অগ্নিবালিকা এবং অশনিপুরুষ
শেষে আমি এই অগ্নিপুরুষের প্রেমে পড়ে যাই। অগ্নিপুরুষ তো পুরুষ—প্রাণবান পুরুষ; নিছক পুরুষ প্রতিমা মাটি বা পাথর কী সোনার যাই হোক সে তো নারীর শরীর জাগাতেই পারে, যদি তা তেমন হয়! আর অগ্নিপুরুষ সে তো বিচিত্র শক্তিধর—অসীম শক্তিধর সূর্যের প্রতিভূ। বঙ্গভাণ্ডারের প্রথম সার্থক ট্যাজিডির নায়িকা কৃষ্ণাকুমারীরে সখি যখন জিগায়, তোমার এই অসংখ্য প্রেমিক রাজপুত রাজার মধ্যে কার প্রেমপত্রের জবাব তুমি দিবা? কৃষ্ণা তখন জানতে চায়, এগর মধ্যে কে সবচে বলী! সূর্য দেবতার পাশাপাশি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে জগতে অগ্নি উপাসক কম নয়। আমি এই অগ্নিপুরুষ দ্বারা ধর্ষণসহ নানা ক্ষতির শিকার হওয়ার আতঙ্কে যেমন তেমনি তার উত্তাপ লাভের গভীর প্রত্যাশায়—আর এমন মিশ্র দশার মধ্য দিয়েই আমার তার প্রেমে পড়া। আমার স্বামীর চে তার বয়স অনেক বেশি, কিন্তু আমার স্বামীধন এক সাধারণ পুরুষ মাত্র কিংবা মাত্র তিন-চার বছরের জীবনযাপনে সে আমার কাছে সাধারণে পরিণত। কিন্তু অগ্নিপুরুষ আমার কাছে এক অতিমানব কী দেবতার মহিমায়। সে মৃত্যুঞ্জয়ী না হলেও তার আয়ু অসীম।
কর্মসূত্রে আমাকে তার কাছে যেতে হয়, আর গেলেই, যেন স্বাভাবিকভাবেই, আমার শরীর গরম হয়। কিন্তু আমার দেহের এই উষ্ণতা কামের, যেমনটি একদা বিয়ের পর আমার স্বামী কর্ম শেষে গৃহে ফিরলে আমি এই বিশ্বাসের মধ্যে এমন উত্তাপের শিকার হতাম যে গৃহাগত এই পুরুষের তো সঙ্গম করে আমার শরীরে মজা লোটার সময় অত্যাসন্ন! এই অগ্নিপুরুষ যদি ওটাই চায় আর আমি নৈতিক কারণে রাজি না হই তবে! আইদার ফ্রেন্ড অর এনিমি—যদি ও চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে!
অগ্নিপুরুষের এই ক্রস যেন না হয় ধর্ষণ আমি তার প্রার্থনা—কামনা করতে করতে নিজেরে প্রস্তুত করতে থাকি।
আমি দেখি আমিও অগ্নিপুরুষের কাছে গেলে তারও দেহ হয় লেলিহান! আগুনের মতো সুন্দরী বলে আমি যখন কলেজে পড়ি ছেলেরা আমাকে বলত অগ্নিবালিকা!
ঠিক তাই! আমি তাদের বলতাম, আমার কাছে আসলে উত্তপ্ত হবে আর আমাতে হাত দিলে জ্বলে পুড়ে মরবে। আমি দয়া করে যারে পোড়াই তার কোনো ক্ষমা নেই। আর পুড়িয়েই আমার আনন্দ—পরমানন্দ! সুতরাং যার পুড়িয়া মরিবার সাধ তাকে স্বাগতম—ওয়েলকাম, আস এবং পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাও—মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান। মৃত্যুর মধ্য দিয়েও যে পরমানন্দ লাভ করা যায় আমারতে এই অভিজ্ঞতা নেও!
ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় হোক কিংবা আমার দুর্বার টানে—তারা আসত।
খুব পুরানো, সেকেলে এই রূপের আগুন, যুগ যতোই আধুনিক হোক, আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক কিন্তু এই রূপতত্ত্ব বদলায় না, বিচিত্রসব ডাল-পালা মেলে বটেক।
এখন আমারই তাতে পুড়িয়া মরিবার সাধ!
অগ্নিপুরুষের হাতে পড়ে আমি, আমার রূপ উত্তরাধুনিক এই সমাজ, অর্থনীতি, বিশ্বব্যবস্থার ছাঁচে কখন যে ঢালাই হতে থাকে!
অগ্নিপুরুষ পোড়ানোর মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি করে। আমি তার সৃষ্টিলীলায় মোহমুগ্ধ। আমি দেখি আগুনের মধ্যে সোনা হচ্ছে, টাকা হচ্ছে, ভবন মাটি থেকে উঠে যাচ্ছে আসমানে! আমি দেখতে পাই না, বুঝতেও পারি না তার সৃষ্টির ফল আসলে ভস্ম অথচ আমি কী এক ঘোরের মধ্যে একবার—শুধু একদিন সারাদিন তার ওই ভষ্মলীলা দেখছিলাম।
তো আমিও কি ভস্ম হব!
বাস্তবত আমি শুধু দেখি সোনা, টাকা, স্কাইস্ক্র্যাপার!
শুধু তাই নয় সে অবলীলায় বানায় পাসপোর্ট-ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট, এলসি!
এ ভাবেই অগ্নিপুরুষের সঙ্গে অগ্নিবালিকার প্রথম সঙ্গম—আগুনের সঙ্গে আগুন মিলে আমাদের দ্বিগুন লেলিহান শিখা আমাজানের দাবানলের ভয়াল সৌন্দর্য পায়।
সে আমাকে নিয়ে দেশের সবচে বড় ওষুধের কারখানা, হাসপাতাল কাম বিশ্ববিদ্যালয়, হাউজিং সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে। আমি তার এই সব পরিকল্পনার সঙ্গে কী করে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলাম সেও এক যাদু!
অফিসিয়ালি আমি এখন অগ্নিপুরুষের মূল প্রতিষ্ঠানের চিফ এক্সিকিউটিভ!
আমার এমন পেশাগত উন্নতি আমার স্বামী আকাশকে গর্বিত করে।
আকাশ স্বপ্ন দেখে আমাদের দুজনার অর্জিত অর্থে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পাখির নীড়ের মতো একটি এপার্টমেন্ট হবে—হায় পরিহাস—আমি যখন হাউজিং সোসাইটির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, দেশের সব বড় শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অসংখ্য বহুতল ভবন।
আকাশ ও অগ্নিপুরুষ উভয়ের বেলায়ই বিশেষ সতর্কতামূলক পদ্ধতি অবলম্বন সত্ত্বেও আমি কখন কামনায় বিদিশা হয়ে যে কনসিভ করে ফেলি মনে করতে পারি না।
তবে তো তোমার কাজের লোড কমিয়ে সেলারি বাড়িয়ে দিতে হয়—ঘটনাটা শোনার পর অগ্নিপুরুষ আবারো শুধু আমার বেতন দ্বিগুনই করে না আমার অফিস রুম, গাড়ি সব পাল্টে অত্যাধুনিক ও আরামদায়ক করে দেয়।
যাক, আমি এখন বাবা হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলেও আমার জন্য এভাবে সৌভাগ্য বয়ে আনার জন্য তোমাকে কনগ্রেচুলেট করছি। আমার স্বামী বলে, অভিনন্দন!
কিন্তু অনেক ভেবেচিন্তে এখনো আমি নির্ণয় করতে পারছি না—এর জনক কে!
তবে যে এখনো আসেইনি তাকে কেন্দ্র করে অগ্নিপুরুষের এমন আচরণ আমাকে আনন্দিত—গর্বিত করলেও এই অজুহাতে আকাশের আমার ওপর খবরদারি আমার শুধু আদিখ্যতাই লাগে না ভারি অস্বস্তি বোধ হয়।
অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানী, দৈনিক পত্রিকা, পোশাক শিল্প আমাদের ইত্যাদি করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তা কেবল সরকারি ব্যাংক থেকে পাওয়া রেকর্ড পরিমাণ ঋণ দিয়েই সম্ভব!
যখন অগ্নিপুরুষ আমার নতুন আইডি কার্ড বানায় এবং স্বামীর কোঠায় তার নাম বসায় আমাদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক না হলেও আকাশকে নিয়ে ওই অস্বস্তি থেকে আমি মুক্তি বোধ করি। তবে নতুন আইডি কার্ডটি বানাতে হয় যখন আমার নামে একই লোন দুইবার নিতে গেলে বিধিগত বিপত্তি দেখা দেয়। ব্যাংকের চেয়ারম্যানই অবশ্য এই কৌশল বাৎলে দেয়!
আকাশ একটি ফ্ল্যাট কেনার উদ্যোগ নেয়। তার পছন্দসই একটি ফ্ল্যাট দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে আমাকে পীড়াপীড়ি করে, তার অর্থের মূল ভরসা আমি। যেখানে আমি ও অগ্নিপুরুষ যে সব ব্যবসা শুরু করেছি তার একটি অজস্র ফ্ল্যাটের হাউজিং ইস্টেট সেখানে তার এমন এক ফ্ল্যাটের আকাঙ্ক্ষা আমার কাছে পলিতারেতীয় মানসিকতার প্রকাশ মাত্র যেমনটি এখন পশ্চিমারা বিবেচনা করে। এক লুম্পেন বুর্জোয়ার কাছেও এমন স্বপ্ন যে কত তুচ্ছ তা আকাশকে বুঝানোর মন বা অবকাশ এখন আর আমার নেই। তার ওপর এটা এমন পরিহাসও হতে পারে সে যে যে টাওয়ারে ও আমাকে নিয়ে যেতে চায় তা আমারই কোনো নির্মাণাধীন প্রকল্প।
আমি খুবই বিরক্ত হচ্ছিলাম যখন সে আমার গর্ভের ভ্রুণ, শিশুর নিয়মিত চেকাপ-টেকাপে সরাসরি হস্তক্ষেপ, খবরদারি করছিল। এ থেকে রেহাই পাওয়ার চিন্তা করে আমি যা পাই তা হল, তাকে সরাসরি জানিয়ে দেয়া যে এ সন্তান তোমার বীর্যজাত নয়—তাতে যা হবার হবে।
কিন্তু সরাসরি এটা ঘোষণা সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ। সেও কম যাবে না। আদালত তো তুচ্ছ আমাকে তার খুন করে ফেলাও সম্ভব। আর আমি নিরুপায় বা অপারগ না হলে খুনাখুনিতে যেতে চাই না।
অতএব আগে তার কাছ থেকে সরে পড়া এবং পরে নিরাপদ অবস্থান থেকে ঘোষণাটা দেয়া।
সত্য মিথ্যা যাই হোক যখন ও জানবে আমার এই সন্তানের জনক ও নয় তখন সে এ নিয়ে লড়াইয়ের মরাল কারেজ পাবে না—যন্ত্রণায় সে শেষও হয়ে যেতে পারে।
আমি আপাতত ধৈর্যকে কৌশল হিসেবে নেই।
আমি যখন এক পুত্র সন্তানের জননী হই তখন আমি সব দিক থেকেই নিরাপদে। এই অবস্থান থেকে আমার কাছে জরুরি বোধ হয় পূর্ব পরিকল্পিত ঘোষণাটি আকাশকে জানিয়ে দেয়া। আমি সরাসরিই তারে ফোন দেই, আমি অগ্নিপুরুষের সন্তানের জননী হইছি।
আমরা যে প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছি তার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব খুব অত্যাবশ্যক ছিল। এর জন্য মন্ত্রী-রাজনীতিবিদদের যে খিরাজ দিতে হচ্ছিল তাতে আমার মনে হচ্ছিল অগ্নিপুরুষ তার কৌশল বা ক্ষমতাবলে কেন রাজনীতিবিদ হয়ে যায় না!
এমন ভাবনার মধ্যে আমাকে নারী কোটার সাংসদ পদের এক নমিনেশন আবেদনে সই করায় ও। তার মানে আমি আজ যা চিন্তা করছি অগ্নিপুরুষ গতকাল তার পদক্ষেপই নিয়ে নিয়েছে।
আমি যে নির্বাচনী এলাকা থেকে ভোটে দাঁড়াই তা আমাদের দুজনার জন্ম এলাকা না হলেও এখানে বা কোথাও আমার ভোটাধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এমন কী আমি তার স্ত্রী কিনা তা নিয়ে। এত দিনেও আমাদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক চুক্তি সংঘটিত হল না, কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোথাও কোনো প্রশ্ন তুলল না। সামাজিকভাবে আমরা যে বিবাহিত বলেই বিবেচিত হলাম এ নিয়ে আমি ছাড়া কারো মনে কোনো বিস্ময়েরও উদ্রেগ করল না।
অগ্নিপুরুষ নির্বাচনের চূড়ান্ত যাদু দেখায় ভোটের দিন। সে সেদিন যারা আমাকে ভোট দিবে তারাই কেবল ভোটকেন্দ্রে যায় কিংবা যেতে পারে। আর যারা আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভোট দিতে ইচ্ছুক তাদের আর ভোট কেন্দ্রেই দেখা যায় না। অগ্নিপুরুষ অগ্নিপুরুষ বলে কথা—যাদুর খেলটা বড় কঠিন করে ফেলে আর তা জায়েজ করতে সবার অজান্তে কিছু ভোট সার্ভারের আমার একাউন্ট থেকে আবার বিশেষ মাত্রাজ্ঞানে কমবেশি করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের একাউন্টে বিলি ও বণ্টন করতে হয়।
আমি সাংসদ হয়ে গেলে অগ্নিপুরুষের কাছে কোনো যাদুই যেন আর কঠিন থাকে না—সব আইটেম ও সম্পন্ন করে অবলীলায়।
আমার সন্তান কী অগ্নিপুরুষ ও আমার সিলসিলার! কিংবা আমার প্রাক্তন স্বামী, অগ্নিপুরুষ ও আমার জটিল সংস্করণ। আমি লক্ষ করি শ্রুতিকটু, অমঙ্গলকর, ধ্বংসাত্মক, পাপবোধক—যা যা শব্দ সে শোনে তা তা সে তার মগজে স্টোর করে রাখে এবং যা যা ঘটালে সে সব শব্দ হয় তা তা করে ও আনন্দ লোটে—সে বড় ধ্বংসাত্বক লীলা! এ সব অবশ্য তার তথাকথিত জনক অগ্নিপুরুষকে খুবই খুশি করে!
এরপর আসে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে অগ্নিপুরুষ অগ্নিপুরুষ বলে শক্তি সঞ্চয়ের স্বার্থে বাইপোলার দলের একটি জামাই আদরে তাকে বরণ করে মনোনয়ন দেয় এবং অগ্নিপুরুষ তার ও তার দলের বলে বিজয়ী হয়।
এই বিজয়ের পর অগ্নিপুরুষ সুপারম্যানের মতো ক্ষমতাধর হওয়ার কথা কিন্তু বিরোধীদলের বজ্জাতি আর আমলাদের তথাকথিত মূল্যবোধ ও পাওয়ার এক্সারসাইজের প্রবণতা তাকে মাঝে-মধ্যেই বিব্রত করে। ও বিভাগীয় রিক্রুটমেন্টে সব পদ আগাম বেচে নিয়োগ দিতে গেলে ওরা বাধ সাধে। তার নেতাকর্মীরা তখন উত্তেজিত হয়ে ওদের মারধর করে সব নিয়োগপত্রে সই করিয়ে নিলেও আমলারা দমে না। অগ্নিপুরুষকে এরই মধ্যে বোর্ডের চেয়াম্যানের গালে চপেটাঘাত করতে হয়েছে। অনল হস্তের চপেটাঘাত—পোড়ার অমোচনীয় দাগ তাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে। পত্রপত্রিকায় সীমিত হলেও বিরূপ লেখালেখির জন্য আমলাদের যার দেখভালের দায়িত্ব অতি ক্ষমতাধর সেই সাবেক আমলাকে এর জন্য ফিল্ডে নামতে হয়—তিনি এই চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সকল ছোট-মাঝারি আমলাকে এই বলে জব্দ করেন যে তোমরা ভারি অদক্ষ, পলিটিক্স কী কৌশলে ট্যাকল করতে হয় ন জানো!
এরপর তো অগ্নিপুরুষকে অনাপসী এক সুন্দরী আমলা ধর্ষণের মধ্য দিয়ে তার দেমাগ মিটিয়ে উভয় স্বার্থ হাসিল করে তার দায় দুই-তিন লুম্পেনের ওপর চাপিয়ে রিমান্ডে পাঠিয়ে আইনগতভাবে পাকাপোক্ত রেহাই নিতে হল!
একটু সময় লাগলেও এ সবের মধ্য দিয়ে অগ্নিপুরুষ অশনিপুরুষে উন্নীত হল। তার জন্য বন কেটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করতে হল। ঋতুর সীমা ভায়োলেট করে এখানে এখন অহরহ বজ্রপাত হচ্ছে। লোকে বুঝতে পারে না কেন এখন এই ভূমণ্ডলে এমন প্রবল, বিধ্বংসী, ক্রমাগত এমন রেকর্ডভাঙা মৃত্যুর বজ্রনির্ঘোষ!
তবে অশনিপুরুষ তার এই বজ্রশক্তিকে রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য করে তুলল।
দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণে প্রশস্ততম নদীর প্রবল স্রোতে স্পান বসাতে তাকে লাগে। বাসে-ট্রেনে-প্লেনে বোমা ফাটিয়ে সারাদেশ, দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অচল করতেও তাকে অত্যাবশ্যক। সে যেভাবে এগোচ্ছে একদিন বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক হ্যাক করে অর্থ হাতাতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষ্ক্রিয় কী ঘটানোয়, বাজার অর্থনীতির বিকাশ কী দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে তাকে লাগবে!
সে চাইলে দুর্নীতি মুক্তির জরিপে এ দেশ শীর্ষে, না চাইলে সর্বনিম্নে!
তার কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন সে বিশ্বময় যেভাবে ছুটছে তাতে তার একটু ভেনটিলেশন আবশ্যক। সে আমার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করলে আমি তাকে প্রস্তাব করি, চল কয়েক মাস ইউরোপ বেড়াই।
তুমি আমার সঙ্গে গেলে যে আমার সব দায়দায়িত্ব-কাজকর্মও যাবে সে হুঁশ তোমার আছে!
রাইট! আমার হুঁশ হয় আমি অনেক জনম ধরে এই মধ্যবয়সীর গোলকধাঁধায় বন্দি হয়ে আছি। তাকে বাইরে পাঠিয়ে এবার যুবক নিয়ে জীবনের বৈচিত্র্যকে ভোগ করে নেই।
তাই! আমি বলি, দুজনই বাইরে গেলে এইদিকটা সামলাইব কেডা!
শেয়ার বাজারে শেয়ার ছেড়ে ক্লায়েন্ট ঠেকানোর ফন্দি-ফিকিরের মতো আমরা মতামত শেয়ার করি। আমি মত দেই, শারীরিক সুখের জন্য অগ্নিপুরুষের শীতের দেশ অর্থাৎ ইউরোপে বেড়ানোই উত্তম। কারণ সেখানে ও যত ঠাণ্ডার ওম উপভোগ করতে পারবে তা অন্য কোথাও অসম্ভব।
আমি তো জানি, গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে ইউরোপ দুনিয়ায় যে সেরা শোষণটা করে তারা যাদের সহযোগিতায় তা পারে, তা পারতে গিয়ে তাদেরও যেটুকু চেটেপুটে খেতে দিতে হয় তা এই চাটুকারদের, চাতুর্যে যারা ওই চটুকারদের চেলা থেকে দোসর হতে পারে অগ্নিপুরুষ তার অন্যতম। এটা এত পরিষ্কারভাবে আমার চোখে ধরা পড়ে তার সঙ্গে বহুবার ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোতেই।
কিন্তু শেষে ও সিদ্ধান্ত জানাল মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের। আমি প্রথমে আপত্তি করছিলাম কারণ সেখানে আগুনের মতো গরমের ফাঁদ আছে, অগ্নিপুরুষ তার মধ্যে খুব বাজেভাবে ফেঁসে যেতে পারে।
কিন্তু আদতে আগ্নিপুরুষও আমার মতোই জানে, শেখেরা আর এখন রক্ষণশীল নয়, বাজারিরা হেদের ফতুর করতে তইল নিয়ে সেই টাকায় বিলাসবহুল হোটেল, বিপনিবিতান, স্কাইস্ক্র্যাপার নির্মাণ করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় জীবন যাপনের ছাঁচ—শীতলতা, বিলাসিতা।
আর অগ্নিপুরুষ তো সেথায় যাচ্ছে হেদের স্বার্থেও! বাগদাদে মার্কিন সেনাদের এন্টারটেইনমেন্টের জন্য আরব রাজা-বাশ্শারা যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে নারী পাঠাইছিল অগ্নিপুরুষও তার দ্যাশের যুবতী, এমন কী কুমারী মা’দের মায়া মায়া ডেকে সেখানে পাঠায়, তাদের আর ফেরার পথ থাকে না। তো শেখ তো তার প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট থাকার কথা।
কিন্তু বজ্জাত শেখ যে কেন তাকেই বেঁধে ফেলল আমি এখান থেকে তা মোটেও বুঝতে পারি না। বাঁধার আগে তার অশনি শক্তি নিউট্রিলাইজ করল! তবে কি তার এই অশনি ও অগ্নিশক্তিই হেদের তারে এমন পাকড়াও করার হেতু! এসব দিয়ে তো সে তাদেরও সেবা দিয়ে আসছিল! তা বাদে তারা তো মানবতার প্রশ্রয়ের নামে খুনিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডার মতো মহৎ হতে পারত! সে যখন একটা রাষ্ট্রের সাংসদ তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে মামলা আনা হল মাদক, সেক্স ট্রাফিকিং ইত্যাদির। আল্লাহ-রসূলের দেশে অগ্নিপুরুষের ডিজিটাল ইঞ্জিন একেবারে নিষ্ক্রিয়, কোনো কাজ তো করলই না বরং তাদের ইঞ্জিনে তা সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হল এবং তারা তা জব্দ করল। তা জব্দ হয়ে গেলে দেশে ও যা যা করেছে তা আপাময় জনসাধারণে দৃশ্যমান হল। এই দৃশ্যমানতা সরকারকে বিব্রত করলে, বেকায়দায় ফেললে তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা সক্রিয় হতে বাধ্য হল।
সরকার যেন চাইছে তাকে এখানে এনে নিজ হাতে আচ্ছামত শাসন করতে।
আমিও চাইছি যাই হোক, এখানেই হোক। এখানকার জেলখানাও তুলনামূলকভাবে অগ্নিপুরুষের জন্য সহনীয়। কিন্তু যদি ফাঁসিই হয়, সে তো নির্বাপনই, তবে দেশেই হোক—তাতে তার যেমন দেশের মাটিতে মিশে যাওয়ার সৌভাগ্য হল পাশাপাশি সহযোগীদের ফাঁসিয়ে যাওয়া। না, তা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না, কারণ আমরা নিজে বাঁচতে নিছক সহযোগীদের যেমন বলি দিয়েছি তারাও এখন আমাদের সে কৌশলে বলি দেবে—হেরা সব ধোয়া তুলসিপাতা!
এমন দুঃস্বপ্ন আসলে দুঃস্বপ্নই—ও ফিরতে পারলে দেখা যাবে সরকারই পাল্টে গেল আর তখন তারা বিরোধীদলে গিয়ে আমাদের এই বলে আন্দোলন করে মুক্ত করবে যে রাজনৈতিক কারণে আমাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
এদিকে আগ্নিপুরুষকে যে মিথ্যা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে তা প্রমাণের জন্য আমার যেভাবে লবিং করা উচিত আমি আসলে তা পারছি না, আমি যে তা পারছি না সে বিষয়ে তেমন সচেতন হওয়ারও আমার উপায় নেই কারণ আমার অগ্নিদেহ। আমি তার লেলিহান শিখার ইন্ধন যোগাতে তাতে একের পর এক যুবককে আত্মাহুতিতে প্ররোচণা তথা বলিদানে ব্যস্ত।
এবং এই যৌনযজ্ঞের মধ্যেই আমি সশরীরে ধরা পড়ে গেলাম।
আমি এরেস্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ের নিচ থেকে বেস সরে গেল, আমি ডানে, বাঁয়ে, সামনে একের পর এক ধরে থাকার অবলম্বন খুঁজতে খুঁজতে দেখি আমার মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ছে—আমি নিরালম্ব দশায় জ্বলছি। এরই মধ্যে আমাদের বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ উঠল, এত সব গুরুতর অভিযোগ যেন তা আগের কারো রেকর্ড ভাঙার আয়োজন, এসব যদিও তার কোনোটাই সন্দেহনির্ভর বা ভিত্তিহীন নয়।
কেউ আমার জন্য আগাচ্ছে না। না থানায়, না গোয়েন্দা দফতরে, না আদালতে!
আমি হাসরের ময়দানে। আমার সোদ্দর ভাইবোন, প্রাণপ্রিয় বন্ধু যাদের জন্য আমি পাপ করেছি তাদের কেউ না! গোয়েন্দা পুলিশ আকাশকে ধরলে, আশ্চর্য, সে অঙ্গীকারনামা দিল যে সেও অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত এবং সে রাজসাক্ষী হবে।
হতাশা, বিষণ্নতার হাজতে থাকতে থাকতে, সেখান থেকে আদালত, পুলিশ-গোয়েন্দার দপ্তরে গিয়ে নানা জবাব দিতে দিতে সাংবাদিকের ক্যামেরা, পাবলিকের চোখ, টিভি, পত্রিকা দেখতে দেখতে বুঝি আমি জনপ্রিয় নায়িকা, প্রভাবশালী রাজনৈতিকনেত্রীর মতো সেলিব্রেটি হয়ে গেছি।
এ পর্যায়ে আমিই জাতির টপ নিউজ!
সরকারই আমাকে আইনজীবী দিল আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে কিংবা আইন বা নীতিগত কারণে।
আমি এখন আমার বিব্রত দশা কাটিয়ে আমার উন্নত স্তন কাঁপিয়ে, ভরাট শরীরে কামুক ভঙ্গি তুলে হাঁটি। তাতে আমার রিমান্ড বা তদন্ত কর্মকর্তা, নিরাপত্তা রক্ষী আমার যাদুর বলয়ে পড়ে আমার প্রতি কঠোর হতে পারে না। আদালত পারবে কি!
তবে কেউ যদি আমায় ভাল করে দেখে, কোনো মনোদৈহিক বিশেষজ্ঞ, যখন আমারে আদালতে আনা-নেয়া করা হচ্ছে, তখন সে কি দেখবে আমাতে এক মধ্যবয়সী নারী যার চোখে-মুখে পাপ, ধূর্ততা, বেপরোয়া ভাব!
আদালত আমার জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আমি সিদ্ধান্ত নেই রাজসাক্ষীর মতো অকপটে সব বলে দেব। তাতে আমাদের সহযোগিরা আর ধোয়া তুলসিপাতা হয়ে থাকবে না। এমনও হতে পারে রাঘববোয়াল যখন টের পাবে তারা সব ফেঁসে যাচ্ছে তখন নিজেরা রেহাই পাওয়ার জন্য আমাদের টেনে তোলায় লাগবে।
রিমান্ড কক্ষ। আমি বক্তব্য শুরু করতেই বিস্মিত তদন্ত কর্মকর্তা কলম থামিয়ে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকায়। বক্তব্য রেকর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেকর্ডিং বন্ধ করে উগ্র ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে আসে।
আপনাকে কিছু বলতে হবে না আমি যা লিখব শুধু তাতে সই করে দিবেন।
না।
আমি যা যা বলছি তা তা মুখস্ত রাখেন আর রেকর্ড অন করলে তাই বলেন।
এ যে দেখছি আগ্নিপুরুষ এসব কর্মকর্তাদের দিয়ে আমাদের মামলার আসামীদের যেভাবে যেমনটি বলিয়েছে, লিখিয়েছে—এও তাই! যেন এদের পেছনে আমার অগ্নিপুরুষের চে শক্তিধর অগ্নিপুরুষ বিদ্যমান!
কিন্তু আমি কি ওই সব লুম্পেনদের মতো! আমি অগ্নিরমণী—আমি দেখে নেব।
দেখতে দেখতে কী রহস্যজনক কারণে যে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি। ধরা পড়া বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদের মতো আমাকে নিয়ে চলে চিকিৎসা চিকিৎসা খেলা!
আমি হাসপাতালের কেবিনে না কন্ডেম সেলে বুঝে উঠতে পারি না।
এখানে আমি নার্সিসাসের মতো আমাকে দেখি—যেন আমি এখানে আমাকে দেখার সুযোগ পাই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমি আমার সৌন্দর্য খুঁজি যা দিয়ে আমি এত কিছু করে বসে আছি! আমার এই মুখ—সাধারণত প্রথমে আমার এই মুখ দেখেই মানুষ ঘোরে পড়ে যায়—তো কী আছে এই মুখে! আগে দর্শনদারি তার পর গুণ বিচারি। আমার গাল-ঠোঁট-চোয়াল-কপাল তথা মুখ আগুনে সেদ্ধ হয়ে ভাপ ছড়াচ্ছে! আমার স্তনে অগ্নিহস্তের পেষণের পোড়া দাগ! যোনি অগ্নিপুংদণ্ড সঞ্চালনের ক্ষতে ঘিনঘিনে!
ডাক্তার তো ডাক্তার শেষে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত আমারে নিয়ে দিশাহীন। আমার গাল-ঠোঁট, স্তন, ঊরু, যোনিপথ—সারা শরীর যৌনাচারের পোড়া দাগে বিক্ষত! এমন কী করে সম্ভব!
হায়! সব মিলিয়ে আমি যে নরকে পোড়া এক আঙড়া!
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন