দি লিটল ফেলো || ম্যানি ফারবার

অ+ অ-

 

ম্যানি ফারবার

ম্যানি ফারবার একজন আমেরিকান চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র সমালোচক এবং লেখক। ফারবারের বাবা লিথুনিয়া থেকে আমেরিকাতে আসেন। ১৯১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি আমেরিকার আরিজোনায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট আন্দোলন ছাড়ার পর তিনি সানফ্রান্সিসকো থেকে ওয়াশিংটন যান। পরবর্তীকালে তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ফারবার গদ্য লেখার একটা নিজস্বধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা পরবর্তী চলচ্চিত্র সমালোচকদের লেখার ক্ষেত্রেও দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। আরেক বিখ্যাত আমেরিকান লেখক ও সমালোচক সুসান সনট্যাগের মতে—‘ফারবার ছিলেন প্রাণবন্ত, তুখোড় এবং আমেরিকা সর্বকালের সবচেয়ে মৌলিক চলচ্চিত্র সমালোচক। টাইম, দ্য নেশন, আর্ট ফোরামসহ বিখ্যাত সব পত্রিকাতে চলচ্চিত্র এবং শিল্প সমালোচক হিসবে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বইAbout Face, Negative Space ও Underground Films। ২০০৮ সালে তিনি ৯১ বছর বয়সে ক্যালিয়োর্নিয়ায় মৃত্যু বরণ করেন।

 

ছবি © অফ স্ক্রিন

 

দি লিটল ফেলো || ম্যানি ফারবার

অনুবাদ || আসিফ রহমান সৈকত

একটা টেবিলে এসে বসে, একজন নিঃসহায় এবং বিষণ্ণ মুখের লোক। হাতে দুটো কাঁটা চামচ নিয়ে, সেটা দুটো [পাউরুটির] রোলে ঢুকিয়ে দিয়ে, সামনে ঝুঁকে বসে আর তখনই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সব থেকে  স্মরণীয়তম দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেটা হলো চার্লি চ্যপলিনের দি গোল্ড রাশ চলচ্চিত্রে, খাবারের রোল নিয়ে [কাঁটা চামচে গেঁথে] চ্যাপলিনের সেই রোলের-নৃত্য [টেবিলে বসেই]। প্রায় দুই দশক পরে আবার ফিরে, আজও সেই দৃশ্য সমস্ত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সব থেকে অনেক বেশি পরিতৃপ্তকর। এতো এতো অন্যান্য চলচ্চিত্রের, মাইলের পর মাইল রিল দেখার সময়ের মধ্যেও, এই দৃশ্যটা আবারো এখন দেখছি, যেটা চ্যাপলিনের শিল্প দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে, যে কোন সময়ের থেকে আরো ভালোভাবে সামনে নিয়ে আসে। আসলে বলতে গেলে, দি গোল্ড রাশ এতো নিখুঁত একটা চলচ্চিত্র যে, তিনি কিভাবে এটা বানালেন, সিনেমাটা দেখার পর আপনি সেটা ভেবেই আশ্চর্য্য হবেন! কিছু হয়তো আলকপাত করা যেতে পারে, তার চলচ্চিত্রের থিমটার সরলতা/স্বাভাবিকতা সম্পর্কেচলচ্চিত্রটিতে সেই দীর্ঘ বিস্তৃত সমতল তুষারই হয়তো ছিল, তাঁর [চলচ্চিত্র নির্মাণ জীবনের] সব থেকে সেরা বাঁধা।

যে চরিত্রটি তিনি সৃষ্টি করেছিলেন সেটা ছিল জীবিত প্রাণীদের মধ্যে সব থেকে ক্ষুদ্র [ক্ষুদ্রতম], ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেবার মতো কেউ, যে অনাদিকাল থেকে ভালোবাসার খোঁজের মধ্যেই আছে; হয়তো তার জন্ম হয়েছে সময়ের আগেই অথবা কোনো ভুল দুনিয়াতে অথবা দুটোই।

তাকে আলাস্কার বিস্তৃত জায়গাতে রেখে দিন, যার চারপাশে ক্ষুধার্ত, মোটা খনিজ অনুসন্ধানকারীদের আনাগোনা, সুন্দরী ড্যান্স-হলের মেয়েরা এবং বিভিন্ন রকমের আলাস্কান প্রাণীরা এবং যেকোন কিছু ঘটতে পারে, যে কোন একটা উদ্ভূত উদ্ভট ঘটনায় চার্লি আক্রমণের শিকার হতে পারে আর তাতে তার অযৌক্তিক, অনুনকরণীয় প্রতিক্রিয়াকে সামনে নিয়ে আসতে পারে।

দি গোল্ড রাশ সিনেমাটা এই ধরনের সব কিছুতে পরিপূর্ণ এবং মজার অনেক দৃশ্যসহ, অন্যান্য কিছু ছাড়াও এই সিনেমাটা আমাদেরকে লোকটার [চ্যাপলিন] দিকে আরেকবার ভালোভাবে দেখার সুযোগ করে দেয়।

আপনি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে এমন সব অদ্ভূত ব্যাপারস্যাপার দেখেন যেগুলো তাঁর মেধার ফলাফল, যেটাকে আপনি ঠিক ব্যাখ্যা করে উঠতে পারবেন না। তার হাঁটার সময়, যখন সে হেলেদুলে, একটার পর একটা পা ফেলে, যে হাস্যরসের সৃষ্টি করে; আক্রমনকারীকে যেভাবে গোপনে গিয়ে একটা লাথি মেরে দিয়ে আসে; অথবা দ্রুত, সম্ভাব্য মুখভঙ্গিগুলো, যেটা সব থেকে বেশি সচল, নিয়ত পরিবর্তনশীল সেটা প্রায়ই একটা অসম্ভব অলৌকিক অনুভূতি তৈরি করে। তার মূকাভিনয়ের এই অসম্ভব দক্ষতা এবং তিনি কি দেখাতে চান তার যথাযথ জ্ঞান এবং মানবিকভাবে কি আসলে মানুষের মনকে ছুঁয়ে যেতে পারে, সে একটা চরিত্র তৈরি করে, তারপর সেটাকে অবস্থার [ঘটনা বা পরিবেশ] মধ্যে ফেলে এবং  সব মিলিয়ে একটা সম্পূর্ণ খণ্ড হিসাবে এটা তৈরি হয়ে আসে।

 ছবি © চ্যাপলিন ফর দ্য এইজ

ঘটনাগুলো কোনো না কোনো একটা উদ্ভট ব্যাপার দিয়ে শুরু হয়: ড্যান্সারের পা হিসাবে দেখানো খাবারের দুটি রোল; একটা ঘর যার একপ্রান্ত খোলা, আরেকপ্রান্ত বন্ধ, একটা খাবার যা জুতা দিয়ে তৈরি। কিন্তু চ্যাপলিনের মূকাভিনয় এই অর্থহীনতাকে [এবসার্ডিটি] মানবিক অনুভূতির মাধ্যমে বিশেষ কিছুতে পরিবর্তিত করে দেয়খাবা্রের রোল একজন নাচের শিল্পীর ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়। বাড়িটা তার সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে হয়ে উঠে বাস্তবতার সরব প্রতিচ্ছবি এবং জুতাটা, যেটাকে রান্না করা হয়, তার পরিণতি হয় অবিশ্বাস্য! একটা আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন, অবাস্তব অবস্থাকে, বাস্তব এবং ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে চিত্রিত করা হলো; যেখানে আপনি সেই অনুভূতিটাকেই বোধ করবেন যেটা চ্যাপলিন আপনাকে অনুভব করাতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু আবার একইভাবে, জুতার ফিতাগুলো কিন্তু স্পেগেটি নয় [নুডুলসের মতো খাবার] আর সেজন্যই আপনি হাসতে থাকেন। এটি হলো দুটি আলাদা নাটকের অন্তর্নিহিত বুনন, যেটা চ্যাপলিনের জোরালো প্রতিভাকে একটা শক্তিশালী দৃশ্যের মাধ্যমে, এক জায়গাতে নিয়ে আসে।

একটা মাত্র জিনিস, যেটা আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না সেটা হলো, গোল্ড রাশ-এর সেই বিশ দশকের ভার্সনের জায়গাতে এখন একটা মিউজিক্যাল স্কোর যোগ হয়েছে আর আগের পুরনো সাবটাইটেলের জায়গাতে চ্যপলিনের নিজের মুখে বলা একটা ন্যারেশন [বর্ণনা] যুক্ত হয়েছে। চলচ্চিত্রের দৃশ্যের সাথে, চ্যাপলিনের কথা বলাটা এতে আরো চ্যাপলিনের স্পিরিটকে যোগ করেছে এবং তাকে আরো অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে।

কবরের পাশে আবার তাঁর উদ্ভট রসিকতা দ্বিগুণ হয়ে যায়, যখন বাতাস এসে চার্লির কেবিনকে [ঘর] বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে তখন, ভীষণ হতাশ, বিগ জিম, তার মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকে। ভয়েস ওভারে, তখন আরো গভীর চিন্তাগ্রস্ত আর হিস্টেরিয়ায় চিতকার করে বলে, ভাগ্যসবসময় এই ভাগ্যই সব! অথবা চার্লি হিসাবে যে কিনা পরমানন্দে রান্নার পাত্রে জুতা রান্না করছিল আর বিগ জিম তাকে পাত্তা দিচ্ছিলো না তখনো, বিগ জিমের দিকে ঘুরে যখন সে খুশিমনে জোরালোভাবে কথা বললো, তখন তার কথা মূকাভিনয়ের গূঢ় আত্মাকে প্রতিধ্বনিত করলো, আর দুইটা মিনিট সময় দাও!

এসব কিছুর পাশাপাশি, চ্যাপলিন এমন একটা শিল্পকুশলতা, কারিগরি দক্ষতা চলচ্চিত্রে নিয়ে আসলেন, যেটা সম্ভবত [কারো পক্ষে] কখনোই অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। চলচ্চিত্রের প্রতিটা বিষয়ের, প্রতিটা দিকের উপরই তাঁর দখল ছিল এবং এগুলোর সবকিছু নিজেই করার মাধ্যমে তিনি অভিনয়, পরিচালনা এবং ক্যামেরার কাজকে একটা সম্মিলিত প্রয়াস হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন যেটা মহৎ শিল্পের জন্য ভীষণ জরুরি।

এই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের গুণাবলী পুনরায় স্টারজেস আর ওয়েলেসের [দুইজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা] মতো লোকদের দ্বারা [নতুন করে] আবিষ্কৃত হচ্ছে। বিশ বছর আগে [লেখাটি ১৯৪২ সালে লেখা হয়েছিল], দি গোল্ড রাশ, এ যে ধরনের ফটোগ্রাফি ব্যবহার করা হয়েছে তার একটা ন্যাচারাল, স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়ে যাওয়া; চোখের জন্য সহজ, স্বাভাবিক এবং সংবেদনশীল একটা ব্যাপার আছে, যা আজকের দিনের  প্রবলভাবে জাহির করা নৈপুন্যের চতুরতা থেকে আলাদা।

একটা দৃশ্য যেখানে বিগ জিমকে দেখানো হয়। সে দিনের পর দিন না খেয়ে আছে আর চার্লিকে ক্ষুধার তাড়নায় একটা হৃষ্টপুষ্ট, মোটা মুরগী হিসাবে দেখছে, যেটা আজও ক্যামেরার কারসাজির একটা  দারুণ কাজ,একটা  বিরল দৃশ্য [দুর্লভ  ব্যাপার], যেখানে সরাসরি সোজাসাপ্টাভাবে ফ্যান্টাসির মাধ্যমে দৃশ্যে আসল কথাটা বলে দেয়া হয়েছে। 

তাই চলে যান [সিনেমা হলে] এবং ভুলে যান সেই সমস্ত মাথাব্যথা যেগুলো হলিউড ইদানীং আপনাকে [অনবরত] দিয়ে যাচ্ছে।

৪ মে ১৯৪২

নোট

ফারবার অন ফিল্ম, দি কমপ্লিট ফিল্ম রাইটিংস অফ ম্যানি ফারবার, সম্পাদনা রবার্ট পলিটো, লাইব্রেরি অব আমেরিকার একটি বিশেষ প্রকাশনা, ২০০৯ সালে প্রকাশিত। ছবির জন্য অফ স্ক্রিন ও চ্যাপলিন ফর দ্য এইজের কাছে কৃতজ্ঞ।