জাপানের উ-কায়: অভিনব মাছ শিকার

অ+ অ-

 

গিফু: নাগারা নদীর পাড়ে

গিফু জাপানের এক ছোট্ট শহর। ট্রেনে টোকিও থেকে দু ঘণ্টার বেশি, কিয়োতো থেকে এক ঘণ্টা, আর নাগোয়া থেকে ত্রিশ মিনিট। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শহর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন ৭৫ বছর বয়স হল। এখানে আমার একজন বন্ধু ছেনছেই [শিক্ষক] আছেন, তার সাথে অনেকদিন থেকে আমি কিছু গবেষণার কাজ করি আর সে সুবাদে মাঝে মাঝে আমার এখানে আসার সুযোগ হয়। বেশ ক বার এসেছি বলে গিফু আমার মুখস্ত শহর। গিফু নাগারা নদীর তীরে। নদীটি সাপের মত একেবেকে চলে গেছে শহরের মধ্যদিয়ে। ছোট নদী কিন্তু বর্ষায় দারুণ স্রোত। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বয়ে যায় এর বুক দিয়ে। সাত বছর আগে দেখা উখাই শোয়ের কথা মনে পড়ে। সন্ধ্যায় এই নদীতেই জেলেরা পাখি দিয়ে মাছ ধরে। শহরের সব চেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায় একটা হাজার বছরের পুরাতন ক্যাসেল আছে, সেই ক্যাসেলে সেবার দুই জাপানি শিক্ষার্থীকে নিয়ে হেঁটে উঠেছিলাম। আড়াই ঘণ্টা লেগেছিল। এই গিফু ক্যাসেল থেকে শহর আর নাগারা নদী দেখতে ভিউকার্ডের মতো লাগে। মূলত টুরিস্টরা এখানে আসে উখাই শো আর হাজার বছরের পুরাতন ক্যাসেল দেখতে। আর আছে শহরের মাঝে একটা প্রাচীন জেলে গ্রাম। কাওরামাচি।

গিফু বিশ্ববিদ্যালয়টি শহরের এক প্রান্তে। শান্ত নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশে অনেকটা আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের মত। চিকিৎসা আর কৃষি এ দুটি অনুষদ এখানে বেশ ভাল। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে এখানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য আসে। বাংলাদেশের কয়েক জন ডাক্তার আর কৃষিবিদ এখানে কাজ করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আসে চীনারা। আমার বন্ধু ছেনছেই হিদিকি মাকি এক অদ্ভুত মানুষ। বয়স আমার সমান। বিভাগে তার কক্ষটি যেন একটা চিড়িয়াখানা। হেন জিনিস নাই  যে পাওয়া যাবে না। জুতাই আছে কম পক্ষে পনের জোড়া। আমেরিকার একটা নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা আর চাকরি মিলিয়ে বার বছর কাটিয়েও তিনি পড়ে আছেন এই গিফুতে। তাও আঞ্চলিক অধ্যয়ন বিভাগে। একটু চেষ্টা করলেই তার জায়গা হতে পারত টোকিও বা কিওতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাপানে বিশ্ববিদ্যালয় যত নামি অধ্যাপকদের গুরুত্ব ও দাম তত বেশি। এত যোগ্যতা নিয়েও মাকি কেন গিফু ছাড়ছে না সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে যা পেলাম তাতে জাপানিদের মানবিকতার কাছে মাথা আরেকবার নত করতে হয়। মাকির মা বৃদ্ধ আর অসুস্থ্। একা চলতে পারেন না। তাই প্রতিদিন তাকে স্নান করানো আর খাবার তৈরি করে দিতে হয়। প্রায় এক যুগ ধরে মাকি এ কাজ নিজেই করছে। একারণে সে গত এক যুগে দেশের বাইরে যায়নি কখনো। একদিনের বেশি গিফু ছেড়ে থাকেনি কখনো। একবার ভেবে দেখিতো আমরা যারা শিক্ষিত তারা আমাদের মায়ের জন্য কী করছি?

উ-কায় জেলের স্ট্যান্ডই তে ছবি তুলেছেন লেখক

পাখি দিয়ে মাছ শিকার

নদীমাত্রিক বাংলাদেশে একসময় জেলেরা মাছ ধরার কাজে ধেড়ের সহায়তা নিত। ধেড়ে মূলত মাছকে তাড়িয়ে জালের মধ্যে দিলে জেলেরা জাল উঠাতো। পাখি দিয়ে মাছ ধরা সারা পৃথিবী ব্যাপী একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রথা। চীন, ইউরোপ, পেরু এবং ভারতীয় উপমহাদেশে নানাভাবে পাখিকে দিয়ে মাছ শিকার করা হত। তবে এসবের মধ্যে উ-কায় বা পাখির মাছ উগরানো পদ্ধতি যে অভিনব ও আকর্ষণীয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। জাপানের গিফু শহরের নাগারা নদীতে হাজার বছর পূর্ব থেকেই আমাদের হাসের মতো এক ধরনের পাখি দিয়ে [যাদের ঠোটটি শুধু বকের মতো লম্বা] মাছ শিকার করে আসছে একে বলা হয় উ-কায়। জাপানি হচ্ছে একটি পাখির নাম, যার গলা লম্বা; আর কাজ হচ্ছে মাছধরা। শুধু নাগরা নদীতেই নয় জাপানের আরও বেশ কয়েকটি নদীতে এবং চীনে এই ঐতিহ্যবাহী লোক মাছশিকার পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যদিও বর্তমানে চীনের এই পাখি দিয়ে মাছ শিকার পদ্ধতি বিলুপ্তপ্রায়। জাপানেও জেলেরা এ বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ছিল, কিন্তু সরকারের উদ্যোগ এবং উৎসাহে এখনো টিকে আছে সীমিত পর্যায়ে। শুধু টিকে নয় এটাকে কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবসাও জমজমাট সেখানে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় জমান এই অভিনব পদ্ধতির মাছ শিকার দেখতে। ইংরেজিতে উ-কায়কে বলে Cormorant fishing. মূলত বর্ষার শুরু অর্থাৎ মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে যখন কিছুটা স্রোত থাকে এই প্রক্রিয়ায় মাছ ধরা হয়ে থাকে। সেই প্রাচীন কাল থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত এটি সফল ও বাণিজ্যিকভাবে মৎস শিকারের অন্যরকম পদ্ধতি হলেও প্রযুক্তির উন্নয়নের একালে এসে মাছ শিকারের এই ঐতিহ্য আজ ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। এটি এখন পর্যটন শিল্পের প্রসারে কাজে লাগানো হচ্ছে। অভিনব কিছু দেখার জন্য পর্যটকরা সবসময়ই উন্মুখ হয়ে থাকে। আর উ-কায় হচ্ছে সেরকমই একটি অকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। তাই পকেটের পয়সা খরচ করে পর্যটকরা উপভোগ করতে আগ্রহী উ-কায়। ২০১৩ সালের মে মাসে জাপানের গিফু শহরের নাগারা নদীতে এই লেখকের সৌভাগ্য হয়েছিল—‘উ-কায় ইভেন্ট দেখার। আর সে অভিজ্ঞতা থেকেই এ লেখা।

গিফুর কাওড়া মাচি বা জেলে গ্রামের প্রবেশ পথে লেখক

উ-কায় কি?

চীনের প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া গেছে সাত-আট শতকে উ-কায় প্রচলনের কথা। যা চীন থেকে জাপানি জেলেরা আত্মস্থ করে সফলতা অর্জন করেছিল। এই মাছ শিকারে উ-পাখিরই প্রধান ভূমিকা। দেখতে হাসের মতো অনেকগুলো পোষা পাখি যাদের গলা লম্বা। এ রকম দশ থেকে পনেরোটি পাখি নিয়ে সন্ধার পর একটি ছোট্ট নৌকায় করে তিন জন জেলের একটি দল পাহাড়ী নদীর উজান থেকে ভাটিতে নামতে থাকেন ধীরে ধীরে। একজন জেলে নৌকার হাল ধরেন পিছনে বসে। নৌকার সামনে লোহার খাচায় জ্বলন্ত কাঠের আগুন আলোকিত করে রেখেছে নদীর পানি। সেই আলোর টানে মাছ আসে কাছে। সুতা বা চিকন দড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখিগুলোকে নদীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা পানির নিচে মাছ গিলে চলেছে একের পর এক। সুতার অপর প্রান্ত একজন জেলের হাতে যিনি এই অভিযানের দলপতিও জাপানি ভাষায় তার নাম উসো। তার মাথায় পাখির মুখের মতো টুপি থাকে। মাছ শিকারী এক একটি পাখি সর্বোচ্চ ৫টি মাছ যাদের আকার চার থেকে সাত ইঞ্চি গলার মধ্যে সঞ্চিত রাখতে পারে। নদীর স্রোত আর কাঠের আলোয় নৌকা সামনে যাচ্ছে আর পাখিরা ডুব দিয়ে মাছ ধরে [গিলছে] রেখে দিচ্ছে গলার নালিতে। পাহাড় পরিবেষ্টিত নাগারা নদীতে সন্ধ্যার আলো-আধারীতে এই দৃশ্য সত্যি অভিনব। কোন পাখির গলার থলে ভরে গেলে সে সুতোয় টান দেয়। তখন উসো বা প্রধান জেলে পাখিটিকে টেনে নৌকায় তোলে। পাখি নৌকার পাটাতনে রাখা ঝুড়িতে মাছগুলো উগরিয়ে দিয়ে আবার মাছের সন্ধানে পানিতে নেমে যায়। এভাবে একের পর পাখি পানি থেকে মাছ ধরে নৌকায় এসে রেখে যায় এবং খুব দ্রুতই ভরে যায় মাছে ডালা। অপর জেলে পাখির নিয়ন্ত্রণ এবং মাছ সংগ্রহের কাজে সহায়তা করেন। আবার পাখি যাতে মাছ খেয়ে না ফেলে সে জন্য তার গলার নিচে একটা ফাঁসের মতো লাগানো থাকে। এক হাতে সুতা দিয়ে দশ-বারটি পাখিকে নিয়ন্ত্রণ এবং অন্য হাত দিয়ে টেনে একের পর এক নৌকায় পাখি ফিরিয়ে এনে মাছ সংগ্রহ অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ না হলে সম্ভব নয়। এভাবে প্রায় চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ধরে জেলে নৌকাগুলো মাছ ধরার প্রথম চক্রগুলো সমাপ্ত করে এরপর ধরা পরা মাছ নামিয়ে রেখে, আবার উজানে ফিরে যায় দ্বিতীয় চক্র শুরু করার জন্য। একসময় অনেক নৌকা একসঙ্গে এই মাছ ধরা অভিযান চালাতো। এখন কমতে কমতে শুধু প্রদর্শনীর পর্যায়ে নেমে এসেছে। শুধু গিফু শহরে মাত্র ৬টি জেলে পরিবার বা নৌকা আছে যারা এই ঐতিহ্যবাহী মাছ শিকারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অবশ্য এর বিনিময়ে সরকার তাদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে।

উ-কায়-এর আসল মুন্সিয়ানা হচ্ছে সুতার খেলা। হাতের পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে দশ-বারোটা পাখির গলায় পরানো সুতাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটার সাথে যেন অন্যটা পেচিয়ে না যায় তা খেয়াল করা সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে চলন্ত নৌকায়। এরপর একের পর এক সুতা টেনে পাখিকে নৌকায় এনে মাছ উগরিয়ে আবার নদীতে পাঠানো। এ সত্যি শুধু দক্ষ অভিজ্ঞ জেলের পক্ষেই সম্ভব।

 

উ-কায়ে মাছ শিকারের কাঠের তৈরি বিশেষ নৌকা

উ-কায়: গিফুর অভিজ্ঞতা

চারিদিকে পাহাড় পরিবেষ্টিত মাঝখানে সমতলের ছোট শহর গিফু। শহরকে প্রায় গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে স্বচ্ছ জলের মাঝারি এক নদী যার নামনাগারা। এই নদীর তীরে হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল এক জেলে পল্লি নাম তার কাওরা মাচি। জাপানি শব্দ কাওরা মাচি অর্থনদীর তীরবর্তী ছোট পল্লি বা গঞ্জ। প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা এই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল এখনো তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি অনেক বাড়ি। বাড়িগুলো বেশ উচু যা বন্যার কারণে করা হয়েছিল। প্রত্যেক বাড়ির সামনে সৌভাগ্যের প্রতীক একটি পাথরখণ্ড এবং রঙিন কাগজের তৈরি ঝাড়বাতি খুবই পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি। এই জেলে পল্লিতেই উ-কায় জেলেরা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস এবং বিশেষ এই পদ্ধতিতে মাছ ধরে আসছেবর্তমানে যাদের মাধ্যে মাত্র ৬টি পরিবার টিকে আছে। অন্যরা পেশা পরিবর্তন করেছে, কেউ কেউ চলে গেছে অন্য শহরে। এই বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ ধরার জন্য যে পাখিকে ব্যবহার করা হয় তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। উ-কায় এতটাই ঐতিহ্যের অংশ যে গিফু শহরের নাগারা নদীর তীরেই অনেক খানি জায়গা নিয়ে বিশাল ভবনে করা হয়েছে উ-কায় জাদুঘর। এখানে একদিকে যেমন উ-কায় সংশ্লিষ্ট সকল জিনিস সংরক্ষণ এবং তার বিস্তারিত বর্ননা রয়েছে। তেমনি আধুনিক আলো ও শব্দ পদ্ধতিতে নাগারা নদীর বাস্তব উ-কায় ইভেন্টকে অডিটোরিয়ামের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই জাদুঘরের দশনার্থীদের। তবে জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য প্রবেশমূল্য একহাজার ইয়েন। এই জাদুঘরেই উ-কায় এর ওপর একটি প্রামান্যচিত্র দেখে অবাক হয়েছিলাম, জানলাম পাখিগুলোর গলা টেনে টেনে কীভাবে লম্বা করা হয় আর সেখানে যাতে চার-পাঁচটি মাছ ধারন করা সম্ভব হয় তার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জেলেদের জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের পোষাক ও মাথার টুপি। টুপির ওপরের দিকটা পাখির মুখের মতো। জেলে দলপতির কোমর থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত খড় দিয়ে ঝাড়আকৃতির একটা আবরণ দেয়া। আর সবার পায়ে দঁড়ি দিয়ে তৈরী বিশেষ একধরনের স্যান্ডেল যা আয়েতনে অর্ধেক। দলকর্তা উসো ছাড়াও অন্য যে দুজন থাকে তাদেরকে বলা হয় নাকানরি বা মধ্যচালক অন্যজন তোমোনরি বা সহচালক। শুধু পাখির প্রশিক্ষণ নয় মাছ ধরার আগে কোনো কোনো পাখিকে আজ নদীতে নামাতে হবে তা নির্বাচন ও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা বিশ্বকাপের প্রতিযোগিতায় খেলোয়ার নির্বাচনের মতো। এরপর রয়েছে উ-কায় অভিযানে যাবার আগে নৌকার প্রস্তুতি। এই নৌকাগুলো চওড়া কম এক ধরনের কাঠের তৈরি বিশেষ নৌকা যাকে বলা হয় উবুনে। লম্বায় চল্লিশ ফুটের মতো। নৌকায় ওঠার পূর্বে বিশেষ খাঁচায় করে পাখিদের নিয়ে নদী তীরে জড় হন তারা। কয়েক মুহূর্তে নীরবতায় প্রার্থনা করেন সম্ভবত জলদেবতার কাছে যেন বেশি বেশি মাছ পাওয়া যায়। এরপর সারিবদ্ধ ভাবে পাখির খাচাগুলোকে হাতে নিয়ে নৌকায় উঠে কাঠে আগুন জ্বালান। তবে উ-কায়-এর আসল মুন্সিয়ানা হচ্ছে সুতার খেলা। হাতের পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে দশ-বারোটা পাখির গলায় পরানো সুতাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটার সাথে যেন অন্যটা পেচিয়ে না যায় তা খেয়াল করা সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে চলন্ত নৌকায়। এরপর একের পর এক সুতা টেনে পাখিকে নৌকায় এনে মাছ উগরিয়ে আবার নদীতে পাঠানো। এ সত্যি শুধু দক্ষ অভিজ্ঞ জেলের পক্ষেই সম্ভব। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই উ-কায় পাখিদের অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের মৃত্যু হলে অনেকটা মানুষের কায়দায় অনুষ্ঠান করে সমাহিত করা হয়। আর সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন এলাকার গণ্যমান্য লোকজন।

উ-কায় এখন পর্যটন প্রসারে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাওরামাচি গ্রামে বিকেল থেকেই একের পর এক পর্যটকবাহী বাস আসতে শুরু করে। পাশেই নাগারা বাসি অর্থাৎ নাগারা ব্রিজ। এর নিচে অপেক্ষা করছে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটি নৌকা এই নৌকায় করে পর্যটকরা নাগারা নদীতে উ-কায় ইভেন্ট দেখে আর রাতের খাবার সারে। জনপতি খরচ প্রায় পঞ্চাশ থেকে দুশো ডলার পর্যন্ত। পর্যটকদের নিয়ে নৌকাগুলো উ-কায় জাদুঘরের সামনে নদীর দুতীরে অপেক্ষা করে। উজান থেকে ৬টি নৌকায় নেমে আসে ভাটিতে আর ক্রমাগত পাখি দিয়ে মাছ শিকার চলতে থাকে তখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আগের দিনে উ-কায় পাওয়া মাছের সুপ খেতে খেতে পর্যটকরা উপভোগ করেন এই ঐতিহ্যবাহী মাছ শিকার। রাতের আঁধারে নদীর বুকে উ-কায় নৌকাগুলোকে আলো আঁধারীর এক রহস্যময় খেলা মনে হয় দূর থেকে। হাজার বছরের ঐতিহ্যময় এই মৎস শিকার আজ আর জীবন-জীবিকা নয় পর্যটক আকর্ষণের এক দারুণ ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। বাকিটা জানতে কিংবা দেখতে জাদুঘর পরিদর্শন অনিবার্য। বিখ্যাত জাপানি কবি মাৎসু বাসো উ-কায় দেখে একটি কবিতা লিখেছিলেন যার কয়েকটি চরণ ছিল

অসম্ভব উত্তেজনাকর মাছ শিকারের এই দৃশ্য
কিন্তু পরক্ষণেই দুঃখে ভাগাক্রান্ত হয় হৃদয়।
শেষ হয়ে গেল কি?

 

পাদটীকা: গিফুর কাওরামাচি গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটা বাংলা লেখা নামফলকে চোখ আটকিয়ে যায়—‘বন্ধু বাংলাদেশ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বে এক জাপানি ভদ্রমহিলা ঢাকার মিরপুরে একটি এতিমখানা পরিচালনা করতেন তার বাড়ি এখানে। তিনি এখন বৃদ্ধ। বাংলাদেশের এতিমদের সহায়তার জন্য এই প্রতিষ্ঠান করেছেন যার নাম বন্ধু বাংলাদেশ। হে বিদেশিনী তোমাকে অভিবাদন।