাদিন বৃষ্টি। তারপর বিকেলে পৃথিবী রাঙিয়ে উঠলো অপরূপ এক রংধনু। সামিনা বাইরে বের হওয়া দূরে থাক জড়োসড় হয়ে সারাদিন পড়ে রইলো ঘরের কোণে। দাদু ওকে টেনে নিয়ে এসে উঠানে দাঁড় করায়। দেখ বুবু, এইখানে যেমন সাতটা রঙ আছে। জীবনেরও সেইরকম হরেক রঙ আছে। কোন একটা রঙে আটকায়ে থাকে না জীবন। এখন বুঝবা না। যখন বড় হবা আস্তে আস্তে বুঝতে পারবা। সেই শেষবার সামিনা দাদুর সঙ্গে রংধনু দেখেছিলো আর অনেক অনেক দিন পরে বুঝেছিলো জীবনের কী এক অমূল্য দর্শন দাদু তাকে দিয়ে গেছেন শেষ সফরে। হ্যাঁ শেষ, কারণ এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দাদু মারা যান।       

 

তিন 

সন্ধ্যা নামছে। সামিনা আরেকবার আকাশ দেখলো। নাহ রংধনু নেই। ইদানীং এই শেষ বিকেলটা পার করা ওর জন্য ভারবহ হয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে ঘুরে ফিরে আসে তারা। যাদের ফেলে এসেছে সে। দূরতম অতীতএকঘেয়ে, দুঃসহ সে অতীত ওর ঘর, বারান্দা আর একটুখানি আকাশকেও রেহাই দেয় না। কাকে বলবে সে এই কথা? কাকে দেখাবে সে এই বেদনাভার? অন্তুটাও আসে না প্রায় তিন সপ্তাহ। আগামী সপ্তাহে অন্তত ছেলেটা আসবে, এই ভেবে খানিকটা স্বস্তি পায় সামিনা। ভাবে জীবনভর একটু ভাল থাকা, একটু আনন্দ কত চড়া দামেই না কিনতে হলো! তা নয়তো কি? শৈশবের সেই এক ঘটনার রেশ টানতে হলো আজীবন। যে ঘটনায় তার না ছিল ভূমিকা, না ছিল অংশগ্রহন, না ছিল আনন্দ তবু তার নিয়ন্ত্রণাধীন হয়েই থাকতে হলো জীবনের সবগুলো ধাপে। বেছে নিতে হলো হিসেবের এক জীবন। মাপা।

প্রথমে তো স্কুল বন্ধ। একে একে বাইরে যাওয়া বন্ধ, খেলেধূলা বন্ধ। বাবা-মা ছাড়া কারও সামনে যাওয়া বন্ধ। তবে স্কুল বন্ধ হলেও অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে সামিনার বাবা বার্ষিক পরীক্ষা দেয়ার বিশেষ অনুমতি নিয়েছিল বলে সামিনা উপরের ক্লাসে উঠতে সমস্যা হলো না। সে বছরটা শেষ হলো সামিনার বাবার অন্য একটি জেলা শহরে বদলির আদেশ আসার মধ্য দিয়ে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সামিনারা সেই জেলা শহরে চলেও গেল।           

নতুন শহরে এসে নতুন স্কুল, নতুন ক্লাসক্লাস সেভেন। এখানে এসে সামিনার স্কুলে যাওয়ার অনুমতি মিললো, তবে, তা কেবল মায়ের সাথে। জীবন একইরকম বৃত্তের ভিতর। আগে তবু তাহমিনার সঙ্গ পাওয়া যেত এখানে তেমন কেউ নেই। সহপাঠীদের দু-একজনের সাথে সখ্যতা তৈরি হলো বটে কিন্তু তা খেলাধুলা, গল্প, যোগাযোগ হওয়ার মত সখ্যতা নয়। পাড়ার বন্ধুরা প্রতিদিন সোমাদের বাড়ির পিছনে ক্রিকেট খেলে। কেউ কেউ ওকে আসতে বলে কিন্তু ওর তা বারণ। স্কুলের পর মেয়েরা সবাই দলবেঁধে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে। সামিনাকে প্রতিদিন ধরাবাঁধা রিকশা করেই ফিরতে হয়। মা যেদিন যেতে পারে না সেদিনও। কোন পরিস্থিতিতেই বন্ধুদের সাথে হেঁটে হেঁটে ফিরবার অনুমতি নেই ওর। এব্যাপারে মা-বাবা দুজনেই খুব কঠোর। রিকশাটা প্রতিদিন যখন গল্পে মশগুল বন্ধুদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয় সামিনার চোখের বাধ ভাঙে। গলা ধরে আসে। কি এক খেয়ালে একদিন সোমার সাথে হাঁটতে শুরু করে আর হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে যায়। বাড়ি পৌঁছে মায়ের অজস্র প্রশ্নবাণ আর অসহ্য বকুনিতে সেদিন সামিনার মনে হয়েছিল পালিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। সামিনার বাবা জানবার পর পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। কেননা বাবার ধারণা বন্ধুদের সাথে হেঁটে আসার জন্য নয়, এর পেছনে ওর অন্য কোন গোপন উদ্দেশ্য ছিল। সামিনার মা সাফ জানিয়ে দেয়, স্কুল আর বাসা। এর বাইরে এক পাও নড়বি না। কলঙ্ক তো করছিস একটা। টের পাস না? কলঙ্ক? কিসের কলঙ্ক? কাঁদতে কাঁদতে সামিনার দাদুর কথা মনে পড়ে। দাদু কখনও ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি। কোনদিন তাকে কষ্ট দেয়নি কিন্তু বাবা-মা দেয়। সবসময় দেয়।         

নতুন পাড়ায় এসে সামিনার সঙ্গী হয় তাই ফুল, গাছ, পাখি, আকাশ, বৃষ্টি আর রংধনু। সামান্য বৃষ্টি হলেই বাড়ির আশপাশটা পানিতে ডুবে যায়। সোমাদের মাঠ তখন বিশাল আকারের এক নদী আর পানিবন্দী ঘরগুলো এক একটা দ্বীপ। ছেলেপেলে ছোট ছোট জাল ফেলে সারাদিন মাছ ধরে। জানালা দিয়ে দুই ভাইবোন তাই দেখে। কেমন এডভেঞ্চারে ভরা ছিল বৃষ্টিবন্দী দিনগুলো। ঘরে বাইরে হাঁটু পানি। ঘরবাড়ি ডুবে গিয়ে আশেপাশের ডোবা-নালা, ল্যাট্রিন সব একাকার। ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত সেই পানি পাড়ানো ছিল মায়ের বারণ। বিছানার উপর বসে ঘরে ভিতর মাছেদের ঘুরাফিরা দেখতে দেখতে রঙিন ছোটখাটো সাপও চোখে পড়তো কখনও কখনও। সামিনারা হৈ চৈ শুরু করতো। মাইচ্ছা সাপ, বিষ নাই’—বলতো পাড়ার ছেলেগুলো। তবু শিশুসুলভ ভয়ে শিউরে উঠতো সামিনা। সায়েম হাতের কাছে যা পেত তাই দিয়ে ঢিল দিত সাপগুলোকে লক্ষ্য করে আর সাপগুলো ছুটে পালাতো এদিক সেদিক।

ঘরের ভেতর পানি প্রায় বিছানা ছুঁইছুঁই। বৃষ্টিতে, পানিতে রান্নার চুলা, লাকড়ি সব ভিজে ব্যবহারের অনুপযুক্ত। তবে সারাবছর লাকড়ির মাচায় থাকা মায়ের আপদকালীন চুলাটি  তখনই কাজে আসতো। টেবিল কিংবা অপেক্ষাকৃত উঁচু কোনস্থানে সেটি বসিয়ে চালানো হতো সাময়িক রান্নাবান্নার কাজ। কেমন একটা চড়ুইভাতি চড়ুইভাতি ভাব চলে আসতো। দুই ভাইবোনের সাধারণ জীবন হয়ে উঠতো একদম অসাধারণ। পড়াশোনার তাগিদ নেই। স্কুলে যাওয়া নেই। বিছানার উপরেই খেলনাবাটি, পুতুলের বিয়ে, ভাইবোনে গড়াগড়ি, মারামারি আর মাঝেমধ্যে রংধনু। তারপর একদিন লাগাতার বৃষ্টি থেমে এলে ঘটতো সকল আনন্দযজ্ঞের পরিসমাপ্তি। 

 

চার 

সামিনা তার শৈশব-কৈশোরের গল্প অন্তুকে শুনিয়েছে। তবে অন্তু কেবল অবাক হয়ে শুনেছে। বাংলাদেশের বাইরে জন্ম নেয়া, এবং বড় হওয়া অন্তুর কাছে বাংলাদেশ যেন এক রূপকথা! সামিনা সবকিছু বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য চেষ্টার কমতি রাখেনি। ইউটিউবে পাওয়া ভিডিও, ডকুমেন্টারি, সিনেমা এসবের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম, মফস্বল বা রাজধানী ঢাকার অবয়ব তৈরি করতে গিয়ে মোটামুটি গলধঘর্ম হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে মানবিক সম্পর্কগুলোর ধরণ বোঝাতে গিয়ে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে বসবাস করে আপাত সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশী সমাজের অভ্যাস, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, চর্চা ইত্যাদি বোঝাতে গিয়ে সামিনা একসময় ক্ষ্যান্ত দিয়েছে। তাছাড়া ছেলে বড় হওয়ার সাথে সাথে ছেলের আগ্রহ, অভ্যাস, পছন্দের সাথে ওর টানাপোড়েন অবধারিত হয়ে পড়ে। মাতৃত্বের দেশীয় যে রূপ সে সারাজীবন দেখে এসেছে এর বাইরে গিয়ে তথাকথিত আধুনিক, পশ্চিমা মাতৃত্বের ধরন-ধারণ আয়ত্ব করা ওর জন্যে জরুরী কিন্তু ভীষণ কঠিন ছিল বৈ কি! অনুগত সামিনার ইচ্ছা, পছন্দের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক ছিল ওর বাবা-মা, এমনকি পুরো সমাজ। নতুন একটি সমাজে মা সামিনার জন্য যা কল্পনাতীত। কেননা শিশুরা এখানে গণ্য হয় একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসাবে। নিজের সন্তান বলে তার উপর নিজের ইচ্ছা, চাহিদা চাপিয়ে দেয়া, বলপ্রয়োগ করতে চাওয়া এখানে অপরাধ। তাছাড়া জামান, সামিনার বর, দীর্ঘদিন বাংলাদেশের বাইরে থেকেছে। বিদেশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত বর, নতুন সমাজ ও সংস্কৃতির সাথেও খুব দ্রুতই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল সামিনা।  

কলেজে পড়ার সময় বাবা-মায়ের পছন্দে সামিনার বিয়ে হয় ওর কাজিন জামানের সাথে। জামান সামিনার অচেনা কেউ নয়। তবে কেন জামান ওকে বিয়ে করতে আগ্রহী হলো সামিনা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে। যদিও কাউকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেনি কিংবা জিজ্ঞাসা করার মত যে সাহস আর অকপট ব্যক্তিত্ব দরকার সামিনার তা ছিলই না, তবে মনে মনে সে খুশি হয়েছিল এই ভেবে যে জীবনের অনেকটা সময় বিদেশে থাকার জন্যই জামানের মনটা অনেক উদার! এবং উদার মন মানসিকতার জন্যই সে সামিনার প্রতি আগ্রহী হয়েছে। সামিনা দ্বিমত করেনি বরং প্রায় সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন ও বাবা-মায়ের কঠোর অনুশাসনের কবল থেকে বাঁচতে জামানের সাথে দেশের বাইরে স্থায়ী হতে পারাকে আশীর্বাদ হিসাবে নিয়েছিল। বরের সাথে নতুন দেশে এসে প্রথম প্রথম সামিনার সবকিছু তাই স্বপ্নের মত মনে হতে থাকে। এমন একটা জীবনও তার হতে পারে!  

স্বপ্নভঙ্গ হতে সামিনার খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রাথমিক ঘোর কেটে যাওয়ার পরপরই অন্য এক জামানকে আবিষ্কার করে সে। প্রথম প্রথম অমনোযোগী, রাগী ইত্যাদি ভেবে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে সে। কিন্তু আস্তে আস্তে টের পায় জামান আসলে ওর সাথে নেই। একদিন  জামানই জানায় ওর স্ত্রী বিদ্যমান, এবং ওদের একটি সন্তানও আছে। বিদেশি মেয়েকে বাবা-মা পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নিবে না বলেই ও রাজী হয়েছিল সামিনাকে সামাজিকভাবে বিয়ে করতে। কিন্তু ততদিনে সামিনা অন্তুর আসার অপেক্ষায়। অন্তুর জন্মের কিছুদিন পরই জামান বাড়ি ছাড়ে। এরপর  কখনও সপ্তাহে, কখনও মাসে, তারপর কালেভদ্রে এসে ছেলেকে দেখে যেত। একসময় আর আসেনি। অন্তুকে নিয়ে সামিনার শুরু হয় একাকী জীবন। বিদেশ বিভূঁইয়ে ছেলেকে একা বড় করতে গিয়ে সামিনার আর দেশেও যাওয়া হয়নি। অন্তু বাংলাদেশকে চেনে মায়ের মাধ্যমে। বলতে গেলে মাই ওর কাছে বাংলাদেশ।    

সামিনার বাবা-মা গত হয়েছেন বহুবছর। সায়েম নিজের মত নিজের জীবনে। অন্তুর জন্য গত পঁচিশ বছরের যুদ্ধে ক্লান্ত বিধ্বস্ত সামিনার নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগই আসেনি। শেষমেশ বাইপোলার ডিস অর্ডারে ভুগতে ভুগতে ঠাঁই হয়েছে এই মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে। আজ ছিল শনিবার। অন্তু আসেনি। নার্স বলেছিল আজ আসবে। সামিনা ছেলেকে মেসেজও দিয়েছিল, উত্তর পায়নি। অন্তু যদি আসেএই ভেবে সামিনা সারা বিকাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। 

নার্স এসে ঘরে আলো জ্বালায়। ইউর সান ইজ নট কামিং টুডে। হি ইজ বিজি।  

ও ও ও, এইটুকু বলে সামিনা বিছানায় গিয়ে বসে। নার্স ঔষধ দেয়। খায়। জানালার ফাঁক দিয়ে অল্প আকাশ। সামিনা বাচ্চাদের মত গাল ফুলায়। রংধনুটা ওঠেনি। অন্তুও আসেনি। অন্তু এলে, ঠিকই উঠতো, মনে মনে ভাবে সে। 

নেক্সট উইক ইজ ইউর বার্থ ডে সামিনা। হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু ডু?  

বোকার মত সামিনা জানতে চায়, অন্তু কি আসবে?  

আই থিংক হি ক্যান নট মেক ইট অন এ ওয়ার্কিং ডে।     

সামিনার সব রাগ গিয়ে পড়ে ঐ রংধনুর উপর। আকাশের দিকে তাকিয়ে ওর কেবল মনে হয় ওর কি আর কিছুই পাওয়ার নেই? সামান্য একটু রঙিন আকাশ, তাও না? সে উপলব্ধি করে, যে রংধনু সে খুঁজে খুঁজে দিশেহারা তা চিরতরে হারিয়ে গেছে। আরও উপলব্ধি করে রংধনুর মতই স্বল্পকালীন আয়ু নিয়ে কিছু প্রিয় মানুষ এসেছিল ওর জীবনেদাদু, সায়েম, জামান, অন্তু, এদের প্রত্যেকেই তাকে দিয়ে গেছে ক্ষণস্থায়ী অথচ মূল্যবান সব রঙ। আজ এই ভেজা সন্ধ্যায় বাগানের গাছগুলো থেকে চুয়ে পড়া বৃষ্টির পানি দেখতে দেখতে ভীষণ আপন একটা গায়ের গন্ধ আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। যে গন্ধটি ভুলিয়ে দিতে পারে রাজ্যের বিষাদ। মুছে দিতে পারে গভীর শূন্যতা। এনে দিতে পারে রংধনু বিকেল। সামিনা বুঝতে পারে ওর মত মানুষেরা এক জীবনে না পাওয়ার যন্ত্রণায় যত না পোড়ে তারচেয়ে বেশি পোড়ে স্মৃতি কাতরতায়। লাল-নীল-হলদে-সবুজ অমূল্য সব স্মৃতি। জীবন তার সমস্ত রঙ ঢেলে ওকে সেই স্মৃতির আবীর মেখে দিয়ে গেছে, এই শেষবেলায় আর কোন রঙ তার পাবার বাকি নেই।