একদিন ডেকেছিল নীল সুন্দর
এই অতল জলরাশি, পারঙ্গম জল নিনাদ এতোই দুর্নিবার যে, এর হাতছানি বারবারই পরোয়া করতে ভালোলাগে। জলের তরল লাবণ্য, প্রতি মুহূর্তে রচিত নতুন ঢেউ কৈশোরিক উচ্ছ্বাসে তীরে এসে আছরে পড়তে না পড়তেই তরুন অসহিষ্ণুতায় আবার সাগরে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। রিসোর্টের নাকের কাছে মহাসমুদ্র। কাঠের ব্যালকোনিতে বসে জলের গম্ভীর নিনাদ আর কাঁহাতক শোনা যায়! তরঙ্গের উসকে দেয়া তরল গানে জলে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে শরীর, মন। যুবকের গলায় ঢেউগুলো আমাকে ডাকে। আমি যারে ভালোবাসি তার নাম জল দিয়ে লেখা। ওই নাম জানে সমুদ্র আর জানি আমি। কফি শেষ করে, আছড়ে পড়া ঢেউকে বলি—আসছি। দারুচিনি দ্বীপের একদম দক্ষিণে এই কাঠের রিসোর্ট। ‘নীল বিলাস’ নিরালায়, নিভৃতে। জলকে চলো, জলকে চলো... গাইতে গাইতে ভালোবাসার পুরুষকেও গাই মনে মনে। পায়ের চপ্পল বালির বিছানায় ছুঁড়ে সমুদ্রকে গভীর আলিঙ্গনে বাঁধি। নভেম্বরের মাঝামাঝিতেও রোদ প্রখর তেজি এখানে। সামিয়ানা বলতেও তো সেই আকাশ! ওর দীপ্তি হরণ করে, কার সাধ্য! জলে নেমেই শরীরে পুরুষ স্পর্শ পাই। জলে লেখা নামটা হো হো হেসে ওঠে। জোনাথন... ম্যাথিও জোনাথন, এ জলে লেগে আছে তোমারও অবগাহন স্মৃতি। ডুব দিয়ে ভেসে উঠে বালির মসৃণ পাটাতনে তাকিয় থ মেরে যাই, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বালক জোনাথন। আমার ম্যাথিও! বিমূঢ় দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিশোরী গলায় ডাকি ওকে—ম্যাথিও ওওওও, জলে আসো জলে, তোমার বয়স এতো কমলো কী করে? আবার ভুস এক ডুব দিয়ে জলে লেখা নামটা নাড়াচাড়া করি। এবার নিশ্চয় উঠে দেখবো জোনাথন নেই, চলে গেছে। সমুদ্র থেকে মাথা উঠিয়ে দেখি ও এখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ওর ব্যাক গ্রাউন্ডে সবুজ কেয়া বন। কী নিবিড় হরিৎ! জোনাথনকে দেখাচ্ছে একটা লাল অ্যালগোর মতো। সেন্ট মার্টিনের সবচেয়ে সুন্দর শৈবাল। এখানের লোকজন শৈবালকে পেজালো বলে। আবার ডুব দিই। এবার মুঠ ভরে দারুচিনি তুলে আনি, আরব বনিকদের দারুচিনি বোঝাই বিশাল জাহাজটা এখানেই ডুবে গিয়েছিল। ভেজা অঙ্গে জোনাথনের দিকে হাঁটি। কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে, গায়ে জড়িয়ে আছে সিক্ত বসন, নিচে বালি। চরণ যেন এগোয় না। মুঠেোর দারচিনিগুলোর একটাও নেই! আর আমি তো এও জানি একটু পরে জোনাথনও হাওয়া হয়ে যাবে। ও এখানে আসে কী করে! আমার নীল নয়ন ম্যাথিও তো এখন মালদ্বীপ। সেও এক জলের কাব্যগাঁথা দেশ। চোখ বন্ধ করে খেলাটা খেলি—জোনাথন আছো তুমি? এর মধ্যে সাগরের ঢেউ বেশ ক'বার চরণ ধুয়ে গেছে। আমার ঠোঁটে গান নাচে—
চরণও ধরিতে দিও গো আমারে,
নিও না, নিও না সরায়ে
জীবনও মরণে সুখ-দুখ লয়ে
বক্ষে ধরিও জড়ায়ে...।
কিন্তু একি! চোখ বন্ধ করেও বুঝি কিশোর জোনাথন আসলে কল্পনা নয় সত্যি। ও আমার কোমল স্পর্শে পিছলে যায়। চোখ খুলে হাসি এবার—কী নাম তোমার? ছেলেটা আমার কাণ্ডে ভড়কে গিয়ে ঘষটানো স্বরে কোনমতো জবাব দেয়—জুনায়েদ। নুয়ে ওর চিবুক ছুঁই—এখানেই বাড়ি তোমার? ও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। আমি বলি: তোমার মায়ের নাম কি মরিয়ম? ও আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লইট্টা মাছের মতো পিছলে সমুদ্রের তটরেখা ধরে দ্রুত দৌড় লাগায়। ওর সোনালী চুল টপকে সমুদ্রের হাওয়ারা সুদূরগামি হলেও তাতে পরোয়া নাই ছেলেটার।
রিসোর্টে ফেরার পথে জোনায়েদ বিষয়ক ভাবনারা আমার সঙ্গী হয়। ও কী মরিয়মের আত্মজ? জোনাথনের কাছে আমি মরিয়মের গল্প শুনেছি।
এতো বড় রিসোর্টে আমি এখন একা। সহকর্মীরা সব ব্রেকফাস্ট করে ছেঁড়া দ্বীপের কাছাকাছি সুন্দর বনে লোকাল প্রজেক্ট ভিজিটে গেছে।
এখানে আসায়, রথ দেখা আর কলা বেচার মতো আনন্দ কুড়াচ্ছি। ইউ এন অর্গানাইজেশনের হয়ে আমরা একটা প্রি ইভালুয়েশন সার্ভে করতে এসেছি। আমি এর কো-অর্ডিনেটর।
রোদ কমলে বিকেলে যাবো দক্ষিণ পাড়ায় খোদেজার বাড়ি। প্রি সার্ভের দলনেতা ও। ছোট্ট দ্বীপে সবাই সবাইকে চেনে। খোদেজা নিশ্চয় মরিয়ম সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। আমার প্রবল কৌতূহল এক্ষুনি দক্ষিণ পাড়া যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে চাইলেই যখন তখন কোথাও যাওয়া যায় না এখানে। বাহনের জন্য আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয়। পনের দিনে বেশ কিছু স্থানীয় পরিবারের সাথে পরিচয় হয়েছে। প্রথমে ভাষাটা বুঝতে কষ্ট হলেও এখন মোটামুটি রপ্ত হয়ে গেছে। মহিলাদের খুব একটা বাইরে বেরোতে দেখা যায় না। ‘কর্মে নারী সম্পৃক্ততা, ও সংসার পরিচালনায় এদের ভূমিকা’ মূলত এর ওপর ভিত্তি করে এই সার্ভে। প্রি সার্ভের রিপোর্ট সেটিসফাইড হলে ভবিষ্যতে মেয়েদের জন্য হয়তো কোন প্রোজেক্ট সেট হতে পারে এখানে।
বছর বারো আগে জোনাথন এই দ্বীপে চাকরিসূত্রে তিনমাস ছিল।
রাতের সমুদ্র দেখার চেয়ে শোনা যায় বেশি। জোনাথনকে সমুদ্র শোনাতে চাই। যদিও ওর কাছেও সমুদ্র আছে। জোনাথন আমার জীবনের প্রথম পুরুষ যে আমাকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলেছে।
গোঁড়া, ধর্মভীরু মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের মেয়ে আমি। আমার বড় বাবা [দাদার বাবা] ছিলো গায়েন। গায়েনের কোন ছেলে সন্তানই বাঁচতো না। এগারোটি পুত্র প্রসব করা তাঁর ক্লান্ত স্ত্রী চল্লিশের ঘর পূরণের আগেই মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুর পর পরিবার তাঁকে খুব পরহেজগার, ধর্মভীরু এক নারীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করে। পুত্র সন্তান জন্মায় সে স্ত্রীর গর্ভে। ছেলের সাত বছর বয়সে গায়েন মারা গেলে, পুরো পরিবার কঠিন ধর্ম খোলসে আশ্রয় নেয়। এমনকি অসূর্যম্পশ্যা নারীদের ঘরেও নেকাব ঢাকা হয়ে থাকতে হতো। ছেলেরা মক্তব, মাদ্রাসায় গেলেও মেয়েদের পড়াশোনার হুকুম ছিল না । সেই পরিবার থেকে উঠে আসা আমি জোনাথনের নাম লিখে রাখি জল দিয়ে। একশো বছর অতিক্রম করা সময় আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিলে আমি রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছোই। ক্রমশ টের পাই বুড়া গায়েনের পুনর্জন্ম হয়েছে আমার রুহুতে। সাহসী, অসম্প্রদায়িক; তাঁর মতো গলায় সুরও আছে। বলা যায় সঙ্গীত পাগল মানুষ আমি। কোথাও তালিম নেইনি, তবু ঠিক তাল ও লয়ে গাইতে পারি। যদিও গাই আমি কেবল নিজের আনন্দে। পড়াশোনা শেষ করার পর পরই চাকরি পেয়ে যাই।
চাকরি পাওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে দাদি মারা যায়। ইউএন অর্গানাইজেশনে জয়েন করে ট্রেনিং করতে দেশের বাইরে আমার প্রথম উড়াল। জোনাথনের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় দেখা। ও ছিল ট্রেনিং অর্গানাইজার। আইস ব্রেকিং সেশনে আমার খালি গলার—‘জাত গেল জাত গেল বলে...’ শোনে আর সবার মতো মুগ্ধ না হয়ে পারেনি ও। পরে জেনেছি জোনাথন বাংলাদেশে কয়েক বছর থেকে গেছে। কাজের সুবাদে লালনের ছেঁউরিয়ার আঁখড়ায় কিছু দিন যাওয়া-আসা ছিল। বাংলাটা বেশ ভালো বলে জোনাথন।
সমুদ্র শোনাতে গিয়ে আমি নিজে ভাব সাগরে ডুবতে ডুবতে ম্যাথিওকে ফোন করি। ওকে জোনায়েদের কথা বলি না। জানাই: তোমার মরিয়মের একটা হদিস পাওয়া গেছে সম্ভবত। জোনাথনের গলা তরল শোনায়—রিয়েলি! তারপর একটু চুপ থেকে বলে: মরিয়ম ইজ নট মাইন। আজ সানডে। উইকেন্ডের অলস সময়ে নিশ্চয় ওর হাতে রেড ওয়াইনের সুদৃশ্য গেলাশ। এতোদূরে বসেও টের পাই ওর ভাবালুতা। জোনাথন সেই পুরনো প্রেমিক গলায় হাসে: এরপর কিছুক্ষণ থেমে ওয়াইন ভেজা গলায় বলে—আই মিস ইউ হানি। সেন্ট মার্টিন রিয়েলি অ্যা ড্রিম আইল্যান্ড। এরপর দীর্ঘ নেটওয়ার্ক প্রবলেম।
বিকেলে দক্ষিণ পাড়ায় যাই। সমুদ্রের তীর ঘেঁষা প্রতিটি বাড়ির সামনে সূর্য ডোবার নান্দনিক আয়োজন চলছে। সন্ধ্যার আগে আগে সবাই কাজ গোছাতে ব্যস্ত। বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে বিদ্যুৎ নাই, সোলার পাওয়ারে চলে। হোটেল, বাজার ও রিসোর্টের জেনারেটর রাত ১২ টায় বন্ধ করে দেয়া হয়।
সূর্যাস্ত দেখার আকর্ষণ নেই এখানকার মানুষের। রোজকার সৌন্দর্য সম্ভবত ধীরে ধীরে আটপৌরে হয়ে যায়। কিন্তু এমন মহান সৌন্দর্যও কী করে সাদামাটা হতে পারে! এসব ভাবনার সুতো ছাড়তে ছাড়তে খোদেজার ঘরে ঢুকি। খোদেজা মাগরিবের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর আট/নয় বছরের মেয়ে বাইরে শুকাতে দেয়া সুটকি আনায় ব্যস্ত। দেখলাম, অতটুকুন মেয়ে খুব গুছিয়ে কাজ করছে। খোদেজার নামাজের প্রতিটা ভঙ্গি দাদিজান আর আম্মার কথা মনে করিয়ে দেয়। কতদিন নামাজ পড়া হয় না! খোদেজার নামাজের মাঝখানে বাইরে লাউড স্পিকারে নেহা কাক্কার গেয়ে ওঠে—দিলবার! দিলবার! দিলবার...! নেহা কাক্কার অবশ্য বেশিক্ষণ গাওয়ার সুযোগ পায় না। ওর সুরেলা গলা ক্ষীণ হতে হতে একসময় ডুবে যায়। সম্ভবত বাহনে করে কোন পর্যটক দল তাদের আনন্দ ভ্রমণ শেষে করে এ পথে ফিরে যাচ্ছে। গানটার সুর আমার ঠোঁটে ট্রান্সফার করে দিয়ে যায় ওরা। আমি গুনগুন শুরু করেও সিজদাহ্ রত খোদেজাকে দেখে থামি।
ওর নামাজ শেষ হতেই অনেকক্ষণ অক্ষত রাখা ধৈর্যের বাঁধ খুলে দিই। জোনায়েদ আর মরিয়মের বিষয়ে জানতে চেষ্টা করি। ছেলেটাকে চেনে নাকি, ওর মায়ের নাম মরিয়ম কি না ইত্যাদি ইত্যাদি...। খোদেজা খুব বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকায়—তু জানো কিবা! ফুয়ার বাফ হুমুদ্দুর মইরগো, ইতা মাছ দরবার গে…। দুক্ষর কতা, ফোলা হওনের আগত বাফটা মরি গেল। মইরম চাঁডি গাঁ থাকন। ফুয়া মাদরাসাত হড়ে। মেলা দিন মইরম ন আসি।
ফেরার সারা পথ খোদেজার কথাগুলো ঘোর বিভ্রমে ফেলে আমাকে। জোনায়েদ ওর বাবার মৃত্যুর পরে জন্মেছে। হতভাগ্য পিতা যদিও বা পিতা হয়েছিল তবু সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারলো না। সেন্ট মার্টিনে আসছি শুনে জোনাথন নিজেই মরিয়মের প্রসঙ্গে বলেছে। সেন্ট মার্টিনে জোনাথনের পাচক ছিল মরিয়মের বাবা। জোনায়েদকে দেখে মরিয়মের সাথে ম্যাথিওর শরীরি সম্পর্ক খুব অসম্ভব কিছু মনে হয় না আমার কাছে। এই বালক কী করে হুবহু জোনাথনের কার্বন কপি হয়! এমন কি ওর ভঙ্গী, নীল চোখ! জোনাথন ওর জীবনের অনেককিছু বলেছে আমাকে। অ্যান আর রেবেকার কথাও। ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ও বিচ্ছেদের কথা। রেবেকার সাথে দেখাও হয়েছে আমার। জোনাথন ইচ্ছে করলে মরিয়মের কথাও লুকাতে পারতো। এমন কী, মাঝে-মধ্যে মেয়েটা তার বাবার কাছে আসতো, সে কথাও বলেছে। আমি খুব জেদি জানে ও। সত্যে সাতখুন মাফ করলেও মিথ্যা বা কপটতার সাথে কোন আপোষ করি না বলে আগেই আত্মসমর্পণ! এসব ভাবতে ভাবতে পেরেশান হয়ে উঠি।
মাথা ঘুরে। গা গোলানো বমি বমি ভাব লাগে। শরীর ক্রমশ ভার হয়ে আসে আমার...।
ম্যাথিও এ-ও বলেছে, রিসোর্টের পাশেই মরিয়মদের বাড়ি ছিল। রাতে কখনও কখনও মরিয়মের উড়ে আসা সুরেলা গীত সে উপভোগ করতো। যদিও সেসব গানের বাণী ছিল ওর কাছে অবোধ্য। সেন্ট মার্টিন এসে পরদিনই আমি মরিয়মের খোঁজ নিয়েছিলাম। স্বামী এবং বাবার মৃত্যুর পর ও চিটাগং চলে চলে গেছে। গার্মেন্টসে কাজ করে, খুব একটা আসে না এখানে। কেউ ওর ঠিকানা বলতে পারে না।
কদিন প্রচণ্ড কাজের ব্যস্ততায় সময়ের নাগাল পাওয়া যায় না। পনের দিনের কাজের রিপোর্ট হেড অফিসে পাঠাতে হবে। এর উপর ভিত্তি করে ফান্ড ক্রিয়েটের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিষয়টি খুবই জরুরি । সেন্ট মার্টিনে নেটওয়ার্ক যোগাযোগ ব্যাহত থাকায় কক্সবাজার যেতে হলো। ম্যাথিওকে জাস্ট এ ম্যাসেজটা দেয়া ছাড়া আর যোগাযোগ করিনি। অভিমান! নিজেকে আটপৌরে লাগে। ছিলই বা মরিয়মের সাথে জোনাথনের শারীরিক সম্পর্ক! কী আসে যায়! কিন্তু জোনায়েদ? ম্যাথিও এ রকম বড় একটা সত্য হাইড করলে সেটা মানার মতো উদারতা থাকা সম্ভব! কয়েকদিন পর আবার ছেলেটাকে রিসোর্টে দেখি। প্রথম দিনের মতো ওকে গ্রহণযোগ্য লাগে না। আরও কিছু বালকের সাথে ডাব বিক্রি করতে এসেছে ও। রাতে জোনাথন ভিডিও কল দিলে শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যস্ততার কথা বলি। উদ্বিগ্ন গলায় জোনাথন আমাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে রেস্ট নিতে বলে। ওর কেয়ারিং আবেগকে প্রশ্রয় দেয়। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে হাসি: ডোন্ট অরি ডিয়ার, আ’ম ফাইন নাউ। ম্যাথিও ‘শুভরাত্রি’ সাথে চুমু জানিয়ে বিদায় নিলে আমি আরও অশান্ত হয়ে উঠি। পরদিন জোনায়েদকে কিছু বালকের সাথে সৈকতে খেলতে দেখি। ম্যানেজারের কাছে জানতে চাই বাচ্চাটাকে চেনে কী না। উত্তরে জানালো, ওর নানা একসময় এখানে সেফের কাজ করতো। বাবা নেই, এতিম। ঠিক তখনই জোনায়েদের নাম ধরে ডাকা এক মহিলা কণ্ঠ আমাকে কৌতূহলী করে তোলে। ম্যানেজারকে বলি—মহিলাটা কে? প্রত্যাশিত নাম শুনে ব্যালকোনি থেকে সিঁড়ি ভেঙে কাঠবেড়ালি লাফে ওদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই—আপনি মরিয়ম? বোরখার নেকাব উঠলে ওর অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে। সুশ্রী অবয়ব আমার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলায়: জ্বে হ। আন্নে কিডা?
এরা আমাদের মতো ভনিতা জানে না। সরল প্রশ্ন। বলি: এখানে উঠেছি, পর্যটক বলতে পারেন। আমার আপনি সম্বোধন সম্ভবত ওর কাছে অপ্রত্যাশিত লাগে। চোখ প্রসন্ন দেখায়। আমি অপ্রাসঙ্গিক জানাই: আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে এই রিসোর্টের ঠিকানা পেয়েছি। ওর নাম জোনাথন ম্যাথিও। মরিয়মের দৃষ্টি বিব্রত হয়ে ওঠে: জ্বে হেরে ছিনি। আঁর বাফ এআনে রান্ধনের কাম করতো। দুই/এগদিন দেখছোত তেঁআরে। আঁর মানুটার হাথে তেঁনার সুরতের এক্কই মিল আছিল। ‘আঁর মানু’ বলতে যে ও তার স্বামীকে বোঝাচ্ছে সেটা বোধগম্য হয়। যদিও ওর কথা জগাখিচুরি। এখানকার ভাষার সাথে হুবহু যায় না। হতে পারে তা বিভিন্ন জায়গায় দীর্দিন কাজের জন্য। বলি: আপনার স্বামী কোথায়? সব জেনেও মরিয়মের কাছে ভনিতা অব্যাহত রাখি। মরিয়ম লম্বা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে না। মাছ ধইত্তে গে সমুন্দরে নিখোঁজ হইছু। মরিয়ম ‘মৃত্যু’ কথাটা উহ্য রাখে। তারপর আবার ছেলেকে ডাকে—জুনাইদ, জলদি ল, আঁরা আইজ চাডিগা চলি যামু বাফ। মরিয়মকে আরও বাজাই: ম্যাথিও, আপনার কথা বলেছে। মরিয়মের কোন ভাবান্তর হয় না। বলে: হেই সাইবেরে দূর থাকি দুই/ এগ বার দেখছু, আব্বারে ডাইকতে আসি। তেমুন কথাবার্তা অয় নাই...। তারপর আবার সে ছেলেকে তাগাদা লাগায়: জুনাইদ, দেরি হয়্যা যাতিছে কিন্তুক...। এবার তার গলায় রাগ প্রকাশ পায়। আমি তাতে আরও সন্দেহ প্রবণ হয়ে উঠি: সেই সাইবের ফোন নম্বর আছে, যদি কোন সাহায্য লাগে, আমাকে বলতে পারো...। এবার তুমিতে নামি। মরিয়মকে বিরক্ত দেখায়: জ্বে না, তিনি ক্যান্ সাইয্য করবো কন! আমার সাতে যার দুইদিনেরও চিনাজানা নাই! মরিয়ম ছেলেকে এবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। নীল সমুদ্রের তট ঘেষে ওরা হেঁটে যায়। জোনাথনের লিটল ভার্সনকে দেখি আমি। ম্যাথিওর মতো ডান হাত দিয়ে ঘাড় জড়িয়ে আলতো ঝুঁকে হাঁটছে মরিয়মের গা ঘেঁষে।
এরপর আর কোনদিন ম্যাথিও জোনাথনের সাথে যোগাযোগ করিনি। পূর্ব পুরুষের সুর আমাকে দখল করে নেয়। গান হয়ে ওঠে আমার পৃথিবী। গলায় সুরের অভাব ছিল না, নিয়মিত তালিম আর অধ্যবসায়ে তা আরও খোলতাই হয়।
দশ বছর পর সেন্ট মার্টিনে এসেছি। আমাদের সেই মহিলা প্রজেক্ট অ্যাপ্রুভ হয়েছিল হেড অফিসে। এদের তৈরি কুরুশের টুপিসহ বেশ কিছু হাতের কাজ সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে অ্যাক্সপোর্ট হয় এখন। সে প্রকল্পের দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে আমি এসেছি গান করতে। এদের সান্নিধ্য সবসময় উপভোগ্য আমার কাছে।
ভোর বেলা সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখে পুরনো দিনের মতোই মুগ্ধতায় আপ্লুত হই। সাথে আমার ছেলে জাবেদ। ওর এই প্রথম সমুদ্র দর্শন। ছেলেটা ডান হাতে ঘাড় জড়িয়ে, একটু ঝুঁকে অপার বিস্ময়ে বলে: ওয়ান্ডারফুল! ওর ঠোঁট গোল করা ভঙ্গি, নীল চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে নীল জলরাশিকে বলি: একদিন ডেকেছিল নীল সুন্দর!
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন